2 of 2

৭৭. কিছুক্ষণ ছোটার পর

কিছুক্ষণ ছোটার পর আমি যত না বেশি হাঁপিয়ে পড়লাম, তার থেকেও বেশি মনখারাপ হয়ে গেল। বার বার মনে হতে লাগল, আমি একটা অপদার্থ। পৃথিবীতে আমার কোনও মূল্যই নেই। আমি অন্যায়কে ভয় করি, আবার ন্যায়ের পথে যাবারও দৃঢ়তা নেই। কিংবা সে-পথ কোনটা আমি জানি না।

এই যে মানুষজন, রাস্তায় এত ভিড়, হইচই, হাসি ও ঝগড়া–এই সবেরই কি কোনও উদ্দেশ্য আছে? আমি কোথায় যাব? শৈশবের এক একটা স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, আর চতুর্দিক প্রকম্পিত হচ্ছে যেন সেই ভাঙার ঝনঝন শব্দে।

কোথায় যাব, এই প্রশ্ন মনে এলে তৎক্ষণাৎ একটা সহজ ও অবধারিত উত্তর মনে আসে। রেণুর কাছে।

আমার মাথার মধ্যে অনেক রকম প্রশ্ন এবং অনেক রকম সমস্যা এসে ভিড় করে। অনেক সময় দিশেহারা হয়ে যাই। কিন্তু দুটি ব্যাপারে আমার উত্তর সব সময়ই সরল। খিদে পেলে খেতে হবে, আর খারাপ হলেই রেণুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

এখন মাথা থেকে আর সবকিছু জটিল ব্যাপার সরিয়ে ফেলে এই সরল দুটি পথ। বেছে নিলাম।

প্রথম কথা, দারুণ খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে শুধু কয়েক কাপ চা ছাড়া আর কিছুই খাইনি। এই কথা মনে পড়তেই আরও অসম্ভব বেশি খিদে পেয়ে গেল।

পকেটে কিছু খুচরো পয়সা আছে। দু’আনি এক-আনি দু পয়সা মিলিয়ে প্রায় বারো আনা। যথেষ্ট খাওয়া হয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে এক কোয়ার্টার মাংস, দুখানা রুটি আর পাঁচটা সিগারেট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে একা খাব কী করে? কোনও দিন আমি একলা কোনও হোটেল রেস্তোরাঁয় ঢুকিনি। একলা বসে বসে কোনও দোকানে চুপচাপ খাবার খেয়ে যাওয়া আমার কাছে একটা অত্যন্ত ভালগার দৃশ্য মনে হয়। অনেককে দেখেছি এ রকম ভাবে খেতে, তারা নিশ্চয়ই মফসসলের লোক।

আমি শ্যামপার্কের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।খালি পেটে সিগারেট টানলে পেটের ভেতরটা চিন চিন করে, তাতেও এক ধরনের নেশা নেশা হয়। অনেক দিন আগে বিষ্ণু আমাকে বলেছিল, জ্বর হলে ওর খুব ভালো লাগে। খুব বেশি জ্বর বাড়লে যখন একটা ঘোরের মতন হয়, তখন কত রকম দৃশ্য দেখা যায়, মনটা খুব চমৎকার ভাবে হালকা হয়। এখন আমি বিষ্ণুর ওই কথাটার মর্ম বুঝতে পারি। শরীরকে কষ্ট দেবার মধ্যেও একটা আরাম আছে। খালি পেটে সিগারেট খাওয়ার কোনও যুক্তি নেই, অথচ ইচ্ছে করে। বিশেষ করে যখন মনখারাপ থাকে তখন শরীরকে কষ্ট দিলে অন্য রকম উপকার পাওয়া যায়।

খিদে পেলেই খেতে হবে, এই সিদ্ধান্ত খুব সরল হলেও গ্রহণ করা সহজ নয়। যেমন, আমার খিদে পেয়েছে, পকেটে পয়সা আছে, তবু আমি খেতে যেতে পারছি না। আমার কোনও বন্ধু যদি একা আমাকে কোনও দোকানে বসে খেতে দেখলে ঠাট্টা করে! আমার কোনও বন্ধুর সঙ্গে এখন দেখা হয়ে গেলে আমি তাকে অনায়াসেই দ্বারিকের দোকানে লুচি আর আলুর দম খাওয়াতে পারতাম। ওরা বিনে পয়সায় যে ডালটা দেয়, সেটার স্বাদই সবচেয়ে ভালো। মনে করলেই জিভে জল আসে।

পঙ্কজ কিংবা ভাস্কর কলকাতায় থাকতে পারে এখন। অনেক দিন ওদের বাড়ি যাই না, এখন একবার গেলে হয়। ভাস্করের বাড়িতে গেলেই খিদের সমস্যা মিটে যায়–এ রকম বিকেলবেলা ওদের বাড়িতে যে-কেউ গেলেই তার জন্য ওপর থেকে খাবার আসে।

কিন্তু এখন ভাস্করের কাছে গেলে আর সহজে ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না। তা হলে রেণুর সঙ্গে দেখা হবে কী করে?

চার পয়সার চিনে বাদাম কিনে নিয়ে তাই খেতে খেতে হাঁটতে লাগলাম। একা একা চিনেবাদাম খাওয়া যায়। ঝালমুনটা কী অসম্ভব ঝাল। চোখের জল বার করে দেয়।

মনখারাপ হলেই রেণুর সঙ্গে দেখা করতে হবে–এই ব্যাপারটাও খুব সরল মনে হলেও আসলে খুব সরল নয়। ইচ্ছেটা সরল, কিন্তু পৃথিবী বড় জটিল। তীব্র ইচ্ছে থাকলেও রেণুর সঙ্গে দেখা করব কী করে?

রেণু অনেক সময় অভিযোগ করেছে যে বেশির ভাগ সময় ওই আমার কাছে দেখা করতে আসে, আমি ওর কাছে যাই না। কথাটা অনেকটা সত্যি, আমার মন-প্রাণ রেণুর দিকে সব সময় ছুটে যেতে চায়, কিন্তু পথে অনেক বাধা। রেণুকে যখনই জিজ্ঞেস করেছি, আবার কবে দেখা হবে, রেণু বলেছে তুমি আমার বাড়িতে আসবে। আমি বলেছি যাব, তবু যাওয়া হয় না। কেন যে যাই না, তা রেণুকেও বুঝিয়ে বলতে পারি না।

বিষ্ণু চলে যাবার পর আর যখন তখন ওদের বাড়িতে যেতে পারি না। শেষের দিকে বিষ্ণুই ছিল ওই বাড়িতে আমার একমাত্র বন্ধু। রেণুর দাদা অংশুর সঙ্গে কিছুতেই আমার বনল না। এখন শুধু রেণুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া কি যায়? কেউ বারণ করেনি, রেণুর ছোটকাকা একদিন শুধু একটু বক্র ইঙ্গিত করেছিলেন। ওদের পুরনো আমলের বনেদি বাড়ি বাইরের কোনও ছেলে ও-বাড়ির কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যায় না। আমি এত ছেলেবেলা থেকে ওদের বাড়িতে যাচ্ছি যে নিজেকে বাইরের ছেলে বলে কখনও ভাবিনি। কিন্তু রেণুর ছোটকাকার ইঙ্গিতটাতে আমার গা জ্বলে গিয়েছিল। সেই থেকে আর ওদের বাড়িতে কখনও যাইনি। আর কিছু নেই, শুধু আমার বাঙালের গোঁটুকু এখনও আছে।

খড়্গপুর থেকে ফেরার পর আর রেণুর সঙ্গে দেখা হয়নি। অনেক দিন রেণুর কোনও খবর জানি না, আজ তো কলেজ ছুটি, রেণু কোথায় থাকতে পারে?

ঘুরতে ঘুরতে আমি রেণুদের বাড়ির রাস্তায় চলে এলাম। একবার হেঁটে গেলাম বাড়িটার সামনে দিয়ে। সদর দরজাটা খোলা, ভেতরের উঠোনটার একটা অংশ দেখা যায় ফাঁকা। অনেক দিন ও বাড়িতে নতুন শিশু জন্মায়নি। ওই উঠোনে এখন কেউ আর খেলাধুলো করে না।

খানিকটা দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতেই হল। ওই বাড়িটা আমাকে চুম্বকের মতন টানছে। অনায়াসে সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারি। রেণুর ছোটকাকার চোখ এড়িয়ে যদি দোতলায় উঠে যাই রেণুর মা আমাকে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। উনি তো একসময় আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। উনি কি কখনও রেণুর কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করেন না?

যেমন পকেটে পয়সা থাকা সত্ত্বেও আমি খাবারের দোকানে ঢুকতে পারিনি, সেই রকম, এখানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি রেণুদের বাড়িতে ঢুকলাম না। এ রকম ভাবে। যাওয়া যায় না।

ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে আমার আরও নিঃস্ব মনে হতে লাগল। কিংবা ভিখারি। কিংবা চোর। রাস্তায় প্রতিটি মানুষ কি আমার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না? যারা হেঁটে যাচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই কোথাও-না-কোথাও যাচ্ছে, আমি শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন?

সত্যিই তো, কেন দাঁড়িয়ে আছি? রেণু যে আজ বাড়ি থেকে বেরোবে, তার কি কোনও মানে আছে? কিংবা রেণু বেরিয়ে গেছে অনেক আগেই, ফিরবে বেশি রাত্রে। ভবানীপুরে ওর মাসির বাড়িতেও যেতে পারে। একমাত্র আমার ইচ্ছাশক্তির জোরেই আমি রেণুকে এখানে টেনে আনতে পারি। এর জন্য কতখানি ইচ্ছাশক্তি দরকার? পি. সি. সরকারের একটা বইতে পড়েছিলাম, রোজ সকালবেলা সবুজ গাছপালার দিকে। তাকিয়ে চোখের একটা ব্যায়াম করলে দৃষ্টিশক্তি এত দূর বেড়ে যায়। ইস, কেন যে সেই চোখের ব্যায়ামটা করিনি।

পেছন থেকে কে একজন আমার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, কী রে বাদল!

এই ব্যাপারটা আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। এ পাড়ায় অনেকেই আমাকে চেনে। এই রকম কোনও জায়গায় চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ-না-কেউ এসে কথা বলবেই।

তাকিয়ে দেখলাম, সুবীর। আমার বয়সি হলেও বিরাট লম্বা চওড়া চেহারা। রেণুদের বাড়ির ঠিক উলটো দিকে থাকে। এ-পাড়ার প্রত্যেকটি মেয়ে ওকে ভয় পায়, আর সুবীর নিজেকে প্রত্যেকটি কুমারী মেয়ের অভিভাবক হিসেবে মনে করে।

আমি সুবীরের দিকে অসহায় ভাবে তাকালাম।.সবল প্রতিদ্বন্দ্বীর মন জয় করার জন্য। হাসলাম ফ্যাকাশে ভাবে। যদি সুবীর আমাকে এক্ষুনি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তা হলে আমি আগামী এক সপ্তাহের জন্য ভগবানে বিশ্বাস করতে রাজি আছি।

সুবীর বলল, এখানে চুপ মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে?

সুবীর জানে না, আমি এখন আর বিষ্ণুদের বাড়ির ভেতরে ঢুকি না। সুবীর জানে, আমি যে-কোনও সময়েই রেণুর সঙ্গে দেখা করতে পারি। সুতরাং ও সে-দিকে কিছু সন্দেহ করবে না।

সম্ভবত ঈশ্বরই আমার মাথায় বুদ্ধি জুটিয়ে দিলেন। আমি বললাম, ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অনেকক্ষণ ট্রাম আসছে না।

মল্লিকাদের বাড়িতে গিয়েছিলি?

এই প্রশ্নে আমি আরও বেশি চমকে উঠি। এটা আবার সুবীরের কী কায়দা? রেণুদের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস না করে মল্লিকাদের বাড়ির কথা বলার মানে কী? মল্লিকা নামটা চেনা চেনা, কিন্তু আমার সঙ্গে আলাপ নেই।

উত্তর না দিয়ে আমি এমন একটা মুখভঙ্গি করলাম, যার অনেক রকম মানে হতে পারে। এবং কথা ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, সুবীর, তুমি ইলেকশানের সময় কিছু করোনি?

সুবীর অত সহজে ভুলল না। ইলেকশানের ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, মল্লিকাদের বাড়িতে খুব রসের কারবার জমেছে, নারে?

আমাকে সাবধান হতে হবে। সুবীরের কাছে দুর্বলতা দেখালে চলবে না। কোনও রকম যুক্তি মানে না সুবীর। যে-কোনও সময় গালাগালি দিতে বা হাত চালাতে পারে। আমি ওকে একটা সিগারেট দিলাম।

সিগারেটে টান দিয়ে সুবীর বলল, বাদল, তুই থিয়েটার করছিস না?

প্রথম দেখার পর আমি সুবীরকে এড়াতে চেয়েছিলাম, ভয় পেয়েছিলাম, এখন আমার কৌতূহল বেড়ে উঠল, সুবীর এসব বলছে কী?

সুবীর আবার বলল, তুই পার্ট ফার্ট করছিস না? দেবুদা তোকে পার্ট দেয়নি?

তৎক্ষণাৎ সুবিধে মতন কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমি সোজা কথাটাই বললাম। মাথা নেড়ে জানালাম, না।

দেবুদা, নিজেকে মস্ত বড় ডাইরেকটার ভাবে কিনা। মাইরি যেন সেকেন্ড শিশির ভাদুড়ী। শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে টেক্কা দেবার জন্য মাল খাওয়া শুরু করেছে, জানিস তো?

এসব কিছুই আমার জানার কথা নয়। কারণ, আমি দেবুদাকেই চিনি না। আমি সোজা সুবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, যাতে আমাকে প্রশ্ন করার বদলে ও নিজেই। কিছু বলে।

সুবীর এরপর যে কথাটা বলল, সেটা আমার পক্ষে হজম করা শক্ত।

দেবুদা রেণু আর মল্লিকা দু’জনের সঙ্গেই হিড়িক দিচ্ছে শালা।

রেণুর নাম নিয়ে কেউ কোনও প্রকার খারাপ কথা বললে আমার শরীর জ্বলে যায়। আমার উচিত ছিল সুবীরের নাকে বিনা বাক্যব্যয়ে একটা ঘুষি মারা। কিন্তু তার উপায় নেই, সুবীরের শরীরের ওজন আমার অন্তত দ্বিগুণ। এবং নিতান্ত বোকা গোঁয়ার ছাড়া কেউ এই সময় মারামারি করে না। আমি তক্ষুনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভবিষ্যতে কোনও-না-কোনও একদিন আমি সুবীরকে কঠিন শাস্তি দেব। সে-দিন হয়তো ও বুঝতেই পারবে না, কী অপরাধের জন্য ওই শাস্তি।

সুবীরের সঙ্গে আমার আর একটাও কথা বলার ইচ্ছে নেই। আমি আপন মনেই বললাম, ওই তো ট্রাম এসে গেছে।

ছুটে গিয়ে উঠে পড়লাম ট্রামে। সুবীর আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিল, শুনতে পেলাম না। সুবীরের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছিল। ট্রামটা একসময় এসে শ্যামবাজার ডিপোর মধ্যে ঢুকল, তবু আমি বসেই রইলাম। ট্রাম থেকে নামলেই কোনও একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ঠিক করতে হবে। কিন্তু কোথায় যাব? এই সময় বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। মুখের ভেতরটা তেতো তেতো লাগছে। আমি রেণুর কাছে যেতে চাই, কিন্তু যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

সুবীরের কথা শুনে বোঝা গেল, মল্লিকাদের বাড়িতে কোনও একটা নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে। রেণু কি তাতে অভিনয় করছে? রেণু কোনও নাটকে অভিনয় করছে, আর আমি তার কিছুই জানি না, এ কি কখনও হতে পারে? অবশ্য, আমিও যে একদিন ইলেকশানের কাজে মেতে ছিলাম, রেণু তা জানে না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, রেণু তো বাইরে কারওর সঙ্গে বেশি মেশে না, নাটক করবে কী করে?

মল্লিকাদের বাড়ি রেণুদের বাড়ির পেছনেই। কোনও দিন আমি সেখানে যাইনি। কিন্তু রেণুকে কয়েক দিন ও বাড়িতে যেতে দেখেছি গল্পের বই আনবার জন্য। রেণু সেখানে এখন রিহার্সাল দিচ্ছে, আর আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব? এই মুহূর্তে হাজার হাজার ডিনামাইট দিয়ে কলকাতা শহরটা ধ্বংস করে দিলে কী হয়?

একসময় দেখি যে আমার ট্রামটা আবার চলতে শুরু করেছে। আবার রেণুদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাব। আমি উদাসীন ভাবে বসে রইলাম। যেখানে খুশি যাক।

হাতিবাগান থেকে ট্রামটা ঘুরতেই আমি নেমে পড়লাম ঝপ করে। এবারও যদি সুবীর আমাকে দেখতে পায়, কী করবে জানি না। আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে রেণুদের বাড়ির পাশের গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

মল্লিকাদের বাড়িটা চিনতে কষ্ট হল না। জোরে জোরে কথাবার্তার আওয়াজ হচ্ছে একতলার একটা ঘর থেকে। জানলার বাইরে অনেকগুলি কৌতূহলী ছেলেমেয়ে এবং কয়েকটি লোভী ছোকরা। তাদের মধ্যেও সুবীরও আছে।

সুবীর আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী রে?

আমি ওকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গম্ভীর ভাবে বললাম, একটা জিনিস ফেলে গিয়েছিলাম।

আমি সোজা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এক নজরে তাকিয়ে দেখে নিলাম, রেণু ছাড়া আর এক জনও চেনা নেই।

আমি হঠাৎ ঢুকে পড়ার জন্য কেউ আমাকে কিছু বলবে কিনা এ-চিন্তা আমার মনেই আসেনি। আমি প্রগাঢ় অভিমান বোধ করছিলাম। কেন কী জানি।

আজ সারা দেশ জুড়ে সাধারণ নির্বাচনের উত্তেজনা, খানিকক্ষণ আগেই আমি দারুণ এক ভিড় ও হুড়োহুড়ির মধ্যে থেকে এসেছি–অথচ এখানে তার চিহ্নমাত্র নেই। এরা নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে। এ রকম হয়, আমি আগে খেয়াল করিনি। গত কয়েকটা দিন ধরে আমি ভাবছিলাম যে, এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দেশের ভাগ্য নির্ভর করছে। এখন দেখতে পাচ্ছি অনেকে এ ব্যাপার নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামায় না।

রিহার্সাল তখন মধ্যপথে। রেণুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আর একজন মাঝবয়সি লোক হাউহাউ করে কান্না কান্না গলায় বলছে, মা জননী, মা জননী, তুমি একবার রাজাবাবুকে বলল–

রেণু আমার দিকে একবার চেনা-চোখে তাকাল, কোনও কথা বলল না। আমি দেওয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম।

রেণুকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘরের সকলের দৃষ্টি তার দিকে। রেণুর ঈষৎ কোঁকড়া চুল শুধু একটা রিবন দিয়ে বাঁধা। একটা সাদা সিল্কের শাড়ি পরে আছে। সবচেয়ে সুন্দর লাগে ওর গম্ভীর ধরনের অথচ ছেলেমানুষি মুখখানা। রেণুর মতন ওইটুকু একটা মেয়েকে একজন বয়স্ক লোক মা জননী বলছে, এটা হাস্যকর। অবশ্য এইসব অ্যামেচার নাটকগুলো হাস্যকরই হয় সাধারণত। দু-একটা লাইন শুনলেই বোঝা যায় এক বিন্দুও সাহিত্যরস নেই।

পরিচালককে সহজেই চেনা যায়। একজন ফরসা ও দীর্ঘকায় লোক, চুল ওলটানো, দীর্ঘ নাসা, গিলে করা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা। এই তা হলে দেবুদা।

ঘরে আরও আট-দশ জন ছেলে ও মেয়ে আছে। সকলেই চুপচাপ। এদের মুখ-চোখে বেশ একটা সাংস্কৃতিক ভাব আছে। আমি চিনি এইসব ছেলেমেয়েদের–এরা সংস্কৃতির চর্চা করতে ভালোবাসে, অন্য সময় প্যান্ট-শার্ট পরা থাকলেও সংস্কৃতি করার সময় ধুতি পাঞ্জাবি পরবেই।

পরিচালক এগিয়ে এসে রেণুর থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বলল, মুখটা তোলো, মুখটা তোলো, অডিয়েন্সের দিকে তাকাও।

রেণু হেসে ফেলে বলল, বললাম তো আমি পারব না। আমি একদম পারব না। কেন পারবে না? পারবে কি পারবে না তা তুমি নিজে কী জানো, সে তো আমরা বলব।

রেণু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আজ আর থাক বরং।

না, না, না–থার্ড সিনটা হয়ে যাক।

পরিচালক দেবুদা রেণুর পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঠিক যেন আমার দিকেই তাকিয়ে বলল, ঠিক এই ভাবে হেসে হেসে মুখটা তুলে বলো, আপনি বোধহয় জানেন না, আমি মানুষ চিনতে কখনও ভুল করি না।

রেণু সেই কথাগুলো উচ্চারণ করল কিন্তু এখনও মুখ নিচু করে। সে যেন আমার দিকে তাকাতে পারছে না।

দেবুদা আবার রেণুর থুতনিতে হাত দিয়ে বলল, মুখটা তোলো, মুখটা তোলো, সোজা ওই দিকে–

আমার চোখ আটকে আছে দেবুদার আঙুলের দিকে। সেই আঙুল রেণুর থুতনি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। দেবুদা নামের এই লোকটির সঙ্গে সারা জীবনে কখনও যে আমার বন্ধুত্ব হবে না তখনই তা ঠিক হয়ে গেল।

আমি এই সময় আবার মনে মনে কথা বলা শুরু করে দিলাম। অনেক লোকের মাঝখানে একা হয়ে পড়লেই এ রকম হয় আমার।

আমি রেণুর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি কোথাও আছি?

রেণু উত্তর দিল কেন?

তুমি আমাকে মনে রেখেছ?

তার মানে?

তুমি কি এই ক’দিনে এক বারও আমার কথা ভেবেছ?

কী মনে হয়?

আমি বুঝতে পারি না, আমি বুঝতে পারি না। আমার ভয় হয়।

দেবুদা তখনও রেণুর গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। উনি কি অভিনয় শেখাচ্ছেন, না নাচ শেখাচ্ছেন? হাত ধরে, কাঁধ ধরে বুঝি অভিনয় শেখাতে হয়? আমি সেদিকে চেয়ে থাকতে পারছি না। গত দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই কি পৃথিবীটা আমার জন্য বদলে গেল? আমার খিদে পেয়েছে, আমি ক্লান্ত, এই সময় রেণুকে আমি কাছে পাব না, অন্য একজন তার গা ছুঁয়ে থাকবে?

বাড়ির ভেতর থেকে অনেকগুলি কাপ-ভরতি করে চা আসছে। চায়ের ব্যাপারে যে মেয়েটি তদারকি করছে, সেই-ই যে মল্লিকা, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। একটু মোটাসোটা ধরনের। কিন্তু বেশ আকর্ষণীয় চেহারা, মুখখানা সব সময়ে হাসিখুশি।

আমার অস্বস্তি বেড়ে গেল অনেকটা। এরা আমাকে চেনে না, নিশ্চয়ই আমাকে চা দেবে না। আমি যে চা খাবার জন্য মরে যাচ্ছি তা নয়, কিন্তু অন্য সকলকে চা দেবার পর আমাকে যদি না দেয়—

মল্লিকা প্রথমেই এসে আমার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল, নিন। আমি নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে চা নিলাম।

মল্লিকা আবার বলল, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না! রেণুকে কত বার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছি, এর আগে এক দিনও আপনাকে নিয়ে আসেনি।

আমার সঙ্গে মল্লিকার কোনও দিন আলাপ হয়নি। তবু মল্লিকা আমাকে চিনল কী করে! মেয়েরা বোধহয় এ রকম ভাবে অন্যদের অজ্ঞাতসারে অনেক কিছু জেনে ফেলে।

আমি লাজুক ভাবে বললাম, আমি কলকাতায় ছিলাম না অনেক দিন।

কোথায় গিয়েছিলেন?

খড়্গপুরের দিকে।

দেবুদা হাত তুলে বলল, আস্তে আস্তে!

রেণু আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আজ আর ভালো লাগছে না। এবার অন্য সিন থোক।

সেই দৃশ্য শেষ হয়ে যাবার পর আবার অন্য দৃশ্যের রিহার্সাল শুরু হল, তার মধ্যে রেণু নেই। রেণু কিন্তু উঠে এসে আমার সঙ্গে কথা বলল না। একবার তাকালও না। হঠাৎ কী একটা আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল মল্লিকার সঙ্গে।

আমি রেণুর চোখে চোখ ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু রেণু যেন আমার উপস্থিতির কথা ভুলেই গেছে। মল্লিকার সঙ্গে ওর কী এত কথা?

এদিকে পরিচালক দেবুদা নিজেই এখন অন্য আর দু’জনের সঙ্গে একটা দৃশ্যের রিহার্সাল দিতে শুরু করেছেন। সংলাপ শুনে মনে হয় উনিই নায়ক। পেছনে একটি ছেলে বসে প্রমটিং করছে, কিন্তু দেবুদার দরকার হচ্ছে না প্রমটিংয়ের। নাটকটাও কী ওঁরই লেখা নাকি? একই সঙ্গে নাট্যকার, পরিচালক ও নায়ক–এতগুলি গুণ সমন্বিত কোনও লোক যদি রেণুর থুতনিতে হাত ছোঁয়ায়, তবে আমি তাকে কিছুতেই পছন্দ করতে পারি না।

এখানে আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার। রেণু আমার কাছে আসছে না কেন? আমিও তো কাছে গিয়ে রেণুকে ডাকতে পারি। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। অথচ আমি কিছুতেই ডাকব না। রেণু নিজে থেকে আমার সঙ্গে কথা না বললে আমি ডাকতে পারি না।

তখন আমি পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালাম। রেণুর সামনে সচরাচর সিগারেট খাই না। রেণু জানে, আমি সিগারেট আবার ছেড়ে দিয়েছি। ও ভীষণ রেগে যাবে। কিন্তু এইটাই আমার প্রতিবাদ। আমি কোনও ঘরে ঢুকলে রেণু আর সবাইকে ফেলে প্রথমেই আমার সঙ্গে কথা বলবে, আমি এটা চাই।

পরিচালক দেবুদা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, এই কবি, কবি, তুমি এবার এদিকে এসো!

বড় চুলওয়ালা একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল। চোখে একটা উদাস উদাস ভাব। ছেলেটিকে দেখে আমার বেশ মজা লাগল। এর নামই কি কবি, না কবিতা লেখে? অথবা কবির ভূমিকায় অভিনয় করছে? মুখের মধ্যে একটা পান্তুয়া-ভরে কথা বললে যে রকম হয়, এর গলার আওয়াজ সেই রকম।

দেবুদা তাকে ঠিক মতন দাঁড় করিয়ে দিলেন। বাঁ হাতটা বাউলের মতন উঁচুতে তোলা। সে এই ভাবে কবিতা বলতে বলতে মঞ্চে ঢুকবে। সে একজন আধুনিক কবি। অর্থাৎ আধুনিক কবির ব্যঙ্গচিত্র। শনিবারের চিঠি এবং প্রমথনাথ বিশীর লেখালেখির জন্য আধুনিক কবিদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা বেশ ফ্যাশন হয়েছে। একটুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলাম, যে-ছেলেটি অভিনয় করছে, সে নিজে সত্যিই একজন কবি। প্রত্যেক পাড়াতেই যেমন একজন পাড়াকবি থাকে। সে পান্তুয়া-গলায় উদ্ভট সব লাইন বুলে যেতে লাগল।

আমার অসহ্য বোধ হল। আজকাল আমি কবিটবিদের দু’চক্ষে দেখতে পারি না। ছেলেটির অভিনয়ে ঘরের মধ্যে হাসির ফোয়ারা পড়ে গেছে। আমি রেণুর দিকে একবার তীব্র চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

হনহন করে হেঁটে এসে দাঁড়ালাম মোড়ের মাথায়। রেণু আজ আমাকে অপমান করেছে। এক একটা দিন আসে এই রকম। প্রত্যেকটি ঘটনাই আমার বিরুদ্ধে যায়। ঘটনাগুলো ষড়যন্ত্র করে ঘটতে থাকে। বিকেলবেলা আমার অতখানি মনখারাপ হবার পর রেণুর কাছে এসে একটু শান্তি কি প্রাপ্য ছিল না?

এখনই সত্যিই আর আমার যাবার কোনও জায়গা নেই। যাবার জায়গা নেই বলেই আমি বাড়িতে গিয়ে পালিয়ে থাকব না। সারা রাত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।

খুব সিগারেট খাওয়া হচ্ছে।

চমকে পাশে তাকালাম। কখন যেন ম্যাজিকের মতন রেণু এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।

কোনও কথা না বলে আমি রেণুর দিকে কড়া ভাবে তাকিয়ে রইলাম। রেণু আবার বলল, সিগারেট ফেলে দাও এক্ষুনি।

না। কেন ফেলব?

তুমি আমাকে না ডেকেই চলে এলে যে?

আমি তো তোমাকে ডাকতে যাইনি।

তবে? রিহার্সালের ওখানে গিয়েছিলে কেন?

এমনিই।

রেণু এক পা এগিয়ে এসে বলল চলো, আমাদের বাড়িতে চলো। ওখানে বসে কথা বলব।

না, তোমাদের বাড়িতে যাব না।

এত রাগ রাগ করে কথা বলছ কেন? কী হয়েছে কী?

তুমি ওদের ওখানে আমার সঙ্গে কথা বলেনি কেন?

এর উত্তরটা খুব সোজা। তোমার বোঝা উচিত ছিল।

না, আমি অত সব বুঝতে পারি না। কী?

আমার লজ্জা করছিল।

একটু থেমে রেণু আবার মিনতি করে বলল, আমাদের বাড়িতে আজ একবারটি এসো৷ নীচেই বসবে–লক্ষ্মীটি এসো।

তোমার ছোটকাকা–

বাজে কথা বোলো না। ছোটকাকা তোমাকে কোনও দিন বারণ করেননি।

বিকেল থেকেই মনটা খুব দুর্বল হয়ে আছে, তাই আর বেশি জেদ দেখাতে পারলাম না। অনেক দিন পর রেণুদের বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকেই কয়েকটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। বড় গেট দিয়ে ভেতরে এসে উঠোন ও ঠাকুরদালানের পাশেই একটা নতুন পাঁচিল উঠেছে। উঠোনের পাশে আর একটা ঘর। প্রশ্ন-চোখে রেণুর দিকে চাইতেই ও জানাল ভাড়া দেওয়া হবে।

বুঝতে পারলাম, এ বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে আর বেশি দেরি নেই। এইসব বনেদি পরিবার নিজের বসত বাড়িতে বাইরের লোককে এনে ভাড়াটে বসাবে, আগে চিন্তাও করা যেত না। রেণুদেরই আর দু-তিনটি-ভাড়া বাড়ি এবং মফস্সলে জমিদারি ছিল শুনেছিলাম। কিন্তু এদের বাড়িতে অধিকাংশ পুরুষই কোনও কাজ করে না, অথচ সকলেরই ব্যয়বহুল বিলাসী জীবন–বিষয় সম্পত্তিগুলো তাই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। রেণুর ঘোটকাকার একমাত্র কাজ মামলা-মোকদ্দমা করা।

যেটা বিষ্ণুর পড়ার ঘর ছিল সেটা এখন বারোয়ারি বসবার ঘর হয়েছে। সোফার ঢাকাগুলো ময়লা। দেওয়ালগুলো চুনকাম হয়নি বহু দিন। সেই ঘরে এসে বসলাম।

রেণু জিজ্ঞেস করল, মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না?

রেণুর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে ওপরে যেতে হবে। তা হলে বিষ্ণুর মায়ের সঙ্গেও দেখা করা উচিত। অনেক দিন পরে এসেছি। ওপরে গেলে রেণুর অন্যান্য। কাকা কাকিমাদেরও প্রণাম করা দরকার। একটু ইতস্তত করে বললাম, পরে যাব।

তুমি কী করে জানলে আমি মল্লিকাদের বাড়িতে আছি?

সুবীর বলল।

সুবীর কে?

ওই যে লম্বা সুবীর, তোমাদের পাড়ার।

ও বুঝি আজকাল তোমার বন্ধু?

হ্যাঁ বন্ধুই তো। যদি হয়ই বন্ধু, তাতে কী হয়েছে?

কিচ্ছু না। তুমি আজকাল কোথায় থাকো, কাদের সঙ্গে মেশো, আমি কিছুই জানি না। এতদিন কোথায় ছিলে?

যেখানেই থাকি না কেন, তোমার তো কোনও ক্ষতি হয়নি! তুমি তো দিব্যি নাটকফাটক নিয়ে মেতে আছ।

আমার সঙ্গে রাগ রাগ করে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।

বেশ করব! তুমি যে নাটকে অভিনয় করছ, আমাকে তা জানাওনি কেন?

তুমিও তো ইলেকশান নিয়ে খুব হইহল্লা করছিলে খবর পেয়েছি। সে-সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, আমি পছন্দ করি কি না? যত সব বকাটে ছেলের সঙ্গে মিশে বিড়ি সিগারেট খেতে শিখছ।

মোটেই তারা কেউ বকাটে নয়। রাজনীতি করা আর এইসব নাটক করা কি এক হল? রেণু তুই কি দিন দিন ইডিয়েট হয়ে যাচ্ছিস?

একবার মুখ থেকে কথা বেরিয়ে গেলে তা আর ফেরানো যায় না। এই সুরে রেণুর সঙ্গে কখনও কথা বলিনি। কিন্তু রেণুকে আজ আঘাত দিতেই ইচ্ছে করছে। রেণুর হাতটা চেপে ধরে কঠোর ভাবে বললাম, লোকজনের সামনে আমার সঙ্গে কথা বলতে তুই বুঝি অপমানিত বোধ করিস? আজকাল প্রায়ই দেখছি..

রেণু আস্তে আস্তে বলল, হাত ছাড়ো।

ওই দেবুদা লোকটা ভালো নয়। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি।

আমি বুঝি আর কারওর সঙ্গে মিশব না? তুমি তাই চাও?

চট করে এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। আসলে আমি তাই চাই। মুখে এটা বলতে পারা সম্ভব নয়। আর কেউ রেণুর দিকে গভীর ভাবে তাকাবে কিংবা কেউ অভিনয় শেখাবার ছলে ওর চিবুক স্পর্শ করবে, এই চিন্তাও আমার পক্ষে অসহ্য। আমার সাংঘাতিক ঈর্ষা।

মুখে কিছু বলতে না পেরে আমি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে রেণুকে জড়িয়ে ধরলাম। রেণু কিছু বলবার আগেই আমি ওকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম দরজার পাশেই, দেওয়ালের গায়ে। ওর বুকের ওপর রাখলাম আমার মুখ।

রেণু বলল, বাদলদা, তুমি অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছ।

হয়েছিই তো। আরও হব।

আমি কিন্তু চেঁচিয়ে কারোকে ডাকব এবার।

রেণুকে ছেড়ে দিয়ে আমি সরে দাঁড়ালাম। রেণু এ রকম নীরস গলায় কখনও আমাকে নিষেধ করেনি। আমি ভালো হতে চাই। আমি উঁচু মানুষ হতে চাই। আমি অন্য সব জায়গায় হেরে গেলেও রেণুর কাছে এসে সান্ত্বনা পেতে চাই। কিন্তু আজ রেণুই বলছে, আমি খারাপ হয়ে গেছি। হঠাৎ আমার চোখে জল এসে গেল, রেণু যাতে দেখতে না পায় তাই আমি মুখটা ফিরিয়ে নিলাম।

রেণু বলল, তুমি পাগলের মতন যখন তখন এ রকম যা-তা কাণ্ড করবে না বলে দিচ্ছি।

রেণু, তুমি আমার নও?

কী গভীর আর্তি নিয়ে যে এ-প্রশ্ন করেছিলাম, তা আর কারোকে বোঝানো যাবে না। ছেলেবেলা থেকে জানি, রেণু আমার। সুতরাং তাকে নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি। রেণু কি তা অস্বীকার করতে পারবে? এটা যেন একটা চ্যালেঞ্জ।

এ-প্রশ্নের উত্তর পাওয়া হল না। বাইরের উঠোনে অনেক লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। রিহার্সাল ভাঙার পর দেবুদা তার দলবল নিয়ে এ-বাড়িতে চলে এসেছেন।

এ বাড়ির পরিবেশ সত্যি অনেক বদলে গেছে। রেণুদের বাড়ি রীতিমতন রক্ষণশীল ছিল, যখন-তখন বাইরের লোকেরা এসে এ বাড়িতে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারত না আগে।

দেবুদা জিজ্ঞেস করলেন, রেণু, হঠাৎ তুমি চলে এলে যে?

আমি লক্ষ করলাম, দেবুদাকে রেণু বেশ সমীহ করে। কয়েক মাস আগেও দেখেছি, রেণু বাইরের লোকজনের সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলতে পারত না। সবাই ওকে গম্ভীর বলত। এখন রেণু অনেক কথা বলে। মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি বদলে যায়!

রেণু বলল, বাঃ, আমার তো আজ হয়ে গেল। আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন। দেবুদা, বসুন।

সকলের বসবার জায়গা নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম। দেবুদা ব্যস্ত হয়ে বললেন, আপনি উঠলেন কেন, বসুন, বসুন।

রেণু আমার সঙ্গে দেবুদার আলাপ করিয়ে দিল। দেবুদা সোৎসাহে বললেন, হ্যাঁ, একটু আগে রিহার্সাল রুমে দেখলাম না? আপনাকে মশাই আমাদের খুব কাজে লাগবে। ঠিক এই রকম একটা রোগা লম্বা চেহারা আমাদের দরকার। আপনি অভিজিতের রোলটা করবেন। কী রেণু, এঁকে অভিজিতের রোলে মানাবে না?

রেণু মুচকি হেসে বলল, হ্যাঁ মানাবে।

আমি শুকনো ভাবে জানালাম, অভিনয় টভিনয় আমার আসে না।

দেবুদা বললেন, সেসব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই তো অ্যামেচার—

রেণু বলল, বাদলদা, তুমি করো না একটা পার্ট।

রেণু আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছে। আমাকে লোকজনের সামনে রাগিয়ে দিতে চাইছে। আমি চুপ করে রইলাম।

দেবুদা বললেন, আচ্ছা, আপনি অরুণের ভাই ভাস্করের বন্ধু না? অরুণের কাছে আপনার কথা শুনেছি। আপনি তো কবিতা টবিতা লিখতেন। এখন আর লেখেন না?

এর প্রত্যেকটি কথায় যেন আমার গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারা হচ্ছে। কেউ আমার কবিতা লেখার প্রসঙ্গ তুললেই অপমানে আমার গা জ্বলে যায়।

দেবুদা লোকটি বেশ হাসিখুশি স্বভাবের। আমার ব্যবহারের আড়ষ্টতা তিনি লক্ষ করলেন না। দু-এক মিনিটের মধ্যেই আবার নাটকের আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়লেন। থিয়েটারের নেশায় যাদের পেয়ে বসে, তারা এ রকমই হয়। রেণুরও বেশ উৎসাহ আছে। দেখছি।

ওদের কথা শুনে বোঝা গেল, দেবুদার সঙ্গে মল্লিকার চেনা ছিল। মল্লিকার উৎসাহেই রেণুকে নাটকের দলে যোগ দিতে হয়েছে। নাটকের অভিনয়ের ব্যাপারে যে রেণুর কোনও আগ্রহ, আগে দেখিনি। এখন খানিকটা মেতে উঠেছে মনে হয়। নিশ্চয়ই এতে রোমাঞ্চ আনে।

হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম আমি। রেণুর সঙ্গে আর একটাও কথা বলিনি। বাইরে এসেই ঠিক করে ফেললাম, রেণু যদি নাটকের অভিনয় না ছাড়ে, তা হলে রেণুর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। দেবুদা যদি পারে তো রেণুকে নিয়ে নিক। আমার চাই না। পৃথিবীতে আমার আর কিছুই দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *