2 of 3

৯৩. প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে

॥ ৯৩ ॥

প্রস্তাবটা দ্বিতীয়বার তুলতে খুবই লজ্জা করছিল হেমকান্তর। রাজেনবাবু ভাল মানুষ, হয়তো কিছু মনে করবেন না, বরং খুশিই হবেন। কিন্তু হেমকান্ত নিজের মানমর্যাদার কথা ভেবে সঙ্কোচ বোধ করছিলেন। বিয়ের কথা আগে একবার হয়েছিল, বিশাখা অরাজি থাকায় এগোয়নি। এখন আবার নতুন করে প্রস্তাব তোলার একটা ভাল অজুহাত থাকা চাই।

ভেবেচিন্তে যে কিছু স্থির করবেন তার উপায় নেই। তেরোই ফাল্গুন বিয়ের দিন ধার্য করলে হাতে সময় খুবই কম। রঙ্গময়ী রোজ তাগাদা দিচ্ছে। বলছে, অত সঙ্কোচ করছো কেন? রাজেনবাবুরাও জানে যে, শচীন আর বিশাখা এখন বিয়ের জন্য মুখিয়ে আছে। কেউ কিছু মনে করবে না।

দিনকাল পাল্টে গেছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা নিজেদের বিয়ে নিয়ে নিজেরাই বোধহয় মাথা ঘামায়।

ছুটির দিন দেখে হেমকান্ত একদিন রাজেনবাবুকে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে পাঠালেন। খুবই একান্তে এবং সাধারণভাবে প্রস্তাবটা করবেন বলে।

নির্দিষ্ট দিনে রাজেনবাবু এলেন। খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে বসলেন বাইরের ঘরে।

হেমকান্ত বিনীতভাবে বললেন, আমার দুর্ভাগ্যের কথা তো সবই জানেন।

দুর্ভাগ্য! দুর্ভাগ্য কী বলছেন?

ছেলেটা গৃহত্যাগী হল। মা-মরা ছেলে। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হেমকান্ত।

রাজেনবাবু ম্লান হেসে বললেন, বাপ হয়ে ছেলের জন্য উদ্বেগ থাকবে না তা তো হয় না। তবু বলি অমন ছেলের বাবা হতে পারলে আমি নিজে ভারী গৌরব বোধ করতাম।

এ কথায় হেমকান্তর চোখে জল এল। সামলাতে একটু সময় নিলেন। তারপর ধরা গলায় বললেন, আমি নানা দিক দিয়েই ভাগ্যতাড়িত। স্ত্রী অকালে চলে গেলেন, ছেলে বিবাগী।

আমরা সব খবরই রাখি হেমবাবু। ভগবান সবসময়ে তো শুধু দেন না, কিছু নেনও। কর্ত্রী বড় লক্ষ্মীমন্ত ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ায় আমরাও একরকম মাতৃহারা হয়েছি। আমার দুর্দিনে তিনি অনেক সাহায্য করেছেন।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, একবার শচীনের সঙ্গে বিশাখার বিবাহের একটা প্রস্তাব তুলেছিলাম। আপনিও সম্মতি দিয়েছিলেন। নানা ঘটনায় আর সে ব্যাপারে এগোনো সম্ভব হয়নি। এখনো যদি আপনার মত থাকে তবে অগ্রসর হই।

রাজেনবাবু সহসা জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তাঁর বিচক্ষণ মুখখানায় কোনো ভাব প্রকাশ পেল না। একটু পর বললেন, প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলেই করেছিলাম। এখনো অমত কিছু নেই। বিশেষত পাত্র ও পাত্রীরও যখন পরস্পরকে পছন্দ। কিন্তু একটা ছোট্ট বাধা হচ্ছে।

হেমকান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কী বাধা?

যদি অভয় দেন তো বলি।

অভয় না দেওয়ার কিছু নেই। আমি খোলামেলা মানুষ।

রাজেনবাবু আবার একটু ভাবলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, আপনি বিপত্নীক। কিন্তু বেশ কম বয়সেই বিপত্নীক হয়েছিলেন। ইচ্ছে করলে আবার বিয়ে করতে পারতেন, কিন্তু করেননি।

হেমকান্ত ভারী অসহায় বোধ করে বললেন, আবার ওসব কথা কেন রাজেনবাবু?

রাজেনবাবু মাথাটা সামান্য নেড়ে বললেন, আমি আপনার পরম শুভাকাঙক্ষী বলেই কথাটা তুলতে চাইছি।

হেমকান্তর অভ্যন্তরে একটা ভয় টিকটিক করছিল। বুঝতে পারছেন, একটা আঘাত আসছে। তবু বলতে হল, বলুন না। সঙ্কোচের কিছু নেই।

রাজেনবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, মানুষ হিসেবে আপনি তুলনাহীন। এমন মাটির মানুষ খুব কম দেখা যায়। আপনার অন্যান্য গুণ সম্পর্কেও আমরা জানি। এই তো সেদিন গুণ্ডার ছুরি খেলেন বিনা অপরাধে! কিন্তু কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন না। আপনার মতো মহৎ বাবা না হলে কি কৃষ্ণকান্তর মতো উজ্জ্বল ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়?

হেমকান্ত কুণ্ঠায় চক্ষু নত করলেন।

রাজেনবাবু বললেন, কিন্তু আমরা এও বুঝি আপনার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন মানুষ দরকার। যে-সে মানুষ নয়। বেতনভুক কর্মচারী দিয়ে সেবা জিনিসটা হয় না। আপনার বড় দুই ছেলে প্রবাসে, বিশাখার বিয়ে হয়ে গেলে আপনি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবেন। তখন যদি দেখাশোনার লোক না থাকে তবে খুবই অসুবিধে হবে।

আমার অভ্যাস আছে।

রাজেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, অভ্যাসের কথা বলছেন! আজ শক্তসমর্থ আছেন বলে বুঝতে পারছেন না। বয়স যখন হবে তখন বুঝবেন।

হেমকান্ত চকিতে একবার রাজেনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে নিলেন।

রাজেনবাবু বললেন, তাই আমি আপনার কাছে আজ একটা প্রস্তাব নিয়েই এসেছি।

হেমকান্ত নড়েচড়ে বসলেন। বড় অস্বস্তি। আঘাতটা কি আসছে এইবার? যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বললেন, বলুন।

আমি মনে করি কালক্ষেপ না করে আপনার আবার দার পরিগ্রহ করা প্রয়োজন।

কথাটা প্রায় সাধু ভাষায় বলা, তবু অর্থ তো পরিষ্কার। হেমকান্ত সহসা জবাব দিতে পারলেন না। চুপ করে রইলেন। রঙ্গময়ীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সিদ্ধান্ত তো তিনি নিয়েই রেখেছিলেন। তবু সঙ্কোচ ছিল। ভয় ছিল।

রাজেনবাবু নম্র গলায় বললেন, আমি সব দিক বিবেচনা করেই কথাটা বলার সাহস পেলাম। একটু স্পর্ধা হয়তো প্রকাশ পেল, কিন্তু যদি আমার পরামর্শ গ্রাহ্য করেন তবে আখেরে মঙ্গলই হবে।

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন। বুঝেছেন। তারপর বললেন, কিন্তু এ প্রস্তাবটার পিছনে অন্য কিছু নেই তো রাজেনবাবু? কোনো গুজব বা রটনা?

রাজেনবাবু সামান্য হাসলেন। তারপর হেমকান্তর দিকে একটু চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, রটনা যাই থাকুক আমি কিন্তু আপনার চরিত্র জানি। যাকে যথার্থ পৌরুষ বলে আপনার তা আছে। যদি না থাকত তাহলে আজ এ বাড়ির মেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব কানেও তুলতাম না।

হেমকান্ত কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। সঙ্কটে তাঁর মাথা গুলিয়ে যায়। বললেন, বিশাখাকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে এটাই কি আপনার শর্ত?

রাজেনবাবু জিব কেটে বললেন, ছিঃ ছিঃ, শর্ত কিসের? আপনার মত মানুষকে শর্ত দিয়ে বেঁধে কি ছোটো করা উচিত? আমি প্রস্তাবটা করছি অন্য কারণে।

কারণটাই জানতে চাই, যদি বলতে বাধা না থাকে।

রাজেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, বলতে যে হবে তা জানতাম। তাই অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে বুঝলাম আপনার সঙ্গে সোজাসুজি এবং খোলাখুলি কথা বলাই ভাল। আপনি তো জানেন, পুরুষ মানুষ যেমনই হোক তার পিছনে একটা অন্দরমহল থাকে!

হেমকান্ত মৃদু হেসে বললেন, আমি অন্দরমহলের বিশেষ খবর রাখি না। সুনয়নী বেঁচে থাকতেও রাখতাম না। আর এখন তো আমার অন্দরমহল বলেই কিছু নেই।

রাজেনবাবুও সহাস্যে বললেন, আপনি একদিক দিয়ে ভাগ্যবান। আমাদের শুধু অন্দরমহলের খবরই রাখতে হয় না, ওই চাবির গোছার ঝনৎকার, ওই বালা আর চুড়ির শব্দের মধ্যে যেসব সঙ্কেত আছে সে সম্পর্কেও হুশিয়ার থাকতে হয়।

দুজনেই হাসলেন।

হেমকান্তর হাসি কিছুটা ম্লান। বললেন, বুঝেছি। অন্দরমহলে আমাকে নিয়ে কোনো কথা উঠেছে। তাই না?

রাজেনবাবু হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। অনেকটা সময় পার করে বললেন, ঠিক তা নয়। মেয়েরা কূটকচালি পরনিন্দা পরচর্চা করে বটে, সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু আমার অন্দরমহলে একটু অন্যরকম মনোভাবও আছে। আপনার প্রতি আমাদের এক ধরনের দুর্বলতা আছে। আমরা বাস্তবিকই আপনার সুখে সুখী এবং দুঃখে দুঃখী হই। কৃষ্ণ নিরুদ্দেশ হওয়ায় আমার স্ত্রী খুবই কান্নাকাটি করেছেন।

কৃষ্ণকান্ত প্রসঙ্গে হেমকান্ত ফের উদাস হয়ে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, আমি বড়ই হতভাগ্য। জীবনে কোনো কিছুকেই আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। যা ঘটবার সবই ঘটে যাচ্ছে, আমার যেন কিছুই করার নেই।

রাজেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ওরকমভাবে বলবেন না। মানুষ সব সময় সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তা বলে আপনাকে কেউ দুর্বলচিত্ত বলে ভাবে না।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বললেন, ঠিক সেটাই ভাবে। আমিও জানি যে, আমি দুর্বলচিত্ত। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, আমার কখনো কোনো পদস্খলন ঘটেনি।

ছিঃ ছিঃ, সে ইঙ্গিত আপনার শত্রুও করে না।

করে। আমি জানি।

কিছু দুর্মুখ থাকতে পারে, তাদের কথা আলাদা।

দুর্মুখ নয়, যেটা ঘটা স্বাভাবিক সেটাই তারা বলে। কিন্তু আমি এমনই দুর্বলচিত্ত যে মনু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে আমার বহু বছর লেগেছে।

মনু! বলে রাজেনবাবু সোজা হয়ে বসলেন।

হেমকান্তর আর ভয় করল না। দুর্বলতা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। সহজভাবে রাজেনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ মনু। তাকে নিয়েই তো যত রটনা।

রাজেনবাবুর মুখ থেকে হাসিটা মুছে গিয়েছিল। আবার ফিরে এল। বললেন, আপনি কি সত্যিই কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

নিয়েছি। আমরা বিয়ে করার কথা ভাবছি। তবে এখানে নয়, প্রকাশ্যেও নয়।

গোপনীয়তার দরকার আছে কি?

আছে। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তারা সামাজিক জীব। আমি তাদের কোনো অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না।

রাজেনবাবু একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল।

সহজ হল?

হল। আমি আপনাকে এ কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।

হেমকান্ত অবাক হয়ে বললেন, সে কী? আপনি আমাদের বিয়ে অনুমোদন করেন?

করি। কারণ আমি পুরুষমানুষ। মধ্যবয়সে স্ত্রী-বিয়োগ ঘটলে যে পুরুষের কী দুর্গতি হয় তা আমি আন্দাজ করতে পারি। অনেককে দেখেছি।

আর আপনার অন্দরমহল?

অন্দরমহলের কথা আলাদা। বাইরের জগতের সব কিছুই তাদের কাছে বাঁকা ভাবে গিয়ে পৌঁছোয়। আপনি ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।

কিন্তু চিন্তার কথা আছে যে। আমার মেয়েটি যদি আপনার অন্দরমহলের কাছে আমার কলঙ্কের জন্যই গ্রহণযোগ্য না হয়?

কলঙ্ক আর থাকছে কই? আপনি যদি মনুকে বিয়ে করেন তাহলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল।

বুড়ো বয়সের বিয়েই কি খুব প্রশংসাযোগ্য?

আমার অন্দরমহল মনে করেন, পুরুষের বিয়ের বয়সটা বড় কথা নয়। আর আপনার তেমন বয়স হয়েছে বলেও তো আমরা জানি না। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অন্তত সাত-আট বছরের ছোটো। তাই না?

আমার পঞ্চাশ পূর্ণ হয়েছে।

ছেলেমানুষ। আর মনুও তো হামা দেয় না। সেও যথেষ্ট বয়স্কা মহিলা।

তবু আপনার অন্দরমহলে সব কথাই জানাবেন। আপত্তি থাকলে আমি আর মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হবো না।

জানাব। তবে আপত্তি যে আর উঠবে না এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

হেমকান্ত মাথা নাড়লেন।

রাজেনবাবু চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ স্থিরভাবে বসে রইলেন তিনি। খুব অন্যমনস্ক। গভীর বিষণ্ণ।

সামনেই একটু নড়াচড়া লক্ষ করে চিন্তারাজ্য থেকে বাস্তবে নামলেন। চোখের দৃষ্টি চিন্তামুক্ত হতে সময় নিল। তারপর দেখলেন, রঙ্গময়ী।

রঙ্গময়ী বলল, সব শুনেছি।

শুনেছো? যাক।

যাক কি? অত হাল ছাড়লে চলবে না।

আমার হাল নেই মনু। বহুকাল আমার নৌকো বেহাল হয়ে স্রোতে ভেসে চলেছে।

তাই বুঝি?

তা নয় তো কি?

বেশ স্বার্থপরের মতো কথা কিন্তু।

কথাটা কি মিথ্যে?

নয়? হাল তুমি ধরোনি বলেই কি আর কেউ ধরে নেই?

হেমকান্ত একটু হাসলেন। বললেন, হাল ধরেছো নাকি? কাছেই আসতে চাও না তো হাল ধরা!

নইলে এতকাল সত্যিই স্রোতে ভেসে যেতে।

রাজেনবাবু কি প্রস্তাব দিয়ে গেলেন শুনলে তো?

শুনেছি।

এবার বলো কী করা যায়!

কী আবার! তুমি তো সবই জানিয়ে দিয়েছো।

কাজটা কি ঠিক হল?

খুব ঠিক হল। ঢাক-ঢাক গুড়গুড়ের চেয়ে ভাল।

বিয়েটা যদি ভেঙে যায়?

পাগল নাকি? মিঞা-বিবি রাজি তো কাজির সাধ্য কি?

হেমকান্ত বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বললেন, রাজেনবাবুর একটি অন্দরমহল আছে। সিদ্ধান্ত হবে সেখানে। আমাদের বেশীরভাগ সংসারেই গুরুতর সিদ্ধান্তগুলো আসে হেঁসেল থেকে।

আসে বেশ হয়। তোমার মত উদাসী পুরুষদের সিদ্ধান্ত হেঁসেল থেকে আসবে না তো কোথা থেকে আসবে?

রাগ করছে কেন? আমি বলছি সেখানে যদি অন্য কোনোরকম সিদ্ধান্ত হয়?

রাজেনবাবুর অন্দরমহলকে আমি ওঁর চেয়েও বেশী চিনি।

চেনো? তাহলে বলো তাঁর মত কী!

তাঁকে আমি সব বলেছি। উনি শুনে মোটেই রাগ করেননি। বরং নিশ্চিন্ত হয়েছেন। পাঁচজনের পাঁচ কথা রটানোর সুযোগ দেওয়ার চেয়ে বিয়ে অনেক ভাল। তাতে একটু ছিঃ ছিঃ হতে পারে বটে, কিন্তু শেষ অবধি মুখে কুলুপ পড়বেই।

হেমকান্ত একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কৃষ্ণকান্তটা যদি কাছে থাকত!

আবার তার কথা এখন কেন?

সে থাকলে আমি স্বাভাবিক মাথায় সব কিছু চিন্তা করতে পারতাম। এখন অর্ধেক মাথায় কেবল তার কথা ভাবি, বাকি অর্ধেক মাথা নিয়ে বিষয়চিন্তা করি।

সে যে দূরে আছে সেটাও ভগবানের আশীর্বাদ বলে জেনো।

কেন বলো তো!

সে কাছে থাকলে তুমি হয়তো শেষ অবধি আমাকে বিয়ে করার কথা ভেবেই যেতে কিন্তু করতে পারতে না। তোমার লজ্জা হত, সঙ্কোচ হত।

হেমকান্ত চুপ করে রইলেন। কথাটা যুক্তিযুক্ত।

রঙ্গময়ী বলল, রাজেনবাবু তোমার কাছে আর একটা কথা জানতে চাইবেন।

সেটা কী?

উনি জানতে চাইবেন তোমার আর আমার বিয়ে কবে হবে।

কী বলব বলো তো!

বলবে হয়ে গেছে।

হেমকান্ত চমকে উঠে বললেন, মিথ্যে কথা বলব?

মিথ্যে হবে কেন? তার আগেই যে আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে।

সে কী? বলে হেমকান্ত উত্তেজনায় উঠে গেলেন।

রঙ্গময়ী এগিয়ে গিয়ে হেমকান্তর হাত ধরে বলল, ওরকম করছো কেন? বোসো।

হেমকান্ত বসলেন। বললেন, আমি তো ভেবেই কুল পাচ্ছি না মনু, কী বলছো তুমি!

রঙ্গময়ী হেমকান্তর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বলল, সেই ছোট্ট থেকে তোমার দিকে চেয়ে বসে আছি। মগডালের ফল তুমি, হাতের নাগালে তো নও। একটা জীবন তোমার দিকে চেয়েই কাটিয়ে দিতে পারতাম। আর তো বয়স নেই। রক্ত কত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তবু আজ তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে এই কাজ তোমাকে আর আমাকে করতে হবে। ওদের বিয়ের পর আমরা না হয় কাশীবাসী হবো।

কিন্তু আমাদের বিয়ের কথা কী বলছিলে?

আমাদের বিয়ে আজ।

আজ?

চমকে উঠো না। আজ লগ্ন আছে, দিন আছে।

বলো কী?

ঠিকই বলছি। এ তো সানাই বাজিয়ে লোক ডেকে বিয়ে নয়। বিয়ে হবে ঠাকুরবাড়িতে। বাবা পুরোহিত হবেন। যজ্ঞ হবে।

হেমকান্ত নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। স্থির চোখে রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে ছিলেন।

রঙ্গময়ী বলল, জানি এটা বড় সুখের সময় নয়। কৃষ্ণ বাইরে, তোমার মন ভাল নেই। তবু বলি, সময় আর কখনো হবে না।

গোপনে বিয়ে করতে হবে মনু?

আমি তো তাই বলি। গোপনই ভাল।

হেমকান্ত অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর অদ্ভুত একটা কথা বললেন, কিন্তু বিয়ে তো উপপাসী থেকে করতে হয়।

বিয়ে কত রকম আছে তুমি জানো?

না। তা জানি না।

তবে ওটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি জানি। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় মতে। একটুও ত্রুটি থাকবে না।

কাজটা কি ভাল হবে মনু?

তা আমি জানি না গো। পাত্রী পছন্দ না হলে এখনো ভেবে দেখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *