৯৮
লোকটা বিনীতভাবে নমস্কার করে বলল, আপনি এই গ্রামের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, আমরা তার কী প্রতিদান দিতে পারি? কত সামান্য আমরা। এই গ্রামের কোনও গৌরব কখনও ছিল না। আপনার সুবাদে আজ আমরা বলে বেড়াই এ হল কৃষ্ণজীবন বিশ্বাসের গ্রাম।
কৃষ্ণজীবন অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করে বলল, গৌরব! গৌরবের কি আছে? আমি সামান্যই করতে পেরেছি। কত কী পারিনি।
আপনার কৃতিত্ব কতখানি তার পরিমাপ করার মতো শিক্ষাও তো এ গাঁয়ের মানুষদের নেই। তারা শুধু জানে, কৃষ্ণজীবন বিশ্বাস এখন মস্ত মানুষ। তবে আমি আপনার বইখানা পড়েছি। মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে, মনটা যেন কেমন হয়ে যায়। অদ্ভুত আপনার ভাষা, তেমনি পর্যবেক্ষণ।
কৃষ্ণজীবন খুশি হয়ে বলল, আমার বই আপনি কোথায় পেলেন? এ দেশে তো বিশেষ পাওয়া যায় বলে শুনিনি।
লোকটি অমায়িক হেসে বলে, পেপারব্যাক এডিশন বেরোলে হয়তো আসবে। এখনও আসেনি। তবে আমার এক ভাগ্নী নিউ জার্সিতে থাকে। তাকে আপনার বইটির কথা লিখেছিলাম। সে নিয়ে এসেছিল।
একটা তৃপ্তির শ্বাস ছাড়ল কৃষ্ণজীবন। সে খ্যাতি চায় না, প্রচুর টাকাও করতে চায় না, সে চায় তার কথা লোকে শুনুক, বুঝুক। সে তো এই পৃথিবীর মঙ্গল চায়, মানুষের জন্য চায় একটি সবুজ দূষণমুক্ত পৃথিবী। সে চায় দোলনের নিরাপদ বড় হওয়া। ভাবীকালের মানুষেরা যেন তাদের অভিশাপ না দেয়।
লোকটি বলল, আপনার বাবাকে গত তিন দিন ধরে আমি বইয়ের বিভিন্ন অংশ অনুবাদ করে শুনিয়েছি। উনি খুব খুশি হয়েছেন।
কৃষ্ণজীবন আবেগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। বাবাকে যে এ বইটির কিছু অংশ শোনানো দরকার এটাই তার মনে হয়নি। সে গাঢ় কণ্ঠে বলল, বড় ভাল করেছেন। কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো!
কী যে বলেন! এই বইটির কথা আমি অনেককে বলেছি। কিন্তু গ্রামের লোক তো ইংরিজি পড়তে পারে না। আপনি বরং এর একটা বাংলা ভাষ্য বের করুন।
কৃষ্ণজীবন ম্লান হেসে বলে, বাংলা এডিশন বেরোলেও গ্রামের লোকে পড়বে না। প্রথমত, তাদের বই পড়ার অভ্যাস নেই, দ্বিতীয়ত তাদের বই কেনার মতো সামর্থ্য নেই।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কথা। তবু বলি, ধীরে ধীরে এই বইয়ের কদর বাংলাতেও হবে। আমাদের গ্রামগুলোতে সভ্যতার কোনও খবরই পৌঁছতে চায় না। বড্ড পিছিয়ে আছে সব কিছু। তবু যদি লাইব্রেরিতে এক-আধ কপি করে রাখা হয় তা হলে এক-আধজনও তো পড়বে।
কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, আপনি এ বইয়ের প্রচার নিয়ে ভাববেন না। এ দেশের লোক আজ পর্যন্ত কারও কোনও শিক্ষাই নেয়নি। আমারটাও নেবে না। ভাল কথা শোনে, বুঝতেও পারে, কিন্তু কাজের সময় পাশ কাটিয়ে যায়।
লোকটি বিনীত হেসে বলে, তবু কি হাল ছাড়লে চলবে?
কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার প্ল্যান কী ছিল জানেন? গান, যাত্রা, নাটক, কবিগানের ভিতর দিয়ে এ সব মানুষকে শেখাবো। গাছ কেটো না, পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখো। কিন্তু পরে হাল ছেড়েছি। দেখলাম এরা এন্টারটেনমেন্টটা নেয়, শিক্ষাটা সাবধানে মাছের কাঁটার মতো বেছে ফেলে দেয়।
লোকটি এ কথায় যেন একটু চিন্তিত হয়ে কৃষ্ণজীবনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মাত্র কয়েকদিন আগে লোকটির সঙ্গে পরিচয়। পটলের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। বছর দুই আগে চাকরি নিয়ে এসেছে। একটু আত্মভোলা, পড়ুয়া ধরনের মানুষ। আশ্চর্যের বিষয় এঁর লেখাপড়া এবং জ্ঞান বেশ বিস্ময়কর। সতীশ ঘটককে কৃষ্ণজীবনের ভালই লাগে।
সতীশ ঘটক ওপর-নীচে মাথা নেড়ে বলল, হিন্দি সিনেমা আর ভিডিওর অত্যাচারও কম নয়। মানুষগুলোকে বড্ড ভোঁতা করে দিচ্ছে। গ্রামে আজকাল চিন্তাশীল, সচেতন লোক নেই। একটা কালচারাল গ্যাপও ঘটে যাচ্ছে। আপনার মতো মানুষকেই গ্রামে দরকার ছিল। কিন্তু গ্রাম আপনাকে তো কিছুই দিতে পারবে না। না চাকরি, না মর্যাদা।
সতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কৃষ্ণজীবন উদাস গলায় বলল, আপনি জানেন না এই বিষ্টুপুর শীতলাতলা আমাকে কত দিয়েছে। আমার জীবনের বোধটাই তৈরি হয়েছিল এখানে। কিন্তু আপনার কথাও মিথ্যে নয়। বিষ্টুপুর আজ আর আমাকে তেমন কিছু দিতে পারে না। তবু বিষ্টুপুর আমার সঙ্গেই থাকে, পৃথিবীর যেখানেই যাই বিষ্টুপুরের সঙ্গে মিলিয়ে সব কিছু দেখি। আপনাকে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারব না।
আমি বুঝতে পারছি।
বিনয়ী মানুষটি উঠে পড়ল। বলল, আমরা স্কুল থেকে আপনাকে একটা সংবর্ধনা দিতে চাই। কবে আপনার সময় হবে?
কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলল, না। সংবর্ধনা মানেই মানপত্র-টত্র তো! ওসব ভারী কৃত্রিম ব্যাপার। অনুষ্ঠানের দরকার নেই। যদি চান তো আমি একদিন ছাত্রদের মুখোমুখি গিয়ে বসব। কথা বলব।
সতীশ উজ্জ্বল হয়ে বলল, সেটাই ভাল হবে। একটা ডেট দিন। সবাইকে জানাতে হবে, ক্লাসে নোটিশ দিতে হবে।
কৃষ্ণজীবন বলল, কাল আমাদের গৃহপ্রবেশ। পরশু অবধি আমি আছি। পরশুই করুন।
সতীশ ঘাড় নেড়ে “যে আজ্ঞে” বলে চলে গেল।
কৃষ্ণজীবন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল বৈঠকখানায়।
এ বাড়িতে মোজেইক করা বৈঠকখানা হয়েছে, তাতে সোফাসেট সাজানো হয়েছে, রঙিন টি ভি এসেছে—এ সব প্রায় রূপকথার মতো। তবু হয়েছে। মিথ্যে নয়। এই পরিবর্তনটার কথাই ভাবছিল কৃষ্ণজীবন। তার অতীতের দারিদ্র্য, তার লড়াই, তার কষ্টের বড় হওয়ার ভিতর দিয়ে একটা সাফল্যের পরিণতি এসেছে। কিন্তু এটাকেই কি সফলতা বলে? দরিদ্র থেকে ধনী হয়ে ওঠা? অখ্যাতি থেকে খ্যাতির স্পষ্টতায় আসা? শুধু এইটুকু? কৃষ্ণজীবনের কাছে সফলতার সংজ্ঞা কিছু আলাদা। এখনও কত কী করার আছে তার। এখনও কত কাজ বাকি, কত সিঁড়ি ভাঙতে হবে তাকে। পৃথিবীর মুখ থেকে মৃত্যুর পাণ্ডুরতা যতক্ষণ দূর না হয় ততক্ষণ তার বিশ্রাম নেই, থামা নেই।
গৃহপ্রবেশ বড় করেই হচ্ছে। অনেক লোকের নেমন্তন্ন। টাকাটা কৃষ্ণজীবনই দিচ্ছে। এটুকু সে আজকাল পারে। ডারলিং আর্থ বাবদে সে পনেরো লাখ টাকা পেয়েছে, আরও দশ-পনেরো লাখ এসে যাবে। দ্বিতীয় বইয়ের জন্য প্রকাশক আগাম দিচ্ছে শিগগিরই। কৃষ্ণজীবনের সামনে এখন অভাবিত ঐশ্বর্যের দরজা খোলা। তবু তার মন থেকে বিষণ্ণতা যায় না।
অভাব তাকে দুঃখী করে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু টাকা তাকে কখনোই সুখী করেনি। রিয়ার সঙ্গে এই টাকা নিয়েই অশান্তি হচ্ছিল। দিন কুড়ি আগে রিয়াকে পাঁচ লাখ টাকার চেক দিয়েছিল সে। রিয়ার মুখে হাসি ফুটল, সব অশান্তি দূর হয়ে গেল। টাকার এই আশ্চর্য শক্তি শুধু কৃষ্ণজীবনের ওপরেই কেন যে ক্রিয়াশীল নয়, কে জানে! টাকার খেলায় তার মা-বাবা-রামজীবনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। শুধু সে কেন পারল না খুশি হতে?
এ প্রশ্নটার জবাব খুঁজতেই যেন বেরিয়ে পড়ল কৃষ্ণজীবন। ডেকে নিল পটল আর গোপালকেও। সকালের আলোয় শীতের বিষ্ণুপুরের কিছু শোভা আছে। ন’পাড়ার মজা দীঘি আমবাগান, বটেশ্বরের বাঁশবনের ভিতরকার সঁড়ি পথটা, জোড়া পুকুর। দেখার চোখ থাকলে এই বিষ্ণুপুরই কত কী দেখাতে পারে। কৃষ্ণজীবনের রূপমুগ্ধ চোখদুটি আজও নষ্ট হয়নি।
পটল বলল, বড় জ্যাঠা, কোনদিকে যাবে?
যেদিকে খুশি চল।
হরিজ্যাঠার ওখানে খেজুরের রস পেড়েছে। খাবে?
কৃষ্ণজীবন হাসল, চল।
হরিহর গুড়ের কারিগর। মেলা খেজুরগাছ আছে তার। সুন্দর মেটেবাড়ি, নিকোনো দাওয়া।
হরিদা আছে নাকি? বলে কৃষ্ণজীবন হাঁক মারতেই হরিহর বেরিয়ে এল। গলায় কণ্ঠি, কপালে তিলক। গায়ে এই শীতেও একখানা বেনিয়ান মাত্র।
ওরেব্বাস রে! কেষ্টবাবু যে! এসো, এসো!
সবাই জানে, কৃষ্ণজীবন এখন মস্ত মানুষ। কতটা মস্ত তার আন্দাজ অবশ্য নেই। কিন্তু যার সঙ্গেই দেখা হয় সে-ই বিস্তর খাতির-টাতির করে। জ্যাঠার এই খাতির খুবই উপভোগ করে পটল। দেখ কেমন একখানা জ্যাঠা আমার! আছে তোমাদের এরকম?
হরিহর উঠোনে মোড়া আর জলচৌকি পেতে দিয়ে বসাল। তারপর রসের হাঁড়ি আর গেলাস এনে রস খাওয়াল। বলল, আজকাল তো আর আসা-টাসা হয় না? খুব নাকি বিলেত-টিলেত ঘুরে বেড়াও?
তা ঘুরি।
বেশ বেশ। আমাদের যে মনে রেখেছে এটাই ভাগ্যি। এক হাঁড়ি নতুন গুড় নিয়ে যেও এবার কলকাতায়। দিয়ে আসব’খন।
রস খেয়ে তারা আবার বেরিয়ে পড়ে।
জ্যাঠা, তুমি এখনও খুব হাঁটতে পারো, না?
তা পারি।
তোমার সঙ্গে হাঁটায় পাল্লা দেওয়া কঠিন কাজ।
কৃষ্ণজীবন একটু হাসল।
খানিকক্ষণ বাদে পটল হঠাৎ বলল, জানো তত বড় জ্যাঠা, আজকাল আমি ক্লাসে ফার্স্ট হই।
কৃষ্ণজীবন হঠাৎ থমকে গিয়ে বলল, তাই নাকি? কই, কেউ বলেনি তো আমাকে!
আমার লেখাপড়ার কথা বাড়িতে কেউ জানেই না। জিজ্ঞেসও করে না। দাদু কিছুদিন পড়াতো। আজকাল নিজেই পড়ি। হিমাদ্রি স্যার আমার রেজাল্ট দেখে কি বলেছে জানো? বলেছে, এও কৃষ্ণজীবনের মতো হবে।
তোকে কেউ পড়ায় না?
না তো! এখন নিজেই পড়ি। শক্ত লাগলে হেডস্যার বা অন্য সব স্যারের কাছে পড়া বুঝে নিই।
কৃষ্ণজীবন একটু ভেবে বলল, কোন ক্লাস হল তোর?
নাইন।
ওরে বাবা, তুই তো বড় হয়ে গেছিস।
পটল হাসল, বড়ই তো।
কত লম্বা হয়েছিস বল তো!
মাপিনি তো! তবে সাড়ে পাঁচ ফুট বোধহয়। তুমি কিন্তু খুব লম্বা। আমি অত লম্বা হবো না বোধহয়।
খেলিস?
হ্যাঁ। ফুটবল, ক্রিকেট। স্পোর্টস-এও প্রাইজ পাই। তুমি পেতে?
কৃষ্ণজীবন হাসল, পেতাম। তবে তখন ভাত জুটত না, বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে সাহস হত না, পাছে খিদে পেয়ে যায়। ওই খিদের ব্যাপারটা থাকা ভাল, বুঝলি? খিদে মরে গেলে জীবনটা আলুনি হয়ে যায়।
বুঝেছি।
খিদে কিন্তু নানারকম আছে। যত বড় হবি, টের পাবি।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হেঁটে তারা একটা পুকুরের ধার পেরিয়ে গেল। কৃষ্ণজীবন জলের দিকে চেয়ে বলল, সাঁতার জানিস?
হ্যাঁ।
এই পুকুরটায় আমি সাঁতার শিখেছিলাম, মনে আছে।
বিস্ময় আর আনন্দে পটল বলে উঠল, আমিও তো এটাতেই শিখেছি জ্যাঠা।
কৃষ্ণজীবন হঠাৎ প্রশ্ন করে, জল তোর কেমন লাগে?
জল! জল খুব ভাল লাগে।
বাঁ ধারে একটা সজনেগাছে বৃষ্টিধারার মতো অজস্র কচি সজনে ঝুলে আছে। কৃষ্ণজীবন দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, জল আর মাটি, মাটি আর জল! কত কী করতে পারে।
বড় জ্যাঠাকে খানিকটা বুঝতে পারে পটল, অনেকটাই পারে না। এই যে জ্যাঠা কেমন আনমনা আর বিষন্ন হয়ে গেল, কেমন গুটিয়ে পড়ল নিজের একটা অদৃশ্য খোলের মধ্যে, এই জ্যাঠাকে বুঝতে পারে না পটল। তবে তার ঠিক জ্যাঠার মতোই হতে ইচ্ছে করে।
কৃষ্ণজীবন হঠাৎ প্রশ্ন করে, লাঙল চালাতে পারিস?
না। কখনও চালাইনি।
শেখা ভাল। মাটির সঙ্গে একটা বুঝ হয়।
আচ্ছা জ্যাঠা।
গাছ চিনবি, বীজ চিনবি, ঋতুচক্র চিনবি, খনার বচন শিখবি। পাখি, পোকামাকড় এ সব লক্ষ করিস? গাছপালা?
একটু-আধটু।
একটু-আধটু নয়, ভাল করে। যা করবি ভাল করে করবি। শুধু বই পড়লে শেখা হয় না। জীবন থেকেই পাঠ নিতে হয়। চারদিকে তোর কত মাস্টারমশাই দেখেছিস? ওই রোদ, আকাশ, গাছপালা, প্রজাপতি, চড়াইপাখি, সব তোর মাস্টারমশাই। পাঠশালা সাজিয়ে বসে আছে।
পটল হাসল, বুঝেছি।
কৃষ্ণজীবনও হাসল। বলল, আমি সামান্যই পেরেছি। তুই অনেক পারিস।
তুমি কত জানো!
শীতলাতলায় আজ হাটবার। মেলা লোকজন। গিসগিসে ভিড়। কৃষ্ণজীবন ভাইপোদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে হাট দেখল। দর জেনে নিল অনেক কিছুর। তারপর বলল, এখানে বোধহয় একটু সস্তা।
হ্যাঁ জ্যাঠা, এখানে কলকাতার চেয়ে অনেক সস্তা। সবাই বলে।
জিলিপি খাবি? আগে নিরাপদর দোকানে জিলিপি ভাজত, এখনও কি আছে সেই দোকান?
পটল নাক কুঁচকে বলল, আছে। তবে আজকাল আর ভাল নেই। এখন ইন্দ্রনীল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ভাল জিলিপি করে।
ইন্দ্রনীল বেশ পরিচ্ছন্ন দোকান। পাকা ঘর, টেবিল চেয়ার আছে।
কৃষ্ণজীবন পটলকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, এরা শালপাতার ঠোঙায় জিলিপি দেয় না?
না জ্যাঠা, প্লেটে দেয়।
ধুস। শালপাতা না হলে জিলিপি খেয়ে সুখই নেই।
ইন্দ্রনীলের মালিক উমাপদ অবশ্য কৃষ্ণজীবনকে চেনে। সে শশব্যস্তে মান্য অতিথির জন্য শালপাতা নিয়ে এল, যত্ন করে বসিয়ে গরম জিলিপি ভাজিয়ে দিয়ে বলল, কেমন হয়েছে আত্তে।
কৃষ্ণজীবন জিলিপিতে কামড় দিয়ে নিমীলিত চোখে উমাপদর দিকে চেয়ে বলল, আমাকে আপনি-আজ্ঞে করছো কেন? তুমি তো আমার সঙ্গে পড়তে। ক্লাসমেট।
উমাপদ লজ্জায় ঘাড় নিচু করে বলল, সে কবেকার কথা! তুমি এখন কত বড় হয়েছো। তাতে কি সম্পর্ক বদলায়? তোমার ছেলে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়, তাকে কি আপনি-আজ্ঞে করবে?
তা নয়। প্রথমটায় ভরসা পাচ্ছিলাম না, চিনতে পারবে কি না, মনে আছে কি না।
আমার স্মৃতিশক্তি সাংঘাতিক। কিছু ভুলি না।
উমাপদ বিগলিত হয়ে গেল। বলল, গরম সিঙাড়া খাবে? কড়াইশুটি আর ফুলকপি দিয়ে করে দিচ্ছি।
না উমাপদ, থাক। কত দাম বলো তো জিলিপির?
ও তোমাকে দিতে হবে না। চিনতে পেরেছে এতেই আমার দাম উঠে গেছে।
কৃষ্ণজীবন তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা দামী ক্যালকুলেটর বের করে উমাপদর হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখো, তোমার কাজে লাগবে।
ও বাবা, এ তো দামী জিনিস।
রাখো। হিসেবের সুবিধে হবে।
উমাপদ খুব লজ্জার সঙ্গে হাসল, আমাদের যা হিসেব তা তো মুখে মুখেই হয়ে যায়। যন্ত্র লাগে নাকি?
ঠিক কথা। ক্যালকুলেটর হাতে থাকলে মানুষ দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করতেও মাথা ঘামায় না, বোতাম টেপে। যন্ত্র খুব খারাপ জিনিস।
উমাপদ এক ঠোঙা জিলিপি বেঁধে পটলের হাতে দিয়ে বলল, তোর দাদুকে দিস। আগে খুব আসতেন, আজকাল আসেন না।
জ্যাঠা, এখন বাড়ি যাবে?
না না, এখনই কি? চল, এখনও কত দেখার আছে।