2 of 3

৮৮. টাকা জিনিসটার যে কী মহিমা

৮৮

টাকা জিনিসটার যে কী মহিমা তাই বসে বসে দেখে বিষ্ণুপদ। টাকা যেন ফুঁ। সেই ফুঁয়ে বাড়িটা যেন বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। দেখ-না-দেখ একতলা ঢালাই হয়ে গিয়ে দোতলার দেওয়াল উঠে গেল লিন্‌টেল অবধি। পরশু থেকে শাটারিং-এর কাজ। সামনের সপ্তাহে দোতলারও ঢালাই।

মুখোমুখি আজও রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া বাড়িটা। তবে আজকাল আর মুখ ভ্যাংচায় না, যেন স্নান চোখে সামনের বুক ফোলানো দোতলা বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকে জুলজুল করে। গায়ে এখনও ভারার মই একটা রয়েছে, তাতে শ্যাওলা ধরেছে। ইঁটগুলো কালো হয়ে এসেছে। ছাদহীন পাকা দেওয়ালগুলো ফাঁকা দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে শুধু। দুটো বাড়ির মধ্যে এই রেষারেষিটা— আর কেউ নয়—বিষ্ণুপদ টের পায়।

রামজীবন কি হেরে গেল? একেই কি হেরে যাওয়া বলে? প্রাণপাত চেষ্টা করে মা-বাপের জন্য পাকা ঘর তুলতে গিয়েছিল। পেরে ওঠেনি। সেইটেই কি তার পরাজয়?

কে জানে কি! তবে রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া বাড়িটার ভিতর থেকে বাতাস যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে।

তবে রামজীবন শুকনো মুখে নতুন বাড়ির তদারকি করে যাচ্ছে। খুব ব্যস্ত। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে কৃষ্ণ আসছে দেখাশুনো করতে। আসছে বামাচরণও। তবে তার মতলব আলাদা।

আদালত থেকে কী একটা ইনজাংশন বেরও করেছিল বামা। একদিন সেই কাগজ নিয়ে এসে হাজির। গাঁয়ের মাতব্বর মুরুব্বিদেরও জড়ো করেছিল। চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একখানা নাটক জমিয়েছিল, দেখুন আপনারা, বামাচরণের বুকের ওপর বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে এরা। ওই বুড়ো ভাম নিজের মুখে কবুল করেছিল, এ ঘরখানা আমায় দেবে। দেখুন অবিচার। আমাকে মেরেধরে তাড়িয়ে সেই জায়গায় বাড়ি তোলা হচ্ছে। এই দেখুন আদালতের অর্ডার। বাড়ির কাজ বন্ধ করতে হবে। নইলে জেল, জরিমানা সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।

কিন্তু বক্তৃতায় বিশেষ কাজ হয়নি। আদালতের হাত এই প্রত্যন্ত গাঁয়ে বিশেষ পৌঁছয় না। আদালতের কাগজে কী লেখা আছে তাও কেউ জানবার জন্য আগ্রহী নয়।

পঞ্চায়েত ষষ্ঠীপদ বলল, মা-বাপের জন্য ছেলে বাড়ি করে দিচ্ছে, তাতে তোমার এত আপত্তি হচ্ছে কেন হে বামাচরণ? সম্পত্তি তো আর বাপ-মা সঙ্গে নিয়ে যাবে না!

আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই শালা শুয়োরের বাচ্চা রামজীবন গুণ্ডা লাগিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। পাছে মা-বাপের বাড়ির ওয়ারিশ হিসেবে আমি দাবি করে বসি। আপনারা ষড়যন্ত্র বুঝতে পারছেন না? আমাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যে!

খুব তুমুল বচসা হল দু’ পক্ষে। কোনও ফয়সালা হল না। তার ভাগ্য ভাল যে, রামজীবন টু শব্দটিও করেনি। গালাগাল খেয়েও নয়।

পরদিন বামা এল শ্যামলীকে নিয়ে। শ্যামলী এসেই মড়াকান্না জুড়ে দিল, বাড়ি উঠছে, আমাদের ঘরখানা অবধি দখল করেছে, এ কী কাণ্ড গো? এ যে পুকুরচুরি…

বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে রইল।

শ্যামলী শাপ শাপান্ত বাপ বাপান্ত করে হেদিয়ে পড়ল।

পরদিন তারা থানা থেকে পুলিশ নিয়ে এল। একজন সেপাই আর বোধহয় একজন সাব-ইন্সপেক্টর। তারা এসে চারদিক দেখেশুনে বিষ্ণুপদকে বলল, এ কাজ তো ঠিক হচ্ছে না। বাড়ি তৈরির কাজ বন্ধ করতে হবে। কোর্টের অর্ডার।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, আমাকে বলে কোনও লাভ নেই। বাড়ি করছে কৃষ্ণজীবন, আমার বড় ছেলে। সে কলকাতায় থাকে। আদালতের অর্ডারের কথা সে বোধ হয় শোনেনি। তাকেই খবর পাঠাচ্ছি, যা হয় সে করবে।

সাব-ইন্সপেক্টর মুখে একটু তম্বি করল; বলল, ঠিকাদারকে বারণ করে দেবেন আর যেন কাজে হাত না দেয়।

বামাচরণকে চলে যেতে বলে সাব-ইন্সপেক্টরটি রয়ে গেল একটু। বামাচরণ সেপাইটির সঙ্গে হাসিমুখে চলে যাওয়ার পর সাব-ইন্সপেক্টর এসে বিষ্ণুপদর পাশে বসে বলল, জ্যাঠামশাই, কৃষ্ণ আর আমি এক ক্লাসে পড়েছি। বামাচরণ আমাকে চেনে না। বামার মাথাটাও একটু গোলমাল মনে হচ্ছে। ওর ওসব কথায় কান দেবেন না। বাড়িটা তাড়াতাড়ি তুলে ফেলুন। কিচ্ছু হবে না।

আদালতের অর্ডার আছে নাকি?

আছে। তবে ওসব সাজানো ব্যাপার। উকিলরা কত কী পারে!

কৃষ্ণ পরের রবিবার এসে সব শুনল। তারপর বলে গেল বামার দুঃখের কারণ নেই। চায় তো ওর ঘরটাও পাকা করে দেওয়া যাবে।

শুনে হাঁ হয়ে গেল বিষ্ণুপদ।

নয়নতারা বলল, কেন, তোর টাকা কি সস্তা হয়েছে? যে কাণ্ড বামা করে বেড়াচ্ছে ওর বউকে সঙ্গে জুটিয়ে, তাতে ওকে দানছত্র করতে আছে? এক নম্বরের নেমকহারাম।

কৃষ্ণ মৃদু হেসে বলল, ঘুষ দিতে চাইছি মা, যাতে তোমাদের আর জ্বালাতন না করে।

ও যা ছেলে, চিরকাল জ্বালাবে বাবা। ঘর পাকা করে দিলে তো বাঘের ঘরে ঘোগের বাসাই হল। শান্তি থাকবে না। বরং যদি পারিস ওর মাথার চিকিৎসা করা।

মাথার চিকিৎসার দরকার নেই মা। ও করতে গেলে আরও সন্দেহ করবে। শুনলাম তোমাদের কাছে বাড়ির ভাগ বাবদ টাকা চাইতে এসেছিল?

হ্যাঁ বাবা, সে কী রাগ!

কত টাকা চায়?

সে অনেক টাকা। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার।

সেটা পেলে কী করবে?

ও-ই জানে! পিছনে থেকে বউ বুদ্ধি দিচ্ছে। ও কি আর ভেবেচিন্তে বলেছে?

ধরো সেই টাকাটা দিয়ে যদি লিখিয়ে নিই?

না বাবা। ওসব করতে যাস না। ওর লোভের শেষ নেই। টাকা নিয়ে আবার একটা ফ্যাঁকড়া তুলবে। ওকে চিনি।

তা হলে থাক। বাবা, আপনি কি বলেন?

বিষ্ণুপদ তার কৃতী ছেলেটির দিকে চেয়ে তটস্থ হয়ে বলল, আমি আর কী বলব?

বামার উৎপাত তো বন্ধ করা দরকার।

উৎপাত আছে থাক, গায়ে না মাখলেই হল।

আপনার চিরকাল ওই কথা বাবা, কোনওদিনই কিছু গায়ে মাখেন না। কিন্তু আমি চাই শেষ জীবনটা অন্তত আপনারা একটু শান্তিতে থাকুন।

বিষ্ণুপদ খুব হাসল। মাথা নেড়ে নিজের পণ্ডিত এবং আহাম্মক ছেলেটির দিকে চেয়ে বলল, তোমারও বাস্তববুদ্ধি বলে কিছু নেই। টাকার ব্যবহারও শেখনি। আমার মতোই।

টাকাই তো চাইছে, টাকা দিলে যদি ঠাণ্ডা হয়।

নয়নতারা পাশ থেকে বলে উঠল, খবর্দার না। এখানে এক কাঁড়ি খরচ হচ্ছে বাড়ির পিছনে, ফের যদি বামার পিছনে টাকা ঢালিস তা হলে বউমা কুরুক্ষেত্র করবে।

সে জানবে না, মা।

তোকে বলেছে! বামাই গিয়ে বলে দিয়ে আসবে।

তা হলে কী করা?

বিষ্ণুপদ বলল, আমি বলি কি, তুই অত ভেবে মরিস না। বামার সঙ্গে তো চিরটা কাল আছি। সব সয়ে গেছে। নতুন উৎপাত নয় বাবা। তবে আগে এত মাথা-গরম ছিল না, আজকাল বায়ু বেড়েছে।

কৃষ্ণজীবন দুঃখিত মুখে বসে রইল। তারপর বলল, বামা গিয়ে আজকাল আমার ফ্ল্যাটে চড়াও হচ্ছে। যখন আমি থাকি না, তখন গিয়ে তার বউদির সঙ্গে বসে নানা খবর দেয়। কেন এসব করে বলো তো! ওর কাজকর্ম নেই? এই যে ইনজাংশন বের করল এতে ওর লাভটা কী? নিজের পায়ে কেউ কুড়ল মারে?

বিষ্ণুপদ প্রসন্ন গলায় বলে, মানুষ হিংসের জ্বালায় কত কী করতে পারে! বামাচরণ এসব করছে জ্বালায়। বড় লোভী ছেলে। অথচ ছেলেপুলে নেই, ওরটা খাবেই বা কে? নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ! গাঁয়ের লোক ডেকে এনে জমায়েত করল, হেঁকে ডেকে গালাগাল করল আমাদের, তাতে যে ওরও গৌরববৃদ্ধি হল না, সেটা বুঝবার মতো বুদ্ধিটাও নেই। ওকে টাকা দিতে চাইছো বাবা? তাতে আরও নষ্ট হবে। টাকা দিয়ে কি সব হয়?

কৃষ্ণজীবন কিছুক্ষণ দুঃখিতভাবে বসে রইল। তারপর মেনে নিল।

বামা তবু আশায় আশায় আসছে। রোজ আসছে। শেয়ালের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে। বাড়ির গড়ন পেটন দেখছে। বিড়বিড় করছে। মাঝে মাঝে হুংকারও দিচ্ছে, সব শালাকে জেলে পাঠাবো।

আদালতের সেই কাগজখানা ছাড়া বামার পক্ষে এখন আর কেউ নেই। কেউই তার পক্ষ নিচ্ছে না। পুলিশও আসছে না। আদালত থেকে পেয়াদা আনানোর মতো দমও তার নেই। শুধু আক্রোশটুকুই যা সম্বল। বিষ্ণুপদর একটু মায়াও হয়। ওই আক্রোশের বিষে, হিংসের বিষে তিলে তিলে ক্ষয় পাচ্ছে ছেলেটা।

আজ সকালে বিষ্ণুপদ উঠোনে বসেছে। রোদটা খারাপ লাগছে না। বৃষ্টি-বাদলা ছেড়ে এখন বেশ মোলায়েম আবহাওয়া। গরমটা তেমন নেই।

নয়নতারা এক বাটি মুড়ি মেখে দিয়ে গেল।

খাও।

মুড়ি দিলে নাকি?

হ্যাঁ। সঙ্গে নারকেল কোরা।

বাঃ বেশ। তবে মুড়ি চিবোতে এখন কষ্ট। কষের দাঁত নড়ছে।

জল দিয়ে ভিজিয়ে দেবো?

না। জল ছিটিয়ে ঘটিরা মুড়ি খায়। আমাদের ও অভ্যাস নেই।

তা হলে দুধ দিই একটু? মুড়ি মুখে দিয়ে দুধে চুমুক দিলে মুড়ি নরম হয়ে যাবে।

ও বাবা, না। দুধে অভ্যাস নেই। পেট ছেড়ে দেবে।

তা হলে?

চালিয়ে দেবোখন। চিবোতে একটু সময় লাগবে, এই যা।

নয়নতারা চলে যেতে যেতে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে বলল, ও মা গো! গোপালটা কোথায় উঠেছে দেখ। ও রাঙা বউমা, দেখ কাণ্ড! ছেলে পড়ে যাবে যে! হনুমানটা কোথায় উঠে বসে আছে দেখ!

দোতলার একটা জানালার ফাঁকায় গোপাল পা ঝুলিয়ে বসা। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। পায়ের নিচে একতলার রেন শেড। সারাদিন দুই ভাই এখন নতুন বাড়িতে বেয়ে বেড়ায়। এটাই তাদের নতুন খেলনা। এরকম আশ্চর্য কাণ্ড তারা কখনও দেখেনি। পটলের ইস্কুলের বন্ধুরা অবধি দল বেঁধে দেখতে আসে।

রাঙা বেরিয়ে এসে গোপালের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। গোপাল নড়ল না। রাঙারও তেমন উদ্বেগ নেই। একটু চেয়ে থেকে ফের রান্নাঘরে চলে গেল।

নয়নতারা বিষ্ণুপদর দিকে চেয়ে বলল, পড়ে যাবে না তো!

বিষ্ণুপদ একটু হাসল। তোমার চোখের আড়ালেও তো কত কী করে। সবসময় কি তুমি সঙ্গে থাকো? পড়বে না। পড়লেও তলায় পা রাখার জায়গা আছে, ভারার বাঁশ আছে, আত্মরক্ষার জৈবী তাগিদ আছে। ভয় পেও না।

তোমার কথা শুনেই বেশি ভয় লাগে। এমন করে বলো!

বিষ্ণুপদ একটু হাসল।

হ্যাঁ গো, তোমাকে বরং একটু চা দিই। চায়ে ভিজিয়ে মুড়ি খাও! তা হলে আর কষ্ট হবে না।

তা দিতে পারো। মাঝে মাঝে চা খেতে খারাপ লাগে না।

মুড়ি খেতে খেতেই চা দিতে এল নয়নতারা। ঊর্ধ্বপানে চেয়ে বলল, হ্যাঁ গো, যা বড় বাড়ি হচ্ছে শেষ হলে একেবারে রাজবাড়ি বলে মনে হবে, না?

মন্দ হচ্ছে না। বিরাট ব্যাপারই হচ্ছে।

যখনই বাড়িটার দিকে চাই বুকখানা ভরে ওঠে। আমাদের বুড়োবুড়ির জন্য এত আয়োজন! গা যেন সিরসির করে।

তা বটে। আমি ভাবি খরচটাও বড্ড বেশিই করে ফেলছে। আর একটু কম করে করলেও পারত।

ওগো, এই বাড়ির দিকে চেয়ে আমি যে কৃষ্ণকেই দেখতে পাই। কৃষ্ণ কি ছোট? সে বড় বলেই তার বাড়িও অমন। সে তো কৃপণ নয়।

বিষ্ণুপদ এক গাল হাসল, বড় ভাল বলেছো তো। দিব্যি কথা ফুটছে আজকাল। মাঝে মাঝে আমাকে তাক লাগিয়ে দাও।

হ্যাঁ গো, আমরা কি অনেকদিন বাঁচবো?

ও কথা কেন?

বেশি দিন না বাঁচলে ও বাড়ি ভোগ করব কেমন করে?

বিষ্ণুপদ চায়ে একটা পেল্লায় চুমুক দিয়ে বলল, মরার তত দিনক্ষণ নেই। কে কখন কবে কোথায় ঢলে পড়বে। আর সেই জন্যই তো মানুষের এত ভোগ-দখলের জলদিবাজি। তবে আমি বলি কি, ও বাড়িতে দুটো দিন বাস করে মরলেও আমার বুকখানা ভরে থাকবে। বাড়িটা তো কথা নয়, ওই বাড়ির পিছনে যে ছেলেটার টান আছে, সেইটেই অনেক।

ঠিকই বলেছো। উঃ, কী কাণ্ডই হচ্ছে!

আজকাল নয়নতারার মুখখানা সবসময়ে ঝলমল করে আনন্দে, গর্বে। অনেকদিন নয়নতারাকে এত খুশি দেখেনি বিষ্ণুপদ।

মিস্ত্রিরা এল নটা নাগাদ।

দুড়ুম দুড়ুম শব্দে কাজকর্ম শুরু হয়ে গেল। সারাদিন চলবে। কিছু খারাপ লাগে না বিষ্ণুপদর। বরং বেশ লাগে। শুধু মনটা খারাপ হয়, মুখোমুখি রামজীবনের অক্ষম বাড়িটার দিকে চাইলে।

রামজীবন রিকশা থেকে কয়েক বস্তা সিমেন্ট নামিয়ে বাড়িতে ঢোকাচ্ছে। ঠিকাদারবাবুর সঙ্গে জরুরি কথা সারল। তারপর দোতলায় উঠল কাজ দেখতে।

অনেকক্ষণ বাদে নেমে এসে বিষ্ণুপদর সামনে উঠোনে বসে একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, আর মাসখানেকের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। গৃহপ্রবেশের দিনটা পুরুত ডাকিয়ে ঠিক করে ফেলব নাকি বাবা?

তা করতে পারো। বলে আধ-খাওয়া মুড়ির বাটিটা রামজীবনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খা।

রামজীবন উচ্ছিষ্ট বাটিটা কপালে ঠেকিয়ে নিল। বলল, ব্যাপারটা জম্পেশই হচ্ছে বাবা। টাকা থাকলে কত তাড়াতাড়ি কত বড় কাণ্ড করা যায়!

তা বটে। বলে চুপ করে রইল বিষ্ণুপদ।

কী ভাবছেন বাবা?

বিষ্ণুপদ একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোর বাড়িটা কি ওরকমই থাকবে? কিছু করবি না?

রামজীবন উদাস মুখে বলল, আমি তো পারলাম না বাবা। ঠেকে গেল। দাদা আমাকে নতুন বাড়ির একতলাটা ছেড়ে দিচ্ছে। তাই ভাবছি ও বাড়ি দিয়ে আর হবেটাই বা কি? থাক পড়ে।

পড়ে থাকলে কি ভাল দেখাবে?

কী করব বাবা?

এ বাড়ি হওয়ার পর ইট সিমেন্ট কিছু বাঁচবে না?

ঠিকাদার কন্ট্রাক্টে কাজ করছে। জিনিস সব তার। আমরা তো কিনে দিইনি। জিনিস বাঁচলে সে নিয়ে যাবে।

আমি ভাবছিলাম, বাড়তি জিনিস দিয়ে ও বাড়িটা শেষ করা যায় কিনা। এই মজুররাই করে দিত।

আপনি কি মেজদার কথা ভাবছেন বাবা? মেজদাকে এনে ও বাড়িতে বসত করাবেন? সে হবে না। মেজদা আসবে না। তার টাকার দরকার। বাড়ি নয়।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, বামার জন্য নয়। ভাবছিলাম, নতুন একটা বাড়ির মুখোমুখি ও বাড়িটা ভাল দেখাচ্ছে না। ওর মধ্যে যে আমি তোকে দেখতে পাই। কত কষ্ট করে বুকের রক্ত তুলে করতে চেয়েছিলি। পারলি না, সে তো তোর দোষ নয়। কিন্তু ওটার দিকে চাইলে আমার কষ্ট হয়।

তা হলে ভেঙে দিই বাবা।

তা কেন? ভাবি কেন? গড়ছিলি যখন, শেষ কর।

আরও কিছু টাকা লাগবে।

তা লাগুক। চেষ্টা রাখতে হয়।

কিছুক্ষণ মুড়ি চিবিয়ে রামজীবন বলল, আপনার আশীর্বাদ থাকলে হয়ে যাবে।

ওই যে বললাম, ওটাই আশীর্বাদ। লেগে থাক।

যদি করে উঠতে পারি তা হলে ও বাড়িতে কী হবে বাবা?

হয়ে থাক। আমার একটা সান্ত্বনা রইল যে, রামজীবনও পেরেছিল।

রামজীবন হাসল, তাই হবে বাবা। করব।

বিষ্ণুপদ একটু হাসল।

বামাচরণ আর শ্যামলী এল বেলার দিকে। যখন বিষ্ণুপদ স্নানে যাবে যাবে করছে। দু’জনেরই উস্কোখুস্কো চেহারা। বামাচরণের চেহারা আরও একটু উদ্‌ভ্রান্ত।

বামাচরণ বলল, আপনার কাছে আসা বাবা।

বস তোরা। দাওয়ায় মাদুর আছে। পেতে বস।

শ্যামলী মাদুরটা নিয়ে এসে পাতল। দুজনে বসল।

বামাচরণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, একটা কথা শুনে ছুটে এলাম।

কী কথা?

আমাদের তো ধনেপ্রাণে মারলেন। শুনছি নাকি দাদা আমার ভাগের টাকাটা দিতে চেয়েছিল। আপনি আর মা বাগড়া দিয়েছেন।

বিষ্ণুপদ একটু অস্বস্তি বোধ করল। হাসবার একটা বৃথা চেষ্টা করে বলল, টাকাটা সে দিতে চাইলেও তোর নেওয়ার হকটা কোথায় তা একটু বুঝিয়ে বলবি?

তার মানে?

কৃষ্ণ তোকে কী বাবদে টাকাটা দিতে চাইছে?

বাঃ, আমার সম্পত্তির ভাগ!

সম্পত্তি কি ভাগ হয়েছে? আইন মোতাবেক কি স্থির হয়েছে কার কতটা ভাগ?

তা না-ই বা হল!

তা যদি না-ই হয়ে থাকে তা হলে তোর পাওনাগণ্ডার কথা উঠছে কি করে?

বামাচরণ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, শুয়োরের বাচ্চা বুড়ো, তুমি শালা বসে বসে শকুনির মতো মতলব আঁটছো? জুতিয়ে তোমার মুখ ছিঁড়ে দিতে হয়!

বিষ্ণুপদ স্তম্ভিত হল বটে, কিন্তু হার্টফেল হল না। এরকম হতে পারে বলে তার একটা আন্দাজ ছিল। সে শুধু বামার দিকে চেয়ে রইল।

নয়নতারা আর রাঙা বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। পটল আর গোপাল দৌড়ে নেমে এল ওপর থেকে। মিস্ত্রিরা কাজ বন্ধ করে মজা দেখছে।

বিষ্ণুপদ তাড়াতাড়ি দেখে নিল, রামজীবন ধারেকাছে আছে কিনা! এ বাড়িতে বামার রক্তপাত হোক তা আর সে চায় না। রামজীবন নেই। বাঁচোয়া।

শ্যামলী তাড়াতাড়ি বামাচরণকে টেনে বসিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বলল, তোমার আক্কেল নেই! কাকে কী বলছো? ছিঃ ছিঃ! কথা বলতে যখন জানো না, চুপ করে থাকলেই হয়। বাবা, আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, ওর মাথার ঠিক নেই।

বিষ্ণুপদর একটু হাঁফধরা গোছের ভাব হচ্ছিল। মুখে কথা এল না। শুধু মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, সে বুঝতে পেরেছে।

শ্যামলী বলল, বাড়ির চিন্তাতেই ওর মাথা এত গরম। দেখুন, যদি সত্যিকারের বিচার করে দেখেন তা হলে এ বাড়িতে আমরাই কেবল বঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের ওপর খুব অবিচার করছেন আপনারা। দাদা এত টাকা খরচ করতে পারছেন আর আমাদের সামান্য কিছু টাকা ওঁকে দিতে দিচ্ছেন না আপনারা, এটা কেমন কথা?

নয়নতারা এগিয়ে এসে বলল, তাই ঝগড়া করে টাকা আদায় করতে এসেছো?

বামাচরণ তার মায়ের দিকে চেয়ে বলল, ওই আর এক বদমাশ মাগী!

শ্যামলী তাকে ফের একটা ধমক দিল, ফের মুখ খারাপ করছো?

নয়নতারা শ্যামলীর দিকে চেয়ে বলল, ওর আর বলতে কিছু বাকি নেই। সব বলা হয়ে গেছে। আমাদের আর নতুন করে অপমান হবে না। নতুন শুধু বাপকে গালাগাল দেওয়া। তা সেটাও তো হয়ে গেল। আমি বলি এবার ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। রেমো এলে অক্ষত ফিরতে পারবে না। যাও।

বামাচরণ লাফিয়ে উঠে বলল, কেন যাবো? কাকে ভয় খাই? রেমো শালা আমার এইটা করবে।

বলে এমন একটা কুৎসিত ভঙ্গি করল যে, নয়নতারা আর রাঙা চোখ ফিরিয়ে নিল।

ও শালার গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়ব। নির্বংশ করে দেবো।

শ্যামলী হঠাৎ উঠে বামাচরণের চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বসিয়ে দিল। বলল, ফের ওরকম করলে কিন্তু মুশকিল আছে।

নয়নতারা বলল, বসছো কেন? বসে কিছু লাভ হবে না। তাড়াতাড়ি চলে যাও। পটল দৌড়ে গেল বোধ হয় বাপকে খবর দিতে। কাজটা ভাল করোনি এসে। ও তো পাগল, কিন্তু তোমার তো আর মাথার গোলমাল হয়নি। ওকে নিয়ে এসেছোই বা কেন?

শ্যামলী হঠাৎ শাশুড়ির দিকে চেয়ে বলল, বাড়ি কি একা আপনার? আমাদের নয়? বে-আইনিভাবে বাড়ি তুলছেন, আবার বড় বড় কথা!

নয়নতারা বলল, যা বলছি শোনো। বাড়ি যাও। এখানে আর থেকো না। বামা তার বাপকে গালগাল দিয়েছে, রেমোর কানে গেলে আস্ত রাখবে না। যাও।

শ্যামলী উঠল। বলল, যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে না দিলে কিন্তু বিপদে পড়বেন। বলে দিচ্ছি।

বামাচরণের হাত ধরে টেনে শ্যামলী বেরিয়ে গেল।

বিষ্ণুপদ তার জলচৌকি ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল। পারল না। হঠাং হাঁটু ভেঙে গোটা শরীরের ভার নিয়ে পুরনো বাড়ির মতো ভেঙে পড়ল উঠোনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *