2 of 3

৮৩. বামাচরণকে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি বিষ্ণুপদ

৮৩

বামাচরণকে প্রথমটায় চিনতেই পারেনি বিষ্ণুপদ। দু’গালে বিজবিজ করছে কাঁচা-পাকা দাড়ি, চুলও লম্বা হয়ে জট পাকানোর জোগাড়, চোখ ঘোলাটে। বেশ রোগাও হয়ে গেছে। চিনতে কষ্ট হল খুব। বামা প্রণাম করে দাঁড়ানোর কয়েক লহমা পর বিষ্ণুপদ বলল, আয়, বোস।

বাম। শানের ওপরেই বসে পড়ল। বিষ্ণুপদ লক্ষ করল, বামার জামাকাপড়ের অবস্থাও ভাল নয়। ময়লা হাকুচ একটা হাওয়াই শার্ট আর তেলচিটে একটা প্যান্ট। এত ময়লা যে রঙ বোঝা যায় না। চটিজোড়াও লক্ষ করল বিষ্ণুপদ। সিঁড়িতে ছেড়ে রাখা একজোড়া হাওয়াই। তলা ক্ষয়ে গেছে। বামার ছেলেপুলে নেই। পিওন বা আর্দালিগোছের চাকরি করলেও সরকারি পাকা চাকরি। তার এমন দুরবস্থা হওয়ার কথা নয়।

কি খবর রে?

এই এলাম। গলায় যেন জোর নেই বামার।

কোথায় আছিস এখন?

শ্বশুরবাড়িতেই ছিলাম এতদিন। এখন একটা ঘর ভাড়া করতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে খুব অশান্তি হচ্ছিল।

কিসের অশান্তি?

সম্বন্ধী আর তার বউ অশান্তি করছে। থাকতে দিচ্ছে না।

একটা শ্বাস ফেলে বিষ্ণুপদ বলল, তা কষ্ট করে থাকার দরকারটা কি? তোর ঘর তো ফাঁকা পড়েই আছে এখানে। তোর মায়েরও ইচ্ছে।

কিন্তু শ্যামলী চাইছে না। কী করব বলুন তো!

বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বল। বউমার এখানে অসুবিধে কি?

এখানে আসতে চায় না। বলছে তার ভাগের সম্পত্তি বাবদ যা টাকা পাওনা হয় তা দিয়ে দিতে। সেই জন্যই আসা।

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, টাকা! টাকাটা দেবে কে? তোর ভাগের অংশটা যদি কেউ কেনে তবে হয়তো হয়। কিন্তু সে তো অবাস্তব কথা। এ হল দখলের জমি, সেই পার্টিশনের পর কিছু মাতব্বর মুরুব্বি এসব জায়গায় আমাদের বসিয়ে দেয়। দলিলপত্রের কারবার ছিল না। এখানকার বসতবাড়ির ভাগ কিনবেই বা কে!

রামজীবনকে বলুন, সে কিনে নিক।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলল, তোরা কি রামজীবনের অবস্থা জানিস না নাকি? সে টাকা কোথায় পাবে? কিনবেই বা কেন? ওসব বুদ্ধি করে লাভ নেই। এখানে বসবাস করতে পারিস, সেটাই সোজা।

বামাচরণ মাথা নেড়ে বলল, আমি কিছু জানি না। আমার টাকার দরকার।

বামাচরণের গলার আওয়াজটা হঠাৎ যেন একটু কেমন-কেমন ঠেকল বিষ্ণুপদর। বামাচরণ যেন আগের মতো নেই। অন্যরকম হয়ে গেছে। সেটা ভাল মনে হচ্ছে না তার।

বিষ্ণুপদ বলল, টাকার দরকার কার নয়? কিন্তু ব্যবস্থা কি করে হবে তাই ভাবছি। তুই বরং আজকের দিনটা থেকে যা। রামজীবনের সঙ্গে কথা বলে দেখ।

বামা একটু রুক্ষ গলায় বলে, ওর সঙ্গে কথা বলতে যাবো কিসের জন্য? আমি ওসব পারব না বাবা। ব্যবস্থা যা করার আপনিই করে দিন।

বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বলে, আমি! আমার টাকা কোথায় দেখলি তুই? আমি টাকা দেবো কোত্থেকে?

বামাচরণ যে তা জানে না তা নয়। খুব ভাল করেই জানে। তবু কেমন অসহিষ্ণু গলায় বলল, তা আমি জানি না।

গতিকটা ভাল ঠেকছে না বিষ্ণুপদর। নয়নতারা বাড়িতে থাকলে একটু সুবিধে হত বিষ্ণুপদর। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার, লক্ষ্মীর জন্য বাতাসা আনতে দোকানে গেছে। একবার বেরোলে নয়নতারা চট করে ফেরে না, পাঁচ বাড়ি ঘুরে গল্পসল্প করে আসে।

বিষ্ণুপদ গলাখাঁকারি দিয়ে অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে বলল, ঠাণ্ডা হয়ে বোস। তোর মা একটু বেরিয়েছে, আসুক।

বামাচরণ বসে বসে অন্য দিকে চেয়ে হঠাৎ বিড়বিড় করতে লাগল আপনমনে। এরকম আগে দেখেনি ওকে বিষ্ণুপদ। আগে তো এসব ছিল না! কী বিড়বিড় করছে তা শোনার জন্য বিষ্ণুপদ একটু ঝুঁকল। তার কানটা গেছে। ইদানীং কানে একটু যেন কম শুনতে পায়। তবু দু’-চারটে কথা কানে এল তার। বামাচরণ বলছে, চালাকি হচ্ছে? অ্যাঁ! চালাকি হচ্ছে? বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো…শুয়োরের বাচ্চা…

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষ্ণুপদ ফের সোজা হয়ে বসল। নিজের ওপর কি বামার বশ নেই? লক্ষণ তো ভাল নয়!

এ কথা ঠিক যে সব মানুষেরই ভিতরে নানা উল্টোপাল্টা কথা প্রায় সব সময়েই ভুরভুরি কাটে। সব মানুষই ভিতরে ভিতরে অল্পবিস্তর পাগল। পাগল ভিতরটাকে চেপে ঢেকে রেখেই মানুষকে চলতে হয়। যখন মানুষ নিজের ওপর বশ হারিয়ে ফেলে তখন বিড়বিড় করে, একা একা কথা কয়। বামার হলটা কী?

বিষ্ণুপদ সস্নেহে ডাকল, বামা!

বামাচরণের বিড়বিড় থামল। স্বাভাবিক গলায় বলল, কি বলছেন?

তিন-চার মাস কোনও খবর দিলি না। কেমন ছিলিটিলি সব খুলে বলবি তো!

বামাচরণ তিক্ত গলায় বলল, আমার খবর জেনে আপনাদের কী হবে? আমি যে আপনার ছেলে সেটাই তো আপনারা স্বীকার করেন না। মেরে-ধরে বাড়ির বার করে দিলেন। এখন আর খবর জেনে কী হবে? দাদাকেও এইভাবে তাড়িয়েছিলেন। তাতে দাদার কাঁচকলা হল। সে এখন সাততলায় থাকে, মোটা মাইনে পায়, এরোপ্লেনে ঘোরে।

বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কৃষ্ণকে বড় অপমান করা হয়েছিল, সে ঠিক কথা। অপমান যারা করেছিল তার মধ্যে তো তুইও ছিলি বাবা। ভুলে গেছিস সব? তোদের ঠাণ্ডা করতে আমি তোদের হাতে-পায়ে অবধি ধরেছিলাম।

বামাচরণ চট করে কথা পাল্টে ফেলে বলল, ওসব পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী হবে? ওসব ছাড়ুন। আমাকে যখন তাড়িয়েই দিয়েছেন তখন আমার ন্যায্য পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন। আর জীবনে কখনও আপনাদের মুখদর্শন করব না।

বিষ্ণুপদ মৃদুস্বরে বলল, তোকে কেউ তাড়ায়নি। তুই নিজে থেকেই গেছিস। ঝগড়াঝাঁটি সব সংসারেই আছে। অত গায়ে মাখতে নেই।

ওসব উপদেশ দিয়ে লাভ হবে না বাবা। আমি ভাগের টাকা চাই। হিসেব করে দেখেছি আমার যা ভাগ আছে তাতে আমার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা পাওনা হয়।

কত বললি?

ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার। কম করেই ধরেছি। টাকাটা ফেলে দিন, আর আসব না।

বিষ্ণুপদ অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলে, এ সম্পত্তির কত দাম তার কোনও আন্দাজই নেই আমার। হিসেব শুনে কী হবে? তবে টাকাটা অনেক টাকা বটে।

বামাচরণ একটু রুখে উঠে বলে, আপনার কি ধারণা আমি বেশি চাইছি?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, না রে, আমার কোনও ধারণাই নেই। বলোম তো। একটা কথা শুনবি আমার?

বলে ফেলুন।

বউমাকে একবার নিয়ে আয়। তাকে একটু বুঝিয়ে বলি।

সে আসবে না। এ বাড়ির ছায়াও মাড়াবে না। তাকে কী বোঝাতে চান আপনি? বুঝিয়ে-টুঝিয়ে কিছু হবে না। টাকা দিয়ে দিন, আমাদের সঙ্গে আর সম্পর্ক থাকবে না।

বিষ্ণুপদ মৃদু স্বরে বলল, বামাচরণ, সম্পর্ক ছাড়া আর কিসের জোরে তা হলে সম্পত্তির ভাগ চাইছিস?

তার মানে?

বিষ্ণুপদ একটু ম্লান হেসে বলল, ছেলে তার বাপের সম্পত্তি পায় কিসের জোরে? বাপ-ছেলে সম্পর্কের জোরেই তো! তা হলে সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক থাকবে না বলে জোরগলায় বলতে আছে? সম্পর্কই যদি নেই তা হলে উরোধিকার বর্তায় কিসের জোরে?

বাজে কথা রেখে দিন, ওসব শুনে আমার লাভ নেই।

একটু ঠাণ্ডা হ বাবা, বড্ড মাথা গরম করে এসেছিস আজ। একটু বিবেচনা করে দেখ। আমাদের অবস্থা তো জানিস, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তুই যে টাকার কথা বলছিস আমি একসঙ্গে অত টাকা জীবনেও দেখিনি।

তা হলে বাড়িটা বেচে দিন। তারপর টাকা ভাগ করে দিন সকলকে।

বাড়ি বেচলে আমরা যাবো কোথায়?

তার আমি কি জানি?

বিষ্ণুপদ স্তব্ধ হয়ে গেল। বামাচরণ কি পাগল হয়ে গেল নাকি? স্তব্ধ হয়ে সে দেখল, বামাচরণ ফের লেবুগাছের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে যাচ্ছে একনাগাড়ে। ভাল কথা বলছে না। ভিতর থেকে নানা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান দৃষিত কথা হয়ে বেরিয়ে আসছে।

পড়ন্ত দুপুর। রাঙা ঘুম ভেঙে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটু। বামাচরণকে দেখে অবাক হয়েছে। তারপর পুকুরের দিকে চলে গেল। বামা অবশ্য ভ্রূক্ষেপ করল না। শুধু বিড়বিড় করে যেতে লাগল।

নয়নতারা ফিরল যেন এক যুগ পরে। এক হাতে বাতাসার ঠোঙা, অন্য হাতে আম্রপল্লব, আরও কি যেন।

বিষ্ণুপদ একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, এলে? বামা এসে কতক্ষণ বসে আছে দেখ।

বামা! বলে এক গাল হাসল নয়নতারা, বামা এলি? এতদিন পর মনে পড়ল বাবা? এমন ভুলে থাকতে পারিস কি করে? কাল রাতেও তো তোকে স্বপ্ন দেখলাম।

বামা উঠে মাকে তাড়াতাড়ি প্রণাম করল। একটু কাণ্ডজ্ঞান যেন এখনও আছে বামাচরণের। বলল, তোমাকে দেখতেই এলাম।

বউমাকে আনিসনি? সে এল না কেন?

তার সময় হয় না।

রাগ করে আছে নাকি এখনও?

বামাচরণকে এই প্রথম হাসতে দেখল বিষ্ণুপদ। হেসে বলল, তা রাগ তো হতেই পারে।

বোস বাবা, বোস। আমি সব রেখে আসি। চা খাবি তো!

বেলাবেলি রওনা হতে হবে। পথ তো কম নয়।

বোস একটু। ভাল করে মুখখানা দেখি।

নয়নতারা ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে এসে আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, চেহারাটা এমন খারাপ করলি কি করে? এ তো দেখছি ভীষণ শরীর ভেঙে গেছে।

বামাচরণ একটা শ্বাস ফেলে বলে, শরীর ভাল যাচ্ছে না। পেটে অম্বলের ব্যথা হয় খুব।

ইস্! অম্বল বড় খারাপ অসুখ। ওষুধ খাস।

বামাচরণ ভাল মানুষের মতো মাথা নেড়ে বলল, খাবো। আমাকে চাট্টি শুকনো মুড়ি দাও তো মা, পেটে কড়ার নিচে ব্যথা হচ্ছে। এই ব্যথাটাই আমাকে মেরে ফেলবে।

বালাই ষাট। আজকাল কত ওষুধ বেরিয়ে গেছে। কত ভাল ভাল ডাক্তার। বলে নয়নতারা ঘরে গিয়ে এক বাটি মুড়ি এনে দিল। বলল, একটু দুধ দিয়ে মেখে খাবি? ভাল দুধ আছে।

না মা। বলে মুড়ি চিবোতে থাকে বামাচরণ।

তা হলে শো কেটে দেবো?

বামাচরণ এ কথাটার জবাব না দিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, আচ্ছা, বাগানের ওপাশে কুয়োর ধারে অত ইট কেন বলো তো! ইঁট দিয়ে কী হবে?

বিষ্ণুপদ সতর্ক চোখে একবার নয়নতারার দিকে চাইল। কিন্তু নয়নতারার চোখ ছেলের দিকে। একগাল হেসে বলল, শুনিসনি বুঝি! কৃষ্ণ যে আমাদের ঘরখানা পাকা করে দিচ্ছে। ইঁট সিমেন্ট বালি সব এসে গেছে। আর দু’-তিন দিনের মধ্যে ভাঙা শুরু হবে।

বামাচরণ হাঁ করে মায়ের দিকে চেয়ে থেকে বেশ একটু বাদে বলল, কে পাকা করে দিচ্ছে?

কৃষ্ণ রে। আর কে দেবে?

বলো কি? এ খবর তো বাবা আমাকে বলেনি!

বিষ্ণুপদ একটা শ্বাস ফেলে বলল, ফুরসত দিলি কই?

বামাচরণ খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, পাকা ঘর মানে কি ছাদও ঢালাই হবে?

বিষ্ণুপদ কিছু বলার আগেই নয়নতারা বলে ফেলল, ও মা! ছাদ ঢালাই কী রে? মস্ত দোতলা হবে যে! তিনতলায় ঠাকুরঘর হবে, ছাদ থাকবে।

ওঃ। বলে বামাচরণ কেমন যেন হয়ে গেল। উত্তেজিত, ক্রুদ্ধ! মুড়ির বাটিটা হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তাও বাবা বলছে যে টাকা নেই? মিথ্যেবাদী কোথাকার! দালান হাঁকড়াচ্ছো, আর আমার ক’টা টাকা ফেলে দিতে হাত কুঁকড়ে যাচ্ছে!

নয়নতারা অবাক হয়ে বলে, কিসের টাকা? কে তোর টাকা নিয়েছে?

বিষ্ণুপদ তাড়াতাড়ি বলল, বামা আজ এ বাড়ির ভাগ বাবদ টাকা চাইতে এসেছে।

নয়নতারা অবাক হয়ে বলে, ভাগ বাবদ টাকা! সেটা আবার কী?

ও তুমি বুঝবে না।

বামাচরণ গলা তুলে বলল, বেশ আছ তোমরা! পায়ের ওপর পা তুলে দোতলা বাড়িতে থাকবে। আর আমার ব্যবস্থা কী হবে? আমার কথা একবারও ভাবলে না?

নয়নতারা বলল, তোর কথা কী ভাবব? তুই কি ভাবনার তোয়াক্কা করিস?

বামাচরণ ক্ষিপ্তের মতো লাফিয়ে উঠে বলল, তোমাদের সব ষড়যন্ত্র এখন বুঝতে পারছি। দাদার সঙ্গে আর রামজীবনের সঙ্গে ঘোঁট পাকিয়ে আমাকে তাড়িয়েছ যাতে বেশ ফাঁদিয়ে বড় বাড়ি তুলতে পারো! সব মতলব আমি বুঝতে পারছি। কী ভেবেছ তোমরা, আমাকে বঞ্চিত করে নিজেরা সব ভোগদখল করবে? আমি আজই উকিলের কাছে গিয়ে ইনজাংশন বের করব।

বিষ্ণুপদ বলল, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কর বাবা। একটু ঠাণ্ডা হয়ে বোস। ওরকম লাফালাফি করিস না। যা ভাবছিস তা নয়।

বামাচরণ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, আমি কিছু শুনতে চাই না। আমার টাকা দিয়ে দিন। আপনারা তিনতলা বাড়িতে থাকুন, আমি অন্য জায়গায় আমার ঘর তুলে নেবো। দিন টাকা।

কেন যে টাকা-টাকা করছিস! টাকা-পয়সা আমাদের কাছে থাকে না। কৃষ্ণ ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়ে দিচ্ছে। ঠিকাদারের সঙ্গে তার বন্দোবস্ত। এর মধ্যে আমরা নেই।

মিথ্যে কথা বলছেন। আপনাদের আমি খুব চিনি। বদমাইসের ধাড়ি আপনারা। টাকা না দিলে বাড়ি আমি কিছুতেই করতে দেবো না।

কোথাও কিছু নয়, হঠাৎ শান্ত নয়নতারা রুখে উঠে বলল, এই মুখপোড়া, চেঁচাচ্ছিস যে বড়, তোর লজ্জা হয় না?

লজ্জা! কিসের লজা?

তোর যদি মনুষ্যত্ব থাকত তা হলে চেঁচামেচি করে মা-বাপের সঙ্গে বীরত্ব না দেখিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতি। কৃষ্ণ আমার আর একটা ছেলে, তোরই ভাই, নিজের টাকা দিয়ে দুঃখী মা-বাবার জন্য বাড়ি করে দিচ্ছে। আর তুইও আমাদের আর একটা ছেলে, সারা জীবন কী করেছিস বল তো আমাদের জন্য? দু’ টাকার মিষ্টিও কখনও কিনে এনেছিস হাতে করে? রামজীবন মাতাল-বদমাস যাই হোক, যত বদনামই করিস, সেও বুক দিয়ে মা-বাপের জন্য করে। এসব দেখে তোর লজ্জা হয় না? মুখ লুকোতে ইচ্ছে করে না?

বামাচরণ কেমন একটু থতমত খেয়ে গেল। তবু একটু তেজ দেখিয়ে বলল, আমার টাকা থাকলে আমিও করতাম।

টাকা থাকলে করার লোক তুই? বউয়ের আঁচল ধরে এ বাড়ি থেকে বিদেয় হয়েছিস, ফের বউয়ের হুকুমেই এসেছিস ফন্দি করে টাকা আদায় করতে। তোর লজ্জাশরম থাকলে করতিস এরকমটা? বাপকে হুমকি দিচ্ছিস, সে নিরীহ লোক বলে। পারবি রেমোকে হুমকি দিতে? বিষদাঁত ভেঙে দেবে।

বামাচরণ তবু একবার তড়পানোর চেষ্টা করে, তা হলে তোমরা সবাই একজোট হয়েছ? সবাই মিলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি আরামে থাকবে? এই তোমাদের মনে ছিল তা হলে?

কে তোকে ফাঁকি দিয়েছে? তোর ঘর ওই তত পড়ে আছে। কেউ ঢোকেনি, দখলও করেনি। ইচ্ছে হলে ফিরে আসতে পারিস। তা কি আর তুই আসবি? সম্পত্তি সম্পত্তি করে হেঁদিয়ে মরছিস, ক’লাখ টাকার সম্পত্তি আমাদের? তোর বাবা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, ধারকর্জ করে এই ক’খানা ঘর তুলেছিল অনেকদিনের চেষ্টায়। তুই বাপের জন্য কিছু করিসনি, মায়ের কথা ভাবিসনি, সম্পত্তির ভাগের বেলায় খুব তো বুঝ আছে!

নয়নতারার এই তেজ বহুকাল দেখেনি বিষ্ণুপদ। ছেলেমেয়েদের কাছে ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকাই তার স্বভাব। আজ হঠাৎ এই তেজী ভাব দেখে বিষ্ণুপদ খুব অবাক হল। কিন্তু এই বয়সে উত্তেজনা ভাল নয়। রেগে গেলে প্রেশার চড়ে বসবে।

বিষ্ণুপদ বলল, ওগো, আর নয়। এবার চুপ করো। তোমার মুখ খুব লাল হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা হও তো।

নয়নতারা বলল, ঠাণ্ডা হবো? ওর লজ্জা করে না তোমাকে না তোক অপমান করে যেতে? এই সংসারের জন্য, মা-বাপের জন্য, ভাইবোনের জন্য ও কোনও কালে কিছু করেছে? যা, তোর বউকে গিয়ে বল আমরা পয়সাকড়ি দিতে পারব না, যা পারে করুক।

নয়নতারা আর বিষ্ণুপদ বরাবর একতরফা কথা শুনে যায়। কোনও দিন প্রতিবাদও করে না। আজ হঠাৎ নয়নতারার এই সাঙ্ঘাতিক রূপ দেখে বামাচরণ ঘাবড়ে গেল। শরীরও বোধ হয় যুতের নয়। ধপ করে দাওয়ার মেঝের ওপর বসে পড়ল। কিছুক্ষণ বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল চুপচাপ।

বিষ্ণুপদ নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, তুমি বরং একটা পান খাও।

আঁচলে মুখের ঘাম মুছে বলল, সংসার না নরক। সাধ্যি থাকলে বুড়োবুড়ি কাশীবাসী হতাম।

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলল, এও কাশী। এই কাশীতে পাপ ক্ষয় হবে তাড়াতাড়ি। একটু পান মুখে দাও।

রাঙা তাদের দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে খর চক্ষুতে এদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অবস্থাটা জরিপ করল। এতক্ষণ আশেপাশে থেকে সবই শুনেছে। চেয়ে থেকে তারপর ঘরে চলে গেল।

বিষ্ণুপদ জানে, কৃষ্ণজীবন যে দোতলা বাড়ি করে দিচ্ছে এটা কেউ ভাল চোখে দেখবে না। রামজীবনকে টেক্কা দিয়ে দিল কৃষ্ণজীবন। রামজীবনের পাকা ঘর এখনও শেষ হয়নি। ছাদ-ঢালাইয়ের মুখে গিয়ে থেমে আছে। টাকা নেই। কৃষ্ণজীবন বাড়ি করে দিচ্ছে শুনে সেও প্রথমটায় রেগে গিয়ে বলেছিল, এ তো জুতো মেরে গরু দান। ওর বাড়িতে তোমরা থাকবে কেন?

বিষ্ণুপদ বলেছে, সে আমাদের কোনও কালে অপমান করেনি, অনাদর করেনি। বরং তাকেই এখান থেকে তাড়ানো হয়েছিল। তার বাড়িতে থাকতে বাধা কী? আদর করে দিচ্ছে। তোর পাকা ঘর হোক, তোরও তো দরকার।

রামজীবন খুশি হয়নি। তবে মেনেও নিয়েছে।

নয়নতারা বলেছে, কৃষ্ণ যখন দোতলা বাড়িই করে দিচ্ছে তখন তুই-ই বা আলাদা ঘরে থাকবি কেন? নিচের তলায় তুই থাকবি, ওপরতলায় আমরা। আর বুড়োবুড়ি মরলে সবটাই তোর হবে।

রামজীবন এ কথাটা ভেবে দেখেছে। বলেছে, দাদার টাকা হয়েছে, করে দিচ্ছে। আমার টাকা নেই মা, কিন্তু আমার কলজেটা আছে।

জানি বাবা, খুব জানি। তোর মতো কলজে ক’টা ছেলের থাকে? কৃষ্ণকে ভুল বুঝিসনি বাবা, সে বড় ভাল ছেলে।

এইভাবেই মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু বামাচরণ আবার উৎপাত শুরু করল আজ।

বামাচরণ অনেকক্ষণ বাদে যখন মুখ তুলল তখন আর সেই তেজটা নেই। দুর্বল গলায় বলল, তা হলে আমার কী হবে বাবা?

বিষ্ণুপদ বলল, তোর আবার কী হবে? বউমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আয়। এখানেই থাক। সব দিক বজায় থাকবে তা হলে।

আপনাদের ঘরখানা আমারই পাওয়ার কথা ছিল, মনে আছে?

বিষ্ণুপদ একটু হেসে বলে, আমাদের ঘর আবার কি? আমার বয়স তো চলে গেছে। আর ক’দিন? পাকাবাড়ি দালান-কোঠা দেখে যেতে পারব কি না তাও ঠিক নেই। যদি বা দেখেও যেতে। পারি তবু ভোগ করব ক’দিন। যা থাকবে তোদেরই থাকবে। যদি বনিবনা করে থাকতে পারিস তবে আর চিন্তা কিসের?

দোতলাটা কে পাবে?

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, এটাও একটা ক্যাচালে প্রশ্ন। দোতলা কে পাবে সে তো দূরের কথা। আগে বাড়িটা হোক।

বামাচরণ কেমন যেন হতাশ হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, আমাকে রেমো ঢুকতে দেবে না। বাড়িতে। পাকাবাড়ি হলে ও সবটাই নেবে। দেখো।

তোর আর কতটাই বা দরকার? যদি আসতে চাস চলে আয়। তোর জন্য আমি আমার ঘরখানাই ছেড়ে দিয়ে যাবোখন। রামজীবন পিতৃভক্ত ছেলে, আমি বললে সে কথার অমান্য করবে না।

বামাচরণ তবু যেন উৎসাহ পেল না। বসে রইল। তারপর বলল, দাদাকে বলো-না, আমার ঘরখানা নিয়ে আমাকে টাকা দিয়ে দিক।

বিষ্ণুপদ তার এই লোভী সন্তানটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, সে কি কোটিপতি বলে ভাবিস? সে নামে বড়, টাকায় নয়। বউমাকে না জানিয়ে গোপনে জমানো টাকা দিয়ে বাড়ি করে দিচ্ছে। বলেছে, এ তার প্রায়শ্চিত্ত। এসব একটু বুঝে দেখ বাবা, একটু ভেবে দেখ। শুধু স্বার্থচিন্তা করলে মানুষ বড় ছোট হয়ে যায়।

বামাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর উঠে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *