1 of 2

৯. পৃথুর জীবনে কুর্চিই একমাত্র আনন্দ

পৃথুর জীবনে কুর্চিই একমাত্র আনন্দ।

এমনই হয়। ভেবেছিল, যা হারিয়ে গেছে, তা গেছেই।

যা হারিয়ে যাবার, তাকে আগলে বসে থাকা সম্ভবও নয় বেশিদিন।

ভেবেছিল, পরিণত বয়সে এসে, চল্লিশের আওতায়, নিজে একটু বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞর মতো ব্যবহার করবে নিজের ছেলেমানুষ চিরশিশু মনটার সঙ্গে। তাকে ধমকে দেবে, বকবে, কান মলাও দেবে প্রয়োজন হলে, দরজা বন্ধ করে ফেলে রেখে দেবে না খেতে দিয়ে ঘরে। এমন চড় মারবে তাকে, আচমকা যে, শিশুরই মতো দমবন্ধ নীল নিঃশব্দ হয়ে থাকবে সে দীর্ঘ সময়।

মনে হবে, প্রাণ বেরুবারই সময় হল বুঝি।

কিন্তু পারল না।

তার প্রতি মুহূর্তর ক্যানসারাস, ভোঁতা বিষণ্ণতা পৃথুকে তীব্র কোনও দুঃখ অথবা আনন্দের অনুভূতি থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে বহুকালই।

বাসটা সুকরাতে এসে দাঁড়াল। গাড়ি, পৃথুরও একটা আছে। কোম্পানির গাড়ি। উর্দিপরা ড্রাইভারও আছে। তবে সে গাড়ি বিশেষ একটা ব্যবহার করে না। কারখানায় যখন যায়, তখনও বেশির ভাগ দিন হেঁটেই চলে যায় এবং আসে। কাছেই তো। যখন ছুটি থাকে, তো কথাই নেই। গাড়ির প্রয়োজন রুষারই বেশি। মিলি-টুসু বড় হচ্ছে, ওদেরও দরকার থাকে মাঝে-মধ্যে। স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়াও। গাড়ি থাকা সত্ত্বেও হেঁটে বা অন্য কারও মোটর সাইকেল বা স্কুটারের পেছনে বা বাসে ছোটা-ম্যানেজারকে সবসময় ঘোরাঘুরি করতে দেখে বলে, সকলেই পৃথুকে আড়ালে ডাকে ‘পাগলা ঘোষা’।

আসলে ঘোষ সাহেব থেকেই ঘোষা। পৃথু জানে সেটা।

বাসটা দাঁড়াবে মিনিট দশেক। সামনেই চায়ের দোকান। পান বিড়ি ভুজিয়া, মাছি-পড়া লাড্ডু, বালুসাই, চুরমুর। অনেকে নেমে খেল; যারা. দূর থেকে আসছে। পৃথু নামল না। বাঁদিকে, ড্রাইভারের পেছনের সিটেই জায়গা করে দিয়েছে কনডাকটর! তাকে এখানে সকলেই চেনে। এই ব্যাপারটা ওর একেবারেই ভাল লাগে না। যাদের সে চেনে না, তাদের অনেকেই তাকে চেনে এই ভাবনাটাই ভারী অস্বস্তিকর। যখন বয়স কম ছিল, চেহারা আজকের মতো কুৎসিত ছিল না, তখন বম্বের এক ফিল্ম-কোম্পানী অফার দিয়েছিল ছবিতে অভিনয় করার জন্যে। বাবা ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বলেননি। ডিরেকটর যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন পৃথুকে, তোমাদের বাড়ি কি খুবই কনসার্ভেটিভ? তখন পৃথু উত্তর দিয়েছিল, কনসার্ভ করার যাদের কিছুমাত্র থাকে, তারাই কনসার্ভেটিভ হয়।

রক্ষা করার মতো আদৌ কিছু না থাকলে সত্যিই রক্ষণশীল হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তখন বাজারী অভিনয় ও ফিল্ম-এর জগৎ আজকের মতো সম্ভ্রান্তও ছিল না। যাইই হোক, রবিবারের সকালে বিস্রস্ত চুলে রাতের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে হাওয়াইন চটি গলিয়ে যে বাজার যেতে পারবে না, একবার ‘হীরো’ বনে গেলে; শুধু এই ভাবনাটাই তাকে তখন সিনেমাতে নামতে দেয়নি। ডিরেকটর, পৃথুর বাবাকে রীতিমত অনুনয়-বিনয়ও করেছিলেন। শিকার করতে-যাওয়া পৃথুর, রাইফেল-কাঁধে ঘোড়ায়-চড়া-চেহারা সুফকর-এর জঙ্গলে দেখেই ডিরেকটরের রোখ চেপে যায়। চরিত্রটিও চমৎকার ছিল। অত্যাচারী জমিদারের সদুৰ্শন ছেলে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকার করে, পাহাড়-জঙ্গলের মেয়েদের মধু লুটে খায়। একদিন তার জীবনেও প্রেম এসে হাজির হল লখীন্দরের লোহার বাসর ঘরের সাপের মতো সূক্ষ্ম শরীরে এবং খলনায়ক রাতারাতি রূপান্তরিত হল দেবশিশুতে।

সিনেমাতে না-নামাতেই বোধহয় দেবশিশু আর হওয়া হল না পৃথুর।

প্রেম-এর নিঃশব্দ চরণে যাতায়াতই চিরদিন পছন্দ ওর। তাই-ই এমন ঘোড়ায়-চড়ে, অশ্বখুরের শব্দে মেদিনী কাঁপিয়ে যে প্রেম আসে, তার প্রতি ওর চিরদিনের অনীহা। শুধু অনীহাই নয়, ও বলবে অসুয়াও। পৃথুর প্রথম এবং শেষ কবিতার বইয়ের নামও যে ‘অসুয়া’, তার কারণও এই বোধ।

বাসটা রায়নাতে এসে থামল। খাতির করে নামিয়ে দিল কনডাকটর। মজা এইই! যাদের কাছে, যাদের হাতে; যত্নখাতির পাবার কথা ছিল না একটুও, তারাই চিরদিন ওকে খাতির-যত্ন করে গেল।

কুর্চিদের বাড়িটা কোথায় একটু খুঁজতে হবে। যা শুনেছিল, তার সঙ্গে মিলছে না। একটা মুদির দোকান, বাস স্ট্যান্ডের পাশে, তারপর তামাকের দোকান। তার পাশে বাসনকোসন ও দেহাতি শাড়ি-ঘাগরার দোকান, তারপরই একটা চৌমাথা। সেখানে বাঁক-ঘুরে বাঁ দিকের নির্জন রাস্তাতে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে। শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। তারপরই বাড়িটা। বাড়িটার ওই পাশে কিছু দূরে রায়না বস্তির একটা হাত এসে পৌঁছেছে, কিন্তু এই মোড় থেকে ওদের বাড়ির পর অবধি কোনও বসতি বা দোকান নেই। খুব সম্ভব সরকারি খাসমহল এটা।

এখন দশটা বাজে। একটার মধ্যেই হাটচান্দ্রাতে ফিরতে হবে। বাড়িতে দেড়টার মধ্যে ফিরে খাবার টেবলে গিয়ে না-বসলে তুলকালাম কাণ্ড হবে। ঠিক পৌনে দুটোর সময় টেবল সাফ হয়ে যাবে। ন্যাপকিন-ছুরি-কাঁটা-চামচ উঠে যাবে। উঠে যাবে সবকিছু। ঝকঝকে বার্নিশ করা টেবলের উপর হলুদ-কালো চৌখুপী-চৌখুপী টেবল ক্লথ পাতা হয়ে যাবে। টেবলের ঠিক মধ্যিখানে ভ্যান ঘঘ-এর ‘স্টিল-লাইফ’ ছবিরই মতো একটি ফ্রুট-বোওল শোভা পাবে। তার মধ্যে সীজনাল ফ্রুটস থাকবে কিছু। ছবির মতোই শোভা পাবে। ওদের বাড়িতে দিন ও রাতের যে-কোনও প্রহরেই কেউ ঢুকুক না কেন, বলবে বাঃ! মুখ থেকে আপনা থেকেই বেরিয়ে আসবে, বাঃ! পৃথুর নিজের মুখ থেকেও বেরোয়। সৌন্দর্য, সুরুচি, এসব এ্যাপ্রিসিয়েট করার ক্ষমতা ভগবান তাকেও কিছু কম দেননি, কিন্তু রুষার বাড়িটা এত বেশি ভাল যে সে বাড়িতে ঢুকে মাঝে-মাঝে পৃথুর মনে হয় যে, এটা বাড়ি নয়। কোনও পশ-দোকানের শো-রুম, বা স্টুডিও। অথবা যে কোনও অ্যান্টিক-ডিলারের একজিবিশন চলছে এখানে। যে-বাড়িতে মানুষ-মানুষী থাকে, সেখানে প্রাণ থাকে, সেখানে ভালোবাসা, প্রীতি সবই ছড়ানো থাকবার কথা। পরিচ্ছন্নতা পৃথুও ভালবাসে। বাকিগ্রস্ততা নয়। ওটা বাড়ি নয়; রাজা-রাজড়ার ভুতুড়ে, গা-ছমছম প্রাসাদ যেন। ছোট মাপের।

একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দূর থেকে বাড়িটা দেখা গেল। কুর্চির বাড়ি। বাড়ি নয়, বাংলো। একতলা। টালির ছাদ, পাঁচ ইঞ্চি দেওয়াল, সামনে একটুখানি খোলা জায়গা। বাগান মতো। চারপাশেই শাল জঙ্গল। পশ্চিমের দিকে জঙ্গলটা গিয়ে মিলে গেছে শাঁওন নদীর সঙ্গে। তারপর নদী পেরিয়ে, অনেক দূরের পথ হেঁটে চলে গেছে কানহার দিকে। সবচেয়ে যা ভাল লাগল পৃথুর, তা হচ্ছে দুটি মস্ত কদম গাছ, কুর্চির বাড়ির ঠিক সামনেই। গেটের দু’পাশে। একটা কুর্চি গাছ থাকলেও খুব ভাল হত।

কুর্চি কিন্তু কুর্চির আসল নাম নয়। ওই নাম পৃথুরই দেওয়া। পৃথিবীর সকলেই কুর্চিকে অন্য নামে ডাকে। কুর্চির উপর কোনওরকম মালিকানাই আর নেই পৃথুর। মালিকানা যেতে যেতে থমকে রয়েছে শুধু নামটুকুরই মধ্যে। ও যে নামে ডাকে, সে নামে আর কেউই কুর্চিকে ডাকবে এ কথা ভাবলেই কষ্ট হয়।

আঃ। কদমগাছ দুটি সত্যিই সুন্দর! খুব বড়। বর্ষায় কী যে হবে এখানে, কেমন যে দেখাবে; ভাবে পৃথু।

দরজাটা খোলা ছিল। ছোট্ট বাগানের গেটটি যদিও বন্ধ ছিল। হয়তো ছাগল, গরু যাতে না ঢুকতে পারে সে জন্যে।

গেট খুলে দরজার কাছে গিয়ে ও ডাকল, কোঈ হ্যায়?

কোনও উত্তর নেই।

আবারও ডাকল।

এবারে একটি ছত্তিশগড়িয়া বুড়ি বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

কুর্চির নিয়মিত, আইনানুগ নামটি বলল পৃথু। কুর্চির স্বামীর নামও বলল।

বাবু গেছে হাটচান্দ্রাতে এক রিস্তেদারের সঙ্গেই দেখা করতে। আর দিদি চান করতে গেছেন।

দিদির সঙ্গেই দেখা করব।

বসুন তাহলে।

বলেই, বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো।

দিদিকে কি এক্ষুনি খবর দেব? না, চান ইলেই?

চান হলেই দিও। তাড়া নেই।

চা-টা কিছু খাবেন? কফি না চা? না কি ঠাণ্ডা দেব?

পৃথু হকচকিয়ে গেল। বলল, না না। কিছু না। দিদি আসুন আগে।

দাঈ চলে গেল নিজের কাজে।

বসে চতুর্দিকে চোখ বোলাল একবার ও। এক-সেট সোফা। ভীষণ দামি কিছু নয়, কিন্তু বসে খুব আরাম। হেলান দিয়ে বসার জন্যে পাতলা বালিশও আছে। স্ট্রাইপড কভার-পরাননা, প্যাস্টেল-রঙা।

সামান্য অগোছালো। দেখে বোঝা যায় যে, এখানে কুর্চি আর ভাঁটু অথবা অন্য কেউ বসেছিল সকালে। একাধিক কাপ চা খেয়েছে। সিগারেট-এর টুকরো এখনও পড়ে আছে অ্যাস্ট্রেতে। চার্মস-এর গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। ঘরের কোণায় একটি কাঁচের আলমারী। নানা জিনিস সাজানো তাতে। উপরের তাকে কুর্চি আর ভাঁটুর বিয়ের পরে ভোলা ফোটো। জোড়ে। ভাঁটুর মুখে গদগদ ভাব। নিখুঁতভাবে দাড়ি গোঁফ-কামানো। এতই নিখুঁতভাবে যে, মনে হচ্ছে বুঝি মাকুন্দ ও। পাশে কুর্চি।

বিয়ের পরই ওরা চলে গেছিল। ভাঁটুর সঙ্গে তেমন আলাপিত হবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ওকে বাঙালি বলে মনেই হয় না। তাছাড়া পড়াশুনাও বেশি করেনি। চেহারাটা লম্বা, চওড়া, ফর্সা, মস্ত একটা মাথা। মাইনাস বুদ্ধি। ভাঁটু কি জানে কুর্চিকে পৃথু ভালবাসে। এবং কুর্চি পৃথুকে? ভালই যদি বাসত, তাহলে বিয়ে করল কেন ভাঁটুকে? বেচারা ভাঁটু। ও বোধহয় জানে না যে, ভালবাসার নানা রকম হয়। একই সঙ্গে একাধিক লোককে ভালবাসা যায়। যে বাসতে জানে।

চারটে বড় বড় জানালা বসার ঘরে। লাল, ম্যাজেন্টা, হলুদ এবং কমলা বোগেনভোলিয়া গাছ। বাগানে পেঁপে, আম, আতা, চেরী এবং কারিপাতা গাছ।

চমকে চেয়ে, পিছন ফিরল পৃথু।

কুর্চি দাঁড়িয়ে আছে। অফফ্‌-হোয়াইট একটি ব্লাউজ আর হালকা খয়েরি আর সাদা ডুরে শাড়ি পরে। দরজার দু দিকের খিলানে দু হাত রেখে। কুর্চি। তার মস্তিষ্কর মধ্যে, বুকের মধ্যে, দু চোখের মধ্যে। আবার হাসল কুর্চি।

অনেকক্ষণ কি বসে আছেন? আমি চান করছিলাম। তেল মাখি না অনেকদিন, ভাল করে। কম ঝঞ্ঝাট। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সব মালপত্র নিয়ে আসা। আজ অনেকক্ষণ ধরে তেল মেখে খুব ভা-ল্ল করে চান করলাম। খুবই ফ্রেশ লাগছে। |

কুর্চি যখন চান করার কথা বলছিল পৃথুকে, পৃথু আচমকাই শরীরে এক অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। ও যেন স্নানরতা কুর্চির অদেখা নগ্নতাকে ওর চোখের সামনে, সেই কার্তিকের উজ্জ্বল উষ্ণ সকালবেলায় দেখতে পাচ্ছিল। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর মনের কোণে বহুদিনের দোষী-সাধ ছিল; গা-শিউরানো এক নিভৃত শখ ছিল যে, কুর্চিকে নিজে হাতে একদিন বছর-ঘোরা শিশুর মতো চান করায়! মায়ের মতো স্নেহ, নার্সের মতো দক্ষতায়। তারপর পাউডার-টাউডার মাখিয়ে, ন্যাপি পরিয়ে চোখে কাজল দিয়ে, কপালের এক পাশে থ্যাবড়া করে কাজল লেপে দেয়, যেন আকাশ বাতাস এই পৃথিবীর কোনও দুষ্ট গ্রহ, ডাইনি, জিন কিচিং কাঁড়িয়া-পীরেত বা কুচক্রী কোনও মানুষেরই চোখ না লাগে। না পড়ে, তার কুর্চির উপর।

কুর্চি বলল, কেমন আছেন আপনি?

কেমন দেখছ?

অনেক রোগা হয়ে গেছেন। ভাল করে খাওয়া দাওয়া করেন না বুঝি?

খাই তো! খুবই খাই। বেশিরকম খাই বলে কত অশান্তি। আর তুমি বলছ খাই না?

তাহলে, অনিয়ম করেন? নিশ্চয়ই?

উপায় নেই। অনিয়ম করার কোনওই উপায় নেই।

তবে? ভাবনা চিন্তা করেন বুঝি সবসময়?

তা করি।

কিসের এত ভাবনা চিন্তা? এত টাকা মাইনে পান। আজ বাদে কাল বোর্ডে যাবেন। ডিরেক্টর-হাটচান্দ্রার চারদিকের পঞ্চাশ মাইলের পরিধির মানুষ, পথে দেখলেই আপনাকে সেলাম করে। রুষাদির মতো ভার্সেটাইল, গুণী, সুন্দরী, স্ত্রী, হাটচান্দ্রার ইন্দিরা গান্ধী; টুসু ও মিলির মতো এমন ওয়েল-ম্যানার্ড, ইন্টেলিজেন্ট, ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়ে। চিন্তাটা কিসের এত আপনার! কী নিয়ে চিন্তা করেন?

কুর্চিটা ভীষণ খারাপ। পরীক্ষা নিতে চায় পৃথুর।

এরপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। পৃথু জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে; কুর্চি বাগানে। কোনও কথা না বলে।

কী খাবেন বলুন? চা, না কফি, না ঠাণ্ডা কিছু?

কিছু না। আমি এক্ষুনি উঠব। রুষাকে বলে আসিনি। দেরি হলে, বাড়িতে খাবার নষ্ট হবে। গালাগালি খেতে হবে।

নষ্ট হবেই না। আপনার খাওয়া তো ভাঁটুই খাবে ওখানে। ভাঁটুর খাওয়ার আপনি খাবেন এখানে। রুষাদি কি এই অবেলায় ভাঁটুকে না খেয়ে আসতে দেবেন? তা হতেই পারে না। ওসব কথা শুনব না। আমি কফি করে নিয়ে আসছি। একটু বসুন পৃথুদা! কী ভাল যে লাগছে না। এখন কফি খান। তারপর আমরা দুজনে বসে খাব। কত্ব গল্প করব। কত্বদিন পর…

তুমি কেন কফি বানাতে যাবে? দাঈকে বরং বলল। আমি কি তোমার কাছে কিছু খেতেই এসেছি বলে তোমার ধারণা? তুমি আমার সামনে বসে থাকো, গল্প করো, তাহলেই সব চেয়ে খুশি হব।

তা হোক। অত বেশি খুশি হওয়ার দরকার নেই। একটু খুশি হলেই হবে। আপনি বসুন। আপনি তো আপনিই। আপনাকে কি দাঈয়েব হাতে তৈরি কফি দিতে পারি? বলুন? এই নিন ‘দেশ’ তিন সপ্তাহ আগের। বলে, ম্যাগাজিন র‍্যাক থেকে তুলে দিল ‘দেশ’টা।

যেতে যেতে বলল, কত কষ্ট করে যে জোগাড় করি, জবলপুরেই পাওয়া মুশকিল ছিল। আর এইখানে তো পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। আচ্ছা। মিলি-টুসু কি বাংলা পড়ে? পৃথুদা! বাংলা বই পড়ে ওরা?

নাঃ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল পৃথু।

তারপর বলল, প্রবাসী বাঙালিদের পরের প্রজন্ম আর বাঙালি থাকবে না। কেউ কেউ হয়তো বাংলা ভাষায় বাড়িতে কথা বলবেন, তাও অ্যাফেক্টেড বাংলায়; বাংলা পড়তে বোধহয় শতকরা পাঁচ ভাগও পারবেন না।

সত্যি! বড়ই দুঃখ হয় ভাবলে।

আমি আসছি। কফিটা নিয়ে। সঙ্গে কিছু খাবেন? চানাচুর? ফিংগার চিপস? ওঃ ভুলেই গেছিলাম। নারকোলের নাড়ু খাবেন? কাল বানিয়েছিলাম।

পৃথু ঘাড় নাড়ল। কুর্চি চলে গেল ভিতরে।

পৃথু ভাবছিল, এক একজন মেয়ে, এক একরকম হয়। রুষা জীবনে একদিনও নিজে হাতে কফি বা চা করে তাকে খাওয়ায়নি। তবে তার বন্দোবস্তে কোনও ত্রুটি নেই। দুজনের দুরকম গুণ। কিন্তু এক একজন পুরুষও যে এক-একরকম হয়। কেউ একটু পার্সোনাল টাচ-এর কাঙাল, কেউ অর্গানাইজেশনের অ্যাডমায়ারার।

নারকোলের নাড়ু! মায়ের মৃত্যুর পর খায়নি। পৌষ পার্বণে পিঠে খায়নি। তেল-কই খায়নি। ধনেপাতা, কাঁচা লংকা, কালোজিরে দিয়ে। ভেটকি মাছের কাঁটা চচ্চড়ি খায়নি। বড় চিতলের তেলওয়ালা পেটি খায়নি, ধনে পাতা, কাঁচা লংকা দিয়ে। ভাপা ইলিশ খায়নি। বড় গলদা চিংড়ির মাথা ভাজা খায়নি। যাক কী পাইনি, কী খাইনি, তার হিসাব মিলাতে আজ ইচ্ছে করছে না পৃথুর। আজ, ও আর কুর্চি একা বাড়িতে। কত গল্প; কত মজা। শুধু ও আর কুর্চি। পাঁচ বছর পর!

এক ঝাঁক টিয়া সবুজ মেঘের মতো নীল আকাশে তীক্ষ স্বরের চাবুক মেরে উধাও হয়ে গেল শাঁওন নদী পেরিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে, দ্রুতবিলীন স্মৃতির মতো, কাঁপতে কাঁপতে। বাইরে কাঁচপোকার মতো রোদে কার্তিকের গায়ের তিক্ত কটু গন্ধ ভাসছে। উড়ছে। নামছে; মনমৌজী হাওয়ারই সঙ্গে সঙ্গে, পাখির মতো। কুর্চির বাগানে অনেকই পাখি। সব পাখিই সুন্দর। কেবল একটিই বিচ্ছিরি। সে পাখির নাম পৃথু।

এমন সময় একটা স্কুটারের আওয়াজ পেল নির্জন পথটাতে। তারপরই দেখা গেল। গাঢ় লাল-রঙা স্কুটার। লম্বা চওড়া ভদ্রলোক ব্যাংলনের একটা গোলাপি গেঞ্জি ও নীলরঙা স্ট্রেচলনের ট্রাউজার। নেমে ধাক্কা দিয়ে গেট খুলে আবার স্কুটার চালিয়েই চলে এল ভিতরে। বাগানে যে ছোট চালামত আছে, তার নীচে সেটাকে রেখে, হাঁক দিল দাঈ-ঈ, গেট বন্ধ কর দেনা জী। দাঈ…

প্রথমে চিনতেই পারেনি পৃথু। পাঁচ বছর আগে দেখেছিল বিয়ে করতে আসা নবাগন্তুককে। ভাঁটু। কুর্চির বর!

বসবার ঘরে ঢুকে পৃথুকে দেখেই বলল, আররে? পিরথু দা যে! আজীব আদ্‌মী তো। আপনার খোঁজেই তো গেছিলাম। দেখুন, ধুলোয় কেইসা ভূত বনে গেছি। সুকরার ঠিক পরেই যে কজওয়েটা মেরামত না হচ্ছে, সেইখানে ডাইভার্সন! রাম কহো! কী ধুলো! হালত সাচমুচ খারাব হো গ্যায়া। ঔর শুনাইয়ে খাল খরিয়ৎ সব ঠিক্কে না?

সব ভাল। রুষা বাড়ি ছিল না? কখন গেছিলেন ওখানে?

হ্যাঁ। হ্যাঁ, ছিল তো। আভ্‌ভিত আ রহা হ্যায়, হুঁইয়েসে।

ও, ছিল তাহলে। কটা বেজেছে এখন ভাঁটুবাবু?

লজ্জা করল পৃথুর। ওকে খাইয়ে দিল না রুষা! ছিঃ!

এখন প্রায় সোয়া একটা হল? কেন? কী হল? এত তাড়া কীসের? আমি তো সামমে আবার যাব ভাবির কাছে। ইদুরকার সাহেব ভি আসছেন। একটা মিটিং ডেকেছেন ভাবি। হাটচান্দ্রাতে কিশোরকুমার নাইট কোরাবার কোথা শোচছি আমরা। মোহিলা সোমিতিকো যো ভি রূপেয়া বাঁচেগা, সব্‌হি দে দেগা। কুর্চি বোলছিল, কোনিকা বনার্জী আর সুবিন রয়কে আনতে।

কী বলল রুষা?

ভাবি বললেন, ছোড়ো, ভাঁটু। রভীন্দর সঙ্গীত-ফঙ্গীত নেহি চলেগা হিঁয়া। আইদার কিশোরকুমার+অমিতকুমার নাইট, নেহি তো আনন্দশংকরকা পার্টিকা বোলা লেও। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারকা ভি দাওয়াত দিতে পারো।

একটু চুপ করে থেকে ভাঁটু বলল, রভীন্দরসঙ্গীত কা জামানা খতম হো গ্যায়া! আভ্‌ভি কুছ ঝিং-চ্যাক্‌ জিগ্‌লিং-ঝুম-ঝুম মিউজিকোঁকো ওয়াক্ত হ্যায়! আপনি কী বোলেন দাদা?

এ সবের আমি আর কী বুঝি বলুন? আপনি খেয়ে এলেন না ওখানে! এত বেলায় এলেন?

খেয়েছি তো। আলবাৎ খেয়েছি। ফ্রেশ লাইম। উইথ ওয়াটার। আপনার আয়া মেরি, নিম্বু চিপে ফ্রিজ-এর পানি দিয়ে ফারস্ট ক্লাস সোরবৎ কোরে দিল।

দুপুরের খাওয়াটাই আপনি খেয়ে এলেন না?

সত্যিই খুব অপরাধী লাগছিল পৃথুর।

আরেঃ! আপনি কি পাগল আছেন? উইদাউট অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বোলা নেই, কোওয়া নেই, হুট করে খাওয়া যায় নাকি? আজকাল সোব ফ্যামিলিতেই গিনতি-করা লোক। এ তো আর আগের জামানা নেই যে, ওনেকেরই খানা বেশি থাকছে রোজই। তাছাড়া রুষা ভাবি আপনার বহুতই ডিসিপ্লিনড হচ্ছে। আমি বহুতই অ্যাডমায়ার করি। বেটা-বেটিও কী চোমকার হোলো দাদা আপনার। বউদি ডাকলেন, ইনট্রোডিউস কোরবার জন্যে। এক সেকেন্ড করে এল, বাও করল, পাক্কা সাহেবের বাচ্চার মতো বলল, হাই! আঙ্কল! তারপর নিজের নিজের ঘোরে চলে গেল। ভাবির কাছ থেকে শেখার বহুত কুছ আছে।

কুর্চি কফি নিয়ে এল। ভাঁটুকে দেখে বলল, খাবে তুমি?

দুসস। আমি বিয়ার লেব। আছে তো ফ্রিজ-এ। কী হল? এই ওবেলায় কফি? বিয়ার চোলবে তো? চোলবে। চোলবে চোলুক।

আবারও পৃথুর মন খারাপ হয়ে গেল। লজ্জা তো হলই। এই অবেলায়, রোদ মাথায় করে যখন ভাঁটু হাটচান্দ্রাতে গেল, তখন ওকে খাইয়ে দিলে কী হত রুষার? একদিন যদি একজন লোক বেশিই খায় উইদাউট নোটিস-এ, তাহলে কি ক্ষতি হয়? নিজেরা না হয় সকলে একটু কম কমই খাওয়া যেত!

আর এখানে বসে কী-ই বা লাভ! কুর্চিকে তো আর একা পাবে না। ভাঁটু তার ভাঙা-ভাঙা বাংলায় ভট ভট করে কন্টিয়াসলি কথা বলে যাবে। অনেকেরই মতো, নিজের গলার স্বরকে ভাঁটু খুবই ভালবাসে। পৃথুরা, ওরা নিজেরাও অনেকদিন প্রবাসী। কিন্তু ভাঁটুর মতো ভাঙা বাংলা ওদের পরিবারের কেউই বলে না। আসলে, ভাঁটুটা অশিক্ষিতও বটে। কী দেখে যে বিয়ে করেছিল কুর্চি, সেই-ই জানে।

পৃথু বলল, আমি উঠলাম।

সে কি?

আহত ও অবাক গলায় কুর্চি বলল।

আরে বোললাম তো বিয়ারসিয়ার খেয়ে ডাটকে খনা খেয়ে স্কুটারে দুজনে বসে সামকা টাইম্‌মে চলে যাব। এখন যাবেনই বা কিসে? এই ধুপ-এ? আসলেন কিসে?

গাড়িতে।

মিথ্যা কথা বলল পৃথু। ভাঁটুর হাত থেকে বাঁচতে।

গাড়িতে? কোথায় গাড়ি?

আছে। বাজারে।

বাজারে? আমি তো এই-ই আসলাম। বাজার হয়ে। কোনও গাড়ি তো দেখলাম না। স্রিফ চান্‌চানীদের জিপটাকে দেখলম।

কাছেই গেছে। কাজে পাঠিয়েছি। এসে যাবে, মানে এসে গেছে এতক্ষণে।

আররে। কী যে বলেন দাদা। আপনার দিমাগই খারাপ। হাটচান্দ্রাতে গাড়ি তো আপনার দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম আপনার বাড়িরই পোর্টিকোতে। আপনারই গাড়ি তো হচ্ছে? নাকি? নেভি-ব্লু রঙা আম্বেসোড়র। ফোরটিন সিক্সটিন নাম্বার। ঠিক কি না?

পৃথু বিরক্ত হল। ছোকরাটা বড় স্টাবর্ন। আর এঁড়ে তক্ক করে। যাদের কোনও কাজ কম্ম নেই, তারাই যত রাজ্যের গাড়ির নাম্বার মুখস্ত করে রাখে।

বলল, আমার নিজের গাড়ি নিয়ে আসিনি। ভুচুর গ্যারাজ থেকে একটা…

ভুচু? কে ভুচু? কুর্চি শুধোল।

আছে। ওর মোটর গারাজ আছে। মান্দলাতে ছিল আগে। তার আগে জবলপুরে।

তাই-ই। বলল কুর্চি।

পৃথু সোজা উঠে পড়ে, বাগানের দিকে এগোল। গেট খুলে পথে যাবে বলে।

কুর্চি কথা না বলে পেছন পেছন এল।

গলা নামিয়ে বলল, কী হল? হলটা কী আপনার? কফিটা অন্তত খেয়ে যান। কি?

নাঃ। আমি যাই কুর্চি।

মাঝে মাঝেই এমন অশান্ত অবুঝ হয়ে ওঠে ও। ও এমন এমন সময় নিজেকেও বোঝে না।

কুর্চি গেট অবধিই এল, খালি পায়েই। পেছন পেছন।

দুদিকে দুটি কদম গাছ। মুখ তুলে ভাল করে তাকাল কুর্চি পৃথুর দিকে। বলল, আপনি ভারী অসভ্য হয়েছেন। ছিঃ!

চিরদিনই ছিলাম। চলি।

আবার আসবেন। কি? আসবেন না?

দেখি।

চিঠি লিখবেন? আগে তো কত লিখতেন?

গলা নামিয়ে কুর্চি বলল।

পৃথু ভাবল বলে যে, চিঠি তো অন্য লোকে হাতিয়ে নিত। কে জানে ভাঁটুই নিত কি না? না, ওর পরিবারের অন্য কেউ? লিখবে কী করে? এখানেও তাই-ই হবে। পরের চিঠি যারা খোলে তারা…

কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

ঠিক আছে।

ঠিক?

ঠিক।

ভাঁটু বসবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি পিরথু দাদা বড্ড জিদ্দি হচ্ছেন। এত জিদ্দি ভাল নয়। আসবেন আবার।

গেট খুলে, পথে পড়ে, শালবনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে লাগল পৃথু, বাজারের দিকে। পিপাসা পেয়েছে। বাজারে গিয়ে দুটো পান খাবে একশ-বিশ জর্দা দিয়ে।

অনেকদূর এসে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ও। কুর্চি তখনও সাদা-রঙা কাঠের গেটের উপরে দুটি হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। জোড়া কদমের নীচে।

আগের মতোই আছে। একটুও বদলায়নি। ভাঁটু ফুল কি কুর্চি ফুলকে বদলাতে পারে? খুবই ভাল লাগল ওর। কুর্চির জন্যে অনেক অনেক শুভকামনা ও হাত না তুলেই কার্তিকের রোদের মধ্যে মিশিয়ে দিল যাতে কুর্চির সারা গায়ে তা গিয়ে ছোঁয়। উড়ে উড়ে, আবিরের মতো; আশ্লেষে।

পৃথু এখন বাড়িতে যাবে না। গেলেই তো অশান্তি। মিথ্যা বলতে পারবে না। বলতেই হবে যে, গেছি, কুর্চির কাছে। বিকেলে আবার মিটিং। বিনোদ ইদুরকার। জিগলিং-ঝুম। ভাঁটু। হুলো বেড়াল। তখনই জানতে পারবে রুষা। রাতে তো বাড়ি ওকে ফিরতেই হবে। তখন…

কপালে আছে…

বাজারে একজোড়া জর্দা পান খেয়ে, জর্দাটা মাথার মধ্যে ব্যাঙাচির মতো লাফালাফি শুরু করতেই ও ঠিক করল, হাটচান্দ্রাতে পৌঁছে বাড়ি না গিয়ে, সাবীর মিঞার দোকানেই যাবে। বহুদিন যাওয়া হয়নি। দোকানে বসেই কাবাব-পরোটা আনিয়ে খেয়ে নেবে।

পানের দোকানের পাশের অশ্বত্থতলার ছায়ায় একটা সাইকেল-সারাই-এর দোকানের কাঠের পাটাতনে বসে রইল পৃথু। বাস আসার প্রতীক্ষায়। পথের নরম ধুলোও প্রতীক্ষায় আছে। কখন কোন দ্রুতগামী যান এসে ওদের উড়িয়ে দেবে বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *