2 of 3

৯৭. পৃথিবীর রূপের জগৎ

৯৭

সে বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে এই পৃথিবীর রূপের জগৎ তার চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে। অফিস আর বাড়ি, টুর আর টাকা তাকে ক্রমে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল। টাকার কুমিরদের সঙ্গে দিন-রাত ফন্দি-ফিকির করতে করতে নিজেকে প্রায় কবর দিয়ে ফেলছিল হেমাঙ্গ। সেই কবর থেকে, জীবনের ভার সরিয়ে সে কি একটু একটু করে উঠে আসছে রোদে আর হাওয়ায়? এ কি তার উত্থান? লোকে বলছে, এ তার অধঃপতন, লোকে বলছে, এ তার পাগলামি। একটা লম্বাটে ক্যাটারপিলার গোত্রের সরীসৃপ পোকাকে পেয়ারা গাছের ডালে আর পাতায় অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছিল তার চোখ। সবুজ রঙের পোকাটার শুধু দেহযন্ত্রটা লক্ষ করতে করতে বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল সে। কত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের সমাবেশ, কত স্বচ্ছ ও শৌখিন তার চামড়া। শুধু শরীরই তো নয়, ও তুচ্ছ পোকাটারও আছে বিপদ আঁচ করার অ্যান্টেনা, আছে জৈব অনুভূতি, আছে ক্ষুধা ও প্রজনন, হয়তো আছে সন্তান পালন করার মতো দায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এইসব পোকামাকড়কে যত দেখে সে ততই সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর এই জগৎ তার কাছে উন্মোচিত হয়। এর পরও আছে জীবাণুরা, অনুবীক্ষণ ছাড়া যাদের দেখাই যায় না। অথচ জীবাণুরও আছে ইন্দ্রিয়সকল, আছে বংশবিস্তার, আছে নিজস্ব জগতের অনুভূতি। কি করে এটা হয়? কে ঘটায় এই সমন্বয়? কে আছে এই মরকোচ বা মেকানিজমের পিছনে? এই রহস্যের কূলকিনারা না পেয়েই কি মানুষ অবশেষে ঈশ্বর নামক অলীককে কল্পনা করে নিয়েছিল?

অলীক! হবেও বা। তবে হেমাঙ্গ আজকাল এত সহজে কিছুই উড়িয়ে দিতে পারে না। আজকাল সে নদীর ধারে বসে কত ভাবে। কত আকাশ-পাতাল চিন্তা করে। কোথাও পৌঁছায় না তার চিন্তা, কিন্তু হেমাঙ্গর তাড়া নেই। পৌঁছনো কি একান্ত দরকার? থাকুক না কিছু অধরা!

আজকাল আসতে হয় উইক এন্ডে। গাঁয়ে বেশি পড়ে থাকলে বিপদ আছে। মা রাগ করে। ছেলে বিবাগী হয়ে যাচ্ছে এই ভয়ে মা কোমর বেঁধে লেগেছে তাকে গৃহবাসী করতে। পাত্রী দেখা চলছে খুব।

হেমাঙ্গ মাঝে মাঝে একা একা হাসে। তাকে পাত্ৰীস্থ করে কোনও লাভ হবে কি? বরং বউ হয়ে যে আসবে সেই মেয়েটা কষ্ট পাবে। হেমাঙ্গ কি সংসারী হতে পারবে কখনও? জগতের বিশালত্বে সে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে, এই ছড়ানো হেমাঙ্গকে কি আবার গুটিয়ে এনে ছোট্টো কৌটোর মতো সংসারে পুরে রাখা যাবে? তা হলে কি বাঁচবে হেমাঙ্গ?

বাঁকা মাঝে মাঝে তার কাছে এসে বসে থাকে। খুব ঠাহর করে লক্ষ করে তাকে। সতর্ক চোখে তাকে জরিপ করতে করতে বলে, সন্নিসী হওয়াই কপালে লেখা আছে আপনার।

তাই নাকি?

তা নয় তো কি?

এ ঠিক সন্ন্যাস নয় বাঁকা মিঞা। নৌকো বার-দরিয়ায় গিয়ে পড়েছে। সহজে ফিরবে না। সেটা সন্ন্যাস নয়, বাউণ্ডুলে হয়ে যাওয়া বলতে পারো।

সেটাই কি ভাল?

জীবনটা যে কত বড় তা বোঝো?

আমাদের বোঝায় কেডা?

ও বোঝানো যায় না, আপনি বুঝতে হয়।

তা বটে। আমাদের বুঝও যে বড্ড কম। তবে আপনার বড্ড বেশি।

আমার গাঁয়ের বাস তো মার কাছে লাগিয়ে ভাঙিয়ে প্রায় তুলেই দিয়েছ তুমি। এর পর আরও কি চাও?

গাঁয়ের বাস তুলে দিচ্ছি আপনার ভালর জন্যই। এর পর একেবারে লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাবেন যে। গাঁয়ের লোক আপনাকে আড়ালে কি বলে জানেন? বলে পাগলাবাবু, অবশ্য আদর করেই বলে, আপনার ওপর কারও কোনও খার নেই। তবে ওসব শুনতে কি আমার ভাল লাগে, বলুন।

হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমি তো পাগলই। লোকে যখনই জীবনের সবচেয়ে সত্য বস্তুর সন্ধান পায় তখনই কি করে যেন লোকের চোখে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে মনে হয় লোকটিকে। তা সে লোকে যাই বলুক আমার কিছুই যায়-আসে না।

আরও একটা কথা। আপনার বাড়ির লোকের ধারণা হয়েছে, আপনি এই গাঁ-গঞ্জেই একটা বিয়েসাদি করে বসবেন হয়তো। তা হলে ষোলো কলা পূর্ণ।

হেমাঙ্গ একটু অবাক হয়ে বলে, তুমি এটাও মাকে বুঝিয়েছ নাকি? তুমি তো মহা বিপজ্জনক লোক!

জিব কেটে বাঁকা বলে, মিছে কথা বলব আপনার নামে? ওসব নষ্টামো করতে যাব কেন? কিছু বলিনি। তবে আপনাকে একটা বিষয়ে একটু সাবধান করে দিই। নগেন সামন্তর মেয়েটা বড্ড ঘুরঘুর করছে আজকাল। অত আসকারা দেবেন না।

পারুল! সে তো পড়তে আসে মাঝে মাঝে।

বয়সের মেয়ে, বুঝলেন না! গাঁ-গঞ্জ জায়গা, পাঁচটা কথা উঠে পড়বে।

হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, সে তো বাচ্চা মেয়ে! তোমরা কিরকম মানুষ বলো তো! ওটুকু মেয়েকে নিয়েও কথা হয়?

টুকু আবার কি? যোলো বছর বয়স হল।

ধুস! বারোর বেশি হতেই পারে না।

আপনার কি দেখার চোখ আছে? অত উদাস থাকলে ওরকমই হয়। ও মেয়ের বয়স পনেরো পুরে এই ষোলো চলছে। সন্ধের পর টর্চ বাতি নিয়ে পড়তে আসার অত কি গরজ? আর পড়া মানে তো হাঁ করে আপনার মুখের দিকে চেয়ে থাকা। আপনি আর ওসব একদম ঘাড়ে নেবেন না।

হেমাঙ্গ একটু অসহায়ভাবে চুপ করে রইল। পারুল তার কাছে পড়তে আসছে মাত্র মাসখানেক হল। তাও সপ্তাহে মাত্র দু’দিন, শনি আর রবিবার, যখন হেমাঙ্গ এখানে আসে। নগেন সামন্ত নিজেই নিয়ে এসে বলেছিল একদিন, বাবু, আমার এ মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল। সবাই বলে, মাথা আছে। ক্লাসে ফার্স্টও হয়। যদি আপনি একটু দেখিয়ে দেন তাহলে আরও ভাল করবে।

সেই থেকে একটু করে পড়ায় হেমাঙ্গ। মেয়েটার মাথা সত্যিই ভাল। গাঁয়ে-গঞ্জে— কে জানে কেন— ছেলেমেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চাড় এবং মেধা নেই। এই মেয়েটার আছে দেখে হেমাঙ্গ একটু উৎসাহ বোধ করেছিল। পারুল দেখতে খুব সাদামাটা গেঁয়ো আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে সামান্য আলাদা চেহারার। চোখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে। কিন্তু তার বয়স এতই কম যে তাকে পুরুষের চোখ দিয়ে কখনও লক্ষই করেনি হেমাঙ্গ।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ভুলটা আমারই। গাঁয়ের মেয়ের বয়স আর শহরের মেয়ের বয়সের যে আলাদা হিসেব সেটা মনে ছিল না, বুঝলে বাঁকা?

আপনার বরাবরই হিসেবের ভুল। অথচ আপনি নাকি হিসেবের ওস্তাদ।

হেমাঙ্গ একটু ভয়ে ভয়ে বলে, গাঁয়ে কি পারুলকে নিয়ে কথা উঠেছে নাকি? না আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?

বাঁকা মিঞা ঘাড় চুলকে বলল, কথাটা ওঠেনি, তবে উঠে পড়বে। আমি আপনাকে আগাম একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলাম। সামন্তকেও বলে দিয়েছি যেন বাবুকে আর ডিস্টার্ব করা না হয়।

হেমাঙ্গ হেসে বলল, তুমি আমার মাকেও ছাড়িয়ে গেলে দেখছি।

আমি হলাম আপনার লোকাল গার্জেন। ঠাকরুন তাই বলে দিয়েছেন।

তা হলে তো কথাই নেই।

আপনি কিন্তু আমার প্রথম কথাটার জবাব দেননি। বলছি এ ভাবেই কি চলবে? সাধু-সন্ন্যাসীই হয়ে যাবেন শেষ অবধি?

তা আর হতে পারলাম কই। সাধুরা তো জপতপ করে, আমি তো তা করি না। আমি শুধু পৃথিবীটা দেখি। চার দিকে কত রূপ বলো তো! ছোট্ট একটা পোকা, একটা ফুল, একটা পাতার মধ্যেও কত সূক্ষ্ম মেকানিজম আর এসথেটিক্স! তুমি দেখতে পাও না?

তা পাই, তবে আপনার মতো অমন মজে যাই না। শুধু দেখে বেড়ালে কি জীবন চলে? এবার একটু সংসারী হওয়ার কথাও ভাবুন।

হেমাঙ্গ শুধু হাসল, কিছু বলল না। বাঁকা মিঞা আরও কিছুক্ষণ সদুপদেশ দিয়ে উঠে গেল। লোকটা যে তাকে ভীষণ ভালবাসে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর ভালমন্দের বোধটা অন্যরকম।

গতকাল শুক্রবার ছিল। অফিস থেকে দুপুরবেলা বেরিয়ে সে সোজা চলে এসেছে এখানে। এখানে যেন গাছপালা, পোকা-মাকড়, বাতাসটা অবধি তার জন্য অপেক্ষা করছিল। এসব কথা সে কাকে বোঝাবে? এখানে আকাশে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা, জলের লহরী, পাতার কাঁপন, উড়ন্ত পোকার পাখনায় আলোর বর্ণালী সে ছাড়া আর কে দেখবে? এখানে এসে সে কত শিখেছে, কত কি বুঝতে পেরেছে, অনুভূতি হয়েছে কত সূক্ষ্ম! তাকে কেন পাগল ভাবে লোক?

উঠোনে নতুন শীতের সকালবেলার রোদ চাদরের মতো বিছিয়ে পেতে দিয়ে গেছে কে। সেই চাদরে গাছপালার ছায়ার নানা নকশা। উঠোন নিকোনো, তকতকে। এ সবই করে বাসন্তী।

বাসন্তীর কথা ভাবতে ভাবতেই বাসন্তী চলে এল। একদিন বাসন্তীকে বলেছিল হেমাঙ্গ, হ্যাঁ রে, অত নোংরা উলোঝুলো হয়ে থাকিস কেন? পরিষ্কার থাকতে পারিস না? সেই থেকে বাসন্তী এখন ফরসা শাড়িই শুধু পরে না, চুল বাঁধে, মুখে বোধ হয় পাউডারও দেয়, তারপর আসে।

আজ এসেই বলল, ও দাদা, গত সোমবার থেকে ব্রাশ আর পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজছি, তা জানো? কী ভাল গো স্বাদটা! মুখটা যেন মিষ্টি হয়ে যায়।

হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, তুই বোধ হয় দাঁত মাজতে গিয়ে পেস্ট একটু খেয়েও ফেলিস!

লজ্জা পেয়ে বাসন্তী বলে, দু-একবার কি আর গিলে ফেলিনি! তবে ব্রাশে বাপু মুখে বড় জ্বালা করে প্রথমটায়। ছড়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য সয়ে গেছে। মুড়ি এনেছি, এই দেখ। সকালে ভাজিয়ে আনলাম সুবাসীর বাড়ি থেকে।

এই বলে একটা প্ল্যাস্টিক ব্যাগ তুলে তাকে দেখায় বাসন্তী।

হেমাঙ্গ নিস্পৃহ গলায় বলে, চা কর।

লহমায় চা করে নিয়ে এল বাসন্তী। সঙ্গে গরম মুড়ি, একটু তেল আর আদাকুচি দিয়ে মাখা, ওপরে কয়েক দানা বাদাম ছড়ানো। বাসন্তী রোজ সকালে তার সামনে বসে চা খায় আর আগড়ম-বাগড়ম বকে।

তোমার মুখখানা আজ শুকনো দেখাচ্ছে কিন্তু দাদা।

হেমাঙ্গ গভীর চিন্তামগ্ন ছিল, বলল, হুঁ।

আজ কী খাবে বলো তো!

খাওয়ার এখনও দেরি আছে। অত তাড়া দিস না।

জোগাড়যন্তর তো করতে হবে। ফুলু বেলা দশটা নাগাদ মাছ দিয়ে যাবে। শুধু মাছের ঝোল আর ভাত করলে হবে? সঙ্গে একটা ভাজাভুজি করে দেবোখন। হবে? বলো না।

খুব হবে।

বাসন্তী উঠে গেল। তার অনেক কাজ এখন। ঝাঁটপাট, বাসন মাজা, নিকোনো, বিছানা তোলা। বাসন্তী গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কাজ করে, দাওয়ায় বসে শুনতে পায় হেমাঙ্গ। ধীরে ধীরে উঠে সে চটিটা পরে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। ইট বাঁধানো বিচ্ছিরি ভাঙাচোরা রাস্তাটা ধরে সে গাঁয়ের মধ্যে খানিকটা হেঁটে যায়। যত দিন যাচ্ছে তত লোক বাড়ছে। বছরটাকের মধ্যে ঘাটপাড়ে নতুন নতুন কয়েকটা দোকান হল। খুবই দীন দোকান। তবু তো দোকান। মানুষ বাড়ছে, ফাঁকা জায়গা ভরাট হচ্ছে, অরণ্য বা চাষের জমি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের বসত আর রুজিরোজগার। কৃষ্ণজীবন লড়াই করছেন বটে, কিন্তু লড়াইটা থেকে যাচ্ছে ওপর মহলে। এখনও সেই লড়াইয়ের কোনও প্রভাব এসে পড়েনি এলাকার এইসব মানুষের জীবনযাপনে।

হাঁটতে হাঁটতে বসতি ছাড়িয়ে পতিত জমি আর আগাছার জঙ্গলে এসে পড়ল হেমাঙ্গ। নিত্যই সে নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করে। একটা করে নামও দেয়। তারপর সেই দেওয়া নাম ভুলেও যায়।

ভাঙাচোরা জমি হঠাৎ খাদের মতো ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। নিচে ক্ষয়া জমি, ঘাসপাতা, কিছু অখ্যাত গাছ। তেমন শ্রী নেই জায়গাটার। তবু সকালের রোদের ঐশ্বর্যে কিছু ঝলমল করছে। ঢালুর ধারে একটু ঘাস-জমি খুঁজে নিয়ে সাবধানে বসল হেমাঙ্গ। আজকাল সে আর সুন্দর জায়গা খোঁজে না, হতশ্রী জায়গাতেও সৌন্দর্যের সন্ধান করে। আজকাল এটাই তার হবি। তার জগৎ অনেক বড় হয়েছে।

পাখি ডাকছে। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে উত্তর থেকে। আজ হেমাঙ্গর মন ভাল নেই। আজ হোক, কাল হোক, তাকে ঘরবন্দী করার চেষ্টা একদিন ফলবতী হবেই হয়তো। নিজেকে সে আর বিশ্বাস করে না। রশ্মির প্রেমে পড়ে বিয়ে প্রায় করেই ফেলেছিল আর কি। কী যে হত তা হলে। ভাগ্যিস রশ্মি বিলেতে ফিরে যাওয়ার বায়না ধরেছিল। ওই শর্ত উপেক্ষা করলে আজ রশ্মি তার বউ হয়ে যেত। কোথায় থাকত তার এই স্বাধীনতা?

থেকে থেকে একটা বিশ্রী পচা গন্ধ আসছিল। কুকুর বেড়াল কিছু একটা মরে পচছে কোথাও কাছেপিঠে। এই গন্ধটার মধ্যে কোনও সৌন্দর্য আবিষ্কার করার চেষ্টা বৃথা। গোঁ ধরে খানিকক্ষণ বসে থেকে উঠে পড়ল সে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর বাঁধে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নদী তার অদ্ভুত লাগে।

পৃথিবীর সব সভ্যতা, সব বড় বড় নগরের পত্তন হয়েছে কোনও না কোনও নদীর ধারে। নদী ছাড়া কোনও মহানগর নেই। কারণটা হয়ত নৌবাহনের সুবিধে। কিন্তু নদী হেমাঙ্গকে পাগল করে দেয়। নদীর ধারে এসে দাঁড়ানোমাত্র তার চোখ দুটো মুগ্ধ আর নিষ্পলক হয়ে গেল।

মন কেন ভাল নেই তার? কিছুতেই বুঝতে পারছে না হেমাঙ্গ। ইদানীং মাঝে মাঝে এটা হয়। মনটা কেমন বিগড়ে বসে থাকে। খুব অস্থির আর হতাশ লাগে তখন। কারণ ছাড়া কিছুই হয় না। মন খাবাপেরও কারণ একটা আছেই। কিন্তু কেন, ধরতে পারে না হেমাঙ্গ?

ঘুরে ঘুরে, অনেকটা হেঁটে, অনেকের সঙ্গে কথাটথা বলে সে যখন ফিরল তখন রান্না সেরে হাঁ করে বসে আছে বাসন্তী।

এই তোমার ফেরার সময় হল? ক’টা বাজে বলো তো! দেড়টা। এর পর কখন চান করে খাবে? অবেলা হয়ে যাবে না?

হেমাঙ্গ একটু হাসল, অত হুড়ো দিস না। ছুটির দিনটা একটু আমার মতো থাকতে দে।

আমার খিদে পায় না নাকি?

খেলেই পারতিস।

ও-বাবা! তোমার খাওয়া হয়নি আর আমি রাক্ষুসী গিলতে বসব? যাও চান করে এসো গে।

একটু চা খাওয়াবি না?

চা? উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। বউ হলে তাকে জ্বালিয়ে খাবে বাপু।

বাসন্তী চা করে দিল অবশ্য। স্নান করে আসার পর ভাত বেড়ে দিল। তারপর বলল, হ্যাঁ দাদা, আমার কিন্তু একজনকে খুব পছন্দ।

অন্যমনস্ক হেমাঙ্গ মুখ তুলে বলল, কাকে পছন্দ হল আবার? তোর তো এখন একটা বর আছে।

আহা, আমার কথা বললাম নাকি?

তবে কার কথা?

তোমার কথা গো! তোমার জন্য একটা পাত্রী আমার পছন্দ হয়েছে খুব।

যাক বাবা। আমি ভাবলাম তোরই বোধ হয় আবার কাউকে পছন্দ হল।

আমার কথা বাদ দাও। এই মরদটাও দেখো, কিছুদিন পরই পিঠটান দেবে। ভাবগতিক ভাল নয়। কাজকর্মও তত নেই। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে সারা দিন।

ওরকম লোককে বিয়ে করলি কেন?

না করে কী করব? কোন জজ-ব্যারিস্টার জুটবে এই পোড়া কপালে? এ-সবই জোটে এসে।

ঘরামী না কী যেন বলছিলি!

ঘরামীই। কিন্তু কাজ নেই হাতে।

কোথা থেকে জোটালি?

ঘাট পেরোনোর সময় ভটভটিতে আলাপ হয়েছিল।

ব্যস! অমনি বিয়ে করে বসলি?

অত অবাক হয়ো না তো। ওরকম হয়। আমাদের সব সয়ে গেছে।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, এটা কিন্তু ভাল নয়। বিয়ে কি এত সহজ? জলভাতের মতো? আমার তো একটা বিয়ের কথা ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

তোমার আবার সবতা’তেই বেশি বেশি।

কী যেন বলছিলি?

সেই রোগা মেয়েটা এসেছিল না, সে কিন্তু খুব সুন্দর!

কোন রোগা মেয়েটা?

ঝুমকি গো!

হেমাঙ্গ একটা বিষম খেল। তারপর বলল, ওঃ, তাকে বুঝি তুই খুব সুন্দর দেখিস?

সুন্দর নয়?

হেমাঙ্গ ভাতটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, তাতে আমার কী?

ওকে তোমার পছন্দ নয়?

পছন্দ করে কী করব রে? সে তো আর আমাকে পছন্দ করেনি।

কী করে বুঝলে?

ওসব বুঝতে কি দেরি হয় রে।

তার বুঝি কেউ আছে?

থাকতেই পারে।

আমার মনে খুব ইচ্ছে, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক। রশ্মিও খুব ভাল ছিল, কিন্তু বড্ড মেমসাহেবের মতো দেখতে।

তাকে বুঝি তোর পছন্দ ছিল না?

ছিল। তবে কেমন যেন একটু বিলিতি গন্ধ। এ মেয়েটা কেমন আটপৌরে।

হেমাঙ্গ হেসে বলে, আটপৌরে মানে জানিস?

ওই কথার কথা একটা।

খাওয়া সেরে একটু উঠোনের রোদে চেয়ার পেতে বসে থাকে হেমাঙ্গ। বাসন্তী চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরে অবধিও তার কথাটা কানে বাজতে থাকে হেমাঙ্গর। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাত্র।

চেয়ারে বসেই ভাতঘুমে কিছুটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সে। হিজিবিজি স্বপ্ন দেখছিল। তাদের বিডন স্ট্রিটের বাড়ির পাশেই নুটুবাবু বলে একজন থিয়েটারের লোক থাকে। পাড়ার লোকে বলে, নুটুবাবু নাকি মেয়ের দালাল। স্বপ্ন দেখল, সেই নুটুবাবু বিয়ে করে ফিরেছেন। সঙ্গে নতুন বউ নিয়ে গাড়ি থেকে নামছেন। হেমাঙ্গ দেখল নতমুখী বউটি ঝুমকি। হেমাঙ্গ চেঁচাতে লাগল, ঝুমকি! পালিয়ে যান, এ লোকটা ভাল নয়! ঝুমকি তার দিকে চেয়ে একটু হাসল।

কে জানে কেন স্বপ্ন দেখে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল তার।

পরদিন সারাক্ষণ মনটা বিগড়েই রইল। একটুও ভাল লাগল না। বিকেলের দিকে কলকাতা রওনা হল সে।

সোমবার অফিস করে হঠাৎ অনেকদিন বাদে সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে এল চারুশীলার বাড়ি।

যাক বাবা, এতদিনে আমাকে মনে পড়ল? দাঁড়া শাঁখ-টাখ বাজাই।

হেমাঙ্গ একটু হাসল, গরিবদের কথা ভাবিস তা হলে?

তুই গরিবদের চেয়েও খারাপ। তুই একটা ইডিয়ট।

তাও বটে, এখন ভাল-মন্দ কিছু খাওয়া তো!

কেন, ভালমন্দ খাওয়ানোর জন্য আমি কেন? বিয়ে করে বউ আন, সে খাওয়াবে।

বউরা কি ভালমন্দ খাওয়ায়? ওরা তো আটপৌরে।

ইস, কথা শিখেছে। আটপৌরে!

হ্যাঁ রে, ঝুমকি কোথায় বল তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *