2 of 3

৯৫. পালপাড়ায় গিয়ে একদিন

৯৫

পালপাড়ায় গিয়ে একদিন বাবাকে প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে এল নিমাই। আসতে চাইছিল না, বলল, ও বাবা, আমি ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।

নিমাই বলল, উপায় থাকলে কি নিয়ে যেতাম! আপনাকে একটু কাজকারবার বুঝে নিতে হবে যে, আমার কবে কি হয়ে যায়!

তোর আবার কী হবে?

সে আপনি বুঝবেন না, চলুন।

অনিচ্ছুক বাবাকে নিয়ে এসে দোকানে বসাল নিমাই, বলল, কাজকারবার একটু বুঝে নিন।

বাবা তো অবাক, আমি কাজকারবার বুঝব কি রে? এ বয়সে এসব আমার মাথাতেই ঢুকবে না।

নিমাই থমকে যায়। কথাটা ন্যায্য। তার বাবার পক্ষে হোটেল চালিয়ে রোজগার বজায় রাখা অসম্ভব ব্যাপার। মাথা আর শরীর দুটোতেই মরচে ধরেছে। নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বলল, আপনার জন্য যে কী করি!

পরদিন নিমাই তার ইনসুরেন্স পলিসি বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলল, এটা হচ্ছে পলিসি। পলিসি বোঝেন তো!

তা বুঝি। মরলে তার আত্মীয়রা টাকা পায়।

ব্যস, সেটুকু বুঝলেই হবে। আমার যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়, তাহলে সিদ্ধিনাথ দাসের কাছে কাগজখানা নিয়ে যাবেন। ত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। বুঝলেন?

বাবা একটু রেগে গিয়েই বলে, ভাল-মন্দ হবে কেন রে? বুড়ো তুই, না আমি?

বাবা, আপনাকে সব কথা বুঝিয়ে বলা যাবে না। আমার একটা বিপদ হতে পারে। যদি-র কথাই বলছি। দোকানটার একটা বিলিব্যবস্থা করে রাখতে হবে। অবশ্য যদি শেষ অবধি দোকানটা রাখতে পারি। হয়তো বা বেচে দিয়ে আক্কেলসেলামী গুনতে হবে। বড্ড বিপদ যাচ্ছে বাবা।

বাবা ভ্যাবলা চোখে চেয়ে বলে, কিসের বিপদ বুঝিয়ে বলবি তো! অমন ভাসা-ভাসা বললে কি বুঝতে পারি?

সে অনেক কথা। বলতে গেলে মহাভারত। মরতে আমার তেমন ভয় করে না। শুধু ভাবি, আমি মরলে আপনার কী হবে! কে দেখবে আপনাকে! টাকাটা হাতে পেলেও কি রাখতে পারবেন?

তুই তো আমাকে গণ্ডগোলে ফেলে দিচ্ছিস বাপ! আমার মাথাটা কেমন করে!

তাহলে আর বুঝে কাজ নেই। যা হওয়ার হবে। ভগবানকে ডাকুন।

নিমাই ভিতরে ভিতরে বড় উচাটন। বনগাঁ থেকে আর কোনও খবর বার্তা নেই। কাকা এসেছিল দিন পাঁচেক আগে। এর মধ্যে সেখানে যে কী হচ্ছে, কে জানে! কাকা তাকে যেতে পইপই করে নিষেধ করে গেছে। নইলে সে গিয়ে ঠিক হাজির হয়ে যেত। কাকা লোক পাঠাবে, তার সঙ্গে যেতে হবে।

বাঁচার কোনও পথ দেখছে না নিমাই। বীণাপাণি যে গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায়ও দেখছে না সে।

নিমাইয়ের আজকাল ঘুম হয় না, সব সময়ে বুক কাঁপে, মাথাটা পাথরের মতো ভার হয়ে থাকে দুশ্চিন্তায়, বীণাপাণির ওপর কাকার বড্ড রাগ। দলের ছেলেরাও ক্ষেপে আছে। মেরে-টেরে ফেলল না তো! একটা লোভের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারল না বীণা। আর সেই লোভই ডেকে আনল সর্বনাশ। আবহমান কাল ধরে এই লোভ আর তার পরিণাম নিয়ে কত কত রামায়ণ মহাভারত লেখা হল, তবু মানুষ আজও কিছু শিখল না, পাঠ নিল না।

মাঝে মাঝে নিমাই একা একা কাঁদে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে এই পাপ পৃথিবী ছেড়ে স্বেচ্ছায় বিদায় নেয়, রেললাইনে কাটা গিয়ে কিংবা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে। কিন্তু সেটা আর এক দফা পাপ হবে বলে চিন্তাটা পুষে রাখে না সে। তার খাওয়া ঘুচে গেছে, মুখে কিছু রোচে না। শরীরটাও বেশ দুর্বল।

কাঁচরাপাড়ায় তার বন্ধুবান্ধব মেলাই হয়েছে। নিমাইয়ের কখনও বন্ধুর অভাব হয় না। সিদ্ধিনাথ একদিন বলল, ওহে নিমাই, ব্যাপারটা কি বলো তো! কাজকারবার মন্দা যাচ্ছে নাকি? মুখ শুকনো কেন?

না, কাজকারবার ঠিকই আছে। নানা কথা ভেবে মনটা ভাল নেই।

সিদ্ধিনাথ ইনসিওরেন্সের দালালি করে। লোক ভাল। নিমাইয়ের তাকে খুব পছন্দ। সিদ্ধিনাথ বলল, নানা কথা ভাবো, সে জানি। ঘরের বউকে যাত্রায় নামিয়েছো, কাজটা ভাল করোনি। এ হল গিয়ে ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচ। তা তোমাদের সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়িয়েছে বলো তো!

সম্পর্ক আর কোথায়?

আইনে যদি না আটকায় তো একটা কথা বলি।

কি কথা?

অমন শুকনো মুখে থাকো বলেই বলছি। আবার সংসার করো। হাতে ভাল মেয়ে আছে। গোত্রে বর্ণে একেবারে ঠিকঠাক।

নিমাই ম্লান মুখে একটু হেসে বলে, পেরে উঠব না ভাই। এক বিয়ের নাকে খত এখনও চলছে। তা হ্যাঁ হে সিদ্ধিনাথ, তুমি তো মাঝে মাঝে বনগাঁয়ে যাও, তাই না?

যাই মানে? হপ্তায় দু-তিনবার তো বটেই। আমাকে পেটের দায়ে চরকিবাজি করতেই হয়।

টাপেটোপে একটা খবর এনে দেবে?

কিসের খবর? তোমার বউয়ের নাকি?

হ্যাঁ। তারই।

কী খবর চাও বলো।

শুধু জেনে এসো সে কেমন আছে।

ব্যস?

হ্যাঁ। বেঁচে আছে কিনা, সেইটেই জানা দরকার।

তার আবার মরার কি হল?

শুনেছিলাম তার বিপদ যাচ্ছে। খবরটা টাপেটোপে নিও। সে যেন টের না পায়।

আরে না। গোবিন্দ ঘোষ আমার বন্ধু মানুষ। চেনো তো তাকে!

খুব চিনি। বাজারে মুদির দোকান আছে তো!

সে-ই। সে হল ওখানকার গেজেট। কালই খবর পেয়ে যাবে। তবে একটু রাত হতে পারে।

হোক। খবরটা রাতেই দিও। বড় অশান্তিতে আছি।

রাতটা আর দিনটা খুবই উদ্বেগের মধ্যে গেল নিমাইয়ের। পরদিন রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ যখন দোকান ধোলাই হচ্ছিল সেইসময় সিদ্ধিনাথ এসে হাজির। তাকে দেখেই হৃৎপিণ্ডটা একটা ডিগবাজি খেয়ে গেল।

কী খবর সিদ্ধিনাথ?

সিদ্ধিনাথের মুখটা কিছু গম্ভীর। মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে বলল, তোমার বউ ওখানে নেই, কিছুদিন হল বাপের বাড়ি গেছে। তবে পালিয়েই যেতে হয়েছে। কাকার দল নাকি তাকে খুঁজছে।

পালিয়ে গেছে?

কী করেছিল বলল তো তোমার বউ? কি সব টাকাপয়সা চুরির কথা শুনলাম।

ঠিকই শুনেছো। পরে বলব সব।

আর সজল বলে কে একটা ছেলে আছে শুনলাম, তোমার বউয়ের সঙ্গে ভাব ছিল। তাকে খুব মেরেছে দলের ছেলেরা।

কেন, সে কী করেছিল?

ঠিক জানি না, বোধহয় বীণাকে সে-ই পালানোর পরামর্শ দিয়েছিল। তবে বীণা রেহাই পাবে না। তুমি বরং ওদিকে আর যেও না, বুঝলে?

নিমাই কথাটা শুনতে পেল না। কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে শুকনো মুখে বসে রইল।

পরদিন দোকানটা সকালে চালু করে দিয়ে, বাবাকে ক্যাশে বসিয়ে, ঠাকুর চাকরকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। যা হওয়ার হবে, এ উদ্বেগ আর সহ্য হয় না।

বাস ধরে বনগাঁ পৌঁছোতে বেশী সময় লাগল না। বাস থেকে নেমে সে একটু দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল। এই বনগাঁ জায়গাটাই তার বন্ধু ছিল একসময়ে। আজ এই শহরে কি তার লাশ পড়বে?

বাস-আড্ডার কাছেই কাকার ডেরা। রাস্তায় মেলা লোকজন যাতায়াত করছে। একটু দ্বিধায় জড়িত পায়ে সে বাজারের পিছন দিকটায় কাকার ঘরে গিয়ে উঁকি দিল।

কাক আর দুটো ছেলে বসে আছে মুখোমুখি।

কাকা, আমি নিমাই।

কাকা তার দিকে তাকাল। মুখে হাসি নেই, চোখেও নেই অভ্যর্থনা। কাঠ গলায় বলল, এসো নিমাই।

নিমাই জড়সড় হয়ে ঘরে ঢুকল।

তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম না?

নিমাই তার শুকনো গলায় একটা ঢোঁক গিলে বলল, আসতে হল, মনে শান্তি পাচ্ছি না বলে।

বসো নিমাই।

নিমাই লক্ষ করল, ছেলেদুটো নতুন। খুব মস্তান মার্কা চেহারা। তাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছে।

কাকা ছেলেদুটোকে বিদেয় করে দিল। তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, বীণা পালিয়েছে, জানো?

শুনেছি।

ডলার আর পাউন্ড সব নিয়ে গেছে সঙ্গে করে।

কি করে বুঝলেন?

আমরা ওর ঘরে হানা দিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ঘরের মেঝে ভেঙেছে শাবল দিয়ে। বেশ বড় গর্ত হাঁ হয়ে আছে। চিড়িয়া উড়ে গেছে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাকে মুখোমুখি পাননি? জিজ্ঞেস করেননি সব কথা?

তোমার কাছ থেকে ঘুরে আসার পর একটা জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল। তবে ছেলেদের বলেছিলাম বীণার ওপর নজর রাখতে। তারা নজর রেখেছিল বটে, কিন্তু পালিয়েছে ভোর রাতে।

এখন কী হবে কাকা?

তাকে পেলে তো বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। বীণা পালিয়ে বাঁচবে না, বরং তুমি তার কাছে যাও। গিয়ে বলল, ডলার আর পাউন্ডগুলো সে যদি ভালয় ভালয় ফেরত দিয়ে দেয়, তাহলে এখনও তাকে বাঁচিয়ে দেওয়া যায়।

নিমাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এ কাজ আমার দ্বারা হবে না কাকা। সে আমাকে মানবে না।

তাকে বাঁচানোর ওইটেই একমাত্র পথ।

আমি এটা পারব না কাকা। এই নিয়েই বীণাপাণির সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি। সে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

কাকা এবার একটু হাসল। বলল, তোমাকে একসময়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল নিমাই। কিন্তু ভেবে দেখলাম, সন্দেহটা অমূলক। তুমি ঠিক সেরকম ফেরেব্বাজ বোধহয় নও।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালেন কাকা, কলঙ্ক নিয়ে মরতেও বড় জ্বালা। তবে বীণার পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি রাজি।

তা কি হয়? একজনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আর একজনকে দিয়ে হয় না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে নিমাই। তারপর বলে, আমি বীণার ঘরখানা একটু দেখে আসতে পারি?

যাও না। পাশের বাড়িতে চাবি আছে।

আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?

আমি গিয়ে কি করব?

চলুন একটু ঘুরে সব দেখে আসি।

চলো তাহলে। বলে কাকা উঠল।

রিকশা করে দশ মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে গেল তারা।

বাড়িখানা ভালই করেছে বীণা। দেওয়াল দিয়ে ঘর তুলেছে নতুন করে। পাকা মেঝে। একখানা দাওয়া হয়েছে। বেশ দেখাচ্ছে। শুধু সুখটা তার সইল না।

কাকা চাবি আনিয়ে ঘরে ঢুকল। পশ্চিম-উত্তর কোণে গর্তটা দেখিয়ে বলল, দেখ কাণ্ড!

গর্তটা ভাল করে দেখল নিমাই। একখানা শাবল পড়ে আছে পাশে। গর্তের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নিমাই কিছু একটা খুঁজছে।

কি খুঁজছো?

মাপটা দেখছি।

কিসের মাপ?

গর্তের মাপ।

কেন বলো তো!

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগের গর্তটা এখানে ছিল না। মাপটাও বড় ছিল।

কোথায় ছিল গর্তটা?

ওই দিকটায়। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ওদিকটা আমি একটু খুঁড়ে দেখব কাকা?

তোমার কি ধারণা মালটা এখানেই ফেলে গেছে বীণা? তাহলে গর্ত খুঁড়ল কেন? ও জিনিস ওর সঙ্গেই আছে।

নিমাই খুব বোকার মতো মুখ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, সঙ্গেই থাকার কথা। তবে কিনা আপনার ছেলেরা নজর রাখছে টের পেয়ে সে জিনিসটা সঙ্গে নাও নিতে পারে। ধরা পড়লে তো হয়েই গেল। তাই হয়তো বুদ্ধি খাটিয়েছে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।

সেটা কিরকম?

ঘরে যে খানাতল্লাসি হবে সেটা বীণা জানে। তাই গর্তটা করে রেখে গেছে যাতে আপনার মনে হয় যে, মাল হাপিস হয়েছে।

ও বাবা! এ যে সাঙ্ঘাতিক কথা বলছো!

লোভ মানুষকে দুষ্টবুদ্ধি জোগায়।

তাহলে ওদিকটা খুঁড়েই দেখ। যদিও আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, তবু দেখ।

নিমাই শাবলটা নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মেঝেটা আগে ভাল করে দেখে নিল। তার চোখ খুবই ভাল। দেখতে পেল, একটা জায়গায় একটা টিপ ছাপ আছে। খুব হালকা, প্রায় চোখেই পড়ে না। গাঁথনি খুবই কাঁচা। সামান্য সিমেন্ট আর মেলা বালি দিয়ে সস্তায় কাজ সারা হয়েছে। নিমাই অল্প পরিশ্রমেই গর্ত করে ফেলতে পারল। তারপর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করে প্লাস্টিকে জড়ানো স্টেনলেস স্টিলের কৌটোটা বের করে আনল। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। বুক কাঁপছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

কাকা অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিমাইয়ের দিকে। মুখে বাক্য নেই।

নিমাইও কথা কইতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর স্খলিত গলায় বলল, এই নিন। বোধ হয় এটাই।

দু’হাতে জিনিসটা বাড়িয়ে ধরল নিমাই। চোখে জল।

কাকা হাত বাড়িয়ে নিল। তারপর চৌকিতে বসে ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের মোড়ক খুলল। কৌটোর ঢাকনা খুলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। কৌটোটার ভিতরে প্লাস্টিকে মোড়া ঠাসা ডলার আর পাউন্ডের নোট। কাকা নোটগুলো বের করল, নীরবে গুনল। তারপর নিমাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, সব ঠিক আছে নিমাই।

ঠিক আছে? বলে নিমাই মাথা নেড়ে বলল, কিছুই ঠিক নেই কাকা। মানুষ ঠিক নেই। মতলব ঠিক নেই। বুদ্ধি ঠিক নেই।

তুমি বড্ড ভেঙে পড়েছে নিমাই। বসো, দম নাও!

নিমাই মাথা নেড়ে বলে, কটাই বা টাকা বলুন! তার জন্য গুনোগার কত দিতে হল। মানুষ খুন হল, স্বামী-স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হল, উদ্বেগ অশান্তি সন্দেহ কত কী দেখা দিল! তবু বীণাপাণি লোভ ছাড়তে পারেনি। হিসেব করে বলবেন তো, এই বিলিতি টাকায় আমাদের কত টাকা হয়।

হিসেব করতে হবে। তবু অনুমান পঞ্চাশ হাজারের মতো হবে।

ব্যস! বলে চোখ বুজল নিমাই।

কাকা একটু হাসল, আজ সত্যি করেই বলছি, তোমার মতো মানুষ আমি আর দেখিনি। আমি পাপীতাপী লোক বটে, কিন্তু যে ভাল, তাকে ভাল বলতে জানি।

হাত জোড় করে নিমাই বলল, দোহাই কাকা, আমার প্রশংসা করবেন না। ও শুনলেও পাপ হয়। কাজ হয়ে গেছে, এবার তবে আসি গিয়ে আমি?

আরে পাগল? এত সহজে ছাড়ব নাকি তোমায়? চলো, আমার ওখানে বসে একটু চা-মিষ্টি খেয়ে যাবে।

এসব আমার গলা দিয়ে নামবে না কাকা। আজ মাথাটা বড্ড চক্কর দিচ্ছে। বুকটাও হালকা। এখন বীণা আমাকে শত শাপশাপান্ত করলেও কিছু না।

বাক্সটা আবার প্লাস্টিকে মুড়ে নিল কাকা। তারপর বলল, বীণার একটা ছেলের সঙ্গে নটঘট ছিল, জানোই তো! তাকে খুব মারধর করা হয়েছে। ছোকরা হাসপাতালে পড়ে আছে। এসব কাণ্ডের পর বীণাকে আর বনগাঁয়ে থাকতে দেওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াল।

নিমাই কাকার হাত দুটো চেপে ধরে বলল, ওকে মাপ করে দিতে হবে কাকা। আপনি যদি রক্ষে করেন তো কেউ ওর ক্ষতি করবে না, প্রাণটা রক্ষে করুন।

কাকা হাসল, তুমি কি বীণাকে এখনও এত ভালবাসো?

ভালবাসা জিনিসটা কিরকম তাই জানি না। আমার ওর ওপর কোনও দাবিদাওয়া বা লোভ নেই কাকা, তবে সে আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। রোগেভোগে যখন মরতে বসেছিলাম, তখন বীণা না বাঁচালে, বাঁচা যেত না। সেই ঋণটা শোধ হওয়া দরকার।

কাকা একটু ভেবে বলল, আজ দলের সবাইকে ডেকে ঘটনাটা বলব, তারপর একটা কিছু স্থির করতে হবে। যাত্রার দলে বীণাকে আর রাখতে চাই না। তার বদনাম হয়ে গেছে।

সে আপনি যা ভাল বুঝবেন, করবেন। শুধু প্রাণে মারবেন না।

না, সে ভয় আর নেই। বীণাও শিগগির এদিকে আসবে বলে মনে হয় না।

নিমাই মাথা নেড়ে বলল, আসবে। ঠিক আসবে।

কি করে বলছো?

ডলার আর পাউন্ডের লোভে আসবে ঠিকই। তবে দিনের আলোয় নয়, রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আসবে। আমার ভয় তখন যদি আপনার দলের ছেলেরা তাকে ধরতে পারে তো বিপদ ঘটবে।

কাকা মাথা নেড়ে বলে, না। আমি বারণ করে দেবো। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

আর সজলবাবুকে সে যদি বিয়ে করতে চায় তো করতে পারে। যদি দেখা হয় তো বলে দেবেন।

এত বড় কথাটা বলতে বলছো!

বলছি। সে যাতে খুশি হয় তাই করুক। আমার আর কিছু এসে যায় না। আমি আসি গিয়ে কাকা?

চলো, তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি।

চলুন।

বাস স্ট্যান্ডে এসে নিমাই বাস ধরে ফিরে এল।

মনটা ভাল নেই। মানুষ পাপের জঞ্জাল জমিয়ে তোলে। একটা জঞ্জাল সাফ হয়, তারপর ফের জমে যায়।

ফিরে এসে কাজেকর্মে মন দিল নিমাই।

বাবা বলল, ওরে, আর কতকাল আমাকে এখানে ধরে রাখবি? আমার এখানে মন বসছে না।

নিমাই বলল, চলুন, আজই পালপাড়ায় রেখে আসি আপনাকে।

সন্ধেবেলা ফিরে এসে দেখল দোকানে রামজীবন বসে আছে।

আরে, আপনি কখন এলেন? বলে পায়ের ধুলো নিতে গেল নিমাই।

তাকে ধরে ফেলে রামজীবন বলল, বিকেল থেকে বসে আছি। সামনের সপ্তাহে আমাদের গৃহপ্রবেশ। বাবা তোমাকে নেমন্তন্ন করতে পাঠাল।

আমাকে? বলে নিমাই অবাক।

তোমাকেই। বড়দা বিরাট বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। মা বাবা থাকবে, দেখলে তাজ্জব হয়ে যাবে।

কিন্তু— বলে নিমাই ঘাড় চুলকোলো।

ওজর আপত্তি শুনতে আসিনি। তোমাকে যেতে হচ্ছে।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বীণাপাণি কি এখন ওখানে আছে?

আছে।

আপনাকে একটা কথা বলব?

বলেই ফেল।

তাকে বলবেন বনগাঁর গণ্ডগোল মিটে গেছে।

কিসের গণ্ডগোল?

ছিল একটা। সে ইচ্ছে করলে ফিরে যেতে পারে।

রামজীবন একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ। বীণাও বলছিল বটে, ওর এবার বনগাঁয়ে যাওয়া দরকার।

বলবেন যেন নির্ভয়ে যায়। কেউ কিছু বলবে না।

আচ্ছা বলব। তাহলে আসি। তারিখটা মনে রেখো।

যে আজ্ঞে। মনে থাকবে। তবে একটু বসে যান।

বেশ কারবারটি ফেঁদেছো তো! ভালই চলছে দেখছি। সন্ধে থেকে তো খদ্দেরের কামাই দেখছি না।

চলে যাচ্ছে।

আমিও দোকান করছি। কিরকম চলবে কে জানে! গাঁয়ে গঞ্জে দোকান চালানো কঠিন।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যে আজ্ঞে।

রামজীবনকে মাংস পরোটা ঠেসে খাইয়ে দিল নিমাই। রামজীবন মহা খুশি। বলল, ওঃ, অনেকদিন এরকম ভাল রান্না খাইনি। তাই বলি, দোকান এত চলে কেন?

রামজীবন চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল নিমাই। গৃহপ্রবেশে সে যাবে না। সম্পর্কই চুকে গেছে, যাবে কেন? তবে শ্বশুর লোকটা বড় ভাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *