২৫তম অধ্যায়
পাণ্ডবপ্রতি মার্কণ্ডেয়মুনির উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, সুখাসীন ইন্দ্ৰসম নরেন্দ্ৰপুত্ৰ পাণ্ডবগণ স্বাস্থদায়ক সরস্বতীতীরস্থ শালবনে অবস্থিতি করিয়া অতিকষ্টে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। মহানুভব যুধিষ্ঠির সেই কাননমধ্যে যতি, মুনি ও বরিষ্ঠ ব্ৰাহ্মণগণকে প্রভূততর ফলমূলদ্বারা পরিতৃপ্ত করিতেন ও সমৃদ্ধতেজাঃ ধৌম্যমহাশয় মহারণ্যবাসী পাণ্ডবগণের ইষ্টি, পৈত্র ও দৈবক্রিয়াসকল নির্ব্বাহ করাইতেন।
একদা অলোকসামান্য জ্বলিতহুতাশনসদৃশ প্রভাসম্পন্ন পুরাণ ঋষি মহাত্মা মার্কণ্ডেয় পাণ্ডব-সকাশে আগমন করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির সেই সুরঋষিমানবপূজিত মহামুনিকে পূজা করিলে তিনি তপস্বিসমাজমধ্যগত পাণ্ডবগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রামচন্দ্রকে স্মরণপূর্ব্বক হাস্য করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির বিমনা হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! আপনি কি জন্য তপস্বিগণ-সমক্ষে আমাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া হাস্য করিলেন? তপস্বিগণ আপনার হাস্য দেখিয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়াছেন।”
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “বৎস! আমি আহ্লাদিত হই নাই, হাস্যও করি নাই এবং হর্ষজনিত দৰ্পও আমাকে অভিভূত করে নাই, আদ্য তোমার এই আপদ অবলোকন করাতে সত্যব্রত দাশরথি আজ আমার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইলেন। তিনি ধনুৰ্দ্ধর, ইন্দ্রের সমান, শমনের নেতা, নমুচির হন্তা, মহাত্মা ও নিম্পাপ; পুরাকালে তাঁহাকেও পিতার আদেশক্রমে লক্ষ্মণ-সমভিব্যাহারে ঋষ্যমূকপর্ব্বতের কানানমধ্যে পৰ্য্যটন করিতে দেখিয়াছি। সেই মহানুভব রামচন্দ্র সমরে দুর্জ্জয় হইয়াও নানাবিধ ভোগসুখ পরিত্যাগপূর্ব্বক বনচারী হইয়াছিলেন। নাভাগ, ভগীরথ প্রভৃতি মহাত্মারা সসাগরা ধরিত্রীর একাধিপতি হইয়াও সত্য অবলম্বনপূর্ব্বক সমস্ত লোক জয় করিয়াছিলেন। সকলে যাঁহাকে অলর্ক বলিয়া নির্দেশ করিত, সেই কাশিকারূষরাজ সমস্ত রাজ্য ও ধন পরিত্যাগ করিয়া সত্যব্রত প্ৰতিপালন করিয়াছিলেন। বিধাতা যে নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন, সপ্তর্ষিমণ্ডল তাহার অনুবর্ত্তী হইয়া আকাশেই প্রকাশমান হইতেছেন। মহাবলপরাক্রান্ত পর্ব্বততুল্যকায় নাগসকল বিধাতার অনুশাসনেই চলিতেছে; সমস্ত ভূতগণ বিধিকৃত বিধানের অনুবর্ত্তী হইয়াই স্বকুলোচিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিতেছে। ইহারা কেহ কখন অধম আচরণ করেন নাই; অতএব সমর্থ হইয়াছি বলিয়া কদাচ অধর্ম্মাচরণ করিবে না। হে কৌন্তেয়! তুমি সত্য, ধর্ম্ম, সদ্বব্যহার ও লজ্জাদ্বারা সকল লোককে অতিক্রম করিয়াছ; তোমার তেজ ও যশঃ প্ৰচণ্ড দিনপতির ন্যায় প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে নিজ প্রতিজ্ঞানুসারে ক্লেশকর বনবাস হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পুনরায় পুরুষকারসহকারে কৌরবগণের দেদীপ্যমান রাজলক্ষ্মী গ্ৰহণ করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় তপস্বিগণ-সমক্ষে রাজা যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক সকলকে সম্ভাষণ করিয়া উত্তরদিকে প্রস্থান করিলেন।