২২তম অধ্যায়
সঞ্জয়-যুধিষ্ঠিরের কুশলপ্রশ্ন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর সঞ্জয় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে পাণ্ডবগণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত বিরাটরাজ্যে গমন করিলেন। তথায় উপনীত হইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদনপূর্ব্বক প্রীতমনে কহিলেন, “মহারাজ! ভাগ্যবলে আমি আপনাকে অরোগ ও সহায়সম্পন্ন দেখিতেছি। বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনার কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, এক্ষণে আপনি মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন, ধনঞ্জয় ও মাদ্রীতনয় নকুল-সহদেব ত’ কুশলে আছেন, এবং আপনি যাহা হইতে সকল মনোরথ সফল করিয়া থাকেন, সেই বীরসহধর্মিণী দ্রুপদনন্দিনী ও তাঁহার পুত্ৰগণের ত’ সর্ব্বাঙ্গীণ মঙ্গল?”
রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি ত’ নির্ব্বিঘ্নে আগমন করিয়াছ? তোমার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া আমরা পরম প্রীত হইলাম; আমি অনুজগণের সহিত কুশলে আছি। বহুকালের পর কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কুশলসমাচার অবগত হইলাম। এক্ষণে তোমাকে দর্শন করিয়া আহ্লাদবশতঃ বোধ হইতেছে যেন, তাঁহাকেও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিতেছি। সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞ মহাপ্ৰাজ্ঞ পিতামহ ভীষ্ম ত’ কুশলে আছেন? আমাদের উপর তাঁহার যে স্নেহ ও সদ্ভাব ছিল, তাহা ত’ বিলুপ্ত হয় নাই? মহারাজ বাহ্লীক, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা ও শল্য, ইহাদের ত’ মঙ্গল? আচাৰ্য্য দ্ৰোণ, অশ্বত্থামা ও কৃপ, ইহারা ত’ সুস্থশরীরে কালযাপন করিতেছেন? ইহারা ত’ কৌরবগণের প্রতি একান্ত অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া থাকেন এবং তাঁহাদিগের নিকট ত’ সমূচিত সমাদর প্রাপ্ত হইতেছেন? রাজকুমার যুযুৎসু ও অমাত্য কৰ্ণ, ইহারা ত’ কুশলে আছেন?
“ভারতজননী বৃদ্ধ রমণীসকল, মহানসে নিযুক্ত দাসভাৰ্য্যা, ব, পুত্ৰ, ভাগিনেয়, ভগিনী ও দৌহিত্ৰ সকলের ত” মঙ্গল?
সন্ধির আকর্ষণ আনয়নার্থ যুধিষ্ঠির-প্রশ্ন
“রাজা ধৃতরাষ্ট্র ব্রাহ্মণগণের নিকট হইতে মদত্ত গ্রামাদি ত’ প্রত্যাহরণ করেন নাই? তিনি ও তাঁহার পুত্ৰগণ ব্রাহ্মণদিগের অবমাননায় কি উপেক্ষা প্ৰদৰ্শন করিয়া থাকেন? তিনি স্বর্গের সোপানভূত মদত্ত বৃত্তিসমুদয় ত’ বিলুপ্ত করেন নাই? হে সঞ্জয়! বিধাতা বৃত্তির প্রতিপালন পরলোকে শুভকর ও ইহলোকে যশস্বর বলিয়া নিরূপণ করিয়াছেন। এক্ষণে তাঁহারা যদি লোভসংবরণ না করেন, তাহা হইলে সমস্ত কৌরবগণ বিনষ্ট হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার আত্মজগণ অমাত্যদিগকে ত’ যথোচিত বৃত্তি প্ৰদান করিয়া থাকেন? তাঁহার শত্ৰুগণ সুহৃদ্বর্গের ন্যায় ঐকমত্য [মতদ্বৈধাহীনতা—মতের ঐক্য] অবলম্বনপূর্ব্বক তাহাদিগের ত’ সুহৃদ্ভেদ [বন্ধুবিচ্ছেদ] উৎপাদনা করিতেছে না? কৌরবগণ ত’ তাঁহাদিগকে অসৎ পরামর্শ প্রদান করেন না? দ্রোণাচাৰ্য্য, অশ্বত্থামা ও কৃপ, ইহারা ত’ আমাদিগের অনিষ্টসাধনের নিমিত্ত কোন সঙ্কল্প করিতেছেন না? তাঁহারা ত’ সপুত্র ধৃতরাষ্ট্রকে সন্ধিস্থাপনাৰ্থ মন্ত্রণা প্ৰদান করেন? তাঁহারা যোদ্ধৃবর্গকে সমবেত দেখিয়া সংগ্রামনির্ব্বাহক অর্জ্জুনের কাৰ্য্যসমুদয় ও তাঁহার জলধরনির্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবধ্বনি ত’ স্মরণ করিয়া থাকেন?
“আমি মহাবীর অর্জ্জুন অপেক্ষা উৎকৃষ্ট যোদ্ধা আর দৃষ্টিগোচর করি নাই; তিনি একষষ্টি সুতীক্ষ পুঙ্খযুক্ত শর এককালে নিক্ষেপ করিতে পারেন। ভীমসেন গদা ধারণ করিয়া মহারণ্যে মদস্রাবী মত্তমাতঙ্গের ন্যায় সংগ্ৰামমধ্যে শত্রুগণকে ভীত ও কম্পিত করিয়া ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে থাকেন, ইহা কি তাঁহারা স্মরণ করিয়া থাকেন? মাদ্রীতনয় সহদেব বাম ও দক্ষিণ হস্তে অনবরত শরক্ষেপ করিয়া সমাগত কলিঙ্গদিগকে পরাজয় করিয়াছেন, ইহা কি তাঁহারা স্মরণ করিয়া থাকেন? পূর্ব্বে আমি তোমার সমক্ষে শিবি ও ত্ৰিগর্ত্তদিগকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত মহাবীর নকুলকে প্রেরণ করিলে তিনি সমস্ত পশ্চিমদিগ্নিভাগ বশীভূত করিয়াছিলেন, ইহা কি তাঁহারা স্মরণ করিয়া থাকেন? ঘোষযাত্ৰাপ্রস্থিত ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের দুর্ম্মন্ত্রণাবশতঃ দ্বৈতবনে যে পরাভব হইয়াছিল এবং ভীম ও অর্জ্জুন শত্ৰুগণকে পরাজয় করিয়া তাঁহাদিগকে যে মোচন করিয়াছিলেন, ইহা কি তাঁহারা স্মরণ করিয়া থাকেন? সেই স্থানে আমি অর্জ্জুনের পৃষ্ঠরক্ষা করিয়াছিলাম ও ভীমসেন নকুলসহদেবের পৃষ্ঠরক্ষা করিয়াছিলাম, ইহাও কি তাঁহারা স্মরণ করিয়া থাকেন? আমরা ধৃতরাষ্ট্রতনয় দুৰ্য্যোধনকে দানাদি উপায়দ্বারা পরাজয় করিতে অসমর্থ এবং একমাত্ৰ সামরূপ উপায়দ্বারাও তাঁহাকে অনায়াসে পরাজয় করিতে পারিব না; অতএব এক্ষণে দণ্ডরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে পরাজয় করা কর্ত্তব্য।”