৮৫
বীণা এত অবাক হল যে, প্রথমটায় মনে করল স্বপ্ন দেখছে। তারপর অবিশ্বাসের গলায় বলল, পাঁচ হাজার টাকা? এত টাকা আমাকে দিচ্ছো কেন গো কাকা?
কাকা শান্ত গলায় বলল, দিচ্ছি, রেখে দাও। তোমাকে তো খুব বেশী কিছু দিতে পারি না। তোমার গুণের কদর হল কই?
তা বলে হঠাৎ এত টাকা! এ তো অনেক টাকা গো!
বীণা, মানুষ আর কতটুকু দিতে পারে? দেনেওয়ালা ভগবান। তাঁর দান হিসেবেই নাও।
বীণা অবাক হয়ে বলল, আবার জল ঘোলা করলে যে—তুমি দিচ্ছো, না ভগবান দিচ্ছে?
কাকা একটু শুকনো হেসে বলল, ভগবানই দিচ্ছে বীণা।
এটা কিসের টাকা? বোনাস?
তাই ধরে নাও।
বোনাস হলে তো সবাই পাবে।
তার কোনও মানে নেই। আমি বলি কি, টাকা ডবল করার অনেক স্কিম হয়েছে আজকাল, সেরকমই একটা স্কিমে টাকাটা ফেলে রাখো। খরচ কোর না।
উদাস গলায় বীণা বলে, আমার আর খরচ কি? দু’ মুঠো খাওয়া আর পরনের কাপড়। ফুর্তি তো আর করব না। কী ইচ্ছে করছে জানো? আমার মা-বাবা তো গরিব, এ টাকা থেকে তাদের কিছু দিই।
সে তো ভাল কথা। তাই দাও।
বীণা একটু ভাবল। না, সেটা ভাল হবে না। তার ডলার আর পাউন্ডের কথা বাবা জানে। বাবা হয়তো সন্দেহ করবে এটা সেই ডলার বেচা টাকা। বাবার অ্যাটাং নেই, কিন্তু ঠ্যাটাং আছে। ট্যাঁকে পয়সা নেই, ওদিকে যুধিষ্ঠির। নিমাইয়ের সঙ্গে খুব স্বভাবের মিল। আর সেইজন্যই বোধ হয় হাড় হাভাতে সচ্চরিত্রটাকে ধরে এনে গলায় ঝুলিয়ে দিল তার। না, বীণা এক পয়সাও দেবে না। বাবাকে।
কী ভাবছো বীণা? পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ভাবছো? এ বাজারে ও টাকার আর কী-ই বা দাম বলো! অত ভেবো না।
আমার কাছে এ অনেক টাকা কাকা। কেন দিলে বলবে না? যা বলছে তা যেন আলগা-আলগা কথা। তোমার মুখটা বড্ড গম্ভীরও।
না বীণা, মুখ গম্ভীর হবে কেন? এই তো হাসছি।
বীণা হঠাৎ একটু ধরা গলায় বলল, টাকা-টাকা করে আমাদের জীবনটা কিভাবে কাটে বলল তো? ক’টা টাকার জন্য আমাদের কত হা-পিত্যেশ! এই যে এত টাকা হাতে এল, আমার এত আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু কী যে করব টাকা দিয়ে তাই ঠিক করতে পারছি না। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
বাড়ি যাও বীণা। ওই টাকাটা থেকে পাঁচ টাকার একটা পুজো দিও।
পুজো দেবো? কিসের পুজো?
আমি তার কী জানি! পুজো-আচ্চা তো মেয়েরাই করে। তোমার কোনও ঠাকুর নেই? লক্ষ্মী হোক সরস্বতী হোক, কালী বা শিব হোক?
না গো, আমার কি ঠাকুর দেবতার কথা মনে থাকে? সারাদিন যাত্রাপালা নিয়ে ভাবছি।
ঠাকুর দেবতার কথাও বোধহয় একটু ভাবা ভাল।
টাকার কথা কি গোপন রাখব সকলের কাছে?
হ্যাঁ, খুব গোপন রেখো।
আমিও তাই ভাবছিলাম। আমাকে হঠাৎ এত টাকা বকশিশ দিয়েছে জানতে পারলে সবাই তোমাকে ছিঁড়ে খাবে।
বকশিশ! ছিঃ, কী যে বলো বীণা। ওটা বকশিশ হবে কেন? বরং ভগবানের আশীর্বাদ বলে জেনো।
তোমাকে আজ ভগবানে পেয়েছে গো।
কাকা ম্লান হেসে বলে, ভগবানে পাওয়া ভাল। ভূতে পাওয়া ভাল নয়।
বীণা একটু স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার মনের মধ্যে নানা আবেগ, নানা ঢেউ। এই পাঁচ হাজার টাকাকে সে সহজভাবে নিতে পারছে না। কত কী মনে হচ্ছে!
আচ্ছা কাকা, তুমি কি একটা কথা জানো?
কী কথা?
কোরাকাঠিতে পালার পর তুমি আমাকে আংটি দিয়েছিলে, মনে আছে?
কেন থাকবে না? খুব মনে আছে। আংটি তুমি নাওনি।
কিন্তু সেই ঘটনা থেকে কী রটেছিল জানো?
কাকা ফের ম্লান একটু হেসে বলল, জানি বীণা। মানুষ তোমাকে আর আমাকে জড়িয়ে গল্প কেঁদেছিল। হঠাৎ কথাটা তুললে কেন? পাঁচ হাজার টাকা দিলাম বলে কোনও সন্দেহ করছ নাকি?
বীণা জিব কেটে বলে, ছিঃ ছিঃ, তুমি দেবতার মতো মানুষ। কোনওদিন পাপচক্ষুতে আমার দিকে তাকাওনি পর্যন্ত। পুরুষের চোখ তো আমি চিনি।
কাকা হাসল, চেনো? সত্যিই চেনো?
খুব চিনি কাকা।
কাকা একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ছিল একজন ভারী ভাল লোক। নিমাই। তাকে চিনেছিলে?
বীণা অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ তার কথা কেন কাকা?
কাকা মাথা নেড়ে বলে, কি জানি কেন, নিমাইয়ের কথা আমার খুব মনে হয়।
ওর কথা ভাবলে তো আমার গা জ্বালা করে।
তা অনেক্কার বলেছো। দোষঘাট ছিল না বলছি না, কিন্তু লোকটা তো সাচ্চা।
সাচ্চা ধুয়ে কি জল খাবো? অপদার্থ।
কাকা একটু হেসে বলল, নিমাইয়ের কোনও খোঁজ রাখো?
জানি। কাঁচরাপাড়ায় দোকান দিয়েছে। সে দোকান নাকি ভালই চলে। ভাল থাকুক, আমার তাতে কী?
সে তো বটেই। তবে তার হিল্লে হয়েছে শুনে আমার কিন্তু মনটা ভাল লাগে। কলিযুগে ওসব লোকের তো কোনও দাম নেই! কিন্তু তবু নিমাই যে নিজের জোরে সততা বজায় রেখে টিকে আছে এটা কিন্তু আমাদের মতো পাপী-তাপীদের কাছেও ভরসার কথা। চন্দ্র সূর্য কাদের জন্য ওঠে জানো? ওইসব মানুষের জন্য, তাদের ভাগ্যে আমরাও চন্দ্র সূর্যের ভাগ পাই। নইলে পেতাম না।
বড্ড যে গদ্গদ ভাব দেখছি তোমার।
লোকটাকে ফিরিয়ে নিতে পারো না বীণা?
তোমার কি মাথা খারাপ হল?
কাকা একটু চুপ করে রইল বিমর্ষ ভাবে। তারপর বলল, সজল কী বলছে?
বীণা ভ্রুকুটি করে বলে, কী বলবে?
কোনও প্রস্তাব করেনি?
ও আমাকে বিয়ে করতে চায়।
আর তুমি?
বীণা খিলখিল করে হেসে বলে, দুদিন রোসো। পুরুষ মানুষের প্রেম হঠাৎ উথলে ওঠে, আবার মিইয়ে যায়।
ওটা কথা হল না বীণা। সজল ভাল ছেলে, অনেক গুণ। তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারা কি সহজ কাজ? শুনেছি ও নাকি নিমাইয়ের কাছেও গিয়েছিল।
কে বলল তোমাকে?
জানি।
বীণা ভ্রুকুটি করে বলে, সেটাই বা কোন অপরাধ হয়েছে?
কাকা মাথা নেড়ে বলল, ওর অপরাধ নয়। তোমারও অপরাধ নয়। ভাবছি, নিমাই ব্যাপারটা টের পেল কিনা!
পেলে পাবে। অত ভয় কিসের? শোনো কাকা, আমার জীবনটা আমারই। এটা কাউকে দাসখৎ লিখে দানপত্র করে দিইনি। একবার বিয়ে হয়েছিল বলে যে চিরদিনের জন্য এক খোঁটায় বাঁধা থাকতে হবে, তেমন নিয়ম আমি মানি না।
কাকা তার দিকে চেয়ে হাসছিল, বলল, তোমার নেত্রী হওয়া উচিত ছিল। বেশ গুছিয়ে বলতে পারো বটে। কিন্তু আমাদের জীবনটা তো গোছানো নয় বীণাপাণি। সব বেগাছ। যাকগে, আমাকে আবার শত্রু মনে কোরো না।
বীণাপাণি একটু গোঁজ হয়ে থেকে বলল, কেন যে তোমরা সবাই ওই লোকটার পক্ষ নাও, তা বুঝি না।
কাকা অবাক হয়ে বলে, কে পক্ষ নিয়েছে? আমি মোটেই নিমাইয়ের পক্ষ নিইনি। নিমাইয়ের কথা খুব মনে হয়, সে কথাই বলছিলাম।
জানি গো জানি।
পাঁচ হাজার টাকা ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরে এল বীণাপাণি তখন তার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন, অনেক দোলাচল। সে বোকা নয়। কাকা হঠাৎ তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ফেলল কেন সেইটে নিয়ে সে আগাপাশতলা ভেবে দেখতে লাগল। এ টাকা কি তার কোনও ভাবে পাওনা হয়? টাকাটা দিতে অনেক ভূমিকা করে নিয়েছিল কাকা। কাল রিহার্সালের পর বলল, আগামী কাল সকাল দশটার সময় আমার কাছে একবার এসো বীণা। কথা আছে। ওই সময়টায় আমি একটু ফাঁকা থাকি। খুবই ফাঁকা ছিল কাকা। দরজা বন্ধ করে টাকাটা দিল। বীণা বুঝতে পারছে না, হঠাৎ এত বদান্যতা কেন! দুঃখের দিনে কাকা তার জন্য অনেক করেছে। এখনও যাত্রার জন্য, হিসেব রাখার জন্য দুটো খাতে কাকা তাকে মাসে হাজার টাকার ওপরেই দেয়। সেও অনেক টাকা। তবে আবার বাড়তি পাঁচ হাজার দিল কেন?
কুসুম আজকাল রোজই আসে। রান্না করে, ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়। এমনিই করে। কুসুম তো তার কাজের মেয়ে নয়। ভালবেসে করে। আজ কুসুম আসতেই বীণা বলল, হ্যাঁ রে, আজ একবার বিষ্ণুপুর যাবো ভাবছি। রাতটা থেকে আসবো। তুই আমার বাড়ি পাহারা দিবি আজ?
কুসুম ঘাড় নেড়ে বলে, দেশে! যাও না। মা-বাবাকে দেখে এসো গিয়ে। অনেকদিন তো যাওনি।
বীণা গড়িমসি করে উঠতে যাচ্ছিল, কুসুম হঠাৎ বলল, একটা খবর আছে বীণাদি।
কী খবর?
আমার কাঁচরাপাড়ার জামাইবাবু এসেছে। বলল পালপাড়ায় তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন গত হয়েছেন।
মানে! মারা গেছে নাকি?
