2 of 3

৯৩. পুত্রকন্যা শব্দগুলির অর্থ

৯৩

বিষ্ণুপদ ক’দিন যাবৎ পুত্রকন্যা শব্দগুলির অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে মনে মনে। তার চেয়েও বড় কথা সম্পর্কটা কিসের, কেন সম্পর্ক সেইটে—এত কিছু জানার পরও— নতুন করে জানতে চায় সে। এ বাড়িতে তেমন কোনও শাস্ত্রটাস্ত্র নেই, ভাল ডিকশনারি নেই, নাগালের মধ্যে তেমন কোনও পণ্ডিত ব্যক্তি নেই যার কাছে নতুন করে এ বিষয়ে পাঠ নেবে। তাই সারাদিন শুয়ে শুয়ে মনে মনে মানে খুঁজে যাচ্ছে সে। সব বিশ্বাস, সব বলভরসা পুরনো ইমারতের মতোই ধসে পড়ে গেল যে সেদিন, যেদিন বামাচরণ তার বাপান্ত করে গেল।

প্রায় দু-তিন ঘণ্টা বিষ্ণুপদর জ্ঞান ছিল না। প্রেশার ঠেলে উঠেছিল দুশোর ওপরে। পুলিন তেমন দরের ডাক্তার না হতে পারে কিন্তু ঠেকা সে-ই দিয়েছিল। প্রেশারের ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, হাতের শিরা কেটে খানিক রক্তমোক্ষণ করে দিয়েছিল। বলেছিল, ওরে বাবা, আমরা সেকেলে লোক। আধুনিক চিকিৎসা না জানতে পারি, কিন্তু পুরনো চাল এখনও ভাতে বাড়ে।

দুদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে কৃষ্ণজীবন কলকাতা থেকে একজন বড় ডাক্তারকে এনে দেখায়। ডাক্তার মেলা ওষুধপত্র দিয়ে গেছে। বলেছে, শুয়ে থাকতে হবে কিছুদিন। তেমন ভয়ের নাকি কিছু নেই।

মানুষের অসুখটা যে কোথায় তা ডাক্তাররা কি ঠাহর পায়? এই যে শরীরটা কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল সেদিন, তার কারণ কি শুধু শরীর? মন নয়? বামাচরণের ওইসব কথা শোনার পর থেকেই শরীরের ভিত কেঁপে গেল। সেই থেকে ভাবছে আর ভাবছে। শরীর হয়তো সারবে, মন সারায় কে!

ধাঁ ধাঁ করে বাড়িটা প্রায় উঠে গেল। মেঝেতে টালি বসানোর কাজ চলছে। জানালা দরজা বসানো হচ্ছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি লাইন বসাচ্ছে। এলাহি ব্যাপার। জানালা দিয়ে সব দেখতে পায় বিষ্ণুপদ। জীবনের বারো আনা কেন, পনেরো আনাই কেটে গেল ভাঙা ঘরে। বাকি আর ক’টা দিন! তাও আয়ু ফুরোনোর আগে যদি বাড়ি শেষ হয় তবে পাকা ঘরে মরার সুখটা অন্তত পাবে। সারাদিন চেয়ে চেয়ে কাণ্ডটা দেখে বিষ্ণুপদর মনটা যেন কেমন হয়ে যায়। বাড়িতে সুখ নেই, টাকায় সুখ নেই, সংসারে সুখ নেই। সুখ যে কোথায় আছে কে জানে!

রামজীবন আর কিছু পারেনি তবে মাসটাক আগে হঠাৎ একটা দুধেল গাই বাছুর সমেত কোত্থেকে কিনে এনেছে। এনেই বলল, এখন আপনার একটু ছানাটানা খাওয়ার দরকার।

গরু দেখে বিষ্ণুপদর চোখ চড়কগাছ। বলল, ও বাবা, এ মরা পেটে দুধ ছানা সইবে নাকি?

খুব সইবে। আপনার শরীরে তো সারবস্তু কিছু নেই। দুধ সহ্য না হোক, ছানা খাবেন। এ খুব তেজী গাই, দিনে দুবেলা মিলিয়ে পাঁচ সের দুধ দেয়।

বিষ্ণুপদ খুশি হয়ে বলে, তা হলে পটল আর গোপালও দুধ খেতে পারবে। ওদের বাড়ের বয়স, কচু-ঘেঁচু খেয়ে থাকলে কি বাড় হয়?

আমরা কচু-ঘেঁচু খেয়েই বড় হয়েছি। বাড়ের বয়সে এমনিতেই বাড়ে। তা খাবে’খন ওরাও।

বিষ্ণুপদ বলল, গরুর পিছনে খাটুনি আছে বাবা। বড় সুখী জীব। যত্ন করতে হয়। তুই তো আলায় বালায় ঘুরিস, গরু দেখবে কে?

রাখাল রাখব।

তবেই হয়েছে। এ কি ভাড়াটে লোকের কাজ? নিজে হাতে করতে হয়।

তাই করব। আপনি বললে তাই করব।

গো-সেবা করলে অনেক শেখা যায়, জানা যায়। অবোলা প্রাণী। কিন্তু তারও বলার মতো কথা আছে। বুঝবার চেষ্টা করতে হয়।

সেই থেকে রামজীবন গরু নিয়ে খুব মেতে আছে। ঘাসের মাঠে বেঁধে দিয়ে আসে। দুবেলা জাবনা দেয়। স্নান করায় নিয়মিত। খোল ভুষি কিনতে হাটে যায়। ভেটেরিনারি ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। গরুটা যত্ন-আত্তি পেয়ে বেশ তেল চুকচুকে হয়ে উঠেছে। দুধটাও দেয় খাসা। সকালে বাতাসার গুঁড়ো দিয়ে বেশ খানিকটা ছানা খায় রোজ।

সেই দৈনিক বরাদ্দটা নিয়ে রাঙা এসে ঘরে ঢুকল। হাতে গরম ছানার প্লেট।

বাবা, আপনার ছানা।

বিষ্ণুপদ উঠে বসে বলল, এটা থেকে তোমার শাশুড়ি মায়েরটা কি তুলে রেখেছো?

তাঁর জন্য আছে। আপনি খান।

বিষ্ণুপদ প্রসন্ন মনে প্লেটটা হাতে নিয়ে রাঙার দিকে চেয়ে বলে, আচ্ছা মা, আমি কি খুব লোভী মানুষ?

রাঙা অবাক হয়ে বলে, ও কি বলছেন!

বিষ্ণুপদ খুব হেসে বলে, বলোই না! আমাকে তোমার খুব লোভী বলে মনে হয় না?

না না, সে কী কথা!

বিষ্ণুপদ খুব হেসে মাথা নেড়ে বলে, স্বীকার কর বা না কর, আমি কিন্তু খুব লোভী মানুষ। সারা জীবন পেটে খিদে নিয়ে কেটেছে। ভরপেট বড় একটা থাকিনি, ভালমন্দ তো দূরের কথা। জিভ তাই শেষ জীবনে শোধ তুলতে চায়। বুঝলে?

আপনি খান তো। ও সব ভাববেন না।

বলতে নেই, রাঙা আজকাল খাতির করে খুব। করারই কথা। সংসারে বাতিল শ্বশুর-শাশুড়ির কল্যাণেই তারা এত বড় দোতলা বাড়িটা ভোগ দখল করবে। কাজেই এখন সে শ্বশুর আর শাশুড়িকে একটুও কথা-টথা শোনায় না। সেবা-টেবাও খুব করে।

পাতিলেবুর গন্ধওলা ছানার একটুখানি মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বিষ্ণুপদ বলল, বড্ড দেরিতে সব হল, বুঝলে, তবু হল তো!

কিসের কথা বলছেন?

এই সব যা হচ্ছে। বাড়ি হল, গরু হল, ভোগসুখ হল। সবই হল, তবু গলায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করে।

কিসের কাঁটা বাবা?

গলার কাঁটা ওই বামা। যখনই ওর কথা ভাবি, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

ও সব ভাববেন না বাবা। মেজদাদার মাথাটাই গেছে।

সেটার কথাও ভাবি। মাথাটাই বা গেল কেন? আমাদের বংশে কেউ পাগল ছিল না। তোমার শাশুড়ির বংশেও না। আগের দিনে বিয়ের সময়ে এ সব দেখা হত। আজকাল আর হয় না।

মেজদার পাগলামি তো বংশগত নয়। লোভের তাড়সে আর মেজদিদির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে হয়েছে।

তাই হবে। সে কি আর আসে-টাসে?

না। আপনার সেজো ছেলে তাঁকে খুব শাসিয়ে দিয়েছে।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ যেন ছানাটা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মুখের ছানাটা একটু জিভ দিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, আমাদের সকলেরই বড় খিদে, না বউমা? বিষয়সম্পত্তি, খাবারদাবার, যশ-প্রতিষ্ঠা, খিদের যেন শেষ নেই।

রাঙা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলল, আমি ভাবি কি জানো? মনে হয় সারা জীবন আমার যে সব খিদে চাপা ছিল তা ওই বামাচরণের ভিতরে ফুটে বেরিয়েছে। ভগবান ওকে সন্তান দেননি, সেটাও একটা কথা। ওরটা কে খাবে বলো তো! বসো বউমা, আমার কাছে একটু বসো।

বসছি বাবা, কিন্তু রান্না পড়ে আছে।

তোমার শাশুড়ি কোথায়?

শীতলাবাড়ি গেছেন।

তাঁর খুব পুজো-আচ্চার বাই। বলে বিষ্ণুপদ হাসে।

রাঙা কাঠের চেয়ারটায় বসে বলে, আপনি আজ কিন্তু ছানাটা খাচ্ছেন না, নাড়ছেন শুধু।

এক একদিন রুচিটা থাকে না। রোজ কাঁচা ছানা না দিয়ে এক একদিন ছানা দিয়ে ডালনা রেঁধো তো মা। বোধহয় ভালই লাগবে। ছানার ডালনার কথা শুনেছি, খাইনি কখনো। জানো রাঁধতে?

সোজা তো। দেবোখন বেঁধে। আজ কষ্ট করে খেয়ে নিন।

বউমা, আজকাল আর রাতে রেমোর চেঁচামেচি শুনি না। জিজ্ঞেস করতে ভয় করে, সে কি মদ ছেড়ে দিয়েছে?

রাঙা একটু জিব কেটে বলে, একরকম তাই। গরুটা আনার পর থেকে খায় না।

কেন বলো তো?

তা জানি না বাবা। মনের কথা তো আর খুলে বলেন না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষ্ণুপদ বলে, বটতলার বন্ধুরাও আসে না, না?

আজকাল আসে না। উনি তো দেখছি সন্ধেরাতেই বাড়ি চলে আসেন।

তোমাকে কিছু বলে না?

দুঃখ করেন, ওঁর তো খুব ইচ্ছে ছিল পাকা বাড়ি করে আপনাদের রাখবেন। উনি পারেননি, বড়দাদা করে দিলেন। এইজন্যই দুঃখ।

জানি। আমিও চেয়েছিলাম আমার হেয়রা ছেলেটা বাড়িটা করে দেখাক।

উনি পারতেন না বাবা। ওর টাকা নেশায় আর জুয়ায় খরচ হয়ে যাচ্ছিল। টাকা উপার্জনও তো ভাল পথে করত না।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, আমারও সেই সন্দেহ ছিল।

বড়দাদা বলেছেন একটা দোকান করে দেবেন।

বলেছে? বলে আগ্রহে ঝুঁকে বসে বিষ্ণুপদ, কী বলেছে?

বটতলায় একখান সাইকেলের দোকান করে দেবেন।

সাইকেলের দোকান? মানে সাইকেল সারাই নাকি?

না। সাইকেল আর সাইকেল পার্টসের দোকান। এ দিকে নাকি সাইকেলের দোকান নেই।

কথাটা এগিয়েছে?

হ্যাঁ। শুনেছি, দোকানঘর হচ্ছে। প্লাস্টিকের জিনিস, স্টিলের বাসন, কেরোসিন স্টোভ এ সবও নাকি থাকবে দোকানে।

রেমো বলেনি তো আমাকে! এ তো গুরুতর খবর।

বড়দা বলতে বারণ করেছেন। আমি তো পেটে কথা রাখতে পারি না, তাই আপনাকে বলে ফেললাম।

বেশ করেছে। অনেক জ্বালাপোড়ার মধ্যে এই একটা ভাল খবর। বুকটা ঠাণ্ডা হল। আমার মনে হয়, মদ ছাড়লে রেমো অনেক কিছু পারবে। তোমার কি ধারণা?

কে জানে বাবা! তবে ওঁর কথা তো কিছু বলা যায় না। আজ ভাল তো কাল খারাপ। মদের নেশা ছাড়া নাকি শক্ত। বেশির ভাগ লোকেই পারে না।

নেশা জিনিসটাই শক্ত জিনিস। তোমার শাশুড়ি কি পারবে দোক্তাপাতা ছাড়তে?

কষ্টেসৃষ্টে ছানাটা শেষ করল বিষ্ণুপদ। তারপর ওষুধ খেল। তারপর বসে রইল। মিস্ত্রিরা কাজে এল সব। আজকাল মিস্ত্রির সংখ্যা কমে গেছে। বাইরে প্লাস্টারিং হবে বলে তোড়জোর হচ্ছে। ছাদে ট্যাংক বসেছে। বাড়িটা যেন বুক ফুলিয়ে হাসছে এখন।

জানালা দিয়ে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকে বিষ্ণুপদ। এত বড় পাকা বাড়ি তাদের দেশেও ছিল না। জমিজমা ছিল কিছু বাড়ির চৌহদ্দিও বড়ই ছিল। কিন্তু সবই কাঁচা ঘর। বলতে কি, এই প্রথম তারা পাকা বাড়িতে বাস করবে।

নয়নতারা ঘরে ঢুকে বলল, শুনলে তো, লোকে বলছে আজকাল নাকি অহংকারে আমার মাটিতে পা পড়ছে না।

বিষ্ণুপদ আচমকা গলার স্বর শুনে একটু চমকে গেল। বাড়ির দিকে চেয়ে এমন মজে ছিল যে, নয়নতারার আসাটা টের পায়নি। বলল, কেন?

এই সবাই বলছে। এ গাঁয়ে তো এত বড় বাড়ি কারও নেই, তাই।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল, এ সবও শুনতে হচ্ছে! তা ভাল। একটু শুনে নাও।

তা শুনছি। তা সত্যি কথা বলতে কি, আমার একটু দেমাকও হয়েছে বাপু। কী করব বলো তো!

বিষ্ণুপদ বলল, কখনও-সখনও একটু অহংকার করতে ভালই লাগে। কখনও তো করোনি!

সেই কথাই বলছি। অহংকার করার মতো তো কিছু ছিল না। এই হল। তা হ্যাঁ গা, গৃহপ্রবেশ করতে হবে না? সবাই যে খুব ধরেছে ভালরকম ভোজ খাওয়ানোর জন্য। আমরা তো তেমন করে কাউকে কখনও নেমন্তন্ন করে খাওয়াইনি। ছেলেমেয়েদের বিয়ে নমো-নমো করে সারতে হয়েছে। তা এবার কি একটু ভাল করে করবে নাকি?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, লোককে খাইয়ে হবেটা কি? পয়সা উড়িয়ে দেওয়া বই তো নয়! লোকে পাত পেড়ে খেয়ে যায়, গিয়ে নিন্দেমন্দ করে—এটা ভাল হয়নি, ওটা বাদ গেছে। তার চেয়ে একটু পূজোটুজো দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়লেই হয়।

নয়নতারা হেসে বলে, তা হলে আমার অহংকারের কি হবে? লোকে যে বাড়ির কথা বলাবলি করছে তাদের কাছে মুখ দেখাব কি করে? দুয়ো দেবে যে! কৃষ্ণ যে মাস মাস পাঁচশো টাকা করে দিচ্ছে তা তো জমেই যাচ্ছে। আমরা তো অত টাকা খরচ করার পথই পাই না। তা সেই টাকায় হয় না?

বিষ্ণুপদ একটু ভেবে বলল, ইচ্ছে হলে দাও লাগিয়ে।

আমার বড় ইচ্ছে, একটা উপলক্ষ ধরে সবাই আবার একজোট হোক, সরস্বতী আর বীণাপাণিও আসুক।

আর বামা?

তাকে ডাকব? পাগল হলে নাকি! তোমাকে তো প্রায় মেরেই ফেলেছিল! ও ছেলেকে যে পেটে ধরেছিলাম সেইটে ভাবতেই লজ্জা হয়। কী কাণ্ডই করে গেল দুজনে!

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যদি বামাকে নেমন্তন্ন না করে তা হলে আবার একটু খোঁচ থেকে যাবে। পাঁচজনের কাছে বলে বেড়াবে নানা কথা।

সে বলে বেড়াবেই! তাছাড়া ব্যাপার-বাড়িতে এসে সে যদি চেঁচামেচি করে, তা হলে তো সব পণ্ড হবে!

বিষ্ণুপদ একটু ভেবে দেখল, কথাটা ঠিকই। বামাচরণের মাথার ঠিক নেই। শ্যামলীও সুবিধের মানুষ নয়। দুজনে মিলে কী যে করবে তার ঠিক কি? বিষ্ণুপদ বলল, তাহলে থাক।

তাহলে মত দিচ্ছো তো? গৃহপ্রবেশ একটু ভাল করেই হচ্ছে তাহলে।

তোমার যখন ইচ্ছে তখন আর অমত করি কি করে? গৃহপ্রবেশের কথায় তোমার মুখখানা একেবারে ঝলমল করে উঠল যে!

নয়নতারার মুখ সত্যিই ঝলমল করছিল। হাসি আর ধরে না। বলল, দেমাকটা বড্ড চকমক করছে ভিতরে।

তাই দেখছি।

বামাচরণ এল আরও দুদিন বাদে, এক সন্ধেবেলায়। বিষ্ণুপদ নতুন বাড়ির দালানে বসে ছিল। একখানা ডুম জ্বলছে মাথার ওপর। তাতে দালানখানা ঝকমক করছে। ওপরতলায় মেশিন চালিয়ে মেঝে পালিশ করছে মিস্তিরিরা। এমন সময়ে শ্যামলীকে নিয়ে এসে হুড়মুড় করে ঢুকল বামা।

একটু আঁতকে উঠেছিল বিষ্ণুপদ।

বামা পায়ের ওপর একেবারে উপুড় হয়ে পড়ে বলল, বাবা, মাপ করে দিন। বড় অপরাধ হয়েছে।

বিষ্ণুপদ ব্যস্ত হয়ে বলল, ওরে, ওঠ ওঠ।

বামাচরণ উঠল না। হাপুস কাঁদতে লাগল।

শ্যামলী বলল, ক’দিন ধরেই কান্নাকাটি করছে। আমিও খুব বকাঝকা করেছি।

ওকে উঠতে বলো বউমা। আমার শরীর ভাল নয়। এ সব তেমন সহ্য হয় না।

শ্যামলী হাত ধরে টেনে বসাল বামাচরণকে। বলল, তোমার জন্যই যত অশান্তি। বাবা তো বলেইছিলেন দোতলাটা আমাদের দিয়ে দেবেন। তা হলে ওরকম করতে গেলে কেন?

বিষ্ণুপদর বুকের মধ্যে একটা হাঁচোড়-পাঁচোড় হচ্ছিল। হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। বলল, তোমরা বসো। শান্তভাবে কথা কও। বেশি উত্তেজক কিছু হলে আমার কেমন হাঁফ ধরে যায়।

পরিষ্কার মেঝের ওপর দুজনে পাশাপাশি বসল। বামা চোখের জল মুছে বলল, আমি মহা পাপী, আমাকে জুতো মারুন। নইলে নরকেও ঠাঁই হবে না।

বিষ্ণুপদ হাঁফধরা গলায় বলে, একটু দম নিতে দে বাবা। বড় চমকে দিয়েছিস।

দুজনে ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।

সাড়াশব্দ টের পেয়েই বোধহয় নয়নতারা কোথা থেকে উড়ে এল যেন।

এ কি, তারা এখানে কেন? কি করতে এসেছিস?

বামাচরণ তাড়াতাড়ি মায়ের পায়ের ওপর পড়তে গেল, মা! মা গো! মাপ করে দাও।

নয়নতারা দু’ হাত পিছিয়ে গিয়ে বলল, ওরে বাপ রে, মাপ চাওয়ার কি ঘটা! কেন রে মুখপোড়া, হঠাৎ মাপ চাইতে এসে হাজির হলি কেন? মতলবখানা কি তোর?

বামাচরণ উঠে বসল। বলল, একটা অপরাধ হয়ে গেছে মা, তা বলে কি আর তার মাপ নেই?

শ্যামলী বলল, আমাদের তো তাড়িয়েই দিয়েছেন মা, নতুন করে আর কী শাস্তি দেবেন?

নয়নতারা বলল, শোনো বউমা, কথাটথা যা আছে সব আমার সঙ্গে আর রেমোর সঙ্গেই বলো। ওঁর সঙ্গে নয়। ওঁর শরীর ভাল নয়। আগের বার এসে তোমরা যা করে গেছ তাতে ওঁর কি অবস্থা হয়েছিল, তা পাঁচজনে জানে। এসো তোমরা ওপাশের পুরনো ঘরে গিয়ে বসো। আমি আসছি।

শ্যামলী একটা ঠেলা দিয়ে বামাচরণকে তুলে দিল। বিষ্ণুপদ দেখল, বামাচরণের চেহারাটা আরও খারাপ হয়েছে। রোগা পাঁশুটে, কেমনধারা যেন!

বাবা, আসি তাহলে?

বিষ্ণুপদ ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

ওরা চলে যাওয়ার পর বিষ্ণুপদ কাঁপা বুক নিয়ে বসে রইল চুপটি করে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শরীর কি আর দেবে? গৃহপ্রবেশের আগেই ফট হয়ে যাবে নাকি!

তা কামনা-বাসনা রাখতে নেই। গৃহপ্রবেশের আগেই হোক, পরেই হোক, শরীর যখন ছাড়ে ছাড়ুক, ভেবে কেন ব্যস্ত হওয়া?

উঠতে গিয়ে বিষ্ণুপদ টের পেল, হাঁটুতে বল নেই। ওঠা যাচ্ছে না। তাই ফের গা ছেড়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে রইল। পুত্র শব্দটার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *