১১শ অধ্যায়
পাণ্ডবহস্তে অশ্বত্থামার পরাজয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার পরিজনগণ এক ক্রোশ মাত্র গমন করিলে মহারথ কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মা তাঁহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ বীরত্রয় জ্ঞানচক্ষু মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে রোরুদ্যমান নিরীক্ষণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বাম্পগদগদস্বরে কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পুত্র অতিদুষ্কর কাৰ্য্যসাধন করিয়া অনুচরগণের সহিত ইন্দ্রলোকে গমন করিয়াছেন। আমাদের অন্যান্য সমুদয় সৈন্যই বিনষ্ট হইয়াছে, এক্ষণে কেবল আমরা তিনজন অবশিষ্ট আছি।”
অনন্তর মহাবীর কৃপাচার্য্য পুত্রশোকার্ত্তা গান্ধারীকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “রাজ্ঞি! তোমার পুত্রগণ যখন নির্ভীকচিত্তে বীরজনোচিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া শত্রুগণকে বিনাশ করিতে করিতে নিহত হইয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তাহারা তেজঃপুঞ্জকলেবর ধারণ করিয়া অমরগণের ন্যায় সুনির্ম্মল দিব্যলোকে পরিভ্রমণ করিতেছে। আমাদের পক্ষীয় বীরগণের মধ্যে কেহই সমরে পরাজুখ বা শত্রুগণের শরণাপন্ন হইয়া নিহত হয় নাই। প্রাচীন মহাত্মারা ক্ষত্রিয়গণের সমরমৃত্যুই উৎকৃষ্ট গতিলাভের কারণ নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। অতএব তাহাদের নিমিত্ত শোক করা কর্ত্তব্য নহে। আপনার পুত্রগণের অরাতি পাণ্ডবগণও সহজে নিষ্কৃতি লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও আমি, আমরা তিনজন, দুরাত্মা ভীমসেন অধর্ম্মানুসারে দুৰ্য্যোধনকে নিহত করিয়াছে শ্রবণ করিবামাত্র সেই রজনীতে শিবিরমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক নিদ্রাভিভূত পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ করিয়াছি। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি পাঞ্চালগণ ও দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র আমাদের হস্তে নিহত হইয়াছে। আমরা এইরূপে তোমার পুত্রের শত্রুগণকে বিনাশপূর্ব্বক পরিশেষে মহাধনুর্দ্ধর পাণ্ডবগণ রোষভরে নিশ্চয়ই বৈরনির্য্যাতনার্থ সমাগত হইবে বিবেচনা করিয়া প্রাণভয়ে পলায়ন করিতেছি। পুরুষপ্রধান পাণ্ডবগণ পুত্রদিগের নিধনবার্ত্তাশ্রবণে উন্মত্তপ্রায় হইয়া আমাদিগকে সংহার করিবার চেষ্টা করিতেছে। অতঃপর আর এ স্থানে অবস্থান করিতে সাহস হইতেছে না। এক্ষণে আপনি শোকসংবরণ করিয়া আমাদিগকে প্রস্থানে অনুমতি প্রদান করুন। মহারাজও আমাদিগকে গমনে অনুমতি প্রদানপূর্ব্বক ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া ক্ষত্রিয়ধর্ম্মের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুন।”
হে জনমেজয়! অনন্তর মহাবীর কৃপাচার্য্য, কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামা রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে প্রদক্ষিণপূর্ব্বক বারংবার নিরীক্ষণ করিতে করিতে ভাগীরথীর অভিমুখে রথসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কিয়দ্দূর অতিক্রম করিয়া পরস্পর পরস্পরকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক উদ্বিগ্নচিত্তে তিনজনে তিন দিকে ধাবমান হইলেন। মহাবীর কৃপাচার্য্য হস্তিনাপুরে, কৃতবর্ম্মা স্বীয় রাজধানীতে এবং দ্রোণতনয় অশ্বত্থামা ব্যাসাশ্রমের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীরত্রয় সূর্য্যোদয়ের পূর্বে ধৃতরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক স্ব স্ব ইচ্ছানুসারে পৃথক পৃথক স্থানে গমনে প্রবৃত্ত হইলেই মহারথ পাণ্ডবগণ পথিমধ্যে অশ্বত্থামাকে আক্ৰমণ করিয়া বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক পরাজিত করেন।