যাত্রীবাহী স্টিমারটিতে প্রচণ্ড ভিড়। ডেকে তিল ধারণের জায়গা নেই, হাঁটাচলা করাই শক্ত। আগে-ভাগে যারা রেলিং-এর ধারে মাদুর বা সতরঞ্চি পেতে কিছুটা স্থান দখল করে নিয়েছে, তারা ভাগ্যবান। নীচের খোলে মানুষের ঠাসাঠাসিতে প্রায় দমবন্ধ হবার মতন অবস্থা। এরই মধ্যে কাচ্চাবাচ্চাদের যখন তখন কান্না, কিছু কিছু যাত্রীর পায়ে পা লাগিয়ে উচ্চ কণ্ঠে বিবাদ। কোথাও কোথাও বিবদমান দু পক্ষকে দেখে মনে হয়, এই বুঝি হাতাহাতি, ঘুষোঘঁষি শুরু হবে, তা অবশ্য হয় না, তবে সেই ঝগড়াতে অনেকটা সময় কেটে যায়। গৌহাটি পৌঁছতে চার দিন লেগে যাবে, একঘেয়ে যাত্রা, সময় কাটানোই প্রধান সমস্যা।
ভরত আর হেম প্রথমে একটু বসারও জায়গা পায়নি, সারেঙ-এর ক্যাবিনের কাছে কোনওক্রমে দাঁড়িয়ে ছিল। দু-জনের কাঁধে দুটি সতরঞ্চি মোড়া পুটুলি, তার মধ্যেই রয়েছে মোট তিনখানি রিভলবার ও গুলির বাণ্ডিল। গোয়ালন্দের ঝাল রান্না খেয়ে হেম বেশ কাহিল হয়ে গেছে, পেটের অবস্থা শোচনীয়, মুখেও সেই ছাপ পড়েছে। কথাবার্তা বন্ধ, দুজনে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে।
কাছেই চার পাঁচজন যুবকের একটি দল মাদুর বিছিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে বসেছে, হইহই করে তাস খেলছে। তাদের পাশে অন্য কেউ বসবার চেষ্টা করলেই খেঁকিয়ে উঠছে, এমনকী ঠেলে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করছে না। এ যেন অনেকটা গায়ের জোরে ভূমি দখলের মতন। ঘণ্টা তিনেক কেটে যাবার পর সেই দলের একজন ভরতকে জিজ্ঞেস করল, দাদারা কি সারা রাত এক ঠ্যাঙে খাড়া হয়েই কাটিয়ে দেবেন নাকি?
এই দু’জন যে অন্য যাত্রীদের মতন জায়গা খোঁজার জন্য একবারও ছোটাছুটি করেনি, তাতেই ওরা স্বতন্ত্র ও দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আগেই ওরা ঠিক করে নিয়েছিল, নিছক ভদ্রতার কথা ছাড়া কোনও সহযাত্রীর সঙ্গেই ভাব জমাবার চেষ্টা করবে না। পূর্ববঙ্গের লোকেরা যেমন অতিথি-পরায়ণ, তেমনই কৌতূহলী। কোথা থেকে আসছেন, কোথায় যাবেন, কেন যাবেন, বাড়ি কোথায়, এই সব প্রশ্ন করতে করতে তারা সাতপুরুষের ঠিকুজি কুষ্ঠি না জানা পর্যন্ত নিবৃত্ত হয় না। এবং জোর করে বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে চায়।
লোকটির প্রশ্ন শুনে ভরত শুধু একটুখানি হাসির উত্তর দিল।
সেই লোকটি আবার বলল, তাস খেলতে জানেন নাকি, তা হলে এসে বসুন, দু হাত হয়ে যাক।
ভরত তাস-পাশা কিছুই খেলতে শেখেনি। হেম অবশ্য জানে, কিন্তু এখন তার খেলার মতন মর্জি নেই। ওরা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল।
লোকটি বলল, আপনারা বেডিং ঘাড়ে করে বইছেন কেন, ওগুলো অন্তত এখানে নামিয়ে রাখুন।
ভরত বলল, না, আপনাদের খেলার অসুবিধে হবে। আমরা ঠিক আছি।
লোকটি এবার উঠে এল ওদের পাশে। অন্য যাত্রীদের একবার দেখে নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, এই স্টেশনের পরের স্টেশন, রাত্তির ন’টার সময় আমরা নেমে যাব। আগে থেকে আপনারা আমাদের জায়গায় বসে পড়ন, নইলে সে সময় কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যাবে।
এ রকম অযাচিত সাহায্য ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার চিন্তায় মনের মধ্যে বেশ বিরক্তির সৃষ্টি হচ্ছিল। ভরতরা এসে বসতেই এরা তাস খেলা বন্ধ করে প্রশ্ন শুরু করে দিল। রাশি রাশি মিথ্যে কথার ভার নিতে হল ভরতকে। হেম ঝিম মেরে রইল।
যুবকেরা নেমে যাবার পর বিছানা পেতে পা ছড়িয়ে বসে ভরত বলল, শুভ সূচনা! ভাগ্য আমাদের প্রতি প্রসন্ন মনে হচ্ছে। রাত্তিরে আমাদের ভাল করে ঘুমোত হবে, শরীর পুরোপুরি সুস্থ রাখা দরকার।
হেম বলল, তা হলে আমি এখনই ঘুমিয়ে পড়ি!
ভরত বলল, সে কী! কিছু খাবে না? ভারী মনোরম রান্নার সুবাস আসছে। আমার তো পেট চনমন করছে।
হেম বলল, ও তো মুসলমান খালাসিদের ক্যান্টিন।
ভরত বলল, তাতে কী! আমাদের তো এখন আর কোনও নিয়ম-কানুন মানার বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা যা খুশি খেতে পারি।
হেম বলল, সে জন্য বলছি না। মুসলমানরা নিশ্চয় আরও বেশি ঝাল দেয়। আমার মেদিনীপুরি পেটে ও ঝাল সহ্য হবে না। তোমার ইচ্ছে হয়, তুমি খেয়ে এসো!
ভরত বলল, গন্ধ শুকেই বুঝতে পারছি, কুকুট মাংস। একেবারে অমৃত! কোনও হিন্দুর দোকানে তো ও জিনিস পাবে না। ঝাল হলেই বা কী, জলে ধুয়ে নেবে! তুমি ওই নিষিদ্ধ পক্ষীটি কখনও খেয়েছ?
হেম বলল, একবার খেয়েছি। বাজি ফেলে। আমাদের ওখানে এক পণ্ডিতমশাই বলে বেড়াতেন যে মুরগি খেলে নাকি কুষ্ঠ হয়। সেই জন্যই হিন্দুরা মুরগির ডিম পর্যন্ত খায় না। সেই পণ্ডিতমশাইকে তোমার ওই খামরবাড়িতে একদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর তার সামনে একটা ঝলসানো মুরগির ঠ্যাঙে কামড় দিয়ে বলেছিলাম, এই যে খাচ্ছি, দেখি কতদিনে আমার কুষ্ঠ হয়! তা দেখে পণ্ডিতমশাই চোঁ-চা দৌড়।
ভরত হাসতে হাসতে বলল, মুসলমান মোল্লারাও শুয়োরের মাংস সম্বন্ধে ওই রকম আজগুবি কথা বলে। সাহেব জাতটা গরু-শুয়োর-মুরগি খেয়ে ভুষ্টিনাশ করছে, কই তাদের তো কুষ্ঠ হয় না, জাতও যায় না। মানুষের যা খেতে ভাল লাগে, তাই খাবে। কথায় বলে, আপ রুচি খানা। খাদ্য নিয়ে কোনও সংস্কার থাকা কাজের কথা নয়। মুরগির মতন এমন সুখাদ্য আর কখনও খাওয়ার সুযোগ পাব না বোধহয়, চলো, সাধ মিটিয়ে খেয়ে আসি।
দীর্ঘ যাত্রাপথ, তাই স্টিমারে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান আছে। হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা। অনেক যাত্রীই সঙ্গে চিড়ে-খই, গুড়কলা নিয়ে আসে, তাই দিয়ে জঠর পুর্তি করে। হিন্দুদের দোকানগুলিতে পাওয়া যায় মোয়া, জিলিপি-অমৃতি, নারকোল তক্তি, বাসি লুচি-তরকারি। মুসলমান খালাসিরা একটা ক্যান্টিন চালায়, সেখানে গরম গরম ভাত আর ইলিশের ঝোল বা মুরগির ঝোল। হিন্দুদের কাছে নিষিদ্ধ হলেও কোনও কোনও হিন্দু যাত্রী লোভে লোভে লুকিয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে।
সত্যিই মুরগির ঝোলের অপূর্ব স্বাদ হয়েছে। ঝাল আছে ঠিকই, ভরতের তাতে অসুবিধে নেই। সে খেয়ে নিল অতি সন্তোষের সঙ্গে। হেম মাংসের টুকরোগুলি ধুয়ে নিল জলে, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত তার বিশেষ পছন্দ।
ভরত বলল, যে কদিন আমরা স্টিমারে থাকব, দু বেলাই এখানে খাব। ভাল খাওয়া আর ভাল ঘুম, এখন বিশেষ প্রয়োজন। ব্যারিস্টার রসুল সাহেবের বাড়িতে আমার এক বন্ধু ইরফানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, মনে আছে? ওই ইরফান আমাকে অনেকবার মুরগি বেঁধে খাইয়েছে। এক সময় আমরা খুব বন্ধু ছিলাম। সেই ইরফান এখন বদলে গেছে।
হেম জিজ্ঞেস করল, ওর সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল?
ভরত বলল, হ্যাঁ, আরও দু’বার। দেখা হলেই তর্ক হয়। ইরফান এখন ঢাকায়। আমায় বলে গেল, নবাব সলিমুল্লার সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সে একটা পার্টি গড়তে চায়। যে পার্টি শুধু মুসলমানদের স্বার্থ দেখবে, নাম হবে মুসলিম লিগ।
হেম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শুধু মুসলমানদের জন্য পার্টি! এতদিন এ দেশে শুধু ধর্মের নামে কোনও দল ছিল না। মুসলিম লিগ নামে কোনও পার্টি যদি সত্যিই চালু হয়, তা হলে রেষারেষি করে হিন্দুরাও কোনও দল খুলবে! মুসলিম লিগ বনাম হিন্দু লিগ। তাতে ইংরেজরা খুশি হয়ে বগল বাজাবে। ওরা তো এটাই চায়। আমরা ওদের হাতের পুতুল হয়ে খেলছি। ওরা আঙুল নাড়বে, আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করব!
ভরত বলল, ইরফান বলে, তোদের একটা হিন্দু দল তো অলরেডি আছে। নামে না হলেও কংগ্রেসটাই তো একটা হিন্দু দল! আমি যত বলি, কংগ্রেসে অনেক মুসলমান আছে, তারাও বিবেকবান, বুদ্ধিমান, ইরফান সে কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। শেষ যেদিন দেখা, সেদিন বলল, তোরা যে ছোট ছোট গুপ্ত দল পাকাচ্ছিস, তাও আমরা জানি। তোরা সব বঙ্কিমচন্দ্রের চেলা হয়েছিস। জায়গায় জায়গায় আনন্দমঠ গড়তে চাস। তোরা এক একজন জীবানন্দ, সত্যানন্দ হয়ে হিন্দু শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিস, তাতে আমরা হাত মেলাতে যাব কী দুঃখে! বঙ্কিমবাবু ওই আনন্দমঠে ‘মার মার ইংরেজ মার’ কেটে দিয়ে মার মার যবন মার’ করেছিলেন, তোর মনে নেই? তোরা ভুলে গেলেও আমরা ভুলব কী করে?
হেম বলল, কথাটা একেবারে ভিত্তিহীন নয়। আমাদের নেতারা হিন্দুয়ানির বাড়াবাড়ি করে মুসলমানদের দূরে ঠেলে দিচ্ছেন তো বটেই। এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। শিলং থেকে ফিরে গিয়ে নেতাদের বোঝাব। বারীনের দাদা অরবিন্দবাবুকেই আমরা প্রধান নেতা বলে মানি, তিনি দিন দিন যে-রকম গোঁড়া হিন্দু হয়ে উঠছেন–
ভরত বলল, শিলং থেকে ফিরে গিয়ে? আমরা ফিরব?
দুজনেই হঠাৎ থেমে গেল। তারপর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল।
দিনের বেলা উৎকট গরম ছিল, এখন বাতাস বেশ আরামদায়ক। কৃষ্ণপক্ষের রাত, কিছুই দেখা যায় না, শুধু স্টিমারের গতিপথে নদীর বিক্ষুব্ধ তরঙ্গরাশির শব্দ শোনা যায়। আকাশ একেবারে অদৃশ্য।
খেয়েদেয়ে এসে হেম আগে শুয়ে পড়ল। ঘুমও এসে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বাদে কী কারণে যেন জেগে উঠল সে। পাশে তাকিয়ে দেখল, ভরত তখনও শোয়নি। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে স্থির হয়ে বসে আছে।
স্টিমারের আর সব যাত্রী যে-যেখানে পারে শুয়ে পড়েছে, অনেকে বসে বসে ঢুলছে। একজনও জেগে নেই, শোনা যাচ্ছে নানা রকম নাসিকাধ্বনি।
হেম ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, এ কী ভরত, তুমি শোবে না? তুমিই যে বলেছিলে, আমাদের ভাল ঘুম দরকার!
উত্তর না দিয়ে ভরত মুখ ফেরাল। একটু চমকে উঠল হেম। হঠাৎ যেন ভরতের মুখোনি অচেনা হয়ে গেছে। এত কাছে, তবু ভরতের দৃষ্টির মধ্যে যেন অনেকখানি সুদুর। একটা ঝোলানো হ্যাঁজাক বাতি দুলছে অনবরত, তার আলো-ছায়া খেলা করছে সর্বাঙ্গে। বি।
একটুক্ষণ পরে ভরত ধীর স্বরে বলল, গৌহাটি পৌঁছাতে চার দিন লাগবে। সেখান থেকে শিলং যেতে আর একদিন। তার পরদিনই অ্যাকশান শুরু করতে পারি। ধরা যাক, যদি আরও একদিন বেশি লাগে, তা হলে মোট সাতদিন। এই সাতদিন আমাদের আয়ু আছে।
হেম কিছু না বলে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল বন্ধুর দিকে।
ভরত আবার বলল, যদি একজন দেবদূত এখন এসে বলে, তোমাদের আর সাতদিন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, এর মধ্যে যদি বিশেষ কোনও সাধ-আহ্লাদ থাকে, মিটিয়ে নিতে পারো–তা হলে তুমি কী চাইবে, হেম?
হেম বলল, উ, সাধ-আহ্লাদ, মানে, সে রকম ঠিক ভেবে দেখিনি, কারুর কাছে কিছু চাইবার, মানে, আসল কথাটা কী, আমি ওসব দেবদূত-টেবদূতে বিশ্বাস করি না।
ভরত বলল, আমিও যে ঠিক বিশ্বাস করি, তা নয়। তবে ছেলেবেলা থেকে শুনতে শুনতে মনের মধ্যে কিছু কিছু ছাপ পড়ে যায়। আচ্ছা, দেবদূত না হয় না-ই এল, তোমার কোনও অপূর্ণ সাধের কথা মনে পড়ে না?
হেম বলল, আমরা চলেছি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে, এর মধ্যে তো আর কোনও সাধ মেটাবার উপায় নেই। সে রকম কিছু অপূর্ণ সাধ.. নাঃ, আমার কোনও কিছুতে লোভও নেই, অতৃপ্তিও নেই। ভরত, তুমিই বরং বলল, তোমার কী অপূর্ণ সাধ?
ভরতের চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে এল, মাথা দোলাতে লাগল দুদিকে। সে মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারবে না। একটি নারীর মুখ চকিতে চকিতে তার মনে পড়ে যাচ্ছে। সে নয়নমণি নয়, সে অনেকদিন আগের দুঃখিনী ভূমিসূতা।
হেমের ঘুম চটে গেছে, সে একটা সিগারেট ধরাল। একটুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, একটা ব্যাপারে এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তুমি কেন যাচ্ছ আমার সঙ্গে? কেন জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ? তোমার আমার কথা দলের কেউ জানে না, তুমি এখনও তো ফিরে যেতে পারো।
ভরত বলল, আমার যাবার ব্যাপারে কোনও অস্পষ্টতা নেই। তুমি কেন যাচ্ছ, সেটাই বরং পরিষ্কার নয়। আমি যাচ্ছি বন্ধুর জন্য। এক বন্ধু যদি প্রাণের ঝুঁকি নেয়, আমি তার পাশে দাঁড়াব না? তা হলে বন্ধু কীসের? এটা খুব সোজা ব্যাপার। কিন্তু প্রথমে তুমি কেন এ দায়িত্ব নিতে গেলে? এত লোক থাকতে, তুমি প্রাণ দেবার জন্য ব্যাকুল হলে কেন?
হেম বলল, এর উত্তর আমি আগেই তোমাকে দিয়েছি।
ভরত বলল, আর একটা কথা তোমাকে বলি। ফুলার সাহেবকে মারলেই কি দেশোদ্ধার হবে? এ রকম আরও কত শত ফুলার সাহেবকে মারতে হবে। ধর্ম মানো কিংবা না-ই মানো, তবু এক ধরনের কালচারের মধ্যে তো আমরা মানুষ হয়েছি, দেশের নামেই হোক আর যে-নামেই হোক, নরহত্যা কি আমাদের বিবেকের সায় দেয়? দেশ নামে একটা ভাববস্তুর জন্য নিজের প্রাণ দেওয়াটাও কি মূখামি নয়? মানুষ যখন জন্মায়, তখন তার কোনও দেশ থাকে না, জাত থাকে না, ধর্ম থাকে না। এই পৃথিবীতে সে মনুষ্যজাতির একজন হয়ে জন্মায়। আবার মানুষ যখন মরে, তারপরেও দেশ-টেশ সব তুচ্ছ হয়ে যায়। যতদিন বেঁচে থাকো, ততদিনই দেশপ্রেম, ততদিনই নিজের গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বন্ধুবান্ধব। সুতরাং যতদিন সম্ভব বেঁচে থাকলেই তো এগুলো উপভোগ করা যায়, প্রাণটা শুধু শুধু নষ্ট করলে তো এসব কিছুই থাকে না।
হেম ক্ষীণ হেসে বলল, তুমি বড় অদ্ভুত মানুষ। তুমি যা যুক্তি দেখালে, সে-ই অনুযায়ী তোমারই তো ফিরে যাওয়া উচিত। বেঁচে থাকো, জীবনটাকে উপভোগ করো। আমি যখন একটা দায়িত্ব নিয়েছি, ঠিক হোক, ভুল হোক, আমাকে সেটা পালন করতেই হবে।
ভরত বলল, উহুঃ, এটা মোটই ঠিক কথা হল না। দায়িত্ব হস্তান্তর করা যায়। বিশেষত সমিতির কোনও কাজে একজনের বদলে অন্য একজন দায়িত্ব তো নিতেই পারে। তোমারই ফিরে যাওয়া উচিত। কাজটা আমিই একলা সেরে ফেলতে পারব। আমার চাল-চুলো নেই, বিশ্ব সংসারে আমার কেউ নেই, আমি মরলাম না বাঁচলাম, তাতে কারুর কিছু যায় আসে না।
হেম বলল, তোমার যদি মনে হয়, দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ায় কোনও সার্থকতা নেই, তা হলে শুধু শুধু প্রাণ দেবে কেন?
ভরত বলল, শুধু শুধু তো নয়। দেশের জন্যও নয়, এমনকী তোমার জন্যও নয়, একজন বন্ধুর জন্য। বন্ধুর জন্য কি মানুষ প্রাণ দেয় না? তাতে কত তৃপ্তি! সকালে যে স্টেশন আসবে, বোধহয় চাঁদপুর, তাতে তুমি নেমে যাও, আমি বারীনের সঙ্গে ঠিক যোগাযোগ করে নেব!
হেম বলল, বাঃ বেশ! ধরো তোমার কথামতন আমি পরের স্টেশনেই নেমে পড়ে ফিরে গেলাম গুটিগুটি। আবার সাজলাম সংসারী। তারপর একদিন খবর পেলাম, সাহেব মারতে গিয়ে তুমি প্রাণ দিয়েছ। এতে তুমি তৃপ্তি পেলে, তুমি মহান হলে। তোমাকে বিরাট দেশপ্রেমিক বানানো হবে, তোমার নামে গান লেখা হবে, ছেলে-ছোঁকরাদের মধ্যে তোমার আদর্শ তুলে ধরার জন্য ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথাও ছড়ানো হবে। আর আমার কী হবে? আমি সারা জীবন হয়ে থাকব এক স্বার্থপর! কাপুরুষ! ঘনিষ্ঠ মহলে যারা আসল ঘটনাটা জানে, তারা সব সময় আমার দিকে তাকিয়ে প্রকাশ্যেই হোক বা মনে মনেই হোক, বলবে, নিজের জানটা বাঁচিয়ে তুমি ভরতকে বলির পাঁঠা করলে? চমৎকার! এই নিয়ে আমি বেঁচে থাকব?
ভরত বলল, তুমি বেশি বেশি বাড়াচ্ছ। অত শত কেউ জানবেই না। আমি কিছুতেই ধরা দেব, ফাঁসিতে ঝুলব না, সঙ্গে সায়েনাইড বিষ এনেছি, সাহেবটাকে খতম করার পর সেপাইগুলো যদি আমায় ঘিরে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে বিষ খাব। কেউ আমাকে চিনবে না। কেউ আমার পরিচয় জানবে না, আমার লাশটা পুঁতে দেবে কিংবা পুড়িয়ে ফেলবে। ব্যাস, আমি হারিয়ে যাব! আমাদের দলের কেউ জানেও না যে আমি তোমার সঙ্গে এসেছি, অন্যরা জানবে কী করে?
হেম বলল, তোমার এ রকম হারিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ততা কেন?
ভরত বলল, ওই যে বলোম, এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমার বেঁচে থাকার কোনও প্রয়োজনই দেখি না। কী হবে আর বেঁচে থেকে। তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে, আমি বসে বসে সেই কথাটাই ভাবছিলাম। তুমি শুধু শুধু কেন প্রাণ দিতে যাবে? তুমি বেঁচে থাকলে সমিতির অনেক কাজ করতে পারবে। তোমার কথা অনেকে মানে। আমার কোনও গুরুত্ব নেই।
হেম বলল, কে বলল, দুনিয়ায় তোমার কেউ নেই। নিশ্চয়ই আছে।
ভরত ঈষৎ চমকে উঠে বলল, কে আছে?
হেম বলল, এই দুনিয়াটাই তোমার আছে।
এ রকম কথার পিঠে কথা চলল প্রায় সারা রাত ধরে। ভোরের দিকে দুজনেই একটু ঘুমোল, কিন্তু সকাল হতেই অন্য যাত্রীদের কলস্বরে জেগে উঠতে হল।
সারাদিন ধরে দেখা যায়, মানুষের ঘোট ঘোট স্বার্থের জন্য বিবাদ। সকলেই যেন জীবনটা আঁকড়ে থাকার প্রবল চেষ্টায় নিরত। শুধু নিজের জীবন, বড়জোর পরিবারের অন্যদের জীবন, তার বাইরে বাকি লোকেরা বাঁচুক বা মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এর মধ্যে বসে আছে এই দুজন, দুজনেই পরস্পরকে ফেরাবার চেষ্টা করছে, অথচ একজনকে ছেড়ে অন্যজন কিছুতেই যাবে না।
মাঝখানে একবার স্টিমার বদল করে ওরা চতুর্থ দিনে এসে পৌঁছল গৌহাটিতে। এর মধ্যে একদিনও স্নান করা হয়নি, গায়ের গেঞ্জি-জামা ঘাম চিটচিটে হয়ে গেছে। এখানে অনেক ধর্মশালা রয়েছে, পুণ্যার্থীরা কামাক্ষা মন্দির দর্শন করতে আসে। একটা ধর্মশালায় আশ্রয় নিয়ে ওরা কুয়োর জলে ভাল করে স্নান সেরে নিল। আজই শিলঙে যাত্রা করতে হবে, শিলং শীতের জায়গা, ওদের সঙ্গে গরম কাপড় কিছু নেই, দুটো চাদর অন্তত কেনা দরকার। সে জন্য দোকানের দিকে এগিয়েও ওরা থমকে গেল। ব্যবহার করা হবে মাত্র দু-তিন দিন, তার জন্য পয়সা নষ্ট করার কী দরকার, শীত সহ্য করাই ভাল। বরং ওই পয়সায় আলাদা টাঙ্গা ভাড়া করা যেতে পারে।”
সাধারণ যাত্রীবাহী টাঙ্গায় গাদাগাদি করে সাত-আটজন যায়, পয়সা কম লাগে। পাহাড়ের ওপর দিয়ে অনেকখানি পথ, ওই ভাবে যেতে বেশ কষ্ট হয়, তা ছাড়া অন্য যাত্রীরা মুখ চিনে রাখতে পারে। শুধু দু-জনের জন্য একটা আলাদা টাঙ্গা ভাড়া করা হল। শেষ কটা দিন এটুকু আরাম করলে দোষ নেই।
ভরতের কাছে বেশ কিছু টাকা রয়েছে। আর ফিরতে হবে না। এই জন্য মেসবাড়ির এক ব্যক্তির কাছে মেদিনীপুরের খামারটা বিক্রি করবে বলেছিল। সেই লোকটিও মেদিনীপুরের, খামারটা দেখেছে, কিন্তু পুরো দাম দিতে পারবে না বলে বন্ধক নিয়েছে।
সমতল ছাড়াবার পর দুপাশের দৃশ্য অতীব মনোহর। ছোট ছোট পাহাড়ের সারি, কোনও পাহাড়ের চূড়ায় জমে আছে মেঘ, কত রকম নাম-না-জানা গাছ, মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝনা। ভরত উত্তর ভারতের বহু অঞ্চল ঘুরেছে, সেই তুলনায় হেমের অভিজ্ঞতা কম। সে আগে পাহাড় দেখেনি। যে মুগ্ধ হয়ে দেখছে পথের শোভা। নিজেদের টাঙ্গা বলেই ইচ্ছেমতন থামানো যায়। এক একবার কোনও ঝর্না দেখে টাঙ্গা থামিয়ে হেম ছুটে যাচ্ছে, তার ঠিক যেন বালকের মতন ফুর্তি। একবার ভরত তার পাশে বসে আঁজলা ভরে জল তুলে বলল, দেখো, এই জল কী ঠাণ্ডা, কী স্বচ্ছ, কী পবিত্র! কী মধুর কুলুকুলু শব্দ। ইচ্ছে করে, এ রকম একটা নির্জন ঝর্নার পারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে।
হেম এক সময় ছবি আঁকত, অনেকদিন পর হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে তার শিল্পী সত্তা। থাকে থাকে নেমে যাওয়া উপত্যকা ও দূরের পাহাড়ি গ্রামের দিকে তাকিয়ে সে বলল, যদি এই জায়গাটার একটা ছবি আঁকতে পারতাম!
এই অঞ্চলের সঙ্গে ভরত ত্রিপুরার বেশ মিল দেখতে পাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক কথা। এই আসাম তার মায়ের দেশ। তার দুখিনি মায়ের কোনও ছবিও সে দেখেনি। এখানকার মাটিতে তার শেষ নিশ্বাস পড়বে, মা তাকে বুকে তুলে নেবে।
একটা ছোট গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি চায়ের দোকান। এমনই ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ যে এখানে থামতেই হয়। দোকানটির সামনে বাঁশের বেঞ্চি করা আছে। চা ছাড়া কমলালেবু আর মধু বিক্রি হচ্ছে সেখানে। তিনটি ফরসা, ফুটফুটে শিশু খেলা করছে ধুলো মেখে। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভরতের হঠাৎ চোখে জল এসে গেল। যেন সে নিজের ওই বয়েসটা দেখতে পাচ্ছে। তিনটে কমলা কিনে সে বাচ্চাদের দিতে গেল, তারা কিছুতেই নেবে না। বোধহয় কমলায় তাদের অরুচি ধরে গেছে।
এ পথ দিয়ে অনবরত টাঙ্গা যাওয়া-আসা করছে। সকলেরই খুব ব্যস্ততা। সন্ধের পর রাস্তাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, ভাল্লুকের উৎপাত আছে, তা ছাড়া ঠ্যাঙ্গাড়ের দলও লুটপাট করে।
ভরত আর হেম বেশ তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছে, তাদের পাশ দিয়ে একটা টাঙ্গা চলে গেল, তাতে বসে আছে একজন মাত্র যাত্রী। পায়ের ওপর পা তোলা, গায়ে শাল জড়ানো, হাতে সিগারেট, রীতিমতন ফুলবাবু। চলে যাবার পরেই ভরত বলল, লোকটিকে চেনা চেনা মনে হল না?
হেম বলল, বারীন?
থামো থামো বলে চেঁচিয়ে সে টাঙ্গাটার পেছনে ছুটতে লাগল, টাঙ্গাটা থামল একটু পরে। মুখভর্তি দাড়ি রেখেছে বলে বারীনকে প্রথমটায় চিনতে পারা যায়নি।
টাঙ্গা থেকে নেমে এসে বারীন বলল, হেম! ইস, তুমি দেরি করে ফেললে?
হেম বলল, কই দেরি তো করিনি। খবর পাওয়া মাত্র বেরিয়ে পড়েছি একটা বেলাও নষ্ট করিনি।
বারীন বলল, হা, তুমি দেরি করোনি, কিন্তু আসলে দেরি হয়ে গেছে। কী চমৎকার সুযোগ ছিল। ফুলার সাহেব রোজ সকালে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যায়। একা। তাকে ফলো করে নিরিবিলি রাস্তায় আমি একটা স্পট ঠিক করেছিলাম। সেখানে বোমা ছুঁড়লে ঘোড়া সমেত ছোটলাটকে ঘায়েল করা যেত, তুমিও পালাবার অনেক সময় পেতে। ধরা পড়ার চান্স খুব কম।
হেম জিজ্ঞেস করল, সেটা কাল করা যাবে না? দেরি হবে কেন?
বারীন বলল, ফুলার সাহেব গতকালই গৌহাটিতে নেমে এসেছে। শিলং-এ আর কিছু করা যাবে না!
হেম বলল, যাঃ। এখন তা হলে.. তা হলে আমাদের আর শিলং যাবার কোনও মানে হয় না। গৌহাটিতে ফিরে যাব?
বারীন জিজ্ঞেস করল, আমাদের মানে? তোমার সঙ্গে আর কে এসেছে?
হেম বলল, ভরত। ওর সঙ্গে মাঝপথে দেখা হয়ে গেল। কিছুতেই আর ছাড়তে চাইল না।
বারীন উৎকট মুখভঙ্গি করে বলল, দেখো হেম, বিপ্লব ছেলেখেলা নয়। যখন তখন জীবনমরণের প্রশ্ন। ভরত কি তা বোঝে? যাই হোক, অ্যাকশানের কথা যখন জেনে ফেলেছে, তখন ওকে আর বাইরে রাখা যাবে না। তোমরা শিলং-এ কয়েকদিন থাকো। আমি গৌহাটি গিয়ে ফুলারের গতিবিধির হদিশ করছি তারপর তোমাদের ডেকে পাঠাব।
পকেট থেকে একটা নোটবুক ও পেন্সিল বার করে এক জায়গায় খসখস করে সে কিছু লিখল। তারপর সেই পাতাটা ছিঁড়ে হেমকে দিয়ে বলল, একজনের নাম-ঠিকানা দিলাম, এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে তোমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। খুব সাবধানে থাকবে। ওখানে আমার একটা গোলমাল হয়েছিল, তাই দেখছ না ছদ্মবেশ ধরেছি!
বারীন টাঙ্গায় উঠে পড়ল, হেম চায়ের দোকানে ফিরে এসে ভরতকে বলল, আরও কয়েকদিন আয়ু বৃদ্ধি হয়ে গেল আমাদের। পাখি উড়ে গেছে। চলো, শিলং শহরটা কেমন ঘুরে দেখা যাক।
বারীন যার নাম লিখে দিয়েছিল, সেই লোকটিকে খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। তার নাম পরেশ, বাজারের মধ্যে একটি দর্শকর্ম ভাণ্ডারের মালিক। বেঁটে মতন, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, চক্ষু দুটিতে দৃঢ়তার ছাপ আছে। নিছক দোকানদারি করে জীবন কাটিয়ে দিতে চায় না, এখানে সে একটা সমিতি। গড়েছে, অনেকটা সময় সেই সমিতির কাজে ব্যয় করে।
পরেশ ওদের নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর সে বলল, আপনারা ইচ্ছেমতন ঘুরে বেড়াতে পারেন কিন্তু বারীন ঘোষের সঙ্গে যে আপনাদের সম্পর্ক আছে সে কথা স্থানীয় বাঙালিদের জানাবার দরকার নেই। আপনারা আমার আত্মীয়, এখানে এমনিই বেড়াতে। এসেছেন, এই কথাই বলব সবাইকে।
কথায় কথায় জানা গেল, বারীন এখানে বেশ একটি গোলমাল পাকিয়ে গেছে। বারীন বেশি। কথা বলতে ভালবাসে, সে যে ফুলার হত্যার জন্য এখানে এসেছিল, সে কথা প্রায় কোনও বাঙালিরই জানতে বাকি নেই। সে যে কত বড় বিপ্লবী তার প্রমাণস্বরূপ অস্ত্রশস্ত্রগুলিও অনেককে দেখিয়েছে। বোমা থেকে খানিকটা বারুদ বার করে ফস করে আগুন জ্বেলে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তাদের। একজন আনাড়ির হাতে সে একটা রিভলবার তুলে দিয়েছিল, সে একটু নাড়াচাড়া করতেই গুলি ছুটে যায়, সেই গুলি লোকটির হাতের তালু ভেদ করে গেল। উপায়ান্তর না দেখে লোকটিকে ভর্তি করতে হল হাসপাতালে। সেখান থেকে পুলিশে রিপোর্ট গেল। শিলং-এর মতন শান্তিপূর্ণ জায়গায় কোনও রকম গণ্ডগোলের আশঙ্কার কথা পুলিশ বিভাগ এখনও চিন্তা করে না। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হল বটে কিন্তু ভয় ঢুকে গেল স্থানীয় লোকদের মনে। এর পর ফুলার বধ হলে পুলিশ এই সব বাঙালিদের নিশ্চিত ধর-পাকড় করবে। বিপ্লবের নাম শুনে যারা। উৎসাহিত হয়েছিল, পুলিশের ছায়া দেখেই তারা অচ্ছুত মনে করতে লাগল বারীনকে। সেইজন্যই বারীনকে এখান থেকে সরে পড়তে হয়।
হেম বারীনের মনোভাব অনেকটা বোঝে। বিপ্লবের প্রধান মন্ত্রগুপ্তিই যে গোপনীয়তা তা বারীনের মনে থাকে না। তার এই দেখানেপনা অবশ্য নিছক আত্মশ্লাঘার জন্য নয়, সে মনে করে, এইভাবে বিপ্লবের কথা প্রচার করলে আরও অনেককে দলে টানা যাবে। অন্য অনেক শহরে যে বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, দলে দলে যুবকেরা প্রস্তুত, এই রকম অনৃত ভাষণেও দ্বিধা নেই তার।
কোনও কাজ নেই, হেম আর ভরত পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। শৈলনগরী শিলং বেশ জনবিরল। চতুর্দিকে বড় বড় ঝাউগাছ, তার ফাঁকে ফাঁকে বাড়িগুলি যেন লুকিয়ে আছে, সাহেব-মেমের সংখ্যাই বেশি, যখন তখন বৃষ্টি নামে বলে সকলেই রঙিন ছাতা রাখে সঙ্গে। পথের ধারে ধারে দোকানগুলি সুন্দরভাবে সাজানো। এ শহরে আজও মোটরগাড়ি আসেনি, উঁচু-নিচু রাস্তায় অন্য যানবাহন চালানোও কষ্টকর। প্রায় সকলেই পদব্রজে ঘোরে। শহরের উপান্তে খাসিয়াদের ছোট ছোট বাড়িগুলি ঠিক ছবির মতন। এদের মধ্যে দারিদ্র্য আছে যথেষ্ট, তবু মানুষগুলি হাসিখুশি, মেয়েরা এক সঙ্গে দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে যায়।
শহরের প্রায় মধ্যেই একটা ছোট পাহাড়। তার চূড়ায় খানিকটা সমতল জায়গা, সেখানে অনেকে চড়ইভাতি করতে আসে। ভরত আর হেম যেদিন অপরাহে সেখানে উঠে এল, তখন সেখানে আর কেউ নেই। চারিদিকে গোল হয়ে আছে পৃথিবী। এখান থেকে মনে হয় যেন সবটাই পাহাড়ের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। একদিকে সূর্যাস্ত হচ্ছে, কিন্তু তেমন বর্ণময় নয়, যেন একটা মেঘলা পাহাড়ের আড়ালে ইচ্ছে করে লুকিয়ে পড়ছে সূর্য। মাথার ওপরের আকাশ এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অমলিন নীল। বাতাসে হিমেল স্পর্শ। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দিক দেখতে দেখতে কেমন যেন একটা দৈব মহিমার কথা মনে হল।
ভরত অনেকটা আপন মনেই বলল, এই যে নীলাকাশ, তার ওপারে সত্যিই কি কিছু নেই?
হেম বলল, একদিন তো সেরকমই বিশ্বাস করে এসেছি। আর কদিন পরই ঠিক ঠিক প্রমাণ পাওয়া যাবে!
ভরত বলল, পৃথিবীটা ভারী সুন্দুর, তাই না?
হেম বলল, এতদিন ভাল করে দেখা হয়নি। শুধু পাহাড় কিংবা সমুদ্র নয়, একটা চুপচ প ফাঁকা মাঠ, যতদূর চোখ যায়, মাঝখানে একটা বড় ঝাঁকড়া গাছ, সেই গাছের নীচে অনেকক্ষণ বসে থাকা, কেউ শুনবে না, শুধু আপন মনে একটা বাঁশি বাজানো, হঠাৎ আজ সকালে এই ছবিটা মনে এল। ও রকম কখনও করিনি!
ভরতের গণনায় ছিল সাত দিন, তারপর আরও কয়েকটা দিন বেড়ে যাওয়ায় সে মোটেই খুশি নয়। বরং ভেতরে ভেতরে অস্থিরতায় সে ছটফট করছে। জীবন দেওয়া ও নেওয়ার ব্যাপারটা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সেরে নেওয়াই যেন ভাল। বেঁচে থাকার চেয়েও, মৃত্যুর পর কী হয় সেটা জানার জন্য আগ্রহই এখন বেশি।
তিন দিন পরই বারীনের কাছ থেকে খবর আসায় ওরা গৌহাটিতে নেমে এল।
বারীন এখানেও এর মধ্যে দলবল জুটিয়ে ফেলেছে। বেশ কয়েকটি যুবক খুব উৎসাহী। বারীনের অস্ত্রগুলি দেখে মুগ্ধ। এরা কেউই জীবনে কখনও রিভলবার দেখেনি, হাতে দেয়া তো সে সকালে অশ্বারোহণে ভ্রমণে বেরোয় না, রাজকার্যে বিশেষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সব সময় লোকজন তাকে ঘিরে থাকে।
তবু নজর রাখার কাজ চলতে চলতেই একদিন একটি যুবক এসে জানাল, ফুলার সেদিনই গৌহাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে বরিশালের দিকে। যুবকটি সরকারি কর্মচারী, সে ভেতরের খবর রাখে। তৎক্ষণাৎ এরাও গৌহাটি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল।
প্যাসেঞ্জার স্টিমার অনেক জায়গায় থামতে থামতে আসে, গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়। ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ব বঙ্গ ও আসাম রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কতা, তার জন্য রয়েছে পৃথক একটি স্টিমার। কিন্তু সে স্টিমারও নিশ্চিত পথে দুএকবার থেমেছিল, বারীনরা বরিশালে এসে দেখল, লাটসাহেবের নিজস্ব স্টিমার ‘ব্ৰহ্মকুণ্ড’ জেটিতে এসে সদ্য ভিড়েছে। ঘাটে এবং রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতারে লাল পাগড়ি পুলিশ। টুপি, শামলা, কোট, চোগা চাপকান পরা আরও বহু সরকারি কর্মচারী ও বশংবদ ব্যক্তিরা এসেছে অভ্যর্থনার জন্য। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে ফুলার সাহেব মুসলমান জনসাধারণের কাছ থেকে যে রকম জয়ধ্বনি পেয়েছিল, বরিশালে সে রকম কেউ নেই। বরিশালের মানুষের মনে পুলিশি তাণ্ডবের ক্ষত এখনও দগদগ করছে।
জেটিঘাটের ভিড় ফাঁকা হয়ে যাবার পর অস্ত্রশস্ত্র সমেত পোঁটলাগুলি ঘাড়ে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল বারীন, হেম আর ভরত। যেন সাধারণ পথিক। বরিশালে ভাল হোটেল নেই, হাটের পাশে কিছু কিছু থাকার জায়গা আছে বটে, সারি সারি ঘর, চাচার বেড়া, ভেতরে একটা করে খাঁটিয়া পাতা, কিন্তু কোনও ঘরেরই দরজা নেই। মারাত্মক অস্ত্রগুলি নিয়ে এ রকম ঘরে থাকা যায় না। কিছুদিন আগে কনফারেন্সে যোগ দিতে এসে স্থানীয় কয়েকজন যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সে রকম দু-তিনজনের বাড়ি খুঁজে খুঁজে দেখা করার পর কালীবাড়ির পাশে এক বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া গেল।
হাতমুখ ধুয়ে মুড়ি-নারকোল খেতে খেতে বারীন বলল, এ এক হিসেবে ভালই হল। : গবান যা করেন, মঙ্গলের জন্য। শিলং-গৌহাটির বদলে এই বরিশালে ফুলারকে মারতে পারলে আমাদের আরও বড় জয় হবে। এখানে ফুলারের হুকুমে পুলিশ বীভৎস অত্যাচার করেছে, এই বরিশালের মাটিতেই ফুলারকে আমরা পুঁতে ফেলব। সারা দেশ বুঝবে, বাঙালি অপমানের বদলা নিতে জানে। হেম, যদি কালপরশুই অ্যাকশান শুরু করা যায়, তোমরা রাজি?
ভরত বলল, পরশু কেন, কাল হলেই ভাল হয়।
বিকেলের দিকে আরও কয়েকজন যুবককে জড়ো করা হল সেখানে। যথারীতি বারীন এক বৈপ্লবিক বক্তৃতা দেবার পর অস্ত্রগুলি দেখাল। সকলেই অভিভূত, সকলেই সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু বাধা এল সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে।
খরার জন্য বরিশাল অঞ্চলে সাঙ্ঘাতিক দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। এখানে বিপদে-আপদে অশ্বিনীকুমার দত্তই ভরসা, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে দলে দলে তোক ছুটে আসছে তাঁর কাছে। এইসব সাধারণ গ্রামের মানুষ সরকারকে চেনে না, জমিদারকে চেনে না, অশ্বিনীকুমারই তাদের বিপদ-ত্রাতা। অশ্বিনীকুমার পাড়ায় পাড়ায় সেবাকেন্দ্র খুলেছেন, দিনরাত খাটছেন। এই তিন যুবকের আগমনবার্তা ও উদ্দেশ্যের কথা তাঁর কানে পৌঁছল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন। সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা চালাতে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে তিনি বিশ্বাসী নন। ফুলার বধের মতন একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটলে পুলিশ এখানে অভুক্ত, অসহায়, দুর্বল মানুষদের ওপর বেদম অত্যাচার চালাবে। তিনি তা কিছুতেই হতে দেবেন না। তিনি কঠোরভাবে কয়েকজন কর্মীকে নির্দেশ দিলেন, কলকাতার ওই ছোঁকরাদের গিয়ে বলো, বরিশালে তাদের ওসব অতি বিপ্লবীপনা চলবে না। ওরা বাহাদুরি করে এখানে নাম কিনতে চায়। এখানে আমরা মানুষদের বাঁচাবার কাজে ব্যস্ত আছি, মানুষ মারার কোনও কথাই শুনতে চাই না। ওরা যত তাড়াতাড়ি বরিশাল ছেড়ে চলে যায়, ততই মঙ্গল!
যে কয়েকটি যুবক বারীনের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তারাও এখন পিছু হঠতে লাগল। অশ্বিনীকুমারের নির্দেশ অমান্য করতে সকলেই নারাজ। অশ্বিনীকুমারের সমর্থন ছাড়া বরিশালে কোনও কিছুই করা সম্ভব নয়।
বারীন তবু থেকে যেতে চায়। হেম আর ভরতের মনে হল, এখানে প্রতিকূলতা এমনই যে-কেউ হয়তো তাদের খবর আগে থেকেই পুলিশের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।
এর পর যেন একটা খেলা শুরু হল। বারীন জিদ ধরে আছে, তার মধ্যেই খবর এল, ফুলার সাহেব এখানে নেই, এর মধ্যেই সে ফিরে গেছে গৌহাটি। তা হলে চলো গৌহাটি। একবার যখন গোঁ ধরা হয়েছে, তখন ফুলারের নিস্তার নেই। কার্যসিদ্ধি না করে হেম আর ভরতের বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!
যাত্রীবাহী স্টিমারটি থেমে গেল চাঁদপুরে, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য আর যাবে না। পরদিন আবার অন্য স্টিমার। চাঁদপুরে নেমে ওরা শুনল, ফুলার বোধহয় এখন গৌহাটিতে নেই, ইতিমধ্যে অন্য কোথাও চলে গেছে। কেউ কেউ বলল, থাকতেও পারে। আসলে ফুলারের গতিবিধি সম্পর্কে সরকার থেকে ইচ্ছে করেই নানান রকম পরস্পরবিরোধী সংবাদ ছড়ানো হয়।
কিন্তু গৌহাটি এসে ফুলার উঠেছে কোথায়? আগেরবার যে বাংলোতে ছিল, সেটা ফাঁকা, পুলিশ পাহারাও নেই। লাটসাহেব এলে পুলিশ ও আমলাদের যতখানি তৎপরতা থাকা উচিত, সে রকম দেখা যাচ্ছে না, অথচ ফুলার এখানে এসেছে ঠিকই। তবে কি সে আবার শিলং চলে গেল?
ঠিক হল, ভরতকে একা পাঠানো হবে শিলং-এ, সে খবরাখবর নেবে, তারপর উপযুক্ত সুযোগ বুঝে সে ডেকে পাঠালেই হেম যাবে সেখানে। বারীন আর শিলং যেতে চায় না। তা ছাড়া ফুলার এর মধ্যে আবার গৌহাটি নেমে আসে কিনা সেটাও লক্ষ রাখতে হবে।
ভরত একা যেতে খুবই আগ্রহী। প্রস্তাবটা শোনামাত্র তার মনের মধ্যে একটা গোপন পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেছে। ছোটলাটকে যদি শিলং-এ পাওয়া যায়, তা হলে হেমবারীনকে আর খবর পাঠাবার দরকার কী? সে একাই অ্যাকশান সেরে ফেলতে পারবে। ফুলার সাহেবের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি চালাবে। শিলং-এর সেই ঘটনা শুনতে পেয়ে এখান থেকে পালাবার অনেক সময় ও সযোগ পাবে হেম আর বারীন।
এটা ভাবতেই ভরতের মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল।
ভরত কিছু একটা হঠকারিতা করে ফেলতে পারে, এ রকম একটা সন্দেহ হেমের মনেও দেখা দিল। ভরত যখন পুটলি গুছিয়ে নিচ্ছে, তখন হেম বলল, ভরতের তো এখন অস্ত্রশস্ত্র কিছু নেওয়ার দরকার নেই। তুমি স্পটটা ঠিক করবে, তারপর সংকেত পেলেই আমি ওসব নিয়ে যাব।
বারীনও বলল, ঠিক। অস্ত্র নিয়ে গিয়ে ভরত আগেই ধরা পড়ে গেলে মুশকিল হবে। ভরতের কিছুই নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। তুমি তো শুধু খোঁজখবর নিতে যাচ্ছ।
হেম অস্ত্রগুলো সব পাশের ঘরে নিয়ে রেখে এল।
টাঙ্গার আড্ডায় তিনজনে এক সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। হেম আর বারীন ভরতকে শুধু খানিকটা পথ এগিয়ে দেবে। ভরত যাত্রীবাহী সাধারণ টাঙ্গাতেই যাবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদুর যাবার পর ভরত থমকে দাঁড়াল। হাসি মুখে বলল, এই রে, পেটটা যেন কেমন কেমন করছে, পথে যদি বেগ পায়, টাঙ্গা থামাতে চাইবে তো? তোমরা বরং এখানে একটু দাঁড়াও, আমি একবার সেরে আসি।
ভরত দৌড়ে ফিরে গেল। হেমের ঘরে ঢুকে দ্রুত পুঁটুলি খুলে প্রথমে একটা রিভলবার খুঁজে নিল পেটে। তারপর বেশ কিছু গুলি ও আর একটা রিভলবারও তুলে নিল। দু হাতে দুটো নিয়ে পরপর গুলি চালাতে হবে, কিছুতেই যাতে ব্যর্থ হতে না হয়। শুধু একটা গুলি রেখে দেবে নিজের মাথার জন্য।