2 of 2

৭৯. ভারতের যে-কোনও শহরেই

ভারতের যে-কোনও শহরেই একজন না-একজন বাঙালি ডাক্তার, উকিল বা অধ্যাপকের দেখা পাওয়া যাবেই। বুলবুল বেশ কয়েক দিন অসুখে ভোগার পর সূর্য যে ডাক্তারটিকে ডাকতে গেল, তার নাম রাধাগোবিন্দ কর। অত্যন্ত রাশভারী মানুষ। সূর্যকে তিনি গ্রাহ্য করলেন না, গম্ভীর ভাবে বললেন, পেশেন্টকে এখানে নিয়ে এসো। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

সূর্য জানাল যে, রোগিনীর হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই।

ডাক্তার বললেন, হাঁটতে না পারেন মাইজিকে বলো টাঙ্গা নিয়ে আসতে। আমার যাবার সময় হবে না।

সূর্য তখন ইংরেজিতে বলল, পুরো ভিজিট দিলে ডাক্তারদের কি রুগি দেখতে যাবার নিয়ম নেই?

ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর মুখ তুলে তাকালেন। অবাক হলেও তিনি মুখের ভাবে তা প্রকাশ করেন না। সূর্যকে তিনি বাড়ির দারোয়ান টারোয়ান মনে করেছিলেন–অনেক চাকর বা দারোয়ানের চেহারাও সুদর্শন হয়। সূর্য ডাক্তারবাবুকে যে বাড়িটিতে নিয়ে যেতে চাইছে–তিনি সেই বাড়িটির পরিচয় জানেন, সেই জন্যই আপত্তি। কিন্তু সেবাড়ির দারোয়ান ইংরেজি বলে না। তিনি বিরক্ত হলেন। তিনি ধমকের সুরে বললেন, আমার ইচ্ছে না হলে আমি রুগি দেখতে যাব না, আমাকে কেউ জোর করতে পারে?

সূর্য একদৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে চেয়ে রইল। বুলবুলরা ওদের চেনা হেকিমসাহেবের ওষুধ খায়। কিন্তু কদিন ধরে কিছুতেই বুলবুলের কাশির রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। যে কয়েক জনের কাছে সে একজন বড় ডাক্তারের নাম জিজ্ঞেস করেছে, প্রত্যেকেই এই রাধাগোবিন্দ করের নাম বলেছে। কিন্তু কে জানত, তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত?

এখানে রাগারাগি করে লাভ নেই, তাই সূর্য অনুনয় করে বলল, আপনি গেলে বিশেষ উপকার হত। আপনি দয়া করে চলুন না।

ভিজিটকা রুপিয়া কৌন দেগা?

ম্যায়—

চশমখোরের মতন ডাক্তার তক্ষুনি হাত বাড়ালেন। সূর্য একটি একশো টাকার নোট এক টাকার নোটের ভঙ্গিতে রাখল টেবিলের ওপর। তিনি সেটা নিয়ে পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ালেন। আদেশ করলেন, আমার ব্যাগটা নিয়ে চলো। গাড়ি ডাকো।

গাড়িতে ডাক্তার একটাও কথা বললেন না। বাড়ির সামনে এসে নাক কুঁচকোলেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময় অন্য একটি মেয়ে নামছিল–ডাক্তার এমন ভাবে দেওয়াল ঘেঁষে সরে দাঁড়ালেন, যাতে মেয়েটির হাওয়াও তাঁর গায়ে না লাগে।

বুলবুল বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বুজে। কুলসম নামে একটি মেয়ে হাওয়া করছে মাথার পাশে বসে। ডাক্তার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, এঃ, কী বিশ্রী অস্বাস্থ্যকর ঘর! সব জানলা খুলে দাও। পরদা সরাও!

বুলবুলের ঘরে খাট নেই, মেঝের ওপর পাতা বিছানা। সেখানে ডাক্তার বসলেন না। কুলসম ছুটে গিয়ে নিজের ঘর থেকে একটা মোড়া নিয়ে এল। সেখানে বসে, রুগি দেখবার আগে ডাক্তার সূর্যকে প্রশ্ন করলেন ইয়ে জেনানা তুমহারা কৌন হ্যায়?

সূর্য বলল, সি ইজ মাই ওয়াইফ।

ডাক্তার বিশ্রী ভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, জল গরম করতে বলো এক বাটি। রুগিকে উঠে বসতে বলো।

মনে হচ্ছে, তিনি সরাসরি রোগীর সঙ্গে কথা বলবেন না। তা হলে চিকিৎসা করবেন কী করে?

তিনি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বুলবুলের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টেথেসকোপটা বাড়িয়ে রাখলেন রোগিনীর পিঠে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন এবং নিজেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে লাগলেন ঘন ঘন।

কুলসম গরম জলের বাটি নিয়ে এল। আরও কয়েক জন এসে ভিড় করেছে দরজার সামনে। কুলসম সূর্যকে বলল, বাঙ্গালীয়া, ডেটল আউর সাবুন উধার রাখ দিয়া

ডাক্তার এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠলেন। আপাদমস্তক দেখলেন সূর্যকে। তারপর কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বাঙালি?

হ্যাঁ।

ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর শুধু নীতিবাগিশ তাই নয়, অত্যন্ত বেশি রকমের প্রাদেশিক। রোগিণীর দিক থেকে নজর ফিরিয়ে তিনি ধমকে জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার?

সূর্য উত্তর না দিয়ে কাধ ঝাঁকাল।

তুমি কোথায় থাকো?

এখানেই।

কেন?

আপনি রুগিকে কী রকম দেখলেন?

ডাক্তার ততক্ষণে স্টেথেসকোপ গুটিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। অবজ্ঞার সুরে বললেন, এখানে এর কিছু করার নেই। একে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও।

হাসপাতালে যাবে না। যেতে চায় না।

তা হলে আমার আর কী করার আছে?

ওর কী হয়েছে কী?

ওর কী হয়েছে, তা যে-কোনও অন্ধও বুঝতে পারে। এক্স-রে নিতে হবে, থুতু পরীক্ষা করাতে হবে–কিন্তু তার আগেই সঠিক ভাবে বলে দেওয়া যায়, ওর দুটো লাংসই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আগে কোনও রকম চিকিৎসা করায়নি?

আগে তো ঠিক বোঝা যায়নি।

এরা সাধারণত বুঝতে দেয় না। রোগের চিকিৎসা করালে আর অন্য পুরুষমানুষের সর্বনাশ করবে কী করে?

ডাক্তার শেষের দিকে বাংলা কথা বলছিলেন বলে সূর্য একটু আস্বস্ত বোধ করল। বুলবুলের এসব কথার মর্ম বোঝার দরকার নেই। অন্য একজন সহৃদয় ডাক্তার ডাকলেই হবে। এই কাঠখোট্টা লোকটিকে দিয়ে কোনও কাজ হবে না।

ডাক্তার গরম জলে অনেকক্ষণ ধরে হাত ধুলেন। ওদের তোয়ালে না ছুঁয়ে বার করলেন নিজের পকেটের রুমাল। সূর্যকে বললেন, চলো।

বাইরের দরজা পর্যন্ত এসে সূর্য হাত তুলে নমস্কার করে বলল, আচ্ছা—

ডাক্তার বললেন, আচ্ছা মানে? আমাকে চেম্বারে পৌঁছে দাও।

আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি একটা গাড়ি ডেকে দিচ্ছি। আমি নিজে যদি না যাই।

তোমাকে যেতে হবে।

আমি তো এক্ষুনি যেতে পারছি না। পরে যদি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করি–

পরে আবার কী? তুমি এখনও এখানে থাকবে নাকি? তোমাকে আমি এখানে থাকতে দেব না। তোমার লজ্জা করে না? দেখে তো ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হয়। রাঙালি জাতির কলঙ্ক!

সূর্য দৃঢ় ভাবে বলল, আমাকে এখানেই থাকতে হবে!

ডাক্তার আবার নাক কুঁচকে সূর্যর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমার স্ত্রী যদি শোনে আমি এই বাড়িতে চিকিৎসা করতে এসেছি, তা হলে আমাকে এলাহাবাদে গিয়ে গঙ্গায় চান করে আসতে হবে, তা জানো? তোমার কথা শুনে আমি এলাম, আর তুমি আমার কোনও কথা শুনবে না?

সূর্য চুপ করে রইল।

ওই মেয়েটির জন্য আর চিন্তা করে কোনও লাভ নেই।

আপনি তো ওর চিকিৎসার কথা কিছুই বললেন না।

ডাক্তার আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, নামকরা ডাক্তারদের একটা ট্র্যাজেডি কী জানো? তাদের হাতেই বেশি রুগি মরে! সকলে একেবারে শেষ সময়ে নিয়ে আসে আমাদের কাছে। এখানে আসবার আগেই আমি জানতাম!

আপনি কী বলছেন?

হাসপাতালে নিয়ে যাও আর যেখানেই চিকিৎসা করো–মাস দু’একের বেশি ওই মেয়েটি বাঁচবে না।

মাত্র চার-পাঁচ দিন আগেও সুস্থ ছিল, কোনও কিছু বোঝা যায়নি।

মেয়েছেলেরা পারে, মেয়েছেলেরা পারে। ওদের অনেক কিছুই বোঝা যায় না। এইসব রুগিকে বিধান রায়, নলিনী সেনগুপ্ত বা আসরফউল্লার মতন ডাক্তাররা হয়তো বাঁচাতে পারে, আমি পারি না।

সূর্য স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এসব কি বিশ্বাস করা যায়? বুলবুল, এত প্রাণবন্ত বুলবুল–

ডাক্তার পকেট থেকে একশো টাকার নোটটি বার করে বললেন,–নাও–

না, না, আপনার ফি আপনি নেবেন না কেন?

আবার বাঁকা হাসিতে তিনি ধিক্কার দিলেন সূর্যকে। নোটটা মুড়ে বাজে কাগজের মতন তিনি ছুঁড়ে দিলেন। আর কোনও মন্তব্য না করে হাত তুলে ডাকলেন একটা চলন্ত টাঙ্গা।

সূর্য নিজের ঘরে ফিরে আসার পর অনেকে মিলে ঘিরে ধরল তাকে। কী বললেন, ডাক্তারসাব?

সূর্য হেসে বলল, খুব রাগ করলেন ওঁকে ডেকে এনেছি বলে। কিছুই হয়নি। সর্দি জমে গিয়ে রক্ত পড়ছে। অত বড় ডাক্তার এত ছোট অসুখ দেখেন না!

সকলে মত প্রকাশ করল, তারাও এই কথাই বলেছিল। হেকিমসাহেবের দাবাই খেলে কোনও শক্ত অসুখ হয় না। বুলবুলকে আজই অনেকটা ভালো দেখাচ্ছে না?

বুলবুল বিছানায় উঠে বসে ক্লিষ্ট ভাবে হাসতে চেষ্টা করছে। মুখখানা চুপসে গেছে এই কদিনেই। তবুও বিশীর্ণ চন্দ্রলেখার মতন একটা রূপ আছে সেই মুখে। চুলে চিরুনি পড়েনি দু-তিন দিন।

সূর্য বলল, হ্যাঁ, আজ অনেক ভালো দেখাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তো কোনও দাবাই পর্যন্ত দিতে চাইলেন না। বললেন, এমনিই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সে-দিন সারা দিন ধরে সূর্য বার বার চোরা চোখে তাকাতে লাগল বুলবুলের দিকে। আগের মতন আর সোজা তাকাতে পারছে না। জেলে থাকার সময় সে একজন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিকে দেখেছিল। সকলেই তার দিকে দারুণ সমীহের সঙ্গে তাকাত। যেন তার শরীরে লেগেছিল মৃত্যুর প্রগাঢ় গাম্ভীর্য। বুলবুলও অনেকটা সেই রকম। মাত্র দু-তিন মাস? এ কি স্বপ্ন?

সারা দিন সে বুলবুলকে হাসিখুশিতে রাখার চেষ্টা করল। ভেতরে ভেতরে তার অসম্ভব দ্বন্দ্ব চলছে। এখন কী করা উচিত? হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করা উচিত নয়? তা হলে বুলবুলকে জানাতে হবে। হাসপাতালের খাটে বুলবুল একা শুয়ে আছে, এটা সে কিছুতেই কল্পনা করতে পারছে না।

জীবন থেমে থাকে না। সেদিনও অন্যান্য ঘরে সন্ধ্যাবেলা বাবুরা এল, হারমোনিয়াম, ঘুঙুর ও তবলার আওয়াজ শুরু হল, যারা বুলবুলকে ভালোবাসে খুব, তারাও এক সময়ে নেশাগ্রস্ত গলায় খিলখিল করে হাসে।

বুলবুলের ঘরে সে-দিন আলো জ্বলল না। সন্ধ্যা থেকে বুলবুলের আবার জ্বর এসেছে, মাঝে মাঝে কাশির দমকে বেঁকে যাচ্ছে পিঠ। সূর্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

একসময় ঘুমিয়ে পড়ল বুলবুল। সূর্য জেগে রইল ঠায়।

একাগ্র হয়ে সে শুনতে লাগল বুলবুলের নিশ্বাসের শব্দ। এখন থেকেই তার ভয় হচ্ছে, হঠাৎ বুঝি নিশ্বাস থেমে যাবে। মৃত্যু জিনিসটা কী রকম, তার কোনও নির্বাচন নেই? পৃথিবীতে এত মানুষ রয়েছে, তবুবুলবুলকেই মরতে হবে কেন? বুলবুল জীবনকে এত ভালোবাসে, আনন্দে ফুর্তিতে তার কখনও কোনও ক্লান্তি নেই, সেই বুলবুলকে মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে যাবে? মৃত্যুর এলাকা কত বড়? তার বাইরে কোথাও বুলবুলকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় না?

জানলার বাইরে একটা নিঃসঙ্গ তারা দেখা যায়। বড় বেশি জ্বলজ্বল করছে। একটা সময় যেন তারাটা সরে গেল মনে হল। কে যেন বলেছিল তারারা মাঝে মাঝে স্থান বদল করে? মানুষের জীবনের বিশেষ কোনও মুহূর্তেই দেখা যায় তারা সরে যাবার দৃশ্য। কী। এর মানে?

একসময় শুনতে পেল কান্নার শব্দ। বুলবুল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

সূর্য তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, এ কী, কাঁদছ কেন? এই, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

বুলবুল বলল, ডাক্তারসাহেব কী বলেছে আমি জানি। আমি আর বাঁচব না!

আরে, তুমি বলছ কী? মোটেই ডাক্তার সাহেব একথা…

আমার কাছে আর মিথ্যে বোলো না। আমি সব বুঝে গেছি।

সূর্যর হাতটা আপনিই গুটিয়ে এল। মেয়েরা শুধু যে অনেক কিছু গোপন করতে পারে তাই নয়, অনেক গোপন খবরও জেনে যায় অনায়াসে।

সূর্য হঠাৎ বিছানার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাকে আমি অত সহজে মরতে দেব ভেবেছ? না! তোমাকে আমি মরতে দেব না!

বুলবুল তার সজল চোখদুটি তুলে বলল, আমি তো আর বাঁচতে চাই না!

সূর্য ক্রুদ্ধস্বরে বলল, মরা অত সোজা নাকি! আমি তোমাকে কিছুতেই মরতে দেব না!

সূর্যর গলার আওয়াজে শিশুসুলভ দৃঢ়তা ছিল। যেন সে সত্যিই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে চায়। শুধু বুলবুলকে বাঁচাবার জন্যই নয়, মৃত্যুকে পর্যুদস্ত করার স্পৃহাও তার মধ্যে জেগে ওঠে। মৃত্যুকে সে তো অনেক বার অনেক রূপে দেখেছে। তাই তার রাগ বেশি।

বুলবুল আর কোনও কথা বলার বদলে কাঁদতে শুরু করে। যুক্তির বদলে কান্নাই তার পক্ষে প্রশস্ত মনে হয়। যদিও এই কান্না নিজেকে বাঁচাবার জন্য নয়, নিজেকে ধ্বংস করার জন্য।

বুলবুলের এ-ধরনের যুক্তিবোধ সূর্যকে কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় করে দেয়। তারপর সে বুলবুলের কাঁধ কাঁপিয়ে বলে, তুমি বলছ কী? তুমি মরতে চাও?

বুলবুল তার কৃশ মুখোনি তুলে বলে, আমি আর কেন বাঁচতে চাইব বলো? আমার কী আছে?

বুলবুল, আমি আছি! তুমি আমার কথা চিন্তা করছ না?

বাঙ্গালীয়া, আমি তোমার যোগ্য নই! আমি তোমাকে পেলাম না।

তুমি এ কী বলছ?

আমি ঠিকই বলছি! আমি আর কী চাইতে পারি? আমার মতন মেয়ে আর কী আশা করতে পারে? তোমার মতন একজন পুরুষ, এত যার রূপ, এত বড় যার হৃদয়, তাকে পাওয়া কি কম ভাগ্যের কথা? তবু আমার ভাগ্যে সইল না! আমার নসিবটাই খারাপ! আমার নিজের মা কী ভাবে মারা গেছে তুমি জানো? ঠিক আমারই মতন–

বুলবুল, ছিঃ, এমন কথা বলে না। আমার মা কীসে মারা গিয়েছিলেন তাও তুমি জানো না। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তা বলে, আমিও কি আত্মহত্যা করছি!

বাঙ্গালীয়া, তুমি কেন আত্মহত্যা করবে? তুমি আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাও!

পাগলির মতন কথা বোলো না! তোমার কী হয়েছে কী, কিচ্ছু হয়নি!

সূর্য তার পরদিন থেকে তোলপাড় কাণ্ড করতে থাকল। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের কাছে সে আর গেল না–তার বদলে সে অন্য তিন জন ডাক্তার ডেকে আনল। সব রকম পরীক্ষা ও ফোঁড়াখুঁড়ি চলল। তখনও, পাঁচের দশকের গোড়ার দিকে, যক্ষ্মাকে রাজরোগ মনে করা হত। এর মধ্যে একজন ডাক্তার আবার অভিমত দিয়ে ফেললেন যে বুলবুলের মোটেই টি বি হয়নি। এক্স-রে রিপোর্ট সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়স্বরে তার মত ঘোষণা করতে লাগলেন। এই ডাক্তারটি যদিও ছিলেন এম বি বি এস, তবু ছিলেন জল চিকিৎসার ভক্ত। দিনের বিভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে জল পান করিয়েই যে এক প্রকার চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, তিনি তাই সুপারিশ করলেন। এবং, আশ্চর্যের বিষয়, বুলবুলের কিছুটা উন্নতি হতে লাগল। তার জ্বর ছেড়ে গেল, কাশির দমকেও আর কষ্ট পায় না।

চিকিৎসার সময়ে প্রায় এক মাস সূর্য এক বারও বুলবুলের পাশ ছেড়ে নড়েনি। সূর্যর স্বাস্থ্যজ্ঞান আছে, সে জানে টি. বি. রোগীর পাশে ও রকম শুয়ে থাকা উচিত নয়, কিন্তু সে গ্রাহ্য করেনি। ও-দিকে, বুলবুলের স্বাস্থ্যজ্ঞান নেই, সে জানে না, তার থুতু বা কাশি অন্য কেউ ছুঁলে কী হয়–তবু সে প্রত্যেক দিন সূর্যকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছে অন্য কোনও ঘরে চলে যেতে। অন্য কোনও ঘর মানেই অন্য কোনও মেয়ের ঘর। এবাড়িতেই আর তো কোনও খালি জায়গা নেই। সে কথা বুঝেও বুলবুল সূর্যকে চলে যাবার জন্য জোর করে। সূর্যকে অন্য কোনও মেয়ের হাতে সঁপে দিতেও তার কোনও আপত্তি নেই এখন। প্রতি রাত্রে এই বিষয়ে পনেরো কুড়ি মিনিট কথা কাটাকাটি হয়ে উঠেছিল একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার।

বুলবুল ঘুমিয়ে থাকার পরও সূর্য জেগে থেকেছে। তার ভিতরে সব সময় এই চাপা ভয়টা ছিল যে বুলবুল বুঝি যে-কোনও সময়ে নিঃশব্দে মরে যাবে। সূর্য মৃত্যুর মুখোমুখি হতে চায় সে কিছুতেই বুলবুলকে একা ছাড়বে না। কোনও কোনও দিন বুলবুলের বুকে খুব বেশি ব্যথা হলে সূর্য সেখানে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কাঁচুলি খোলার পর বুলবুলের উন্নত বুকে হাত বুলিয়ে সূর্যর মনে হয়েছে, কিছুই তো বদলায়নি। বুলবুল তো ঠিক সেই রকমই আছে। মৃত্যুটা তা হলে নিশ্চয়ই একটা অবাস্তব ঘটনা!

বুলবুল যখন অনেকটা ভালো হয়ে উঠছে, সেই রকম সময়ে একদিন মাঝ রাত্রে সূর্য একটি ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল! সে-দিন সূর্যর একটু তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ বমির শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। সূর্য ধড়ফড় করে উঠে দেখল, বুলবুল বিছানায় নেই।

বাথরুম অনেক দূরে, সেই জন্য ঘরের কোণে একটা বড় গামলা রাখা ছিল। বুলবুল সেখানে বসে আছে। সূর্য তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সে দেখল, বুলবুল গলায় হাত দিয়ে। ইচ্ছে করে বমি করছে। গলগল করে বেরোচ্ছে কাঁচা রক্ত।

সূর্য কোমল ভাবে বুলবুলের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কী হয়েছে বুলবুল? তোমার বুকে ব্যথা করছে?

বুলবুল এক ঝটকায় সূর্যর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, ছোড় দেও মুঝে–

সূর্য অবাক ভাবে চেয়ে রইল বুলবুলের চোখের দিকে। বুলবুলের দৃষ্টি উন্মাদিনীর মতন। সে চিৎকার করতে লাগল, নিকাল যাও! তু মেরা ঘরসে নিকাল যাও!

বুলবুলের অসুখ পুরনো হয়ে গেছে। এখন আর তার আকস্মিক চিৎকার শুনলে অন্য ঘর থেকে মেয়েরা ছুটে আসে না। এই রাত্তিরেও কোনও কোনও ঘর থেকে ঘুঙুরের আওয়াজ ভেসে আসে। রক্ত-মাংসের উল্লাসময় যে জীবন, তা অন্য কারওর দুঃখ নিয়ে। মাথা ঘামায় না।

দৈত্যের হাতের খেলনার মতন সূর্য জোর করে বুলবুলকে কোলে তুলে নিয়ে আসে। বুলবুল ছটফট করে, সূর্যকে আঁচড়ে কামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে দিতে চায়। সেই সঙ্গে তার মুখ দিয়ে ফোয়ারার মতন বেরোয় অজস্র গালাগালি। এমনকী সূর্যকে সে রেন্ডিকা বাচ্চা বলতেও দ্বিধা করে না। আশ্চর্য, যে নিজে রেন্ডি, তার কাছেও রেন্ডির বাচ্চাই একটা চূড়ান্ত গালাগাল।

পর পর কয়েক দিন বুলবুল সূর্যকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সে কিছুতেই আর সূর্যর সঙ্গে থাকতে চায় না। তার ব্যবহারে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় যে সে আর নিজের ভাগ্যের সঙ্গে সূর্যকে জড়াতে চায় না। সে সূর্যকে মুক্তি দিতে চাইছে। বুলবুল তো আর সূর্যর গোঁয়ারতুমির পূর্ব পরিচয় পায়নি!

দিন দশেক বাদে বুলবুলের অবস্থা আবার হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে পড়ে। জল চিকিৎসার সেই ডাক্তার খুঁটিনাটি ব্যাপারে ভুল ধরে সূর্যকে তিরস্কার করেন। অন্য ডাক্তাররা বলেন, কাছাকাছির মধ্যে ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর ছাড়া অন্য কেউ আর বুলবুলকে বাঁচাতে পারবে না। সূর্য আবার রাধাগোবিন্দ করের কাছে গিয়ে কাকুতিমিনতি করে তাঁকে ডেকে এনেছিল। তিনি খিটখিটে মেজাজ নিয়ে আবার এলেন, বুলবুলের সঙ্গে একটিও কথা না বলে ভালো করে পরীক্ষা করলেন–তারপর সূর্যকে বাংলাতে জানালেন, আর দিন দশেকের মধ্যে মেয়েটা এই পাপ জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।

সূর্যর দিকে ফিরে তিনি জ্বলন্ত চোখে বললেন, তোমারও মুক্তি!

ডাক্তার চলে যাবার পর সূর্য জিজ্ঞেস করল, বুলবুল, তোমার কী ইচ্ছে করে? তুমি কিছু খেতে চাও? তুমি কোনও জিনিস চাও?

বুলবুল আগের তুলনায় অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেছে। সে তার শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, বাঙ্গালীয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না!

মৃত্যুর বোধ যে কী প্রগাঢ়, তা বুলবুলকে দেখলে এখন বুঝতে পারা যায়। সব রকম অতৃপ্তি, ছটফটানি থেমে গেছে তার, সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। কয়েক দিন আগেও সে সূর্যকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন তার কথা শুনলে মনে হয়, সকলে এসে মৃত্যুকে সম্মান করুক। ভয় পাবার কিছু নেই।

সূর্য বুলবুলের উষ্ণ কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বলল, তোমাকে আমি কক্ষনও ছেড়ে যাব না। আমার তো আর কোথাও যাবার জায়গা নেই!

সূর্য একটু অন্যমনস্ক হতেই বুলবুল বিছানার ওপর উঠে দাঁড়াল। টলটলে পায়ে একটু হেঁটে বলল, তুমি নাচ ভালোবাসো। আমি এখনও নাচতে পারি। দেখবে?

সূর্য এক লাফে বুলবুলের কাছে এসে তার কাধ চেপে ধরে ধমকে বলল, কী হচ্ছে কী?

বুলবুল হাসতে হাসতে শরীর দোলাতে লাগল। পরক্ষণেই সূর্যর বুকে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগল হু হু করে।

সব ব্যাপারটা অতি নাটকীয় মনে হয়। কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে বড় আর কোনও নাটক নেই।

কয়েক দিন বাদে, বুলবুলের যখন কণ্ঠস্বর পর্যন্ত অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এসেছে, সেই সময় সূর্যর একটা কথা মনে পড়ল। বুলবুল একসময় প্রায়ই বলত, সে কখনও সমুদ্র দেখেনি। গোয়ালিয়ার ছেড়ে সে বাইরেই গিয়েছে খুব কম–তবু সে পাহাড় ও নদী দেখেছে, কিন্তু সমুদ্র দেখা হয়ে ওঠেনি। কয়েক বার সে সূর্যর কাছে আবদার করেছিল, বাঙ্গালীয়া, আমাকে একবার সমুদ্র দেখাবে?

সূর্যর মনে হল, জীবনটা শেষ হয়ে যাবার আগে, বুলবুলের এই বাসনাটা অতৃপ্ত থাকে কেন? সে কানে কানে জিজ্ঞেস করল, বুলবুল তুমি সমুদ্র দেখতে যাবে?

বুলবুল চোখ অর্ধেক খুলে বলল, সেখানে তুমি আমার পাশে থাকবে তো?

হ্যাঁ। আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব। আমি আর ভয় পাই না। কিন্তু বুকের মধ্যে বড্ড কষ্ট হয়।

সেখানে আমার অসুখ কি কমবে? ওগো, আমার বড় কষ্ট–আমার কষ্টটা একটু কমিয়ে দাও না!

এবার তোমার কষ্ট কমে যাবে। আমার বড্ড বাঁচতে ইচ্ছে করে! আমি জীবনে কী পেলাম? বড় কষ্ট…তুমি বুঝবে না…সত্যি সমুদ্র দেখতে পারব? তোমার পাশে দাঁড়িয়ে?

নিশ্চয়ই। সমুদ্রের ধারে কারওর অসুখ থাকে না। সেই জন্যই তো সমুদ্রের কাছে যাবার কথা বললাম।

বুলবুলের মতন সামান্য মেয়ে তখন অসামান্য চোখে সূর্যর দিকে তাকায়। সূর্যর এই স্তোকবাক্য শুনে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকের চেয়েও গভীর ভাবে একটা নিশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, যদি আর একটা বছরও বাঁচতে পারতাম!

আর একটা বছর বাঁচলে বুলবুলের কোন পরমার্থ সাধিত হত, তা সূর্য জানে না। তবু সে তীব্র ভাবে চিন্তা করতে লাগল, মাত্র একটা বছর সে কোনও জায়গা থেকে ধরে আনতে পারে না? তার নিজের জীবন থেকে অনেকগুলো বছর তো সে যে-কোনও মুহূর্তেই দিতে রাজি আছে!

ট্রেনে বুলবুলকে এই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ঠাকুরসাহেবের সহায়তায় সূর্য একটা মস্ত বড় স্টেশন ওয়াগন ভাড়া করল। বুলবুলকে সে বোম্বাইতে নিয়ে যাবে। গাড়ির ঝাঁকানিতে পাছে বুলবুলের কষ্ট হয়, তাই সূর্য তার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে রইল। বুলবুল সূর্যর বাহু চেপে ধরে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল, সত্যিই আমরা সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি!

সমুদ্র দেখার সম্ভাবনায় সে যেন ঠিক শিশুর মতন কৌতূহলী ও খুশি।

গোয়ালিয়ার শহর ছাড়াবার আগেই বুলবুলের হেঁচকি উঠতে লাগল এবং অসম্ভব বমি। সে এখন কথাও বলতে পারছে না। শুধু ফ্যাসফ্যাসে গলায় মাঝে মাঝে বলতে লাগল, পানি, একটু পানি দাও, বড্ড তেষ্টা–অল্পক্ষণের মধ্যেই সূর্য বুঝতে পারল, বুলবুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

হাসপাতালের গেটে পৌঁছে বুলবুলকে গাড়ি থেকে নামাতেও হল না। একজন ডাক্তার তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি একটু উঁকি দিয়েই বললেন, এ তো মুর্দা হ্যায়।

সূর্যর কোলে মাথা রেখে বুলবুল একটু আগেই মারা গেছে।

সূর্য কঁধদুটো আড়ষ্ট করে অন্য দিকে মুখ ফেরাল। তার ঠোঁটে একটা তিক্ত হাসি ফুটে উঠেছে। যেন বুলবুলের মৃত্যুর জন্য নয়, বুলবুলকে শেষ পর্যন্ত সমুদ্র দেখানো গেল না বলেই সে হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *