2 of 3

৮৩. সংজ্ঞা যখন ফিরল

॥ ৮৩ ॥

সংজ্ঞা যখন ফিরল তখন হেমকান্তর উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছে। দুর্বল শরীরে রাগ, অপমান এবং অযোগ্যের স্পর্ধা তাঁকে বড় বেশি আন্দোলিত করে ফেলেছিল। হেমকান্ত চারদিকে চাইলেন। ঘরভর্তি তাঁর আত্মজনেরা। আত্মীয়দের দেখে এতটা প্রসন্ন তিনি কোনোকালে বোধ করেননি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর বরাবর দূরত্ব ছিল। নিজের অনেক নাতি-নাতনীকে তিনি ভাল করে চেনেনও না।

একদম শিয়রের কাছে রঙ্গময়ী বসা। হাতে পাখা।

হেমকান্ত রঙ্গময়ীকে উপেক্ষা করলেন, কারণ সে-ই সবচেয়ে নিকট আত্মীয়া, তাকেই উপেক্ষা করা যায়।

কনক আরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। হেমকান্তর সংজ্ঞা ফিরে আসার পর প্রশ্ন করল, এখন কেমন আছেন?

ভাল। দুর্বলতা আর আচমকা উত্তেজনায় মাথাটা কেমন করল।

করতেই পারে। দারোগাদের স্পর্ধা যে কোথায় পৌঁছেছে!

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ঘরের সবাই চাপা স্বরে কথা বলছে। সকলের চোখেই একটা আতঙ্ক আর দিশেহারা ভাব এই অল্প আলোতেই লক্ষ করলেন হেমকান্ত। কনককে বললেন, দারোগার আর দোষ কি? ইংরেজরাই ওদের মাথায় তুলেছে।

জীমূতকান্তি এগিয়ে এসে হেমকান্তর কাছে দাঁড়ায়। বলে, স্বদেশীরা আপনাকে মারার চেষ্টা করল আর রামকান্ত রায়কে ছেড়ে দিল এটা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি। স্বদেশীরা কি শত্রুমিত্র ভুলে গেছে?

হেমকান্ত মৃদু হেসে বললেন, আমাকে মারা সোজা কিন্তু রামকান্তকে মারা তো সহজ নয়। তার কাছে অস্ত্র থাকে, সঙ্গে সেপাই থাকে। তাছাড়া সে নিশ্চয়ই সর্বদা সতর্ক হয়েই চলে। থাকগে, রামকান্ত রায় কি চলে গেছে!

বিশাখা মৃদু স্বরে বলল, গেছে।

হেমকান্ত ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভীড়ের মধ্যে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রটির মুখ খুঁজছিলেন। কিন্তু ঘরে কৃষ্ণকে দেখা যাচ্ছিল না। হেমকান্ত বিশাখার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বললেন, কৃষ্ণ কোথায়?

সে বোধহয় বাড়ি নেই।

এত রাতে কোথায় গেল?

কি জানি।

হেমকান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে বসলেন। দুই ছেলের দিকে চেয়ে বললেন, তোমরা দেখ তো! দরকার হলে চাকর দারোয়ানদের চারধারে পাঠাও। আর প্রজাদেরও খবর দাও।

কনক বলে, অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

কারণ আছে বলেই হচ্ছি। কৃষ্ণর ওপর রামকান্ত খুশি নয়, জানোই তো। কি হয় না হয় তার ঠিক কি?

আচ্ছা, আমরা দেখছি।

বাড়িতেও দেখ। আগে বাড়ির ঘরগুলো কাছারির ওদিকটা সব ভাল করে দেখে নিও। তাকে পেলেই আমার কাছে পাঠাবে।

খুব ফিসফিস করে রঙ্গময়ী বলে, তাকে আমি শচীনদের বাড়ি পাঠিয়েছি।

হেমকান্ত বিস্মিত হয়ে বলেন, কেন?

পুলিস দেখে।

হেমকান্ত ছেলেদের দিকে চেয়ে বললেন, থাক আর খুঁজতে হবে না। তোমরা বরং রাজেনবাবুর বাড়িতে যাও। সে সেখানেই আছে। তাকে নিয়ে এসো। দেউড়িটা সব সময়ে বন্ধ রাখতে বলে দিও।

জীমূত আর কনক বেরিয়ে গেল। কৃষ্ণকান্ত মেয়ে আর বউদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা গিয়ে যে যার ঘর ভাল করে খুঁজে দেখ। বাড়ির আনাচ কানাচ তো রাত্রে ভাল দেখতে পাবে না। তবু চাকর আর দাসীদের দিয়ে খুঁজিয়ে নিও। কিছু আপত্তিকর জিনিস বা কাগজপত্র থাকলে আমার কাছে নিয়ে এসো।

চপলা বলল, কেন বাবা?

অনেক সময় পুলিস নিজেই আপত্তিকর জিনিস আগে থেকে রেখে যায়। ওদের তো কূটকৌশলের অভাব নেই। আমার ওপর রাগ তো আছেই। কৃষ্ণর ঘরটা ভাল করে দেখো।

হেমকান্ত এসব সিদ্ধান্ত নিলেন ঠাণ্ডা ভাবে, একটুও ভয় না পেয়ে না ঘাবড়ে। নিজের এই নিরুত্তাপ আচরণ এবং মোটামুটি বুদ্ধিমানের মতো চিন্তা করার শক্তি দেখে নিজেই একটু অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন হেমকান্ত। অন্যেরাও হচ্ছিল বোধহয়। কিন্তু তাদের মুখের ভাব ততটা অল্প আলোয় দেখা গেল না।

সবাই চলে গেল। রইল রঙ্গময়ী। বলল, দুর্বল শরীরে অনেক ধকল গেছে। এবার শুয়ে পড়ো।

হেমকান্ত শুনলেন না। বললেন, সারাদিন শুয়ে বসেই আছি। বিশ্রাম নিতে আর ভাল লাগছে না।

তাহলে কি মুগুর ভাঁজবে নাকি?

যা দিনকাল দেখছি তাই ভাঁজতে হবে। দারোগার স্পর্ধা দেখে বড় অবাক হয়েছি আজকে।

রঙ্গময়ী মৃদু একটু হেসে বলল, একটা কথা বলব?

বলো। কি কথা?

রামকান্ত রায় যখন আসে তখন তুমি কী করছিলে?

হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, কী করছিলাম মানে? বসে ছিলাম।

বসে কিছু করছিলে না?

না তো।

কোথায় বসে ছিলে?

এই ডেসকে।

সেখানে বসে কী করছিলে মনে করে দেখ।

হেমকান্ত একটু ভেবে বললেন, মনে পড়েছে। একটা চিঠি লিখছিলাম।

কাকে?

হেমকান্ত রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে বললেন, অত খোঁজ নিচ্ছো কেন?

কারণ আছে বলেই নিচ্ছি।

সচ্চিদানন্দকে।

তাতে এমন কোনো কথা লেখোনি তো যে অন্যে দেখলে ক্ষতি হতে পারে।

না। বলেই হেমকান্ত থমকালেন। সংজ্ঞাহীনতার ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে বোধহয়।

কী হল?

হ্যাঁ মনু, তাতে আমি অনেক আবোলতাবোল লিখেছি বটে।

লিখেছো! এই রে।

কেন, কী হয়েছে? কেউ দেখে ফেলেছে নাকি?

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, তোমাকে যখন অজ্ঞান অবস্থায় বাতাস দিচ্ছিলাম তখন দেখলাম, বিশাখা ডেসকে দাঁড়িয়ে চিঠিটা পড়ছে।

বলো কি?

খুব বেশি পড়েনি। আমি ওকে ডাক দিয়ে জল আনতে পাঠাই। কারণ ওর ভাবসাব দেখে আমার মনে হল, এই বিপদের মধ্যেও যখন অত মন দিয়ে একটা লেখা কাগজ পড়ছে তখন ওই কাগজে তেমন কিছুই লেখা আছে।

তারপর কী হয়েছে? কাগজখানা কই?

আছে। আমি সরিয়ে রেখেছি। তোমার তোশকের তলায়।

ওতে তোমার কথা আছে মনু।

কেন সচ্চিদানন্দকে ওসব লেখো?

দোষের কিছু হয়েছে?

আগেই তো বলেছি উনি লোক ভাল নন।

তোমার সন্দেহ অমূলক। সচ্চিদানন্দ আমার বাল্যবন্ধু। আমি ওকে চিনি।

তোমার মতো সদাশিব কখনো কাউকে খারাপ দেখে না।

দেখে বইকি! এই যে রামকান্ত দারোগা এ লোকটা খারাপ।

ভুল। রামকান্ত খারাপ হবে কেন? বরং রামকান্ত কর্তব্যপরায়ণ মানুষ, মাঝে-মধ্যে বাড়াবাড়ি করে ফেলে।

তুমি সব সময়ে আমার উল্টো দিকে দাঁড়াও কেন বলো তো!

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, সে সাহস আমার নেই।

তবে রামকান্তকে সাপোর্ট করছো কেন?

করছি না। সাপোর্ট করবো কেন? তবে সে যে সার্চ করতে এসেছিল তার কারণ আছে।

কী কারণ?

কৃষ্ণ তোমার একটা রিভলবার সরিয়ে নিয়েছিল।

হেমকান্ত চমকে উঠলেন, রিভলবার?

হ্যাঁ, বোধহয় সেটা সে এক-আধদিন স্কুলেও নিয়ে গিয়ে থাকবে। ওর যা বয়স নতুন খেলনা পেলে সকলকেই দেখানোর ইচ্ছে হয়।

সর্বনাশ!

ভয় পেও না। ওটায় গুলি ছিল না। আমার মনে হয় কেউ ওর কাছে রিভলবার দেখে পুলিসকে জানিয়েছে।

সেটা আমাকে এতদিন বলোনি কেন?

বলার কী আছে। তোমারও তো শরীর ভাল ছিল না। তাছাড়া আমিও তো ওর মায়ের মতোই। ওর ভালমন্দ নিয়ে ভাবি।

রিভলবারটা চেয়ে নাওনি ওর কাছ থেকে?

চাইনি, তবে চুপি চুপি সরিয়ে নিয়েছি। ওটা এখন আমার কাছে আছে।

পুলিস জানে বলছো?

জানে বলেই তো মনে হয়। না হলে সার্চ করতে চাইবে কেন? একটা কথা বলি?

বলো।

কৃষ্ণকে রিভলবার নিয়ে কিছু বলতে যেও না। যা বলার আমিই বলব।

কিন্তু এ তো অতি বিপজ্জনক ঘটনা!

ছেলেমানুষ, ও কি আর অত বোঝে?

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আজ রাতে আমার আর ঘুম হবে না। কৃষ্ণ রিভলবার নিয়ে কী করতে চায় বলো তো।

তোমাকে ছোরা মারার পর থেকেই বোধহয় ওর একটা শোধ নেওয়ার ঝোঁক এসেছে। ভীষণ ভালবাসে তোমাকে।

শোধ নেওয়ার জন্য রিভলবার! ও তো জানেও না কে আমাকে ছোরা মেরেছে।

তার ওপরেই যে শোধ নিতে হবে তার কোনো মানে নেই। ও শোধ নিতে চায় দলটার ওপর। পুলিসের ওপরেও খুব রাগ।

ওকে সামলাও মনু। ওকে নিয়ে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা।

সে তোমাকে বলতে হবে না। কৃষ্ণ যে আমারও ছেলে সেটা ভুলে যাও কেন? তবে বড় হচ্ছে, কত আর সামাল দিতে পারব আমরা?

তাহলে বলো ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি কাশী চলে যাই।

সে একরকম ভাল প্রস্তাব। যেতে তো আমারও ইচ্ছে। কিন্তু সংসারকে ফাঁকি দিয়ে কি যেতে পারবে? কত দায়িত্ব তোমার।

হেমকান্ত কয়েক পলক চোখ বন্ধ করে কৃষ্ণকান্তর মুখটা দেখতে পেলেন কল্পনায়। ছেলেটি তাঁরই ঔরসজাত, অথচ যেন অন্য এক পরিমণ্ডল থেকে আসা। বড্ড অচেনা, বড্ড অন্যরকম।

রঙ্গময়ী বলল, কত আর ভাববে? এসব তোমাকে না বললেই হয়তো হত। কিন্তু ঘটনা যেদিকে গড়াচ্ছে তা দেখে মনে হল, সবকিছু তোমার জানা না থাকলে হয়তো বিপদে পড়বে। জানলে আগে থেকে বিলিব্যবস্থা করা যায়।

ঠিক কাজই করেছো মনু। আরো আগে বললে ভাল করতে। কাল সকালে রামকান্ত সার্চ করতে আসবে। রিভলবারটা সাবধানে রেখেছে তো।

সাবধান হওয়ার দরকার নেই। তোমার কাছে রাখলেই চলত। তোমার লাইসেন্স আছে, পুলিসের কিছু বলার থাকত না। কিন্তু আমি একটা ভুল করেছি।

সর্বনাশ। আবার কী করলে?

একটা স্বদেশী ছেলেকে দিয়েছি।

মনু! ছিঃ।

রঙ্গময়ী লজ্জা পেল না। স্থির চোখে হেমকান্তর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আমি তোমার মতো লেখাপড়া জানি না। আমার অত বুদ্ধিও নেই। আমি ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যা বুঝেছি করেছি। রাগ কোরো না।

হেমকান্ত চুপ করে একটু ভাবলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, পুলিস এসে রিভলবারটারই খোঁজ করবে। ট্রেস করা না গেলে আমাকে ফেলবে জবাবদিহিতে। তুমি ঠিকই বলেছো মনু, রিভলবারটা যে বাড়িতে নেই তা পুলিস জানে।

তোমার পায়ে পড়ি, এর জন্য শাস্তি যা আমাকে দিও। কৃষ্ণকে কিছু বোলো না।

হেমকান্ত করুণ মুখে মাথা নেড়ে বললেন, বলার কিছু নেইও। কী বলব? ছেলে বড় হচ্ছে, নিজস্ব মতামত নিজস্ব চরিত্র তৈরি হচ্ছে। আমি কী করতে পারি বলো।

হেমকান্তর করুণ মুখখানার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রঙ্গময়ী মাথা নাড়ল। বলল, আমিও সেই কথা বলি। তুমি ভেবো না।

রঙ্গময়ী চলে যাওয়ার পর হেমকান্ত তাঁর খাস চাকরটিকে ডেকে বললেন, হরি, মনুর কাছে কেউ আসে-টাসে নাকি রে? ছোকরামতো কেউ। দেখেছিস কখনো?

হরি জন্মাবধি এই বাড়িতে আছে। অসম্ভব বিশ্বাসী। গলা কেটে ফেললেও কেউ তার মুখ থেকে কথা বের করতে পারে না! কম কথার মানুষ, বুদ্ধিমান এবং সজাগ লোক। মাথা চুলকে একটু বিনয়ের ভাব দেখিয়ে বলে, বাইরে থেকে তেমন কাউকে যাতায়াত করতে দেখি না। তবে…

তবে কি?

প্রতুল দাদাবাবু কৃষ্ণদাদাকে পড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় ওঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতেন।

প্রতুল! ছেলেটা তো এমনিতে নিরীহ। স্বদেশী করে নাকি?

হরি ফের মাথা চুলকে বলে, সে কি করে বলব? তবে কৃষ্ণদাদাকে একটু-আধটু স্বদেশী শেখাত।

হেমকান্ত বাড়ির খোঁজখবর বড় একটা রাখেন না। প্রতুলকে দেখেনওনি বহুদিন। তাই জিজ্ঞেস করলেন, কৃষ্ণকে কি এখনো ও পড়ায়?

না। দাদাবাবু আজকাল নিজেই পড়ে।

প্রতুল আসে মাঝে মাঝে?

মাঝে মাঝে আসতে দেখি। তবে চুপি চুপি। আঁধার হলে।

কি করে বেড়ায় একটু খোঁজ নে তো?

হরি মাথা চুলকে বলে, খোঁজ পুলিসেও নিচ্ছে। ধরতে পারছে না।

হেমকান্ত বিমূঢ়ের মতো চেয়ে থেকে বলেন, তুই তো অনেক খবর জানিস দেখছি। বলিস না কেন আমাকে?

বলার কি! শরীর তো এমনিতেই খারাপ। এসব শুনে আরো বিগড়োবেন।

প্রতুল তাহলে ফেরার?

মনে তো হয়।

রিভলবারটা কবে কৃষ্ণ নিয়ে গেছে জানিস?

কবে বলতে পারব না। তবে নিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে।

তুই জানতে পেরেছিলি?

একদিন ঘরটা সাফ করতে গিয়ে তোশকের তলায় দেখতে পাই।

তখনো আমাকে বলিসনি?

ও অস্ত্রটার গুলি বাড়িতে নেই। শুধু ওটা দিয়ে আর কী হবে?

গুলি তো কিনতে পাওয়া যায়।

হরি মাথা চুলকে বলে, আমি কথাটা মনুদিদিকে বলে দিয়েছিলাম। মনুদিদি গিয়ে সরিয়ে আনে।

খুব বুদ্ধিমান। বলে হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন জানালার বাইরের অন্ধকারে। তারপর বলেন, ওরা এল কিনা দেখ। কৃষ্ণর জন্য চিন্তা হচ্ছে।

এই যে যাই।

বলে হরি বেরিয়ে গেল।

হেমকান্ত তোশকের তলা থেকে সচ্চিদানন্দকে লেখা চিঠিখানা বের করলেন। ভারী লজ্জা করছিল চিঠিখানার দিকে চেয়ে। শাস্ত্রে তাই বলে শতং বদ মা লিখ। লেখা জিনিস দলিলের মতো। শত গুজবেও যা করতে পারে না এক টুকরো চিরকুট তা অনায়াসে করতে পারে। হেমকান্তর একটা ডায়েরীও আছে। এক কিশোরীকে নিয়ে নানা প্রণয়োপাখ্যান। এগুলো কি পুড়িয়ে ফেলা উচিত?

বিশাখা যদি চিঠিটা পড়ে থাকে তবে যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। আর কিছু করার নেই। বিশাখা ভাল স্বভাবের মেয়ে হলেও নিন্দেমন্দ করা এবং কূটকচালি তাদের প্রিয় স্বভাব। কোনো সময়ে তার মুখ দিয়ে কথাগুলো প্রকাশ পেতে পারে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হেসে উঠলেন হেমকান্ত। তাঁকে আর রঙ্গময়ীকে নিয়ে প্রচার তো বহুকাল ধরে হচ্ছে। অতএব ভয়ের আর কী?

বাইরে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। হেমকান্ত চিঠিটা লুকোলেন।

ঘরে এসে ঢুকল কনক আর জীমূত। তাদের মুখচোখের চেহারা ভাল নয়। কেমন উদ্‌ভ্রান্ত।

কৃষ্ণ কোথায়?

কনক বলল, সে ও বাড়িতে নেই।

নেই মানে? মনু যে তাকে পাঠিয়েছে।

গিয়েছিল। কিন্তু তারপর কোথায় চলে গেছে।

হেমকান্ত উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন, তার মানে? এত রাতে সে যাবে কোথায়?

তা কেউ বলতে পারছে না। সন্ধেবেলায় গিয়ে ও বাড়িতে শচীনের খোঁজ করে। শচীন ছিল না। কিছুক্ষণ বসে ছিল বাইরের ঘরে। ওদের এক ঝি বলল, একটা ছেলে নাকি সাইকেলে হঠাৎ কোথা থেকে এসে ওকে ডেকে নিয়ে যায়। সেই সাইকেলেই উঠে গেছে।

হেমকান্ত দুর্বল শরীরে অবসন্ন বোধ করে বিছানায় বসে পড়লেন। বললেন, তাহলে?

আমরা চারদিকে লোক পাঠিয়েছি। খোঁজ পাওয়া যাবেই।

সাইকেলওলা ছেলেটা কে?

ওদের ঝি তা বলতে পারল না।

হেমকান্ত উঠে পড়লেন। বললেন, গাড়ি জুড়তে বলল। আমি বেরোবো। কনক জীমূত দুজনেই হাঁ-হাঁ করে ওঠে, এই শরীরে কোথায় যাবেন?

শরীরে যথেষ্ট জোর পাচ্ছি। চিন্তা কোরো না।

মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। একটু আগেই তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

বাধা দিও না। গাড়ি জুড়তে বলো।

খবর পেয়ে মেয়েরা বউরাও এল।

কোথায় যাবেন বাবা? আজ অন্ধকার রাত।

আমি বিশেষ একজনের কাছে যাবো। সে বোধহয় বলতে পারবে।

জীমূত বলে, তার নাম বলুন। আমরা খোঁজ নিচ্ছি।

সে অ্যাবসকণ্ডার, তার নাম বলা উচিত হবে না। আমাকে যেতে দাও। কৃষ্ণর কিছু হলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

তাহলে আমরা কেউ আপনার সঙ্গে যাই।

হেমকান্ত একটু ভেবে বললেন, কনক বরং চলো। আর শোনো, বন্দুকের ঘরটা কাউকে খুলতে পাঠাও। আমি সঙ্গে একটা অস্ত্র রাখতে চাই।

সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করল না।

হেমকান্ত বন্দুকের ঘরে ঢুকে চেস্ট অফ ড্রয়ারস খুললেন। নীচের দেরাজে একদম কোণের দিকে হাত বাড়িয়ে একটা পিস্তল বের করে গুলি ভরলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল। বুকে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি অস্ত্র পছন্দ করেন না। কিন্তু কৃষ্ণ, তাঁর প্রিয় পুত্র কৃষ্ণর জন্য তিনি দরকার হলে হাজারটা লোককে মারতে পারেন।

ঘোড়ার গাড়িতে বসে কনক জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন বাবা?

প্রতুলের বাড়ি। কাছেই।

প্রতুল কে? কৃষ্ণর সেই প্রাইভেট টিউটর?

হ্যাঁ। ছেলেটা শুনেছি স্বদেশী করে।

কৃষ্ণর সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক?

হেমকান্ত একটু চুপ করে থেকে সতর্ক গলায় বলেন, আমার ধারণা কৃষ্ণ স্বদেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করছে। এবার হয়তো অ্যাকশনে নামতে চাইছে।

সর্বনাশ।

হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তোমরা কেউ থাকে না এখানে। আমিও সবদিকে নজর রাখতে পারি না। কী যে হবে।

গাড়ি একটা ঘিঞ্জি পাড়ায় ঢোকে। তারপর এসে দাঁড়ায় একটা টিনের বাড়ির সামনে! হতদরিদ্র চেহারার বাড়ি।

গাড়োয়ানের পাশ থেকে নেমে হরি ভিতরে গিয়ে এক বুড়ো ভদ্রলোককে ডেকে আনে। প্রতুলের বাবা। শশব্যস্তে এসে ভদ্রলোক হাতজোড় করে দাঁড়ান, আজ্ঞে আপনি!

প্রতুল কোথায়?

প্রতুল! সে তো মাসেকের ওপর বাড়ি নেই। পুলিস এসে রোজ খোঁজ করে যাচ্ছে।

হেমকান্তর শ্বাস হঠাৎ বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *