৯৬
মণীশের বাক্যহীন চেয়ে-থাকাটা আজকাল সহ্য করতে পারে না অপর্ণা। মণীশ রোগা হয়ে যাচ্ছে, চোখের নিচে কি কালিও পড়ছে? দুর্বল হৃদযন্ত্র নিয়ে মণীশের বেঁচে থাকা, তার ওপর যদি ওরকম বিষণ্ণতা চেপে বসে মাথায় তা হলে কি ভাল?
এ কথা ঠিক যে বুবকা আই আই টি-তে চলে যাওয়ার পর সকলেরই মন খারাপ। বাড়িটা হাঁ-হাঁ করছে ফাঁকা। তবু লোকে সব অবস্থাই তো সামলে নেয়। মণীশ পারছে না কেন?
জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাশ করে বুবকা যখন হস্টেলে গেল তখন আর এক উদ্বেগ পেয়ে বসেছিল মণীশকে। আই আই টি-তে ভীষণ র্যাগিং হয়। মণীশ উদ্বেগে প্রায় পাগল হয়ে বুবকার সঙ্গে চলে গেল খড়্গপুরে। হোটেলে রইল কয়েকদিন, যাতে বিপদে পড়লে বুবকা তার কাছে পালিয়ে আসতে পারে। বুবকা অবশ্য পালিয়ে আসেনি। র্যাগিং সহ্য করেছে এবং তারপর সকলের সঙ্গে মিশেও গেছে। ছেলের র্যাগিং নিয়ে এমন চিন্তায় পড়েছিল মণীশ যে, ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। র্যাগিং-এর ভয় গেছে, কিন্তু মণীশ এখনও বুবকার অভাবটা সামলে উঠতে পারছে না।
হ্যাঁ গো, ছেলে কি কারও বিদেশে যায় না? সবসময়ে বুকে আগলে থাকা যায় বুঝি? ছেলের ভবিষ্যৎ বলে কি কিছু থাকবে না?
মণীশ এ কথার সরাসরি জবাব দেয় না, কিন্তু চেয়ে থাকে শূন্য চোখে। তারপর বলে, নাউ হি ইজ অ্যান অ্যাডাল্ট। বড় হয়ে গেল!
সেটা কি কোনও ট্র্যাজেডি? ছেলে বড় হচ্ছে এটা তো আনন্দের কথাই গো!
মণীশ মাথা নেড়ে বলে, ঠিকই তো। বড় হওয়ারই তো কথা। কিন্তু এই যে আলাদা হয়ে গেল, এই কিন্তু ছাড়াছাড়ির শুরু।
সে আবার কী কথা! ছাড়াছাড়ির কী আছে? পাশ করে চলে আসবে।
না অপু, পাশ করে চাকরি করবে, হয়তো বিদেশে যাবে, তারপর বিয়ে করবে, তারপর আমার বুবকা আরও অনেকের বুবকা হয়ে যাবে। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনাচ্ছে হয়তো, ঠিক বোঝাতেও পারব না। তবে বুবকা যেমন আমার এক্সক্লুসিভ ছিল ঠিক তা তো আর থাকবে না। নিজস্ব মতামত হবে, ব্যক্তিত্ব হবে, চরিত্র হবে। এ জেন্টলম্যান অফ হিজ ওন।
সেই জন্য তুমি মন খারাপ করে আছো? আচ্ছা পাগল তো! তুমি নিজেও তো বড় হয়েছো, আলাদা হয়েছো, তাতে কী অসুবিধে হল শুনি!
মণীশ মৃদু একটু হাসি মুখে টেনে বলে,বুবকা আমার এত ক্লোজ ছিল বলেই বোধহয় বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
তুমি বাপু বড্ড নরম। যা ভেবেছিলাম তোমাকে তার চেয়েও অনেক বেশি নরম।
দুর্বল, তাই না?
তাও।
হার্ট অ্যাটাকটা হওয়ার পর থেকেই আমার এরকম একটা ব্যাপার হয়েছে। ঝুমকির বিয়ের কথা মনে হলে বা বুবকা চাকরি করতে বাইরে যাবে ভাবলে কেমন যেন রি-অ্যাকশন হতে থাকে। মনে হয় ওদের দূরে কোথাও যেতে না দেওয়াই বোধহয় ভাল।
তোমার এ সব কথা বুবকার কানে গেলে ও কিন্তু পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে চলে আসবে। হস্টেলে যাওয়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে, তা জানো?
জানি অপু। তুমি ভেবো না। আমাকে একটু সময় দাও, ঠিক সামলে উঠব।
তোমার যা অবস্থা দেখছি আমার তো চিন্তা হচ্ছে। আমি তো মা, তবু তোমার মতো অবস্থা তো আমার হয়নি।
মণীশ একটু চুপ করে থেকে বলল, কাউকে কাছ-ছাড়া করতে ইচ্ছে হয় না। কেবল মনে হয়, আমার সঙ্গে যদি আর দেখা না হয়?
ছিঃ! ও কি অলক্ষুণে কথা!
অলক্ষুণে হলেও মিথ্যে হয়তো নয়। জীবন এত অনিশ্চিত, আয়ুর ঘরে মস্ত এক প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে আছে, আর কতদিন?
তুমি বুবকার ভবিষ্যতের কথা ভাবছো না কেন?
তাও ভাবি। খুব ভাবি। বুবা একটি উজ্জ্বল ছেলে। পড়াশুনোয় ভাল, স্বভাবে ভাল, হৃদয়বত্তায় ভাল, ওর ভবিষ্যৎ তো ভালই হবে অপু। ওর জন্য কখনও আমাকে কোনও উদ্বেগ পোয়াতে হয়নি। বরাবর ওবিডিয়েন্ট ছিল, বিনীত ছিল, ভদ্র ছিল। সব ভাল, তবু একটু দূরে সরেই গেল কিন্তু। এই দূরত্বটা ক্রমে ক্রমে বাড়বে। তাই না?
উঃ, তুমি এত ভাবতেও পারো! আমার তো এ সব কথা একবারও মনে হয় না। ছেলে দূরে গেলেই কি পর হয়ে যায় নাকি?
মণীশ মৃদু হেসে বলে, ঘরে ঘরে কত ছেলে পর হয়ে যাচ্ছে তার হিসেব জানো?
সেও জানি। অত ভেবো না। পরই যদি হয় তো তার অনেক দেরি আছে। ছেলেরা পর হতে থাকে বিয়ের পর, তার আগে নয়। আগ বাড়িয়ে অত ভাবছো কেন?
ঠিক আছে, আর ভাবব না।
চলো, একটু সিনেমা থিয়েটার কিছু দেখে আসি।
মণীশ মাথা নেড়ে বলে, না। ওসব আমার ভাল লাগে না। তার চেয়ে ক্যামেরাগুলো বের করো। তোমাদের কিছু ছবি তুলি।
আবার আমাদের ছবি? তোমার মাথাটাই গেছে। বারো-চোদ্দটা অ্যালবাম ভর্তি হয়ে আছে শুধু আমাদের ছবিতে।
তা হলে বরং এমনি ছবি তুলে বেড়াই কয়েকটা দিন।
পরিশ্রম আর ধকল সইতে পারবে তো? ভেবে দেখ।
মণীশ হাসল, পারব। ছবি তোলার একটা নেশা আছে। শুরু করলেই একটা টনিকের কাজ করবে।
যা ভারী তোমার ক্যামেরার ব্যাগ!
না, ব্যাগ নেবো না। দূটো ক্যামেরা নিলেই হবে। শুধু লেন্সের জন্য একটা ছোটো ব্যাগ হলেই হবে।
কয়েকটা ছুটির দিনে মণীশ বাস্তবিকই ছবি তুলে বেড়ালো। নিজেই ওয়াশ করল ফিল্ম। প্রিন্ট করিয়ে আনল। তারপর খুঁটিয়ে দেখল সব ছবি। অপর্ণাকে বলল, নাঃ, এখনও মরে যাইনি দেখছি। তবে অ্যাকশনের ছবি আর তুলতে পারব না। আর পারব না ছুটতে বা খুব উঁচু জায়গায় উঠতে।
পেরে দরকার নেই।
মণীশ বলল, না, সত্যিই দরকার নেই। ক্যামেরা তুলে রাখো।
শখ ফুরিয়ে গেল নাকি?
ঠিক তা নয়। মনের বিষণ্ণতাটা কেটেছে।
বাঁচা গেল। যা ভাবছিলাম!
বিষণ্ণতাটা সত্যিই কাটল কিনা তা বুঝতে পারল না অপর্ণা। শুধু বুঝল, মণীশ এখন আগের চেয়ে কম কথা বলে এবং মাঝে মাঝে অদ্ভুত শূন্য এক চোখ মেলে ভাষাহীন চেয়ে থাকে।
মাস দেড়েক বাদে বুবকা তিন দিনের ছুটিতে বাড়ি এল। কী যে হইচই হল তা বলার নয়। মণীশের এমন উত্তেজনা হচ্ছিল যে আবার তার হার্ট না বিগড়ে বসে ভয় হল অপর্ণার।
ছুটির দ্বিতীয় দিনটায় তারা একটা পার্টির ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগে থেকেই। পার্টি যেমন হয় তেমন নয়। রাতে তারা একটা বড় হোটেলে গিয়ে খেল। মাত্র পাঁচজনের জন্য খরচ হল তিন হাজার টাকার ওপর।
অপর্ণা বলল, টাকা কি তোমাকে কামড়ায়? ওগো, আমরা কিন্তু শেঠজী নই। আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকার ব্ল্যাকমানি নেই, তোমাকে বছরে পঞ্চাশ হাজার টাকার ওপরে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়, মনে রেখো।
জানি অপু। এর পর তুমি মেয়েদের বিয়ে আর বুবকার পড়ার খরচের কথাও তুলবে। অত ভেবো না, এই একটা দিন। বুবকা বাড়ি এসেছে।
আর নয় কিন্তু। ফের এরকম পাগলামি করলে আমি ভীষণ রেগে যাবো। ইস, গালে থাপ্পড় মেরে পয়সা নিয়ে নিল।
বুবকা বলল, মা, দাম বেশি ঠিকই, কিন্তু খাওয়াটা ফ্যান্টাস্টিক হয়েছে।
অনু বলল, ঠিক মা, এরকম পসিন্দা কাবাব আর দম পুখত, কখনও খাইনি। মুখের মধ্যে যেন গলে গেল।
সমর্থক পেয়ে মণীশ বলল, তোমার ভাল লাগেনি অপু?
ভাল? আমি হোটেল দেখেই দামের কথা ভেবে এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে, খাবারের স্বাদই বুঝতে পারিনি।
মণীশ বলল, এই ঝুমকি, তুই চুপ কেন রে?
ঝুমকি করুণ মুখ করে বলল, আমারও কিন্তু মার মতোই মনে হচ্ছে। খাবারগুলো খুব ভাল, কিন্তু দামটা বড্ড বেশি।
তুই স্বভাবে ঠিক তোর মায়ের মতোই হয়েছিস। দাম নিয়ে অত ভাবিস কেন? একদিন তো!
না, ভাবছিলাম, দামটা একটু কম হলে আবার আসা যেত।
আবার আসব। তাতে কি?
না বাবা, আর আসতে আমার লজ্জা করবে।
তোর খাবারগুলো ভাল লেগেছে তো!
দারুণ।
বুবকা দিদির কাঁধে একটু দাদাসুলভ চাপড় মেরে বলল, তুই একটু কিপটে আছিস কিন্তু দিদি।
কাল আমি তোকে একটা জিনিস বেঁধে খাওয়াবো, দেখিস এদের চেয়ে মোটেই খারাপ হবে না।
বুবকা হঠাৎ বলল, আচ্ছা দিদি, সবাই একরকম আছে, কিন্তু তোকে একটু অন্যরকম লাগছে কেন রে?
ঝুমকি অবাক হয়ে বলল, অন্যরকম! যাঃ, অন্যরকম লাগবে কেন?
ঠিক ডিফাইন করা যাবে না। কিন্তু তোকে ঠিক আগের মতো দিদি-দিদি লাগছে না।
কিরকম লাগছে? পিসি-পিসি?
আরে নাঃ। মনে হচ্ছে তুই একটু পাল্টে গেছিস।
মাত্র এই ক’দিনে? তুই তো সবে এই সেদিন হস্টেলে গেলি!
তাই তো ভাবছি হোয়াট ইজ ডিফারেন্ট অ্যাবাউট মাই ডিয়ার দিদি?
অপর্ণা বলল, ঝুমকি তা হলে নিশ্চয়ই আরও রোগা হয়ে গেছে। হবে না! খাওয়া নিয়ে ওরকম বাছাবাছি যাদের থাকে তাদের শরীর শুকোবেই।
বুবকা বলল, না মা, দিদি আর শুকোবে কি করে? ও তো সম্পূর্ণ ডিহাইড্রেটেড। তা নয়, কিন্তু একটা অন্যরকম লাগছে, ধরতে পারছি না।
তোকে আর পণ্ডিতী করতে হবে না। এই, আপার খবর কি রে? পাশ করে তো দেখা করতে এল না!
পাশ করাটা ওর কাছে আবার একটা ব্যাপার নাকি? ও তো ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে।
সে তো জানি।
পড়ছে। পাশ-টাশ করে কোথাও সেবায় লেগে যাবে। ওর তো আমাদের মতো ক্যারিয়ারের ব্যাপার নেই, ওর হল মিশন।
কিরকম রেজাল্ট করেছিল?
ও বাবা, ও ছিল টুয়েলভথ্। ভাল করে পড়লে ফার্স্ট হত।
তোর সঙ্গে আর তো দেখা হয় না!
না। তবে একটা চিঠি দিয়েছে।
কী লিখেছে?
হাই ফিলজফি। চিঠিটা আমি বাবার জন্য রেখে দিয়েছি। ওর ওই সব ফিলজফি বাবার খুব পছন্দ হবে।
মণীশ মৃদু হেসে বলে, ও মেয়েটাকে আমার খুব ভাল লাগে। বড় কিছু করবে দেখিস।
অপর্ণা বলল, বড্ড সাহস। মেয়েদের অত সাহস ভাল নয়।
বাড়ি ফিরে যখন সবাই এক প্রস্থ আড্ডায় বসল তখন বুবকা ফের বলল, দিদি, ইউ রিয়েলি লুক ডিফারেন্ট। তোকে আগে একটু কাঠখোট্টা লাগত, এখন লাগছে না।
ঝুমকি একটু নার্ভাস হাসি হেসে বলল, যাঃ, আমি বুঝি কাঠখোট্টা ছিলাম!
ছিলি একটু।
আমি বদলাইনি মোটেই। বরং তুই একটু বদলেছিস। আগে কো-এডুকেশনে পড়তিস, একটু নরম ভাব ছিল। এখন হুমদো হুমদো ছেলেদের মধ্যে থাকিস, তাই তুই কাঠখোট্টা হয়েছিল।
বুবকা হাঃ হাঃ করে খানিকক্ষণ হেসে বলল, কথাটা কিন্তু ঠিক। আমি এখন টোটাল ম্যাসকুলিন সারাউন্ডিংস-এ থাকি। মা নেই, অনু নেই, দিদি নেই, মেয়ে-বন্ধুরা নেই। কিন্তু ভালই লাগে।
অপর্ণা হঠাৎ বলল, তোর কার জন্য সবচেয়ে বেশি মন খারাপ লাগে?
বাবার জন্য অফ কোর্স। কিন্তু সকলের জন্যই। তবে কি জানো মা, এত বন্ধু আর এত পড়ার চাপ যে মন খারাপ-টারাপ সব উড়ে যায়। তারপর খেলাধুলো আছে, আড্ডা আছে।
মণীশ বলল, ইজ ইট থ্রিলিং?
ভেরি মাচ।
একটু গভীর রাতের দিকে যখন সবাই শুতে গেল তখন ঝুমকি এসে বুবকাকে ডাকল, এই ভাই, ঘুমিয়েছিস নাকি?
না রে। আজ এতদিন পরে বাড়ি এসে এত অদ্ভুত লাগছে যে ঘুম আসছে না। আয় না, গল্প করি।
ঝুমকি আলো না জ্বেলে চেয়ার টেনে বিছানার মুখোমুখি বসে বলল, আমাকে তোর অন্যরকম লাগছে কেন বল তো!
কি জানি রে দিদি, বুঝতে পারছি না।
তুই এমনভাবে বলছিলি যে আমার ভয় করছিল।
কেন, ভয়ের কি আছে?
কেমন মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি কোনও অন্যায় করে ফেলেছি।
যাঃ, তোকে সেরকম লাগছে না মোটেই। মনে হয় তুই বোধহয় একটু ওয়েট গেন করেছিস। ওজন নিয়ে দেখিস তো।
তা হতে পারে।
সেটাই হবে।
ঝুমকি একটা শ্বাস ফেলে বলল, বাবা তোর জন্য খুব ভেঙে পড়েছিল, জানিস?
জানি, মা বলেছে। কিন্তু বাবা সামলেও গেছে। জীবনটা যে কত বড় তা বাড়িতে থাকলে বোঝা যায় না। হস্টেলে থাকলে বোঝা যায় খানিকটা।
কত বড় রে?
ঠিক আন্দাজ করা মুশকিল। এখানে তোরা আছিস, তুই, মা, বাবা, অনু সবাই মিলে কেমন একটা ঘেরাটোপ। নিজেকে ঠিক স্বাধীনভাবে ফিল করা যেত না। আমি হয় কারও ছেলে, নয়তো ভাই, নয়তো দাদা। কিন্তু ওখানে তো তোরা নেই। হঠাৎ মনে হল অথৈ জলে পড়ে গেছি। তারপর ধীরে ধীরে মনে হতে লাগল, এই পৃথিবীটা অনেক বড় এবং এখানে তোরা ছাড়াও অনেক মানুষ আছে। ঠিক বোঝাতে পারব না। হোয়েন আই অ্যাম অন মাই ওন তখন অন্যরকম ফিলিং হয়।
তোর ভাল লাগছে ওখানে?
খুব।
আমাদের ভুলে যাচ্ছিস না তো!
আরে নাঃ। দিদি, দাবা খেলবি?
এত রাতে?
আজ ঘুম আসবে না। আয় এক পাট্টি খেলি।
ঠিক আছে।
দাবায় দু’বার হেরে যখন মাঝরাতে ঘুমোতে গেল ঝুমকি তখন তারও ঘুম এল না। আজকাল মাঝে মাঝে এটা হয়। বুকের ভিতরে একটা হায়-হায়, শূন্য ভাব ভর করে থাকে। সে কি ধরা পড়ে গেছে বুবকার চোখে? তার গভীর গোপন একটা অন্তর্জগতের ঘটনা কি ছায়া ফেলছে তার মুখে বা শরীরে?
অনেকক্ষণ জেগে শুয়ে রইল ঝুমকি। কাউকে সে কখনও বলতে পারবে না। মরে গেলেও না। চারুমাসি বিদেশে চলে যাবে, তারপর আর ও বাড়ি যাওয়া হবে না। আর হয়তো দেখাই হবে না হেমাঙ্গর সঙ্গে।
না হোক। দেখা হয়েই বা কী হত? হেমাঙ্গ এখনও ডুবে আছে আকণ্ঠ রশ্মির প্রেমে। রশ্মি বিয়ে করেছে শুনে প্রায় বিবাগী হয়ে গ্রামে গিয়ে থানা গেড়ে ছিল। আবার ফিরেছে বটে, কিন্তু মেয়েদের আর লক্ষই করে না সে। হয়তো মেয়েদের ঘেন্নাই করে মনে মনে।
করুক, তাতে আর ঝুমকির কী?
পরদিন বুবকা সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখা করে এল। রাতের বেলা আড্ডা হল একটু। ভোর হতে না হতেই চলে গেল খড়্গপুর। বাড়ি ফের ফাঁকা। এই ফাঁকটা আর ভরাট হবে না সহজে। ফাঁকাই থেকে যাবে।
ঝুমকি চাকরি ছেড়েছে। কম্পিউটার শেখা শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝে প্র্যাকটিস করতে চারুশীলার বাড়ি যায়। চারুশীলা গোছগাছ শুরু করেছে। বলে, জানিস, আমার আর এ দেশ ভালই লাগছে না।
তুমি তো সুব্রতদার সঙ্গে বিদেশেই থাকতে পারো।
বিদেশেও কী বেশি দিন ভাল লাগে ভাবিস? আমার মনটাই একটু চঞ্চল ধরনের। যখন ভাল না-লাগে তখন কোথাও ভাল লাগতে চায় না। আর নিজের ইচ্ছেয় জায়গা বদল করলে তো হবে না। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো আছে।
ওদের বিদেশেই পড়াও না কেন?
সুব্রত সেটা পছন্দ করবে না। মেয়েটাকে এবার আমেরিকায় ভর্তি করে দেবো ভাবছি। সুব্রতর খুব ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু এখন বলছে, নাঃ, ওসব দেশে না রাখাই ভাল। কী যে করব বুঝতে পারছি না।
তোমার যে কত সমস্যা।
আমিই আমার সমস্যা।
আর একদিন ঝুমকি গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসেছে, চারুশীলা এসে হঠাৎ বলল, হ্যাঁ রে, তুই বিয়ে করছিস না কেন বল তো!
ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, বিয়ে? এখনই কিসের বিয়ে?
এটাই তো বয়স।
তোমার আমলে ছিল। এখন নয়।
তোর কোনও অ্যাফেয়ার নেই তো?
ঝুমকি লাল হয়ে বলল, থাকলে টের পেতে না?
না। তুই ভীষণ চাপা।
কাজ করতে দাও তো। বড্ড জ্বালাও।
আমাকেও বলবি না?
অ্যাফেয়ার নেই মাসি।
বাজে কথা। তুই বলছিস না।
তোমার কাছে কি কিছু লুকোই?
চারুশীলা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ায় সাময়িক রেহাই পেয়ে গেল ঝুমকি। কিন্তু দু’দিন বাদে আবার কথাটা উঠল। ঝুমকি বড্ড অস্বস্তি বোধ করে প্রসঙ্গটা উঠলেই।
একদিন চারুশীলা করুণ মুখ করে বলল, জানিস আমি আমার ওই পাগলা ভাইটাকে বড্ড ভালবাসতাম। যতই গালাগাল করি আর বকি-ঝুকি ওর মতো সাদা মনের মানুষ হয় না। কিন্তু ও বোধহয় সন্ন্যাসী-ইন্ন্যাসীই হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।
ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, কেন মাসি?
তা যদি জানতুম তা হলে তো হতই। রশ্মি বিয়ে করেছে বলেই কি না জানি না, ও যেন কেমন বারমুখো আর উদাসীন হয়ে গেছে।
ঝুমকির বুকটা ধক ধক করছিল। বলল, ওঁদের মধ্যে কি খুব ভালবাসা ছিল মাসি? আমার তো মনে হয় না।
আমারও তা মনে হয় না। হেমাঙ্গ তো চিরকাল মেয়েদের ব্যাপারে উদাসীন। তবে কি জানিস, হয়তো রশ্মির বিয়েটা ওর পৌরুষে ধাক্কা দিয়েছে। তাই ওরকম হয়ে গেছে। মানুষের ভিতরের কথা কে জানতে পারে বল!
তুমি ভাল করে খোঁজ নাও। এত অনুমান করো কেন?
কি করে খোঁজ নেবো বল তো! হেমাঙ্গ তো কলকাতায় থাকেই না। কখনও হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়, কখনও গাঁয়ে গিয়ে বসে থাকে। আজকাল নাকি চাষবাস করছে, মাছ ধরছে, আরও কি কি সব করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।
ঝুমকি একটু চুপ করে থেকে বলল, ওসব করা তো খারাপ নয়।
কে জানে কী! তবে হেমাঙ্গ বড় পাল্টে গেছে। গত শনিবার এসেছিল। মুখে হাসি নেই, কথাবার্তা নেই। এমন কি ভাল করে খেল না অবধি।
ওঃ। বলে ঝুমকি চুপ করে থাকে।
হেমাঙ্গর সঙ্গে তার আর কবে দেখা হবে তা জানে না ঝুমকি। কখনও দেখা হবে কি? মাঝে মাঝে তার মনে হয়, জীবনের নানা স্রোত, ফেনা, ঘটনা বা ঘটনাহীনতার ভিতর দিয়ে হেমাঙ্গ বহু বহুদূর সরে যাচ্ছে। সে কি কখনও জানবে বা টের পাবে যে একজনের হৃদয় তার জন্য অপেক্ষা করে?
মুখ ফুটে কখনও বলতে পারবে না ঝুমকি। কখনও নয়। কাউকে নয়। কিন্তু হৃদয়ের কথা কি পৌঁছয় না তবু?