৪২তম অধ্যায়
জয়দ্রথকর্ত্তৃক চক্রব্যূহ রক্ষা
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! পরম-সুখোচিত, বাহুবলদপিত সমর কুশল বালক অর্জ্জুনতনয় ত্রিহায়ণ উৎকৃষ্ট অশ্ব-যোজিত রথে আরোহণ করিয়া প্রাণপণে সংগ্রাম করিবার বাসনায় সমর সাগরে অবগাহন করিলে পাণ্ডব সৈন্যগণের মধ্যে কোন্ কোন্ মহাবীর তাঁহার অনুগমন করিয়াছিলেন?
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন নকুল, সহদেব, মৎস্যদেশীয়গণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, কৈকয় ও ধৃষ্টকেতু প্রভৃতি অভিমন্যুর আত্মীয়গণ তাঁহাকে রক্ষা করিবার মানসে তাঁহার অনুসরণ ক্ৰমে সমরে ধাবমান হইলেন। কৌরব সৈন্যগণ পাণ্ডবপক্ষ বীরগণকে সমরে ধাবমান অবলোকন করিয়া রণে পরাঙ্মুখ হইল। তখন আপনার জামাতা উগ্ৰধন্বা মহাতেজস্বী সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কৌরব সৈন্যগণকে স্থির করিবার মানসে দিব্যাস্ত্র সমুদায় প্রয়োগ পূর্ব্বক পুত্রবৎসল পাণ্ডবগণকে সসৈন্যে নিবারণ করিয়া মত্ত-মাতঙ্গের ন্যায় সমর স্থলে বিচরণ করিতে লাগিলেন।
জয়দ্রথের শিববরপ্রাপ্তি প্রসঙ্গ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! মহাবাহু জয়দ্রথ একাকী পুৱক্ষাভিলাষী, অতিক্রুদ্ধ পাণ্ডবগণকে নিবারণ করিয়া সমরে অতিভার বহন করিয়াছেন; আমি জয়দ্রথের বলবীৰ্য্য অদ্ভূত জ্ঞান করিতেছি তুমি সবিস্তরে তাঁহার সমর-বৃত্তান্ত বর্ণন কর। মহাবীর সিন্ধুরাজ এমন কি দান, হোম, যজ্ঞ বা তপস্যা করিয়াছিলেন যে, একাকী রোষপরবশ পাণ্ডবগণকে নিবারণ করিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ যৎকালে দ্রৌপদীকে হরণ করিয়াছিলেন, সেই সময় মহাবীর ভীমসেন তাঁহাকে পরাজয় করেন; মহাবীর জয়দ্রথ সেই অভিমানে নিতান্ত দুঃখিতমনে প্রিয় ভোগ্য বস্তু হইতে ইন্দ্রিয়গণকে নিবৃত্ত এবং ক্ষুৎ-পিপাসা ও আতপ-ক্লেশ সহ্য করিয়া নিতান্ত কৃশ ও শিরাব্যাপ্ত কলেবর হইয়া তপোনুষ্ঠান এবং বেদোচ্চারণপূর্ব্বক বর লাভার্থ দেবাধিদেব মহাদেবের আরাধনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর ভক্তবৎসল ভগবান্ ভূতনাথ জয়দ্রথের প্রতি দয়া করিয়া তাঁহাকে স্বপ্নাবস্থায় কহিতে লাগিলেন, হে জয়দ্রথ! আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছি; স্বাভিলষিত বর প্রার্থনা কর। তখন সিন্ধুরাজ প্রণিপাত পূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, হে দেবদেব! আমি যেন আপনার বর প্রভাবে একাকী রথারূঢ় হইয়া মহাবল পরাক্রান্ত পঞ্চ পাণ্ডবকে নিবারিত করিতে পারি। প্রমথনাথ কহিলেন, হে সিন্ধু রাজ! আমি বর প্রদান করিতেছি, তুমি অর্জ্জুন ব্যতীত আর চারিজন পাণ্ডবকে নিবারণ করিতে পারিবে। জয়দ্রথ মহাদেবের বাক্য শ্রবণে তথাস্তু বলিয়া স্বীকার করিয়া জাগরিত হইলেন।
হে মহারাজ! মহাবীর সিন্ধুরাজ মহাদেবের সেই বরপ্রভাবে ও দিব্যাস্ত্রবলে একাকী পাণ্ডবসৈন্যগণকে নিবারিত করিলেন। তাঁহার জ্যানির্ঘোষ ও তলধ্বনি-শ্রবণে শত্রুপক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ ভীত এবং কৌরব-সৈন্যগণ আহ্লাদিত হইলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ জয়দ্রথের উপর সমরের সমুদয় ভার সমর্পিত দেখিয়া সাহসপূর্ব্বক শরাসন আকর্ষণ করিয়া যুধিষ্ঠিরের সৈন্যাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।”