॥ ৮১ ॥
“প্রদোষের আলো ম্লান হইয়া আসিয়াছে। আমার ঘরখানিতে কিছু ভৌতিক ছায়া ঘনাইয়া উঠিতেছে। এইসব ছায়া আমার পরিচিত। আমি একা মানুষ বলিয়া এবং একাকী থাকিতে পছন্দ করি বলিয়া নিজের পারিপার্শ্বিককে বড় বেশী অনুভব করি। এইসব ছায়াদের সহিত আমার পরিচয় বহুকালের। কখনো এমন হইয়াছে যে, আমি নির্জনতায় একাকী আমার চারিদিকের ছায়াগুলির মধ্যে একপ্রকার নীরব বাঙ্ময়তা লক্ষ করিয়াছি। ইহারা যেন কিছু বলিতেছে, কিছু প্রকাশ করিতে চাহিতেছে।
“কিন্তু কী বলিবে? ছায়ারাজ্যের কোন গোপন বার্তা ইহারা আমাকে শুনাইতে চাহে? এক একদিন আমি এইসব ছায়ার সহিত কিছু ক্রীড়ায় মাতিয়া উঠি। দেরাজের উপর হইতে সেজবাতিটি সরাইয়া আলমারির মাথায় স্থাপন করি। কখনো বা জানালার তাকের উপর রাখি। এইরূপে ছায়াগুলির রূপান্তর ঘটে, নকশা পাল্টাইয়া যায়। কখনো বা আমি ছায়াগুলির সহিত কথা কহিবার চেষ্টা করি। কিন্তু ছায়া অলীক, তাহার সত্তা নাই। বস্তু ও আলোর পারস্পরিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল এক প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই সত্য জানিয়াও মাঝে মাঝে ওইসব ছায়ার ভিতর আমি পরপারের অস্পষ্ট দর্শন পাইয়া যাই।
“আজও প্রদোষের আলো ম্লানতর হইল। ঘরে এখনো আলো দিয়া যায় নাই। শিয়রে ম্লানমুখী সেই কিশোরী বসিয়া আছে। আজ সে আর কিশোরী নহে। বয়সের হিসাবে সে প্রবীণাই বোধহয়। ত্রিশ ছুঁইয়া তাহার সতেজ শরীরটা যেন তপোক্লিষ্টা উমার মতো। এই বয়সে গৃহবধূরা পুত্রকন্যার জননী এবং ঘোর সংসারী। এই যুবতী অনূঢ়া বলিয়াই বোধহয় সংসারের নানাবিধ গ্লানি ইহাকে স্পর্শ করে নাই। আমার বিশ্বাস, বিবাহ হইলেও ইহার অন্তর অমলিন থাকিত।
“আজ প্রদোষের এই ক্ষীণ আলোয় ইহার মুখের প্রতি চাহিয়া মনে হইল, আমার হৃদয় কতকাল যাবৎ চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত ও উর্ধ্বমুখ হইয়া আছে। সুনয়নী আমাকে সন্তান দিয়াছে, সংসার দিয়াছে। আমার দাম্পত্য জীবন বিন্দুমাত্র অসুখের ছিল না। তবু তাহাই সবটুকু নহে। কী যেন অসম্পূর্ণ ছিল। আজ আমার প্রিয় ছায়াগুলির মধ্যে সেও এক অস্পষ্ট রহস্য মাখিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। রক্তমাংসের অতীত এক শাশ্বত মানবী। পুরুষকে পরিপূর্ণ করিবার অমৃত ভাণ্ডটি তাহার হাতে।
“যে নির্লজ্জ প্রস্তাব তাহার নিকট করিলাম স্বাভাবিক নিয়মে আমার ন্যায় সঙ্কুচিত রসনার মানুষের পক্ষে তাহা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ঘরের ছায়াগুলি—সত্তাহীন অলীক ওই ছায়াগুলি কী এক পরিমণ্ডল রচনা করিয়া দিল। আমার মনে হইল যাহা চাই তাহা আজ এই মুহূর্তে মুখ ফুটিয়া চাহিয়া না লইলে চিরকাল, এমন কি পরজন্মেও আক্ষেপে মাথা কুটিয়া মরিতে হইবে। তৃষ্ণা মিটিবে না।
“সে লজ্জায় অধোবদন হইল। কিন্তু জানি, এই প্রস্তাব তাহার কর্ণে বংশীধ্বনির মতো শুনাইল। সে আর সেই কিশোরী নহে। চঞ্চলমতী, দুঃসাহসী, লজ্জাহীনা সেই কিশোরী প্রতিনিয়ত যেন উপচাইয়া পড়িত। আজ এই যুবতী কিন্তু নিজেকে দুই কূলের মধ্যে বাঁধিয়াছে। তাহার উচ্ছ্বাস নাই, গভীরতা আছে। দুঃসাহস প্রকাশ পাইতেছে প্রগাঢ় দায়িত্বজ্ঞানে। নির্লজ্জতা ঢাকিয়াছে অন্তঃশীলা স্নেহের স্রোত। ইহাকে আমি কোনোদিনই কামনা করি নাই, তবে চাহিয়াছি। আজ আমি যে বয়স ও যে মানসিকতায় উত্তীর্ণ হইয়াছি তাহাতে দেহগত কামনা আমাকে পীড়া দেয় না। কোনোকালেই দিত না। তাই এই যুবতী যখন কিশোরী ও প্রগল্ভা ছিল তখনো আমি ইহাকে কামনা করি নাই।
“সে বলিল, আমরা কি পারব?
কি পারার কথা বলছো?
সব ছেড়ে চলে যেতে হবে, তা জানো?
কেন, সব ছেড়ে যাবো কেন?
তোমার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। তারা সব সন্তানের মা-বাবা।
সে সব জানি।
আমার বাড়ি থেকেও কথা উঠবে।
কেন উঠবে?
দশ বছর আগে হলে উঠত না। এখন উঠবে।
“আমি হাসিয়া কহিলাম, আমাদের এখন এসব ভাববার মতো সময় নেই। সময় জিনিসটা ভারী অদ্ভুত। কখন যে মানুষ যুবক অবস্থা থেকে টক করে বুড়োর দলে চলে যায় তা টেরই পাওয়া যায় না।
“সে চোখ পাকাইয়া কহিল, তুমি কি বুড়ো?
“আমি একটু ভাবিয়া কহিলাম, নিজেকে বুড়ো ভাবার বাতিক আমার কেটে গেছে। বয়স নিয়ে বেশী ভাবি না। কিন্তু এটাও ঠিক, সময় জিনিসটাকে খেয়াল রাখতে হয়।
আচ্ছা মানলাম। কিন্তু ধরো যদি আমাদের এক হতেই হয় তাহলে তার আগে কতগুলো কাজ সেরে নিতে হবে না? হুট করেই কি এ বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসা যায়?
আমাদের আবার বকেয়া কাজ বাকি কী?
পুরুষমানুষের যদি কখনো কিছু খেয়াল থাকে। তোমার বিয়ের যুগ্যি মেয়ে ঘরে রয়েছে, নাবালক ছেলে। এদের ব্যবস্থা করতে হবে না?
“আমি হাল ছাড়িয়া কহিলাম, তবেই হয়েছে। ওসব করতে গেলে কত সময় বয়ে যাবে।
যাবে যাক। এতদিন যখন অহল্যার মতো অপেক্ষা করতে পেরেছি আর কিছুদিনও পারব। বিশাখার বিয়েটা হোক, তুমি কন্যাদায় থেকে মুক্ত হও, তারপর সব।
নাবালক পুত্রকে নিয়ে কী বলছিলে?
কিছু বলছিলাম না। ভাবছিলাম। তোমাকেও ভাবতে বলি।
কৃষ্ণকে নিয়ে তো কোনো ঝামেলা নেই। ভাবব আবার কী?
“সে মাথা নাড়িয়া কহিল, ভাববার আছে বৈকি। কৃষ্ণ তো আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। ওর বুদ্ধি বেশী, তেজ বেশী। ও যদি আমাদের এই বুড়ো বয়সের বিয়েকে না মানে তবে আমি বড় অশান্তি পাবো। ও আমার ছেলেই। আর ছেলে বলেই দুশ্চিন্তা।
“আমি একটু দ্বিধায় পড়িলাম। বাস্তবিক কৃষ্ণ শুধু বুদ্ধিমান নহে, প্রবল রকম তেজস্বীও। সে আমার পুত্র এবং তাহার সহিত আমার বয়সের প্রচুর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আমি তাহাকে কি করিয়া যেন শ্রদ্ধা করিতে শুরু করিয়াছি। এই শ্রদ্ধাবোধের পিছনে যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। পুরুষমানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ ব্যক্তিত্ব। বুদ্ধি, মেধা, অন্যান্য সাফল্যের চেয়েও ব্যক্তিত্ব অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিত্ববান তাহাকেই বলা যায়, যে ঘৃণাকে ঘৃণা, সুন্দরকে আলিঙ্গন, শুভকে অভিনন্দন জানাইতে কুণ্ঠিত হয় না। যে লক্ষ লোকের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও সত্যকে সত্য বলিয়া ঘোষণা করিতে ভতি হয় না। সৌভাগ্যক্রমে আমি তেমনই ব্যক্তিত্ববান একটি পুত্র লাভ করিয়াছি। বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে সে কিরূপ হইবে তাহা আগাম বলিতে পারি না। কিন্তু এই বাল্যকালে, জীবনের ঊষালগ্নে তাহার চরিত্রের যে গঠন লক্ষ করিতেছি তাহা যেমন আশাপ্রদ তেমনই আনন্দদায়ক।
“কাজেই কৃষ্ণকে লইয়া ভাবিতে হইবে বৈকি। সে মুখে কিছুই হয়তো বলিবে না। তাহার ভদ্রতাবোধ উদাহরণযোগ্য। সে বিনয়ী এবং নম্র। কিন্তু তাহার অভ্যন্তরে ইস্পাত-কঠিন এক দৃঢ়তাও আছে। আজ এই বয়সে যদি আমি পুনরায় বিবাহ করি তাহা হইলে তাহার মনোভাব কী হইবে সেটাই ভাবনার বিষয়। মনে হইতেছে, একমাত্র তাহার প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কাহারও প্রতিক্রিয়া বা মতামত লইয়া মাথা ঘামাইবার কিছুই নাই।
“সে বলিল, কী ভাবছো?
কৃষ্ণর কথা। তুমি ঠিকই বলেছো, কৃষ্ণকে নিয়েই ভাবনা।
“সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমি ওকে সব বলব।
“আমি বিস্মিত হইয়া কহিলাম, বলবে! কৃষ্ণকে এসব বলবে কেন?
বলা উচিত। কিন্তু তুমি ভেবো না। আমি বুঝিয়ে বলব।
“আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বলিলাম, তোমার বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। তুমি যা করবে ভেবেই করবে জানি।
ভেবেই করব। কৃষ্ণ অবিবেচক নয়।
বিশাখার বিয়ের ব্যাপারে একটু রাজেনবাবুকে খবর দেবে?
রাজেনবাবু তো কালও তোমাকে দেখতে এসেছিলেন!
না না, দেখতে এলে আলাদা রকম আসা। তখন বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া ঠিক নয়। প্রস্তাব দিতে হলে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ করে আনা উচিত। আমি বরং একটা চিঠি লিখে পাঠাচ্ছি।
তাই ভাল।
শচীন কি আসে-টাসে? ওকে ক’দিন দেখছি না।
বড় বউমা আসার পর থেকে আসছে না। বোধহয় লজ্জায়।
“আমি হাসিলাম। লজ্জা হওয়ারই কথা। কহিলাম, কাগজ আর দোয়াত কলম আনো। চিঠিটা লিখে ফেলি।
“চিঠির মুসাবিদা করিয়া আজ বুকের ভার হালকা হইল। কন্যার বিবাহ হইবে, পিতা হিসাবে দায়মুক্ত হইব। আনন্দেরই কথা। কিন্তু মনে হইতেছে এই পত্রের মুসাবিদা করিয়া যেন আমি আমার জীবনেরই একটি রুদ্ধদ্বারকে অর্গলমুক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমি কি স্বার্থপর?
“চিঠিখানা তাহার হাতে দিয়া একটু হাসিলাম। তৃপ্তির হাসি। জানি চিঠি পাইয়া রাজেনবাবু আসিবেন। তারপর কী হইবে তাহা জানি না। আমার ঈশ্বরে বিশ্বাস পোক্ত হইলে হয়তো বলিতাম, সবই মঙ্গলময়ের ইচ্ছা। কিন্তু আমি নিশ্চেষ্ট ও কর্মকুণ্ঠ হইলেও অদৃষ্টবাদী নহি। তাই সকল বিষয়ে ঈশ্বর বা অদৃষ্টকে বরাত দিয়া বসি না।
“সে আমার মাথার উপর স্নিগ্ধ হাতখানা ক্ষণিকের জন্য রাখিল। তারপর দ্রুত পায়ে চলিয়া গেল।
“আজ উঠিয়া বসিতে পারিতেছি। তেমন দুর্বলতাও বোধ করিতেছি না। আজ সচ্চিদানন্দকে একটি পত্র লিখিলে কেমন হয়? জীবনে কোনো এমন মানুষ পাই নাই যাহাকে সব কথা খুলিয়া বলা যায়। সচ্চিদানন্দও যে সেরূপ মানুষ তাহা নহে। তবে সে আমার আবাল্য সুহৃদ এবং বিশ্বস্ত। সে আমার যতই সমালোচনা করুক বা প্রকাশ্যে বিদ্রুপ করুক অন্তর দিয়া সে আমাকে একদা ভালবাসিয়াছিল। আজ প্রবাসে গিয়া সে বড় উকিল হইয়াছে, কংগ্রেস করিতেছে, দেখা-সাক্ষাৎ নাই। তথাপি আমি জানি সে আমাকে জীবন হইতে মুছিয়াও ফেলে নাই। কতগুলি সম্পর্ক মুছিয়া ফেলা যায়ও না।
“লিখিলাম! ভাই সচ্চিদানন্দ, বহুকাল তোমাকে পত্র দিই না। তোমার শেষ পত্র পাইয়াছি বোধহয় মাস ছয়েক আগে। তাহাতে ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটে নাই। তোমার আমার মধ্যে নিয়মিত পত্র বিনিময়ের পৌনঃপুনিক ক্লান্তি নাই। যখন প্রয়োজন ও আগ্রহ দেখা দেয় তখন লিখিলেই চলে। ইহা একরূপ ভাল। ইহাতে কথা জমিয়া উঠিবার অবকাশ পায়। পত্র লিখিবার আনন্দ ব্যাহত হয় না। তাহা ছাড়া পত্র তো বাহক মাত্র। যাহা সে বহন করিয়া লইয়া যায় তাহা হৃদয়। সেই হৃদয়ই যদি স্পন্দিত না হয় তাহা হইলে পত্র লিখিয়া কী হইবে? তোমার আমার সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হউক, পরস্পরের কুশলবার্তা না পাইলে অস্থির হইব এমন নহে।
“আজ তোমাকে কী লিখিব তাই ভাবিতেছি। লিখিবার যে কত কিছু আছে। কত কথা অভ্যন্তরে জমিয়া পুঞ্জীভূত হইয়াছে। কিন্তু ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়া তোমার শিরঃপীড়ার কারণ হইব নাকি?
“বরং তোমাকে একটি সংবাদ দিই। সেই কিশোরী রঙ্গময়ীকে তুমি তো ভুলিতে পার নাই। তাহাকে লইয়া অনেক বিদ্রূপ বাণ আমার প্রতি নিক্ষেপ করিয়াছ। এমন কি বিবাহ করিবার পরামর্শ দিতেও তোমার বাধে নাই। বরাবরই তুমি ঠোঁটকাটা এবং অবিনয়ী। যদিও নিজেকে তুমি উচিতবক্তা বলিয়া মনে কর।
“রঙ্গময়ী আজ আর কিশোরী নাই। তুমি এখানকার বাসস্থান গুটাইয়াছ। বহুকাল এ শহরে পদার্পণ কর নাই। রঙ্গময়ীকেও সুতরাং তুমি এখনকার রূপে চাক্ষুষ কর নাই। কিন্তু আমার চক্ষুর সম্মুখেই সে বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়াছে। বড় ইচ্ছা করে আমার চক্ষু দুইটি আজ তোমাকে দিই, আমার দুই চক্ষু দিয়া তুমি রঙ্গময়ীকে অবলোকন কর।
“রূপের কথা কি ছাই বকিতেছি? রঙ্গময়ীকে রূপের জন্য কে শিরোপা দিবে? ধারাল মুখশ্রী ও তীক্ষ্ণ চক্ষু দুইটি ছাড়া তাহার চটকদার কিছু নাই। কিন্তু আমার চক্ষু দিয়া যদি দেখিতে তবে তাহার মধ্যে আর এক অপরূপাকে তুমি দেখিতে পাইতে। একদা তুমি তাহার রূপে মজিয়াছিলে। কিন্তু হৃদয়ের কন্দরে তাহার যে এক দিব্য প্রস্রবণ আছে তাহাতে অবগাহন করিতে পার নাই।
“তোমাকে কী বলিব তাহাই ভাবিয়া পাইতেছি না। এ বয়ঃসন্ধির প্রণয় প্রলাপ নহে। ইহা এক আবিষ্কারের কাহিনী। কিন্তু এমনই ব্যক্তিগত সেই আবিষ্কার যে, খুব ঘনিষ্ঠ বয়স্যকেও বুঝি বুঝাইয়া বলা যায় না।
“এই আবিষ্কার ঘটিল এক আকস্মিকতার মাধ্যমে। এক আততায়ী আমাকে হত্যা করিবার জন্য আক্রমণ করে। বলা বাহুল্য যে, সে সফল হয় নাই। তবে আমাকে সে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল বটে। আজও আমি একপ্রকার শয্যাশায়ী।
“এই ঘটনাটির কথা বিশদ লিখিব না। তাহার প্রয়োজনও নাই। মানুষের জীবনে দৈব-দুর্বিপাক তো ঘটিয়াই থাকে। কিন্তু এই ঘটনার অন্যতর এক গভীর তাৎপর্য আছে। যেমন দুর্যোগের অশনিপাতে মানুষ আচমকা বহুদূর পর্যন্ত দেখিতে পায়, এই ঘটনার সময় মৃত্যু-অশনির ক্ষণিক স্পর্শে আমি সেইরূপে এক দূরদৃষ্টি লাভ করি।
“ভায়া হে, মৃত্যু চিন্তার কথা তোমাকে বহুবার লিখিয়াছি। হয়তো বিরক্ত হইয়াছে। আজও লিখি, মৃত্যুর কথা আমি কখনো ভুলি না। সর্বদা বাঁচিয়া থাকিয়া মৃত্যুর ধ্যান ইহজন্মে আমাকে ছাড়িবে না।
“কিন্তু প্রকৃত মৃত্যুর মুখোমুখি হইয়া আমার জীবনে মোড় ফিরিল। আজ আর আমি সেই দুর্বলহৃদয়, মৃত্যু চিন্তায় বিহ্বল হেমকান্ত নই। মৃত্যু যেন আমাকে ঘাড়ে ধরিয়া একটা ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া গেল, মরিতে হয় তো মর না! মৃত্যু এইরূপ।
“আমি দেখিলাম এবং চিনিলাম। মনে হইল, ইহা তো খুব বেশী কিছু নয়। খুব অঘটন কিছু তো নয়। আততায়ীর অস্ত্র, সন্ন্যাস রোগ, যক্ষ্মা—উপলক্ষ্য যাহাই হউক, ঘটনা সামান্যই।
“বাল্যকাল হইতেই আমি গাছপালা ও পশুপক্ষীর সন্নিকটে থাকিতে ভালবাসি। ইহাদের মধ্যে ক্ষুদ্র প্রাণের প্রকাশ ও সেই প্রাণের নানা ক্ষুদ্র ক্রীড়া প্রত্যক্ষ করিয়াছি। জীবজগতের সহিত তবু একাত্মতা আমার কোনোদিন ঘটে নাই। কোনোদিন মনে হয় নাই, একটি মানুষ বা একটি গাছের জন্ম বা মৃত্যু কোনো ঘটনাই নহে। বিশ্ব জুড়িয়া প্রাণের যে অবিরল প্রকাশ ঘটিতেছে আমরা তাহারই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। একটি নিবিয়া গেলেও প্রাণ তো অবিনাশী—ক্রিয়া করিয়াই চলে। যে কেবল ব্যক্তিগত মৃত্যুর কথা ভাবিয়া বিষন্ন হয় সে জ্ঞানবান নহে।
“একটু ভুল বকিতেছি কি ভাই সচ্চিদানন্দ? হইতে পারে। আজ আমার মনটাই প্রগলভ। বাক্য বা ভাষা তো তদনুরূপই হইবে। ক্ষমা করিও। তোমার এই চির-নাবালক বয়স্যটির অনেক অত্যাচার সহ্য করিয়াছ। এবারটাও কর।
“যাহা বলিতেছিলাম। খানু পাগলের তাড়া খাইয়া বাল্যকালে আমার যে দুর্দশা হইয়াছিল তাহা তোমার মনে আছে। এবার আততায়ী আসিয়া তদপেক্ষা অনেক বড় ঝাঁকুনি দিয়া গিয়াছে। সেই আন্দোলন আমার রক্তে এখনও দোলাচল সৃষ্টি করে।
“এই ঘটনার ফলে আমার অভ্যন্তরে যেন ঘুম ভাঙিল। নিদ্রোত্থিতের মতো চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছি। বাস্তব জগৎ স্বপ্নের মতো নহে। সেই দৃষ্টিতেই রঙ্গময়ীর দিকে চোখ ফিরাইলাম। এই যুবতী বাল্যকাল হইতে আমাকে প্রার্থনা করিয়া শিবের মাথায় জল ঢালিয়াছে, কলঙ্কের গুরুভার বহন করিয়াছে, বিবাহহীন কৌমার্যকে অবলম্বন করিয়া বড় অনাদরে বাঁচিয়া আছে। ইহাকে আদর করিবার কেহ নাই। কিন্তু সকলেই ইহার নিকট কেবল আদর যত্ন ও সেবা প্রত্যাশা করে।
“এইসব দেখিলাম। মনে হইল, কেন ইহাকে আর কষ্ট দিব? সংসার ইহাকে কিছু দেয় নাই। সংসার দেয় নাই বলিয়া আমিও চিরকাল স্তোকবাক্যে ইহাকে তুষ্ট রাখিব? আর কিছু তাহার প্রত্যাশা বা দাবী নাই?
সুতরাং—”
কর্তাবাবু!
হেমকান্ত চমকে উঠে চিঠিখানা ঢাকা দিলেন।
চাকরটা মৃদু স্বরে বলল, দারোগাবাবু এসেছেন।
দারোগাবাবু! বিস্মিত হেমকান্ত আপনমনে কথাটি উচ্চারণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন, নিয়ে আয়।
একটু বাদে যখন রামকান্ত রায় ঘরে ঢুকলেন তখন সেজবাতির আলোয় তাকে আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছিল।
হেমকান্ত বললেন, বলুন কি খবর!
আপনি কেমন আছেন?
একটু ভাল। বলে হেমকান্ত নড়েচড়ে বসলেন।
রামকান্ত রায় শালগাছের মতো সিধে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, আমি একটা অপ্রিয় কাজ করতে এসেছি।
হেমকান্ত অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললেন, কি কাজ?
আপনার বাড়ি সার্চ করার আদেশ আছে।
আমার বাড়ি সার্চ করবেন? হেমকান্ত হাঁ করে রইলেন।
সরকারী কাজ।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু সার্চ করবেন কেন?
সব কারণ তো আপনাকে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার কাছে ওয়ারেন্ট আছে। দেখবেন?
হেমকান্ত ওয়ারেন্ট দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। কিন্তু তাঁর চোখে হঠাৎ একটা তীব্র রাগের দীপ্তি দেখা দিল। তিনি বললেন, সার্চ করবেন। কিন্তু আমার বাড়িতে এত রাত্রে আমি পুলিস ঢুকতে দিতে পারি না। বাড়িতে মেয়েরা রয়েছেন। আপনি কাল সকালে আসবেন।
রামকান্ত রায় হেমকান্তের গলার দৃঢ়তা লক্ষ করে একটু দ্বিধায় পড়লেন। বললেন, আমি বাড়ির সব জায়গা সার্চ করব না। শুধু বিশেষ কয়েকটা স্পট।
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, আপনার একজন সেপাইও আজ রাত্রে আমার দেউড়ি যেন না পেরোয়। তার ফলাফল ভাল হবে না।
রামকান্ত রায় একটু হেসে বললেন, আপনি রাগ করছেন কেন? আমাদের তো সত্যিকারের জরুরী প্রয়োজনও এটা হতে পারে। আজ রাত্রে যদি সার্চ করি তবে বাড়ির লোকদের একটুও বিরক্ত করব না। কিন্তু যদি সেই অনুমতি না দেন কাল সকালে এসে গোটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে যাবো। সেটাই কি ভাল হবে?
হেমকান্ত বহুদিন পর সত্যিকারের রাগলেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ। কপালে একটা শিরা রাজটিকার মতো ফুলে আছে। মুখ রক্তিমাভ। বললেন, আমি জানি রাত্রে বাড়ি সার্চ করার নিয়ম নেই। আপনি ইচ্ছে করলে বাড়ি ঘিরে রাখতে পারেন। তবু কেন জবরদস্তি করছেন?
রামকান্ত রায় একটা শ্বাস ফেলে বললেন, সরকারী নিয়ম আপনি আমার চেয়ে ভাল জানেন না হেমকান্তবাবু।
যদি নিয়ম থেকেও থাকে তবু বলছি, আপনি ওকাজ করবেন না। এখন আসুন।
দুজনে দুজনের দিকে কিছুক্ষণ বিষদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
তারপর রামকান্ত রায় বললেন, আচ্ছা। দেখা যাবে।
সামান্য উত্তেজনায় হেমকান্তর দুর্বল শরীর কাঁপছিল। দরজায় তাঁর দুই ছেলেমেয়ে এবং ছেলের বউরা উৎকণ্ঠিত মুখে নিঃশব্দে ভীড় করে এসে দাঁড়িয়েছে কখন।
কনক বলল, কী হয়েছে বাবা?
হেমকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, কিছু হয়নি। দারোয়ানদের বল দেউড়ি পেরিয়ে যেন কেউ ঢুকতে না পারে।
রামকান্ত রায় একটু হাসলেন। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।
হেমকান্ত সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেয়।