2 of 2

৭৯. স্টিমার ছাড়ল খুলনা থেকে বরিশালের দিকে

একটা বড় স্টিমার ছাড়ল খুলনা থেকে বরিশালের দিকে। সাধারণ যাত্রীবাহী স্টিমার নয়, এর পুরোটাই ভাড়া নেওয়া হয়েছে দেশকর্মীদের জন্য। ওপরের ডেকের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সুরেন্দ্রনাথ, বিপিনচন্দ্র, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, মতিলাল ঘোষ, কৃষ্ণকুমার মিত্র প্রমুখ প্রবীণ নেতারা এবং সস্ত্রীক আবদুল রসুল ও আবদুল হালিম গজনভি। আর এক দিকে ছেলেছোঁকরার দল, তাদের মধ্যে মিশে আছে বারীন্দ্রকুমার, হেমচন্দ্র, ভরত, উপেন, নরেন গোঁসাই, সত্যেন, কানাই এবং অরবিন্দ ঘোষ।

স্টিমারটি যাত্রা শুরু করার সময় তীর থেকে হাজার হাজার লোক তুমুল কণ্ঠে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছে। এর আগে আরও তো কত সভা-সমিতি হয়েছে, কিন্তু সকলেরই কেন যেন ধারণা হয়ে গেছে যে, বরিশালের সভায় একটা দারুণ কিছু ঘটবে। সাধারণ মানুষও এমন উদ্দীপনা দেখাচ্ছে, যেন এটা যুদ্ধযাত্রা, স্বদেশি বাবুদের সঙ্গে এবার সরাসরি লড়াই বাঁধবে ইংরেজ সরকারের।

চৈত্রের শেষ, এর মধ্যে বেশ গরম পড়ে গেলেও সকালবেলার বাতাসে তেমন তাপ নেই। ধান কাটা হয়ে গেছে, নদীর দু’পারের মাঠ শুষ্ক, রুক্ষ। মাছ ধরা নৌকোগুলো স্টিমারের ভোঁ শুনে এস্তে সরে যাচ্ছে পাড়ের দিকে, উড়ে যাচ্ছে বকের ঝাঁক। নদীতে দেখা যাচ্ছে শুশুক, মাঝে মাঝে চর থেকে সরসর করে নেমে যাচ্ছে কুমির।

স্টিমার আলাইপুর স্টেশনে পৌঁছতেই দেখা গেল যে, সেখানেও অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছে এক বিশাল জনতা। কী করে আগে থেকে খবর রটে গেল! লক্ষ করতে দেখা গেল, জনতার মধ্যে রয়েছে অনেক চাষা-ভুষো, জেলে। ছাত্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারাও বন্দেমাতরম ধ্বনি দিচ্ছে। নাচানাচি করছে অল্পবয়েসীরা! লাল কাপড় দিয়ে তারা পতাকা বানিয়েছে। কেউ কেউ লাঠির তলায় লাল গামছা বেঁধে পতাকা করে নিয়েছে। ভারতবাসীর কোনও পতাকা নেই। কী করে এরা লাল রংটা বেছে নিল? যেন রক্ত ঝরানোর জন্য সবাই প্রস্তুত হচ্ছে।

বারীন বলল, দেখো দেখো, জেলেরা নৌকোয় জাল গুটিয়ে রেখে দৌড়ে আসছে স্টিমারঘাটায় আর বন্দেমাতরম বলে চেঁচাচ্ছে। ওরা কি বন্দেমাতরম কথাটার মানে জানে?

হেম বলল, মানে না জানলেও ধ্বনিটা কানে ভাল শোনায়। ওরা মন্ত্রের মতন একটা কিছু পেয়ে গেছে।

ভরত বলল, হঠাৎ বন্দেমাতরম ধ্বনিটা কী করে সারা দেশে ছড়িয়ে গেল? বঙ্কিমবাবু যখন গানটা লিখেছিলেন, তখন বোধহয় তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি যে, এই শব্দের এরকম ব্যবহার হবে!

বারীন বলল, বন্দেমাতরম ধ্বনিটা ছড়াতে বেশি সাহায্য করছে তো ইংরেজ সরকার! তারা নিষিদ্ধ। করেছে বলেই লোকে এখন বেশি বেশি বলছে!

হেম বলল, এবারে কাশী কংগ্রেসেও অনেকে নাকি বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়েছে। অবাঙালিদের মধ্যেও এটা ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ভরত বলল, একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে। সরকার নিষেধ করেছে জেনেও সাধারণ মানুষ এই ধ্বনি দিতে সাহস পাচ্ছে কী করে? সাধারণ মানুষ সরকারকে ভয়-ভক্তি করে। এর আগে কেউ কি কখনও দেখেছে যে, এ দেশের সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে সরকারি নিষেধ অগ্রাহ্য করছে?

হেম বলল, একটা নতুন আলো ফুটেছে, মানুষের ভয় ভাঙছে। এইখান থেকেই আইন অমান্য শুরু হবে!

সত্যেন বলল, নেতারা কিন্তু এখনও আইন অমান্যের পথে যেতে চান না!

হেম অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, নেতা? সেরকম নেতা কে আছে, যার কথা সবাই শুনবে? এক এক জন এক এক রকম কথা বলে!

এক পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সিগারেট টানছেন অরবিন্দ। এর আগে তিনি কলকাতা ও দেওঘর ঘুরে গেছেন, কিন্তু গ্রাম বাংলা সম্পর্কে তাঁর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। এমন দৃশ্য তিনি আগে দেখেননি। এত জল, চতুর্দিকে জল! একটার পর একটা নদী এসে মিশছে। ঘাটে ঘাটে স্নান করছে কত নারী-পুরুষ, সবাই বাংলায় কথা বলে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে মন্দির-মসজিদের চূড়া। অপূর্ব এক ভাল লাগায় তাঁর মন ভরে আছে।

স্টিমারটি যেখানে যেখানে থামছে, সর্বত্রই একই দৃশ্য। বহু মানুষ জড়ো হয়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে সহমর্মিতা জানাচ্ছে এই স্টিমারের যাত্রীদের সঙ্গে।

আবদুল রসুল পায়চারি করতে করতে চলে এসেছেন ডেকের অন্য প্রান্তে। হেম এবং ভরত সসম্ভ্রমে তাঁকে অভিবাদন জানাল। রসুল সাহেব অরবিন্দর দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, মাপ করবেন, আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার এক পূর্ব-পরিচিতর খুব মিল আছে। আপনি…আপনি এ ঘোষ?

অরবিন্দও কুঞ্চিত করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বললেন, রসল?

রসুল সাহেব বললেন, তবে ঠিকই ধরেছি। অরবিন্দ, তুই?

দুই বন্ধুতে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন।

বিলেতে এঁরা দুজন ছিলেন সহপাঠী। একেবারে একই বয়েসী। দেশে ফিরে আসার পর আর পরস্পরের যোগাযোগ ছিল না।

প্রাথমিক উচ্ছাসের পর রসুল বললেন, কতকাল পর দেখা। এখন কী করছিস তুই? আই সি এস তত শেষ পর্যন্ত দিলি না। চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়, তাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি, সে-ও ঠিক বলতে পারে না।

অরবিন্দ বললেন, আমি যে থাকি অনেক দূরে, বরোদায়। বিলেতের কোনও বন্ধুর সঙ্গেই বিশেষ যোগাযোগ নেই। বাংলায় খুব কম আসা হয়।

রসুল জিজ্ঞেস করলেন, বরোদায় কী করছিস? ব্যারিস্টারি?

অরবিন্দ হেসে বললেন, না। ওখানকার রাজ কলেজে ইংরিজি পড়াই। তুই বরাবরই বক্তৃতায় তুখোড় ছিলি, বিলেত থাকতেই বুঝেছিলাম, তুই সফল ব্যারিস্টার হবি। তাই-ই হয়েছিস নিশ্চয়ই। আমি ওসব ঠিক পারি না।

রসুল বললেন, তুই তো ছিলি কবি। এখনও কবিতা লিখিস? দাঁড়া, দাঁড়া, মনে পড়ছে, একটা কথা! এখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথাবার্তা চলছে জানিস তো? প্রায় পাকা হয়ে গেছে। বড় বড় নেতারা আলাপ-আলোচনা করছেন যে, সেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ কে হবেন? একবার মিস্টার ঘোষ বলে একজনের নাম উঠেছিল, সেই ঘোষ তা হলে তুই? অবশ্য বরোদায় তুই নিশ্চয়ই অনেক বেতন পাস, এখানে তো সামান্য টোকেন মানির বেশি দিতে পারবে না। তুই কি রাজি হবি?

অরবিন্দ বললেন, বরোদায় আর আমার ভাল লাগছে না! এত বড় ঝড় উঠেছে বাংলায়, আমি কি আর এখন অত দরে বসে থাকতে পারি?

বসুল বললেন, তুই বরিশালের সভায় যোগ দিতে যাচ্ছিল, এ কথাও কেউ আমাকে জানায়নি।

অরবিন্দ বললেন, জানাবার তো কিছু নেই। আমি শুধু দেখতে যাচ্ছি।

রসুল বললেন, সুরেনবাবু, বিপিনবাবুদের সঙ্গে তার পরিচয় আছে? চল চল ওদিকে চল।

রসুল অরবিন্দকে টেনে নিয়ে গেলেন।

যথাসময়ে স্টিমারটি পৌঁছল বরিশাল শহরে। এখানেও স্টিমারঘাটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অগণ্য মানুষ। কিন্তু এখানে একটি বিচিত্র ব্যাপার ঘটল! স্টিমার থেকে সবাই চেঁচিয়ে উঠল, বন্দেমাতরম। কিন্তু ওদিক কে কোনও প্রতিধ্বনি এল না। সবাই নিঃশব্দ। যেন মুখে কুলুপ এঁটে আছে।

এর আগে সব জায়গায় মানুষ এত উদ্দীপনা দেখিয়েছে, অথচ বরিশালে কোনও সাড়াশব্দ নেই? তবে কি বরিশালের মানুষ এখানে সভা করার বিরোধী? কিন্তু এ যে অবিশ্বাস্য!

সমস্ত পূর্ব বাংলার মধ্যে বরিশাল জেলা এক বিশেষ ব্যতিক্রম। অন্যান্য অনেক জায়গায় ঢাকার নবাবের নির্দেশে বয়কট ভাঙা হয়েছে, বয়কটের স্বেচ্ছাকেঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে, বঙ্গভঙ্গের সপক্ষে জোর প্রচার চালানো হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের মতবিরোধ প্রকট হওয়ায় ছোটখাটো দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয়েছে কয়েক জায়গায়। ঢাকার নবাব বাংলা ভাষার ঐক্যের দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন, বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই, তিনি উস্কে দিয়েছেন ধর্মীয় অগ্রাধিকারের প্রশ্ন : একমাত্র বরিশাল জেলাতেই সফল হতে পারেনি তার দলবল। তাঁর কারণ, বরিশালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা অশ্বিনীকুমার দত্ত। তিনি মুসলমান-হিন্দুর কাছে সমান জনপ্রিয়। দুর্ভিক্ষ-মহামারীর সময় তিনি কে হিন্দু, কে মুসলমান তা বিচার করেন না, তিনি আর্তদের বুক দিয়ে সেবা করেন। বিপদে পড়লে যে-কেউ এসে তাঁর কাছে সাহায্য পায়। লোকের মুখে মুখে তাঁর ডাকনাম শুধু বাবু। এই বাবু যা বলবেন, প্রত্যেকে তা মেনে নেবে! অশ্বিনীকুমার বিলিতি দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন, এই জেলায় এই সব জিনিসের সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ কোনও বিলিতি জিনিস ছোঁবে না। কেউ বিলিতি কাপড় পরলে তার ধোপা-নাপিত বন্ধ। এক বৃদ্ধ মুসলমান অশ্বিনীকুমারের কাছে এসে কাঁচুমাচু গলায় বলেছিল, বাবু, আমার বাড়িতে একটা বিলিতি আমড়ার গাছ আছে, সেটাকে কেটে ফেলব? অশ্বিনীকুমার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, নারে না, নামে বিলিতি আমড়া হলেও সেটা তো দেশের মাটিতেই গজিয়েছে! এ দেশের মাটিতে যা উৎপন্ন হবে, সবই স্বদেশি!

অশ্বিনীকুমারকে টিট করার জন্য নবাবের পক্ষ থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে কম চেষ্টা করা হয়নি। নবাবের অনুগত মোল্লারা এসে প্রচার করতে লাগল, হিন্দুদের এই আন্দোলনে মুসলমানদের যোগদান ধর্মবিরুদ্ধ। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানদের মিল কোথায়? আমরা পশ্চিম দিক মুখ করে নামাজ পড়ি, হিন্দু সন্ধ্যাপূজা করে পুব দিকে মুখ ফিরিয়ে। আমরা কলাপাতার যে পিঠে ভাত খাই, হিন্দু তার উল্টো পিঠে খায়। হিন্দু কাছাকোঁচা দিয়ে ধুতি পরে, আমরা লুঙ্গি। আমরা বলি পানি, হিন্দু বলে জল।

সাধারণ মুসলমান তা শুনে বলাবলি করে, মাঠে যে ধান ফলে, হিন্দুও তার ভাত খায়, মুসলমানও খায়। একই গরুর দুধ হিন্দুও খায়, মুসলমানও খায়। নদীতে মাছ ধরা হলে হিন্দু-মুসলমান এসে কেনে। একই রাস্তা ধরে সবাই হাঁটে। বন্যার সময় একই জায়গায় সবাই আশ্রয় নেয়। এতকাল সবাই পাশাপাশি থেকেছে, কখনও ঝগড়া হয়েছে, কখনও ভাব হয়েছে, সুখে-দুঃখে একই জীবনধারায় অংশীদার, হঠাৎ এ কী নতুন কথা শুরু হল? অনেক সময় হিন্দুরাও পানি বলে, আমরাও জল বলি, তবে ক্ষতি কী আছে?

নবাবের আদেশে জোর করে বিলিতি জিনিসপত্রের বিক্রির জন্য হাট খোলা হল। অশ্বিনীকুমারের নির্দেশে স্বদেশি জিনিসের হাট বসল নদীর অন্য পারে। কোনও খদ্দের নবাবের হাটে যায় না। বিলিতি বস্ত্র যারা আমদানি করেছে, তাদের এক বছরেই ক্ষতি হল তিন কোটি টাকা। বরিশালে বাহান্নটা মদের দোকানের মধ্যে পঞ্চাশটাই বন্ধ হয়ে গেছে।

এবার জোরজবরদস্তি শুরু হল সরকার পক্ষ থেকে। নতুন রাজ্য পূর্ব বাংলা ও আসাম-এর গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার। তিনি প্রকাশ্যেই মুসলমানদের দিকে একদেশদর্শিতা দেখিয়েছেন। রসিকতার ছলে তিনি বলেছেন, অনেক লোকের যেমন দুটো বউ থাকে, আমারও সেই অবস্থা। এক বউ ভাল ব্যবহার না করলে অন্য পক্ষের দিকে আমাকে ঢলে পড়তেই হবে!

সেই দুয়োরানি হিন্দুদের কঠোরভাবে শায়েস্তা করার জন্য তিনি নামিয়েছেন গোখা বাহিনী। তারা শুধু নির্দেশ মানতে জানে, মায়া-দয়ার ধার ধারে না। বয়কট সমর্থকদের ওপর চলল বেত, লাঠি। সরকার থেকে নতুন বাজার বানিয়ে, আলো দিয়ে সাজিয়ে, সানাই বাজিয়ে খদ্দের ডাকা হতে লাগল। তবু সব ভোঁ-ভাঁ। সেখানে মাছি ওড়ে, একটাও মানুষ যায় না। সরকার ভয় দেখায়, আর অশ্বিনীকুমারের প্রতি রয়েছে সাধারণ মানুষের ভালবাসার টান। ভয়ের চেয়েও ভালবাসার জোর বেশি!

বরিশালে এই সমাবেশের প্রস্তুতি চলছে চার-পাঁচ মাস ধরে। সারা বাংলা থেকে কয়েক হাজার প্রতিনিধি আসবে, অশ্বিনীকুমারের কলেজের বহু ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক হয়ে খাটাখাটনি করছে, তৈরি হয়েছে বিশাল মণ্ডপ। আগেই জানানো হয়েছিল যে, কলকাতা থেকে আগত নেতাদের খুব ধুমধামের সঙ্গে মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হবে অতিথি ভবনে। হঠাৎ কী এমন হল, কেউ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে না। এখানে সবাই যেন শোকসভায় দাঁড়িয়ে আছে।

স্টিমার থেকে বারীন-হেমদের দল চিৎকার করে বলল, বন্দেমাতরম! বলো ভাই বন্দেমাতরম!

তবু তীর থেকে সাড়া এল না। এবার দেখা গেল, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে গোখা পুলিশবাহিনী।

তা হলে কি স্টিমার থেকে নামা ঠিক হবে? সবাই জানে যে, অশ্বিনী দত্ত অকুতোভয়, তিনিও কি পুলিশকে ভয় পেলেন? তা হলে কি সম্মেলন বাতিল হয়ে গেছে?

ভিড়ের মধ্যে দেখা যাচ্ছে অশ্বিনী দত্তকে, ধুতি আর ফতুয়া পরা রোগা-পাতলা মানুষ। তিনি হাত তুলে কী যেন বলছেন, শোনা যাচ্ছে না।

অন্যদের আপাতত স্টিমারেই থাকতে বলে সুরেন্দ্রনাথ, বিপিনচন্দ্র আর কৃষ্ণকুমার মিত্র–এই তিনজন নামলেন। এগিয়ে এসে তাঁদের উষ্ণভাবে আলিঙ্গন করলেন অশ্বিনী দত্ত।

সুরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, অশ্বিনীবাবু? সবাই একেবারে চুপচাপ।

জনতার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, শুধুই নিঃশব্দ নয়, লোকেরা গম্ভীর, বিরক্ত এবং যেন ক্ষুব্ধ।

অশ্বিনী দত্ত থুতনি চুলকোতে চুলকোতে বললেন, একটা মুশকিল হয়ে গেছে, ম্যাজিস্ট্রেট ইমারসান সাহেবের কাছে আমি কথা দিয়েছি, এখানে চেঁচামেচি করা যাবে না, আর আপনাদের নিয়ে শোভাযাত্রায় বন্দেমাতরম ধ্বনিও দেওয়া যাবে না।

বিপিনচন্দ্র সবিস্ময়ে বললেন, সে কী! আপনি…আপনি এরকম কথা দিলেন কেন?

অশ্বিনী দত্ত বললেন, না হলে যে সম্মেলনই বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সম্মেলনের অনুমতিই দিয়েছেন এই শর্তে। এখান থেকে মণ্ডপে যাওয়া পর্যন্ত শ্লোগান দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। বেশি দূরের রাস্তা নয়।

অশ্বিনী দত্ত সুরেন্দ্রনাথের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, শুধু এইটুকু মেনে নিন।

সুরেন্দ্রনাথ বললেন, অগত্যা তাই-ই করা যাক।

কৃষ্ণকুমার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না! বরিশালের মাটিতে পা দিয়েই আমরা পুলিশের ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে থাকব? লোকে আমাদের কাপুরুষ ভাববে!

বিপিনচন্দ্র মাথা নাড়লেন, তিনিও কৃষ্ণকুমারকে সমর্থন করেন।

অশ্বিনী দত্ত বললেন, তা হলে যে সব আয়োজন পণ্ড হয়ে যায়। ওরা সম্মেলন চালাতে দেবে না।

একটুক্ষণ তর্কবিতর্ক চলল। সম্মেলন বন্ধ হয়ে যাক, এটা কেউ চায় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, এখন থেকেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গিয়ে কাজ নেই। তবে এখান থেকে শোভাযাত্রাও হবে না। নিঃশব্দ শোভাযাত্রা মানেই পরাজয়, তার বদলে প্রতিনিধিরা স্টিমার থেকে নেমে যার যার নির্দিষ্ট বাসস্থানের দিকে চলে যাক।

অশ্বিনী দত্ত বললেন, সভাপতির জন্য চার ঘোড়ার গাড়ি সাজিয়ে রেখেছিলাম! তা হলে শোভাযাত্রা হবে আগামী কাল।

সুরেন্দ্রনাথ স্টিমারে ফিরে এসে সকলকে বোঝাতে লাগলেন। রাগে গজরাতে লাগলেন কৃষ্ণকুমার ও আরও কয়েকজন, ছোঁকরারা হাসাহাসি করতে লাগল দূরে দাঁড়িয়ে।

পরদিন সম্মেলনের উদ্বোধন। কলেজ প্রাঙ্গণে বিশাল ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে, ছোট ছোট বালকেরা প্রবেশদ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ফুলের ডালি নিয়ে। মাননীয় অতিথিদের মাথায় পুষ্পবর্ষণ হবে। কাছের একটি বাড়ির ছাদ থেকে মহিলারা করবেন শঙ্খধ্বনি।

রাজাবাহাদুরের হাভেলি থেকে শুরু হবে শোভাযাত্রা। একেবারে পুরোভাগে চার ঘোড়ার গাড়িতে বসেছেন মূল সভাপতি আবদুল রসুল ও তাঁর স্ত্রী, পিছনে পদব্রজে আসছেন সুরেন্দ্রনাথ-বিপিনচন্দ্র ও অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ, তারপর অন্যান্য প্রতিনিধি ও ছাত্ররা।

সকলে একসঙ্গে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতেই ঘোড়া ছুটিয়ে কেম্প নামে একজন পুলিশ সার্জেন এসে বলল, বন্ধ করো, বন্ধ করো, ওই ব্যান্ডেমাটারাম চলবে না!

অশ্বিনীকুমার এগিয়ে এসে বললেন, সে কী কথা! ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছিল, স্টিমারঘাটায় আমরা শ্লোগান দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে পারব না। সে কথা আমরা রেখেছি। আজ কেন নিষেধ করছেন?

কেম্প বলল, ওসব জানি না। রাস্তায় ওই শ্লোগান দেওয়া যাবে না। এই সার্কুলার তো জারি রয়েছেই! তোমরা শ্লোগান দিলে আমি মিছিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।

কৃষ্ণকুমার চেঁচিয়ে বললেন, তা হলে দরকার নেই। সম্মেলন বন্ধ হয় তোক। আমরা বন্দেমাতরম বলে জেলে যাব!

সুরেন্দ্রনাথ হাত তুলে বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত মাথা গরম করছেন কেন? পুলিশ সাহেবকে আমি জিজ্ঞেস করছি, আমাদের সম্মেলনের সময়, ঘেরা জায়গায় আমরা বন্দেমাতরম বলতে পারব তো?

কেম্প বলল, সেখানে আপনারা যা খুশি করুন। রাস্তায় ওসব চেল্লামেল্লি চলবে না।

সুরেন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে। রাস্তায় বন্দেমাতরম বন্ধ থাক, তার বদলে গান চলুক। গান সম্পর্কে কোনও সার্কুলার নেই।

চারণ কবি মুকুন্দ দাস রয়েছেন গানের দলে। তিনি উদাত্ত গলায় গান ধরলেন :

আমরা নেহাত গরিব
আমরা নেহাত ছোট
তব আছি ত্রিশ কোটি–জেগে ওঠো!
জুড়ে দে ঘরে তাঁত
সাজা দোকান
বিদেশে যেন না যায় ভাই
গোলার ধান!

শোভাযাত্রাটি সবেমাত্র এগোতে শুরু করেছে, অমনি পাশের একটি বাড়ি থেকে হইহই করে বেরিয়ে এল বারীন, হেম, উপেন, ভরতের দল। তারা লাফাতে লাফাতে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে নাচতে লাগল। অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, বলল ভাই বন্দেমাতরম! যদি বাঙালির বুকের পাটা থাকে, তবে গলা ছেড়ে হেঁকে বলল, বন্দেমাতরম!

প্রথমে তাদের সঙ্গে যোগ দিল অ্যান্টি সার্কুলার সমিতির সদস্যরা। তারপর যেন দাবানলের মতন ছড়িয়ে গেল বন্দেমাতরম ধ্বনি। মিছিলের সকলে একযোগে বন্দেমাতরম বলে চিৎকার করতে করতে বাতাস কাঁপিয়ে দিল। আর পুলিশের নিষেধ কেউ মানবে না।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ছুটে এল গোখাবাহিনী। নির্মমভাবে লাঠি চালাতে লাগল নির্বিচারে। তারপর এল অশ্বারোহী বাহিনী। সাধারণ মানুষ যেন উন্মাদ হয়ে গেছে, এত পুলিশ দেখেও তারা থামে না, মার খেয়েও তারা ধ্বনি দিচ্ছে।

স্বেচ্ছাসেবকরা প্রথমে বড় বড় নেতাদের সরিয়ে নিয়ে গেল নিরাপদ দূরত্বে। কিছুক্ষণ পরেই তাঁরা আবার ফিরে এলেন, জনসাধারণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে চান না। তাঁরাও পুলিশের লাঠি অগ্রাহ্য করতে চান। কেউ কেউ আহত হলেন, কয়েকজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।

বারীন, হেম, ভরতের দল পুলিশের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা খেলছে। পুলিশ তাড়া করে এলে তারা দৌড়ে পালাচ্ছে কাছাকাছি গলির মধ্যে, আবার অন্য গলি দিয়ে ফিরে এসে প্রবলভাবে বন্দেমাতরম বলে পুলিশকে ক্ষেপাচ্ছে। কেউ কেউ আড়াল থেকে ইষ্টক বর্ষণ করছে পুলিশের ওপর।

এক জায়গায় একটি যুবককে ঘিরে ফেলেছে তিন-চারজন গোখা, সবাই মিলে তাকে প্রহার করছে, তার মাথা ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। দূর থেকে একজন কেউ চেঁচিয়ে উঠল, মনোরঞ্জনবাবুর ছেলেকে মেরে ফেলল! তখন অনেকেই চিনতে পারল, ওই যুবকটি বিশিষ্ট নেতা মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার পুত্র চিত্তরঞ্জন। সেও অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সদস্য, বন্দেমাতরম ধ্বনি কিছুতেই ছাড়বে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। মার খেতে খেতেও সে গলা ফাটিয়ে বন্দেমাতরম বলে যাচ্ছে। একসময় সে বাঁচবার জন্য পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাতেও নিস্তার নেই, একজন গোখাও সঙ্গে সঙ্গে পুকুরে নেমে পড়ে লাঠি চালাতে লাগল তার সর্বাঙ্গে।

শত শত লোকের চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটছে।

দূরের জনতা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল একজন অচেনা যুবক। তার হাতে একটা বাঁশ। সে চেঁচিয়ে বলল, বাঙালি কি মরে গেছে? আমাদেরই একজন সাথীকে পুলিশ মারছে, আমরা চুপ করে দেখব? বাঙালি এত কাপুরুষ? আজ ওই শালা পুলিশেরই একদিন কি আমারই একদিন।

বারীন আর হেম লাফিয়ে এসে সেই যুবকটিকে দু’দিকে চেপে ধরে বলল, করছেন কী? পুলিশকে মারলে যে আপনাকে এখানেই শেষ করে দেবে।

তারা টানতে টানতে যুবকটিকে সরিয়ে আনল।

পুলিশকে মারলে কী হয়, তা ভরতের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। পুলিশকে একটা মাত্র ঘুষি মেরেছিল বলে তাকে নিদারুণ অত্যাচার সইতে হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে দেড় বছর।

কিন্তু পুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নিজেই চঞ্চল হয়ে উঠল। চিত্তরঞ্জন মার খেতে খেতে অবশ হয়ে যাচ্ছে, গলার আওয়াজ হয়ে গেছে ক্ষীণ। এবার যে ছেলেটি জলে ডুবেই মারা যাবে। পুকুরের পাড়ে এত পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে যে, কেউ ওদিকে যেতে সাহস পাচ্ছে না।

ভরত তীরবেগে ছুটে সেই পুলিশদের ভেদ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। চিত্তরঞ্জন ডুবে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে তার জামার কলার ধরে টেনে তুলল। ভরতের কাঁধে পুলিশের লাঠির একটা বাড়ি পড়ল, ভরত গ্রাহ্য করল না, চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে সে সাঁতরাতে লাগল পুকুরের অন্য পাড়ের দিকে। চিত্তরঞ্জন একেবারে জ্ঞান হারায়নি, আচ্ছন্ন গলায় বলল, জেলে নিয়ে যাচ্ছ? আমি জেলে যাব না। আমাকে মেরে ফেল! আমাকে মেরে ফেল! বন্দেমাতরম!

ভরতও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলল, বন্দেমাতরম!

কিছুটা দূরে কৃষ্ণকুমার মিত্র এক কনস্টেবলের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়েছেন। অন্য কয়েকজন পুলিশ তাঁকে মারতে আসতেই তিনি বললেন, সাবধান! এরপর কিন্তু রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে!

কেম্প সাহেব তক্ষুনি এসে পড়ল সেখানে। কৃষ্ণকুমার বললেন, আপনি কী করছেন বুঝতে পারছেন না! পুলিশদের লেলিয়ে দিয়েছেন, মানুষজন যেরকম ক্ষেপে উঠছে, এর পর যে-কোনও মুহূর্তে এখানে বিরাট মারামারি শুরু হয়ে যাবে!

কেম্প বলল, দোষ তো আপনাদেরই। আমার কথা শোনেননি!

কৃষ্ণকুমার ধমক দিয়ে বললেন, এই সেপাইটা আমাদের ব্রজেন গাঙ্গুলিকে মাথা ফাটিয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছে। গভর্নমেন্টের এরকম নির্দেশ আছে?

সুরেন্দ্রনাথ সেখানে এসে পড়ে বললেন, শিগগির এই অত্যাচার থামান। বন্দেমাতরম বললে গ্রেফতার করার কথা, এরকমভাবে মারধরের আদেশ কে দিয়েছে? যদি মনে করেন আমাদের গ্রেফতার করুন।

কেম্প বলল, ঠিক আছে, আপনাকে গ্রেফতার করলাম!

কৃষ্ণকুমার এবং অন্যান্য নেতারাও বলে উঠলেন, আমাদেরও গ্রেফতার করুন। আমরা দায়িত্ব নিতে চাই।

কেম্প কিন্তু শুধু সুরেন্দ্রনাথকে ধরে নিয়ে চলল, অন্য নেতারাও চললেন ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর দিকে।

এ দিকে মিছিলের সামনের দিকটা বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে সভামণ্ডপে পৌঁছে গেছে। রসুল সাহেবকে সভাপতির আসনে বসিয়ে সভার কাজ শুরু করে দেওয়া হল। অনেকেরই ধারণা, পুলিশ যেরকম আচরণ শুরু করেছে, তাতে এই সভাও হয়তো বন্ধ করে দিতে চাইবে। তার আগে যতক্ষণ চালানো যায়। সুরেন্দ্রনাথ গ্রেফতার হয়েছেন শুনে সকলেই দারুণ উত্তেজিত। বিভিন্ন বক্তা তীব্র ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা তাঁর পুত্র চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানে। চিত্তরঞ্জনের মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা, গায়ের জামা রক্তাক্ত। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আমার ছেলের এই রক্তপাত কি বৃথা যাবে?

সহস্র কণ্ঠে ধ্বনি উঠল, না, না!

ভিড়ের মধ্য থেকে কারা যেন বলল, প্রতিশোধ চাই! প্রতিশোধ চাই! রক্তের বদলে রক্ত!

আরও কিছুক্ষণ পরে খবর পাওয়া গেল, বেশি গোলমালের আশঙ্কায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সুরেন্দ্রনাথকে কারাগারে না পাঠিয়ে জামিনে মুক্তি দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা সুরেন্দ্রনাথকে নিয়ে আসছে সভায়। বক্তৃতা থেমে গেল। সকলে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইল পথের দিকে। সুরেন্দ্রনাথ এসে পৌঁছতেই বহু লোক ছুটে গেল তাঁর পদধূলি নিতে। সভাস্থল বন্দেমাতরম ধ্বনিতে কম্পিত হতে লাগল।

সুরেন্দ্রনাথ মঞ্চে উঠে বললেন, বরিশালের সাধারণ মানুষ আজ যে মনোবলের পরিচয় দিয়েছে তা অভূতপূর্ব। আজ নতুন করে বয়কটের শপথ নিতে হবে। যদি বেশি সময় না পাওয়া যায়, তাই আমি এখনই শপথবাক্য পাঠ করছি, আপনারা সবাই সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারণ করুন। “জগদীশ্বর ও জন্মভূমির নামে প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমরা সাধ্যমতো বিদেশি পরিত্যাগ এবং স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করিব। কোনও অত্যাচারেই আমরা নতি স্বীকার করিব না।”

সভাপতি রসুল সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বেশি সময় পাওয়া যাবে না, এই আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই আমিও আগেভাগেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নিতে চাই। বয়কট প্রসঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠেছে। আমি মনে করি, হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় জাতি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আমরা এক জননী ও জন্মভূমির সন্তান। এবং আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হিন্দুর সঙ্গে অভিন্ন। ধর্ম সম্বন্ধীয় ব্যাপারে আমাদের স্বার্থ চিন, তুরস্ক ও জাঞ্জিবার দেশীয় মুসলমানদের সঙ্গে এক হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক অভিযানে আমরা স্বদেশীয় হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সহযাত্রী!

হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাল তাঁকে। বরিশাল শহরে বেশ কিছু খ্রিস্টান রয়েছে, তারাও এসেছে, সভাস্থলের এক দিক থেকে সেই খ্রিস্টানরাও উঠে দাঁড়িয়ে সহমত জানাল। তারপর একের পর এক বক্তা উঠে বর্ণনা দিতে লাগলেন সরকারি দমন নীতির।

কলেজ প্রাঙ্গণে যখন এই সভা চলছে, সেই সময় কীর্তনখোলা নদীতে একটি নৌকোয় এসে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন রাজকার্যের এক সংকটে মহারাজ রাধাকিশোরকে পরামর্শ দিতে। সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে আসায়, আসতে তাঁর কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। বরিশালে রাজনৈতিক সম্মেলনের সঙ্গে সঙ্গে একটি সাহিত্য সমাবেশও হবে, তিনি সেই সমাবেশের সভাপতি। সাহিত্যের মাধ্যমেই বিভক্ত বাংলার ঐক্য বেশি করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে।

লাখুটিয়ার জমিদার দেবকুমার রায়চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে আতিথ্য দেবেন। আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে, রবীন্দ্রনাথ জল ভালবাসেন বলে শহরের মধ্যে না গিয়ে তিনি নদীর ওপর একটা বজরাতেই থাকবেন। নৌকো ছেড়ে সবেমাত্র বজরায় এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, বিশ্রামেরও সময় পেলেন না, স্বেচ্ছাসেবকরা ছুটে এসে তাঁকে আজকের ঘটনার বিবরণ জানাল। গোখা পুলিশ শহরে তাণ্ডব শুরু করেছে, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অনেককে আহত ও অজ্ঞান করে দিয়েছে তো বটেই, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বহু দোকানে। এরই মধ্যে সভা চলছে। আপনি শিগগির সেখানে চলুন!

রবীন্দ্রনাথ সব শুনলেন। তারপর বললেন, না, আমি যাব না।

একজন স্বেচ্ছাসেবক বলল, সে কী, আপনি যাবেন না? লোকজন মহা উত্তেজিত হয়ে আছে। আপনার কথা শুনলে তারা প্রেরণা পাবে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমি সাহিত্য সভার জন্য এসেছি। রাজনৈতিক সভায় তো বক্তৃতা দেবার কথা ছিল না আমার।

স্বেচ্ছাসেবকটি বলল, এমন যে ব্যাপার হবে, কেউ কি জানত? কলকাতায় রাখিবন্ধনের দিন আপনি যেমন মিছিল করেছিলেন, এখানে আজ যদি আপনি একবার গিয়ে দাঁড়ান, হাজার হাজার মানুষ আপনাকে অনুসরণ করবে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, এখন বহু স্থানেই মিছিল হয়। আমার আর মিছিলে দাঁড়াবার প্রয়োজন দেখি না।

তবু স্বেচ্ছাসেবকরা পীড়াপীড়ি করতে লাগল, একবার চলুন, একবার চলুন। একজন বলল, আমরা আপনাকে ঘিরে থাকব। আপনার ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। পুলিশ যদি লাঠি তোলে, আমরা মাথা পেতে নেব।

রবীন্দ্রনাথ চুপ করে রইলেন।

সেই রাখিবন্ধনের মিছিলের পর রবীন্দ্রনাথ আর বিশেষ কোনও প্রতিবাদ মিছিলে যাননি, সভাসমিতিতেও যান না। অনেকের ধারণা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করে নেতৃত্ব থেকে সরে যাচ্ছেন। তা কি কোনও ভয়ে? দু-একটি সভায় এ নিয়ে তাঁর নামে বক্রোক্তিও করা হয়েছে, তাও রবীন্দ্রনাথের কানে এসেছে।

রবীন্দ্রনাথ সত্যিই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেকখানি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে তিনি অনেকখানি ভূমিকা নিয়েও এখন আর মন লাগাতে পারছেন না। অন্য অনেকের কথাবার্তা বা কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারেন না, অতিরিক্ত বাগাড়ম্বর বা আস্ফালন তাঁর চরিত্রবিরোধী। দেশের স্থায়ী মঙ্গলের জন্য কিছু করতে গেলে ধীর স্থিরভাবে এগোতে হয়। কিন্তু অনেক নেতা গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে স্পর্ধা প্রকাশকেই বড় করে দেখছেন। জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন যেন সেই স্পর্ধা প্রকাশেরই একটা উপলক্ষ।

বয়কট আন্দোলন যেদিকে মোড় নিয়েছে, সেটাও তাঁর পছন্দ নয়। জোর-জুলুম-জবরদস্তি চলছে অনেক জায়গায়, তা উনি সমর্থন করতে পারছেন না। বিভেদ তৈরি হচ্ছে দুই সম্প্রদায়ে। তিনি ‘শিবাজী উৎসব’ নামে কবিতা লিখে দিয়েছিলেন, তখন বুঝতে পারেননি, এই উৎসবের নামে ভবানী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু হবে। যারা মূর্তি পূজক নয়, তারা এই উৎসব-সভায় যাবে কেন? তিনি নিজেও যান না সেইজন্য।

রবীন্দ্রনাথকে চুপ করে থাকতে দেখে দেবকুমার রায়চৌধুরী বলল, রবিবাবু, কাল সাহিত্যবাসর হবে কি না ঠিক নেই। আজ যা কাণ্ড হল, কাল কি সভা করা যাবে? আপনি বরিশালে এসেছেন, লোকে আপনার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। আপনি আজকের সভাতেই কিছু অন্তত বলুন।

রবীন্দ্রনাথ বিরক্তির ভাব যথাসম্ভব গোপন করে বললেন, দেবকুমার, আমি কোনও জন্মেই লিডার বা জনসঙ্ঘের চালক নই, আমি ভাট মাত্র, যুদ্ধ উপস্থিত হলে গান গাইতে পারি, যদি আদেশ দেবার কেউ থাকেন, তাঁর আদেশ পালনেও প্রস্তুত আছি। দেশীয় বিদ্যালয় যদি সত্যিই কোনওদিন গড়া হয়, তার সেবাকার্যের জন্য যদি আমাকে আহ্বান জানানো হয়, আমি অবশ্যই যাব। কিন্তু নেতা হবার দুরাশা আমার একেবারেই নেই। যাঁরা নেতা বলে পরিচিত তাঁদের আমি নমস্কার করি। ঈশ্বর তাঁদের শুভবুদ্ধি দিন!

একটু থেমে তিনি আবার আপন মনে বললেন, যে অগ্নিকাণ্ড চলছে, তাতে আমি উন্মত্ত হতে পারব না। যতদিন আয়ু আছে, আমার নিজস্ব প্রদীপটি জ্বেলে পথের ধারে বসে থাকব।

আর একদল স্বেচ্ছাসেবক এই সময় ছুটতে ছুটতে এসে বলল, সভা ভেঙে গেছে, পুলিশ জোর করে সভা বন্ধ করে দিয়েছে!

দেবকুমার বলল, সেকী! সভামণ্ডপের মধ্যেও পুলিশ লাঠি চালিয়েছে? নেতাদের মেরেছে?

একজনের মুখ থেকে পূর্ণ বিবরণটি জানা গেল। পুলিশ সভাস্থলে লাঠি চালায়নি বটে, কিন্তু বক্তৃতা চলাকালীন সার্জেন কেম্প গটমট করে এসে মঞ্চে উঠে পড়েছিল। সভাপতিকে সে বলেছে, শহরে আইন-শৃঙ্খলার গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। সরকার এর প্রশ্রয় দিতে পারে না। এই সভা চলতে পারে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের কথা দিতে হবে, সভা শেষে সবাই চুপচাপ ফিরে যাবে, আর কোনও মিছিল হবে না, কেউ বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে পারবে না রাস্তায়।

সভাপতি বললেন, সভায় এত লোক, তারা এখান থেকে বেরোবার পর শ্লোগান দেবে কি না, সে দায়িত্ব আমরা কী করে নেব!

কেম্প বলল, আপনাদের সে দায়িত্ব নিতেই হবে। নচেৎ, আপনারা সভা বন্ধ করে দিন, আমরা সব লোকদের বার করে দেবার ব্যবস্থা করছি।

অন্য নেতারা সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা পুলিশের সঙ্গে কোনও চুক্তি করতে রাজি নই। আমরা সভা চালিয়ে যাব। পুলিশ কী করবে, জোর করে আমাদের তাড়াবে?

কেম্প বলল, সে রকম হলে আমি বলপ্রয়োগে বাধ্য হব!

তখনও কয়েকজন বললেন, তা হলে চলুক সভা। দেখি, পুলিশ কত মারতে পারে।

বড় রকমের গণ্ডগোলের আশঙ্কায় সুরেন্দ্রনাথ সভা বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব দিয়ে, অন্যদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন। কোনও কোনও নেতা ফিরে গেছেন কাঁদতে কাঁদতে। যোগেশ চৌধুরী সকলকে বলেছেন, এই সভা ভাঙল, এখন প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে সভা হোক। চতুর্দিকে আগুন জ্বলুক, সে আগুনে চিরদিনের মতো বিলেতি জিনিস দগ্ধ হোক! কৃষ্ণকুমার মিত্র কিছুতে যেতে চাইছিলেন না, তিনি বারবার বলছিলেন, পুলিশ আমাকে মেরে তাড়াক! লাঠি মারুক! গুলি করুক। বন্ধুরা জোর করে তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে।  

একজন স্বেচ্ছাসেবক বলল, আমি নিজের কানে শুনলাম, ভূপেন বোস, বিড়বিড় করে বলছেন আজ থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের অবসান শুরু হল!

আর একজন বলল, শহরের রাস্তায় এখন আর একটাও লোক নেই। শুধু পুলিশ!

দেবকুমার বলল, এরপর কালকের সাহিত্যবাসরের কি কোনও আশা রইল?

রবীন্দ্রনাথ দু দিকে মাথা নাড়লেন। সভাপতির অভিভাষণ তিনি প্রবন্ধাকারে লিখে এনেছিলেন কুতার পকেট থেকে সেই লেখাটি বার করে রাখলেন বাক্সের মধ্যে। তারপর বললেন, দেববাবু, যাত্রা আর বরিশালের মাটিতে আমার পা দেওয়া হল না। আমার ফেরার ব্যবস্থা করো। আি ভোররাত্রেই ফিরতে চাই।

বারীন, হেম, ভরতদের দল এসে সন্ধেবেলা দাঁড়িয়েছে খেয়াঘাটে। ঝালকাঠিতে হেমের এক আত্মীয় থাকে, সেখানে সবাই রাত্রি যাপন করবে। অরবিন্দ রয়ে গেছেন রসুল সাহেবের সঙ্গে এখানকার অতিথিশালায়।

চিত্তরঞ্জনকে পুলিশ মারছে দেখে যে যুবকটি পুলিশকে মারার জন্য ছুটে যাচ্ছিল, সেও খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। সে বেশ স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ। বারীন তার কাছে গিয়ে বলল, নমস্কার, আজ আপনার সাহস দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেছি। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। আমার নাম বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, আপনার নাম জানতে পারি? আপনি কি কোনও সমিতির সদস্য?

যুবকটি বলল, না, আমি কোনও সমিতিতে নেই। এমনিই মিটিং শুনতে এসেছিলাম। আমার নাম উল্লাসকর দত্ত।

বারীন তার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে বলল, যে গোখাটা চিত্তরঞ্জনকে পেটাচ্ছিল, সে তো সামান্য একটা সেপাই। ওকে মেরেই বা কী হবে? ও তো একটা চুনোপুঁটি। মারতে হলে ওর বাবাকে মারা উচিত।  

উল্লাসকর ঠিক বুঝতে না পেরে কুঞ্চিত করে বলল, ওর বাবা? সে কে? ওঃ হো, সার্জেন কেম্প?

বারীন মাথা নেড়ে বলল, না। সেপাইরা যদি চুনোপুঁটি হয়, তা হলে কেম্পরা হল কই-খলসে। বাবারও বাবা থাকে। যেমন রাঘব বোয়াল। গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার। তার নির্দেশেই তো এইসব অত্যাচার চলছে। তাকে মারতে পারবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *