৪৯তম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের বাক্যে সঞ্জয়ের সমর্থন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! আপনি দুৰ্য্যোধনের যে-সকল চরিত্র বর্ণন করিলেন, তাহার কিছুই অযথাভূত নহে, সকলই যথার্থ। মহাতেজঃ পাণ্ডবগণ ধর্ম্মপত্নী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে আনয়ন করিতে দেখিয়া অবধি রোষাবিষ্ট হইয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহারা দুঃশাসন ও কর্ণের নিদারুণ বাক্য শ্রবণ করিয়া সাতিশয় রোষপরবশ হইয়া সতত ভৎসনা করিতেছেন। হে মহারাজ! আমি শ্রবণ করিয়াছি যে, একাদশতনু [একাদশ রুদ্র] ভগবান ভবানীপতি ধনঞ্জয়কে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত স্বয়ং কৈরাতবেশ ধারণ করিয়া তাহার সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন; ধনঞ্জয় কামুকদ্বারা যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে পরম পরিতুষ্ট করিয়াছেন। অৰ্জ্জুন অস্ত্রলাভের নিমিত্ত তপঃপ্রভাবে এরূপ পরাক্রান্ত হইয়াছেন যে, লোকপালগণ তথায় আসিয়া তাহাকে দর্শন দিয়াছেন। পৃথিবীতে অর্জ্জুন ভিন্ন কেহই এই ঈশ্বরগণের সাক্ষাৎকার লাভ করিতে সমর্থ নহে। অষ্টমূর্ত্তি [ক্ষিতি, জল প্রভৃতি অষ্টমূর্ত্তি] মহেশ্বর যাঁহাকে ক্ষীণবল করিতে অক্ষম হইয়াছেন, কোন বীরপুরুষ সংগ্রামসাগরে তাঁহার বলক্ষয় করিতে ক্ষমতাপন্ন হইবে? দ্রুপদনন্দিনীর কেশাকর্ষণ করিয়া পাণ্ডবগণের রোষানল প্রজ্বলিত করাতেই এই লোমহর্ষণ তুমুল ব্যাপার সমুপস্থিত। দুৰ্য্যোধন দ্রৌপদীকে উরুদ্বয় প্রদর্শন করিলেন দেখিয়া ভীমসেন স্ফুরিতাধর হইয়া কহিয়াছিলেন, “আরো পাপাত্মা কপটদ্যূতকারিন্! ত্ৰয়োদশ বর্ষাবসানে আমি গদাঘাতে তোর উরুদ্বয় ভঙ্গ করিব।” হে রাজনী! পাণ্ডবগণ সকলেই যোদ্ধৃপ্রধান, অমিততেজঃ এবং দেবগণেরও দুর্জ্জয়। তাঁহারা প্ৰণয়িনীর ক্ৰোধে উত্তেজিত ও রোষানলসন্তপ্ত হইয়া আপনার পুত্ৰগণের জীবনান্ত করিবেন, সন্দেহ নাই।”
পাণ্ডবভয়ে ভীত ধৃতরাষ্ট্রের দুঃখ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “সূত! দ্রুপদনন্দিনীকে সভামধ্যে আনয়ন করাতেই এই অনর্থকর শক্ৰতা জন্মিয়াছে। কর্ণের পরুষবাক্যপ্রয়োগ করাতে কি এমন হইতে পারে? যাহাদের উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিনয়শূন্য, সেই মূঢ়মতি পুত্রেরা অদ্যাপি কি নিমিত্ত জীবিত রহিয়াছে, বলিতে পারি না। আমাকে নয়নধনে বঞ্চিত ও চেষ্টারহিত দেখিয়া দুরাচার পুত্র কোনমতেই আমার উপদেশবাক্য শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করে না। মন্দমতি বিচেতন কর্ণ ও সৌবল প্রভৃতি মন্ত্রিবর্গ কেবল দুৰ্য্যোধনের দোষেরই উন্নতি করিতেছেন। ক্ৰোধসহকারে শরজালবর্ষণ করা দূরে থাকুক, অমিততেজাঃ ধনঞ্জয় যদৃচ্ছাক্রমে একবার শরবিক্ষেপ করিলেই আমার পুত্ৰগণ দগ্ধ হইয়া যাইবে। কেন না, সেই বাণ অর্জ্জুনকর্ত্তৃক দিব্যমন্ত্রে শোধিত হইয়া মহাধনু হইতে বাহুবল সহকারে বিক্ষিপ্ত হইলে অমরগণকেও অবসন্ন করে। ত্ৰৈলোক্যনাথ বাসুদেব যাহার মন্ত্রী, রক্ষক ও সুহৃদ, এই জগতীতলে তাহার অজেয় কি আছে? হে সঞ্জয়! ইহা অতি আশ্চৰ্য্য যে, ধনঞ্জয় মহাদেবের সহিত বাহুযুদ্ধ করিয়াছে এবং পূর্ব্বে দামোদর ও ফাল্গুনি বহ্নিকে সহায় করিবার নিমিত্ত খাণ্ডবারণ্যে যাহা করিয়াছিল, তাহাও সকলে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। অতএব ভীম, ধনঞ্জয় বা বাসুদেব রণে রোষাবিষ্ট হইলে আমার পুত্ৰগণ, অমাত্যবর্গ ও শকুনির সহিত একত্র মিলিত হইয়াও জয়লাভ করিতে সমর্থ হইবে না।”