2 of 2

৮.০৪ শান্তিনিকেতন : উপাসনা ও ভাষণ

৮.৪ পরিশিষ্ট
শান্তিনিকেতন : উপাসনা ও ভাষণ
নববর্ষ, ১৩৯০

গান।

হে চিরনূতন, আজি এ দিনের প্রথম গানে
জীবন আমার উঠুক বিকাশি তোমার পানে ॥
তোমার বাণীতে সীমাহীন আশা,       চিরদিবসের প্রাণময়ী ভাষা–
ক্ষয়হীন ধন ভরি দেয় মন তোমার হাতের দানে ॥
এ শুভলগনে জাগুক গগনে অমৃতবায়ু,
আনুক জীবনে নবজনমের অমল আয়ু।
জীর্ণ যা-কিছু যাহা-কিছু ক্ষীণ       নবীনের মাঝে হোক তা বিলীন–
ধুয়ে যাক যত পুরানো মলিন।
নব-আলোকের স্নানে ॥

মন্ত্রপাঠ।

গান

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে ॥
বাসনার বশে মন অবিরত    ধায় দশ দিশে পাগলের মতো,
স্থির-আঁখি তুমি মরমে সতত জাগিছ শয়নে স্বপনে ॥
সবাই ছেড়েছে, নাই যার কেহ, তুমি আছ তার আছে তব স্নেহ–
নিরাশ্রয় জন, পথ যার গেহ, সেও আছে তব ভবনে।
তুমি ছাড়া কেহ সাথি নাই আর,      সমুখে অনন্ত জীবনবিস্তার–
কালপারাবার করিতেছ পার কেহ নাহি জানে কেমনে ॥
জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি,      তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে ॥
জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর    লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর–
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে ॥

কথা

এই বিশ্বের একটি সাংসারিক উদ্দেশ্যশূন্য সহজ রূপ আছে, সেটি তার আনন্দরূপ। বিশ্বকে আনন্দরূপে পাওয়া সহজ নয় কারণ সহজ হওয়া সহজ নয়। আমরা যখন শিশুর দষ্টি নিয়ে বিশ্বের দিকে তাকাই তখন সব কিছই বিস্ময়কর। প্রতিটি বস্তু শুধ তার অস্তিত্বের গুণেই আশ্চর্য। প্রতিটি শব্দে এবং স্পর্শে শিশু চমকে ওঠে; গন্ধে, রূপে সে মোহিত হয়। শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ, রূপ এবং রসে মিলে এই পৃথিবী অপরূপ।

সেই অপরূপতা ধীরে ধীরে চেতনা থেকে অপসৃত হয়। বিশ্বকে আমরা আর আন্দরূপে পাই না। এর কিছুটা ঘটে অভ্যাসে, কিছুটা বিষয়বুদ্ধির শাসনে।

আমাদের প্রাণের স্পর্শে বস্তু প্রাণময় হয়ে ওঠে। অভ্যস্ত দৃষ্টিতে তারই অভাব ঘটে। অভ্যস্তদৃষ্টি নিষ্প্রাণ। যেমন অষ্টপ্রহর দর্শনের ফলে গৃহিণী গৃহস্থের চোখে শুভদৃষ্টির সুষমা হারায়, এই সুন্দরী পৃথিবী এবং প্রকৃতিও তেমনই ব্যবহারিকতার প্রাত্যহিক অবলেপনে। মলিন হয়ে ওঠে। সাংসারিক অতিনৈকট্যের ভিতর দিয়ে জগতের আনন্দরূপটি হারিয়ে ক্ষয় হয়ে যায়। এতে ক্ষতি আমাদেরই। আমাদের দৃষ্টি যখন ভালোবাসার শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন ক্ষতি আমাদেরই। আমদের দৃষ্টি যখন ভালোবাসার শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন ক্ষতি আমাদেরই। বিশ্ব তো একটি বাঁশী হয়ে সারাক্ষণই আমাদের সামনে পড়ে আছে। আমদের প্রাণে যদি গান না থাকে তো বাঁশী বাজবে কী করে?

গান

প্রাণে গান নাই মিছে তাই ফিরিনু যে
বাঁশিতে সে গান খুঁজে।
প্রেমেরে বিদায় করে দেশান্তরে
বেলা যায় কারে পূজে।।
বনে তোর লাগাস আগুন, তবে ফাগুন কিসের তরে–
বৃথা তোর ভস্ম’-পরে মরিস যুঝে।।
ওরে, তোর নিবিয়ে নিয়ে ঘরের বাতি
কী লাগি ফিরিস পথে দিবারাতি–
যে আলো শতধারায় আঁখিতারায় পড়ে ঝরে
তাহারে কে পায় ওরে নয়ন বুজে ॥

কথা

অভ্যাস যখন আমাদের বিশ্বচেতনাকে অসাড় করে ফেলে তখন সেইটাই আবার একদিন আমাদের কাছে দম্ভের জিনিস হয়ে ওঠে। একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা অন্ধদের দেশে একবার চক্ষুষ্মন মানুষ বাইরের পৃথিবী থেকে হঠাৎ গিয়ে পড়েছিল! প্রভাত যখন পর্বতচূড়াতে আলোর মুকুট পরিয়ে দেখা দিল সেই মানুষটির প্রাণে তখন সুন্দরের সাড়া জাগালো। অন্ধেরা তাতে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, ঐ মানুষটি নিশ্চয়ই পাগল অথবা ব্যাধিগ্রস্ত। নিষ্প্রাণ অভ্যাসের বস্তুপুঞ্জে ঘেরা সাংসারিক মানুষদেরও একই অবস্থা। আমাদের অভ্যস্ত দৃষ্টিহীনতাকেই আমরা মানুষের স্বাভাবিক অবস্থা বলে জানি। সেটাই আমাদের কাছে একমাত্র সত্য। যাদের চোখে বিশ্ব তার আনন্দরূপ হারিয়ে ফেলেনি, তাদের দৃষ্টিকে আমরা বলি অবাস্তব, অথবা আমরা তাদের নিতান্ত কবি বলে দূরে সরিয়ে রাখি।

অভ্যাসের নির্জীবতাই একমাত্র বাধা নয়। আরো একটা বাধা আছে। সংসারের দুঃখে তাপে, আঘাতে ও ব্যর্থতায়, আমাদের মনে জগতের প্রতি একটা বিরূপতা জমে ওঠে। এই সব আঘাতকে অতিক্রম করে জীবনের প্রতি বিস্ময়বোধ এবং জীবের প্রতি সহজ ভালোবাসার শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। অথচ এই শক্তি যদি আমরা হারাই তবে সেই আলোকবঞ্চিত পৃথিবীতে প্রাণধারণই একটা গ্লানির মতো হয়ে ওঠে। সেই গ্লানি থেকে পালাবার তখন আর জায়গা থাকে না।

এই বিশ্বসংসার জীববিশেষের প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য সৃষ্টি হয়নি। বিশ্ব তার নিজের নিয়মে চলে। আমাদের জৈব প্রয়োজনের বিচারে কোথাও সে সহায়ক, আবার কোথাও সে প্রতিবন্ধী, এমনকি ভয়ংকর। যেমন আগুন কোথাও তাপ দেয়, কোথাও দুগ্ধ করে। কিন্তু এসবই হলো সাংসারিক প্রয়োজনের বিচার। এসবের আরো ঊর্ধ্বে আগুনের মতোই বস্তুর একটা শুদ্ধ রূপময়তা আছে। শুদ্ধ বলেই সেই রূপময়তা অরূপের সহোদর। তাকে আমরা সহজে পাই না, অথচ সে শিশুর কাছেও লভ্য।

একদিকে সত্য সহজ, প্রথমদিনের সূর্যের মতোই আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত। অন্যদিকে সত্যকে আবিষ্কার করতে হয় সংশয়ের ঘন মেঘের আড়াল থেকে, কঠিন দুঃখের ভিতর দিয়ে, সংসারের নানা মলিনতা ও ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে। এই দুই বিপরীতকে মিলাতে না পারলে আমাদের সত্যোপলব্ধি সম্পূর্ণ হয় না।

গান

(১)

যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,
দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে ॥
যাবার বেলা সহজেরে
যাই যেন মোর প্রণাম সেরে,
সকল পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে ॥
খুঁজতে যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,
সদাই যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।
নিত্য যাহার থাকি কোলে
তারেই যেন যাই গো বলে–
এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালবেসে ॥

(২)

নয় এ মধুর খেলা–
তোমায় আমায় সারা জীবন সকাল-সন্ধ্যাবেলা     নয় এ মধুর খেলা ॥
কতবার যে নিবল বাতি, গর্জে এল ঝড়ের রাতি–
সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা।।
বারে বারে বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে।
দারুণ দিনে দিকে দিকে কান্না উঠেছে।
ওগো রুদ্র, দুঃখে সুখে    এই কথাটি বাজল বুকে–
তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা ॥

কথা

শিশুর কাছে সত্য সহজ রূপে দেখা দেয়। সেই পাওয়া তবু স্থায়ী পাওয়া নয়। যদিও শৈশবস্মৃতি স্বপ্নের মতো আমাদের মনে থাকে তবু সংসারে দগ্ধ হয়ে সেই সত্যকে জীবনের সহায়রূপে ফিরে পাওয়া সহজ নয় সে জন্য প্রয়োজন হয় মনের কঠিন প্রস্তুতি, অবিরত সাধনা।

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের শৈশবের স্মৃতি। তাঁকে ____ ____ আজ যথার্থভাবে পাই না তার কারণ তাঁকে আমরা আজও বড় অনায়াসে পেতে চাই। আমরা যেন চাই যে, আমাদের অভ্যস্ত সাংসারিকতায়, ছোটো ছোটো স্বার্থে, কলহে, পরশ্রীকাতরতায় আমরা মগ্ন থাকব, আর তারই মধ্যে রবীন্দ্রনাথকেও লাভ করব। আমাদের ছোটো অহং এবং সংকীর্ণ সংসারের বাইরে বড় কিছুকেই আমরা বস্তুত স্বীকার করব না, আরামের চেয়ে কঠিন কিছু আমাদের অভীষ্ট হবে না, কোনো বৃহৎ উদ্দেশ্য এবং কর্মের জন্য অনুশীলন করব না, নিজেকে প্রস্তুত করব না, কিন্তু তাঁকে আমরা পেয়েছি এই দম্ভকে একটা নিষ্প্রাণ বিগ্রহের মতো রক্ষা করে যাব আমাদের এই তুচ্ছ জীবনে। এটা তাঁকে পাবার পথ নয়। যে-সদাগ্রহের পথে তাঁকে পেতে হবে, আজ এই নববর্ষের দিনে আমাদের চিন্তা ও সংকল্প সেই পথে চালিত হোক।

গান

বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সেকি সহজ গান।
সে সুরেতে জাগব আমি দাও মোরে সেই কান ॥
আমি ভুলব না আর সহজেতে,      সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে
মৃত্যু-মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ ॥
সেই ঝড় যে সই আনন্দে চিত্তবীণার তারে
সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নাচাও যে ঝংকারে।
আরাম হতে ছিন্ন ক’রে      সেই গভীরে লও গো মোরে
অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান ॥

মন্ত্রপাঠ

গান

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে, তোমায় যরে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে ॥
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে?
আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ–
তুমি যদি বল এখনি কবির বিষয়াবাসনা নিসর্জন ॥

সাতই পৌষ, ১৩৮৭

কথা

আজ সাতই পৌষ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দীক্ষার দিন। বহু বছর আগে, ১৮৯১ সালে, এই দিনটিতেই শান্তিনিকেতনের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। আবার ১৯০১ সালে এই দিনেই শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। সাতই পৌষ শান্তিনিকেতনের জীবনে এক মহা উদ্বোধন দিবস।

এই উদ্বোধনের গভীর অর্থটি গৃহীত হয়েছে মহর্ষির দীক্ষা গ্রহণের ঘটনা থেকে। আমরা সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষিত নই, কিন্তু সেটা প্রধান কথা নয়। দীক্ষার একটা মূল ভাব আছে সেটাই প্রধান। দীক্ষার মূল কথাটি এই যে, স্বার্থ হতে জাগো, জড়তা হতে জাগো। প্রভাত যেমন অন্ধকারের বন্ধন কাটিয়ে জাগে আমাদের মনও তেমনই প্রাত্যহিক অভ্যস্ত তুচ্ছতা থেকে, ব্যর্থ কলহ ও ব্যর্থ শোক থেকে, একটি বৃহত্তর যোগের মুক্তির ভিতর, আনন্দের ভিতর জাগুক।

গান

মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্ত দ্বারে

কথা

মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, সে কোনো সীমাকেই শেষ সীমা বলে মানতে চায় না, কোনো সীমাবদ্ধ বস্তুতেই মনুষ্যত্বের শেষ অর্থ খুঁজে পায় না। স্বাভাবিকভাবেই সংসারে মানুষের জন্ম হয়, সংসারেই তার বৃদ্ধি। কিন্তু সংসার বলতে তো অসংখ্য ছোটো ছোটো। স্নেহ ও স্বার্থ। এই সব স্নেহকে আমরা যতই আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করি ততই দেখি যে, আরও বড় কিছুর আশ্রয় ছাড়া তাদের পরিপূর্ণতা নেই। ক্রমে আমাদের মনে এই সত্যের। উদয় হয় যে, কোনো সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্যের ভিতরই আমাদের মুক্তি নেই। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একটি স্মরণীয় উপদেশ পাঠ করছি :

“যেমন জননীর গর্ভ গর্ভস্থ শিশুর সম্যক উপযুক্ত স্থান, সেইরূপ এই পৃথিবী মনুষ্যের উপযুক্ত স্থান। যেমন শিশু গর্ভে থাকিয়া গর্ভকে পরিত্যাগ করিবার জন্য উপযুক্ত হইতে থাকে, সেইরূপ এই পৃথিবীতে থাকিয়াই পৃথিবী ছাড়িয়া অন্য উৎকৃষ্ট লোকে যাইবার জন্য উদ্যোগী হইতে হইবে। ইহাতে সংসার যদি প্রতিকূলতা করে তবে তুমি তাহার প্রতিকূল হইবে।

“বিষয় সুখে মনুষ্যের আত্মার তৃপ্তি হয় না–পার্থিব সৌন্দর্যে তাহার প্রেমের পূরণ হয় –দোষ-গুণ-মিশ্রিত ভাবে তাহার ভাবের প্যাপ্তি হয় না…।”

গান

(১)

আমি সংসারে মন দিয়েছিনু

(২)

এই কথাটা ধরে রাখিস–মুক্তি তোরে পেতেই হবে।

কথা

এই যে মুক্তির তত্ত্ব এতে স্বর্গ এবং মর্তের সংযোগের একটা রহস্য আছে। সূর্যের আলো তো কত লক্ষ যোজন দূর থেকে আসছে, কিন্তু যতক্ষণ সে মাটি ছুঁতে না পারছে ততক্ষণ সে প্রাণ সঞ্চার করতে পারছে না। যেমন মৃত্তিকার গর্ভে সূর্যের ঔরসে বীর্যবান। প্রাণের জন্ম, তেমনি সাংসারিক অভিজ্ঞতার মাটিতে দিব্যতার স্পর্শে ঘটে মহৎ সত্যের প্রকাশ। যেখানে এই সংযোগ নেই সেখানে দিব্য আলো যেন ব্যর্থ, সাংসারিক অভিজ্ঞতা যেন বন্ধ্যা।

সংসার যে এই দিব্যতাকে চায় সে তার নিজেরই দায়ে। তা নইলে তার জড়ত্ব ঘোচে না; তার নিজেরই অসার্থকতার আঘাতে সে ভিতরে ভিতরে শুধুই ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে। এ সংসারে আমরা যে যেখানে আছি সেখানেই আমাদের ছোট বড় নানা কাজের সঙ্গে স্বার্থের চেয়ে বড় কোনো আদর্শকে যদি যুক্ত করতে না পারি তবে মনের ভিতরে একটা অসার্থকতার দৈন্য জমে ওঠে, সেই গ্লানি থেকে মুক্তির কোনো আশা থাকে না। এই আন্তরিক গ্লানিকে আমরা নানা চিৎকার ও কলহের হট্টগোল ভুলে থাকতে চাই বটে, কিন্তু সেটা মুক্তির পথ নয়। দীক্ষার জ্যোর্তিময় প্রভাতে আমরা তাই দিব্যতাকে আমাদের। জীবনের মধ্যে আহ্বান করি জড়ত্ব থেকে মুক্তির আশায়।

গান

জয় হোক, জয় হোক নব অরুণোদয়।

বাইশে শ্রাবণ, ১৩৮৭

কথা

শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে বারবার মৃত্যুর ছায়া নিয়ে এসেছে। শ্রাবণে মৃত্যুকে, অতএব জীবনকে, আমরা নতুন করে বুঝবার চেষ্টা করি। অনাদি কাল থেকে মৃত্যুশোক একটি আর্ত জিজ্ঞাসার আকারে নিজেকে প্রকাশ করেছে : মৃত্যুকে অতিক্রম করে কিছু কি অবশিষ্ট থাকে না? আমরা যাকে প্রাণ বলি, দেহকে আশ্রয় করে তার বিকাশ। দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণেরও বিলোপ ঘটে। তবে কি এখানেই সব শেষ? না কি মৃত্যুর তমিস্রা পেরিয়ে পাওয়া যাবে কোনো আলোকের সন্ধান? মৃত্যু কি রূপান্তরের একটি দুয়ার?

গান

শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?

কথা

মৃত্যুর পরও জীবনের জ্যোতি ফুরোয় না। এমন তারকা আছে যার দেহ বিলুপ্ত হয়েছে, যার অস্তিত্ব আজ নেই, অথচ তার আলো আজও কোটি কোটি যোজন অতিক্রম করে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। তারকার মৃত্যুর আগে থেকে সেই আলো আসছিল; তারকার মৃত্যুর পরও সেই আলোর যাত্রা অব্যাহত আছে! আমাদের এই পার্থিব গৃহ, এই পরিচিত গ্রহ থেকে সেই তারকার অবস্থান যত দূরে তত দীর্ঘকাল ধরে তার আলো। আমাদের দিকে প্রবহমান থাকবে।

মহাপুরুষেরা আমাদের থেকে অনেক দূরে, অথচ আমাদের অতি নিকটে। বুদ্ধ একদিন ছিলেন। তাঁর দেহ বহুদিন হল বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবন থেকে, তাঁর বাণী থেকে, যে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছিল সেই আলোর ধারা কি আজও চোখ তুললে আমরা দেখতে পাই না? যে শঙ্খ তিনি একদিন হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তার শুভ্র ধ্বনি কি আজও কান পাতলে আমরা শুনতে পাই না? বুদ্ধ উদাহরণ মাত্র। সকল মহামানব সম্বন্ধেই এ কথা প্রযোজ্য। আমাদের হৃদয়ের পুব দিকে জানালাটি যখন ভোলা থাকে তখন আমরা প্রয়াত মহামানবকে প্রভাতের রবীন্দ্রের মতো আবার দেখতে পাই।

গান

ওই আলো যে যায় রে দেখা–
হৃদয়ের পুব-গগনে সোনার রেখা।

কথা

সংসারের একটা মোহ-আবরণ আছে। বহু ক্ষুদ্র প্রত্যাশা ও হতাশা, প্রাত্যহিক ভয় ও। লোভ ও ক্ষোভ, এইসব মলিনতার ধূম্রাবরণের ভিতর দিয়ে সংসারে মানুষকে আমরা দেখি। কদাচিৎ কোনো শুভ মুহূর্তে সেই আবরণ অপসৃত হয়। মৃত্যুর অন্ধকার পেরিয়ে সত্যকে আমরা শুদ্ধতার রূপে লাভ করি। মৃত্যুর একটি দৈবী শক্তি আছে। সে সংসার থেকে উত্থিত হয়েও সংসারের সঙ্গে এমন একটি দূরত্ব সৃষ্টি করে দাঁড়ায় যে, আমরা তখন ক্ষুদ্র কলহ স্বার্থবুদ্ধির তুচ্ছতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে যেন একটি চিরন্তন রূপে দেখতে পাই। মৃত্যু সামান্য জীবনের দুয়ার ভেঙে আমাদের এক জ্যোতির্ময়তার প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

গান

ভেঙেছে দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়।

কথা

সূর্যের আলো তো প্রতিক্ষণই পৃথিবীর দিকে যাত্রা করছে। মহামানবের বাণীর আলোও তেমনি আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে নিয়ত ছুটে আসছে। আমাদের চিত্তের চারিদিকে, অতি সন্নিকটে, একটা বায়ুমণ্ডল আছে। অহমিকার বাষ্পে আর প্রাত্যহিক কলহের ধূলায় মিশে এখানে মেঘ জমে ওঠে। তখন বহু লক্ষ যোজন থেকে ছুটে এসেও সেই আলো এই নিকটস্থ বায়ুমণ্ডলকে ভেদ করতে পারে না।

এই-যে আমরা সত্যের আলোকে হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারছি না, এজন্য অন্তত একটি অভাববোধ অন্তরে জাগিয়ে রাখা চাই। আমরা তাকে পেয়েছি এই অহংকারের চেয়ে আমরা যে তাকে পাচ্ছি না, এই-পাওয়ার বেদনাই ভালো। কারণ এই বেদনাই তো আমাদের মনকে ভিতরে ভিতরে তাকে পাবার যোগ্য করে তোলে

গান

যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু, এবার জীবনে
তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে ॥

কথা

যে-সত্য আমাদের মনকে নির্মল করে, বিশ্বের সঙ্গে যে শুভাকাঙ্ক্ষী যোগ আমাদের চিত্তকে তুচ্ছতা থেকে উদ্ধার করে, তাকে বার বার হারিয়ে তবেই বার বার ফিরে পেতে হয়। সত্যকে অথবা মহামানবের বাণীকে যখন আমরা আবিষ্কারের বস্তু বলে মনে করি, তাকে যখন আমরা আমাদের স্থায়ী এবং স্থাবর সম্পত্তি বলে ধরে নিই, তখন যে-জিনিস একটি জীবন্ত অনুভূতি হতে পারত, নবপথপ্রদর্শনী শক্তি হতে পারত, তাই একটি গতিহীন অহমিকা, অতএব অসত্য হয়ে ওঠে। সেই অহমিকা, সেই অসত্য, আমাদের মন থেকে জিজ্ঞাসা কেড়ে নেয়, আমাদের বিস্ময়ের শক্তি নাশ করে।

শোকের ভিতর একটা শুচিতা আছে। সেই শুচিতায় আমরা বিস্ময়ের শক্তিকে ফিরে পাই। আমরা যখন মৃত্যুর দিনটিতে পরম শ্রদ্ধেয় কাউকে স্মরণ করি, আমাদের মনে তখন সেই ভাবটি থাকা চাই।

গান

তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ
ও মোর ভালোবাসার ধন।

(রামকিংকরের মৃত্যু ১৩৮৭র এই শ্রাবণে।)

বাইশে শ্রাবণ, ১৩৮৮

কথা

শান্তিনিকেতনে এই ___ আমরা তাঁকে স্মরণ করি, সেই মৃত্যু যাকে আশ্রয় করে জীবন এগিয়ে চলেছে।

মৃত্যু সম্বন্ধে দুটি সহজ কথা প্রথমেই মনে আসে। এক, মৃত্যু অনিবার্য। এ কথাটি ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে একে আমরা সত্য বলে মানি। দ্বিতীয় কথাটি যদিও সহজ তবু ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।

মৃত্যুই নবজন্মের পথ উন্মোচন করে। মানুষের জগতে যদি মৃত্যু বলে কিছু না থাকত তবে কিছুকালের ভিতরই প্রাচীন বস্তুপুঞ্জ স্তূপীকৃত হয়ে উঠত এবং সংসারে পিতামহ প্রপিতামহসহ আরও ঊর্ধ্বতন পুরুষের সংখ্যা এমনই অতিশয় বৃদ্ধি পেত যে নবজাতকের জন্য গৃহে আর স্থান হত না। জীবনের এই চলমান গাড়িটি স্টেশনে স্টেশনে কিছু যাত্রীকে নামিয়ে দেয়, কিছু যাত্রী তুলে নেয়। যদি কাউকেই নামানো না যেত তবে কয়েক স্টেশন পরেই গাড়ির ভিতর ভিড়ের চাপ এমন অসহ্য হত যে নতুন যাত্রীকে তোলা একেবারে অসম্ভব হত। মৃত্যুর অবিরাম ধারাই নবজন্মের জন্য অবিরত স্থান সৃষ্টি করে দেয়। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত মৃত্যু যদিও আমাদের দুঃখে কাতর করে তবু এই মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে যখন আমরা তাকাই তখন দেখি যে, বহু দুর্যোগের ভিতর দিয়ে মহামরণের সযত্ন হস্ত মহাজীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

গান

হে মহাজীবন, হে মহামরণ, লইনু শরণ, লইনু শরণ

কথা

জীবনের এটাই ধর্ম যে, কোনো কিছুকেই অপরিবর্তিত রাখা যায় না। প্রাচীন মিশরে সম্রাটদের দেহ অবিকৃতভাবে রক্ষা করবার প্রচলন ছিল। আধুনিক যুগেও কোনো কোনো। নেতার দেহ নিয়ে সেই চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এই রকমের চেষ্টার ভিতর দিয়ে আমরা। যে বস্তুটি পাই সেটি অবিকৃত জীবন নয়, বরং সমস্ত ক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর একটি শীতল নিশ্চল রূপ। এতে আসল মানুষটিকে ধরা যায় না, কারণ সেই মানুষটি নিশ্চল ছিলেন না, নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। জীবনের গতিময়তায় তিনি নবনবরূপে নিজেকে উদঘাটিত করেছেন। কোনো একটি গতিহীন ভঙ্গি অথবা অথবা কোনো প্রাণহীন বিন্যাসের সঙ্গে যখন তাকে আমরা সমার্থক করে তুলতে চাই তখন সেটা হয় তাঁর জীবন নিয়ে পরিহাসেরই নামান্তর।

মানুষের মধ্যে যাঁরা বড় তাঁরা জীবনের প্রতি একটা মহৎ প্রেম নিয়ে কাজ করে যান। সে প্রেম পথের মধ্যে সিংহাসন পেতে স্থির হয়ে বসে না। মহাপুরুষের স্মৃতিকে যখন। আমরা একটা অচল সৌধে অথবা অপরিবর্তনীয় প্রদর্শনশালায় পরিণত করতে উদ্যত হই তখন তাঁকে যথার্থ শ্রদ্ধা দেখানো হয় না। সেই শ্রদ্ধার উপায় ভিন্ন। তাঁর বাণীকে হৃদয়ে গ্রহণ করে এই পরিবর্তনশীল জগতে তাকে নানা বিচিত্ররূপে প্রকাশ করবার যে প্রয়াস, তারই ভিতর দিয়ে মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভবিষ্যতের জন্য অর্থময় হয়ে ওঠে। মৃত্যু যেভাবে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায় যথার্থ শ্রদ্ধা সেইভাবেই স্মৃতিকে সম্মুখে চালিত করে।

গান

(১)

জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি

(২)

আমারে দিই তোমার হাতে

কথা

মৃত্যু একদিকে যেমন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, কিছুই স্থায়ী নয়, সবই গতিশীল ও বিবর্তমান, অন্যদিকে তেমনি মৃত্যুই আবার বস্তুর শুদ্ধরূপ আমাদের কাছে তুলে ধরে। কোনো ব্যক্তি যখন প্রয়াত হন, সংসারে তিনি নেই বলেই যখন আমাদের কোনো বাস্তব স্বার্থেরও তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বী নন, তখনই তাঁকে আমরা নিতান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক বাসনার চাঞ্চল্য থেকে উদ্ধার করে একটি শুদ্ধ ও চিরস্থায়ী রূপে পেতে পারি। যেহেতু মানুষের লোভের সীমা নেই অতএব মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে অবশ্য এমনও ঘটে যে মৃত্যুর পরও তাঁদের স্মৃতিকে আমরা পণ্য হিসেবে ব্যবহার করি, তাঁদের নাম আমরা গ্রহণ করি প্রাত্যহিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ, মহাপ্রয়াণের বৈরাগ্যে বিধৃত যে শুদ্ধ দৃষ্টি, সেই শুদ্ধতাও অনায়াসে লভ্য হয় না অথবা রক্ষা পায় না, তার জন্যও কিছু বিশেষ সাধনার প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আজ চল্লিশ বছর পূর্ণ হল। তাঁর স্মৃতি যদি আজ আমাদের চিত্তে স্বার্থচিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটি শুভ্র নব শঙ্খের মতো ধ্বনিত হয় তবেই এই বিশেষ দিনটি সার্থক হতে পারে।

গান

শুভ্র নব শঙ্খ তব গগন ভরি বাজে

বাইশে শ্রাবণ, ১৩৮৯

কথা

প্রতিটি ঋতুরই যদিও নিজস্ব রূপ ও সৌন্দর্য থাকে তবুও বর্ষায় যেন একটা বিশেষ গভীরতা অনুভব করা যায়। এই গভীরতা আমাদের চেতনাকে প্রথমে অস্পষ্টভাবে স্পর্শ করে। ক্রমে চিন্তার ভিতরও এর অর্থ কিছুটা ধরা পড়ে। তখন দেখি যে, দুটি বিপরীত ভাবের আশ্চর্য সংমিশ্রণে রহস্যময়তার সৃষ্টি।

একদিকে বর্ষায় শুনি অশ্রুভরা বেদনার ধ্বনি ঘন ছায়ায়, তার উতলা হাওয়ায়, তার অজস্র জলধারায় একটা স্মৃতিরোমন্থক গুণ আছে। শ্রাবণ আমাদের মনকে নিয়ে যায় কোনো এক আদিম বিশ্বজোড়া বিরহের সান্নিধ্যে।

অন্যদিকে বষাই আবার এদেশের পল্লীজীবনে প্রাণরসধারার প্রতীক। গ্রীষ্মের অসহ্য দাহনের শেষে বর্ষা আসে যেন পৃথিবীর প্রথম প্রাণময়তার মন্ত্র নিয়ে। তাই শ্রাবণেরই আমন্ত্রণে কবি বলেন, প্রথম যুগের বচন শুনি মনে। নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।’ বিরহ ও নবজন্ম, আমাদের অস্তিত্বের মূলে এই যে দুটি বিপরীত অথচ চিরন্তন ভাব, বর্ষা এদের যুগ্ম প্রতীক। বোধ হয় অন্য কোনো ঋতু আমাদের চেতনার এতো গভীরে এমন নিবিড় ছায়া বিস্তার করে না।

গান

(১)

আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে ॥
ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে নাচের তালে ওঠেন মেতে,
চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে ॥
প্রথম যুগের বচন শুনি মনে
নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।
পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে,     তার সাথে মোর ভাবনা চলে
কালহারা কোন্ কালের পানে ছুটে ॥

(২)

আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে গোপন তব চরণ ফেলে
নিশার মতো, নীবর ওহে, সবার দিঠি এড়ায়ে এলে ॥
প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি, বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,
নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে ॥
কৃজনহীন কাননভূমি, দৃয়ার দেওয়া সকল ঘরে–
একেলা কোন্ পথিক তুমি পথিকহীন পথের পরে।
হে একা সখা, হে প্রিয়তম, রয়েছে ভোলা এ ঘর মম–
সম্মুখ দিয়ে স্বপনসম যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে।

কথা

আজ বাইশে শ্রাবণ। কবির মৃত্যুদিন। শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণ উৎসব। এই। বৃক্ষরোপণ নবজীবনের প্রতীক। বিরহ ও নবজন্মের সমন্বিত বাণীতে বষা অপরূপ। তারই রহস্যকে আশ্রয়ে করে অতি স্বাভাবিকভাবে শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হয়েছে, একই। দিনের পরিধির ভিতর, বাইশে শ্রাবণের দুটি পরিপূরক অনুষ্ঠান।

মৃত্যুর ভিতরও দুটি বিপরীত ইঙ্গিত আছে। একদিকে মৃত্যু জীবনের অন্ত। মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের ভিতর এমন একটা কিছু আছে যা এই সমাপ্তিকে একান্ত বলে মেনে নিতে চায় না। তাই মৃত্যুর ভিতর থেকেই সেই প্রশ্নের উদয় হয়, সেই দৃষ্টি আমরা লাভ করি, যাকে সম্বল করে মৃত্যুকেও অতিক্রম করা সম্ভব। প্রতিটি বিচ্ছিন্ন মৃত্যুর পরও জীবনের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এই অব্যাহত ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই প্রতিটি খণ্ড জীবন তার বিশেষ অর্থ লাভ করে। কোনো একটি পৃথক মৃত্যু যত বড় শোকেরই কারণ হোক না কেন, তাকে এই প্রবাহিত জীবনের সমগ্রতার চেয়ে বড় করে ভাবাটা ভুল।

মানুষের চেতনার মৃত্তিকাকে মৃত্যু নিয়ত উর্ব করে চলেছে। মুতু করুণার উৎস। আবার মৃত্যুই পারে মানুষকে দিতে মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস। এই করুণা ও ভয়হীনতার মিশ্র উপাদানে সৃষ্টি হয় মানুষের মহত্ত্ব। এরই নব নব প্রকাশে, স্তর থেকে শুরান্তরে উন্নয়নে, মানুষের ইতিহাস তার বৈশিষ্ট্যের অধিকার লাভ করেছে।

তাই যে-কোনো মৃত্যুকে শ্রদ্ধা দেখাবার রাজপথ একটিই। যখন আমরা ফ্রেমে আঁটা ছবির মতো করে দেখি তখন সে-যে অপরিবর্তনীয়, তার চলবার শক্তি যে গেছে ফুরিয়ে, এই ভাবটাই বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাকে যখন আমরা অতীত থেকে উৎসারিত একটা আলো মতো করে ভাবি, চলমান জীবনের সঙ্গে যোগ করে তাকে দেখি, তখন সে ইতিহাসপথিক মানুষের হাতে একটি অক্ষয় বর্তিকা হয়ে ওঠে। অন্তহীন জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই মৃত্যু তার অন্তময়তা থেকে মুক্তি পায়।

গান

তুমি কে কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়     আকাশের নীড়,
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।

কথা

সত্যের দু’টি রূপ আছে। একটি যান্ত্রিক সত্য, অন্যটি জীবনের সত্য। যান্ত্রিক সত্যকে একবার জানা হয়ে গেলেই তাকে পুরোপুরি লাভ করা যায়। জীবনের সত্যকে স্থায়ী সম্পত্তির মতো লাভ করা যায় না, তাকে বার বার হারিয়ে ফিরে ফিরে পেতে হয়। তাকে আমরা কখনও চিরকালের মতো হাতের মুঠোর ভিতর পাই না। আমাদের ভিতর যাঁরা মহৎ তাঁরা তাঁদের জীবনের সত্যকে পেয়েছিলেন জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। আমরা যে সেই সব সত্যকে পাব শুধু মুখের কথা হিসেবে, যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির সাহায্যে, এমন হতেই পারে না। সংশয়ের ভিতর দিয়েই সত্য বিশ্বাসে পৌঁছনো যায়। সংশয়ের শক্তি যখন আমরা হারাই তখন সত্যকে নতুন করে অনুভব করবার শক্তিও আর থাকে না। যান্ত্রিক বিশ্বাসের জড়তায় জীবনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন “যে প্রকাণ্ড জড়তার কুণ্ডলীর পাকে সংশয়কেও আবৃত করে থাকে তার হাত থেকে যেন মুক্তিলাভ করি।” সেই জড়তার চেয়ে বড় মৃত্যু আর নেই। জড়তার মৃত্যুর ভিতর দিয়েই আমরা নবজীবনের প্রবেশের অধিকার যেন অর্জন করতে পারি। এই হোক। বাইশে শ্রাবণের বাণী।

সাতই পৌষ, ১৩৮৮

কথা

আজকের এই দিনটি শান্তিনিকেতনের জীবনে একটি বিশেষ দিন। আমরা যখন কোনো বড় কাজে উদ্যোগী হয়েছি তখন শুভ উদ্বোধন দিবস রূপে এই দিনটিকে বার বার বেছে নিয়েছি। এই দিনে, আজ থেকে নব্বই বছর আগে, এখানে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। এই দিনে, আজ থেকে আশি বছর আগে, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়। আবার এই একই দিনে, আজ থেকে যাট বছর আগে, বিশ্বভারতীর শুভ উদ্বোধন উদযাপিত হয়। সারা বছরের প্রাত্যহিক মালিন্য থেকে উদ্ধার করে সাতই পৌষকে আমরা শুদ্ধতার প্রতীক রূপে চিহ্নিত করেছি।

গান

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান।

কথা

সংসারে প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপনের ভিতর দিয়ে তুচ্ছতার একটি সূক্ষ্ম জাল আমাদের চিত্তকে ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলে। অভ্যাসের পৌনঃপুনিকতায় আমরা সেই বিস্ময়ের শক্তি হারিয়ে ফেলি যে-বিস্ময়ের গুণেই শুধু এই পুরাতন পৃথিবী আমাদের চোখে চির নতুন হয়ে ফিরে ফিরে আসে। খণ্ড খণ্ড স্বার্থের ক্ষুদ্রতায় আমরা সেই ভালোবাসার। শক্তিকে হারাই যে-ভালোবাসা আমাদের ক্লান্ত প্রাণকে নতুন জীবন দান করে। বিস্ময়বোধহীনতা ও প্রেমশূন্যতার এই যে জড়তা এ-থেকেই মানুষের শুদ্ধ সত্তা চিরকাল মুক্তি আকাঙ্ক্ষা করেছে। সাতই পৌষের দীক্ষার দিনে সেই মুক্তিকে আমরা নতুন করে আহ্বান করি।

গান

এই কথাটা ধরে রাখিস-মুক্ত তোকে পেতেই হবে।

কথা

সাতই পৌষ একদিকে মহর্ষির দীক্ষালাভের দিন। অন্য দিকে শান্তিনিকেতনের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির এটি উদবোধন দিবস। দীক্ষার নিহিত অর্থ হল আধ্যাত্মিক; আর প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ম জাগতিক। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, মহর্ষির দীক্ষার দিনটিকেই এখানে প্রতিষ্ঠানের উদবোধন দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল কেন?

যেমন ব্যক্তির বিকাশে তেমনই প্রতিষ্ঠানের জীবনেও জীর্ণতা থেকে উদ্ধারের প্রয়োজন আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটা দিক আছে যেটা তার আদর্শের দিক, তার মহৎ উদ্দেশ্যের দিক। অন্য একটি দিক আছে যেখানে আমরা প্রতিদিনের ছোট ছোট আবশ্যক কর্মে ব্যস্ত। আবশ্যক বলেই এইসব কাজ কমবেশী মূল্যবান। কিন্তু এদের একটা বড় উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা চাই। তা নইলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সেই সব বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে, ছোট ছোট গোষ্ঠীর সেই সব দাবি বেশী জরুরী হয়ে ওঠে, ব্যক্তির সৃজনশীলতা অথবা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কল্যাণের সঙ্গে যার সদর্থক যোগ নেই। উদ্দেশ্য যেখানে বড় সেখানে উপায় নিয়ে মতের বিভিন্নতায় অগৌরবে নেই। কিন্তু খণ্ড খণ্ড স্বার্থ ও প্রত্যাশার কলহে যখন আমরা শক্তিহীন হয়ে পড়ি তখন সেই দৈন্য আমাদের সকলেরই অমঙ্গল ডেকে আনে। সেই সামূহিক বিপদ থেকে তখন উদ্ধারের পথ খুঁজতে হয়। সাতই পৌষের দীক্ষাদিবসে আমরা শান্তিনিকেতনের সেই বড় আদর্শকে স্মরণ করি যাকে আশ্রয় করে আমাদের সমস্ত সীমাবদ্ধ প্রয়াসে একটা মহত্ত্বের সঞ্চার সম্ভব।

সময়ের স্রোত যদিও নদীর স্রোতের মতোই অবিভাজ্য তবুও প্রকৃতি নিজের হাতে ঋতু ও বর্ষের পরিক্রমায় তাকে ভাগ করে দিয়েছে। আমরাও বছর গুণে গুণে সময়কে চিহ্নিত করে চলি। সেই গণনায় শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর আজ আশী বছর পূর্ণ হল। সময়ের এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে শতবর্ষের একটি নিশানা যেন দূর থেকে দেখা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন শুধু অতীতের কাজের জন্য পুরস্কার প্রার্থনা করে তখন। জানতে হবে যে ভিতরে ভিতরে সে দেউলিয়া হয়ে গেছে। আজকের এই দিনটিতে আমাদের দৃষ্টি বাড়াতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। এই শতকের প্রথম বর্ষে সেই যে যাত্রা শুরু, শেষ বর্ষে তার কী পরিণতি হবে জানি না। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, মানুষ যেমন নিজেরই শ্রমে ও উদ্ভাবনী শক্তিতে তার ইতিহাস নিজেই সৃষ্টি করে, শান্তিনিকেতনের ভবিষ্যৎও তেমনই বহু পরিমাণে নির্ভর করবে আমাদেরই রচনাত্মক কাজ এবং অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিঃস্বার্থ সহায়তার ওপর। সাতই পৌষের দীক্ষার দিনে সেই বৃহৎ দায়িত্ব আমরা সকলে যেন বিনীতভাবে গ্রহণ করতে পারি।

গান

(১)

চলো যাই, চলো, যাই চলো, যাই—

(২) মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *