॥ ৮৪ ॥
চৈতন ধ্রুবকে লক্ষ করছিল। খুব নিবিষ্ট চোখে এবং অখণ্ড মনোযোগে। এতকাল করেনি। দরকারও হয়নি। আর পাঁচজন মোদো মাতাল ইয়ারবাজের মতোই একজন ছিল ধ্রুব। তফাৎ শুধু, ও মিনিস্টারের ছেলে। এখন আর ধ্রুবর বাবা মিনিস্টার নয় বটে, কিন্তু কিছু কমও যায় না।
সে যাই হোক, ধ্রুবকে মিনিস্টারের ছেলে বলে কোনোদিন খাতির দেখায়নি চৈতন। ধ্রুবর বন্ধুরা সবাই জানে বাপের সঙ্গে ধ্রুবর বনিবনা নেই। তবু ধ্রুবকে সবাই খাতির করে। কিছু তো বলা যায় না, শত হোক মিনিস্টারের ছেলে তো। উপকার না করুক ফাঁসিয়ে দিতে পারে। সকলেই জানে ধ্রুবর পিছনে সর্বদা ছায়ার মতো গার্ড থাকে। পুলিশের লোক অবধি নজর রাখে। কাজেই ধ্রুবকে খাতির না করে উপায় নেই। কিন্তু চৈতন কোনোকালে ধ্রুবকে তার বাপের ছেলে হিসেবে দেখেনি। আলাদা বা বিশিষ্ট কেউ বলেও মনে করেনি। কিন্তু আজকাল একটু কেমন যেন লাগছে ওকে।
মল্লিকপুরের এই বাগানবাড়িখানা শীতের দুপুরে রমরম করছে। বিস্তর পাখি ডাকছে গাছে গাছে। মাংসের গন্ধে মাত হয়ে আছে বাতাস। গাছতলায় শতরঞ্জি পেতে জনা দশেক ইয়ারদোস্ত তিনপাত্তি খেলছে, পাশে বোতল, গেলাস, গরম মাছভাজা আর ফুলুরি। জনা চারেক এমনি এমনি গ্যাঁজাচ্ছে বসে বসে। তাদের মধ্যে দুটো গেঁজেল আছে। দুই গেঁজেল গাঁজাভরা সিগারেট অন্যদের গছিয়ে দলে টানার চেষ্টা করছে। যেমনটা হয় আর কি। দু তিনজন বেরিয়েছে ইদিক সিদিক একটু ঘুরে আসতে।
লরি ভর্তি এই যারা এসেছে, অর্থাৎ তারা যে খুব সুবিধের লোক নয় তা চৈতনের চেয়ে ভাল আর কে জানে? এদের মধ্যে তাসের আড্ডায় কলকাতার এক সেরা খুনে এবং পয়লা নম্বরের গুণ্ডা আছে। আছে অন্তত তিনজন স্মাগলার, মেজো বা সেজো গুণ্ডা, মাতাল, মেয়েমানুষের কারবারী। এরা সব চৈতনের বন্ধু। ধ্রুবরও। কিন্তু ধ্রুব আজ মিশ খাচ্ছে না।
চৈতন একটা বোতল নিয়ে নিরিবিলি দেখে একটা পেয়ারা গাছের ছায়ায় এসে বসেছে। তিনপাত্তির উত্তেজনা তার আজকাল সহ্য হয় না। হার্ট খারাপ। গ্যাঁজাতেও তার ভাল লাগে না। খামোখা মুখের ফেকো তোলা, কাউকেই তো নতুন কিছু বলার নেই, কারো কাছ থেকেই নতুন করে কিছু শোনারও নেই। চৈতন তাই গাছতলায় বসে আছে। কিন্তু শুধু শুধু বসে নেই। সে ধ্রুবকে দেখছে। ঠিক তার মতোই ধ্রুবও একটু আলগা হয়ে বসে আছে সিঁড়িতে। পিছনের সিঁড়িতে কনুই রেখে, সামনে দু’ পা ছড়িয়ে। তার পাশে যে ছোকরাটা বসে আছে সে জ্যোতিষী। নাম পানু। তারাপীঠে যাতায়াত আছে। এক সময়ে হাওড়ার দানুবাবুর সাকরেদ ছিল। সিনেমা করতে গিয়েছিল একসময়ে। যাত্রার দল খুলেছিল। সব ছেড়েছুড়ে এখন হোলটাইম জ্যোতিষী। এ দলে সবাই যে সকলের বন্ধু তা নয়। কেউ হয়তো তার বাইরের বন্ধুকে ধরে এনেছে। অচেনা, আধচেনা বেশ কয়েকজন আছে। পানু এই আধচেনাদের দলে।
পানু এতক্ষণ ধ্রুবর হাত দেখছিল। কী ফোরকাস্ট করল কে জানে। চৈতন দেখল, একটু বাদে ধ্রুব ভারী বিরক্ত হয়ে হাতটা টেনে নিল। তারপর উদাস হয়ে বসে আছে ওই। পানু হাতের গেলাসে চুমুক মারতে মারতে ধূর্ত চোখে চারদিক নজর করছে। ধ্রুবর হাতে গেলাস নেই, চোখের দৃষ্টি বহু দূরে।
চৈতন বিড়বিড় করে বলল, মরবে শালা, এবার মরবে। মরার আগে মুর্গীদের যেমন ঝিমুনি রোগ ধরে এই শালাকেও তেমনি ধরেছে।
তিনটে মেয়েছেলে এসেছে দলের সঙ্গে। তিনজনই ভাড়াটে। হাফ-গেরস্ত। বয়স কুড়ি-বাইশের মধ্যে। খুব ছলবলে, খুব স্মার্ট। কেউ দেখলে বুঝবে না যে হাফ-গেরস্ত। মনে হবে বালিগঞ্জের বড়লোক বাড়ির মেয়ে। সারাদিন সঙ্গ দেবে, ঢলাঢলি করবে, একটু-আধটু ছোঁয়াছুঁয়ি চলতে পারে, তবে তার বেশী কিছু নয়। সতী টাইপের আর কি।
সেই মেয়ে তিনজন এখনো ফিল্ডে নামেনি। সাজগোজ করছে। তারা ফিল্ডে নামলে হুল্লোড়বাজি লেগে যাবে। মেয়েমানুষ যেখানে নামে সেখানকারই হিউম্যান প্যাটার্ন পালটে যায়। কিন্তু চৈতন জানে ওই তিনটি ফুটফুটে মেয়ে ধ্রুবকে একটুও টলাতে পারবে না। লরিতে ধ্রুব ওই তিনটি মেয়ের সঙ্গে ড্রাইভারের কেবিনে বসে ছিল। চৈতন পিছনের ফুটোটা দিয়ে কয়েকবারই উঁকি মেরে দেখেছে, ধ্রুব মুখ খাট্টা করে বসা, মেয়ে তিনজন সিঁটিয়ে বসে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
চৈতন উঠে গিয়ে শালপাতায় গোটাকয় মাছভাজা নিয়ে এল রান্নার জায়গা থেকে। আবার পেয়ারা গাছের তলায় বসে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল, ইমপোটেন্ট শালা। ব্রহ্মচারী হয়েছে ব্যাটা। মরবি, মরবি। এই বলে রাখছি এসব ভাল লক্ষণ নয়।
একটা মেয়ে ফিল্ডে নামছে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে। কালো শাড়ি, কালো ব্লাউজ, ম্যাচিং টিপ। দারুণ দেখাচ্ছে। চৈতন হাঁ হয়ে দেখল। লরিতে আসতে ঘামটাম হয়েছিল, হাওয়ায় চুল হয়েছিল বেগোছ। এখন সব সেরেসুরে নতুন মেকআপ নিয়ে আসায় খোলটাই পাল্টে গেছে একেবারে। ছিপছিপে শরীরটা দেখলে বোঝা যায়, এরা বেশ তৈরি করে নিজেদের।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মেয়েটা ধ্রুবর কাছে একটু থামল। কী একটু বলল। ধ্রুব শালা তাকালও না, শুধু হাত নেড়ে খুব অবহেলার সঙ্গে কি একটা জবাব দিল। মুখ চূণ হয়ে গেল মেয়েটার।
তবে পুষিয়ে গেল। তিনপাত্তির আড্ডা থেকে একটা হাল্লা উঠল জোর, এসে গেছে। এসে গেছে! কমলি এসে গেছে!
দুদ্দাড় উঠে ছুটে গেল কয়েকজন। একটা টেপ রেকর্ডার চালু হল। ঝিনচাক হিন্দি গান ঝলসাতে লাগল বাতাসে।
পর পর আরও দুটো মেয়ে ফিল্ডে নামছে। একজনের কমলা, অন্যজনের সবুজ শাড়ি। এ দুটিও দারুন। আবার একটা হাল্লাচিল্লা উঠল।
এরকমই হওয়ার কথা। এরকম হওয়াই নিয়ম।
চৈতন একটা মাছের কাঁটা দুটো মোটা আঙুল দিয়ে কষের দাঁতের ফাঁক থেকে টেনে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ফের আপনমনে বলল, শালা সতী।
তিনজন মেয়েছেলেকে কত আর ভাগাভাগি করা যায়? এক একজনকে নিয়ে তিন চারজন করে হামলে পড়ল। তিনপাত্তির আড্ডায় টিমটিম করছে মাত্র জনা চারেক। আর সব নাচানাচির জন্য তৈরি হয়েছে।
চৈতন চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বোতল হাতে নিয়ে উঠল। শালাকে একটু নাড়া দেওয়া দরকার।
ধ্রুব! আই বে ধ্রুব!
ধ্রুব প্রথমটায় সাড়া দিল না।
আই বে শালা ধ্রুব! শুনছিস?
ধ্রুব চোখ ফেরাল।
কী ভাবছিস বসে বসে গাড়লের মতো?
কিছু ভাবছি না।
পিকনিক ভাল লাগছে না?
লাগছে। লাগবে না কেন?
ফুর্তি করতে এসেছিস তা অমন শোকাতাপা মুখ করে বসে আছিস কেন?
ওসব আমার ভাল লাগছে না আজ।
মাল টানছিস না?
না। পেটে ব্যথা হয়।
মাছভাজা খাবি?
ইচ্ছে করছে না।
চৈতন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধ্রুবর পাশে বসে বলে, তুই কি সুইসাইড করবি ধ্রুব?
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল, সুইসাইড! কেন, সুইসাইডের কী হল?
আমার ছোটো ভাই তোর মতো বয়সে সুইসাইড করেছিল। বেশীদিনের কথা নয়। মরার আগে তাকে ঠিক এরকম দেখতাম।
এরকম মানে?
ঠিক তোর মতো। কোনো কিছুতে গা নেই, কথা বললে উল্টোপাল্টা জবাব দেয়, সব সময়ে অন্যমনস্ক, উদাস উদাস ভাব। তারপর একদিন মাঝরাতে গোঙানি শুনে তার দরজা ভেঙে ঢুকে দেখা গেল ব্লেড দিয়ে শিরা কেটে পড়ে আছে। রক্তের সমুদ্র একেবারে।
বোকারা সুইসাইড করে।
তুই কি খুব চালাক?
ধ্রুব হেসে ফেলে। বলে, হঠাৎ আমাকে দেখে কেন যে সুইসাইডের কথা তোর মনে হল! পাগল আছিস মাইরি।
চৈতন একটা চাপা হুঙ্কার দিয়ে বলে, পাগল আছি তো আছি, তোর বাপের কী? এখন সত্যি করে বল তো তোর হয়েছেটা কী?
কিছু হয়নি। তুই আজকাল বড্ড আমার পিছনে লেগেছিস।
লাগাচ্ছিস বলে লাগছি।
কেন, একজন মানুষের কি একটু একা বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না?
হবে না কেন? আমিও তো এতক্ষণ একা বসে ছিলাম। বসে বসে চুক চুক করে মাল খাচ্ছিলাম, মাছভাজা খাচ্ছিলাম। তুই কিছু করছিস না। শুধু বসে হাঁ করে চেয়ে আছিস। কেন?
তোকে নিয়ে আর পারি না চৈতন।
শুধু তাই নয়। তিনটে ডবকা মেয়েছেলে গা ঘেঁষে বসা তবু একটু ছোঁক ছোঁক করলি না, একবার ভাল করে চেয়ে দেখলি না। মেয়েমানুষের এই অপমান কি ধর্মে সইবে রে!
ধ্রুব খুব হাসল খাণিকক্ষণ। তারপর বলল, এই মেয়েগুলো বড় সাব-স্ট্যাণ্ডার্ড।
তা হোক না। সাব-স্ট্যাণ্ডার্ড ছাড়া ভাড়া খাটবে কেন? তোর এত শুচিবায়ু কবে থেকে হল বল তো?
হবে কেন? বরাবরই ছিল। কোনোদিন আমাকে দেখেছিস মেয়েছেলের পিছনে ছোঁক-ছোঁক করে বেড়াচ্ছি?
দেখিনি, কিন্তু দেখতে চাই। তুই নরম্যাল নোস কেন?
আমার তো মনে হয় বিশ জন লোকের পক্ষে তিনজন ভাড়াটে মেয়েমানুষের পিছনে লাগাই অ্যাবনরম্যাল এবং ইনহিউম্যান।
চৈতন রাগের চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ ঠাণ্ডা মেরে গেল। তারপর বলল, তুই কি নারীদরদী নাকি রে?
কি জানি কী। তবে ওই তিনজনের মধ্যে একজনকে আমি চিনি।
চিনিস? কী সূত্রে চিনিস?
সে তোকে বলা যাবে না। কিন্তু মেয়েটা এ দলে থাকায় আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করারও নেই।
তোর রিলেটিভ হয়?
ওরকমই।
কোন মেয়েটা?
তা তোর জেনে কাজ নেই।
চৈতন আবার বড় বড় চোখ করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থেকে বলে, তুই তো রাজার ছেলে। রাজার বংশের মেয়ে কখনো হাফ-গেরস্ত হয়? তুই গুল ঝাড়ছিস।
বংশের মেয়ে কে বলল?
এই যে বললি রিলেটিভ!
না। তবে রিলেটিভের মতোই।
সত্যি বলছিস?
সত্যি। মিথ্যে বলব কেন?
মেয়েটা তোকে চিনতে পেরেছে?
পেরেছে। খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
একটু দেখিয়ে দে ধ্রুব মেয়েটাকে।
কেন, কি করবি?
কলকাতার গাড়িতে তুলে দিয়ে আসব।
সাধে কি আর পাগল বলে তোকে?
এতে পাগলামির কি আছে?
মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলে তোরা ওকে পুরো টাকা দিবি?
দেবো।
তাতেও লাভ নেই। এটাই ওর ব্যবসা। এরকম ওকে করতেই হবে। খামোখা একটা সীন তৈরি করে লাভ কি?
ওই মেয়েটার জন্যই কি এমন খাট্টা মুখ করে বসে আছিস?
ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না। আমি ব্যাপারটা স্পোটিংলি নিয়েছি। আমার কোনো সংস্কার নেই, দেহের শুচিতা আমি মানিও না। তবে মেয়েরা যখন শরীরটাকে ভাড়া খাটায় তখন খারাপ লাগে। আমি সহ্য করতে পারি না।
চৈতন আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোর জন্য দুশ্চিন্তায় আমার নেশা ছুটে যাচ্ছে রে ধ্রুব।
কেন, দুশ্চিন্তার কি?
তুই কি শেষে সামাজিক জ্যাঠামশাই হয়ে দাঁড়াবি?
ধ্রুব হাসল না। চুপ করে রইল।
চৈতন তার আর একটু কাছ ঘেঁষে বসে নরম গলায় বলল, কোন মেয়েটা তা বলবি না?
বলে লাভ কি?
একটু দেখি।
দেখে কি হবে? বাকি দু’জনের সঙ্গে ওর তফাৎ নেই। একইরকম।
তবু একটু দেখিয়ে দে।
ধ্রুব রাগল না, শুধু একটু হেসে মাথা নেড়ে বলল, না রে। তা হয় না। ওকে আলাদা করে চেনার আর দরকার নেই।
তুই কি ওর প্রতি একটু সফট ধ্রুব?
ধ্রুব আবার হাসে, না। আমার ভিতরে সফটনেস বলে কিছু নেই।
জানি। ধারাও সেই কথা বলে।
ধ্রুব চুপ করে থাকে।
সামনে বিস্তৃত লন। দুপুরের ফলাও রোদে চারদিকে প্রকৃতির যেন এক উৎসব চলছে। লন্-এ তিনটে মেয়েকে নাচাচ্ছে মাতাল ও উদ্দণ্ড পুরুষেরা। একটা আদিম দৃশ্য।
তিনজনের মধ্যে কে তা অনেকক্ষণ চেয়েও বুঝতে পারল না চৈতন। দুঃখিতভাবে সে বোতলের মুখ নিজের মুখে তুলে নিল।
ধ্রুব!
বল।
তুই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।
কোথায়? এই তো তোদের সঙ্গে জুটে চলে এসেছি।
এসেছিস! সত্যি এসেছিস!
তার মানে?
সেই যে রবিঠাকুরের গানে আছে, তব মুখপানে চাহি এসেছো কি আসো নাই বুঝিব কেমনে?
ফিলজফি হচ্ছে!
পাগল! মাতালের পেটে কি ফিলজফি সয় রে! লাইনটা মনে পড়ে গেল তাই বললাম। কিন্তু আমার সত্যি মনে হচ্ছে তোর খোলটা পড়ে আছে এখানে। তুই নেই।
আমি সেই অর্থে কোথাও নেই রে চৈতন।
উল্টে ফিলজফি ঝাড়ছিস গুরু?
না। আমি বাস্তবিক কেমন যেন একটা নেই-নেই ভাবের মধ্যে আছি।
আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চৈতন বলে, আমারো সেই ভয় হচ্ছিল রে। কেবলই মনে হচ্ছে, ধ্রুবটা কি বাঁচবে?
চৈতন ফের বোতল মুখে তোলে এবং ঝুম হয়ে বসে থাকে।
এরা কে কখন খাবে তার কোনো ঠিক নেই। লরি কখন ফিরবে তারও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ধ্রুবর আর ভাল লাগছিল না।
নিঃশব্দে উঠল ধ্রুব এবং পায়ে পায়ে লন-এর উল্টোদিক দিয়ে ঘুরে বাড়ির পিছনের উঠোনটায় এসে দাঁড়াল। দুটো কয়লার উনুনে দু’জন ঠাকুর প্রবল বেগে রান্না করছে।
ধ্রুবকে দেখে একজন গামছায় হাত মুছে বিগলিত মুখে এগিয়ে এসে বলে, কিছু দিই স্যার? মাংস, মাছভাজা, চপ?
ধ্রুব একটু ইতস্তত করে। তার খিদে পেয়েছে।
লোকটা কোথা থেকে একটা কাঠের চেয়ার টেনে এনে ঝেড়েঝুড়ে বসতে দেয় তাকে। ভাঁড়ে মাংস, শালপাতায় চপ আর মাছভাজা নিয়ে এসে দেয়। বলে, পোলাও হয়ে এল স্যার। একটু চেখে দেখবেন।
ধ্রুব একটা চপ খেয়েই উঠে পড়ে। তার ভাল লাগে না। পেটের মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। প্রবল একটা আলোড়ন।
খেলেন না স্যার?
না।
টেস্ট ভাল হয়নি স্যার?
খুব ভাল হয়েছে। কিন্তু আমার শরীরটা আজ ভাল নয়।
ধ্রুব উঠে উঠোনটা থেকে বেরিয়ে পিছন দিকে খানিকটা এগোয়। এদিকটা পতিত জমির মতো পড়ে আছে। আগাছায় ভরা। একটা মজা পুকুর। ধ্রুব খানিকদূর এগিয়ে দাঁড়ায়। একটা বড় গাছকে ঝেঁপে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে একটা প্রবল লতা।
জায়গাটা খুব নির্জন। ধ্রুব ঘাসের ওপর আস্তে আস্তে বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। পেটে গোঁতলানোর ভাবটা প্রবল হচ্ছে। বমি আসছে। সম্ভবত গ্যাস হয়েছে।
শুয়েই ধ্রুব বুঝতে পারল, একটা ভুল করেছে সে। শোওয়া উচিত হয়নি। শরীর জুড়ে একটা ঝিমঝিমুনি উঠেছে তার। চোখে কেমন ধাঁধা লাগছে। মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। হাতখানেক উঁচু ঘাস ও আগাছার মধ্যে ডুবে তার মনে হল, এখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।
দুশ্চিন্তাটা বেশীক্ষণ রইল না ধ্রুবর। আস্তে আস্তে চোখ বুজল। আঠার মতো লেগে গেল দু’ চোখের পাতা।
কতক্ষণ শুয়ে ছিল তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু চোখ চেয়ে সে যাকে দেখতে পেল তাকেই দেখবে বলে একটা ক্ষীণ আশা ছিল তার।
কী হয়েছে তোমার বলো তো! শুয়ে আছো কেন এখানে?
তুই যা নোটন।
কালো শাড়ি পরা সুন্দর মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজছি। ভেবেছিলাম পালিয়ে গেছ। রান্নার ঠাকুর বলল, এদিকে আসতে দেখেছে তোমাকে। ছুটে এসেছি। আর তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছো?
তোকে তাড়াবো না তো কাকে তাড়াবো?
আমার সব দোষ, না?
তবে কার দোষ?
নোটন চোখের জলে মুখ ভাসিয়ে বলে, ঠিক আছে, আমার দোষ। কিন্তু তোমার কি হয়েছে ধ্রুবদা?
কিছু হয়নি।
রাগ করছো কেন? একটা থাপ্পড় মারো বরং!
আমার কী হয়েছে জেনে কী করবি? এত দরদ কবে থেকে হল?
দরদ বরাবরই ছিল। তুমি বুঝবে না।
না, আমি বুঝবো কেন? বুঝবি তুই। কবে থেকে শুরু করেছিস এসব?
বেশীদিন নয়। আমার দাদাকে জ্যাঠামশাই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তা জানো?
তাড়িয়ে দিয়ে থাকলে এমনি দেয়নি।
আমি কি বলেছি এমনি? দাদারই দোষ ছিল। কিন্তু সেই থেকে দাদা নিরুদ্দেশ।
তোরা বাবার কাছে গেলি না কেন?
গেলে যদি জ্যাঠামশাই রাগ করে! যা রাগ!
ধ্রুব চুপ করে নোটনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।