৭ বংশবাটি

৭ বংশবাটি

চল, এবার গঙ্গার ওপারে যাওয়া যাক। কাঞ্চনপল্লীর ওপারে বংশবাটী। না, দিদি, স্টীমলঞ্চে পার হওয়া চলবে না। কেন? ভুলে গেলে নাকি হে, তুমি আমার যাত্রাসঙ্গিনী হয়েছ অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আমি এখন এই স্থবিরা বিংশশতাব্দীর পলিতকেশ কথাসাহিত্যিক নই, আমি এখন—‘কালিদাসকে হারিয়ে দিয়ে গর্বে বেড়াই নেচে’।

চল, পারানি নৌকায় তোমাকে ওপারে নিয়ে যাই।

পারানির কড়ি আছে তো তোমার ঐ ‘ফুটুনি-বটুয়ায়’? এক কড়ি লাগবে। নেই বুঝি? তা না থাক, পয়সা তো আছে? কপর্দক? তাও নেই। সর্বনিম্ন মুদ্রা কী আছে তাহলে? পাঁচ নয়া? মহো ভাগ্য! নিরানব্বই কড়া ভাঙানি পাব কোথায়? ঠিক আছে, আমিই না হয় তোমার পারানির কড়ি গুণে দেব। কী আর করা? যাত্রাসঙ্গিনী হতে যখন রাজী হয়েছ, তখন এক কড়া বহুদ্দো খরচই করা যাক!

তুমি-আমি পারানি-নৌকায় গঙ্গা পার হলাম।

ঐ দেখ, ঘাটোয়াল আমাকে চেনে। বলছে, হুঁসিয়ার ঠাকুর-মোসা! ঘাট পিছল হৈ!

আমি ওকে বলতে গেলাম, ‘দুনিয়ার সব ঘাটই তো পিছল মাঝি-ভাই’—কিন্তু বলা হল না। নজর হল, তুমি ইতস্তত করছ নৌকা থেকে পিছল-ঘাটে পা বাড়াতে।

ঘাটোয়াল আমাকে ধমক দেয়, কেমন মানুষ আপনি ঠাকুর-মোসা! মাইজির হাতটো তো পাকড়ান!

শুধু তুমি নয়, আমিও লজ্জা পেয়েছি। ঘাটোয়াল ভুল বুঝেছে! লেখক-পাঠিকার সম্পর্কটাও নিবিড়—শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসার—কিন্তু তা কি জানে ঐ ঘাটোয়াল? তুমি সামলে নিয়ে বললে, না না, ভয় পাইনি, ভাবছিলাম আলতাটা ধুয়ে যাবে!

তা বটে! তোমার পায়ে তো হাই-হিল নেই, নূপুর-বেষ্টিত অলক্তক-আলিম্পন। কিন্তু তাই বলে আমি তো আর তোমাকে পাঁজা-কোলা করে পিছল ঘাটটুকু পার করে দিতে পারি না। হয়তো সে আশঙ্কাতেই তুমি আর ইতস্তত করলে না—খপ্ করে চেপে ধরলে আমার হাতটা।

শৈশবের হাঁটি-হাঁটি পা-পা ছন্দে দুজনে উঠে এলাম শক্ত জমিতে।

.

বংশবাটী

আমরা দুজন বংশবাটীতে পৌঁছলাম—সেই 1742 সালে। তখনো ওখানে হংসেশ্বরী মন্দিরটা নির্মিত হয়নি। সেটার নির্মাণকার্য শেষ হয়েছিল 1814 খ্রীষ্টাব্দে। তবে স্বয়ম্ভরা এবং অনন্ত বাসুদেবের মন্দির দুটি ছিল। কিন্তু সেসব গল্প দ্বিতীয়বার বলব না। ‘হংসেশ্বরী’-তে তা বিস্তারিত বলেছি। অনন্ত বাসুদেব মন্দিরটিই প্রাচীনতম নির্মাণ কাল 1679; ঔরঙ্গজেবের জমানায় বংশবাটী সম্বন্ধে যে দুটি তথ্য “হংসেশ্বরী” উপন্যাসে বলা হয়নি,শুধু তাই বলি। প্রথম কথা দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নাটকে বর্ণিত নীলকুঠির অবস্থান এই বাঁশবেড়েয়। দ্বিতীয় কথা : এখানে 1843 খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার তত্ত্ববোধিনী সভা একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কিশোরমতি পড়ুয়ার দল বেদান্তের দিকে ঝুঁকে পড়ছে দেখে স্থানীয় পণ্ডিতেরা তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যান। একযোগে সবাই ছাত্রদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। বিদ্যালয়টি উঠে যায়।

আরও দুটি কথা প্ৰসঙ্গত বলি :

এক নম্বর : এখানে বহু পূর্বযুগে একটি গীর্জা ছিল। কারও কারও মতে সেটি বঙ্গদেশের প্রথম নির্মিত গীর্জা। সেটা বিতর্কমূলক, কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, সেই গীর্জার প্রধান পাদ্রী ছিলেন প্রথম ভারতীয় পাদ্রী : তারাচাঁদ। ইংরাজী, ফরাসী এবং পর্তুগীজ তিন-তিনটি ভাষা জানতেন তিনি। বলাবাহুল্য, তার সঙ্গে বাঙলা, হিন্দি ও সংস্কৃত। সম্ভবত আরবী-ফার্সিও!

দ্বিতীয়ত : তারাশঙ্কর তাঁর ‘রাধা’ উপন্যাসে দরাফগাজীর উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন, মনে পড়ে? ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে গাজীকে আসতে দেখে পাঁচিল-আসীন হিন্দু সন্ন্যাসী ‘পাঁচিল চেপে’ এগিয়ে আসেন? সেই ঘটনাটি এই বাঁশবেড়ের। সন্ন্যাসীর নাম ভিখারীদাস। খামারপাড়ায় বাবাজীর আখড়াটির অবস্থান লোকে এখনো দেখায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *