মধ্য কলকাতায় ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের বাড়িটি চোখে পড়বার মতন। ধপধপে সাদা রঙের ত্রিতল গৃহ, সামনে ফুলের বাগান, পিছনে কলা, পেঁপে, বেগুন, পালং শাক ইত্যাদি তরি তরকারির খেত, সমগ্র জমিটি মজবুত লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা, গেটের সামনে একজন উর্দি পরিহিত পাহারাদার সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িটিতে সাজসজ্জার আড়ম্বর নেই, কিন্তু সর্বত্র ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতাই গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।
রবিবার দিন ব্যারিস্টার সাহেব মক্কেলদের ডাকেন না, সপ্তাহে এই একটি দিন পুরোপুরি ছুটির দিন, সকালবেলা নিজের হাতে বাগান পরিচর্যা করেন। বিকেলবেলা ব্যাডমিন্টন খেলেন বন্ধুদের সঙ্গে। জনসাধারণের জন্য সেদিন অবারিত দ্বার, অনেকেই বিভিন্ন ব্যাপারে প্রার্থী হয়ে আসে তাঁর কাছে। বেশ কিছু দরিদ্র ব্যক্তিকে তিনি উদার হস্তে দান করেন প্রতি মাসে।
বেলা এগারোটার সময় সেই বাড়ির দ্বারের কাছে এসে দাঁড়াল হেম আর ভরত। দ্বারবান বাধা দিল না, আঙুল দেখিয়ে সামনের বৈঠকখানায় প্রবেশ করার নির্দেশ দিল। সে ঘরখানিতে আট-দশখানি কালো মেহগনি কাঠের চেয়ার, শ্বেতপাথরের মেঝে, এক পাশে একটি ছোট টেবিল। ওরা গিয়ে বসতেই লঘু পায়ে একটি যুবক ঢুকে একটি ফর্ম পূরণ করতে দিল। তাতে নামধাম ও সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিবরণ দিতে হয়। ভরত সেটি পূরণ করে উদ্দেশ্যর জায়গায় লিখল, ব্যক্তিগত। যুবকটি সেটি পাঠ করে বলল, আপনাদের কুড়ি-পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, সাহেব এইমাত্র স্নান করতে ঢুকেছেন।
একদিকের দেওয়ালে মহারানি ভিক্টোরিয়া ও সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ডের দুটি বড় ছবি। আর একদিকের দেওয়ালে ঝুলছেন লর্ড কার্জন। বাড়িটি এমনই নিস্তব্ধ যে ফিসফিস করে কথা বলতেও দ্বিধা হয়। ওরা চুপ করে বসে রইল।
একটু পরে বাইরে থেকে আরও একজন এল, বেশ হৃষ্টপুষ্ট রাশভারি পুরুষ, মুখভর্তি চাপ দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি। সে কিন্তু বসল না, গটগটিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তাকে দেখে ভরতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আরে!
হেম চোখের ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল কী?
ভরত বলল, লোকটাকে আমার চেনা একজনের মতন মনে হল। তবে বোধহয় সে নয়। ভুল হয়েছে।
হেম বলল, মেঝেটা এত পরিষ্কার, আমাদের কি বাইরে জুতো খুলে আসা উচিত ছিল?
দু’জনেরই পায়ে সাধারণ চটি, এ বাড়ির পক্ষে বেমানান। হেমেরটা আবার একটু ছেঁড়া। ধনী গৃহে এলে স্বাভাবিকভাবেই একটু সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়, পায়ে ছেঁড়া জুতো থাকলে তো কথাই নেই। ভরত তবু বলল, ওই লোকটি তো জুতো পরেই ভেতরে ঢুকে গেল।
আবার কিছুক্ষণ দু’জন নিস্তব্ধ। কিন্তু কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়। টেবিলের ওপর ‘ক্যাপিটাল’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা রয়েছে, তার প্রথম পৃষ্ঠায় লর্ড কার্জনের ভারত পরিত্যাগের সংবাদ। হেম সেটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগল।
ভরত খুব মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, লর্ড কার্জনের কী হল বলো তো? দেশে এত আন্দোলন হচ্ছে, কিন্তু ওঁর কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি!
হেম বলল, কার্জন তো অনেকদিন আগেই পদত্যাগ করেছে।
ভরত বলল, তা তো জানি। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কার্জনের এত জেদ ছিল, সেটা কাজেও করে দেখাল, তার মধ্যে হঠাৎ পদত্যাগ করতে গেল কেন?
হেম বলল, সেনাপতি কিচনার কার্জনকে একটা থাপ্পড় কষিয়েছে!
অবিশ্বাসের সুরে ভরত বলল, যাঃ, তা হয় নাকি?
হেম বলল, হাত দিয়ে না মারলেও মেরেছে ঠিকই। ভেতরের ব্যাপারটা ঠিক জানি না। সাহেবরা তো নিজেদের দলাদলির কথা বাইরে প্রকাশ করে না। কিন্তু ওদের মধ্যেও রেষারেষি, আকছা-আকছি, ল্যাং মারামারি সবই আছে।
ভরত বা হেমের মতন প্রায় সব ভারতীয়ই চরম গৌরবের মুহূর্তে ভাইসরয় কার্জনের হঠাৎ অপসারণের কারণটি বুঝতে পারেনি। সকলেরই ধারণা, বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব কার্জনেরই মৌলিক চিন্তা। আগে থেকে আড়ালে যে কত কী ঘটেছে, তা জনসাধারণ জানবে কী করে? বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবার পরেও কার্জনের কোনও উৎসাহ নেই কেন?
উৎসাহ থাকারও কথা নয়। বঙ্গভঙ্গ হল কি না হল, তাতে কার্জনের এখন আর কিছু যায় আসে না। এই সাধের ভারতবর্ষ সম্পর্কেও তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। কার্জন এখন ক্ষুব্ধ, অপমানিত, বিগত-মহিমা! মানসিক আঘাতের ফলে শরীরও ভেঙে পড়েছে।
এ সেই প্রভুর কৃপা ধন্য হবার জন্য দুই ভৃত্যের চিরাচরিত লড়াই। কার্জন এবং কিচনার দুজনেই ব্রিটিশ সম্রাটের উঁচু জাতের ভৃত্য। কার্জন মনে করে বসে আছেন যে, তাঁকে ভারতের সর্বময় কর্তৃত্বের ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আর কিচনার মনে করেন, কার্জন ভাইসরয়গিরি করুন ঠিক আছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তাঁর নাক গলানো চলবে না। কিচনার এও জানেন, স্বদেশে তিনি কার্জনের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাই মাঝে মাঝে তিনি পদত্যাগের হুমকি দেন, তিনি পদত্যাগ করলে ইংলন্ডের জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে, প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই তা চাইবেন না, এ বিশ্বাসও কিনারের আছে। আর কার্জনের ধারণা, শাসন কার্যে তাঁর যোগ্যতা সমস্ত সমালোচনার উর্ধ্বে, স্বয়ং সম্রাট নিশ্চয়ই তা জানেন। প্রধানমন্ত্রী, সেক্রেটারি অফ স্টেটও তাঁর পক্ষে।
সেনাবাহিনীতে একজন তদারকি অফিসার রাখার প্রশ্ন নিয়ে খিটিমিটি অনেক দূর গড়িয়েছে। কিচনার কিছুতেই তাঁর দাবি ছাড়বেন না, আড়ালে তিনি কলকাঠি নেড়ে চলেছেন। সামাজিকভাবে কার্জন-পরিবারের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার অতি অমায়িক। মেরিকে তিনি এমন আদর-আপ্যায়ন এমনকী প্রেম প্রেম ভাব করেন যে মেরির দৃঢ় বিশ্বাস কিচনার কিছুতেই তাঁদের শত্রুতা করতে পারেন না। কিচনারের ধূর্ততা বোঝা এই আমেরিকান রমণীটির অসাধ্য।
একদিন এক ঘরোয়া খানাপিনার আসরে কার্জন বারবার কিচনারকে বলতে লাগলেন, এসো, আমরা দুজনে মিলে একজন মিলিটারি মেম্বারের নাম ঠিক করি। আমরা একমত হলে আর কোনও গণ্ডগোল থাকবে না। তুমি রাজি হও, প্লিজ রাজি হও। সরকার চাইছে ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে সিভিলিয়ান মেম্বার রাখতে, কিন্তু মিলিটারি মেম্বার রাখাই কি উচিত নয়? তুমি রাজি না? একমত হবে না আমার সঙ্গে?
কিচনার বললেন, ঠিক আছে, রাজি।
কিচনার যে মিথ্যে কথা বলতে পারেন, তা কার্জন কল্পনাও করেননি। একদা ভারতবাসীদের কার্জন মিথ্যেবাদী বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের জাতের মধ্যেও যে কত রকম মিথ্যে ও কপটতার খেলা চলে সে ব্যাপারে যেন তিনি সচেতন নন। কিচনার গোপনে টেলিগ্রাম করে লন্ডনে জানিয়ে দিলেন, কার্জন জেনারেল ব্যারো নামের যে ব্যক্তিটিকে মিলিটারি সাপ্লাই মেম্বার হিসেবে নিতে চাইছেন, কিচনার তাকে গ্রহণ করতে রাজি নন। কার্জনের প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল।
এরপর অভিমানী বালকের মতন কার্জন পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। একবার নয়, দুবার। কার্জনের আত্মবিশ্বাস এত প্রবল যে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে, সরকারে তাঁর বন্ধুরা হন্তদন্ত হয়ে তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে বলবেন, তাঁর অভিমানে প্রলেপ লাগাবেন, তাঁর ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবেন।
দশ দিনের মধ্যে স্বয়ং সম্রাটের কাছ থেকে টেলিগ্রাম এল। কার্জন যখন পদত্যাগের জন্য এত ব্যস্ত, তখন সম্রাট বাধ্য হয়েই তা গ্রহণ করছেন গভীর দুঃখের সঙ্গে!
কার্জন শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন বেশ ক’দিন। এরপরেও ভারতে থেকে যাওয়া তাঁর পক্ষে মোটেই সম্মানজনক নয়, তবু থেকে গেলেন কয়েক মাস। কলকাতা ছেড়ে আগ্রায়। মাঝে মাঝে তাঁর প্রিয় তাজমহলের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। কলকাতায় তিনি ভিক্টোরিয়ার নামে যে বিশাল স্মৃতিসৌধ বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা অসমাপ্ত হয়ে পড়ে রইল। আরও অসমাপ্ত রইল কত কাজ। পরবর্তী ভাইসরয় লর্ড মিন্টো এসে যাবার পর কার্জন বম্বে থেকে জাহাজে চড়েছেন গত সপ্তাহে। একবারও পেছনে ফিরে তাকাননি। এই ভারতবর্ষের মাটিতে তিনি আর কোনওদিন পা দেবেন না!
ভরত বলল, ব্যারিস্টার সাহেব এখনও কার্জনের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?
হেম বলল, নতুন বড়লাটের ছবি বোধহয় এখনও জোগাড় করা যায়নি।
ভরত উঠে গিয়ে একটা জানলার কাছে দাঁড়াল। পেছন দিকের বাগানটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে হলুদ গাউন পরা একজন শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা মালিকে কী সব নির্দেশ দিচ্ছেন। ব্যারিস্টার রসুল সাহেব যে একজন ইংরেজ রমণীকে বিয়ে করেছেন, তা ভরত আগেই শুনেছে।
সে জানলার কাছ থেকে সরে আসতেই সেই দাড়িওয়ালা, টুপি পরা ব্যক্তিটি ফিরে এসে ঘরের মাঝখানে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, কী রে, ভরত, তুই এখানে কোন উদ্দেশ্যে?
ভরত কয়েক মুহূর্ত বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর বলল, ইরফান? আমি চিনতেই পারিনি। এ কী চেহারা হয়েছে তোর?
ইরফান একগাল হেসে বলল, মুটিয়েছি, তাই না? সকাল: ভিসি
ভরত বলল, পসার ভালই জমেছে বোঝা যাচ্ছে। বড়লোক হয়েছিস।
ইরফান বলল, আল্লার আশীর্বাদে মোটামুটি ভালই আছি। তোর সঙ্গে সেই যে একবার একটা থিয়েটারে দেখা হল, তারপর তো আর যোগাযোগই রাখলি না!
ভরত বলল, হেম, এই আমার কলেজের বন্ধু ইরফান আলি। এক সময় আমরা অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলাম। তখন ওর ছিপছিপে রোগা-পাতলা চেহারা ছিল। দাড়ি ছিল না।
ইরফান জিজ্ঞেস করল, বিষয়-সম্পত্তি কিছু করেছিস বুঝি? মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিস?
হেম বলল, না, না, ওসব কিছু নয়। রসুল সাহেবের সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি।
ভরত বলল, বরিশাল কনফারেন্সে রসুল সাহেবের যাবার কথা ছিল, আবার শুনছি উনি যাবেন না। ওঁর যাওয়াটা খুব দরকার, সেটাই আমরা বুঝিয়ে বলতে চাই।
ইরফানের মুখোনা কঠোর হয়ে এল। দাড়ি চুমরিয়ে সে বলল, কেন যাবেন ব্যারিস্টার সাহেব? উনি যাতে না যান, সেই চেষ্টা করছি আমরা।
ভরত বলল, সে কী! তোর আপত্তি কীসের?
ইরফান বলল, উনি আমার মুরুব্বি। মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই ওঁর কথা মানে। মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কিছুই ওঁর করা উচিত নয়! বরং হিন্দুদের এই আন্দোলনে মুসলমানরা যাতে যোগ না দেয়, সেটা বুঝিয়ে বলাই ওঁর কর্তব্য!
ভরত বলল, আমাদের লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এখন হিন্দু-মুসলমানের আলাদা আলাদা স্বার্থ থাকতে পারে নাকি?
ইরফান ধমকের সুরে বলল, তোদের ওই যে বয়কট আন্দোলন, তোদর ছেলেরা বেছে বেছে মুসলমানদের দোকানে হামলা করছে, জিনিসপত্র পোড়াচ্ছে, হাট-বাজার বন্ধ করে দিচ্ছে, এ সব তোরা জানিস না?
ভরত বলল, জানি। কোথাও কোথাও বাড়াবাড়ি হচ্ছে ঠিকই। ছাত্রদের বদলে কিছু কিছু লুঠেরা ফেরেব্বাজ বয়কটের নাম করে দোকান থেকে মালপত্র লুটে নিচ্ছে। আবার কয়েক জায়গায় ছাত্ররা এসে পড়ে ওদের ধরে পিটিয়েছেও বটে। কিছু কিছু অরাজকতা চলছে। কিন্তু ইরফান, তুই কী করে বললি যে বেছে বেছে মুসলমানদের দোকানপাটের ওপরেই হামলা চলছে শুধু? বহরমপুরে হিন্দুর দোকানে আগুন ধরানো হয়নি? মাড়োয়ারির দোকান জোর করে বন্ধ করতে গিয়ে মারপিট হয়নি বড়বাজারে?
ইরফান জোর দিয়ে বলল, মুসলমানদের ওপরেই জুলুম চলছে বেশি!
ভরত বলল, স্বীকার করছি, সেটাও মিথ্যে নয়। গোটা ছাত্রসমাজ ক্ষেপে আছে, তারা হিন্দু-মুসলমান বিবেচনা করছে না। মুসলমানরা অনেক জায়গাতেই বয়কটের সিদ্ধান্ত মানছে না, জোর করে দোকান খোলা রেখে বিলিতি জিনিস বিক্রি করতে চাইছে, ঢাকার নবাব মুসলমানদের জন্য আলাদা বাজার বসাচ্ছেন, তাই ছাত্ররাও সেসব জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বয়কট যে একটা দারুণ ভাল অস্ত্র। সেটা বুঝতে পারছিল না। এর মধ্যেই ইংরেজদের ব্যবসায়ে অনেকটা ধাক্কা লেগেছে। ম্যানচেস্টার থেকে কাপড়ের আমদানি কমে গেছে অনেক। হিন্দু-মুসলমান হাত মিলিয়ে আরও একটা বছর যদি এই আন্দোলন চালানো যায়।
তাকে থামিয়ে দিয়ে ইরফান বলল, এই আন্দোলন চালিয়ে মুসলমানের কী লাভ? মুসলমানের ঘাড়ের ওপর পা দিয়ে হিন্দুরা গাছের ভাল ভাল ফলগুলো ছিঁড়তে চাইছে, তাই না? মুসলমান তা মুখ বুজে মেনে নেবে, তারা এত বোকা?
ভরত কয়েক মুহূর্ত বিহ্বলভাবে চেয়ে থেকে বলল, তুই কী বলছিস, আমি বুঝতে পারছি না। ইরফান!
ইরফান তার লম্বা কুতার পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ফস করে ধরিয়ে নিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, তোরা কি শেষ পর্যন্ত এ দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়াতে চাস?
ভরত একবার হেমের দিকে তাকাল। হেম তার সমর্থনে কিছুই বলছে না, মুখ নিচু করে আঙুলের নোখ খুঁটছে।
ভরত বলল, মানে, ইংরেজদের তাড়ানো তো মুখের কথা নয়, আমাদের এখনও সে শক্তি নেই, প্রস্তুতি নেই। তবে মুখে স্বীকার না করলেও স্বরাজের স্বপ্ন কে না দেখে? আমরা কি চিরকাল পরাধীন হয়ে থাকব?
ইরফান বলল, স্বরাজ পাবার পর হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপিত হবে, তাই না? ভরত বলল, মোটেই না। ভারতবাসীরা ভারতবর্ষ শাসন করবে! ইরফান বলল, তার মধ্যে মুসলমানদের স্থান হবে কোথায়? চর্তুদিকে তো হিন্দু হিন্দু রব। তোদের সব নেতারা হিন্দুত্বের নামে শপথ নেয়। শিবাজী এখন ন্যাশনাল হিরো। এমনকী রবিবাবু, তাঁর কবিতা আমি এত ভালবাসি, তাঁর সব কবিতা আমার মুখস্থ, তিনি শিবাজী-উৎসব নামে ওটা কী লিখলেন? ‘এক ধর্মরাজ্যপাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’। এটা কোন ধর্মরাজ্যপাশ?
হেম এবার মুখ তুলে বলল, ওই কবিতাটা আমারও ভাল লাগেনি। ওঁর ওই কবিতাটা লেখা উচিত হয়নি। মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক এক নম্বরের কট্টর হিন্দু। তিনি শিবাজী উৎসব চালু করলেন, অমনি বাঙালিরা তা মেনে নেবে? শিবাজী উৎসব, প্রতাপাদিত্য উৎসব, বীরাষ্টমী এই সবগুলোর মধ্যেই হিন্দুত্বের জয়গান। রবিবাবু প্রতাপাদিত্যকে পছন্দ করেন না, কিন্তু শিবাজীকে হিরো বলে মেনে নিলেন কেন?
ভরত কবীন্দ্র রবীন্দ্রবাবুর এমনই গুণমুগ্ধ যে তাঁর সমালোচনা সে সহ্য করতে পারে না। সে বলল, কবিরা উচ্ছ্বাসপ্রবণ হয়, তিনি ঝোঁকের মাথায় লিখে ফেলেছেন বোধহয়। শুনেছি সখারাম গণেশ দেউস্করের উপরোধে তিনি ওই কবিতাটা লিখে দিয়েছেন। উপরোধ এড়াতে পারেননি আর কী! তবে, ওটা নিতান্তই একটা হিস্টোরিক্যাল কবিতা, ঔরঙ্গজেব হিন্দুধর্মের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শিবাজী, এটা তো হিস্টোরিক্যাল ট্রুথ। রবিবাবু ব্রাহ্ম, তিনি কোনওরকম মূর্তিপূজা মানেন না, তিনি হিন্দু সাম্রাজ্য সমর্থন করবেন কী করে?
ইরফান বলল, ঔরঙ্গজেবের কথা বাদ দে! তুই কবিতাটা ভাল করে পড়িসনি। প্রেজেন্ট কনটেক্সটেই রবিবাবু ওই ধর্মরাজ্যের কথা বলেছেন। “সেদিন শুনিনি কথা, আজ মোরা তোমার আদেশ/ শির পাতি লব.. ‘এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন/ কবির সম্বল”… এর চেয়ে স্পষ্ট আর কী হতে পারে?
ভরত খানিকটা দুর্বলভাবে বলল, আমরা রবিবাবুকে গিয়ে বোঝাব। না, না, ওঁর কোনও ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকতে পারে না। শুধু একটা কবিতা দিয়ে বিচার করলে কী চলে?
ইরফান বলল, একটার পর একটা যোগ হচ্ছে। তোদর সব নেতারা যদি হিন্দুত্বের রব তোলে, তা হলে মুসলমানরা দূরে সরে যাবেই। আমরা আর হিন্দুদের বিশ্বাস করি না, তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাই না।
ভরত বিবর্ণ মুখে বলল, ইরফান! তুই আর আমাকে বিশ্বাস করিস না? আমরা এক সঙ্গে দিনের পর দিন…
ইরফান কাছে এসে ভরতের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছিস! তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে নাকি? দ্বারিকাকে মনে আছে? সে তত নিষ্ঠাবান হিন্দু, এক সময় যখন আমার খাওয়ার সংস্থান ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না, তখন ওই দ্বারিকাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তার সেই উপকার আমি জীবনে কখনও ভুলব? তুইও চিরকাল আমার বন্ধুই থাকবি। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হবে কেন? কিন্তু জাতিগতভাবে মুসলমানরা হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নেবে কেন? হিন্দুদের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য মুসলমানদের এখন পৃথক আইডেনটিটি দরকার। সেইজন্যই আমরা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করি। মুসলমান প্রধান একটা আলাদা রাজ্য পেলে আমরা ছাড়ব না কিছুতেই?
হেম এবার শ্লেষের সঙ্গে বলল, তাতে অবশ্য চোরের ওপর রাগ করে আপনাদের মাটিতে ভাত খাওয়া হবে। হিন্দুদের অবিশ্বাস করে আপনারা সরাসরি ইংরেজদের ভেদাভেদের রাজনীতির খপ্পরে পড়বেন। ইংরেজ কিছুদিন আপনাদের নিয়ে সোহাগ করবে, তারপর আবার একসময় ছুঁড়ে ফেলে দেবে! আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে এই ফাঁদটা বুঝতে পারছেন না? ইংরেজরা এই ভারত সাম্রাজ্যটা কার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, হিন্দু না মুসলমানদের কাছ থেকে? আজ আপনারা আপনাদের সেই পরম শত্রু ইংরেজদের পা চাটবেন?
ইরফান বক্ৰহাস্যে বলল, এর নাম রাজনীতি! পুরনো ইতিহাস আঁকড়ে থাকলে চলে না।
দরজার কাছে একটা শব্দ হতেই সবাই ফিরে তাকাল। ব্যারিস্টার রসুল সাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জমিদার বংশের সন্তান, অতিশয় সুপুরুষ। দীর্ঘকায়, গৌরকান্তি, মুখে প্রশান্তশ্রী মাখানো, পাজামা কুতার ওপর একটি জামেয়ার জড়িয়ে রেখেছেন গায়ে। কৌতুক হাস্যে বললেন, কী, খুব তর্কাতর্কি হচ্ছিল বুঝি? সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিছুটা শুনছিলাম। এ কী, আপনাদের চা-পানি দেয়নি?
উঠে দাঁড়িয়ে ভরত ও হেম সসম্ভ্রমে কপালের কাছে হাত তুলে বলল, আদাব!
রসুল সাহেব দুই করতল যুক্ত করে বললেন, নমস্কার।
ইরফান তাঁর দুপা ছুঁয়ে কদমবুসি করল।
ভৃত্যদের ডেকে চা পাঠাবার কথা বলে রসুল সাহেব একটা চেয়ারে বসলেন। তিনি হরিণের চামড়ার চটি পরে আছেন। ভরত দেখল, ওঁর পায়ের গোড়ালিও কী পরিষ্কার। তিনি এদের দুজনের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী বার্তা বলুন!
হেম বলল, আমরা দুই বন্ধু অতি সাধারণ মানুষ। আপনি সকলের সঙ্গে দেখা করেন শুনেই এসেছি। নিছক একটা কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য। বরিশালে যে-প্রাদেশিক কনফারেন্স হচ্ছে, তাতে আপনি সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছেন শুনেছিলাম। আবার শুনেছি, আপনি যাবেন না। কেন মত পরিবর্তন করলেন, সেটাই জানতে ইচ্ছে করে।
রসুল সাহেব একটুক্ষণ হেমের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনাদের কি কেউ পাঠিয়েছে? কারুর পক্ষ থেকে এসেছেন?
হেম বলল, আজ্ঞে না। আমাদের কেউ পাঠায়নি।
রসুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে, আমি সভাপতি হতে রাজি হই বা না হই, সেটা। আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন? এটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার!
হেম সঙ্কুচিত ভঙ্গিতে বলল, যদি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়, তা হলে আমরা মোটেই কৌতূহল প্রকাশ করতে চাই না। মাপ করবেন। আমরা দেশজুড়ে বর্তমানে যে-আন্দোলন চলছে, তার সামান্য কর্মী। আপনার যোগ দেওয়া না-দেওয়া যদি নীতিগত ব্যাপার হয়, তার একটা গুরুত্ব আছে। এই কথাই ভেবেছিলাম। তা হলে আর আপনার সময় নষ্ট করব না, আমরা উঠি।
রসুল সাহেব এক হাত তুলে বললেন, আরে বসুন, বসুন! চা আনতে বলেছি। যা জানতে এসেছেন, তা জানাতেও আমার আপত্তি নেই। বিপিন পাল ও সুরেন বাঁড়জ্যে মশাইদের সঙ্গে কালই আমার কথা হয়েছে। আগে ঠিক ছিল বরিশাল কনফারেন্স হবে ফেব্রুয়ারি মাসে, তাতে যোগদান করতে আমার ব্যক্তিগত অসুবিধা ছিল। ওই সময় পরিবারকে নিয়ে একবার ডালহৌসি পাহাড়ে যেতে হবে। ওনারা এখন তারিখ বদলেছেন, কনফারেন্স হবে পয়লা বৈশাখ, তখন আমার অসুবিধা নেই, আমি সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়ে কথা দিয়ে ফেলেছি।
ইরফান মুখ ঝুঁকিয়ে তীব্র স্বরে বলল, স্যার, আপনি রাজি হয়ে গেলেন?
রসুল সাহেব বিস্মিত ভাবে বললেন, জী। কেন?
ইরফান বলল, ওখানে আপনার যাওয়া উচিত হবে না। এটা মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী।
রসুল সাহেব বললেন, তাই নাকি? কেন বলো তো?
ইরফান বলল, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন হিন্দুর আন্দোলন। মুসলমান-প্রধান একটা আলাদা রাজ্য পেলে আমাদের লাভ হবে। মুসলমানরা অনেক বেশি চাকরি-বাকরি পাবে, আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে। ঢাকা হবে ক্যাপিটাল। হবে মানে কী, হয়েই তো গেছে! আবার আমরা দুই বাংলাকে জোড়া দিতে চাই না!
রসুল সাহেব সামান্য হেসে বললেন, ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’, এই কি একটা নতুন রাজ্যের উপযুক্ত নাম হল? সে রাজ্যের বাঙালিরা নিজেদের কী বলবে, পূর্ব বাঙালিয়া? না কি বঙ্গালি-অসমিয়া?
ইরফান বলল, স্যার, নামে কী আসে যায়? অসমিয়াদের মধ্যেও অনেক মুসলমান আছে।
ভরত বলল, আমরা হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি নই। হিন্দু বেশি চাকরি পাবে, না মুসলমান বেশি চাকরি পাবে, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আমাদের প্রশ্ন, ইংরেজ সরকার জুলুম করে বাঙালি জাতটাকে দুভাগ করে দিতে চাইলেই আমরা মেনে নেব কেন? শাসন কাজের সুবিধের ছুতোয় এটা তো স্পষ্টই তাদের ভেদনীতি, তাই না?
রসুল সাহেব বললেন, এই প্রথম হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এর আগে খোলাখুলি কেউ এ বিষয়ে কথা বলেনি। এক হিসেবে ভালই হয়েছে। সম্পর্কটা পরিষ্কার হয়ে গেলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ঘুচে যেতে পারে। ইরফান, তোমাকেই প্রথম জিজ্ঞেস করি, তুমি কি বাঙালি থাকতে চাও, না শুধু মুসলমান থাকতে চাও?
ইরফান বলল, দুটোই! ইসলাম আমার পবিত্র ধর্ম, আমার জীবন-মরণ, ইহকাল-পরকাল সেই ধর্মের সঙ্গে জড়িত। তা সত্ত্বেও বাঙালি থাকতে তো আমার বাধা নেই!
রসুল সাহেব বললেন, গুড! ইসলাম হল ধর্ম, আর বাঙালিত্ব হল একটা জাতীয়তাবাদ। এ দুটো যদি তুমি মেনে নাও, তা হলে মুসলমানের মতন, হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টানও বাঙালি হতে পারে! যার যার ধর্ম আলাদা থাক, তবু সবাই মিলে বাঙালি। এই মিলিত বাঙালি জাতির মধ্যে ভেদাভেদ আনলে তো আমাদেরই ক্ষতি! ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল! ঠিক কি না? আমি কিছু গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি। হিন্দুরা নিজেদের বাঙালি বলে, কিন্তু মুসলমানরা নিজেদের বলে শুধু মুসলমান! মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগাতে হবে, আমাদের ভাই-বেরাদরদের মধ্যে গিয়ে তুমি এটা বোঝাবার দায়িত্ব নাও, তা হলেই অনেক সমস্যা মিটে যাবে!
ইরফান বলল, স্যার, আপনি যা বলছেন, তা হল তত্ত্বকথা। বাস্তবের চেহারা ভিন্ন। লেখাপড়ায় হিন্দুরা অনেক এগিয়ে গেছে, চাকরি-বাকরি অধিকাংশ তারা দখল করে রেখেছে। ফোর ফ্রন্টে সব জায়গায় হিন্দু। এটা কি মেনে নেওয়া যেতে পারে? পৃথক একটা রাজ্য হলে মুসলমানরা শিক্ষার অনেক সুযোগ পাবে, সব দিক থেকেই এগিয়ে যাবে। এ সুযোগ আমরা ছাড়ব কেন? ইংরেজ করুক আর যে-ই করুক, বঙ্গভঙ্গ আমাদের পক্ষে আর্শীবাদ। আর একটা কথা বলা দরকার, বাঙালি মুসলমানরাও জাতীয়তার প্রশ্নে শুধু বাঙালি নয়, সারা বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গেও যুক্ত!
রসুল সাহেব বললেন, এটাও তোমার তত্ত্বকথা। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। শুধু মুসলমান বলেই অন্য মুসলমানরা আমাদের কস্কে দেয় না। অবজ্ঞা করে। মনে করে, আমরা খাঁটি মুসলমান না। বুঝে দেখো। হিন্দু কি হিন্দুর ওপর অত্যাচার করে না? হিন্দুদের মধ্যে কত জাত-পাত, কত শোষণ! তেমনি মুসলমানও কি মুসলমানকে শোষণ করে না? মুসলমানের হাতে মুসলমান খুন হয় না? সিয়া-সুন্নিদের কী সাঙ্ঘাতিক লড়াই আমি দেখেছি! ওরে ভাই রে, সব দেশেই কিছু লোক অন্যদের শোষণ করে ধনী হতে চায়। পৃথিবীতে দুটি মাত্র জাত আছে, অত্যাচারী আর অত্যাচারিত, তা যে ধর্মেরই হোক। আর একটা কথা, এদেশে হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা এগিয়ে আছে ঠিকই। ইংরেজরা দেশটা কেড়ে নিয়েছে মুসলমানদের হাত থেকে। তাই মুসলমানদের সন্দেহের চক্ষে দেখে দূরে সরিয়ে রেখেছে, মুসলমানরাও খানিকটা অভিমানভরে ফিরিঙ্গি শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। হিন্দুরা সুযোগ পেয়েছে বেশি। সে জন্য হিন্দুদের দোষ দিয়ে লাভ কী, তারা তো মুসলমানদের বাধা দেয়নি! দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই যদি পরীক্ষায় পাশ করে, আর এক ভাই ফেল করে, তাতে কি বলা যায় যে অন্য ভাইটার জন্য এই ভাই পাশ করতে পারল না? অভিমান ভুলে এবার প্রতিযোগিতায় নামো! অন্যকে দোষারোপ না করে নিজে উপযুক্ত হও। তা কিছুটা শুরুও হয়েছে, মুসলমানরা লেখাপড়া শিখছে, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে।
ইরফান প্রকাশ্য ক্ষোভের সঙ্গে বলল, একটা কথা বলব স্যার, কিছু মনে করবেন না? যদি গুস্তাকি হয় মাপ করবেন। আপনি বিলাতে লেখাপড়া করেছেন, মেম বিয়ে করেছেন, ব্যারিস্টার হিসেবে সফল! আপনি অন্য যে-সব উঁকিল-ব্যারিস্টারের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তারা সবাই হিন্দু। খানাপিনা করেন সাহেবকেতায়, ইসলামের রীতিনীতি কতটা মানেন জানি না। আপনি সাধারণ মুসলমানের মর্মবেদনা বুঝবেন না। মুসলিম সমাজকে উন্নত করতে গেলে আমাদের এখন বিশেষ বিশেষ অধিকার পেতেই হবে। সেইজন্যই বলছি স্যার, ঢাকার নবাব এই সব বয়কট-ফয়কটের বিরুদ্ধে মুসলমানদের এককাট্টা হওয়ার যে ডাক দিয়েছেন, তাতে আমাদের সকলেরই শামিল হওয়া উচিত। আপনার মতন মানুষকে পেলে আমাদের শক্তি অনেক বাড়বে।
হা-হা করে হেসে উঠে রসুল সাহেব বললেন, তুমি যে আমার নামে অনেক অভিযোগ করে ফেললে হে! বিলেতে লেখাপড়া করেছি, সেটা তো ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, এখন আরও অনেকে যাচ্ছে। মেম বিয়ে করেছি বটে, কিন্তু তার আগে মায়ের অনুমতি নিয়েছি। মাকে বলেছিলাম, জননী, তুমি যদি রাজি না হও, তবে এ বিয়ে করব না! তিনি আর্শীবাদ করেছিলেন। আমার স্ত্রী আমার ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি শুয়োর-গরু কিছুই খান না। এ বাড়িতে গোস্তের চলই নেই। আমরা দুজনের কেউই সুরা পান করি না। আমি পাঁচবার নামাজ আদায় করি না বটে, সময় পাই না, কিন্তু প্রতিদিন সকালে ও রাত্তিরে দু’বার অন্তত করি। রোজার মাসে রোজা রাখি, শবেবরাতের রাতে সারা রাত কোরান পাঠ করি। কোরান আমার যতখানি মুখস্থ, ততখানি অনেকেরই নেই। তবে আমি অন্যদের চেয়ে মুসলমান কম কীসে? মুসলমানের ভাল-মন্দ আমার গায়ে লাগবে না?
ভরত ও হেমের দিকে চেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা একেবারে চুপ কেন?
হেম বলল, আপনি পাক্কা ব্যারিস্টারের মতন যে-ভাবে মামলা পরিচালনা করছেন, তাতে আমরা তো মুখ খুলতেই পারছি না।
ভৃত্য এসে চায়ের সঙ্গে প্রচুর বিস্কিট, কেক ও সন্দেশ দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রসুল সাহেব বললেন, তোমাকে আর একটা কথা বলি ইরফান। আমাকে মাস হয়েকের জন্য লাহোর থাকতে হয়েছিল। সেখানে আমাদের অনেক খানদানি ভাই বেরাদরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই তেমন অন্তরঙ্গতা হল না। কেন জানো? ওরা কথা বলে ওদের মাতৃভাষায়, আমি উর্দু কিছু কিছু জানি বটে, কিন্তু আমার মাতৃভাষা বাংলা তো ওরা বোঝে না! তা ছাড়া দিনের পর দিন কী নিয়ে কথা বলব? আমাদের, ধর্ম এক হলেও সব সময় তো ধর্ম নিয়ে কথা বলা যায় না। ওরা স্থানীয় বিষয় নিয়ে কথা বলে, যা আমি বুঝি না, ওদের রসিকতা অন্যরকম। দু চারখানা গজল শুনতে ভাল লাগে বটে, কিন্তু বাংলা গান না শুনলে কি মন ভরে? দিনের পর দিন কি বিরিয়ানি-মুরগ মশল্লম খাওয়া যায়? সাদা ভাত-মাছের ঝোলের জন্য মন আনচান করে। দেখো, একটা জায়গার ভাষা, খাদ্য, পোশাক, লোকাঁচার, গান-বাজনা নিয়ে একটা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, সবাই কিছু না কিছু ভাবে সেই সংস্কৃতির মধ্যেই জীবন কাটাতে পছন্দ করে। এই সংস্কৃতির টান সব সময় বোঝা যায় না, কিন্তু এর জোর কম নয়। রাজনীতির যোগ, ধর্মের যোগের চেয়েও সংস্কৃতির যোগের মূল্য বেশি, এটা আমি বুঝেছি। বাংলার এই সংস্কৃতির মধ্যে আমি ভেদ ঘটাতে চাই না, মুসলমান-হিন্দু সবাইকে মিলিয়েছে এই সংস্কৃতি।
ভরত ফস করে জিজ্ঞেস করল, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনি কী ভাষায় কথা বলেন?
রসুল সাহেব বললেন, তাঁকে বাংলা শিখিয়ে নিয়েছি। তিনি বাউল-ফকিরদের মুখে বাংলা গান শুনতে ভালবাসেন। দিব্যি সজনে ডাঁটা চিবিয়ে খান।
ইরফান জিজ্ঞেস করল, আপনি বরিশাল কনফারেন্সে যাবেনই তা হলে?
রসুল সাহেব বললেন, কথা দিয়েছি, অবশ্যই যাব। শুধু কথা দেবার জন্য নয়, তোমাদের ঢাকার নবাব সলিমুল্লার সঙ্গে আমি গলা মেলাতে পারব না। তাকে আমি নেতা মনে করি না। আমি মনে করি, আমরা সবাই বাংলা মায়ের সন্তান। হিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি কূপমণ্ডুক হয়ে থাকার পক্ষপাতী নই। সুখে-দুঃখে আমরা এক সঙ্গে থাকব। একবার বিভেদের চেষ্টা মেনে নিলে তার থেকে শুরু হবে বিদ্বেষ, তারপর বিরোধ, তারপর মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত, আগুন, দু’পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার পরিণতি কোথায় আমি জানি না। এই হিংসা-বিদ্বেষের বলি হবে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। না, না, আমি ওসব ভাবতে পারি না। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, বাঙালির জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা চালিয়ে যাব!
আরও কিছুক্ষণ পর ওরা বিদায় নিয়ে বাইরে চলে এল।
ইরফান ওষ্ঠ বক্র করে বলল, ভরত। তোরাই জিতে গেলি! দলে পেয়ে গেলি ব্যারিস্টার সাহেবকে।
ভরত বলল, আমাদের তো বিশেষ কিছু বলতেই হল না!
হেম বলল, আপনি মহাভারতের গল্প জানেন? কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হবার আগে শ্রীকৃষ্ণকে দলে পাবার জন্য কৌরব আর পাণ্ডব দু’পক্ষই গিয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ দু’পক্ষেরই আত্মীয়। তিনি তখন ঘুমিয়েছিলেন, অর্জুন গিয়ে বসল তাঁর পায়ের কাছে, আর রাজার অহংকারে দুর্যোধন বসেছিল শিয়রের কাছে। চোখ মেলে শ্রীকৃষ্ণ প্রথম অর্জুনকেই দেখতে পেলেন, তাই তার অনুরোধ আগে শুনলেন। এখানেও তাই, আমরা রসুল সাহেবকে জোর করতে আসিনি, শুধু তাঁর মতামত শোনার জন্য পায়ের কাছে বসতে চেয়েছিলাম। আপনার জোর ছিল অনেক বেশি।
ইরফান বলল, রসুল সাহেবকে অতটা গুরুত্ব দেবেন না। উনি নামী ব্যারিস্টার হতে পারেন, কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে ওঁর তেমন কিছু জনপ্রিয়তা নেই। ঢাকার নবাবের কথাই বেশি লোক মানবে।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরফানের নতুন গাড়ি। সে গাড়ির দরজা খুলে ইরফান বলল, আপনাদের কোথাও পৌঁছে দেব?
হেম বলল, না দরকার নেই, আমাদের মেস কাছেই। হেঁটে যাওয়া যায়।
ইরফান তবু ভরতকে বলল, ভরত, তুই চল না আমার সঙ্গে। আমার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করবি। তারপর পুরনো কালের গল্প হবে।
ভরত বলল, তোর সঙ্গে গেলে মন্দ হত না, খাওয়াটা ভালই জুটত। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী জানিস, আমরা একটা পত্রিকা বার করছি, সেই ব্যাপারে দুপুরে একটা ঘরোয়া মিটিং আছে। আর একদিন যাব। কালই যেতে পারি।
ইরফান জিজ্ঞেস করল, কী পত্রিকা?
ভরত বলল, বাংলা পত্রিকা, নাম রাখা হয়েছে ‘যুগান্তর’। অনেকে মিলে করা হচ্ছে।
ইরফান বলল, হুঁ, আমাদের মুসলমানদের ভাল পত্রিকা নেই। একটা বার করতে হবে।
এগিয়ে এসে ভরতের কাঁধে চাপড় মেরে, দাড়ির ফাঁক দিয়ে হেসে ইরফান বলল, তোরা যতই চেষ্টা করিস, জিততে পারবি না। বাংলা একবার ভাগ হয়ে গেছে, আর কোনওদিনও জোড়া লাগবে না। ফাটা বাঁশি জোড়া দিলেও আর ঠিক সুরে বাজে না!