ঘুমোতে যারার আগে

হন্তারক গুলিবিদ্ধ হিস্পানি প্রান্তরে পড়ে-থাকা
লোর্কা, তাঁর কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা স্তব্ধ মধ্যরাতে
মাথার ভেতরে ডালিমের দানার মতন লাল,
হল্‌দে চকোলেট,
ফিরোজা, বেগুনি গুঞ্জরণ; যেন কেউ কী বিভোর
বাজিয়ে চলেছে এক চন্দ্রিল সিস্ফনি
সত্তা জুড়ে; জানালার কাছে যাই, একটি ব্যাকুল গাছ হাত
বাড়ায় আমার দিকে, বুঝি সখ্য দিতে চায় এই
প্রীতির কাঙালটিকে। মশারির ভেতরে গৃহিণী
ঘুমে কাদা, তার মৃদু নিঃশ্বাস পতনে অতীতের
তরুণীর শরীরের দিলরুবা আর মরূদ্যানের হাওয়ার
ধ্বনি, ঠোঁটে কিছু
স্বপ্নকণা ঝরে, ব্লাউজের বেড়া টপকিয়ে বের
হয়ে আসে স্বপ্নভ্রষ্টতায়
যমজ চাঁদের মতো স্তন, ওর খোলা চুল নিয়ে
খেলা করি, সৌন্দর্য এসেছে যেন ফিরে বেখবর অবয়বে।

রক্তভেজা হিস্পানি প্রান্তর থেকে উঠে
তিনি, লোর্কা, চলেছেন হেঁটে একা দেশদেশান্তরে
দুয়েন্দোর ঘূর্ণিনাচে। মুখের ভেতর থেকে তাঁর
কেবলি বেরিয়ে আসে রঙিন বুদ্বুদ
অবিরত, যায়
দিগন্তের দিকে বাধাবন্ধহীন। ফুটন্তে জিপসি
রমণীর নৃত্যপর ঘাগরা এবং অগ্নি গোলকের মতো
ষাঁড়, বুকে গোলাপ-প্রোথিত মাতাদোর, বৃষ্টিপায়ী
স্তব্ধ ঠোঁটে মৃত্যুর প্রসূন, কাসিদার
স্মৃতি নিয়ে চলেছেন হেঁটে বড় একা।

আজও কি হবে না ঘুম? বাথরুমে বালতিতে পড়ে
পানি, ট্যাপ বন্ধ করা হয়নি নিশ্চয়

ভুলক্রমে। দাঁত মেজে রিলাক্সেন খেয়ে শুয়ে যাই।
ফ্ল্যাট বাড়িটার
কোমরে জড়ানো জ্যোৎস্নালতা; স্তব্ধতাকে
চিরে, যেন জামদানি শাড়ি তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে কাটে
কেউ ফালি ফালি করে, চাঁদের উদ্দেশে অকস্মাৎ
পথের কুকুর গেয়ে ওঠে সেরেনাদ।
গোধূলিতে গরুর গলার
ঘণ্টার রুপালি ধ্বনি যেমন মধুর ভেসে আসে
তেমনি কোনো আওয়াজের ঢেউ
হৃদয়ের তটে এসে ফেটে যায়, সহর্ষ চমকে ওঠে ত্বক। ঘুম নেই,
শয্যায়, দেয়ালে, বারান্দায়
চেয়ারে গাছের পত্রালিতে ঘুম নেই। শত শত
ঘোড়া, মুখের রক্ত জমা, শ্বেতপদ্ম নিয়ে ছুটে আসে
আমার চৌদিকে; হাত
চলে যায় মাথার পেছনে, কতকাল চুল ছাঁটা
হয়নি, হঠাৎ মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় সেই কবে এক
আহত পাখিকে বুকে জড়িয়ে বালক
অশ্রুময় চোখে হেঁটে গিয়েছিল বৃষ্টি ভেজা পথে
সন্ধ্যেবেলা; কে যেন আমার হাত থেকে
এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে কাফকার উপন্যাস
হেসে উঠেছিল বিকেলকে
চমকিয়ে সূর্যাস্তের রঙে তাকে আপাদমস্তক স্নাত
রূপসী কাতিল মনে হয়েছিল! আমি
তার স্বেচ্ছাবলি ভেবে
হৃদয়কে কণ্ঠস্বর ক’রে পৌঁছে দিয়েছি আকাশে,
যেখানে মেঘের ফাঁকে অজস্র গোলাপ ফুটে ওঠে।

ভোরবেলা এখনো গা ঢাকা দিয়ে আছে দূরে কোনো
বিপ্লবীর মতো
দুর্নিবার প্রত্যাশায় শয্যা ছেড়ে কাঠের চেয়ারে
বসে থাকি; যেন আমি অন্য কোনো কাল

থেকে এসে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছি, অথবা আমি কি
ভবিষ্যের কেউ এই জানালার পর্দা
সরিয়ে দেখছি ফাঁকা রাস্তা মধ্যরাতে কোনো দূর
শতাব্দীর?
কে যায় একাকী চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত পোজে
খাবি খায় নর্দমায়, মণিরত্ন খোঁজে?
আমিও তো মাঝে-মাঝে
উড়িয়ে মেঘের তুলো ঠুকরে ঠুকরে পথ চলি
জলাঞ্জলি দিয়ে ভব্যতার নীল ভোকাট্রা নিশান।
ত্বরিত বলক-আসা দুধের মতন
কবিতা ফুটছে হাড়ে, মজ্জায়, চাঁদিতে
হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, প্রতি রোমকূপে, নখে।
খাতা টেনে বসি, দেখি রহস্যময়তা কবুতরের ধরনে
নিরিবিলি ডিম পেড়ে যায়
খাতায় পাতায়। ক্লান্ত লাগে, মনে হয়
আমার ভেতরে কোনো যুদ্ধশ্রান্ত সেনা
করেছে প্রবেশ, ঘুমকাতরতা তাকে ক্রমশ করছে গ্রাস,
এবং সিঁড়ির ধাপগুলো
অজানা সমুদ্রতীরে চলে, জলে মিশে যায়।

যদি কাল ভোরবেলা আমার চোখের পাতা দুটো
পাখির গুটিয়ে-রাখা ডানার মতন
হয়ে যায়, যদি মৃত্যু আমার সত্তার তন্তুজালে
সকালে ফলিয়ে যায় নিরুত্তর হিম, তবে আমি
রোদ্দুরের রেণুমাখা ডুমুর গাছের পাতা, ডালে দোল-খাওয়া
পাখি দেখব না আর; এবং যেসব
কবিতার, দর্শনের বই কিনে সাজিয়ে রেখেছি
থরে থরে বুক-শেলফে, সেগুলো হবে না পড়া আর
কোনো দিন, যার মুখ বার বার দেখেও মেটে না
দৃষ্টি-তৃষ্ণা, তার
মুখশ্রী অদৃশ্য হবে আবছায়া হয়ে চিরদিনকার মতো।

রাত আড়াইটা বাজে, চৌকিদার হেঁকে যায় কখনো-সখনো,
ঘুম কি আসবে আজ? আমার চিন্তার
গা বেয়ে ক্রমশ নামে মাকড়সা, অষ্টবক্র মুণি,
তীরবিদ্ধ দুলদুল, কবরের মাটি-চেরা হাত, বৃষ্টিধারা,
আমার চিন্তার মোহনায় সদ্যমৃতা
সিমোন দ্য বোভোয়া দাঁড়ান, অস্তরাগে মুখ তাঁর
জরাকে তাচ্ছিল্য করে অপরূপ দীপান্বিতা, যেন
তাঁকে কোনো শহরতলিতে
দেখেছি কখনো হেঁটে যেতে চুপিসারে, টুপি-পরা
ক্ষেতে জংধরা কিছু রাইফেল পড়ে আছে কংকালের মতো,
দীর্ঘ ঘাসে ঢাকা হরিণেরা সবুজ রঙের ত্বক পেয়ে যায়,
ডান দিকে কবর খুঁড়ছে কারা ক্রমাগত এবং বাঁদিকে
কণ্ঠে এনে সমুদ্র কল্লোল কী প্রবল
গান গেয়ে হেঁটে যান পল রবসন।