2 of 2

৭৮. বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে

বুলবুল চেয়েছিল সূর্যকে নিয়ে সে আলাদা কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকবে। এমনকী, সে এ-শহর ছেড়ে চলে যেতেও চেয়েছিল। সূর্য রাজি হয়নি। এ বাড়িতেই সে বেশ আছে।

এতগুলো দিন কেটে গেল, তবু বুলবুল বুঝতে পারে না, সূর্য কী চায়। ও কক্ষনও নিজের কথা কিছু বলে না। তবে, লোকটা তাকে ভালোবাসে, এটা সত্যি। এত যত্ন করে তো আগে কেউ বুলবুলকে ভালোবাসেনি। কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে বুলবুল এইটুকু অন্তত বুঝেছে যে শুধু মেয়েমানুষের ভালোবাসায় পুরুষমানুষের মন ভরে না। ওদের আরও কিছু দরকার। বুলবুল ভেবেই পায় না, সূর্যকে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়েও আর কী দিতে পারে। এই বদ্ধ বাড়িটার পরিবেশ ছেড়ে বাইরের খোলামেলা হাওয়ায় গেলে হয়তো আরও আনন্দ পাওয়া যেত। বুলবুলের বড় সাধ, একবার সে সূর্যকে নিয়ে সমুদ্রের ধারের কোনও দেশে বেড়াতে যাবে। কিন্তু সূর্য গা করে না।

দিনের বেলা বাড়িটা নিঝুম হয়ে থাকে। সকালে দশটা-এগারোটার আগে কেউ বিছানা ছেড়ে ওঠে না। ঘুম থেকে ওঠার পরও সবকিছুর মধ্যেই একটা আলস্য ভাব। যখন-তখন হাই ওঠে। এ বাড়ির বাসিন্দাদের কারওর যেন খিদে নেই, তৃষ্ণা নেই। নারীদের চুল বিস্রস্ত, ঠোঁটে গত রাত্রির পান খাওয়ার দাগ, চোখের সুরমা খানিকটা মুছে গেছে, পোশাকের দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। শুকনো ফুলের মালাগুলো ছড়িয়ে থাকে। বারান্দায়।

অনেকের ঘরেই প্রত্যেক দিন রান্না হয় না। নোকররা দোকান থেকে খাবার এনে দেয়। সেই দোকানের শালপাতার ঠোঙা থেকেই খাওয়া হয়ে যায়, থালাবাসন বার করার ঝামেলাও নেয় না। আবার কেউ যদি শখ করে রান্না করতে বসে, অন্য ঘরের মেয়েরা ভিড় করে এসে দাঁড়ায় তার রান্নাঘরের দরজায়।

অধিকাংশ ঘরের মেয়েরাই একলা থাকে। এদের মধ্যে যাদের বাঁধা প্রেমিক আছে, তাদের সেই সব প্রেমিকরাও দিনের বেলা থাকতে চায় না কখনও। তবলচি বা দালালরা কখনও কখনও টাকা চাইতে আসে, বারান্দায় উবু হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে যায়–দিনেরবেলা সময়ের কোনও দাম নেই এখানে। কারওর কারওর ঘরে বুড়ি মা এবং দু’একটা বাচ্চাও থাকে। সব মিলিয়ে সাত-আটটি বাচ্চা আছে এ বাড়িতে। তাদের হুটোপুটির শব্দ কচিৎ শোনা যায় বটে, কিন্তু ঠিক সন্ধ্যার পর বাচ্চাগুলো যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় কে জানে!

সূর্য সারা দিন প্রায় শুয়ে শুয়েই কাটায়। বুলবুল হাজার চেষ্টা করেও তাকে বাইরে পাঠাতে পারে না। বিছানায় মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকাই সূর্যর সবচেয়ে প্রিয় ভঙ্গি। বুলবুল খাবার নিয়ে এসে ডাকাডাকি করলে সূর্য উঠে বসে, মুখটুখ না ধুয়েই খাবার খায়। এ বাড়িতে চায়ের রেওয়াজ নেই। পাথরের মস্ত বড় গ্লাস-ভরতি গরম দুধ খেতে হয় তাকে। তারপর সিগারেট ধরিয়ে ধীরে সুস্থে গোসলখানায় যায়। ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়ে।

দুপুরে আর একবার স্নান করার জন্য উঠতে হয়। প্রত্যেক দিন স্নান করার ইচ্ছে হয় না তার, কিন্তু বুলবুল এ-ব্যাপারে খুব কড়া। ঠেলেঠুলে তাকে পাঠাবেই। বুলবুলের স্নানের বাতিক আছে। সারা দিনে সে নিজে অন্তত তিন বার স্নান করে, জ্বরজারি হলেও বাদ দেয় না।

স্নান করতে যাবার আগে সূর্য তার শরীরের জড়তা ভাঙবার জন্য হঠাৎ লাফালাফি শুরু করে। প্রথমে শ’ খানেক ডন বৈঠক দেয়, তারপর এদিক সেদিক শরীর মোচড়ায় আর লাফায়। লাফিয়ে লাফিয়ে সে ঘরের ছাদ পর্যন্ত ছোঁবার চেষ্টা করে, কখনও এলোমেলো তাণ্ডবনৃত্য লাগিয়ে দেয়। সেই সময় বুলবুল হেসে একেবারে কুটিকুটি হয়।

এই ব্যায়ামের সময় সূর্যর নৃত্যম্পৃহা দেখে বুলবুল প্রথম প্রথম কয়েক দিন চেষ্টা করেছিল সূর্যকে নাচ শেখাবার। কয়েক দিন পরেই সে চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়েছে। সূর্যর ব্যায়াম করা শক্ত শরীরে এখন আর ভারতীয় নৃত্য আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।

সূর্যর আসল নামটি আর কেউ মনে রাখেনি, তাকে সকলে ডাকে বাঙ্গালীয়া বলে। প্রথম প্রথম বাঙ্গালীয়া বাবু বলত, এখন বাবু শব্দটাও অতিরিক্ত হয়ে গেছে। এখানকার সকলের সঙ্গেই তার বেশ ভাব। অন্য ঘরের মেয়েরা তার সঙ্গে খুব সহজ ব্যবহার করে, কখনও কখনও প্রয়োজন হলে তারা নিঃসংকোচে এসে বলে, বাঙ্গালীয়া পাঁচঠো রুপিয়া। দেও তো।

দিনেরবেলা মেয়েরা এখানে শুধু একটা ঘাগরা আর কাঁচুলি পরে থাকে। কারওর কারওর আবার কঁচুলিরও বালাই থাকে না, শুধু ঘাগরাটাই বুক পর্যন্ত টেনে গিট বেঁধে রাখে–সেই অবস্থায় সূর্যর সামনে পড়ে গেলে তারা একটুও লজ্জা পায় না। এত বড় বাড়িতে গোসলখানা মাত্র দুটি এবং স্নানের জায়গাটি একতলায় ইদারার ধারে এবং উন্মুক্ত। সব সময়েই ভিড় লেগে থাকে। স্নান করতে এসে সূর্যকে প্রায়ই আধ ঘণ্টা-এক ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়, অন্য মেয়েরা স্নান করতে করতেই সূর্যর সঙ্গে গল্প এবং রঙ্গরস করে।

গোড়ার দিকে সূর্যকে দেখে সকলেই নিশ্চিত দারুণ বিমূঢ় হয়েছিল। একটা লোক অন্য এক বাবুর সঙ্গে ফুর্তি করতে এসে তারপর একেবারে থেকেই গেল। সেই যে এল আর এক দিনের জন্যও আর কোথাও গেল না? কোনও মেয়ের জন্য কেউ কি এ রকম সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে থাকতে পারে? তাও কিনা বুলবুলের সঙ্গে? এ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে বুলবুলেরই আকর্ষণ সবচাইতে কম, তাকে কেউ সুন্দরী মনে করে না, তার গালে বসন্তের দাগ এবং সে ভালো গানও জানে না। নাচতে জানে বটে, কিন্তু সুরত না থাকলে মেয়েমানুষের নাচের আবার দাম কী? সেই বুলবুলের কাছেই কিনা চলে এল কোথা থেকে এক রাজপুত্তুর। যেমন সুন্দর স্বাস্থ্য, তেমন ফরসা গায়ের রং। টাকাপয়সাও খরচ করে এন্তার। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষটার শরীরে এক বিন্দু রাগ নেই, যে-যা বলে তাই। শোনে।

কারওর কারওর মনে একসময় সন্দেহ হয়েছিল যে সূর্য বোধহয় কোনও ফেরারি আসামি, এখানে এসে লুকিয়ে আছে। এ রকম ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু কয়েক মাস কেটে গেল, সে রকম কিছুই বোঝা গেল না। মাঝে মাঝে এখানে পুলিশের লোকও আসে, কিন্তু তারা সূর্যকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অন্য ঘরের মেয়েরা এখন বুলবুলের ভাগ্যকে ঈর্ষা করে। তবে এখানে এক রকমের কঠোর নীতিবোধ আছে। অন্য ঘরের কোনও পুরুষকে কখনও কেউ ছলাকলায় ভুলিয়ে নিজের ঘরে ডেকে আনবে না। সেই পুরুষ। নিজে থেকে আসতে চাইলেও রাজি হবে না।

সারা দিন সূর্য পড়ে ঘুমোয়। সন্ধ্যাবেলায় এ-বাড়িতে যখন একটা সাজসাজ রব পড়ে যায়, তখন সেও জেগে ওঠে। মেয়েরা যেমন সাজসজ্জা বদলে প্রসাধন সেরে নেয়, সূর্যও তেমনই একটু সাজগোজ করে। বুলবুল তার জন্য কয়েকটা শেরওয়ানি আর কলিদার সিল্কের পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছে। সূর্যর এখন মস্ত বড় গোঁফ এবং মুখ-ভরতি দাড়ি। ওই সব পোশাকে তাকে আর বাঙালি বলে চেনাই যায় না। রাজপুত কিংবা শিখ বলেই মনে হয়। জামাকাপড় বদলানো হয়ে গেলে বুলবুল নিজের হাতে সূর্যর চুল আঁচড়ে দেয়, আতর মাখিয়ে দেয় গোঁফে। বুলবুল নিজেও খুব পরিপাটি করে সাজে। হাতে আঁকে মেহেদি, ঠোঁটদুটো লাল টুকটুকে করে, লম্বা বেণী ঝোলায়। একটা মোতির মালা গলায় পরে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আয়নার সামনে। তারপর মুচকি হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় সূর্যকে জিজ্ঞেস করে, কেমুন দেখাচ্ছে? এই, বলো না?

বুলবুলের সব সাজগোজই এখন সূর্যর জন্য। তার ঘরে এখন আর অন্য কেউ আসে না। অন্য ঘরে নিত্যনতুন বাবু আসে, নাচগান যখন জমে ওঠে, তখন বুলবুল আর সূর্য পরস্পরকে নিয়ে মত্ত থাকে।

এক একটা দিন অবশ্য অন্য ঘরের কোনও কোনও মেয়ে তাদের বাবুদের নিয়ে চলে আসে এ-ঘরে। সকলে মিলে একসঙ্গে হইচই হয়। গানবাজনা সাধারণত বেশি লোক না হলে জমে না। অন্য কোনও ঘরে মাইফেল বসলেও তারা সূর্য আর বুলবুলকে ডেকে নিয়ে যায়। সকলের কাছেই ওরা দু’জন প্রিয়। সূর্য সারা দিন প্রায় চুপচাপ কাটালেও এই সময়ে বেশ ফুর্তিবাজ হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড মদ খায় আর প্রচুর সিগারেট ফোঁকে। যে-কোনও রসিকতায় হেসে ওঠে হো হো শব্দে। মাত্র কয়েক মাস আগেও সে যে মদ বা সিগারেট স্পর্শ করত না–এখন তাকে দেখে তা কল্পনাও করা যায় না। শেষ রাত্রের দিকে অন্যরা ক্লান্ত হলেও সে ক্লান্ত হয় না একটুও। তার দিন বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে।

বিকেলের পড়ন্ত আলোয় টানা বারান্দায় গোল হয়ে তাস খেলছিল আট-দশটি নারী, এদের রূপ ও যৌবন ছাড়া আর কোনও পরিচয় নেই। এরা আনন্দের পণ্যা। সাধারণ সংসারী নারীদের তুলনায় এদের দুঃখবোধ কম। তাস খেলাটা একটা নিমিত্ত মাত্র, আসলে ওরা রসের গল্পে বসেছে। সকলেরই চুল এখন ভোলা। পিঠের ওপর ছড়ানো, এ-ওর গায়ের ওপর ভর দিয়ে পা-মেলে বসেছে, অনেকেরই বুক ও পেটের অনেকখানি অংশ অনাবৃত, কারণ কাছাকাছি কোনও পুরুষ নেই। হঠাৎ হঠাৎ উলু দেবার মতন ওরা কলস্বরে হেসে ওঠে, গড়িয়ে পড়ে একজন আর একজনের গায়ে কেউ কেউ নিজের ঊরুতে চাপ-চাপড় মারে। ওদের এই সময়কার হাসিতে অসভ্যতার ঝংকার আছে, তার মানেই গত রাত্রের কোনও গূঢ় গল্প।

ক্রমে আলো মিলিয়ে আসে, নোকররা ঘরে ঘরে ধূপ জ্বালিয়ে যায়, ফুলওয়ালা মালা নিয়ে এসে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ায়। ওদের তবু ওঠার নাম নেই। একজন বুড়ি এসে ওদের বকাবকি করতে শুরু করে, গা-ধুয়ে সেজেগুঁজে নেবার জন্য তাড়া দেয়। আঁধার হয়ে এল, এক্ষুনি যে বাবুরা আসতে শুরু করবে। ওই বুড়ি পরীবানুর মা–এ বাড়িতে পরীবানুই সবচেয়ে রূপসি, তার কাছে বেশি লোক আসে। সকলের ধারণা ওই বুড়ি এত টাকা জমিয়েছে যে ভালো মহল্লায় তিনখানা বাড়ি কিনতে পারে।

অগত্যা খেলা ভাঙবার পর যে-যার ঘরে ফিরে যায়। হাসির রেশ তখনও লেগে থাকে। বুলবুল নিজের ঘরে এসে সে-দিন সাজগোজের দিকে গেল না, ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সূর্য ততক্ষণে জেগে উঠে সিগারেট ধরিয়ে নিঃশব্দে কী চিন্তা করছিল। বুলবুলকে শুয়ে পড়তে দেখে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এ কী, শুয়ে পড়লে যে?

বুলবুল মুখ দিয়ে একটা শুধু আদরের উঁ উঁ শব্দ করল।

সূর্য নিজে উঠে বসে বলল, এই, সন্ধ্যাবেলা শুয়ে থাকে নাকি? ওঠো। আজ ঠাকুরসাহেবের আসবার কথা না?

বুলবুল বুকের কাছে হাতদুটি এনে গুটিশুটি হয়ে বলল, আমার শীত লাগছে।

সূর্য বুলবুলকে ছুঁয়ে দেখল তার তার গা ছ্যাঁকছেঁকে, প্রায়ই বুলবুলের একটু-আধটু জ্বর হয়। কিন্তু এমন পাগল মেয়ে কিছুতেই ওষুধ খাবে না। কাছাকাছি এক বৃদ্ধ হেকিমসাহেব থাকেন, তিনি এদের চোখে একেবারে ধন্বন্তরি–তার দেওয়া পুরিয়া খায় মাঝে মাঝে। জ্বর কমুক বা নাকমুক সেই অবস্থাতেই খুব করে আবার চান করে, তারপর ছলছলে চোখে সুর্মা মাখে।

সে-দিন ঠাকুরসাহেবের আসবার কথা। ঠাকুরসাহেব যে-দিন আসেন সে-দিন সারা বাড়িতে এক বিরাট উৎসব পড়ে যায়। ঠাকুরসাহেব নিজেও সঙ্গে আনেন সাত–আট জনের একটি দলসারা বাড়ির সবাইকে একঘরে জড়ো করে নাচগানের এক জলসা বসিয়ে দেন। খাবারদাবার মদ ইত্যাদি সবকিছুরই খরচ ঠাকুরসাহেবের। তার চেহারাটা পুরনো আমলের জমিদারদের মতোই–পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, গলার আওয়াজটা বাজখাঁই। ঠাকুরসাহেবের রোজগারের সূত্র কী কেউ জানে না, তবে এখানে অনেকের ধারণা, চম্বলের ডাকাতদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে। তবে লোকটি গানবাজনার প্রকৃত সমঝদার।

সে-দিন রাত আটটার পর ঠাকুরসাহেব দলবল নিয়ে পরীবানুর ঘরে জমিয়ে বসেছেন, তখনও বুলবুলের ঘর অন্ধকার। একটি মেয়ে বাইরে থেকে এসে ডাকাডাকি করতে লাগল। বুলবুল, বুলবুল, এ বাঙ্গালীয়া–

ঠাকুরসাহেব এর আগে কয়েক বার এসেছিলেন, সূর্যর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে। তিনি নিজেই খোঁজ করেছেন সূর্য আর বুলবুলের।

সূর্য মেয়েটিকে জবাব দিল, আজ আমরা যাব না। বুলবুলের তবিয়ত ভালো নেই।

বুলবুল সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে বলল, আমি যাব না, তুমি যাও।

সূর্য বলল, না, আমারও ইচ্ছে করছে না।

বুলবুল অনুযোগ করে বলল, আমার জন্য তুমি শুধু শুধু ঘরে বসে থাকবে কেন! এ কী রকম মরদ।

সূর্য একদৃষ্টে বুলবুলের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে কী রকম যেন অস্বস্তি লাগে। চেনা মানুষকে কি কেউ এতক্ষণ ধরে দেখে? বুলবুল জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ, অমন করে?

সূর্য বলল, তুমি বুঝতে পারো না?

না। তুমি প্রায়ই এ রকম সোজাসুজি তাকিয়ে থাকো, আমি মানে বুঝতে পারি না।

তোমার মধ্যে যে আর-একটা বুলবুল আছে, আমি তাকে দেখি।

আর-একটা বুলবুল? আর কেউ নেই, আমার ভেতরে আর কিচ্ছু নেই!

আমি ঠিক দেখতে পাই।

তোমার ভেতরে যে আর-একজন সূরয আছে, তা কিন্তু আমি ঠিক জানি। তুমি যদিও আমাকে বলোনি।

বলার দরকার কী! আমার ভেতরের মানুষটাই তো তোমার ভেতরের মানুষটাকে ভালোবাসে।

বুলবুল বলল, ঠিক আছে, ওঠো, ওঠো। তুমি যাও, ঠাকুরসাহেব তোমাকে ডাকাডাকি করছেন।

সূর্য তবু যেতে রাজি নয়। ও-দিকে পরীবানুর ঘর থেকে প্রবল হুল্লোড়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। আলাহিয়া বিলাবলে গান ধরেছে কেউ। অনেকে মিলে একসঙ্গে হাততালি বাজিয়ে তাল দিচ্ছে। বুলবুল জানে, সূর্য এসব ভালোবাসে।

সে তখন উঠে পড়ে বলল, ঠিক আছে, চলো আমিও যাচ্ছি।

সূর্য বলল, তুমি এই জ্বর গায়ে নিয়ে কোথায় যাবে? না, আজ যেতে হবে না।

আমার কিচ্ছু হবে না।

বাতি জ্বালিয়ে বুলবুল প্রসাধন করতে বসল। সূর্য অনেক করে নিষেধ করল তাকে, কিছুতেই শুনবে না। শেষ পর্যন্ত সূর্য বলল, তুমি সাজলে কী হবে। আমি যাব না। আমার আজ আর ইচ্ছে নেই।

বুলবুল বললে, তুমি থাকো তা হলে। আমি একলাই যাই?

বুলবুল জানে, সূর্যকে তা হলে যেতেই হবে। সে কক্ষনও বুলবুলকে ছেড়ে একা ঘরে বসে থাকবে না।

একটু বাদে ওরা দু’জন পরীবানুর ঘরে ঢুকতেই সকলে একসঙ্গে অভ্যর্থনা করল ওদের। ঠাকুরসাহেব সূর্যকে রসিকতা করে বললেন, বাঙালিবাবু, আপনাকে এতক্ষণ দেখিনি! ফুল আর বুলবুল, এ কি কেউ একা একা ভোগ করে!

এখানে এই আনন্দের পরিবেশে অসুখের কথা বলা মানায় না। সূর্য বলল না বুলবুলের জ্বরের কথা। আর বুলবুলকে দেখে তো এখন আর কিছুই বোঝা যাবে না। সে এখন পাখির মতনই ছটফট করছে।

ঠাকুরসাহেব নিজের পাশে বসালেন সূর্যকে। ঠাকুরসাহেবের স্বভাব আছে, পুরুষদেরও কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলা। উৎসাহের আতিশয্যে এক এক বার তিনি সূর্যর কাধ আঁকড়ে ধরে ধরে কাছে টেনে আনছেন আর সূর্যর কনুইতে একটা কঠিন কিছুর খোঁচা লাগছে। সূর্য সহজেই বুঝতে পারে, ঠাকুরসাহেবের কোমরে পিস্তল গোঁজা আছে। কোমরে পিস্তল গুঁজে নাচগানের আসর জমানোটা মন্দ ব্যাপার নয়। ঠাকুরসাহেবের মুখে জর্দার ভুরভুর গন্ধ–সেই গন্ধটা তাড়াবার জন্য সূর্য ঘনঘন হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয়।

বুলবুলকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না, যে তার শরীর খারাপ। ছুন্নির গানের সঙ্গে তবলচি একটা চমৎকার বোল দিতেই বুলবুল পায়ে ঘুঙুর বেঁধে উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগল। সকলে একটা উল্লাসের শব্দ করল। বুলবুলের পাতলা ছিপছিপে দেহটা বিদ্যুতের মতন ঘুরতে থাকে। ছুন্নি আর তবলচি ক্রমশ লয় বাড়িয়ে দেয়। বুলবুল যেন চ্যালেঞ্জের সুরে তাদের কাছে ভাও বাতলায়।

ঠাকুরসাহেব যত বেশি মাতাল হন, ততই তার ফুর্তি বাড়ে। লোকটির প্রাণশক্তি আছে বটে, সারা রাতেও ক্লান্ত হন না। কাছাকাছি বসে থাকা যে-কোনও নারী-পুরুষের উরুতে চাপড় মেরে তিনি হইহই করে হাসতে থাকেন। আজ বুলবুলের নাচ তার খুব পছন্দ হয়েছে–এ জন্য সব কৃতিত্ব যেন সূর্যর, সেই চোখে তিনি তাকান সূর্যর দিকে।

বুলবুলের এক একটা নাচ শেষ হতেই সকলে বলে উঠে, আরও, আরও! বুলবুলের কোনও আপত্তি নেই, সে যেন বেশি উৎসাহ পেয়ে গেছে। এক এক বার বিরতির সময় বুলবুল সূর্যর কাছে আসে তার গ্লাস থেকে মদে চুমুক দিতে। সূর্য তাকে চোখের ইশারায় জানাতে চায়, আর না। আজ আর থাক। বুলবুল ভ্রূক্ষেপ করে না, মুখ ফিরিয়ে নেয়। আজ এখানকার সবাইকে সে একাই মাতিয়ে রেখেছে।

রাত আড়াইটের সময় বুলবুল হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে সূর্য তাকে কোলে করে নিয়ে আসে নিজের ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *