বৃহস্পতি-প্রত্যাখ্যাত মরুত্তের নারদ-সাক্ষাৎকার
ব্যাস কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! অতঃপর বৃহস্পতি-মরুত্ত সংবাদ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সুরাচাৰ্য্য বৃহস্পতি ইন্দ্রের নিকট ‘মনুষ্যের যাজ্যক্ৰিয়া করিব না’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলে, নরপতি মরুত্ত সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অচিরাৎ বৃহত্তর যজ্ঞের আয়োজনপূৰ্ব্বক বৃহস্পতির সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! পূর্ব্বে আমি আপনার বাক্যানুসারে যজ্ঞানুষ্ঠান করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলাম। এক্ষণে সেই পূৰ্ব্বসঙ্কল্পিত যজ্ঞ আরম্ভ করিতে উৎসুক হইয়া উপকরণসমুদয় আহরণ করিয়াছি, অতএব আপনি আগমনপূর্ব্বক আমার যজ্ঞ সমাধান করুন।’
“তখন বৃহস্পতি কহিলেন, ‘বৎস! আমি দেবরাজ ইন্দ্রের পৌরোহিত্যে বৃত ও তাঁহার নিকট মনুষ্যের যাজ্যক্ৰিয়া করিব না বলিয়া প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ হইয়াছি, অতএব আমি তোমার যাজনকার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারিব না।’
“মরুত্ত কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি আপনার পৈত্রিক যজমান, আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাকি; অতএব আপনাকে অবশ্যই আমার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিতে হইবে।’
“বৃহস্পতি কহিলেন, ‘রাজন। আমি দেবতাদিগের পুরোহিত হইয়া কিরূপে মনুষ্যের পৌরোহিত্য করিব? অতএব তুমি এ স্থান হইতে প্রস্থান কর, আমি কখনও তোমার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিব না; অতঃপর তোমার যাহাকে অভিলাষ, যজ্ঞে বরণ কর।’
বৃহস্পতি এইরূপে প্রত্যাখ্যান করিলে নরপতি মরুত্ত একান্ত লজ্জিত হইয়া তথা হইতে গৃহাভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন। আগমনকালে পথিমধ্যে দেবর্ষি নারদের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার হইল; তখন তিনি বিধিপূৰ্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া তাঁহার সমীপে কৃতাঞ্জলিপুটে বিষণ্নভাবে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। দেবর্ষি নারদ তাঁহাকে নিতান্ত বিষণ্ন দেখিয়া সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন! আজ তোমাকে এরূপ দুঃখিত দেখিতেছি কেন? কোন অমঙ্গল ত হয় নাই? তুমি কোন স্থানে গমন করিয়াছিলে এবং তোমার অপ্রসন্নতারই বা কারণ কি? যদি বক্তব্য থাকে, আমার নিকট ব্যক্ত কর। আমি সাধ্যানুসারে তোমার দুঃখাপনোদন করিব।’
দেবর্ষি নারদ, এইরূপ কহিলে নরপতি মরুত্ত তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দেবর্ষে! আমি যজ্ঞের সমুদয় উপকরণ আহরণ করিয়া বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যে বরণ করিবার মানলৈ তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিলাম; তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান। করিয়াছেন। অতএব আর আমার জীবন ধারণ করিতে বাসনা নাই। যখন গুরু আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন নিশ্চয়ই আমি দুষিত হইয়াছি।
নরপতি মরুত্ত এইরূপ দুঃখপ্রকাশ করিলে, দেবর্ষি নারদ তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন! অঙ্গিরার কনিষ্ঠপুত্র পরমধার্ম্মিক সংবর্ত্ত দিগম্বরবেশে মানবদিগের বিস্ময়োৎপাদন পূৰ্ব্বক চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতেছেন। তুমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে প্রসন্ন কর, তাহা হইলে তিনিই তোমার যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করিবেন।’
তখন নরপতি মরুত্ত নারদকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবর্ষে! আপনি আমাকে এই উপদেশ প্রদান করিয়া প্রাণদান করিলেন। এক্ষণে সংবর্ত্ত কোন স্থানে অবস্থান করিতেছেন, কিরূপে আমি তাঁহার দর্শনলাভে সমর্থ হইব এবং তাঁহার নিকট কিরূপ ব্যবহার করিলে তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিবেন না, আপনি তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন। তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলে আমি কদাচ জীবনধারণ করিব না।’
মরুত্তের সংবর্ত্ত সাক্ষাৎকার—পৌরোহিত্য প্রার্থনা
“তখন দেবর্ষি নারদ কহিলেন, ‘মহারাজ! এক্ষণে মহাত্মা সংবর্ত্ত উন্মতের ন্যায় বেশ ধারণ করিয়া বিশ্বেশ্বরের দর্শনবাসনায় বারাণসীতে পরিভ্রমণ করিতেছেন। তুমি তথায় গমন করিয়া বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের দ্বারদেশে এক মৃতদেহ সংস্থাপন কর। যিনি প্রাতঃকালে বিশ্বেশ্বরের দর্শনার্থ তথায় আগমন করিয়া সেই মৃতদেহ দর্শন করিবামাত্র প্রতিনিবৃত্ত হইবেন, তিনিই সংবৰ্ত্ত। ঐ মহাত্মা শবদর্শনানন্তর যে দিকে গমন করুন না কেন, তুমি তাঁহার অনুগমন করিবে। পরে কোন নির্জ্জনস্থানে উপস্থিত হইলে তুমি তাঁহার সম্মুখীন হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার শরণাপন্ন হইবে। যদি তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কাহার নিকট আমার বিষয় অবগত হইলে? তাহা হইলে তুমি কহিবে, আমি নারদের নিকট আপনার বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি। তুমি ঐ কথা কহিলে যদি তিনি আমার নিকট আগমন করিবার মানসে আমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহা হইলে তুমি নির্ভীকচিত্তে কহিও, নারদ অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন।
দেবর্ষি নারদ এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে নরপতি মরুত্ত তাঁহার বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক বারাণসীতে গমন করিয়া বিশ্বেশ্বরের পুরীর দ্বারদেশে এক মৃতদেহ স্থাপিত করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহর্ষি সংবৰ্ত্ত ঐ পুরীর দ্বারদেশে প্রবেশ করিয়া শবদর্শন করিবামাত্র তথা হইতে নিবৃত্ত হইলেন। তখন মহারাজ মরুত্ত তাঁহাকে পৌরোহিত্যে স্বীকার করাইবার নিমিত্ত কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহর্ষি সংবর্ত্ত নির্জ্জনস্থানে মহারাজ মরুত্তকে সম্মুখীন অবলোকন করিয়া তাঁহার গাত্রে পাংশু [ধূলা], কর্দ্দম [কাদা], শ্লেষ্ম [কফ] ও নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কিন্তু মরুত্ত তাহাতে নিবৃত্ত না হইয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে মহর্ষি সংবৰ্ত্ত সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়া এক বহুশাখাসমাকীর্ণ অশ্বথবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় সমাসীন হইলেন; মহারাজ মরুত্তও কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার সমীপে দণ্ডায়মান রহিলেন।