হ্যাঁ, চার পাঁচদিন হল। খবরটা তোমাকে দিতে বলছিল।
বীণা একটু স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। শাশুড়ি! হ্যাঁ, এখনও তো সম্পর্কটা সামাজিকভাবে আছে। কী করবে সে? তার কি কিছু করা উচিত?
কুসুম তার দিকে চেয়েছিল। খবরটা শুনে তার কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাই দেখছে বোধ হয়।
বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, কি করে হল?
তা তো জানি না। নিমাইদাদা নাকি উত্তম কুস্তম কান্নাকাটি করছে। জল অবধি খাচ্ছে না। ভীষণ অবস্থা। মাকে বড় ভালবাসত, তাই না?
বাসত। খুবই বাসত। নিমাইয়ের কাছে মা বাপ ছিল দেবতার মতো। বিয়ে হয়ে এসে বীণা অনেক অভাবের কষ্ট সয়েছে, কিন্তু শাশুড়ির মুখাড়া খায়নি কখনও। বড় নিরীহ মানুষ, বড় বোকাসোকা। অনেকটা তার মায়ের মতোই। আরও নিরীহ। আরও বোকা।
খবরটা কি তোর নিমাইদাদাই দিতে বলেছে আমাকে?
কুসুম একটু ইতস্তত করে বলল, না। তোমাকে সে খবর দিতে বলেনি।
ঠিক জানিস?
কুসুম আবার একটু চুপ করে থেকে বলল, কি জানি বাবা, তোমাকে বলা উচিত হবে কিনা। তুমি যা নিমাইদাদার ওপর রেগে যাও।
কী গোপন করছিস বল তো? এমন কী কথা!
আমার জামাইবাবু তো নিমাইদাদার সঙ্গেই পালপাড়া গিয়েছিল। নিমাইদাদা তাকে বলেছে, খবরটা বীণা যেন না পায়, দেখো। তার সুখের জীবন, এসব খবরে তার আনন্দ মাটি হবে। আমরা তো তার কাছে মুছে গেছি, এ খবরে তার আর দরকার নেই।
বীণা একটু জ্বলে উঠল, বলেছে! তাহলে খবরটা আমাকে দিলি কেন?
কুসুম কাঁচুমাচু হয়ে বলে, জামাইবাবু বলল নিমাইদাদা ঠিক কথা বলেনি। শাশুড়ি মরলে তো তোমার অশৌচ হয়। খবরটা না দিলে পাপ হবে।
অশৌচ!
হ্যাঁ, সেটাও তোমাকে বলে দিতে হবে নাকি?
বীণা দাঁতে দাঁত পিষে বলে, অশৌচ হবে কেন? সম্পর্কই যেখানে নেই, সেখানে অশৌচ হবে কেন?
তুমি মানবে না অশৌচ?
কেন মানব?
কুসুম এ জবাবে খুশি হল না। বলল, না মানলে মেনো না। তবে অশৌচ কিন্তু হয়।
বীণা স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ওসব আমি মানি না। আমার কেউ নেই।
কুসুম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অন্তত নিরামিষটা তো খেতে পারো। চুলে তেল-টেল দিলেই হল।
বীণা একটা শ্বাস ফেলে বলে, তোদের অনেক সংস্কার।
কুসুম মুখটা শুকনো করে বলে, তা যাই বলো, এসব মানতে হয়।
সাহেবরা তো অশৌচ মানে না, তাদের কোন ক্ষতিটা হয়েছে শুনি? দুনিয়াটা তো তারাই চালাচ্ছে। আমরা এত মানছি, তাতে কোন হাত পা গজিয়েছে আমাদের। ধুঁকছি।
কুসুম একটু অবাক হয়ে বলে, সাহেবদের কথা ভেবে কী হবে? তারা আলাদা মানুষ। আমরা তাদের মতো নই। তুমি কেন রেগে যাও বীণাদি? নিমাইদাদা কাছে থাকলে তুমিও কিন্তু মানতে। যাকগে বাবা, যা ভাল বোবঝা করো। আমি আর কিছু বলব না।
আমি যাচ্ছি কুসুম। তুই ঘরদোর দেখে রাখিস।
এসো গিয়ে।
বীণা উঠল।
কুসুম হঠাৎ বলল, শোনো, এ খবর শুনলে স্নান করতে হয়।
বীণা বলল, না করে দেখিই না কী হয়!
বীণা শাড়ি পাল্টাল, মুখে একটু পাউডার দিল, সামান্য লিপস্টিক ছোঁয়াল। পাঁচ হাজার টাকা-ভরা ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। খুব তীক্ষ চোখে আগাগোড়া লক্ষ করল তাকে কুসুম। কুসুম খুশি হচ্ছে না। কুসুম তাকে সমর্থন করছে না।
বীণা বাস স্ট্যান্ডে এসে দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার কান্না পাচ্ছে না, কিন্তু কে জানে কেন মনটা খারাপ লাগছে একটু।
বিষ্ণুপুরে যখন পৌঁছলো তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে সে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াল। এ কাদের বাড়ি? সে কি ভুল বাড়িতে ঢুকছে? মা-বাবার ঘরখানা লোপাট। চারদিকে ইট কাঠ টিন ভূপাকার ছড়ানো। অনেকগুলো মিস্তিরি গোছের লোক ধ্বংসস্তৃপের ভিতরে কি সব করছে।
সে চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, মা!
নয়নতারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বলে, ওমা, তুই এসেছিস? আয়, দ্যাখ কী সব কাণ্ড হচ্ছে!
কী কাণ্ড মা?
কৃষ্ণ আমাদের বাড়ি করে দিচ্ছে যে!
দাদা বাড়ি করে দিচ্ছে? কই আমাকে খবর দাওনি তো!
বড্ড তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল কিনা! আমরা বামার ঘরটায় আছি। যা, গিয়ে ও ঘরে কাপড়-টাপড় ছাড়।
মেজদা নেই?
না। সে চলে গেছে। অনেক কথা। পরে শুনিস।
বীণা অবাক চোখে ভাঙা ঘরের জায়গাটা দেখছিল। ফাঁকা ন্যাড়া অদ্ভুত দেখাচ্ছে। জন্ম থেকেই দেখে-আসা চেনা জায়গাটা কেমন হবে এবার!
কত বড় বাড়ি হবে মা?
ওরে সে মস্ত বাড়ি হবে শুনছি। তিনতলা। বড় বড় ঘর হবে, বারান্দা হবে, দরদালান হবে, বাথরুম হবে, ঠাকুরঘর হবে, কল লাগানো হবে, পাম্প বসবে কুয়োয়।
বলো কী! দাদা এত করবে?
করছে তো।
বীণার মনটা ভিজে গেল। মা-বাবাকে সে চিরকাল কষ্ট করতেই দেখে এসেছে। এত সুখ সইবে তো!
বীণা একটা শ্বাস ফেলে বলল, যাক, তাহলে দাদার এতদিনে সুমতি হল।
ওকথা কেন বলছিস? কৃষ্ণর কি কখনও কুমতি ছিল! ওই খাণ্ডার বউয়ের পাল্লায় পড়ে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণর মনটা তো আমি জানি। কষ্ট করে মানুষ হয়েছে, সেই কষ্ট তোরাও করিসনি। দুঃখীর ছেলে বলেই সে বরাবর আমাদের দুঃখ বুঝত। কিছু করতে পারত না, তা সেটা তার দোষ নয়।
তুমি তো বরাবর দাদার পক্ষে মা, দাদার এতটুকু নিন্দে সইতে পারো না।
নয়নতারা অহংকারে উজ্জ্বল মুখে বলে, আমার কথার কী দাম বল? কিন্তু আজ যে দুনিয়াসুদ্ধ লোক আমার কৃষ্ণর নামে জয়জোকার দিচ্ছে! দেখতে পাস না আমার কৃষ্ণ কিরকম মাথা-উঁচু মানুষ। আমি কি এমনি এমনি পক্ষ নিই?
বীণা মুখটা চুপ করে বলে, হ্যাঁ মা, দাদা আজ অনেক বড়, আমাদের নাগালের বাইরে। দাদা বলে ভাবতেও ভয় করে। পরিচয় দিলে লোকে বিশ্বাস করে না।
বীণা ধীর পায়ে ঘরে এল। কাপড় ছাড়ল। তারপর শুয়ে রইল একটু চুপচাপ। কী করবে সে এখন? কী করা উচিত? শাশুড়ির মরার খবরটা পেয়ে অবধি তার মৃদু একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মন থেকে তাড়াতে পারছে না অস্বস্তিটাকে।
বাবা কোথায় গিয়েছিল। গরমে ঘেমে ফিরে এসে তাকে দেখে বলল, কখন এলি?
একটু আগে। তোমরা বেশ সুখে আছো, না বাবা? পাকা বাড়িতে থাকবে।
বিষ্ণুপদ জামাটা ছেড়ে রেখে বসল। তারপর বলল, সংসারে সুখ বড় একটা নির্ভেজাল হয় না। তার মধ্যেও কত চোরা টান, কত শত্রুতা থাকে। বামা তো শুনছি আইন আদালত করবে। বাড়ির কাজ না বন্ধ হয়ে যায়।
কেন, বাড়ি হলে মেজদার ক্ষতি কী?
সেটা সে-ই জানে। গত রোববার সে বড় বউমাকে নিয়ে এসেছিল। বড় বউমা এসে মিষ্টি মিষ্টি করে অনেক কথা শুনিয়ে গেল। মনটা তাই ভাল নয়।
বউদি কথা শুনিয়ে গেল? কেন বাবা?
বিষ্ণুপদ অসহায় ভাবে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, সে সব বুঝবার মতো মাথা কি আমার আছে? তোর মাও বোকা মানুষ।
কী বলছিল?
সে শিক্ষিতা মেয়ে, পাপষ্টি তো ঝগড়া করে না। নানারকম কথা বলল। ইংরেজিতেও অনেক কথা। সব কি বুঝি? তবে জানিয়ে গেল এ কাজটা ভাল হচ্ছে না।
এ বাড়িতে এল, ভাতটাত খেয়েছে তো?
না। খেয়ে এসেছিল। চা-টুকু খেয়েছিল। সেটাই ভাগ্যি। তবে তার দোষ নেই। কৃষ্ণ খরচটাও তো কম করছে না! বউমার সেটা ভাল না লাগতে পারে। আমি সেই থেকে ভাবছি, এ বাড়ি কি আনন্দের বাড়ি হবে? বামা ক্ষেপে আছে, বড় বউমা খুশি নয়, ওই দালানে থাকতে কাঁটা কাঁটা লাগবে না একটু?
তা কেন বাবা? টাকা তো বউদির নয়, দাদার।
হ্যাঁ। কৃষ্ণ পরদিন এসে সে কথাই বলল। বউমা যে কথা শোনাতে আসবে তা জানা ছিল তার। তাই পরদিনই এসে হাজির। আমাদের মন খারাপ দেখে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গেল। তোর মুখটা অমন শুকনো কেন বল তো?
রোদে এলাম তো!
তাই হবে।
বীণা বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে। অশৌচ! হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, পালপাড়া। মাঝে মাঝে বুকটা ধক করে উঠছে।
খাওয়ার সময় সে ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করল, মাছ নেই মা?
নয়নতারা বলল, মাছ তো রোজ আসে না। মাঝে মাঝে। তাও এখন ঘর ভাঙাভাঙির গণ্ডগোলে আমাদের খাওয়া-দাওয়া সব মাথায় উঠেছে।
রাঙা বলল, আজ রাতে তোমাকে ভাল মাছ খাওয়াবো।
রাতে! বলে একটু থমকাল বীণা। তারপর বলল, আজ রাতে আমি থাকব না তো!
ওমা! কেন? গোপাল যে তোমাকে দেখে কত লাফালাফি করল! পটল তো বলছে, সাতদিন রেখে দেবে তোমায়।
না বউদি। আজ যেতে হবে।
এত অল্প সময়ের জন্য কেউ আসে?
পরে এসে থাকব। দালানও উঠে যাবে ততদিনে। কী বলে?