মরুরাজের যজ্ঞবৃত্তান্ত—বংশানুকীৰ্ত্তন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! মহাত্মা মরুত্ত কোন্ সময়ে পৃথিবীর অধীশ্বর ছিলেন এবং কিরূপেই বা তাহার তাদৃশ সুবৰ্ণরাশি সঞ্চিত হইয়াছিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”
বেদব্যাস কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে করন্ধমবংশসম্ভূত মহাত্মা মরুত্তের বিষয়ে তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“সত্যযুগে প্রথমতঃ বৈবস্বত মনু রাজা হইয়া রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। তাহা হইতে মহারাজ প্রসন্ধির উৎপত্তি হয়। প্রসন্ধির ঔরসে মহাত্মা ক্ষুপ ও ক্ষুপের ঔরসে ইক্ষ্বাকু জন্মগ্রহণ করেন। মহারাজ ইক্ষ্বাকুর একশত ধার্ম্মিক পুত্র জন্মিয়াছিলেন। ইক্ষ্বাকু তাঁহাদের সকলকেই রাজপদে অভিষিক্ত করেন। উঁহাদের সৰ্ব্বজেষ্ঠের নাম বিংশ; ধনুর্ব্বিদ্যায় উহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। উনি বিবিংশনামে এক পুত্ৰ উৎপাদন করেন। মহাত্মা বিবিংশের ঔরসে পঞ্চদশ পুত্র সমুৎপন্ন হইয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই ধনুর্ব্বিদ্যাবিশারদ, সত্যবাদী, দানধৰ্ম্মনিরত ও পরাক্রমশালী ছিলেন। তাঁহাদিগের জ্যেষ্ঠভ্রাতা খলীনেত্র সমুদয় ভ্রাতাকে নিপীড়িত করিয়া বাহুবলে সমুদয় রাজ্য পরাজয়পূৰ্ব্বক পৃথিবীতে একাধিপত্য সংস্থাপন করেন।
“খলীনেত্র এইরূপ অসাধারণ প্রভাবশালী ছিলেন, তথাপি প্রজাগণ তাঁহার প্রতি অনুরক্ত না হইয়া, তাঁহাকে রাজচ্যুত করিয়া তাঁহার পুত্র সুবৰ্চ্চাকে রাজ্য প্রদান করিয়াছিল। মহাত্মা সুবৰ্চ্চাও পিতাকে রাজ্যচ্যুত দেখিয়া শঙ্কিতচিত্তে যথোচিত যত্নসহকারে প্রতিনিয়ত প্রজাগণের হিতসাধনে তৎপর হইয়াছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণপ্রিয়, সত্যবাদী, পবিত্র ও শমদমাদি গুণসম্পন্ন ছিলেন বলিয়া সমুদয় প্ৰজাই তাঁহার প্রতি একান্ত অনুরক্ত হইয়াছিল। তিনি এইরূপ ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিলেও কিয়দ্দিন পরে তাঁহার কোষ ও বাহনসমুদয় বিনষ্ট হইল। ঐ সুযোগে অধীনস্থ ভূপালগণ চতুর্দ্দিক্ হইতে সমাগত হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ ও পীড়ন করিতে লাগিলেন। মহারাজ সুবৰ্চ্চা ঐ সময় ভৃত্য ও পুরবাসিগণের সহিত যারপরনাই বিপদগ্রস্ত হইলেন। শত্রুগণ কেবল তাঁহার ধার্ম্মিকতানিবন্ধন তাঁহার প্রাণসংহার করিতে সমর্থ হইল না। পরিশেষে তিনি যদৃচ্ছাক্রমে করদ্বয় সংপুটিত [অঞ্জলি বন্ধনাকারে মিলিত] করিয়া তাহাতে মুখমারুত [মুখবায়ু] সংযোগ করিবামাত্র তাঁহার অলৌকিক পরাক্রম প্রাদুর্ভূত হইল। তখন তিনি অনায়াসে সমুদয় বিপক্ষ ভূপতিকে পরাজিত করিলেন। এই নিমিত্ত অদ্যাপি সেই মহাত্মা সুবৰ্চ্চার নাম করন্ধম বলিয়া বিখ্যাত রহিয়াছে।
“ঐ মহাত্মা ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে অবিক্ষিৎনামে এক ইন্দ্রতুল্য রূপবলসম্পন্ন দুর্জ্জয় পুত্র উৎপাদন করেন। ঐ অবিক্ষিৎ রাজ্যে অভিষিক্ত হইলে সমুদয় প্রজাই তাঁহার বশীভূত হইয়াছিল। তিনি ধর্ম্মপরায়ণ, যজ্ঞশীল, ধৈর্য্যশীল, সংযতেন্দ্রিয়, শমদমাদিগুণ সম্পন্ন, সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী, পৃথিবীর ন্যায় ক্ষমাশীল, বৃহস্পতির ন্যায় বুদ্ধিমান ও হিমালয়ের ন্যায় স্থিরপ্রকৃতি ছিলেন। তিনি কায়মনোবাক্যে প্রজাগণের প্রীতিবর্দ্ধনপূর্ব্বক যথাবিধানে শত অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। মহাত্মা অঙ্গিরা স্বয়ং তাঁহার যজ্ঞে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। ঐ মহাত্মাই অযুত-নাগের তুল্য পরাক্রমশালী, মূৰ্ত্তিমান্ বিষ্ণুস্বরূপ মহারাজ মরুত্তকে উৎপাদন করেন। মহাত্মা মরুত্ত যজ্ঞাভিলাষী হইয়া হিমালয়ের উত্তর পার্শ্ববর্ত্তী সুমেরুপৰ্ব্বতে গমনপূর্ব্বক অসংখ্য সুবর্ণময় পাত্র প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। সুমেরুর অনতিদূরবর্ত্তী এক সুবর্ণময় পৰ্ব্বতের নিকটেই তাঁহার যজ্ঞভূমি নির্ম্মিত হয়। ঐ স্থানে স্বর্ণকারগণ নৃপতির আজ্ঞানুসারে অসংখ্য সুবর্ণময় কুণ্ড, পাত্র, স্থালী [চরুপুরোভাশাদি পাকপাত্র] ও আসন প্রস্তুত করিয়াছিল। মহারাজ মরুত্ত সেই উৎকৃষ্টস্থানে নানাদিগদেশস্থ ভূপতিগণে পরিবেষ্টিত হইয়া বিধিপূৰ্ব্বক যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করিয়াছিলেন।”