কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কোনও চিকিৎসাই বাকি রাখছে না দ্বারিকা। শহরে শল্যচিকিৎসক হিসেবে প্রধান এখন ডোনাল্ড জেফ্রি, লোকমুখে তাঁর নাম ধন্বন্তরি জেফ্রি সাহেব, তিনি সফল অস্ত্রোপচারে ভরতের পেট থেকে বর্শার ফলাটা বার করে দিয়েছেন, কিন্তু তাতেও দুভাবনা কাটেনি। ভরতের কিছুতেই পুরোপুরি জ্ঞান ফিরছে না। তার ক্ষতস্থানটি দূষিত হয়ে আছে, সেই জন্যই তার শরীর সর্বক্ষণ জ্বরতপ্ত, মাঝে মাঝে তো সে বিড়বিড় করে কিছু বলে, তা প্রলাপের মতন অসংলগ্ন, ভাল করে শোনাও যায় না।
ডোনাল্ড জেফ্রির সুযোগ্য ছাত্র নিশিকান্ত মজুমদার আসেন প্রতিদিন। তাঁর সঙ্গে কবিরাজ গঙ্গাচরণ সেনের আলোচনা হয়। অ্যালোপ্যাথির ডাক্তারের সঙ্গে কবিরাজির বিরোধ নেই, কিন্তু হোমিওপ্যাথ গুণময় দত্ত প্রতিবাদ জানিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। তাঁর মতে, কবিরাজির শেকড়-বাকড়ের সঙ্গে হোমিওপ্যাথির সূক্ষ্ম ওষুধ একেবারেই চলে না। অপরপক্ষে নিশিকান্ত মজুমদারের দাদামশাই ছিলেন কবিরাজ, বাল্যকালে তাঁর চিকিৎসাতেই একবার কঠিন রোগ থেকে তিনি বেঁচে উঠেছেন, সুতরাং কবিরাজকে তিনি কখনও তাচ্ছিল্য করতে পারেন না। কবিরাজ গঙ্গাচরণ সেনও বিশেষ খ্যাতিমান, শোনা যায়, সুচিকাভরণ দিয়ে তিনি মৃত্বৎ রোগীকেও জাগিয়ে তুলতে পারেন, এ ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন ফল হচ্ছে না তাঁর ওষুধের। বিচিত্র এই মানুষের শরীর, কোন ওষুধে যে কার কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে, তা আজও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এত ওষুধেও কেন ভরতের জ্বর প্রশমিত হচ্ছে না, তা বুঝতেই পারছেন না চিকিৎসকরা। এর চেয়েও গুরুতর রোগীরা এই একই ওষুধে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
ডাক্তার কবিরাজরা যখন আসেন, তাঁদের সঙ্গে থাকে দ্বারিকা, ভূমিসূতা তখন পাশের একটি ছোট কক্ষে চলে যায়। সে সামনে আসে না, কিন্তু আড়াল থেকে সব কথা শোনে। কয়েকদিন ধরে কবিরাজমশাই একটি নতুন প্রস্তাব দিতে শুরু করেছেন। তিনি অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, কোনও কোনও যোগী-মহাপুরুষের এমন ক্ষমতা থাকে যে, তাঁরা ইচ্ছে করলে কোনও মৃত ব্যক্তিরও প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেন। এরকম একজন মোগী আছেন কাশীতে, তাঁর নাম স্বরূপানন্দ স্বামী, তিনি প্রখ্যাত ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাক্ষাৎ শিষ্য। শেষ উপায় হিসেবে ভরতকে এবার তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। নিশিকান্ত মজুমদার এ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী, তিনি স্বরূপানন্দ স্বামী সম্পর্কে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতে চান না, কিন্তু এরকম রোগীকে এখন স্থানান্তর করার প্রশ্নই ওঠে না। এখান থেকে কাশীতে নিয়ে যাবার ধকল সহ্য করা এ রুগির পক্ষে অসম্ভব।
দ্বারিকা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। ভরত দিন দিন যেরকম ক্ষীণবল হয়ে আসছে, তাতে যে-কোনও সময় হঠাৎ তার প্রাণবায়ু নিবে যেতে পারে। নিজে থেকে তো সে খেতেই পারে না, জোর করেও তাকে প্রায় কিছুই খাওয়ানো যায় না। সে অচেতনের মতন পড়ে থাকে, কোনওক্রমে তার মুখ খুলে চিনির জল ও অতি তরল মাংসের সুরুয়া খাওয়ানোর চেষ্টা হয়, কিছুটা ভেতরে যায় কি যায় না, আবার বেরিয়ে আসে। এখন কোনও অলৌকিক সংঘটন ছাড়া তাকে বাঁচাবার বোধহয় কোনও উপায় আর নেই।
ভূমিসূতাকে সে জিজ্ঞেস করে, কী করা যায় বলো তো? বেনারসেই নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব? ডাক্তাররা তো আর কোনও আশ্বাসই দিতে পারছে না।
ভূমিসূতা ধীরে ধীরে দু দিকে মাথা দোলায়। দ্বারিকা তার বন্ধুর চিকিৎসার সব রকম ভার নিয়েছে, ভূমিসূতার পক্ষে পৃথক মতামত দেওয়া ভাল দেখায় না। কিন্তু ভরতকে এখান থেকে সরাবার চেষ্টা সে কিছুতেই মানতে পারে না, কবিরাজের মুখে কথাটা শোনামাত্র আশঙ্কায় তার বুক কেঁপেছে।
দ্বারিকা বলল, কাশীর বাতাস এমনিই বড় পবিত্র। বড় স্বাস্থ্যকর। সেখানে গেলে সকলেরই উপকার হয়। আর সত্যিকারের মহাপুরুষরা ইচ্ছে করলে অসাধ্যসাধন করতে পারেন।
ভূমিসুতা চুপ করে থাকে, তার নীরবতাতেই অনিচ্ছা প্রকাশ পায়।
বসন্তমঞ্জরীও এককথায় এ প্রস্তাব নস্যাৎ করে দিয়েছে।
ভূমিসূতা আসবার পর থেকে সে আর একবারও ভরতকে দেখতে যায়নি। যেন ভূমিসূতার ওপর সব ভার অর্পণ করে সে নিশ্চিন্ত হয়ে আছে। ভরত বাঁচবে কি বাঁচবে না, দ্বারিকা তাকে এই প্রশ্ন করলে সে সরলভাবে বলে, আমি তো জানি না, অত বড় বড় ডাক্তাররা দেখছেন…। যেন তার দৈবশক্তি চলে গেছে, ভবিষ্যদ্বাণী করারও আর ক্ষমতা নেই। ওসব মাঝে মাঝে হয়, যখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, তা আবার কেটেও যায়। সর্বক্ষণ ওইরকম ঘোরের মধ্যে থাকলে তো সে বাঁচতেই পারত না।
ভূমিসূতার সঙ্গে তার বেশ মনের মিল হয়েছে। যদি সুখের সময় হত, তা হলে দুজনের সখীত্ব আরও নিবিড় হতে পারত, কিন্তু এখন দুঃখের কথাই বেশি হয়। ভরতের সেবায় ভূমিসূতার নিজের নাওয়া-খাওয়ার খেয়াল থাকে না, বসন্তমঞ্জরীর তা ঠিক খেয়াল থাকে, সে ভূমিসূতাকে জোর করে ওপরে ডাকিয়ে আনে, নিজের সঙ্গে খেতে বসায়। ভূমিসূতা খেতে না চাইলে সে কৃত্রিম কোপের সঙ্গে বলে, দেখো মেয়ে, তুমিও অসুস্থ হলে কী ঝাটে পড়ব বলো তো! এ বাড়িতে দুটো রুগি কে সামলাবে!
এর মধ্যে একদিন সে ভূমিসূতাকে বলল, ডাক্তাররা যা-ই বলুক, ওই মানুষটাকে বাঁচিয়ে তুলতে একমাত্র তুমিই পারো। তোমার সঙ্গে আমার জীবনের অনেক মিল। অনেক দুঃখ, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পার হয়ে, অনেক সাধনার পর আমি এই শিবের মতন স্বামী পেয়েছি। ছোটবেলা আমি কৃষ্ণনগরে এক বাড়িতে খেলতে যেতাম। সেখানে উনি আমাকে প্রথম দেখেন, উনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা রাজি হলেন না, আমাকে নরকের দিকে ঠেলে দিলেন। সে কী অন্ধকার, সে কী পিচ্ছিল, কত বাঘ-ভাল্লুকের মতন মানুষ, কী দুর্গন্ধ! এক নদী থেকে আর এক নদী। ছোট নদী থেকে বড় নদী। আমি ভাসতে ভাসতে গেলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, উনিই আমার স্বামী, আর কেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না। নষ্ট করতে পারবে না। যখন-তখন মরতে রাজি ছিলাম, বিষের কৌটো বেঁধে রেখেছিলাম আঁচলে, ভগবানকে ডেকে বলতাম, হে ঠাকুর, একবার যেন ওঁর দেখা পাবার পর মরি! কত পাঁকের মধ্য দিয়ে গেছি, কিন্তু গায়ে কাদা লাগেনি, মরতে ভয় ছিল না বলে আর কিছুকেই ভয় পাইনি। যখনই একা থাকতাম, দেখতে পেতাম, নিদারুণ অন্ধকারের মধ্যে এক জায়গায় একটা জোরালো আলো, যেন একটা সুড়ঙ্গের ওপরে ঝকমক করছে সূর্য, সেই আলো আমাকে হাতছানি দিত। আমি জেদ ধরে বসেছিলাম, ওই আলোর কাছে আমাকে যেতেই হবে! এখন দেখো, কত আলো, আমার স্বামী, সংসার, আমার সন্তান।
ভূমিসূতা মুখ নিচু করে ভাতের থালায় আঙুল দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলল, তুমি ভাগ্যবতী, তুমি শেষ পর্যন্ত পেয়েছ। কিন্তু আমার ভাগ্যে বোধহয় তা আর হবে না। বড় দেরি হয়ে গেছে।
বসন্তমঞ্জরী বলল, ও মা, অমন অলক্ষুণে কথা বলতে আছে? মানুষটা তো বেঁচে আছে এখনও। যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। বেহুলা লখীন্দরকে বাঁচিয়েছিল, আর তুমি পারবে না? তোমাকে যে পারতেই হবে।
ভূমিসূতা বলল, কী করে পারব আমি জানি না। আমার কতটুকু শক্তি?
বসন্তমঞ্জরী বলল, তোমার হাতেই তো সব শক্তি। ইচ্ছাশক্তি। তুমি ওকে ভালবাসা দাও, খুব ভালবাসা, আরও আরও, অনেক অনেক ভালবাসা। সেই ভালবাসার টান এড়িয়ে ও যাবে কোথায়?
ভূমিসূতা মুখ তুলে বসন্তমঞ্জরীর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এরকম রমণী সে আগে কখনও দেখেনি। এ পর্যন্ত অন্য যত নারীদের সঙ্গে সে মিশেছে, তারা কেউ ভালবাসা শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণই করে না। এই শব্দটাই যেন সে নতুন শুনছে।
সে দ্বিধার সঙ্গে বলল, যার বোধ নেই, যে কোনও সাড়া দেয় না, আমি ঘরের মধ্যে আছি কি না জানেই না, সে কী করে বুঝবে আমার ভালবাসা কম না বেশি…
বসন্তমঞ্জরী বলল, ও মা, তাতে কী হয়েছে? মানুষ দেবতাকে ভালবাসে না? দেবতা কি সব সময় সাড়া দেয়? তবু মানুষ পাথরের মূর্তির পায়ে মাথা ঠোকে, কাঁদে। মানুষ ফুলকে ভালবাসে না? ফুল, গাছপালা, সুন্দরের কত মহিমা, ভালবাসায় বুক টনটন করে, কিন্তু তারা তো কেউ সাড়া দেয় না। ভূমি, আমি জানি, একা একা যে ভালবাসা, অন্য কারুর জন্য, তা অনেক বেশি তীব্র হয়। তা ক্রমশ বাড়তেই থাকে, শরীরটা যেন গলে গলে অদৃশ্য হয়ে যায়, শূন্যতার মধ্যে জেগে থাকে হাহাকার, আমি জানি, আমি নিজের জীবন দিয়ে এটা জানি। তুমি ভালবাসা দিয়ে ওই ঘরটাকে ভরিয়ে রাখো, ধূপের ধোঁয়ার মতন তোমার বুক থেকে ভালবাসা বেরিয়ে এসে ওই মানুষটাকে ঘিরে থাকবে, তা হলে যমদূত ওখানে ঢুকতে সাহস পাবে না। ভালবাসার কাছে মৃত্যুও নির্ঘাত হেরে যাবে।
এরকম কথা শুনলে কান্না রোধ করা সম্ভব নয়। ভূমিসূতা বসন্তমঞ্জরীর কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে থাকে।
রাত্রিবেলা ভূমিসূতা রোগীর ঘরেই মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়। ঘুম তার প্রায় আসেই না। এত বড় বাড়ি একসময় নিঝুম হয়ে আসে, শহরের রাজপথের শব্দও কমে আসে। কচিৎ দু-একটি ঘোড়ার গাড়ি যায় আসে, শোনা যায় লাঠি ঠকঠকিয়ে পাহারাওয়ালার হুঁশিয়ারি। ভূমিসূতা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে ভরতের নিশ্বাসের শব্দ। এমনিতে খুবই মৃদু, প্রায় শোনাই যায় না, মাঝে মাঝে হঠাৎ খুব জোরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। তখনই ভূমিসূতা ভয় পেয়ে যায়। উঠে এসে ভরতের মুখের দিকে চেয়ে দেখে, বুকের ওপর হাত রেখে ওঠা-পড়া ঠিক আছে কি না বুঝে নেয়।
প্রথম রাত্রেই ভূমিসূতার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। এই প্রথম সে একজন পুরুষের সঙ্গে এক কক্ষে রাত্রিবাস করছে। যে-কোনও পুরুষ নয়, তার দয়িত, যার জন্য সে এতকাল তার কুমারীত্ব রক্ষা করেছে। ভরতকে সে কোনওদিন ফিরে পাবে, তা ঠিক আশা করেনি, তবু ভরতের জন্য সে তার শরীর উৎসর্গ করে রেখেছিল। ভরতের সেই চিঠিটির প্রতিটি অক্ষর তার মনে গেঁথে আছে। ভরত লিখেছিল, “তোমাকে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমার সহিত আমি সংযোগ রক্ষা করিব। তোমাকে অপমানের জীবন হইতে মুক্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করিব। কিন্তু এতদিন তাহা পারি নাই। তুমি নিশ্চয়ই স্থির করিয়াছ যে, আমি কাপুরুষের মতন পলায়ন করিয়াছি, তোমাকে বিস্মৃত হইয়াছি। …সত্য এই যে, আমি তোমাকে একদিনের জন্যও বিস্মৃত হই নাই। সর্বক্ষণ তোমার কথা মনে পড়ে। রাত্রে আমার ঘুম আসে না। আমার ঘরের শূন্য দেওয়ালে তোমার মুখচ্ছবি দেখিতে পাই…”। এ চিঠি পাবার আগে থেকেই ভূমিতা স্থির করে রেখেছিল যে, ভরতই তার জীবনস্বামী।
তা হলে এই প্রথম রাত্রিই তো তার বাসররাত্রি। কিন্তু এ কেমন বাসর? ফুল নেই, মালা নেই, চন্দনের সুবাস নেই, এমনকী মনের মানুষটি থেকেও নেই। সে ভূমিসূতার অস্তিত্বের কথাই জানে না। ভূমিসূতা তাকে স্পর্শ করলেও সে টের পায় না।
এ যেন বেহুলা-লখীন্দরের লৌহবাসরের মতন। সেখানে তবু ফুলশয্যার প্রথম প্রহরে লখীন্দর নববধুকে অনেক সোহাগ করেছিল, তারপর ঢলে পড়ে সাপের বিষে। বেহুলা শেষপর্যন্ত স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিল, সে জন্য তাকে ভাসতে হয়েছিল কলার ভেলায়, নাচতে হয়েছিল দেবতার সামনে। ভূমিসূতাও নাচ জানে বটে, কিন্তু এখানে তা কোন কাজে লাগবে?
নাচের কথা মনে পড়লেই ভুমিসূতার মনে একটা আশঙ্কা জাগে। ভরত চেতনাহীন, ভূমিসূতাকে সে ডাক পাঠায়নি। যদি তার চেতনা ফিরে আসে, সে কি উন্মুক্ত মনে ভূমিসূতাকে গ্রহণ করতে পারবে? সে যে থিয়েটারের নটী! ভরত কি শুনতে চাইবে যে, ভূমিসূতা এতকাল স্বেচ্ছাবৈধব্য বরণ করেছিল? সজ্ঞানে আসার পরই যদি সে বলে, কালামুখী, তুই এখানে কেন এসেছিস? ভূমিসূতাকে দেখে খুশি হবার বদলে যদি বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়, তা হলে তো ওর আরও ক্ষতি হতে পারে।
তবু ভূমিসূতা এখান থেকে যেতে চায় না। ভরতকে কাশী পাঠানোর প্রস্তাবও তার মনঃপূত নয়। এক হিসেবে, এই রাত্রিগুলিই ভূমিসূতার সবচেয়ে সুখের সময়। তার মনের মানুষকে সে এখানে অতি আপন করে পেয়েছে। সে ভরতের সর্বাঙ্গ ধুয়ে মুছে দেয়, ইচ্ছে হলে ওর বুকে হাত রাখে। ভরতের অবশ আঙুল চুঁইয়ে দেয় তার মুখে। ভোরের আলো যখন ফোটে, জানলা দিয়ে রক্তিম রশ্মি এসে পড়ে ভরতের মুখে, ভূমিসূতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই মুখের দিকে। এই তো তার পরম পাওয়া।
এক একদিন সন্ধের পর থেকেই ভরতের জ্বর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভূমিসূতা তার কপালে জলপটি দেয়। কপালের উত্তাপে সেই জল শুকিয়ে গেলে আবার কাপড়ের ফালিটা ভিজিয়ে নিতে হয়। সেইরকম জ্বরের সময় ভরত বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুরু করে। ভূমিসূতা ব্যাকুলভাবে সেই কথাগুলি শোনার চেষ্টা করে, ভরতের মুখের কাছে কান নিয়ে যায়, তবু বোঝা যায় না প্রায় কিছুই, একটা নাম শুধু চেনা যায়, হেম, যেন ওই নামের লোকটিকে সে কিছু জানাবার চেষ্টা করছে।
ভূমিসূতার সমস্ত অন্তরাত্মা তৃষিত হয়ে থাকে ভরতের মুখে অন্তত একবার তার নামটি শোনার জন্য। শোনা যায় না। ভরতের মনের গহনে কি ভূমিসূতা কোথাও নেই আর?
হেম নামের লোকটিকে ভূমিসূতা চেনে। দ্বারিকা যুগান্তর পত্রিকা অফিসে ভরতের বন্ধুদের খবর দিয়েছিল। বারীন, হেমচন্দ্র, প্রফুল্ল, নরেন, উপেনরা এসে ভরতকে দেখে গেছে। হেম একা এসেছে কয়েকবার। সকালের দিকে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।
ভরতের মুখ থেকে এরকম অসংবদ্ধ প্রলাপ তিন দিন মাত্র শোনা গেছে। অন্যান্য দিন সে কোনও শব্দই করে না। যেন যোগনিদ্রায় মগ্ন। মুখের একটা রেখাও কুঞ্চিত নয়, যেন তার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, ব্যথা বোধ নেই, মানুষের সংসারে কোনও কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। হয়তো এই নিদ্রার মধ্যেই সে একসময় মহানিদ্রায় চলে যাবে। ভূমিসুতা কিছুতেই বুঝতে পারে না, আর কতখানি ভালবাসা দিলে ভরত মৃত্যুঞ্জয় হতে পারবে, কী করে দিতে হয় সেই ভালবাসা? সে রাত্রির ঘুম বিসর্জন দিয়েছে, সারারাত ঘরের কোণে একটি প্রদীপ জ্বলে, সেই ক্ষীণ আলোতে সে বই পড়ার চেষ্টা করে, কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সে উঠে এসে ভরতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ফিসফিস করে বলে, চলে যেয়ো না, চলে যেয়ো না।
ভূমিসূতা আসার একাদশতম রাতে ভরত একবার পাশ ফিরে বলল, উফ! মাগো!
তারপর দুবার বলল, জল, জল!
ভূমিসূতার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। এ যে পরিষ্কার কণ্ঠস্বর! এ পর্যন্ত সে একবারও জল চায়নি। তবে কি জ্ঞান ফিরে আসছে?
প্রচণ্ড আনন্দ হল বটে। তবু ভূমিসুতা ভাবল, সে কি নিজে জল দেবে, না অন্য কারুকে ডাকবে? চোখ মেলে প্রথম ভূমিসূতাকে দেখার বদলে অন্য কারুর যাওয়াই বোধহয় ঠিক। বসন্তমঞ্জরীদের কাছে খবর পাঠাবে? কিন্তু এখন রাত দুটো-তিনটের কম নয়। এই সময় ডাকাডাকি করাটা কি উচিত হবে! দাস-দাসীরা কয়েকজন নীচের তলায় শোয়–
এর পরেই তার মনে হল, এ কী করছে সে? মানুষটা জল চাইছে, সে জল দেবে না? এই যদি তার শেষ জল চাওয়া হয়?
সে ধড়ফড় করে ছুটে গিয়ে গেলাসে জল নিয়ে এল। চোখ মেলেনি ভরত, তবে তার মুখের কাছে জলের গেলাসটি ধরতেই সে অনেকখানি জল পান করল, তারপর পাশ ফিরল অন্য দিকে।
তাতেও ভয় কাটল না ভূমিসূতার। প্রদীপ নিবে যাবার আগে দপ করে একবার জ্বলে ওঠে। মানুষের জীবনেও এরকম হয়, ভূমিসূতা জানে। সে ভরতের শয্যার পাশে বসে তার নিশ্বাসের শব্দ গণনা করতে লাগল।
ভোরের দিকে আর একটু বেশি জ্ঞান ফিরল ভরতের। সে আবার জল চাইল। এবার জল পান করতে করতে চোখ মেলে বলল, তুমি কে?
আবেগকম্পিত কণ্ঠে ভূমিসুতা বলল, আমি ভূমি…আপনি আমায় চিনতে পারছেন না?
ভরত বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, তুমি ভূমি? কত দূর থেকে এসেছ, তোমার খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?
ভূমিসতা বলল, কই, না, দুর থেকে আসিনি তো!
ভরত মাথাটা একটু ঘুরিয়ে ঘরের ছাদটা দেখে জিজ্ঞেস করল, এটা কোন জায়গা?
ভূমিসূতা বলল, এটা কলকাতা। আপনার বন্ধুর বাড়ি।
ভরত বলল, কলকাতা? আমি কি তা হলে কোথাও যাইনি? যাইনি? যাইনি?
ক্রমে জড়িয়ে এল তার স্বর, সে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
এবারে সত্যিকারের আনন্দের স্রোত বয়ে গেল ভূমিসূতার শরীরে। ভরত সুস্থতার দিকে ফিরেই আসছে, তাকে দেখে রাগ করেনি। জল খাওয়ার সময় তার আঙুলের সঙ্গে ভরতের আঙুলের ছোঁয়া লেগেছে।
একটু পরে আবার অন্য রকম হল। ভরত জেগে গিয়ে বলল, উফ এত গরম!
ভূমিসূতা পাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে দেখল, ভরতের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। সে ভূমিসূতার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
ভূমিসূতা বলল, আমি ভূমি।
ভরত বলল, তুমি বুঝি এই কালীমন্দিরে থাকো?
আগের তুলনায় ভরতের কণ্ঠস্বর আবার নিস্তেজ, চোখ মেলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। একটা হাত উঁচু করতে চাইলেও পেশির শক্তি নেই, আবার পড়ে যাচ্ছে ধপ করে।
ভরত ভূমিসূতার চোখে চোখ রেখে বলল, কপাল…কুণ্ডলা। আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি। পড়ে গেল! ও কি আমায় আবার মারবে? আর আমি পারব না, এবারই শেষ! কেউ জানে না। আমি রাস্তা চিনি না…
এও এক ধরনের প্রলাপ, কিন্তু কথাগুলি বোঝা যায়। ভূমিসূতা ভরতের একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরল। সে প্রদীপ নিবতে দেবে না। কিছুতেই না। বসন্তমঞ্জরী বলেছিল, ভালবাসা ধূপের ধোঁয়ার মতন বুক থেকে বেরিয়ে আসবে, সত্যি তা হয়? অন্তর্যামী জানেন, ভূমিসূতা নিজের সবটুকু আয়ু দিয়েও এই মানুষটিকে বাঁচিয়ে তুলতে চায়।
জানলা দিয়ে সমান্তরাল রেখার মতন সূর্যের আলো এসে পড়েছে ঘরে। জেগে উঠছে শহরের জীবন। শোনা যাচ্ছে ফেরিওয়ালাদের ডাক। একটি কিশোর প্রতিদিন সকলের চেয়ে আগে ননী-মাখন বিক্রি করতে আসে, সে খটখট করে কড়া নাড়ছে দরজার। এ বাড়ির দাস-দাসীরাও সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা শুরু করেছে।
ভরতের শয্যার পাশে পাষাণমূর্তির মতন স্থির হয়ে বসে আছে ভূমিসূতা, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা। মাথার চুল খোলা, পরপর রাত্রি জাগরণে চক্ষু দুটি কোটরগত, মনে হয় যেন অনন্তকাল সে সেখানেই বসে থাকবে।
দ্বারিকা যখন খোঁজ নিতে এল, তখনও ভরত কথা বলে যাচ্ছে আপন মনে। তার স্থানকালের বোধ নেই, কথার মাঝে মাঝে সে কেঁপে উঠছে, যেন ঝাঁকুনি লাগছে সারা শরীরে। দ্বারিকা তার নাম ধরে ডাকাডাকি করল কয়েকবার, তাতে কোনও সাড়া পেল না, তবু দ্বারিকা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তখুনি খবর পাঠানো হল ডাক্তারদের। নিশিকান্ত মজুমদারও রোগীর এই অবস্থান্তর দেখে খুশি, জ্বর ছেড়ে গেছে, এটাই প্রবল আশার কথা। পেটের ক্ষতস্থানটি পরীক্ষা করে তিনি নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন, বসে রইলেন অনেকক্ষণ, নিজে একসময় কয়েক চামচ ফেনাভাত খাওয়াবার চেষ্টা করলেন ভরতকে। আজ আর বমি হল না।
সারা দিন আধো-তন্দ্রার মধ্যেই রয়ে গেল ভরত। সন্ধের পর তার আবার জ্বর এল বটে, খুব বেশি নয়, তার মধ্যেও তার স্বগতোক্তির বিরাম নেই। সেই অবচেতনের ভাষা অন্য কেউ বুঝবে না। যেন সে কোনও অচেনা জটিল অরণ্যে একা একা ভ্রাম্যমাণ।
ভূমিসূতাকে সে চিনতে না পারলেও তার পাশে যে একজন নারী সর্বক্ষণ বসে আছে, এই বোধ তার আছে। এই নারী তাকে জল পান করাচ্ছে, উষ্ণ কপাল মুছে দিচ্ছে, সুতরাং এর দ্বারা কোনও বিপদ ঘটবে না। এটা মানুষের শরীর ঠিক অনুভূতি দিয়ে বোঝে। এর একটা সুফল হল এই যে, পরের রাত্রে ভরত যখন স্ববশে এল, বুঝতে পারল যে, সে শুয়ে আছে একটা পালঙ্কে, ভাঙা মন্দিরে নয়, বাইরে শহরের কলরোল এবং পাশের সেবাপরায়ণা নারীটি ভূমিসূতা, অর্থাৎ আকস্মিকতার আঘাত তাকে সইতে হল না, ভূমিসূতা সম্পর্কে তার যে অপরাধবোধের আড়ষ্টতা ছিল তাও মনের উপরিতলে এল না, ভয়ার্ত শিশু, যেমন মাকে আঁকড়ে ধরে, সেইভাবে সে নিজেই তখন ভূমিসূতার আঁচল চেপে ধরল এবং সজ্ঞানে প্রথম কথাটিই বলল, ভূমি, আমাকে বাঁচাও!
ভূমিসূতার শুষ্ক চোখ জলে ভরে গেল। এই প্রথম খুব দুর্বল বোধ করল সে।
শুধু তাই নয়, কিছুক্ষণ পরে এক ধরনের অদ্ভুত লজ্জাও পেয়ে বসল তাকে। এতদিন ভরত ছিল প্রায় জড়ের মতন, এখন সে একজন চেতনাসম্পন্ন পুরুষ, হাত-পা নাড়তে পারে, স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। এখন তো ভূমিসূতার পক্ষে আর ভরতের সঙ্গে এক ঘরে থাকা উচিত নয়। লোকে বলবে কী? তার সঙ্গে ভরতের তো কোনও সামাজিক সম্পর্ক নেই। প্রথম দিন এসে সে মনে করেছিল, এটা তার বাসরঘর। এখন তার পরিচয়, সে একজন সেবিকা মাত্র।
একটু পরে ভরত আবার ঘুমিয়ে পড়তেই ভূমিসূতা ওপরে চলে এল বসন্তমঞ্জরীর কাছে।
বসন্তমঞ্জরী তার ও কথাটা শুনে হেসে একেবারে লুটিপুটি খায় আর কি। হাসি আর থামেই না। তারপর বলল, ওমা, তাই তো, তাই তো। ঠিকই বলেছ। তোমরা বর বউ নও, তা হলে কী করে এক ঘরে শোবে? মানুষটা উঠে বসতে পারে?
ভূমিসূতা বলল, এখনও পারে না। কিন্তু তোক চিনেছে। কথা বলতে পারছে।
বসন্তমঞ্জরী বলল, তা হলে এক কাজ করো। দুটো গোরের মালা আনিয়ে দিই, আজ রাতে তোমরা মালা বদল করে নাও। ব্যস! গন্ধর্ব মতে হয়ে যাবে। যেমন দুষ্মন্ত আর শকুন্তলা!
লজ্জায় কর্ণমূল আরক্ত হয়ে গেল ভূমিসূতার। সে বলল, যাঃ, তা হয় না। আমি নিজে থেকে…
থুতনিতে আঙুল দিয়ে কৃত্রিম চিন্তার ভঙ্গি করে বসন্তমঞ্জরী বলল, তাও তো বটে! মেয়েদের তো মুখ ফুটে বলতে নেই। পুরুষরাই আগে বলে, সেটাই নিয়ম। পুরুষরা বলবে, মেয়েরা মেনে নেবে। মানুষটার রোগব্যাধি এখনও সারেনি, এখন কি আর ওই কথা মনে পড়বে? আচ্ছা, মনে করো, তুমি মানুষ নও, তুমি অপ্সরা। আকাশ থেকে নেমে এসেছ। অপ্সরারা নিজের মুখে বলতে পারে, তাতে কোনও দোষ হয় না।
ভূমিসূতা প্রবল বেগে মাথা নাড়ল।
বসন্তমঞ্জরী বলল, তা হলে আমার কর্তাকে ঘটকালি করতে বলতে হয়। সেটা উনি ভাল পারবেন। গাঁইগুঁই করলে ঘাড় ধরে জোর করে বিয়ে দেবেন। খুব ঘটা করবেন। তাতে আবার সময় লেগে যাবে। আচ্ছা, ও কথা এখন থাক। ভূমি, তুমি কখনও কাশী গেছ?
ভূমিসূতা বলল, কাশী? না তো! আমি আর কোথায় গেলাম! সেই ছোট বয়েসে পুরী থেকে এসেছি কলকাতায়, তারপর আর কোথাও যাইনি।
বসন্তমঞ্জরী বলল, আজ বিকেলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। তখনই তোমাকে ডেকে বলব ভেবেছিলাম। বারান্দায় বসে আছি, উনি বাড়িতে নেই, একলা, রাস্তা দেখছি, কত মানুষ, গাড়ি যাচ্ছে, ঘোড়া যাচ্ছে, বরফওয়ালা, একটা খোঁড়া ভিখিরি, দুজন পাদ্রি সাহেব, ঝাঁকা মুটে, এই সব দেখছি, হঠাৎ সব মিলিয়ে গেল! রাস্তা নেই, দেখছি একটা নদী। ঢেউ ছলাত ছলাত করছে। সেই নদীর ঘাট দিয়ে ধাপে ধাপে অনেক সিঁড়ি উঠে গেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, ওমা, এ তো খুব চেনা জায়গা। কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাট। ওখানে আমরা এক সময় থেকেছি, ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করে সূর্যপ্রণাম করেছি।
ভূমিসূতা বলল, তোমার সেই কথা মনে পড়ে গেল?
বসমঞ্জরী বলল, না, না, সে জন্য নয়। অমন তো মানুষের মনে পড়েই। আর দেখলাম, সেই ঘাটের সিঁড়িতে তুমি বসে আছ। তোমার খোঁপায় একগোছ সাদা ফুল। তুমি বেনারসে কখনও যাওনি বললে, অথচ তোমায় আমি ওখানে বসে থাকতে দেখলাম কেন?
ভূমিসূতা চুপ করে চেয়ে রইল।
বসন্তমঞ্জরী বলল, কবিরাজমশাই ভরত সিংহকে বেনারস পাঠাতে বলেছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, তা মোটেই উচিত নয়। কিন্তু আমি ওরকম দেখলাম। অবশ্য এটা আমার একটা স্বপ্ন। আমি এরকম কত স্বপ্নই যে দেখি!
ভূমিসূতা বলল, তুমি কী করে এমন স্বপ্ন দেখো? আমায় শিখিয়ে দেবে?
বসন্তমঞ্জরী হেসে বলল, এসব না দেখাই ভাল। অনেকে তো এ জন্য আমাকে পাগল বলে! আমি নিজের এসব পাগলামি নিয়ে বেশ আছি!
ভূমিসূতা বলল, সত্যিই তুমি বেশ আছ। তোমাকে হিংসে হয়। আচ্ছা বোন, আজ রাতে তা হলে আমি তোমার কাছে থাকি?
এবার বসন্তমঞ্জরী রেগে উঠল। চোখ পাকিয়ে বলল, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। উনি একা থাকবেন? রাত্তিরবেলা জেগে উঠে তোমাকে দেখতে না পেলে কী রকম অসহায় বোধ করবেন। বলো তো? যদি আবার রোগ বাড়ে? মানুষটা এখনও উঠে বসতে পারে না। নিজে নিজে কিছু খেতে পারে না, সেই মানুষের ঘরে থাকলে দোষ হয়?
ভূমিসূতা তবু বলল, সত্যি দোষ হয় না?
বসন্তমঞ্জরী বলল, সে কথা পরে। আগে তুমি বলো, তোমার মন চায় কি চায় না?
এর পরে আর কথা নেই। ভূমিসূতা নীচে নেমে এল। ভরতের ঘরের মেঝেতে তার বিছানা পাতা। অন্য দিন জেগে বসে থাকে, আজ তার ঘুমে চোখ টেনে আসছে। ভূমিসূতা মনে মনে বলছে, ঘুমোব না, ঘুমোব না, ঘুমোলেই কোনও বিপদ হতে পারে। তবু একসময় বুঝি তার ঝিমুনি এসেছিল, ভরতের ডাক শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে এল। ভরত তিনবার তার নাম ধরে ডেকেছে।
ভূমিসূতা কাছে এসে দাঁড়াতেই সে শান্তভাবে বলল, আমি এবার বেঁচে গেলাম, তাই না? যদি বেঁচেই উঠব, তা হলে মৃত্যু বারবার আমাকে টানে কেন বলতে পারো?
ভূমিসূতা বলল, এখন ওসব ভাববেন না। একটু জল দেব?
ভরত বলল, এবার মনে হচ্ছিল, আমি একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যাচ্ছি তো যাচ্ছি, টের পাচ্ছিলাম যেন এটাই মানুষের জীবনের শেষ যাত্রাপথ, অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে, তারপর এক সময় সেই অন্ধকারে মানুষ মিলিয়ে যায়, তারপর আর কিছু নেই। কিন্তু শেষ তো হল না, প্রথম চোখ মেলে দেখতে পেলাম তোমাকে। তুমি যেন সেই সুড়ঙ্গ থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে এলে!
ভূমিসূতা ব্যাকুলভাবে বলল, এসব কথা এখন থাক। আপনার বিশ্রাম দরকার।
ভরত বলল, এই মাত্র আমার ঘুম ভাঙল একটা ভয়ের কথা মনে পড়ল বলে। আমার জীবন অভিশপ্ত। মৃত্যু আমাকে যখন-তখন টানে। আমি কোনওক্রমে বেঁচে যাই বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে যাদের জীবন জড়িয়ে থাকে..আমার মা…আর একজন, তোমার সঙ্গে তার মুখের মিল ছিল..এরপর, তোমারও যদি কোনও বিপদ হয়?
ভূমিসূতা বলল, আমার সহজে মরণ নেই, আমি জানি!
ভরত খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলল, পুরীর মন্দিরের বাইরে আমি ভিখারিদের সঙ্গে শুয়ে থাকতাম। ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো কোনও না কোনওদিন মন্দিরে পূজা দিতে আসবে, তখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে। তুমি একদিনও আসনি! তুমি তখন কোথায় ছিলে?
ভূমিসূতা বলল, সেসব কথা পরে বলব। আজ নয়।
ভরত বলল, আমরা কি আর সময় পাব?
ভূমিসূতা তার কোমল হাত দিয়ে ভরতের চোখ বন্ধ করে দিয়ে বলল, এখন আর কোনও কথা নয়।
ভরত অনাদিকে ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পরদিন সকালে এল হেম। ভরত এর মধ্যে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে। এই প্রথম চা খাচ্ছে।
হেম বলল, এই তো একেবারে ফিট দেখছি! সেরে উঠেছ! একটা নাপিত ডেকে দাড়ি কামিয়ে ফেল। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশি রুণ দেখায়। যুগান্তরের আখড়ায় সবাই তোমার কথা বলাবলি করে। চলো, যাবে নাকি?
ভরত দুর্বলভাবে হেসে বলল, আজই কি পারব?
হেম বলল, আজ না হয় কাল। বেশিদিন বিছানায় শুয়ে থাকা ঠিক নয়। দ্বারিকাবাবুকে সবাই ধন্য ধন্য করছে। উনিই তোমাকে বাঁচালেন। আমরা দ্বারিকাবাবুকেও দলে নিয়ে নেব ঠিক করেছি।
ভরত জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা হেম, সে রাতে আর কারুর কিছু হয়নি?
হেম বলল, কোথায়, সেই রংপুরে? না, আমরা সবাই মিরাকুলাসলি এসকেপ করতে পেরেছিলাম। তোমায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাইনি। আর একটা ডাকাতের দল এসে এমন গণ্ডগোল পাকিয়ে দিল। আমি সারারাত একটা গাছে উঠে বসেছিলাম, আমায় কেউ দেখতে পায়নি।
ভরত বলল, শুধু আমারই কেন এমন হয়? লোকটা যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল আমার সামনে, হাতে একটা বর্শা। শুধু আমাকে মারবার জন্যই যেন ওকে কেউ পাঠিয়েছিল।
হেম বলল, ওসব আর ভেবে লাভ নেই। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমাদের কাজ তো শেষ হয়নি। আবার শুরু করতে হবে।
ভরত অস্ফুট স্বরে বলল, ফুলার?
হেম এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে নিল। কাছাকাছি কারুকে দেখতে না পেয়ে মাথাটা ঝুঁকিয়ে এনে বলল, সেই শূকর সন্তানটা এখনও বেঁচে আছে। আমাদেরও বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে বলতে পারো। রংপুরে তো কিছুই হল না। আমরা তোমায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে ধরে নিলাম, তুমি কলকাতায় ফিরে গেছ। কারণ পুলিশের হাতেও তুমি ধরা পড়নি। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল, ব্যামফিল্ড ফুলার ট্রেনের বদলে ব্ৰহ্মকুণ্ড স্টিমারে চেপে গোয়ালন্দ যাচ্ছে, সেখানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
ভরত বলল, সংবর্ধনা?
হেম বলল, সেই তো মজা! আমরা যাকে বাঙালির এক নম্বর শত্রু ভেবে নিধন করতে চাইছি, তাকেই আবার বাঙালিরা সংবর্ধনা জানাতে চায়। অবশ্য বঙ্গভঙ্গের জন্য যারা খুশি, সেই পূর্ববঙ্গের এক শ্রেণীর বাঙালি! আমরা ঠিক করলাম, ওখানেই অ্যাকশান নিতে যাব। এবারে আর বারীন গেল না, আমাকে আর প্রফুল্ল চাকীকে পাঠাল। ও হরি, গোয়ালন্দে গিয়ে দেখি সেখানে জল থইথই করছে। কদিন আগে বন্যা হয়েছে, গোয়ালন্দ স্টেশনেও এক কোমর জল। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাতিল, লাটসাহেব স্পেশাল ট্রেনে ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়।
ভরতের ওষ্ঠে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল।
হেম চওড়াভাবে হেসে বলল, হাসিরই ব্যাপার বটে। এ যেন বাচ্চাদের চোর-পুলিশ খেলাকেও হার মানায়। আমরা যেখানেই যাই পাখি ফুড়ৎ! তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আমাদের প্ল্যান জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। তা হলে তো পুলিশ আমাদের শ্রীঘরে পুরে দিত আগেই। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি, ফুলারের নিয়তিই যেন তাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। গোয়ালন্দে বসেই আমরা মরিয়া হয়ে ঠিক করলাম, শিয়ালদা স্টেশনেই আমরা ফুলারের ওপর অ্যাটেম্পট করব। আমরা ধরা পড়ি, মরি, যা হয় তোক। প্রফুল্লর খুব উৎসাহ। আমি তোমার অভাবটা খুব ফিল করছিলাম। যাই হোক, ট্রেনে চেপে আমরা নৈহাটি স্টেশনে এসে দেখি, সেখানে পুলিশে পুলিশে একেবারে ছয়লাপ। যেদিকে তাকাও শুধু লাল পাগড়ি। চতুর্দিকে প্রচুর আলো। কী ব্যাপার? শোনা গেল, ফুলারসাহেব ওই স্টেশনে বসে আছে, সেখানে ইঞ্জিন পালটানো হবে না কী যেন হবে। পুলিশ সব লোকের বডি সার্চ না করে স্টেশনে যেতে দিচ্ছে না। বাচ্চা ছেলেরাও বাদ নয়। আমরা দুজনে কামরার উলটোদিকের দরজা দিয়ে নেমে পড়ে হাঁটতে লাগলাম লাইন ধরে। খানিক দূরে গিয়ে অন্ধকার মাঠের মধ্যে বসে রইলাম। ট্রেন তো এই দিক দিয়ে যাবেই। প্রথমে বেশি স্পিড থাকে না। লাটসাহেবের কামরা দেখে লাফিয়ে উঠতে পারব। তারপর দুজনে গুলি চালাব সঙ্গে সঙ্গে যাতে মিস না হয়! দুজনে বসে একটার পর একটা সিগারেট টানতে লাগলাম। আমার এ কথাও মনে হচ্ছিল, এভাবে অ্যাকশান নিলে আমাদের পালাবার কোনও পথ থাকবে না, লাটসাহেবের বডিগার্ডরাও গুলি চালিয়ে আমাদের ছুঁড়ে ফেলবে, তাই যদি হয়, তা হলে সিগারেটের প্যাকেটটা আর রেখে লাভ কী, শেষ করাই ভাল! প্রায় ঘণ্টাখানেক বসে আছি, কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপর একসময় ট্রেনের শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজনে ফুল অ্যালার্ট। ও হরি, সেটা ট্রেন নয়, শুধু ইঞ্জিন। তাও ঘ্যাস ঘ্যাস করে খানিকটা এসে থেমে গেল, আবার পিছোতে লাগল। ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা গুটিগুটি এগোলাম স্টেশনের দিকে। গিয়ে দেখি, একটাও পুলিশ নেই। আলো নেই, সব ভোঁ ভাঁ। যেন ভানুমতীর খেলের মতন সব কিছু মিলিয়ে গেছে। একজন টিকিটবাবুকে ধরে জানলাম, লাটসাহেব হুগলির পুল পেরিয়ে চলে গেছে গঙ্গার ওপারে। সেখান থেকে ই আই রেলওয়ে ধরে সোজা চলে যাচ্ছেন বোম্বাই। তারপর জাহাজ ধরে একেবারে বিলেত। এ দেশে আর ফিরবেনই না!
ভরত হতবুদ্ধির মতন জিজ্ঞেস করল, তার মানে কী…উনি ভয় পেয়ে পালালেন?
হেম বলল, পাগল নাকি? মহাশক্তিমান ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধি ভয় পাবে আমাদের মতন কয়েকটা ল্যাকপেকে বাঙালিকে? ব্যাপারটা তা নয়। একটা খবর আমরা জানতেই পারিনি, ব্যামফিল্ড ফুলার এর মধ্যে পদত্যাগ করেছে। কেন্দ্রের সঙ্গে কী একটা ব্যাপারে খিটিমিটি বেঁধেছিল, কার্জন সাহেবের মতন ফুলারও পদত্যাগ করে দেশে ফিরে গেল। আমাদের প্রথম বিপ্লব প্রয়াসেরও এখানেই ইতি। ।
ভরত বলল, ফুলারের বদলে অন্য ফুলার আসবে।
হেম বলল, তা ঠিক।
অন্দরমহল থেকে হেমের জন্য চা ও জলখাবার এল। দ্বারিকা অনেক বেলা পর্যন্ত নিদ্রাসুখ উপভোগ করে। এগারোটার আগে নীচে নামে না। ভূমিসূতা সংলগ্ন কক্ষটিতে নিঃশব্দে বসে আছে, হেম তার উপস্থিতি টের পায়নি।
খানিকক্ষণ বিশ্রম্ভালাপের পর হেম বলল, আমি কয়েক দিনের জন্য মেদিনীপুরে যাব, তুমিও আসবে নাকি আমার সঙ্গে?
ভরত একটু ইতস্তত করে বলল, এখনও বিছানা থেকে নামতে পারি না। একটু নড়াচড়া করলেই পেটের ক্ষতটায় ব্যথা শুরু হয়। কবে হাঁটতে পারব জানি না।
হেম বলল, ঠিক আছে, আরও কয়েকটা দিন বিশ্রাম নাও। আমি ঘুরে আসি। মেদিনীপুরে বসে প্ল্যান করব। এরকম ছেলেখেলা আর নয়, এরপর আটঘাট বেঁধে কাজে নামতে হবে। তখন তোমাকে সঙ্গে পাব তো? তোমাকে ডাকলে তুমি আসবে?
ভরত পাশের ঘরের দিকে চকিতে একবার তাকাল। দরজার একটি পাল্লা খোলা। একটা জলচৌকির ওপর বসে থাকা ভূমিসূতাকে সে দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু বিপরীত দিকের চেয়ারে হেমের দৃষ্টিপথে সে আসে না।
হেম বলল, বন্ধু, আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংসারসুখ আমাদের জন্য নয়। আমার তো বাড়িতে থাকতেই ভাল লাগে না। বঙ্গভঙ্গের প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়ব না। আমরা তো প্রাণ দিতে রাজিই আছি। কিন্তু তার আগে একটা কিছু বড় কাজ করে যেতে হবে, যাতে ইংরেজ-শক্তি কেঁপে ওঠে।
ভরত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বন্ধু, তুমি যখনই ডাকবে, আমি তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াব।