2 of 3

৯২. একটা মধ্যযুগীয় শাসনতন্ত্র

৯২

হেমাঙ্গদের বাড়িতে এখনও একটা মধ্যযুগীয় শাসনতন্ত্র বহাল আছে। এখনও এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা যা খুশি করতে পারে না এবং করার কথা ভাবতেও পারে না। একটা অদৃশ্য শাসন এবং দৃশ্যমান ভ্রূ-কুঞ্চন তাদের আতঙ্কিত এবং সতর্ক রাখে। প্রেমঘটিত বিয়ে অবশ্য একটা-দুটো ঘটেছে, কিন্তু তাও আবার বর্ণে মিললে তবেই। কাজেই এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়তে হলেও আগেভাগে হিসেব করে নেয়।

হেমাঙ্গ জানে, সেও স্বাধীন নয়। স্বাধীনতা একটা মনোভাব যা ব্যক্তিত্বের ব্যাপার। সেটা কেমন তা অবশ্য হেমাঙ্গ জানে না। হয়তো সেটা যথেচ্ছাচার বা উচ্ছৃঙ্খলতাই হবে। যখন যা মনে এল করে ফেললাম, কারও তোয়াক্কা করলাম না। হেমাঙ্গ সেটা ইহজীবনে পেরে উঠবে বলে মনে হয় না।

এই যে গরচার বাড়িতে বসবাস বা মাঝে মাঝে গাঁয়ের বাড়িটিতে যাওয়া কিংবা গাঁয়ের প্রাকৃত মানুষের মতো জীবনযাপনের চেষ্টা, এর কোনওটাই মা বা বাবা সুনজরে দেখছে না বলে তার অস্বস্তি হচ্ছে, এটাই হয়তো মানসিক স্বাধীনতার মস্ত অন্তরায়। সে ইচ্ছে করলেই কি মা-বাবার মতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যা করছিল তা করে যেতে পারে? পারে না। তার স্বাধীনতা এইখানেই মার খেয়ে যাচ্ছে।

হেমাঙ্গ অবশ্য কয়েক মাস ধরে মাকে বেশ কয়েকবার বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু মা শেষ অবধি একটা কথাই বলল, গরচার বাড়ি তোকে লিখে দেবো, গাঁয়ে গিয়েও যা-খুশি করতে পারিস, কিন্তু শর্ত একটা। আগে বিয়ে কর। তারপর যা-খুশি করিস।

ওরে বাবা!

তোর বাবারও একই মত। বিয়ে করলে সব মেনে নেবো।

হেমাঙ্গ তাই আজকাল একটু বিমর্ষ। একটু আনমনা। বিয়ে খুব সুখের ব্যাপার নয়। একটা মেয়ের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলার মানেই হচ্ছে জীবনটা ভোগে চলে যাওয়া। প্রেম জিনিসটা কম দামী সেন্টের মতো, গন্ধ টপ করে উবে যায়। একজন চিন্তাশীল, কল্পনাপ্রবণ মানুষ বিয়ের পর হয়ে যায় শ্রমিকের মতো। প্রেমের সমাধির ওপরেই তো বিয়ের সৌধ!

প্রায় দু’ মাস ফোন করেনি রশ্মি। বোধ হয় লজ্জায়। তাকে বিব্রত করতে চায় না বলে হেমাঙ্গও করেনি। টেলিফোনের সম্পর্কটা বড্ড আনুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছিল। কুশল প্রশ্ন এবং আলগা কিছু কথা ছাড়া কোনও গভীরতায় পৌঁছচ্ছিল না। বাড়ছিল শুধু টেলিফোনের বিল। সম্পর্কটা আর জিইয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না।

কিন্তু দু’ মাস বাদে একদিন রাতে রশ্মিই টেলিফোন করল।

কেমন আছ?

ভালই। তুমি?

আমি ভাল নেই।

কেন রশ্মি?

মন ভাল নেই। তোমার জন্য।

আবার আমি কি করলাম?

তুমি কিছু করোনি। আমিই করেছি। কেবল ভাবছি কাজটা কি তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে গেল?

তা কেন রশ্মি? তুমি প্র্যাকটিক্যাল।

ঠেস দিলে না তো!

আরে না। আমি তোমার অসুবিধের কথা জানি।

এখন এখানকার অবস্থা তো খুব ভাল নয়। অনেক এথনিক গ্রুপ ঢুকে পড়েছে, রিসেশন শুরু হয়েছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। একা একটা মেয়ের পক্ষে থাকা খুব নিরাপদ নয়। অথচ আমাকে তো থাকতেই হবে।

জানি রশ্মি। তুমি কিন্তু অ্যাপোলোজাইজ কোরো না। আমি তো জানিই, একা তোমার পক্ষে ওখানে থাকার অসুবিধে আছে। পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে রশ্মি। এখন চারদিকে ভায়োলেন্স।

হ্যাঁ হেমাঙ্গ। ভীষণ ভায়োলেন্স। আর কত ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হচ্ছে, কত তাদের অভাব-অভিযোগ-দাবিদাওয়া তার সীমাসংখ্যা নেই। সবাই মিলিট্যান্ট, সবাই টেরোরিজমে বিশ্বাসী। ক্রমে ডিটোরিয়েট করছে। আমার কী মনে হয় জানো? সব দেশেই গভর্নমেন্টগুলো এদের কাছে অসহায়। কিছুই করতে পারছে না।

ফিরে এসো রশ্মি।

ফিরে গিয়ে কী হবে বলো তো! আমাদের দেশে কোনও কাজ হয়? নাকি লোকে কিছু মাথার কাজ করতে চাইলে তা করতে পারে? একটা ভাল লাইব্রেরি অবধি নেই। কী হবে ফিরে গিয়ে? আমরা ভাবছি সুইজারল্যান্ডে সেটল করব। এখনও সুইজারল্যান্ড বোধ হয় কিছুটা ভাল। আমার হাজব্যান্ডটি অবশ্য আমেরিকা বেশি পছন্দ করছে। দেখা যাক।

তোমার বিদেশবাস ঘুচবে না, না রশ্মি?

আমার কাছে ইংল্যান্ড তো বিদেশ ছিল না কখনও। বরাবর ইংল্যান্ড আমার প্রিয় জায়গা। এটাই আমার দেশ। ছোট সুন্দর শান্ত পরিচ্ছন্ন সুশৃংখল একটা দেশ। হাতের কাছেই ইউরোপ। চারদিকে যত ইতিহাস আর ঐতিহ্য ছড়ানো। কিন্তু ধীরে ধীরে সব কেমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সুইজারল্যান্ড বা আমেরিকায় সেটল করতে আমার একটুও ইচ্ছে করে না। কিন্তু বুঝতে পারছি না কী হবে।

হেমাঙ্গ খুব সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করল। সে খুব ভাগ্যবান যে রশ্মির প্রস্তাবে রাজি হয়নি। সে কিছুতেই বিদেশে থাকতে পারত না। নস্ট্যালজিয়া তাকে টানত, তাকে টানত আত্মীয়তা, তাকে টানত শিকড়। বিদেশে থাকার কথা হেমাঙ্গ ভাবতেও পারে না।

চুপ করে আছ যে! তোমার খবর তো কিছু বললে না।

আমার খবর কিছু নেই রশ্মি।

গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছ এখনও?

মাঝে মাঝে।

আমার কিন্তু তোমার নদীর ধারের বাড়িখানার কথা খুব মনে পড়ে। ভারি কিউট, সুন্দর বাড়িটি তোমার। যদি আমাদের বিয়ে হত তাহলে আমি তোমাকে ওখানেই হানিমুন করতে বলতুম।

একটু হাসল হেমাঙ্গ। বলল, থ্যাংক ইউ।

তুমি এখানে বেড়াতে আসবে বলেছিলে। সত্যিই আসবে?

হেমাঙ্গ বলে, কী হবে বেড়াতে গিয়ে বলো তো! প্লেনের যা ভাড়া হয়েছে তাতে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যায়। আর কী জানো, ভেবে দেখেছি বেড়ানোর কোনও মানে হয় না। দেশ দেখে বেড়ানো একটা পণ্ডশ্রম মাত্র। বরং এই যে কাছেপিঠে যাই, নিজের দেশটাকে বুঝবার চেষ্টা করি, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করি এতে অনেকটা গভীরতা খুঁজে পাই।

তুমি বরাবরই একটু অন্যরকম। অলওয়েজ ইন সার্চ অফ সামথিং। সেই জন্যই তুমি সবসময়ে ইন্টারেস্টিং।

কী যে বলো! আমার মনের ভিতরটা যদি দেখতে পেতে!

দেখার চেষ্টা কি করিনি? সেই যে গাঁয়ের স্কুলে অডিট করতে গিয়েছিলে সেই প্রথম দিনটি থেকেই তোমাকে লক্ষ করে আসছি। প্রথম দিন থেকেই মনে হয়েছিল তুমি নরম মনের মানুষ। তোমার খুব একটা স্ট্রং পারসোনালিটি নেই ঠিকই, কিন্তু তোমার ভিতরে একটি কৌতুহলী শিশু আছে। পৃথিবীটা তোমার কাছে সহজে পুরনো হবে না। এটা কিন্তু একটা মস্ত কমপ্লিমেন্ট, বুঝেছ?

হয়তো ঠিকই বলেছ।

বিয়ে করার কথা ভাবছ নাকি?

না তো!

ভাল থেকো।

তুমিও ভাল থেকো।

এইভাবে শেষ হল টেলিফোন পর্ব। কিন্তু রেশ থেকে গেল। টেলিফোন রেখে দেওয়ার পর রশ্মিকে নিয়ে অনেক ভাবল হেমাঙ্গ। ভাবল প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি নিয়ে। ভাবল মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে। তারপর তার মনে হল, দুটি কাঁটা যেমন ক্রমাগত উল বুনে বুনে তৈরি করে সোয়েটারের প্যাটার্ন, দুটি মানুষ কি তা পারে? সম্পর্ক কি ওইরকম, উলের মতো নানা নকশা সৃষ্টি করে যাওয়া?

বিয়ে, প্রেম ইত্যাদি তামাদি হয়ে যাচ্ছে দুনিয়ায়। ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় রোমান্টিক প্রেম কবেই নির্বাসনে গেছে। আছে কেবল দগদগে যৌন সম্পর্ক। ওই সম্পর্কের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। বিয়ে করছে না, একসঙ্গে থাকছে, ছেলেপুলে হচ্ছে, বাঁধা পড়ছে না। পৃথিবীর ভবিতব্য কি তাহলে ওটাই? কুকুর বেড়ালের মতো শুধু দেহের প্রয়োজনে একসঙ্গে হওয়া এবং ফের আলাদা হয়ে যাওয়া, ইচ্ছে হলেই?

হেমাঙ্গ কিছুটা অস্থির বোধ করতে থাকে। মাঝে মাঝেই জীবন থেকে বিষধর সাপের মতো নানা প্রশ্ন উঠে এসে তাকে ছোবল দিয়ে যায়। বিষ অনেকক্ষণ জর্জরিত রাখে তাকে।

আজকাল মা নিয়ম করে দিয়েছে, শনি আর রবিবার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। নিয়মটা যে মানতেই হবে, এমন নয়। কিন্তু মা তার জন্য ইদানীং এত বেশি চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন যে, সে না গেলে বা যেতে না চাইলে মার প্রেসার বাড়ে, হার্টে প্যালপিটিশন হয়।

উইক এন্ডটা মায়ের কাছে বিডন স্ট্রিটে কাটাতে খারাপও লাগে না হেমাঙ্গর। মার হাতের কিছু অনবদ্য রান্না খেতে পায়। আর মায়ের নানা কথা বসে বসে শুনতে তার ভালই লাগে।

কিন্তু এই শনিবারটা তার বিডন স্ট্রিটে যেতে ইচ্ছে করছিল না। গাঁয়ের বাড়িটা তাকে ডাকছে। দু’ মাস যায়নি। বিডন স্ট্রিটে মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, শনিবার বাইরে যাচ্ছে। কোথায় তা অবশ্য বলল না। না বললেও বাঁকা মিঞার কাছ থেকে মা ঠিকই পরে খবর পেয়ে যাবে। কিন্তু পরের কথা পরে। এখন যে তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে!

প্রচণ্ড শীত, মেঘলা আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি আর উত্তাল নদী পেরিয়ে যখন ভটভটি তার ঘাটে লাগল তখন মনটা ভাল লাগছিল বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে হাঁচি এবং শারীরিক অস্বস্তি টের পাচ্ছিল সে। পিছল ঘাট বেয়ে ওপরে উঠেই বৃষ্টির সহস্র শরে বিদ্ধ হতে হতে সে ভাবল, মেরেছে। জ্বর হয়ে পড়ে থাকলে যে সব মাটি।

বাসন্তী এল, বাঁকা মিঞা এল, ফজল এল। অনেক দিন বাদে যেন আপনজনদের কাছে ফেরা।

বাসন্তীই টের পেল সবার আগে, ও দাদাবাবু, তোমার চোখ অমন ছলছল করছে কেন? মুখখানাও যে একটু লাল মতো! জ্বর বাঁধিয়েছ নাকি?

বাঁকা মিঞা নাড়ি ধরে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট হয়ে থাকার পর বলল, একশ’র ওপর। এখন কী হবে বলুন তো! এখানে না পাবেন বদ্যি, না ওষুধ। এই জন্যই তো বলি এখানে ঘাঁটি করার দরকার নেই।

কেন বাঁকা, এখানে কি মানুষের জ্বরটর হয় না? তারা যা করে আমিও তাই করব।

তাদের শরীরের ধাত আর আপনার শরীরের ধাত কি একরকম? এখানকার ডাক্তার কে জানেন? ওই বিশু মুদি। অসুখ হলে লোকে গিয়ে বিশুর কাছে ওষুধ চায়। বিশুর সাত পুরুষে কেউ ডাক্তার নয়, তবু ওই বিশুই ওষুধ বেচে। এমন কি পেনিসিলিন অবধি।

জানি।

আপনাকে বিশু ওষুধ দিলে খাবেন?

হেমাঙ্গ হাসল। বলল, সামান্য সর্দিজ্বর। অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? বিশুর দোকানে যে ওষুধ পাওয়া যায় তাই ঢের। বিশু না জানুক, আমি তো খানিকটা জানি। দরকার হলে ওষুধ আনিয়ে নেবো।

বাসন্তী বলল, এর আগে একবার কিন্তু তুমি কিছু ওষুধ এনে রেখে গিয়েছিলে। সেগুলো বের করে এনে দেবো?

না, থাক। তুই খুব গরম চা খাওয়া আমাদের। দুপুরে আজ রুটি করিস আর সন্ধের পর ঘরে একটু তুষের আগুন করে দিয়ে যাস।

বাঁকা মিঞা মাথা নেড়ে বলে, তা হবে না। আমার একটা দায়িত্ব আছে। নদীর ধারের ঘরে থাকলে আপনার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। আমার পাকা ঘরখানায় থাকবেন। আমি গিয়ে সব ব্যবস্থা করছি। ফজল, দৌড়ে গিয়ে তোর মাকে বল তো, ঘরটা তৈরি রাখতে।

অত ভেবো না বাঁকা। আমি এখানেই থাকতে পারব। ঘরের জানালা-দরজা এঁটে দিলে হাওয়া লাগবে না।

তা বললে হয়? নদীর ধারে হাওয়ার নানা চক্কর। তার ওপর শীতের বাদলা, এ বড় ভয়ংকর খারাপ জিনিস। এ ঘরটা ড্যাম্পও বটে। শেষে অসুখ গাঢ়িয়ে গেলে জবাবদিহিটা করব কি?

বাসন্তী তেমন না ভেবে-চিন্তে হঠাৎ বলে উঠল, আমি রাতে এসে থাকব’খন।

কথাটা মুখ ফসকা, বলে ফেলেই বোধ হয় লজ্জা পেয়েছিল। বাঁকা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি, না?

বাসন্তী খুব মিইয়ে গেল এ কথায়।

বাসন্তীর ওপর একটু মায়া হল হেমাঙ্গর। বেচারা! কথাটার যে গর্হিত দিক আছে তা তো বোঝেনি। হেমাঙ্গর প্রতি টান থেকেই বলেছে। হেমাঙ্গ বলল, তাহলে বরং ফজল এসে থাকুক। পাশের খুপরিটায় তো চৌকি আছে। বিছানা আনলেই হবে।

বাঁকা বলল, ফজল থাকবে? থেকে লাভ আছে কিছু? ওর যা ঘুম গায়ের ওপর দিয়ে মোষ হেঁটে গেলেও টের পায় না। ওর থাকাও যা না থাকাও তাই।

মাথাটা টিপটিপ করছিল হেমাঙ্গর। গা ভরে জ্বর আসছে। জ্বরটা সম্ভবত একটু ভোগাবে। আবহাওয়া আরও খারাপ হচ্ছে। বাতাসের জোর বাড়ছে, বৃষ্টি বাড়ছে। ঘরে এসে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। একটু কাঁপুনি হল। বাসন্তী তুষের আগুনটা দুপুরের আগেই এনে দিল ঘরে। বলল, বাঁকা চাচা তোমার জন্য কী একটা ব্যবস্থা করতে গেল গো দাদা। তুমি ওর বাড়িতেই চলে যাবে?

হেমাঙ্গ বলল, ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এত যত্ন করবে যে তাতে আমার হাঁফ ধরে যাবে। কিন্তু কী করব বল! বাঁকা যদি নিয়ে যেতে চায় তো যেতেই হবে।

মাথাটা টিপে দেবো?

না, এখন থাক।

তাহলে পায়ের তেলোয় গরম তেল মালিশ করে দিই?

দে। তার আগে ওষুধের স্টকটা বের কর। দেখি কী আছে।

বাসন্তী একটা টিনের বাক্স নিয়ে এল। জ্বর আর ইনফ্লুয়েঞ্জার চার-পাঁচ রকম ওষুধ থেকে বেছে নিয়ে দুটো একসঙ্গে খেয়ে নিল হেমাঙ্গ। ওষুধ তার ভাল লাগে না।

বাসন্তী তার পায়ে খুব যত্ন করে গরম তেল মালিশ করে মোজা পরিয়ে পা কম্বলে ঢেকে দিয়ে গেল রুটি করতে।

আধঘণ্টা বাদেই বাঁকা এসে বলল, কপালটাই খারাপ। এই শরীরে আপনি আমার বাড়িতে যাবেন, তা ভ্যানগাড়ি একটাও নেই এখন। কোথায় ধান তুলতে গেছে, বিকেলের আগে ফিরবে না। থাকলেও লাভ ছিল না। এ বৃষ্টিতে ছাতার আড়াল দিয়ে তো আর নেওয়া যাবে না। ভিজবেনই। তার চেয়ে ওবেলা বৃষ্টিটা ধরলে বরং নিয়ে যাওয়া যাবে। ফজলকে বলেছি, জানালার দিকটা আড়াল করে একটা ত্রিপল টাঙিয়ে দিতে। ফাঁকফোকর দিয়ে বাতাস না এসে ঢোকে।

হেমাঙ্গ শুধু অসহায়ভাবে হাসল।

বৃষ্টি আর বাতাস বাড়তে লাগল। রীতিমতো ঝড়ের গতিতে বাতাস বইতে লাগল দুপুরের পর। চারদিক অন্ধকার। এই চমৎকার প্রাকৃতিক ব্যাপারটি হেমাঙ্গ দেখতে পাচ্ছে না। তার ঘরের দরজা-জানালা এঁটে বন্ধ। নদীর দিকের জানালা ঢেকে ত্রিপল টাঙিয়ে দিয়ে গেছে ফজল। ওষুধের গুণে এবং ঘর গরম থাকায় একটু হাঁসফাঁস লাগে হেমাঙ্গর।

বাসন্তী গরম রুটি আর তরকারি খাইয়ে বাসন-টাসন ধুয়ে রেখে একবার বাড়ি গিয়েছিল। আবার চলে এসে ঘরের একধারে বসেছে।

কেমন লাগছে এখন তোমার?

একটু ভাল। ওষুধের গুণটা কেটে গেলে অবশ্য আবার জ্বর উঠবে।

কী হবে গো দাদা?

মরব না, তোর ভয় নেই।

ছিঃ, মরার কথা মুখে আনতে আছে? আমি বুঝি সে কথা বলেছি?

অত ভাবছিস কেন? ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-জ্বর। তুই আর বাঁকা এমন করিস যে আমার এখানে আসতে এখন ভয় করে।

আচ্ছা বলো তো, আমি কী করলুম আবার? এখানে তোমার যত্ন-আত্তি কে করে বলো! তুমি শহুরে মানুষ, আমাদের মতো কি তোমার সয়?

একটু বিরক্ত হয়ে হেমাঙ্গ বলে, আমি আর শহুরে লোক নেই। দেখছিস না কেমন লাঙ্গল চালাতে পারি, নৌকো বাইতে শিখেছি। আমার শরীর অনেক পোক্ত হয়েছে আজকাল।

বাসন্তী খুব হাসল। তারপর বলল, তোমার মতো কিম্ভুত মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। একখানা আস্ত পাগল।

দেশে পাগলের অভাব কি? কত পাগলই তো দেখেছিস?

আহা, তুমি কি তাদের মতো নাকি? কী বললাম, কী বুঝলে। তুমি হচ্ছ ভাবের পাগল।

হেমাঙ্গ একটু অস্থিরতা বোধ করে বলল, ওরে বাসন্তী, অসুখে না হোক, দম বন্ধ হয়েই মরতে হবে দেখছি। জানালা হোক, দরজা হোক একটা কিছু একটু খুলে দে। ঘরে অকসিজেনের অভাব হচ্ছে।

অকসিজেন? ওঃ, হ্যাঁ। দাঁড়াও। কিন্তু কী বৃষ্টি দেখেছ? চতুর্দিক থেকে ছাঁট আসছে।

উঠোনের দিকটায় একটা জানালা সামান্য ফাঁক করল বাসন্তী। বাইরে তুমুল ঝড়। জানালা ফাঁক হতেই হিম ঠাণ্ডা হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটা দাওয়া পেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরে। ভয়ে পিছিয়ে এল, ও মা গো!

জানালাটা দড়াম করে খুলে ফের দড়াম করে বন্ধ হয়েই ফের খুলল। বাসন্তী ঝাঁপিয়ে পড়ে জানালা টেনে বন্ধ করে বলল, হবে না।

ঘরে একটা প্রদীপ জ্বলছিল। হাওয়ায় সেটা নিবে গেছে।

বাসন্তী হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই খুঁজে সেটা জ্বালাল, হ্যারিকেনটা জ্বালাই দাদা?

খবরদার না। হ্যারিকেনের গ্যাসে কত লোক মারা গেছে।

ও বাবা, তাহলে থাক।

শোন, খুপরির দিকটার দরজাটা খুলে রাখ। আর খুপরির ঝাঁপের জানালাটা একটু ফাঁক করে রেখে আয়, তাহলে ভেন্টিলেশনটা হবে।

তাই করল বাসন্তী। এসে ফের খাপ পেতে বসে বলল, এখন কেমন লাগছে?

হ্যাঁ। ফ্রেশ বাতাস পাচ্ছি। খুব দুর্যোগ, না রে?

ভীষণ। ভটভটি বন্ধ হয়ে গেছে। নদীতে সাঙ্ঘাতিক ঢেউ দিচ্ছে। যা ঝড় আর বৃষ্টি! চারদিক ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।

ঝড়বৃষ্টি চলতে থাকল। সন্ধের পর জ্বর ফিরে এল হেমাঙ্গর। শীত করে কাঁপুনি দিয়ে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা। আর তার মধ্যেই বাস্তব আর ঘোর মিলেমিশে যেতে লাগল।

মাথায় একখানা ঠাণ্ডা হাত এসে পড়তেই সে বলে উঠল, কে, মা নাকি?

না গো, আমি।

ওঃ, তুমি! কাকে বলল তা নিজেও বুঝল না হেমাঙ্গ। কিন্তু খুব চেনা একজনকেই বলল যেন। ফের একটা ঘোরের মতো এসে কোথায় যেন নিয়ে গেল তাকে।

অনেক রাতে ঝড়বাদল একটু কমতেই এসে হাজির হল বাঁকা আর ফজল।

বাঁকা বলল, ওঃ, কী লণ্ডভণ্ড কাণ্ডই হয়ে গেল। গাঁয়ের বহু বাড়ি পড়ে গেছে। আপনারটা কী করে দাঁড়িয়ে আছে তাই ভাবছি। কপালের জোর বটে আপনার। আমি তো ঝড়ের গতিক দেখে ভাবছিলাম, গেল এবার বাবুর বাড়ি। আসার উপায় ছিল না। উড়িয়ে নিয়ে যেত। আজ নির্ঘাৎ কয়েকটা নৌকো ডুবেছে।

হেমাঙ্গ একটু ক্ষীণ হাসল। বলল, এ ঝড়টা আমার দু’ চোখ ভরে দেখা হল না।

ওঃ, কী যে আপনার সব বাই চাপে! খুপরিতে আজ ফজল থাকবে। বিছানা নিয়ে এসেছে। বলে দিয়েছি রাত জেগে পাহারা দেবে।

কোনও দরকার নেই। ও ঘুমোক।

না না, ঘুমোলেই ও মড়া। জেগে বসে থাকবে।

হেমাঙ্গ ঘুমোলো। তারপর ঘুমের মধ্যেই ফের আধো-জাগা একটা ঘরের ভিতরে চলে এল। বারবার একখানা আবছায়া মেয়ের মুখ চলে আসছে চোখের সামনে। মেয়েটা মাঝে মাঝে তার মাথার কাছটিতে এসে বসছে। চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।

ঠিক চিনতে পারছে না সে। আবার চেনা-চেনাও লাগছে। কে মেয়েটা?

কে?

আমি।

আমি কে?

একটু হাসির শব্দ হল, আমি তো।

ওঃ তুমি!

হেমাঙ্গ বুঝতে পারল না। তবু যেন বুঝল। হাসল। ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *