৯১
আপাতত একতলা। দোতলাটা পরে হবে, যদি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই “প্রয়োজনটা” নিয়েই আবার মণীশ আর অপর্ণার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে। মণীশ বলল, দোতলাটা একবারেই করে ফেলা দরকার। দোতলাটা হবে লিভিং কোয়ার্টার, একতলায় থাকবে বসবার ঘর, ডাইনিং রুম, রান্নাঘর।
অপর্ণা মাথা নেড়ে বলে, দোতলার এখন কোনও দরকার নেই। দু’ কাঠা জমি নিয়ে বাড়ি হচ্ছে। একতলাতেই অনেক জায়গা।
মণীশ আপত্তি করতে লাগল, একতলায় মশা বেশি। চোরের উৎপাত হবে খুব। জানালা দিয়ে লগি ঢুকিয়ে আলনার জিনিসপত্র টেনে নিয়ে যাবে।
অত সোজা নয়। জানালায় জাল থাকবে।
শোনো অপু, একতলায় আরও হ্যাজার্ডস্ আছে। ক্রলিং ওয়ার্ম এসে ঢুকবে বর্ষাকালে। ব্যাঙ লাফাবে ঘরের মধ্যে, কেঁচো বেয়ে বেড়াবে, বিছে কিলবিল করবে।
হ্যাঁ গো, এরপর আমাকে ভয় দেখানোর জন্য রাক্ষস-খোক্কসের গল্পও ফাঁদবে নাকি? একতলায় কি মানুষ থাকছে না? সব একতলাই কি সুন্দরবন!
খুবই ব্যথিত হয়ে মণীশ বলল, একতলার হ্যাজার্ডস্ তুমি স্বীকার না করলেও, আছেই। বেশি বৃষ্টি হলে ডুবেও যেতে পারে ঘরদোর।
অনেক কিছু হলে অনেক কিছুই হতে পারে। তা বলে সেসব ভেবে গুটিয়ে থাকতে হবে নাকি?
তুমি ভীষণ অ্যাডামেন্ট অপু।
মোটেই নয়। আমি প্র্যাকটিক্যাল। এক গাদা টাকা খরচ করে দোতলা বানাবে। থাকবে কে বলো তো? মোটে তো পাঁচটি প্রাণী। অনু আর ঝুমকির বিয়ে হয়ে যাবে, বুবকা হয়তো পড়তে চলে যাবে হোস্টেলে, তখন অত বড় বাড়ি হাঁ হাঁ করবে না? তুমি তো ভাড়াটেও বসাতে দেবে না।
না, না, ভাড়াটের প্রশ্নই উঠছে না। কিন্তু দোতলা অনেক সেফ এটা তো মানো?
সাবধান থাকলে একতলাও সেফ। অত ভয়ের কিছু নেই।
আচ্ছা অপু, একটা কাজ করলে হয় না?
আবার কী?
ধরো, একতলাটা আমরা কমপ্লিট করলাম না, শুধু পিলার থাকল। শুধু পিলারের ওপর দোতলাটা করলাম। ডিজাইনটাও চমৎকার হবে আর দোতলায় থাকাও হবে।
মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া এলেই তো হবে না। দোতলা মানেই দু’ দফা ছাদ ঢালাই। খরচ কাছাকাছিই পড়বে।
মণীশ খুবই হতাশ মুখে বসে থাকে। মুখে থমথম করে বাচ্চা ছেলের মতো অভিমান। তারপর বলে, ঠিক আছে, ছেলেমেয়েদের মতও নেওয়া হোক। লেট আস পুট ইট টু ভোট।
অপর্ণা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, কখনও নয়। তোমার ডেমোক্র্যাসির চালাকি আমার জানা আছে। ছেলেমেয়েরা সবাই তোমার দলে। তোমার মতোই ইমপ্র্যাকটিক্যাল। ওরা যখনই বুঝবে যে, তুমি দোতলা করতে চাও তখনই ওরা তোমার পক্ষ নেবে। আমি তোমার ভোটাভুটি মানি না।
তুমি একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছো অপু।
তাই চালাবো। তোমাদেরও মানতে হবে।
আবার ভেবে দেখো অপু। তুমি বড় কৃপণ।
আমাদের টাকা তো ছপ্পড় ফুঁড়ে আসে না!
প্রচুর আপত্তি, বাদানুবাদের পর ছেলেমেয়েদেরও চুপ করাতে পারল অপর্ণা। বাড়ি করার ব্যাপারে স্বপ্নশীল মণীশকে সে দূরে রাখল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও কোনও পরামর্শই করল না। সে ধরল চারুশীলাকে।
আপনার হাজব্যান্ড তো নামকরা মানুষ, যদি তাঁর চেনাজানা কোনও ঠিকাদার বা রাজমিস্ত্রি ঠিক করে দেন তো ভাল হয়।
চারু অবাক হয়ে বলল, তা কেন? সুব্রত নিজেই করে দেবে আপনার বাড়ি।
অপর্ণা শিহরিত হয়ে বলে, কী যে বলেন! আমাদের বাড়ি নিতান্তই ছোট আর সাদামাটা। ওঁর মতো মস্ত মানুষ কেন ওরকম বাড়ি করতে যাবেন?
তাতে কী? সাদামাটা বাড়ি করলে কি ওর জাত যাবে?
তা নয়। আসলে উনি ব্যস্ত মানুষ। আমার তো ওঁকে দরকার নেই। একজন ভাল রাজমিস্ত্রি পেলেই আমার হয়ে যাবে।
চারুশীলা অবশ্য এত সহজে ছাড়ল না। সুব্রতর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিল অপর্ণার। বলল, ওঁর বাড়িটা তোমাকেই করে দিতে হবে।
অপর্ণা তো লজ্জায় মরে।
কিন্তু সুব্রত এতটুকু বিব্রত বা বিরক্ত হল না। মিটিমিটি হাসিমুখে অপর্ণার বাড়ির প্ল্যানটা খুব খুঁটিয়ে দেখল। দু’ একটা প্রশ্ন করল। তারপর বলল, বাড়ির প্ল্যান ভালই হয়েছে। সয়েলটা একটু টেস্ট করিয়ে নিলে ভাল হত। জলা বা পুকুরটুকুর ছিল না তো ওখানে!
তা তো জানি না।
তাহলেও একটু ডীপ ফাউন্ডেশন করবেন। আমি মিস্ত্রি ঠিক করে দিচ্ছি। তাকেই বুঝিয়ে বলে দেবো সব।
উঃ, বাঁচালেন!
আপনি কি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি করাবেন, না কি কন্ট্রাক্টে?
যদি নিজে করাই?
সুব্রত মিষ্টি হেসে বলল, করতে পারলে তো ভালই। কিন্তু প্রবলেমও আছে। মেটিরিয়াল চুরি হয়ে যাবে। চৌকিদার রেখেও সেটা আটকাতে পারবেন না। লোকাল মস্তানরা চাঁদা চাইবে। তারপর আপনার ফিজিক্যাল কষ্টটা তো আছেই। অনেকে বাড়ি করাতে গিয়ে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তাহলে কন্ট্রাক্ট দেওয়াই কি ভাল?
কলকাতায় সেটাই ভাল। একটু দেখাশুনো করলেই হবে।
তাতে কি টাকা একটু বেশি লাগবে?
সুব্রত মিটিমিটি হেসে বলে, যে টাকাটা বেশি লাগবে সেটা নিজে করলেও লেগে যাবে। চুরিটুরি গেলে তো সেটাও এস্টিমেটের মধ্যে চলে আসবে কিনা।
তাহলে দয়া করে আমাকে একজন ঠিকাদার ঠিক করে দিন। আমার কর্তাটি কোনও কাজের নন।
কোনও সমস্যা হবে না। কাল বা পরশু সকালেই ঠিকাদার গিয়ে আপনার বাড়িতে দেখা করবে।
আপনাকে বিব্রত করলাম।
আরে না। এ তো সামান্য ব্যাপার।
চারুশীলা এসব কথায় মোটেই খুশি হল না। বলল, তোমাদের কথার মাঝখানে কথা বলিনি। কিন্তু বাড়িটা তুমি করলেই পারতে।
সুব্রত একটুও বিব্রত না হয়ে বলল, পারতাম। কিন্তু আমাকে তো পরশুই আবার দিল্লি যেতে হবে। সময় কি হবে?
অপর্ণা বলল, না না, আপনাকে একটুও বিব্রত হতে হবে না। একজন ভাল ঠিকাদার পেলেই আমার হবে।
পরদিন সকালে যে লোকটি সুব্রতর রেফারেন্সে এসে অপর্ণার সঙ্গে দেখা করল তাকে দেখে অপর্ণা তটস্থ। লোকটা এসেছে একখানা ঝকঝকে মারুতি গাড়িতে। তার পোশাকআশাক এবং চেহারা এতই অভিজাত যে, ঠিকাদার কথাটা এর পরিচয়ের সঙ্গে মেলে না।
কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, লোকটি বিনয়ী এবং সুব্রতর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। সে ইউ পি-র লোক তবে বাংলা বলতে পারে। বলল, কোনও চিন্তা করবেন না। মিস্টার রায় যখন বলেছেন তখন দেয়ার উইল বি নো প্রবলেম।
লোকটা প্ল্যান খুঁটিয়ে দেখল। একটা পকেট ক্যালকুলেটারে হিসেব করল। আর বুক কাঁপতে লাগল অপর্ণার, এস্টিমেট যা দেবে তা সে সইতে পারবে তো?
লোকটা যা এস্টিমেট দিল তাতে খুবই অবাক হল অপর্ণা। সে যা ভেবে রেখেছিল তার চেয়েও কম। ভুল শুনেছে কিনা তা বুঝতে না পেরে বারকয়েক জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিল। তারপর বলল, আপনি কাজ শুরু করে দিন। কত টাকা দিতে হবে এখন আপনাকে?
লোকটা হাত তুলে বলল, নো মানি নাউ। পেমেন্ট করবেন আফটার কমপ্লিশন।
কমপ্লিশন! ভূতগ্রস্তের মতো চেয়েছিল অপর্ণা। বিশ্বাস হচ্ছে না।
লোকটা বলল, টাকা তো বেশি নয়, সামান্যই! ওদিকে আমার কাজও হচ্ছে। আপনি ভাববেন না। আপনি ভূমিপূজা করে নিন, তারপর আমাকে একটা খবর দেবেন। কাজ শুরু হয়ে যাবে।
লোকটা তার কার্ড রেখে চলে গেল।
অপর্ণা একটু অভিভূত হয়ে বসে রইল। চারুশীলা আর তার বরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুকটা ভরে উঠছিল তার। প্রতিদানে চারুশীলার জন্য কিছুই করার নেই তার। ওরা এত বড়লোক, এত ওদের ক্ষমতা, অপর্ণা কী করতে পারে ওদের জন্য?
সে চারুশীলাকে ফোন করে বলল, ভাই, আপনি যে আমার কী উপকার করলেন তা বোঝাতে পারব না। কন্ট্রাক্টর আজ এসে দেখা করে গেছে।
চারুশীলা বলল, উপকার আবার কিসের? জানেন তো, ঝুমকি আমার খুব বন্ধু। মাসি বলে ডাকে, কিন্তু আসলে আমরা বন্ধুই। আমার ইচ্ছে ছিল বাড়িটা সুব্রত করে দিক।
আপনি বড্ড বাড়াবাড়ি করেন। আমার বাড়ি উনি করলে কি ওঁর মান থাকে? আমিও যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।
এস্টিমেট বেশি দেয়নি তো?
না। বরং আমি যা ভেবে রেখেছিলাম তার চেয়েও কম।
লোকটা কে বলুন তো! শর্মা নাকি?
না। এঁর নাম এ পি সিং।
চিনি না। ওর তো অনেক চেনা। আজ আসুন না বিকেলে আপনার বাড়ির সম্মানে ডিনার হোক।
উঃ, আপনাকে নিয়ে পারা যায় না।
আসবেন তো? সবাইকে নিয়ে কিন্তু।
দুপুরে আগে কেউ বাড়িতে থাকত না। অপর্ণা একা। আজকাল ঝুমকি সকালে বেরিয়ে দুপুরে ফিরে আসে। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। একটু আনমনা, কিন্তু খুব যেন হতাশ নয়।
ঝুমকি আজ ফিরতেই অপর্ণা সুসংবাদটা তাকে দিয়ে বলল, জানিস, একটা পয়সাও আগে দিতে হবে না, বাড়ি কমপ্লিট হলে টাকা।
খুব একটা খুশি হল কি ঝুমকি? খবরটা যেন তাকে স্পর্শই করল না। শুধু একটু হেসে বলল, তাই নাকি? বাঃ, বেশ ভাল তো!
চারুশীলার বর লোকটা খুব ভাল, না রে? একটা কথায় সব ঠিক করে দিল।
হ্যাঁ, খুব ভাল। সুব্রতদার কোনও তুলনাই হয় না।
তুই ওকে দাদা ডাকিস নাকি? এই যে শুনলাম, চারুশীলাকে মাসি ডাকিস!
ঝুমকি ক্ষীণ হাসল, কি করব? চারুমাসি নিজেই আমাকে মাসি ডাকিয়েছে। সুব্রতদাকে মেসো ডাকতে হয়নি, রক্ষে। আত্মীয় তো নয়, ডাকে কী আসে যায়?
ঝুমকির আনমনা ভাবটা অপর্ণার পছন্দ হয় না। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র ঝুমকিই ভীষণ চাপা। তার পেট থেকে কখনও কথা বের করতে পারে না অপর্ণা। ঝুমকিকে ঠিক বুঝতেও পারে না। তবু চেষ্টা করে।
বলল, হ্যাঁ রে, তোর কী হয়েছে বল তো! এত আনমনা কেন?
জবাবে সাধারণত রেগে যায় ঝুমকি। কিন্তু আজ রাগল না। হেসেই বলল, কত কী ভাবছি।
কী ভাবছিস, চাকরির কথা?
চাকরির কথাও। এই বিংশ শতাব্দীকে বুঝতে পারো মা?
কেন পারব না? আমি তো এ যুগেরই মেয়ে।
এই যুগটা খুব অদ্ভুত। কত নতুন ভ্যালুজ জন্মাচ্ছে।
আবার কোন ভ্যালুজ জন্মাল যা নিয়ে তুই এত চিন্তা করছিস!
আছে মা! সব কথা কি বলতে হয়?
তুই তো কিছুই বলিস না আমাকে।
যারা সব বলে দিতে ভালবাসে তারা কি ভাল? তারা সরল হতে পারে, কিন্তু বোকা।
থাকগে বাবা, শুনতে চাই না।
ঝুমকি আলগোছে নিজের ঘরে চলে গেল।
সন্ধেবেলা আজ পারিবারিক মিটিং বসিয়ে সগৌরবে অপর্ণা কন্ট্রাক্টরের কথা ঘোষণা করল। মণীশকে বলল, বুঝলে মশাই, এখন তোমাকে একটি পয়সাও ডাউন পেমেন্ট করতে হচ্ছে না।
মণীশ একটু অবাক হয়ে বলল, লোকটা তোমার প্রেমে পড়েনি তো অপু?
অপর্ণা চোখ পাকিয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ, ছেলেমেয়ের সামনে ও তোমার কেমন ঠাট্টা?
বুবকা বলে উঠল, কিন্তু মা, বাবা তো ঠিক কথাই বলেছে। এ যুগে কেউ এত লিনিয়েন্ট হয়?
অনু বলল, মম ইজ স্টিল বিউটিফুল অ্যান্ড ইয়ং অ্যান্ড ভেরি অ্যাট্রাকটিভ।
অপর্ণা রাঙা হয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ, তোরা যে বাপের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় গেছিস!
বুবকা বলল, যুগ পালটে গেছে মা, এখন এত লজ্জা পেতে হবে না। ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।
মণীশ মিটিমিটি হাসছিল। বলল, যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো অপু। এখন সন্ধি করাই ভাল।
তোমার আর তোমার ছেলেমেয়েদের মতো অসভ্য আমি জন্মে দেখিনি বাবা। তোমাদের সঙ্গে সন্ধি নয়।
আহা, বলোই না, লোকটাকে কি করে জপালে। হিপনোটিজম প্র্যাকটিস করছো নাকি?
ওসবের দরকার হয়নি। মিস্টার সিং খুব ভাল লোক। তাছাড়া সুব্রত রায়ের চেনা।
মণীশ একটু অবাক হয়ে বলে, সুব্রত মানে চারুশীলার বর নাকি? তুমি তাকে কনট্যাক্ট করেছিলে? সে তো মস্ত আর্কিটেক্ট!
তাতে কি?
না, তাতে কিছু না। তবে বলতেই হবে তোমার বুদ্ধি আছে। বাচ্চারা তোমরা তোমাদের মায়ের নামে জয়ধ্বনি দাও। বলো, মাতাজীকি জয়।
অনু, বুবকা আর ঝুমকি এমন হুল্লোড় করে উঠল যে, কানে হাত চাপা দিতে হল অপর্ণাকে।
প্রাথমিক উত্তেজনা আর আনন্দ রইল কয়েকদিন। সিং-এর সঙ্গে আরও দু’বার দেখা এবং টেলিফোনে কয়েকবার কথা হল অপর্ণার। একদিন সিং এসে ডিনার খেল এবং সকলের সঙ্গে পরিচয় করে গেল।
বাড়িটা শুরু হল পুজোর আগে। ডিসেম্বরে ছাদ ঢালাই হয়ে বাড়িটা যখন একটা সম্পূর্ণতার চেহারা পেয়ে গেল তখন বড্ড অবাক লাগতে লাগল অপর্ণার। স্যাংশন করা প্ল্যানের মধ্যেই বাড়িটাকে চমৎকার একটা আধুনিকতার ডিজাইন-যুক্ত করে দিয়েছে সিং। তার দক্ষ মিস্ত্রিরা টপাটপ কাজ করে ফেলছে। শূন্যতার মধ্যে একটা বাড়ি গজিয়ে ওঠার ঘটনাটা যেন অপর্ণার কাছে এক অষ্টম আশ্চর্য!
এক রাতে অপর্ণা লেপের তলায় মণীশকে আঁকড়ে ধরে বলল, কেমন করে ফেললাম বাড়িটা, বলো।
হ্যাটস্ অফ। কিন্তু অপু, দোতলা হল না।
প্রভিসান তো রইল। দোতলাটা আমরা নিজেরাই দেখেশুনে করিয়ে নিতে পারব।
এ লোকটিকে দিয়েই তো করাতে পারতে।
ওগো, বড় বাড়ি করলেই তো হবে না। পরিষ্কার রাখতে হবে যে! আর বড় বাড়িতে বড্ড ফাঁকা লাগবে।
তোমার কৃপণতাটা আর কিছুতেই গেল না। দোতলা করতে দাওনি ঠিক আছে। কিন্তু এবার আমার একটা কথা রাখো।
আবার কী কথা?
এসব ফার্নিচার, খাটফাট সব বেচে দেবো। নতুন বাড়িতে খুব মডার্ন ফার্নিচার দিয়ে সাজাবো।
পাগল নাকি? আমার ফার্নিচারগুলো দেখেছো? কী দারুণ মজবুত ভাল জিনিস! বেচলে আর পাবো এরকম? কত খুঁজে খুঁজে ঘুরে ঘুরে ঝুল কাঠের সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস কিনে পালিশ করিয়ে তবে সাজিয়েছি। প্রাণ গেলেও বেচতে পারব না। হ্যাঁ গো, তোমার কি পুরনো জিনিসের ওপর মায়া হয় না?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মণীশ বলে, তোমার ওপর হয়। তুমি যে পুরনো ধ্যানধারণা কেমন আঁকড়ে ধরে থাকতে ভালবাসো! তুমি কেন আর একটু আধুনিকা হলে না, বলো তো!
আমাকে বুঝি আজকাল আর পছন্দ হচ্ছে না?
না হচ্ছে না। আমি পাত্রী দেখছি।
দেখাচ্ছি। বলে এমন জড়িয়ে ধরল মণীশকে যে, মণীশ হাঁফসে পড়ল।
বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, পাত্রী দেখব না।
খুব শখ, না? এই প্রাচীনপন্থীকে নিয়েই এ জীবনটা কাটাতে হবে, বুঝলে?
আর পরের জন্ম?
যদি পরজন্ম থাকে তবে পরের জন্মেও।
ও বাবা, পরের জন্মেও তুমি?
হ্যাঁ, বরাবর আমি। আমি ছাড়া আর কেউ নয়। শোনো, তুমি একবার একটা খুব খারাপ কথা বলেছিলে, মনে আছে?
কী কথা?
তুমি বলেছিলে পঁচিশ হাজার বছর বেঁচে থাকলে আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। বলেছিলে?
ঠিকই তো বলেছি অপর্ণা! পঁচিশ হাজার বছর যদি আমরা বেঁচে থাকতাম তাহলে কি সত্যিই আমরা দুজনে দুজনের কাছে পুরনো হয়ে যেতাম না?
বলেছি তো, না।
মণীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ভাগ্যিস সেই পরীক্ষাটা আমাদের দিতে হবে না।
ভাগ্যিস কেন? পঁচিশ হাজার বছর ধরেই আমি তোমাকে ভালবাসতে পারি। একটুও কমবে না ভালবাসা।
মণীশ একটু হেসে বলল, তোমার কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে অপু। হয়তো তোমার পক্ষে তা সম্ভব।
ফ্ল্যাটের অন্য একটা ঘরে আর একজনও ভালবাসার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছিল বিছানায় শুয়ে। খুব শীত। কিন্তু এই ঠাণ্ডাতেও সে বার বার উঠে জল খাচ্ছিল। সমস্ত শরীরে কেমন একটা সিরসিরে ভাব। একটা উৎকণ্ঠা। সঙ্গে অচেনা ভয়।
কয়েকদিন আগেই দেখা হয়েছিল। কী আশ্চর্য উদাসীন, বিষণ্ণ, গম্ভীর হয়ে গেছে লোকটা! ও কি সত্যিই রশ্মিকে ততটা ভালবাসত? কোনওদিন বিশ্বাস হয়নি ঝুমকির।
অনেক লোক ছিল সেদিন চারুশীলার বাড়িতে। তবু ঘুরেফিরে তাদের দেখা হয়ে যাচ্ছিল। চোখাচোখি হচ্ছিল বারবার।
শেষ অবধি তাদের দেখা হল একটা নির্জন ঘরে। কারা ক্যারম খেলতে খেলতে ছিটোনো গুটি ফেলে চলে গেছে। একা একা হেমাঙ্গ স্ট্রাইকারে টোকা মেরে গুটি ফেলার চেষ্টা করছিল।
ঝুমকি ঢুকেই বেরিয়ে আসছিল লজ্জায়।
হেমাঙ্গ ডাকল, শুনুন।
ঝুমকি দাঁড়াল।
হেমাঙ্গ হঠাৎ বলল, আপনি আমাকে খুব অপছন্দ করেন, না?
অবাক ঝুমকি বলল, কেন? অপছন্দ করব কেন?
মনে হয়।
ও।