৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
গত রাত থেকে জামী অসুস্থ। জ্বর, কাশি, বুকে ব্যথা, নিঃশ্বাস নিতে শোঁ-শোঁ শব্দ, কষ্ট।
সন্ধ্যের মুখে আমি আর শরীফ বাগানে বসেছিলাম। দুটি ছেলে গেট দিয়ে ঢুকে ধীর পায়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। এদেরকে আগে কখনো দেখি নি, তবু একপলক তাকিয়েই চিনলাম। পরনে সাধারণ প্যান্ট-সার্ট, মাথার লম্বা চুল প্রায় ঘাড় অব্দি, গাল পর্যন্ত নেমে আসা জুলপি, প্রায় চিবুক ছোঁয়া ঝোলানো গোঁফ। দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী আর হাবিবুল আলম।
ছেলে দুটি একটু হেসে আদাব দিল। শরীফ মৃদুস্বরে বলল, বস। সামনের দুটো খালি বেতের চেয়ারে ওরা বসল। শরীফ বলল, সব রেডি। বাসায় এনে রেখেছি। একটু বুঝিয়ে দিতে হবে।
শরীফ আমার দিকে তাকাতেই আমি উঠে ভেতরে গেলাম। ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম টেবিলটা পরিষ্কারই আছে, পাশের জানালার পর্দাও টেনে ঢাকা আছে। রান্নাঘরে গিয়ে কাসেমকে বললাম, গোটা চারেক শামি কাবাব আর দুটো চাপ এখুনি ভেজে ফেল। ফ্রিজ খুলে রসমালাইয়ের হাঁড়ি থেকে খানিকটা রসমালাই একটা বাটিতে তুলে দিয়ে বললাম, ওগুলো ভাজা হলে এই মিষ্টিসুদ্ধ ট্রেতে সাজিয়ে কোয়ার্টার প্লেট, চামুচ, পানি সব দিয়ে ডাইনিং টেবিলে দিবি পনের মিনিট পর। আমি আর আসতে পারব না। বুঝলি?
বাইরে বেরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কোন বাড়ির জানলায় কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না, রাস্তাতেও কেউ নেই। শরীফকে বললাম, ডাইনিং টেবিলে বসো গিয়ে।
ওরা তিনজন ঘরে গেলে আমি বাগানেই বসে রইলাম গেট পাহারা দিতে। বুক দুরু দুরু করছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওদের সঙ্গে গিয়ে বসতে, ওদের মুখ থেকে রুমীর কথা শুনতে। কিন্তু গেট ছেড়ে আমার যাবার উপায় নেই। জামীটাও অসুখ বাঁধিয়ে পড়ে থাকার আর সময় পেল না।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমাদের উল্টোদিকের দুটো বাড়ির পর রেজা সাহেবের ছেলে সাজ্জাদ এসে দাড়াল গেটে, খালাম্মা, একটা ফোন করব। আমি বললাম, ফোন তো খারাপ। ও চলে যেতেই দ্রুত পায়ে ঘরে গেলাম। এক্ষুণি কোথাও থেকে ফোন এলে মুশকিলে পড়ে যেতাম। দোতলায় উঠে বেডরুমের এক্সটেনশান ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম এক ডায়াল করে। তারপর আবার বাগানে গিয়ে বসলাম। আমাদের সিঁড়িটা ডাইনিংরুমের ভেতর পুবের দেয়াল ঘেঁষে। নামার সময় পায়ের গতি শ্লথ করে ডাইনে আড়চোখে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালাম। শরীফ টেবিলে ড্রয়িংয়ের কাগজ মেলে তার ওপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মৃদুস্বরে কিছুবলছে, কানে এলো দুচারটে শব্দ। অ্যাটমেন্ট, পিয়ার, গার্ডার, বিয়ারিং। ছেলে দুটি কাগজের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে একমনে শুনছে।
সন্ধ্যারও অনেক পরে ছেলে দুটি গোল করে গোটানো কাগজ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল। আমার গলার কাছে কি যেন পাকিয়ে উঠল। এই কাগজের রোল হাতে নিয়ে বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো খুবই বিপজ্জনক। ওদের তাড়াতাড়ি ডেরায় পৌঁছানো দরকার। একটা প্রশ্ন করলেও দেরি হয়ে যাবে। বোবার মতো তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা নীরবে মাথার কাছে হাত তুলে গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।