৮ম অধ্যায়
পাণ্ডবসৈন্যগণের পলায়ন
সঞ্জয় কহিরেন, “দ্রোণাচার্য্য সেই রূপে অশ্ব, সারথি ও হস্তিগণকে সংহার করিতেছেন দেখিয়া পাণ্ডবগণ ব্যথিত না হইয়া উহারে নিবারণ করিবার চেষ্টা করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ধনঞ্জয়কে কহিলেন, হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! হে অর্জ্জুন! তোমরা সকলে সতর্ক হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিবারণ কর। তখন অর্জ্জুন, অনুযায়িবর্গসমেত ধৃষ্টদ্যুম্ন ও অন্যান্য মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্যকে আক্রমণ করিলেন। কৈকেয়গণ, ভীমসেন, অভিমন্যু, ঘটোৎকচ, যুধিষ্ঠির, নকুল সহদেব, মৎস্য, দ্রুপদ, শিখণ্ডী, দ্রোপদীর পুত্রগণ, ধৃষ্টকেতু, সাত্যকি, চেকিতান, যুযুৎসু ও পাণ্ডবগণের অনুযায়ী অন্যান্য পার্থিবগণ স্ব স্ব কুল-বীর্য্যের অনুরূপ কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। সমরদুৰ্ম্মদ দ্রোণ সক্রোধে নেত্রদ্বয় বিবর্ত্তিত করিয়া দেখিলেন, পাণ্ডবগণ সেই সৈন্যগণকে রক্ষা করিতেছেন। তখন তিনি যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া বায়ু যেমন জলদজালকে ছিন্ন ভিন্ন করে, সেইরূপ পাণ্ডব সৈন্যকে ছিন্ন ভিন্ন করিলেন এবং রথ, অশ্ব, মনুষ্য ও মাতঙ্গগণের প্রতি মত্তের ন্যায় ধাবমান হইয়া বৃদ্ধ হইলেও যুবার ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিলেন। বায়ুবেগগামী, শ্রান্তিহীন তাঁহার আজানেয় অশ্বগণ স্বভাবতই শোণিতবর্ণ, তাহাতে আবার শোণিতাক্ত হইয়া অধিকতর কান্তি ধারণ করিল।
দ্রোণাচার্য্য অন্তকের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া আগমন করিতেছেন দেখিয়া পাণ্ডবপক্ষ যোদ্ধাগণ ইতস্তত পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল; কেহ কেহ পুনরায় আবর্ত্তিত হইল; কেহ কেহ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল; কেহ কেহ দৃষ্টিপাত করিয়া এক একবার দণ্ডায়মান হইয়া রহিল; শূরগণের হর্ষজনন ভীরুগণের ভয়বর্দ্ধন তাহাদিগের নিদারুণ শব্দে সমস্ত রোদসী পরিপূর্ণ হইতে লাগিল। দ্রোণাচার্য্য পুনর্ব্বার আপন নাম উচ্চারণ পূর্ব্বক শত শত শরে শত্রুগণকে আচ্ছন্ন করিয়া
আপনারে নিতান্ত ভয়ঙ্কর করিলেন
বৃদ্ধ হইয়াও যুবার ন্যায়
, কৃতান্তের ন্যায় যুধিষ্ঠিরের সৈন্যমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন এবং মস্তক ও অলঙ্কৃত বাহু সকল ছেদিত ও রথ সকল নির্ম্মনুষ্য করিয়া উচ্চস্বরে চীৎকার আরম্ভ করিলেন। তাঁহার সেই হর্ষ শব্দে ও বাণবেগে যোদ্ধৃগণ শীতার্দ্দিত গো সমূহের ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিল; তাঁহার রথঘোষে, মৌৰ্ব্বী নিষ্পেষণে ও শরাসন শব্দে আকাশে এক মহৎ শব্দ সমুত্থিত হইল এবং তাহার শরাসন হইতে শরনিকর বিনিঃসৃত হইয়া সমুদায় দিক আচ্ছন্ন করিয়া মাতঙ্গ, তুরঙ্গ, রথ ও পদাতিগণের উপর পতিত হইতে লাগিল। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ সেই মহাবেগ কামুক সনাথ, অস্ত্র সমূহে প্রজ্বলিত হুতাশন দ্রোণাচার্যের নিকটবর্তী হইলে তিনি তাঁহাদিগকে ও তাঁহাদিগের কুঞ্জর, পদাতি ও অশ্বগণকে যমসদনে প্রেরণ করিয়া পৃথিবীকে শোণিত দ্বারা কর্দ্দমিত করিলেন এবং অনবরত এরূপ দিব্যাস্ত্র ও শরসকল নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন যে, সমুদায় দিকে এবং পদাতি, অশ্ব ও রথে শরজাল ভিন্ন আর কিছুই নয়ন গোচর হইল না, কেবল তাঁহারই কেতু মেঘরাজি বিরাজিত বিদ্যুতের ন্যায় বিচরণ করিতেছে, নিরীক্ষণ করিলাম।
অনন্তর অদীনসত্ত্ব দ্রোণাচার্য্য কৈকেয়গণের প্রধান পাঁচ বীরকে ও দ্রুপদকে শরজালে নিপীড়িত করিয়া কামুক বাণ হস্তে যুধিষ্ঠির সৈন্যের সমীপবর্তী হইলেন। ভীমসেন, ধনঞ্জয়, সাত্যকি, দ্রুপদপুত্রগণ, শৈব্যনন্দন কাশিরাজ ও শিবি হৃষ্ট হইয়া সিংহনাদ করিতে করিতে শরনিকরে তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিলেন। দ্রোণাচার্য্যের শরাসন বিমুক্ত স্বর্ণপুঙ্খ শরনিকর গজ ও অশ্বযুবাদিগের কলেবর ভেদ করিয়া শোণিতলিপ্ত পক্ষে মহীতলে নিপতিত হইতে লাগিল। যুদ্ধক্ষেত্র যোদ্ধা সমূহে, রথ সমূহে ও শরনিভিন্ন গজবাজি সমূহে আচ্ছন্ন হইয়া শ্যামল মেঘসমূহে সমাবৃত আকাশের ন্যায় প্রতীয়মান হইল। এই রূপে দ্রোণাচার্য্য দুর্য্যোধনের উন্নতি কামনায় সাত্যকি, ভীম, অর্জ্জুন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, অভিমন্যু, দ্রুপদ ও কাশিরাজ প্রভৃতি বীরগণকে বিমর্দ্দন ও অন্যান্য কর্ম্ম সকল সম্পাদন পূর্ব্বক প্রলয়কালীন প্রদীপ্ত দিবাকরের ন্যায় সকল লোককে সন্তাপিত করিয়া ইহলোক হইতে সুরলোকে গমন করিলেন। তিনি পাণ্ডবগণের বহু সহস্র যোদ্ধা সংহার করিলে পর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে নিপাতিত করিলেন। তিনি পাণ্ডবগণের দুই অক্ষোহিণীর অধিক সমরে অপরাঙ্মুখ শূরগণকে নিহত করিয়া পশ্চাৎ পরমগতি প্রাপ্ত হইলেন। তিনি দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদন করিয়া পাণ্ডব ও ক্রয়কর্ম্মা অমঙ্গল্য পাঞ্চালগণের হস্তে প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন। অনন্তর সৈন্য ও অন্যান্য লোকের ঘোর নাদ আকাশে সমুত্থিত হইল। ভূতগণের ‘অহো ধিক!’ শব্দে স্বর্গ, মর্ত্ত্য, অন্তরীক্ষ, দিক্ ও বিদিক সকল প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। দেবগণ, পিতৃগণ ও মহারথ দ্রোণাচার্য্যের বান্ধবগণ তাঁহাকে জীবনশূন্য অবলোকন করিলেন। পাণ্ডবগণ জয় লাভ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন; তাঁহাদিগের সিংহনাদে বসুন্ধরা কম্পিত হইতে লাগিল।