2 of 3

৮০. চিঠিটা এল দুপুরে

৮০

চিঠিটা এল দুপুরে। মুখ আঁটা একটা খাম। হাতের লেখা অচেনা। বীণার ঠিকানায় চিঠি আসেও না বড় একটা। ন’ মাসে ছ মাসে বিষ্ণুপুর থেকে মা কিংবা বাবা লেখে।

চিঠিটা খুলে বীণা খানিকক্ষণ বজ্রাহতের মতো বসে রইল।

নিমাই লিখেছে : কল্যাণীয়াসু, শ্রীভগবানের পাদপদ্মে তোমার কুশল কামনা করি। হয়তো পত্র পাইয়া অবাক হইবে। তোমার নাটকের দলের একটি ছেলের নাম সজল রায় দিনকতক আগে আসিয়াছিল। তোমার সম্পর্কে আমার দাবি-দাওয়া কতটুকু তাহা জানিতে চায়। সে তৃতীয় ব্যক্তি, তাহার কাছে কী বলিব? কিন্তু তাহার আগ্রহ ও ব্যস্ততা দেখিয়া মনে হইল, ইহার পিছনে অন্য কারণ আছে। বীণা, সজলকে পাঠাইলে কেন? তোমাকে তো আমার অধীনস্থ কখনও থাকিতে হয় নাই। আমিই তো তোমার অন্নদাস ছিলাম। কোন বাঁধনে তোমাকে বাঁধিব? আমার না আছে জোর, না যোগ্যতা। তোমার বন্ধন তো কখনও ছিল না। বহুকাল আগেই তোমাকে বলিয়াছি, আমাকে ছাড়িয়া যদি অন্য কাহাকেও বিবাহ কর তাহাতে আমার অপমান হইবে না। আমার কোনও স্বত্ব-স্বামীত্ব নাই। তবু যদি আদালতের রায় প্রয়োজন হয় তবে পত্রপাঠ সেই ব্যবস্থা করিও। আমি আইনের বন্ধনটুকু খুলিয়া দিতে সাহায্য করিব। আমরা যে স্তরের মানুষ সেই স্তরের মানুষের কাছে আইন আদালতের প্রয়োজন হয় না। মোটা অপরাধ না করিলে দেশের আইন আমাদের স্পর্শ করিবে না। তোমার ও আমার বিবাহের কোনও দলিল নাই, সাক্ষীসাবুদও নগণ্য। তাহার চেয়েও বড় কথা আমার দিক হইতে তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত। নিমাই অপদার্থ হইলেও, মিথ্যাবাদী নহে। নিশ্চিন্ত থাকিও। সজলবাবুর আগ্রহ দেখিয়া নিজেই তোমাকে সব জানাইয়া দিলাম। সর্বদাই তোমার মঙ্গল আকাঙক্ষা করি। শুভকামনা জানাইয়া রাখিলাম। অনর্থক আমাকে বাধা কল্পনা করিয়া বিব্রত হইও না। ইতি নিমাইচরণ রায়।

বীণা চিঠিটা বার কয়েক পড়ল। কেন পড়ল এবং বারবার পড়েও যেন একটা সংকেতবাক্য কেন উদ্ধার করতে পারল না তা নিজেও বুঝতে পারল না। ভরদুপুরে বন্ধ ঘরের মধ্যে বিছানায় অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সজল গিয়েছিল তা সে জানে। এসে বলেছিল, বীণা, তোমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাপ করে এলাম।

বীণা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন?

এমনিই। মানুষটা কেমন তা একটু জরিপ করে এলাম।

তার কোনও দরকার ছিল কি?

আমার ছিল।

কেন, সেটা বলবে তো?

সজল একটু হেসে বলল, কেন বোকা সাজছ? কেন গিয়েছিলাম তা তুমি জানো।

বীণা একটু চুপ করে থেকে বলল, কী বলেছে ও?

তেমন কিছু নয়। তবে সে তোমাকে মনে মনে ত্যাগ করেছে। ডিভোর্স দিতে রাজি।

সেটা আমি জানি।

তুমি কি মন থেকে ওকে ছাড়তে পারোনি এখনও?

বীণা একটু ভেবে বলল, তা হয়তো পেরেছি। কিন্তু বাড়াবাড়িটার দরকার ছিল না। আমার কোনও কাজে বাধা দেওয়ার সাহস ওর নেই। আমি যখন যা খুশি করব, ওর অনুমতি বা মতামতের দরকার আমার হয় না। তুমি ওর কাছে গিয়ে বরং আমাকেই অপমান করেছ।

যাঃ, এ তো উল্টো কথা শুনছি!

উল্টো নয় সজল। আমি তো কারও ক্রীতদাসী নই।

তা তো নও জানি।

না, জানো না। জানলে ওর কাছে দৌড়ে যেতে না। এ কথা কেন ভুলে যাও যে, আমার ভবিষ্যৎ আমারই হাতে! আমার জীবনটা আমারই! সেখানে কোনও পুরুষের কোনও ভূমিকাই নেই। আমি ওকে মানি না। তোমার যা কিছু বলার তা আমাকেই বলতে পারতে। ওর কাছে কেন গেলে?

সজল একটু যেন ভয় পেল। বলল, ভুল হয়ে গেছে বীণা। মাপ করে দাও।

সজলের সঙ্গে তার সম্পর্ক এর পর আরও একটু গাঢ় হয়েছে। সজল মেয়েদের ব্যাপারে সাহসী পুরুষ। অনেক পুরুষের শুধু এই একটা ব্যাপারে খুব সাহস আর আত্মবিশ্বাস থাকে। কিন্তু বীণাও কম পুরুষের সঙ্গে মেশে না। সে সজলকে একটু লাগাম পরিয়ে রাখল। খুব কাছাকাছি হতে দিল না।

সম্পর্কটা একটা জায়গায় থেমে আছে। বীণা শরীরের সম্পর্কে যেতে চায় না। ওটা ঘটে গেলে বেইমান পুরুষ ওইটেই চাইবে। দায়িত্ব নিতে পিছপা হবে।

সজল প্রায়ই আসে। চা খায়। রাত নটা দশটা অবধি গল্প করে। তারপর নানা ইশারা ইঙ্গিতের ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে যায়। একদিন বলেই ফেলল, আজ জ্যোৎস্না রাত ছিল বীণা, দুজনে যদি সারা রাত একসঙ্গে জেগে থাকতে পারতাম!

বীণা তাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, বাড়ি যাও।

তাড়িয়ে দিচ্ছ?

মেয়েদের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করা ছাড়া যে-সব পুরুষের আর কোনও বড় কাজ থাকে না তাদের মেয়েরা পছন্দ করে না সজল।

আমাদের মতো ছেলের আর কী বড় কাজ থাকবে বলো তো বীণা? আমি ইস্কুল-কেরানির ছেলে, কষ্টেসৃষ্টে বড় হয়েছি। লেখাপড়াও করেছি। কিন্তু ওসব লেখাপড়ায় তো কিছু হয় না। বাংলায় এম এ হয়েও একটা মাস্টারির চাকরিও জোটাতে পারিনি। অনেক টাকা দিতে হয়, তবে মাস্টারি মেলে। বড় কিছু করতেই তো সিনেমায় নামার জন্য ঘোরাঘুরি করতাম। হয়নি। ঘুরতে ঘুরতে কাকার দলে। কী বড় হবো বলো তো! কি ভাবে বড় হওয়া যায়? এ দেশে আমাদের মতো ছেলের জন্য ওপরে ওঠার কোনও সিঁড়ি নেই। এ তো তুমিও জানো বীণা।

জানি। কিন্তু তোমার মধ্যে চেষ্টাও নেই।

চেষ্টা নেই? না, কথাটা ঠিক হল না। এ কথা ঠিক যে, অভিনয়ে আমি খুব পাকা নই। কিন্তু শেখার চেষ্টা করেছি। হয়নি, কি করবো বলো?

নাটক লিখতে পারো না? বাংলায় এম এ, তোমার তো লেখার হাত থাকা উচিত।

ছিল একসময়ে। নাটক নয়, কবিতা লিখতাম। কিন্তু ওসব পোষাল না। কবিতার লাইনেও বেজায় ভিড়। সব লাইনেই দারুণ কমপিটিশন।

বীণা হেসে ফেলে বলেছিল, আজ বাড়ি যাও। জ্যোৎস্না রাতে আমার খুব ঘুম পায়।

তুমি যখন বলছ, নাটক লেখার চেষ্টা করব। কিন্তু তাতেও কিছু হবে না। আমি জানি।

তোমাকে বাড়িতে টাকা দিতে হয় না?

দিতে পারলে তো ভালই হত। টাকা কোথায়? তবে আমার এক ভাই স্টেট ট্রান্সপোর্টে চাকরি করে। কন্ডাক্টর। সংসার সে চালিয়ে নেয়।

সজল সে রাতে চলে গেল। কিন্তু তা বলে সঙ্গ ছাড়ল না। সঙ্গ ছাড়ুক এটা তো বীণাও চায় না। কিন্তু তার কপাল এমনই যে, এক হাড়হাভাতের বদলে এসে জুটল আর এক হাড়হাভাতে। তফাতের মধ্যে এর চেহারাটা বড় সুন্দর। আর গানের মোহময় গলা।

তুমি তো গায়ক হতে পারতে সজল?

চেষ্টা কি করিনি ভাবছ? আগে ফাংশনে গাইতাম। রেডিওতে তিনবার অডিশন দিয়েছি, হয়নি। বড় ওস্তাদের কাছেও তালিম নিতে গেছি। আমার গলায় নাকি ওসব সুর আসে না।

রিহার্সাল থেকে ফিরতে ফিরতে দুজনে কথা হচ্ছিল। বীণা টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখতে দেখতে বলল, সেরকম চেষ্টা করোনি। আমার গানের কান আছে। তোমার গলা বেশ ভাল।

বেশ ভাল, জানি। সবাই বলে, বেশ ভাল। কিন্তু গলারও একটা ক্যারেক্টার আছে। সেটা থাকলে লোকে গান শুনেই বলে উঠত, দারুশ ভাল, ইউনিক। তা কিন্তু কেউ বলেনি।

তোমার এই জিনিসটা আমার খুব ভাল লাগে।

কোন জিনিসটা?

এই যে, নিজের সম্পর্কে তোমার চাঁছাছোলা মতামত। তোমার অহংকার নেই।

তাও ছিল। একেবারে নেই বোলো না। তবে ছেলেবেলা থেকে বাস্তবের ঘষটানি খেয়ে খেয়ে অহংটা ভোঁতা হয়ে গেছে।

তুমি এম-এ পাশ, চেহারা সুন্দর, গানের গলা ভাল, তোমার যে কোথায় আটকাচ্ছে বুঝতে পারি না।

সজল হাসল, আমার চেয়ে ঢের বেশি শুণী ছেলেরাও ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বীণা। চান্স পাওয়া—কথাটা তো তুমি ভালই জানো। ওই চান্স পাওয়া যে কত শক্ত!

ঘরে এসে সজলকে চা করে খাওয়াল বীণা। তারপর বলল, শোনো সজল, বনগাঁয়ে পড়ে থেকে নিজেকে নষ্ট কোরো না। আরও চেষ্টা করো, খুব চেষ্টা করো।

সজল মাথা নেড়ে বলল, ইচ্ছেটাই মরে যাচ্ছে।

কেন মরে যাচ্ছে?

নিজেকে খুঁচিয়ে তুলবার আর উপায় নেই। তাই তোমার কাছে আমার একটা নিবেদন আছে। বলব?

বলো। আমাকে যদি কেউ সবসময়ে তাড়না করে, ভালবেসে, উৎসাহ দিয়ে চালাতে পারে তাহলে হয়তো কিছু এখনও হয়। বীণা, তুমিই একমাত্র যে পারো।

আমি! সর্বনেশে কথা।

আমি জানি তুমি বিবাহিতা, তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এখনও মুছে যায়নি। তবু তোমাকে প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল, তুমি ভীষণ তেজী, জেদী, একরোখা। তোমার মতো কাউকে পাশে পেলে হয়তো হয়।

বীণা হেসে ফেলল। বলল, এখন বাড়ি যাও। মাথা ঠাণ্ডা করো গে।

তুমি কি একটু নিষ্ঠুর বীণা?

না। আমি প্র্যাকটিক্যাল।

সজল চলে গেল বটে কিন্তু রেখে গেল তার ছায়াকে, তার মায়াকে। অনেক রাত অবধি তাকে নিয়ে এক মোহময় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল বীণা। সে কি এই চালচুলোহীন সুন্দর ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেল! কিন্তু এই কি প্রেমে পড়ার সময়! এখনও জীবনটা তো গুছিয়ে তুলতে পারেনি, সবে একটা সম্পর্ক ছিঁড়ে স্বাধীন হয়েছে। এখনই কি আবার গলায় ফাঁস পড়ার দরকার হল?

প্রেমে পড়েছে কিনা সেটা ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই কিন্তু তাদের নিয়ে গুজব ছড়িয়ে গেল। কাকা একদিন তাকে ডেকে আড়ালে বলল, বীণা, কি সব শুনছি! সত্যি নাকি?

কী শুনছ?

তোমাকে আর সজলকে নিয়ে।

বীণা ঠোঁট উল্টে বলল, গুজবে কান দাও কেন?

তাহলে সত্যি নয়?

না।

কাকা একটু ভেবে বলল, তোমার পারসোনাল ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিত নয়। কিন্তু একটু ভেবে দেখো। সজল সবে কিছুদিন হয় দলে এসেছে, এখানকার ছেলেও নয়। ওর সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিয়ে তারপর এগোনো ভাল।

বীণা একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, তার মানে তুমি আমার মুখের কথাটা বিশ্বাস করলে না? ধরেই নিচ্ছ যে সজলের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছে?

তোমার মুখে আরও কিছু কথা ফুটে উঠছে বীণা। সেগুলো তুমি উচ্চারণ করছ না বটে, কিন্তু গোপনও থাকছে না। আমার কাছে অস্বীকার করে কি লাভ? সজলকেও তো দেখছি, বড্ড উড়ু-উড়ু ভাব। ওসব কি গোপন করা যায় বীণা?

বীণা একটু রেগে গিয়ে বলল, সজলকে নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক সমস্যা।

কাকা গম্ভীর মুখে বলল, রাগ কোরো না। যা করবে তা ভেবেচিন্তে করতে বলেছি। তোমার ভাল চাই বলেই বলেছি, অন্য কারও ব্যাপার হলে মাথাই ঘামাতাম না। যাত্রা থিয়েটার সিনেমায় এসব তো হয়েই থাকে। কেউ গায়ে মাখে না। আমারও শুচিবায়ু নেই। কিন্তু নিমাই চলে যাওয়ার পর থেকে তোমার ভালমন্দ নিয়ে আমার একটা উদ্বেগ থাকে।

সেটা তোমার দয়া কাকা, তুমি আমার জন্য অনেক করেছ।

ওটা কথা নয়। আমি গুণের দাম দিই। তোমার গুণের কদর আমি আর কতটুকু করতে পারি? কিন্তু কথাটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। আসল কথাটা হল, যা করবে ভেবেচিন্তে কোরো।

ঠিক আছে কাকা।

সেদিন সজলকে এড়িয়ে একা ফিরল বীণা। কিন্তু পরদিনই সজল তাকে ধরল, বীণা, কী হয়েছে? অমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন?

তোমার জন্য আমাকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে।

সজল একটু হাসল, কথায় কি যায় আসে? কে তোমাকে কী বলেছে বীণা?

সেসব শুনে তোমার লাভ নেই। আমার মন খুব খারাপ।

সজল অসহায় মুখ করে বলল, তোমাকে কিছু বলতে আমার ভয় হয়। যা রেগে যাও! কিন্তু বীণা, আমার অপরাধটা কি?

তোমার অপরাধ কি কে জানে! কিন্তু আমাদের নিয়ে কথা হচ্ছে।

হোক না।

তুমি যত সহজে হোক না বলতে পারলে আমি তত সহজে বলতে পারব না। পুরুষমানুষদের অনেক সুবিধে, মেয়েদের তা নেই। সমাজের যত খবরদারি তো মেয়েদের ওপরেই। সেইজন্য আজকাল পুরুষ জাতটার ওপরেই আমার ঘেন্না হয়।

সজল লজ্জা পেয়ে বলে, আমার জন্য তোমার কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো বীণা? কিন্তু তোমার সঙ্গে মেলামেশা ছাড়া, চা খাওয়া ছাড়া আমি তো আর কিছু করিনি! তোমার সঙ্গ আমার ভাল লাগে, তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন বলে মনে হয়। কি করে এই ভাল লাগাটাকে, প্রয়োজনটাকে অস্বীকার করি বলো!

বীণা একটু ভিজল। নরম গলায় বলল, কিছুদিন আমার সঙ্গে মিশো না। একটু দূরে থাকো।

ও বাবা! তোমাকে একদিন না দেখলে যে ভীষণ অস্থির লাগে!

বীণা হেসে ফেলল। তারপর বলল, তাহলে আড়াল থেকে দেখো। কাছে বেশি এসো না।

সজল মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, বীণা, তুমি এত তেজী, এত স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্বময়ী তবু মাঝে মাঝে এমন মধ্যযুগীয় মহিলার মতো হয়ে যাও কেন? লোকে কথা রটাচ্ছে বলে ভয় পেয়ে গেলে? আজকাল মেলামেশা নিয়ে কেউ কি মাথা ঘামায়? সিরিয়াসলি ঘামায় না। তবে পাসটাইম হিসেবে কূটকচালি করতে পারে। তা করুক না, কি যায় আসে তাতে?

বীণা এই সুপুরুষ তরুণটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যদি মেয়ে হতে তো বুঝতে। স্বাধীনচেতা, তেজী হয়েও মেয়েদের কত বাধা থাকে।

জানি, সব জানি। কিন্তু আমি তোমাকে কখনও ঠকাব না, কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করব না তোমার সঙ্গে। আজ অবধি আমি তোমার মতো আর কাউকে খুঁজে পাইনি।

সজলের আবেগ প্রায় কন্ঠরুদ্ধ করে দিচ্ছিল তার। বীণা তাই খুব কোমল কণ্ঠে বলল, তোমাকে আমারও খুব ভাল লাগে। কিন্তু জানো তো, একটা সম্পর্কের জ্বালা আমার এখনও যায়নি। আমার আর একটু সময় লাগবে। তুমি যেমন অস্থির হয়ে পড়ছ, আমি তেমনটা হতে পারছি না। ঘরপোড়া গরু তো!

সে ঠিক আছে, কিন্তু দূরে সরে থাকতে বলছ কেন? আমি তো শুধু সঙ্গটুকুই চাই, তার বেশি এখন কিছু চাই না।

এই পাগলকে নিয়ে আর পারল না বীণা। তার প্রতিরোধ ভাঙল। তবুবলল, খুব বেশি নয় কিন্তু।

কিন্তু সেটা কথার কথা হয়ে রইল। রিহার্সালের পর একসঙ্গে ফেরা, চা খাওয়া এবং গল্পগুজব যথারীতি হতে লাগল। কথাবার্তায় অনেক ফেরতা, অনেক ইশারা ইঙ্গিত, চোখে চোখ রেখে মুগ্ধমূক হয়ে বসে থাকা। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দুজন। টের পাচ্ছে, তবু ঠেকাতে চেষ্টা করছে না।

ঠিক এই অবস্থায় এল নিমাইয়ের এই চিঠি। হতবাক বীণা চিঠিটার দিকে চেয়ে রইল। নিমাইয়ের হাতের লেখা সে চিনত না, কেনো নিমাই এর আগে কোনওদিন তাকে চিঠি লেখেনি, তার দরকারও হয়নি। হাতের লেখাটা খুবই সুন্দর, ভাষা গোছানো। বীণা চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে দিল। বক্তব্য নতুন নয়, এরকম কথা নিমাই তাকে আগেও বলেছে। নতুন হল, চিঠি।

কাঁচড়াপাড়ায় একদিন সকাল দশটা নাগাদ নিমাই তার দোকানের কোণটিতে বসে এক গেলাস ঘোল খাচ্ছিল। দোকানে এখন ভিড় নেই। দুপুরের খাবার তৈরি হচ্ছে। এগারোটার পর মানুষের গাদি লেগে যাবে। রান্নার গন্ধটা পাচ্ছিল নিমাই। রোজ সে এই গন্ধটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করে। গন্ধেই তো স্বাদ। ঠিকমতো গন্ধ না বেরোলে গিয়ে রাঁধুনীকে একটু সমঝে দিয়ে আসে। সে সতর্ক মানুষ। কোথাও ফাঁক রাখতে চায় না। বাসি জিনিস মেশাতে দেয় না কখনও। রাতের বাসি বাড়তি খাবার নিয়ে যায় কিছু ভুখা মানুষ আর কচিকাঁচা বাচ্চারা। ওটা তার নিত্যকার কাঙালীভোজন। লোকে নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দেয় তাকে। লাভ বাড়ানোর ফন্দিফিকির বলে যায়, নিমাই সেগুলো শোনে, কিন্তু মানে না। সেই যে কথায় আছে, হাঁ জী, হাঁ জী করতে রহো, বৈঠো আপনা ঠাম। তেল মশলায় তার কোনও ফাঁকি নেই। ঘানির তেল, বাছাই মশলা। তার দোকানে বাসন, কাপ প্লেট ধোয়া হয় সযত্নে, কোথাও ফাঁক থাকে না নিমাইয়ের। শালপাতা, কলাপাতা, ভাঁড়ের ব্যবস্থাও আছে। এত সামলে চলতে গিয়ে মাথার মধ্যে আর অন্য চিন্তা পাক খায় ঘোলটা শেষ করে হিসেবের খাতা টেনে নিয়ে বসতে যাবে, এমন সময়ে একটা লোক ঢুকল দোকানে।

নিমাই যে! ভাল আছ?

নিমাই শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল। একগাল হেসে হাত জোড় করে বলল, কাকা! এতদিন পর নিমাইকে মনে পড়ল তাহলে? আসুন, আসুন, বসুন ভাল করে।

কাকা বসল। নিমাই বলল, একটু কিছু মুখে দিতে হবে। কী খাবেন বলুন তো!

ব্যস্ত হয় না। সকালে জিলিপি আর কচুরি ঠেসেছি, এখন আর খাওয়া নয়। এক কাপ চা দাও শুধু।

চায়ের হুকুম দিয়ে জুৎ করে বসল নিমাই মুখোমুখি। বলল, তারপর খবরটবর কি?

তুমি তো আর বনগাঁ-মুখো হলে না!

নিমাই হাত উল্টে বলল, কি করতে যাবো? বনগাঁর পাট তো চুকেই গেছে। তা এখানে হঠাৎ আসা হল কেন?

একটা বায়নার ব্যাপার ছিল। কাল রাতেই এসেছি। আজ বনগাঁ রওনা হওয়ার মুখে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছি। বীণার খবর-টবর নাও না?

নিমাই সলজ্জ হেসে বলল, তার কথা আবার কেন? যতদূর জানি ভালই আছে, নামটামও হচ্ছে।

কাকা মৃদুস্বরে বলল, তোমাদের মধ্যে কি হয়েছিল আমাকে একটু বলবে নিমাই? যদি বাধা না থাকে?

নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলল, সব কথা কি খোলসা করে বলা যায় কাকা?

খোলসা করে বলতে বলছি না। স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, আবডাল থাকাই ভাল। কিন্তু মোদ্দা কথাটা কী?

নিমাই মুখখানা গম্ভীর করে বলল, আমাকে তার আর দরকার হচ্ছে না।

এটা কোনও কথা হল?

একটা মানুষ আর একটা মানুষের কাছে হঠাৎ যে কেন ফুরিয়ে যায় তা তো বলতে পারি না। মনের রহস্য কে ভেদ করতে পারে বলুন।

বীণাও কি তোমার কাছে ফুরিয়ে গেছে?

নিমাইয়ের চোখদুটো মেদুর হয়ে গেল! গলাটাও কি ধরে গেল একটু? সামান্য ভারী গলায় বলল, না কাকা। সে আমাকে যে চোখে দেখত আমি তো তাকে সে চোখে দেখতাম না।

ওইটেই তো আমি জানতে চাই।

নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার জন্য অনেক করেছে বীণা। অনেক। অসুখবিসুখে যখন যেতে বসেছিলাম তখন সে-ই আমাকে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনে। তার দয়ায় আমার মা-বাবা উপপাসের হাত থেকে বেঁচে যায়। কত মুখে তার কথা বলব? সে আমার কাছে ফুরোবে কেন?

কাকা একটু চুপ করে থেকে বলল, সজল নামে একটা ছেলে এসেছিল তোমার কাছে?

নিমাই তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, এসেছিলেন। বড় ভাল ছেলেটি।

কী বলতে এসেছিল?

নিমাই ম্লান একটু হাসল, তিনি বোধ হয় আমার মনোবাসনা জানতে এসেছিলেন। তা আমি বলে দিয়েছি, আমার কোনও দাবিদাওয়া উঠবে না কখনও। মানুষকে কি দাবিদাওয়া করে, আইন আদালত করে আটকানো যায়?

কাকা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর বলল, তোমার মতো মানুষ আমি বেশি দেখনি নিমাই। তোমার রাগ হয় না?

জিব কেটে নিমাই বলে, রাগ! বলেন কি? রাগ কি আমার শোভা পায়। আজও তার ঋণে আমার কাঁধ ভারী হয়ে আছে। আমি অকৃতজ্ঞ নরাধম বলে তার ঋণ শোধ করতে পারিনি। শোধ করতে গেলে হয়তো উল্টো বুঝবে, তাই চেষ্টাও করিনি।

কাকা দৃঢ় গলায় বলে, তোমার কাছে বীণার অনেক শেখার ছিল। আমাদেরও শেখার আছে। দোকানটা তো দিব্যি দাঁড়িয়ে গেছে দেখছি।

ভগবানের দয়া।

এলেম তোমার কম ছিল না। হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলে বলে হচ্ছিল না। তোমার উন্নতি দেখে যে কী খুশি হয়েছি তা বলার নয়।

আশীর্বাদ করবেন যেন টাকাপয়সা আমাকে খেয়ে না ফেলে। ভগবানে যেন বিশ্বাস-ভক্তি থাকে। একটা কথা বলব কাকা? আমার একটা কাজ করে দেবেন?

কী কাজ?

বীণার জন্য পাঁচ হাজার টাকা তুলে রেখেছি। এমনিতে সে হয়তো নেবে না। আমার নাম না করে টাকাটা তাকে দেবেন?

পাঁচ হাজার টাকা! সে তো অনেক টাকা!

টাকাই তো। কাগজ মাত্র। তবু এ দিয়ে তার যদি কিছু উপকার হয় তো আমি শান্তি পাবে। আপনি একটু অন্যভাবে দেবেন।

কী বলব তাকে?

সে আপনি ঠিক করে নেবেন।

মিথ্যে কথা বলতে বলছ?

জিব কেটে নিমাই বলে, না না, তা কেন? ধরুন, টাকাটা আমি আপনাকেই দিচ্ছি। এবার আপনার অভিরুচি।

ইতি গজ? বলে কাকা হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, দাও। এ টাকায় খেলে তার অনেক পাপ কেটে যাবে। দাও।

নিমাই উজ্জ্বল হয়ে বলল, বাঁচলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *