৩য় অধ্যায়
নকুল-সহদেব-দ্ৰৌপদীর গুপ্তবেশধারণ বিনিশ্চয়
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে নকুল! তুমি সুখ-সম্ভোগসমুচিত, সুকুমার শূর ও প্রিয়দর্শন। এক্ষণে সেই বিরাটরাজের রাজ্যে কি কর্ম্ম করিবে, তাহা কীর্ত্তন কর।” নকুল কহিলেন, “মহারাজ! আমি অশ্ববিজ্ঞান ও অশ্বরক্ষণে সুনিপুণ এবং অশ্বশিক্ষা ও অশ্বচিকিৎসায় সম্পূর্ণ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছি। এক্ষণে গ্ৰন্থিক নামে আপনার পরিচয় প্রদানপূর্ব্বক বিরাটরাজের অশ্বাধিকারে নিযুক্ত হইব। এই কাৰ্য্য আমার একান্ত প্রিয়তর। হে রাজন! আপনার ন্যায় আমিও অশ্বগণকে নিতান্ত প্ৰিয়বোধ করিয়া থাকি। হে মহারাজ! বিরাটনগরেনিবাসী কোনো ব্যক্তি আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে কহিব, আমি পূর্ব্বে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অশ্বাধিকারে নিযুক্ত ছিলাম। হে রাজন! আমি এইরূপে প্রচ্ছন্নবেশে বিরাটনগরে বাস করিতে বাসনা করিয়াছি।”
তখন যুধিষ্ঠির সহদেবকে কহিলেন, “সহদেব! তুমি বিরাটরাজ-সন্নিধানে কি প্রকারে পরিচিত হইবে এবং কিরূপ কাৰ্য্যানুষ্ঠান দ্বারা প্রচ্ছন্নবেশে কালাতিপাত করিবে?”
সহদেব কহিলেন, “আমি গোসমূহের প্রতিষেধ [বশে রাখা], দোহন ও সংখ্যান [গণনা-পরীক্ষাদি] বিষয়ে সম্যক পারদর্শী। বিরাটরাজসমীপে তন্ত্রীপাল নামে আপনার পরিচয় প্রদানপূর্ব্বক তাঁহার গোসংখ্যান-কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইব। আমি কৌশলে বিরাটরাজ্যে কালাতিপাত করিব। আপনি আমার নিমিত্ত কিছুমাত্র দুঃখিত হইবেন না। পূর্ব্বে আপনি নিরন্তর আমাকে গোচর্য্যায় নিয়োগ করিতেন, তন্নিবন্ধন তদ্বিষয়ে আমি অশেষবিধ কৌশল বিশেষরূপে জ্ঞাত আছি। গো-লক্ষণ, গো-চরিত এবং তাহাদের শুভ ও অশুভ সমুদয়ই আমার বিদিত আছে। যাহাদিগের মূত্র আঘ্রাণ করিয়া বন্ধ্যা নারী পুত্ৰবতী হয়, আমি এইরূপ শুভলক্ষণ-সম্পন্ন বৃষভ-সকলকে জ্ঞাত আছি। হে মহারাজ! গোচৰ্য্যায় আমার সবিশেষ প্রীতি আছে, অতএব আমি এই কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইবার ইচ্ছা করিয়াছি। হে রাজন! আমি এইরূপে অজ্ঞাতবেশে বিরাটরাজের তুষ্টিসাধন করিব।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সহদেব! আমাদিগের প্রাণপ্রিয়া ভাৰ্য্যা দ্ৰৌপদী জননীর ন্যায় পালনীয়া ও জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় পূজনীয়া। ইনি কিরূপ কাৰ্য্য অবলম্বনপূর্ব্বক তথায় কালাতিপাত করিবেন? এই পতিপরায়ণা সুকুমারী রাজকুমারী যাজ্ঞসেনী অন্যান্য নারীর ন্যায় কোনো প্রকার কাৰ্য্যসাধনে সমর্থ নহেন। ইনি আজন্মকাল কেবল মাল্য, গন্ধ, অলঙ্কার ও বিবিধ বস্ত্রের বিষয়ই সম্যক জ্ঞাত আছেন।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “মহারাজ! লোকে শিল্পকর্ম্মসম্পাদনাৰ্থে কিঙ্করী নিযুক্ত করিয়া থাকে। সৎকুলসম্ভূত রমণীরা কদাচ তৎকাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন না বলিয়া লোকের বিশ্বাস আছে; অতএব আমি কেশসংস্কারকুশল সৈরিন্ধ্রী বলিয়া তথায় আপনার পরিচয় প্রদান করিব এবং রাজা জিজ্ঞাসা করিলে কহিব, পূর্ব্বে আমি কুরুরাজ যুধিষ্ঠিরের আলয়ে দ্রৌপদীর পরিচারিকা ছিলাম। হে রাজন! আমি এইরূপে আত্মগোপনপূর্ব্বক রাজমহিষী সুদেষ্ণার পরিচর্য্যা করিব। আমি উপস্থিত হইলে তিনি অবশ্যই আমাকে নিযুক্ত করিবেন। অতএব এক্ষণে আপনি আমার নিমিত্ত আর মনস্তাপ করিবেন না।”
তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণে! তুমি উত্তমই কহিয়াছ। অতি মহন্দ্ৰবংশে তোমার জন্ম হইয়াছে এবং তুমি সতত সদাচারেই নিরত থাক, কদাচ পাপাচারে প্রবৃত্ত হও না; অতএব দেখিও যেন বিপক্ষগণের দৃষ্টিপথে পতিত হইও না; যেন সেই পাপাচারপরায়ণ ধূৰ্ত্তেরা পুনরায় সুখী হয় না।”