৯ম অধ্যায়
ব্যাসকর্ত্তৃক ইন্দ্র-সুরভি বৃত্তান্তকথন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “ভগবন দেবর্ষে দ্যূতে আমার তাদৃশী ইচ্ছা ছিল না, বোধ হয়, বিধাতা আমাকে বলপূর্ব্বক আকর্ষণ করিয়া তদ্বিষয়ে প্রবৃত্ত করিয়া দেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর ও গান্ধারী ইহাদিগেরও এ বিষয়ে কিছুমাত্ৰ স্পৃহা ছিল না। তৎকালে সকলের বুদ্ধিভ্রংশপ্রযুক্তই দৃঢ়তারম্ভ হইয়াছিল। এক্ষণে আমি সবিশেষ জানিয়াও স্নেহবশতঃ নিতান্ত দুর্বোধ দুৰ্য্যোধনকে পরিত্যাগ করিতে অসমর্থ।” ব্যাসদেব প্রত্যুত্তর করিলেন, “মহারাজ! তুমি যাহা কহিলে, তাহাতে কোন সংশয় নাই। পুত্ৰই শ্রেষ্ঠ পদার্থ, ইহলোকে পুত্র অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পদার্থ আর কিছুই নাই। অধিক কি, গোমাতা সুরভি অজস্র অশ্রুপাতদ্বারা ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রেরও এই বিষয়ে সম্যক বোধ জন্মাইয়া দেন। তদবধি ইন্দ্ৰদেব পুত্র অপেক্ষা অন্যবিধ সমৃদ্ধ পদার্থ উৎকৃষ্ট বলিয়া বিবেচনা করেন না। এক্ষণে ইন্দ্র-সুরভি-সংবাদ-নামক অত্যুত্তম এক উপাখ্যান আরম্ভ করিতেছি, শ্রবণ কর।
“পূর্ব্বকালে একদা দেবলোকে সুরভি রোদন করিতেছিলেন। দেবরাজ তদ্দর্শনে কারুণ্যরসপরবস হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, ‘হে শুভে! তুমি কি নিমিত্ত রোদন করিতেছ? দেবতা, মনুষ্য ও নাগগণের ত’ কোন অমঙ্গল ঘটে নাই?” সুরভি কহিলেন, “হে ত্ৰিদশনাথ! ত্ৰিলোকমধ্যে কুত্ৰাপি অশুভঘটনা দৃষ্ট হইতেছে না। আমি কেবল পুত্রদুঃখে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে রোদন করিতেছি। ঐ দেখুন, নির্দ্দয় লোকেরা লাঙ্গলে নিযুক্ত করিয়া কশাঘাতদ্বারা আমার দুর্ব্বল পুত্রদিগকে প্রহার ও সমধিক যন্ত্রণা দিতেছে দেখিয়া আমি সাতিশয় করুণাবিষ্ট হইয়াছি, আমার মন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইতেছে। উহাদিগের মধ্যে একটি মহাবল; এই নিমিত্ত সমধিক ভার বহন করিতে সমর্থ; দ্বিতীয়টি নিতান্ত দুর্ব্বল, কৃশ ও শিরাব্যাপ্তশরীর; সুতরাং অতি কষ্টে অল্পভার বহন করিতেছে। হে দেবরাজ! দেখুন, কশাদ্বারা পুনঃ পুনঃ আহত হইয়াও ভারবহন করিতে সমর্থ হইতেছে না; এই নিমিত্ত আমি শোকে অভিভূত ও দুঃখে পীড়িত হইয়া অবিরল বাষ্পাকুলালোচনে রোদন করিতেছি।’ ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে শোভনে! তোমার আহত সহস্ৰ পুত্রের মধ্যে যদি একটি বিনষ্টই হয়, তাহাতে ক্ষোভ বা পরিতাপের বিষয় কি?” সুরভি প্রত্যুত্তর করিলেন, “হে শত্ৰু! যদিও আমার পুত্ৰ সহস্ৰসংখ্যক, তথাচ তাহাদিগের উপর আমার আন্তরিক ভাব একরূপই আছে, কিন্তু তন্মধ্যে যে দীন ও সাধু, আমি তাহাকে সমধিক কৃপা করিয়া থাকি।”
ব্যাসদেব এইরূপে উপাখ্যান সমাপন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! দেবরাজ ইন্দ্র সুরভির বাক্য শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। তদবধি তিনি পুত্রকে প্ৰাণাধিক বলিয়া স্বীকার করিলেন। তৎপরে কৃষীবলের বিঘ্ন করিবার নিমিত্ত অজস্র মুষলধারে বারিবর্ষণ করিতে লাগিলেন।
“হে নরনাথ! সুরভি যেরূপ কহিয়াছিলেন, সেইরূপ তোমারও যেন পুত্ৰগণের প্রতি আন্তরিক ভাব সমান থাকে। বিশেষতঃ সহায়হীন দীনের প্রতি সমধিক কৃপাদৃষ্টি করা কর্ত্তব্য; দেখ, আমি তোমাকে ও মহামতি বিদুরকে পুত্রসদৃশ জ্ঞান করি, কখন ভিন্ন বোধ করি না; অতএব স্নেহবশতঃ যাহা বলি, তাহা প্রতিপালন করা। তোমার একশত এক পুত্র; কিন্তু পাণ্ডুরাজের কেবল পাঁচ পুত্র; তাহারাও নিতান্ত দুঃখভারে আক্রান্ত ও হীনবল হইয়া আছে। ঐ নিরাশ্রয় পুত্রপঞ্চক কি প্রকারে জীবিত থাকিবে ও কিরূপেই বা অভ্যুদয়লাভ করিবে, এই চিন্তায় আমার মন সাতিশয় ব্যাকুল হইতেছে। হে মহারাজ! যদি তুমি কৌরবদিগের প্রাণরক্ষা করিতে ইচ্ছা কর, তাহা হইলে তোমার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধনকে শান্ত ও ক্ষান্ত হইতে আদেশ কর।”