2 of 2

৮১. পৃথিবীর রং অনেকটাই পালটে গেছে

পৃথিবীর রং অনেকটাই পালটে গেছে। এখনও বিবর্ণ নয়, তবে বহু গাঢ় রং এখন ফিকে হয়ে আসছে দীপনাথের চোখে। এ কি বয়সের দোষ?

বয়সও কম হল না। বোধহয় পঁয়ত্রিশের এপারে বা ওপারে। সঠিক হিসেব জানত মা বা পিসিমা। তারা কেউ নেই। তবু বয়সেরই সব দোষ হয়তো নয়। দোষ আছে জীবনযাপনেরও। এ কেমন এক নির্ভেজাল ঘটনাহীন জীবন বয়ে যাচ্ছে তার? কলকাতায় আজও তার সত্যিকারের বন্ধু হয়নি কেউ। তার কোনও আচ্ছা নেই, অবসর বিনোদন নেই। সে শুধু এক কোম্পানি থেকে আর এক কোম্পানিতে ব্যক্তিগত গুডউইল নিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সে কাজ জানে, আর কিছু জানে না। বৈধভাবে কোনও মেয়ের প্রেমেও সে পড়েনি বহুকাল।

একমাত্র মণিদীপা, যাকে পাওয়ার নয় বা পেয়েও লাভ নেই। মণিদীপার দোরগোড়ায় অফিসের গাড়িটা থেকে নেমে সে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নিজের দামি জুতোজোড়ার চাকচিক্যের দিকে চেয়ে নিজের অনুজ্জ্বলতার কথা ভাবল।

সে জানে, আজ তাকে অনুজ্জ্বল, ক্লান্ত এবং খানিকটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কিছু করার নেই।

ব্যালকনিতে কেউ ছিল না। কিন্তু ওপরে উঠে সে দেখে, বোস সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ভিতরে বেশ গমগমে আড্ডা হচ্ছে।

দোরগোড়ায় একটু দ্বিধাভরে দাঁড়ায় দীপনাথ। কথা ছিল, আজ তার একার নিমন্ত্রণ। কিন্তু তাই কি? বোধহয় কথাটা রাখেনি বোস সাহেব। পার্টিতে গিয়ে গিয়ে দীপনাথের অভ্যেস হয়ে গেছে। ভালও লাগে না, মন্দও লাগে না। ওই একরকম। কিন্তু বোসের বাসায় আজকের নিমন্ত্রণটা একটু অন্যরকম হতে পারত।

দরজার এপাশ থেকেই অ্যালকোহলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। কাচের সঙ্গে কাচের শব্দ।

বোস উচ্চৈঃস্বরে বলল, কাম ইন! কাম ইন! ইটস ইয়োর শো। আসুন দীপনাথবাবু। জয়েন দি ক্রাউড।

ভিতরে যারা বসে আছে তারা প্রায় সবাই দীপনাথের চেনা বা আধা-চেনা। একজন বোসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মুরলী। অনন্যরা অন্য সব মেজো সেজো কোম্পানির রাঘববোয়াল। মোট জনা দশেক। মৃদু স্বরে প্রায় সবাই দীপনাথকে স্বাগত জানায়।

বোসকে যতটা মাতাল ভেবেছিল, ততটা নয়। পাশে বসতেই বুঝল। বোস মৃদু স্বরে জানিয়ে দিল, এটা ককটেল মাত্র। ডিনারে কেউ থাকবে না।

দীপনাথের দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে আসে। ইদানীং দীপনাথ মদ খায় কালেভদ্রে। খেতে খেতে অধিকাংশ লোকেরই স্পৃহা বাড়ে। দীপনাথের হয়েছে ঠিক উলটো। মদ খেলে তার ভারী মাথা ধরে। মন ভার হয়, সব দুঃখের স্মৃতি এসে ঘিরে ধরে তাকে, চারিদিকটা ভারী বিমর্ষ হয়ে যায়।

ভদ্রতাবশে দীপনাথ গ্লাসটা হাতে নেয় মাত্র। তারপর এক ফাঁকে রেখে দেয়। কেউ তেমন লক্ষ করে না অবশ্য। অফিস নিয়ে তুলকালাম কূটকচালি গল্প হচ্ছে, এসব ককটেল মিট-এ যা সাধারণত হয়ে থাকে।

কাশ্মীরা এক্সপোর্টের গোস্বামী জিজ্ঞেস করল, আপনার গাড্ডাটি তো বিগ বিজনেস। সোমানি আছে না অ্যাকাউন্টসে?

দীপনাথ মাথা নাড়ল শুধু।

গোস্বামী বলল,সোমানি কৃষ্ণমূর্তিকে লাথি মেরে উঠে গেল কী করে জানেন?

দীপনাথ মৃদু হাসল শুধু। তারপর শুনে যেতে লাগল। কোম্পানির ক্লেদ, কলঙ্ক, গুপ্ত সব পাপের কথা। অবশ্য কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। বাইরে ভাল ঢাকনা দেওয়া কোম্পানিগুলির ভিতরকার ঘা পাঁচড়া সে বহুকাল ধরে দেখে আসছে। তার অবাধ্য চোখ খুব সাবধানে, গোপনে মণিদীপাকে খুঁজছিল। কান সতর্ক। মনে হল, রান্নাঘর থেকে একবার মৃদু কণ্ঠস্বরটি শোনা গেল, দইটা ভাল করে ঘোঁটা হয়নি সতীশ, গ্রেভিতে দইয়ের টুকরো ভেসে থাকবে। এঁটে দাও।

একটু হাসল দীপনাথ। মণিদীপা রাঁধছে! সত্যিই রাঁধছে! সে এতটা আশা করেনি।

সাধারণত এসব ককটেল-মিলন ভারী একঘেয়ে আর বিরক্তিকর। বোস সাহেবের চামচা থাকাকালীন দীপনাথ বিস্তর ককটেল অ্যাটেন্ড করেছে। তখন সে এদের সমকক্ষ ছিল না, তাই তখন এদের সব কথা আর কূটকচালিকে ইম্পর্ট্যান্ট ভেবে হাঁ করে গিলত। আজ দীপনাথ এদের সমকক্ষ তো বটেই, বরং অনেকের চেয়ে তার পজিশন এবং বেতন ভাল।

লরেল-অশোক ভারী স্প্রিং তৈরিতে অগ্রণী কোম্পানি। তার টেকনিক্যাল ম্যানেজাব প্রসাদ জিজ্ঞেস করল, স্টেটসে আপনার ক’দিনের প্রোগ্রাম?

ছ’মাস আপাতত। তবে আরও বেশিদিন থাকতে হতে পারে।

ইউ আর লাকি। সানফ্লাওয়ার যাকে নেয় তার জন্য বহুত করে। আমাদের কোম্পানির মতো হারামি নয়।

দীপনাথ একটু ক্ষীণ হেসে বলে, লাক ইজ এ রিলেটিভ টার্ম।

ওকথা কেন বলছেন? আর ইউ নট হ্যাপি দেয়ার?

দীপনাথ এবার আর-একটু বড় করে হাসে, হ্যাপিনেসও রিলেটিভ।

আপনাকে নিয়ে মশাই পারা যায় না, ক্রনিক পেসিমিস্ট। সেই আগেও দেখেছি শুকনো মুখ, এখন সানফ্লাওয়ারের একজিকিউটিভ বনে আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছেন, তাও সেই শুকনো মুখ।

নিজের ভিতর হাসিখুশির অভাব দীপনাথও বড় বেশি টের পায়। সে হাসবার একটা চেষ্টা করে বলল, খুশি হওয়ার মতো কিছুই ঘটে না যে মিস্টার প্রসাদ।

কাট দ্যাট মিস্টার বিট। উই আর ফ্রেন্ডস তা খুশি হওয়ার মতো কিছু ঘটিয়েই ফেলুন।

কী ঘটাব? বিয়ে?

দূর, দূর, বিয়েটা কোনও ফেনোমেনন নয়। টেক এ গার্ল, টেক এ লং ড্রাইভ টু গোপালপুর অন সি অর ডালটনগঞ্জ, টেক টু স্কচ উইথ ইউ। দ্যাটস হ্যাপিনেস।

স্টিল রিলেটিভ।—দীপনাথ হাসিটা ধরে রাখল।

বোস একটু অস্বস্তি নিয়ে চেয়ে ছিল দীপনাথের দিকে। সম্ভবত, দীপনাথ কেন সুখী বা খুশি নয় তার রহস্যময় কার্যকারণটা ধরার চেষ্টা করছিল আজ। বলল, লিভ চ্যাটার্জি অ্যালোন। কিছু লোক আছে তারা কিছুতেই খুশি হয় না।

এই নিয়ে বোসের সঙ্গে প্রসাদের একটা ডিসকাশন শুরু হয়ে গেল। এখনকার মানুষের অসুখী হওয়ার কারণ নিয়ে।

দীপনাথ একটা হাই গোপন করল।

ককটেল শেষ হল আটটার মধ্যেই। সবাই বিদায় নেওয়ার পর বোস দরজা দিয়ে হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া ঘরটার টেবিলে আর মেঝেয় বোতল আর গ্লাস আর ভুক্তাবশিষ্টের পিরিচগুলোর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল একটু। তারপর দীপনাথের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, দি ককটেল ওয়াজ নট মাই আইডিয়া। আমি নিজে ড্রিংক খুব কমই করি আজকাল।

দীপনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, তবে কার আইডিয়া?

ওদের। আপনার সঙ্গে ওরা নতুন করে ইনট্রোডিউসড হতে চেয়েছিল।

তার কারণ?

বিজনেস-ভালচারদের তো কারণ একটাই। দে ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট সানফ্লাওয়ার। সান-ফ্লাওয়ার মিনস বিগ বিজনেস, সানফ্লাওয়ার মিনস মাল্টিন্যাশনাল। ইউ হ্যাভ অলরেডি বিকাম অ্যান ইম্পর্ট্যান্ট ম্যান ইন সানফ্লাওয়ার। ওদের দুশ্চিন্তা, পাছে আপনি ওদের ভুলে যান। সো ইট ইজ নেসেসারি দ্যাট ইউ আর রিমাইন্ডেড অফ দেম অ্যাফ্রেশ। রিনিউয়াল অফ রিলেশনশিপ। যা খুশি ভেবে নিতে পারেন। তবে আজকের এইসব আয়োজনের টার্গেট ছিলেন আপনিই। বুঝতে পারেননি?

দীপনাথ সততার সঙ্গেই ঘাড় নেড়ে বললে, না।

ইউ আর স্টিল অ্যান ইনোসেন্ট গায়। শুনলাম আপনি এখনও সেই পুরনো মেসবাড়িতে আছেন! মেস নয়, বোর্ডিং।

তা হবে। আপনাদের বিগ বসের স্টেনোে মিহির চৌধুরীকে চেনেন তো! একই বাসে বোধহয় আপনার সঙ্গে অফিসে যায়। সে বলছিল, মিস্টার চ্যাটার্জি খুব বিচ্ছিরি একটা জয়েন্টে থাকেন।

দীপনাথ বলল, আছি তো মোটে আর কয়েকটা দিন। এ কদিনের জন্য আর ফ্ল্যাট নিয়ে কী হবে? বরং ফিরে এসে দেখা যাবে।

ফিরে এসেই তো আর ফ্ল্যাট পাবেন না। যদি বলেন তবে আপনার জন্য একটা ওনারশিপ ফ্ল্যাট বুক করে রাখতে পারি। আমার এক বন্ধু শঙ্কর লেক গার্ডেন্স-এ অনেক ফ্ল্যাট তৈরি করছে। বলব তাকে?

দীপনাথ জাগতিক বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ভাবতে ভালবাসে না। একা মানুষ কোথাও পড়ে থাকলেই হয়। জবাব দিচ্ছিল না তাই। বোস বলল, কলকাতার হাউসিং প্রবলেমটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তার খোঁজ বোধহয় রাখেন না।

আমি একটা পুরো অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে কীই-বা করব! একা থাকলে রান্নাবান্নার ঝামেলা আছে। ফ্ল্যাট হলে আবার তার মেনটেনেন্স নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। ঘরদোর সাজাতেও হবে একটু। আমার যা জিনিসপত্র আছে তা দিয়ে একটা ছোট ঘরও ভরে না।

চিরকাল কি সমান যাবে?

আমার বোধহয় এমনিই কেটে যাবে।

ইউ আর নট বিয়িং প্র্যাকটিক্যাল। কলকাতায় কয়েক বছর আগেও ওনারশিপ ফ্ল্যাটের নামে লোক নাক সিঁটকোত। আজকাল একটা ফ্ল্যাট বুক করাই টাফ জব। বুক করে রাখুন। ফিরে এসে সোজা নিরাপদ নিজস্ব ফ্ল্যাটে ঢুকে যাবেন। সানফ্লাওয়ারের একজিকিউটিভ কেন থার্ড গ্রেড বোর্ডিং-এ থাকবে!

দীপনাথ একটু ভেবে বলল, আমি ভেবেছিলাম ফিরে এসে একটু ভাল কোনও বোর্ডিং-এ উঠব। বোর্ডিং-এ আর যা-ই হোক, লোনলি লাগে না। ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, ফ্ল্যাটটা বুক করাই যাক।

বোস খুশি হয়। বলে, উইথ এ গ্যারেজ।

ওঃ বাবা!

ডোন্ট ন্যাগ। ইউ ক্যান অ্যাফোর্ড এ কার নাউ। অফিস তো কার-অ্যালাউন্স দেবেই, অ্যাডভান্সও দেবে।

দীপনাথ কিছু বলল না। বোস সাহেব তার ভালই চায় বোধহয়। এখনও চায়। মণিদীপার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার সেই পাগলাটে চেষ্টার পরও।

এতক্ষণ একবারও মণিদীপা দেখা দেয়নি। বহুকাল মণিদীপাকে দেখেনি দীপনাথ। বলতে নেই ওই পরস্ত্রীর জন্য এখনও বুকের মধ্যে এক ছোট্ট শূন্যতা রয়ে গেছে। কোনওদিনই সেই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। মেয়েমানুষের মধ্যে শাশ্বত কিছুই পাওয়ার নেই, দীপনাথ জানে। রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু এসব হল ইমোশনাল একসেস। অতিশয় বাড়াবাড়ি। নারীপ্রেম জীবনের কতটুকু? ভাবপ্রবণ পুরুষেরা ব্যাপারটাকে যতদূর সম্ভব ফঁপিয়ে ফুলিয়ে তুলেছে। তবে এও ঠিক, যাকে পাওয়া গেল না, যাকে পাওয়ার নয়, সেই মেয়েটির জন্য দীর্ঘকাল স্মৃতিগন্ধময় বেদনার মতো কিছু থেকে যায়। সেটা হয়তো সঠিক প্রেম নয়, বকলমে নিজের আহত পৌরুষ। পুরুষ যেটাকে দখল করতে পারে না সেটাকেই মহিমান্বিত করে তোলার চেষ্টা করে।

বোস সাহেব হঠাৎ বলে, প্রসাদ খুব ভুল বলেনি। আপনাকে আজকাল একটু বেশিই বিষ দেখায়। সামথিং পার্সোনাল? সেই আপনার ভগ্নিপতির নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটাই কী?

শুধু তা নয়। আসলে পৃথিবীটা আমি যেমন চাই, পৃথিবীটা তেমন নয়।

এ কথায় বোস হেসে উঠতে পারত কিন্তু হাসল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, আপনি একটা পাহাড়ে চলে যাবেন বলে মাঝে মাঝে আমাদের শাসাতেন। এটা তারই প্রোলোগ নয় তো!

পাহাড়! বলতেই দীপনাথের সামনে মহাকায় সেই উত্তুঙ্গ শৃঙ্গের একটা ছায়া ভেসে ওঠে। হিম তুষারে ঢাকা, নির্জন, নিস্তব্ধ, প্রশান্ত। পৃথিবীতে তার কোনও তুলনা নেই। কোনওদিনই সেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবে না সে। শুধু আমৃত্যু আরোহণ করবে। সঙ্গে খাবার থাকবে না, জল থাকবে না, জাগতিক কোনও উপকরণ থাকবে না। সানফ্লাওয়ারের একজিকিউটিভের পায়ের তলায় জমি নড়ে উঠল হঠাৎ। মাঝে মাঝে সে যখন ডাকে তখন সব দড়িদড়া ছিড়ে যেতে চায় যে!

দীপনাপ মাথা নেড়ে বলে, না। সেটা হয়তো একটা রোমান্টিক চিন্তা। কিন্তু আমি সুখী নই অন্য কারণে। মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই অগভীর।

আপনি বরাবরই একটু ফিলজফার ধরনের। হাই থট। আই র্যাদার লাইক ইট। কিন্তু কথাটা হল, ফিলজফাররা জীবনে সুখী হয় খুব কমই। অবশ্য নন-ফিলজফাররাই যে সুখী হয় তাও নয়।

দীপনাথ একটু করুণভাবে হাসল। প্রসঙ্গটা পালটানোর জন্য একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ইজ দি হোমফ্রন্ট ও-কে?

বোস একটু অপ্রতিভ হয়। তারপর মৃদু মাথা নেড়ে বলে, সো সো। নাথিং হ্যাপেন।

তার মানে?

তার মানে নাথিং। রিং-এর মধ্যে দু’জন বক্সার, দুজনেই ডেঞ্জারাস। ঘুরছে, ঘুরছে, পরস্পরের দিকে সতর্ক চোখ রাখছে, কিন্তু কেউ কাউকে হঠাৎ অ্যাটাক করতে সাহস পাচ্ছে না। দি অ্যাটমোসফিয়ার ইজ চার্জড উইথ হেট্রেড, ক্রুয়েলটি, রেজ, বাট দেয়ার অলসো ইজ এ ভ্যাকুয়াম অফ নো অ্যাকশন। এ লাল।

দীপনাথ একটু লজ্জা, সংকোচ আর ভয়ের সঙ্গে খুব মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, নো সেক্স রিলেশন?

বোস সামান্য অবাক হয়। তবে মৃদু গলায় সহজভাবেই বলে, আই অ্যাম নো গুড ফর সেক্স নাউ। ডাক্তারের বারণ। ফিজিক্যালিও আমি আনফিট। তবে ফিট থাকলেও হয়তো সেক্স রিলেশন হত না। সেক্স তো শুধু শরীর নয়, অনেকটাই মন।

দীপনাথ মাথা নাড়ল, বুঝেছে।

বোস বলল, ড়ু ইউ থিংক উই শুড হ্যাভ সেক্স টাইম টু টাইম?

দীপনাথ একটু হাসল। তারপর বলল, দেয়ার ইজ এ পয়েন্ট টু পন্ডার। ইট মে হ্যাভ ইটস্ ইউজফুলনেস।

বোস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বুঝলাম। কিন্তু হাউ টু অ্যাপ্রোচ? শি মে রিফিউজ, শি মে ইনসাল্ট মি। বহুদিন আমাদের সম্পর্ক নেই। বহুদিন।

পরদার ওপাশ দিয়ে একটা সুগন্ধ হেঁটে গেল। দীপনাথ আর বোস চুপ করে যায়।

একটু বাদেই সুগন্ধটা ফিরে আসে। দাঁড়ায়। তারপর পরদা সরিয়ে নিঃশব্দে ভিতরে আসে।

এতদিনে সময় হল?

দীপনাথ চোখ তোলে। কিন্তু ভাল করে তাকায় না। হঠাৎ তার চোখ দুটো আবছা হয়ে আসে।

একটু হাসবার চেষ্টা করে সে বলে, এত কী রাঁধছেন?

একজন বিগ একজিকিউটিভকে নেমন্তন্ন করলে তার উপযুক্ত আয়োজন তো করতে হয়।

আমি আজকাল খেতে পারি না।

একজিকিউটিভরা খায় নাকি? ফেলে দেয় তো। আর তারা ফেলে দিয়ে ধন্য করবে বলেই তো এত যত্ন করে রান্না।

দীপনাথ মৃদু একটু হেসে বলল, ফেলব কেন? এ বাড়িতে তো কোনওদিন পাত পেড়ে খাইনি। আজ চেটেপুটে খেয়ে যাব।

এ কথায় লুকনো ছিল চোরা মার। এ কথা! ঠিক, দীপনাথ এ বাড়িতে অনেক ডিনার দেখেছে, কিছু কিছু জোগানদারের কাজও করেছে একসময়। কিন্তু গরিব ও স্ট্যাটাসহীন দীপনাথকে বোস সাহেব ডিনারে ডাকার সাহস পায়নি কখনও।

হাসিখুশি হতে গিয়েও কেমন একটু ফ্যাকাসে হয় গেল মণিদীপা। কত লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে দীপনাথের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে। এই তো সেদিন তার সঙ্গে দীপনাথকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিল বুনু। কী লজ্জা! কিন্তু আজ তার চেয়েও বেশি লজ্জা পায় মণিদীপা। সে মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে।

বোস সাহেব তার গ্লাসের তলানি একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে বলল, এটাকে ঠিক ফুল ফ্লেজেড ডিনার বলা চলে না। ইটস এ পার্সোনাল অ্যাফেয়ার। ডিনার হল সোশ্যাল মিট। বলে একটু হাসল বোস। বলল, আপনি বহুদূর চলে যাচ্ছেন। আজ চোখের জলে কিছু খাদ্যের সামনে বসে থাকা।

বোস এভাবে কথা বলে না কখনও। এই কথাটুকুর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। গভীর ভালবাসা ছিল। তাই অস্বস্তিটা কেটে গেল আবহাওয়া থেকে।

দীপনাথ সহজভাবে বসে বলল, মণিদীপা, আপনি কি এখনও একজিকিউটিভদের ঘেন্না করেন?

আমি বর্ন-হেটার অফ একজিকিউটিভস।

ভালবাসা বা ঘেন্না দুটোই দীর্ঘদিনের অভ্যাসে রপ্ত হয়। কেউ ঘেন্না নিয়ে জন্মায় না। আপনাকে কেউ না কেউ ঘেন্না করতে শিখিয়েছে।

হবে।—বলে মণিদীপা মুখোমুখি বসে। পরনে মোটা তাঁতের শাড়ি এবং সেটারও খুব চিক্কণতা নেই, ভজ নেই। চুল এলোমেলো। মুখে ঘাম। আঁচলে মুখ মুছে বলল, কেউ হয়তো শিখিয়েছে।

কিন্তু একজিকিউটিভদের ঘেন্না করার কিছু নেই। বরং তারাই সবচেয়ে করুণার পাত্র। মালিকরা তাদের বেশি মাইনের লোভানি দিয়ে লেলিয়ে দেয় নিজেদের ইচ্ছাপুরণে। দে বিকাম ডগস অফ দি ক্যাপিটালিস্টস। তারা যে চাকর সেটা ভুলে গিয়ে কিছুদিন ভুল অভিনয় করে যায় মাত্র। লম্বা বেতন পায় ঠিক, কিন্তু মদে পার্টিতে স্ট্যাটাসের পেছনে এত উড়িয়ে দেয় বা দিতে হয় যে, শেষ পর্যন্ত দে বিকাম হ্যাভনটস। প্রলেতারিয়েতস। বিশ্বাস করেন?

আপনি কি তাই?

আমি এ লাইনে নতুন। তবে অভিজ্ঞতা থেকে জানি।

বোস সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কথাটা ঠিক।

আসুন, খেতে দিই।—বলে মণিদীপা উঠল।

যখন খেতে বসার আগে বেসিনে হাত-মুখ ধুচ্ছিল দীপনাথ তখন মণিদীপা কাছে এল আচমকা। মৃদু স্বরে বলল, অনেক দূর। কেন যাচ্ছেন?

চাকরি।

মণিদীপা ঠোঁট কামড়ে একটু হাসে, আমেরিকায় না গেলেও দূরই তো ছিলেন। এ থাউজ্যান্ড লাইট-ইয়ারস।

দূরই ভাল।

ভুলে যাবেন?

সব কি ভোলা যায়? বোসকে দেখবেন। উনি খুব হেলপলেস।

জানি। আমিও তো হেলপলেস।

দু’জনেই হেলপলেস হলে আশা আছে। ইউ ক্যান হেলপ ইজ আদার।

ওসব থিয়োরি, থিয়োরি। জীবন ওরকম নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *