2 of 3

৭৬. পার্কের মধ্যে ঘাপটি মেরে

৭৬

পার্কের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল লোকটা। পার্কের গায়েই বাস স্টপ। বেলা ন’টায় যখন আপা এসে বাস স্টপে দাঁড়াল তখন লোকটা তাকে ডাকল।

আপা, শোনো। জরুরি কথা আছে।

লোকটা মধ্যপ্রদেশের। নাম যশবীর সিং। ট্রান্সপোর্টের বিশাল চেন আছে। প্রচুর পয়সা। বিদেশি পারফিউম মাখে, দারুণ পোশাক পরে। মুখখানা একটু কর্কশ ধরনের হলেও ফর্সা, সুন্দর, লম্বা চেহারা। সন্ধের দিকে একটু মদ খায় রোজ। ওর বউ বিমলার সঙ্গে খুব ভাব ছিল আপার। সেই ভাবসাব যশবীর ইদানীং পছন্দ করছে না। বিমলা মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছে।

আপা ঘড়ি দেখল। হাতে বিশেষ সময় নেই। স্কুল শুরু হবে সাড়ে ন’টায়। তবু সব মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের যে নীতি সে অনুসরণ করে সেটাকে ভাঙল না। পার্কের ভাঙা গেট দিয়ে ঢুকে সামনে দাঁড়িয়ে বাংলায় বলল, বলুন।

যশবীর ভালই বাংলা বলে। আপা যশবীরের মুখ দেখে বুঝতে পারল, লোকটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। পরনে চমৎকার পোশাক, গা থেকে সুগন্ধ আসছে, দাড়ি পরিপাটি কামানো, গোঁফে কেয়ারি, সবই ঠিক আছে। তবু লোকটার চোখে একটা বিভ্রান্তি আছে। যশবীরের মুখে একটু হাসিও আছে, আপার সেটাও পছন্দ হল না। তাদের পাশের বাড়িতেই যশবীর থাকে, অনেক দিনের চেনা। আবার তেমন চেনাই বা বলা যায় কি করে? লোকটা উদয়াস্ত খাটে, সারা ভারতবর্ষে দৌড়ে বেড়ায় আর দু’হাতে টাকা রোজগার করে। টাকাই ওর নেশা। এ ধরনের রোবটকে চেনা মুশকিল হয় আপার পক্ষে। মনুষ্যত্বের শতকরা ভাগ কার মধ্যে কতটা আপা সেটা সবসময়েই নিজের মেধা ও বোধ দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করে। সেই হিসেবে এই লোকটাকে তার বোঝবার কথা নয়।

যশবীর প্রথমেই একটা অদ্ভুত কথা বলল, তুমি বাংলা বলো কেন? বাংলা কি তোমার মাদার ল্যাংগুয়েজ?

একটু অবাক হয়ে আপা বলল, ভারতবর্ষের যে কোনও ভাষাই আমার মাদার ল্যাংগুয়েজ, যদিও আমি সব ভাষা জানি না।

বাট ইউ সাউথ ইন্ডিয়ানস্‌ আর অ্যান্টি-হিন্দি।

আপা বুঝল না লোকটা তার সঙ্গে খামোখা ঝগড়া করতে চাইছে কি না। সে ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, আমার তো বেশি সময় নেই হাতে। কিছু বলবেন?

ইউ ক্যান স্পিক ইংলিশ।

আপা মাথা নেড়ে বলে, ইংরেজদের সঙ্গে ছাড়া আমি ইংরিজি বলতে ভালবাসি না।

হোয়াই নট হিন্দি?

আমি হিন্দি জানি না।

ইউ হেট হিন্দি।

না। কিন্তু আপনি কী বলতে চাইছেন?

রিগার্ডিং মাই ফ্যামিলি লাইফ।

ওঃ। কিন্তু এখন তো আমার সময় নেই।

স্পেয়ার মি ফাইভ মিনিটস্‌। কথাটা জরুরি।

বলুন না!

বিমলা ইজ ট্রায়িং টু ডেজার্ট মি।

আপা অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি?

বাট আই ওন্ট অ্যালাউ হার।

ওঃ। তা আমি কী করব?

যশবীরের ফর্সা মুখ আচমকা একটু লাল হল। সে একটু গরম গলায় বলে, আপা, ইউ আর বিহাইন্ড অল দিস।

আমি! আমি তো কিছু জানি না।

শী ওয়াজ এ ভেরি ওবিডিয়েন্ট অ্যান্ড সার্ভিং ওয়াইফ। তোমার সঙ্গে মিক্স করার পর শী হ্যাজ বিকাম ডিফারেন্ট। ও গড়িয়াহাটে একটা লেডিজ গ্রুপের মেম্বার হয়েছে। তুমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলে। শী হ্যাজ কনফেসড।

গলাটা বেশ চড়ে যাচ্ছিল যশবীরের।

আপা ঠাণ্ডা গলাতেই বলল, বিমলা ভাল মেয়ে। একটু একা। আপনি ওকে বুঝবার চেষ্টা করেন কেন? ওকে আর একটু সঙ্গ দিন।

আই অ্যাম নট গোয়িং টু টেক অ্যাডভাইস ফ্রম ইউ।

আপা ফের বিনীতভাবেই বলল, আপনি বিমলার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। ওকে মারেন, পা টেপান, রাগ হলে জিনিসপত্র ভাঙেন। বিমলা আপনাকে ভয় পায়।

বিমলা আর আমার ব্যাপারটা আমাদের পারসোনাল। তুমি কেন এর মধ্যে আসছ? তুমি কে?

বিমলা আমার বন্ধু।

শী ইজ ওল্ডার দ্যান ইউ। তুমি ওকে উইমেন্স লিব শেখাচ্ছ? জানো তার কনসিকোয়েন্স কী হতে পারে? আই শ্যাল কিক হার আউট অব দি হাউস। তারপর কি তুমি ওকে খাওয়াবে?

আপনি চিৎকার করছেন কেন? ভিড় জমাতে চান?

ভিড় না হলেও চেঁচামেচি শুনে রাস্তা থেকে কয়েকজন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে।

কিন্তু যশবীর ক্রমশ রেগে যাচ্ছে। গলা আরও এক পা ওপরে তুলে বলে, আলবাৎ চেঁচাবো। বিমলা ওয়াজ এ গুড গার্ল। তুমি ওকে স্পয়েল করছ। ইন ফ্যাক্ট, শী হ্যাড এ কোয়ারল উইথ মি দিস মর্নিং। বিমলার কখনও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস ছিল না। ওকে কে সাহস দিচ্ছে? হু? ইউ আর দি কালপ্রিট।

লোকটার রাগ দেখে আপার মায়া হল। এই সেই আবহমানকালের পুরুষ যে স্ত্রীর কাছে কেবলই আশা করে বশ্যতা, মুগ্ধতা, নতশির দাসত্ব, প্রত্যুত্তরহীন অপমানের পাত্রী। এই সেই পুরুষ যারা গুহামানবের উত্তরাধিকার এখনও রক্তে বহন করে। যারা শয্যাসঙ্গিনী ছাড়া স্ত্রীকে আর কিছুই ভাবতে পারে না। এদের চাই একটি সুন্দরী জ্যান্ত রক্তমাংসের পুতুল।

আপা বলল, এসব কথা রাস্তায় না বললেই আপনার চলত না? আপনি তো আমাকে আমাদের বাড়িতে গিয়েই বলতে পারতেন বা আমিও যেতে পারতাম আপনাদের বাড়িতে।

নেভার! তুমি কখনও আমার বাড়িতে আসবে না। আই শ্যাল কিক ইউ আউট।

আপার হঠাৎ কেমন খটকা লাগল। লোকটা স্বাভাবিক নেই। লোকটা পাগলের মতো ব্যবহার করছে। এরকম করছে কেন?

আপা শান্ত গলায় বলল, আপনার কী হয়েছে বলুন তো? আপনি তো পাগল হয়ে গেছেন দেখছি!

এ কথায় যশবীর লাফিয়ে উঠে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, পাগল হয়ে গেছি! তুমি জানো বিমলাকে আমি কত ভালবাসতাম! অ্যান্ড আই হ্যাভ লস্ট হার ফর এভার! ফর এভার!

ফর এভার শুনে আপার মাথা একটা চক্কর দিল। যশবীর কি বিমলাকে খুন-টুন কিছু করে এসেছে? তারপর প্রলাপ বকছে?

যশবীর চেঁচাচ্ছিল, ইফ শী কমিটস্‌ সুইসাইড ইউ উইল বি রেসপনসিবল। ইফ শী ডাইজ ইউ উইল বি দি কজ।

আপা হঠাৎ ‘হায় ভগবান’ বলে ঘুরে ছুট দিল। রাস্তাটা হরিণের মতো চকিতে পেরিয়ে সে গিয়ে ঢুকল পাশের বাড়িতে। ডোরবেল বাজাতে বাজাতে ডাকতে লাগল, বিমলা! বিমলা!

বিমলা জবাব দিল না। দরজাও খুলল না।

আপা জানালার কাছে গিয়ে দেখল, কাচের শার্শি বন্ধ, পর্দা টানা।

হঠাৎ যশবীর হাঁফাতে হাঁফাতে এসে কর্কশ হাতে একটা ধাক্কা দিল আপাকে, হোয়াট ডু ইয়া ওয়ান্ট? হোয়াট ডু ইয়া ওয়ান্ট? গেট আউট ফ্রম হিয়ার।

ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিল আপা। রোগা কনুইটা ঠকাস করে ঠুকে গিয়েছিল শানে। পড়ে-থাকা অবস্থাতেই বলল, আপনি বিমলাকে কী করেছেন? ও দরজা খুলছে না কেন?

শী হ্যাজ লেফট। নাউ ইউ গেট আউট।

আপা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। বিমলা ঘরে আছে।

যশবীর ধমকে ওঠে, ইউ বিচ! ইউ রেচেড গার্ল! গেট আউট! গেট আউট!

আপার চোখে জল আসছিল। বিমলা একটি ভারি সরল সোজা নরম প্রকতির মেয়ে। একটু অন্যমনস্ক ধরনের। কিন্তু হাসিখুশি, প্রাণময়। প্রায়ই আসত তাদের বাড়িতে। আপাও যেত। বিমলার সারা দিন সময় কাটে না। স্বামী বাড়ি না থাকলে সে শুধু ঘর গোছায়, টিভি দেখে আর টুকটাক মার্কেটিং করে। যশবীরের মা-বাবা থাকে ইউ পি-তে। মাঝে মাঝে তারা এসে থেকে যায় কয়েক মাস। তখন বিমলার খুব কাজ বেড়ে যায়। অবশ্য বিমলাদের কাজের লোক আছে। একজন রান্না করে, একজন ঠিকে ঝি অন্য কাজ করে দিয়ে যায়। সুখী পরিবার বলেই মনে হয় বাইরে থেকে। কিন্তু বছরখানেক আগে বিমলা এসে একদিন অনেক কথা বলল আপাকে। নিঃসঙ্গতার কথা, স্বামীর অন্যান্য মেয়ে-বন্ধুর কথা, একঘেয়ে জীবনের কথা, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে অবনিবনার কথা। সব মেয়েদেরই অভিযোগ মোটামুটি একইরকম। বিমলারও আলাদা কিছু নয়। কথা হল, বিয়েতে বিমলার বাবাকে দু’ লক্ষ টাকা নগদ বরপণ দিতে হয়েছিল।

ভালবাসা কি কেনা যায় আপা? যদি যায় তাহলে আমি দু’ লাখ টাকার ভালবাসা কিনেছি।

খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপা জানে কোনও কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে এর চেয়েও অনেক বেশি পণ নেওয়া হয়। কিন্তু ছেলেমানুষ বিমলা স্বামীর কাছ থেকে একটু ভালবাসা চাইত। যশবীর অবশ্য কৃপণ নয়। বউকে বিস্তর প্রেজেন্টেশন দিয়েছে। ভালবাসা দিয়েছে কি না কে জানে!

বিমলাকে একটু চার-চৌখোস বানানোর জন্যই আপা তাকে মাঝে-মধ্যে একটু মেয়েদের অধিকার, তাদের সত্তা, তাদের ভবিষ্যতের কথা শোনাত। বিমলা বলত, তুমি ঠিক বাঙালি মেয়েদের মতো কথা বলো! বাঙালী মেয়েরা কত ভাল আছে দেখ। আমাদের মতো মাথা নিচু করে থাকতে হয় না। অনেক স্বাধীন।

আপা বলেছে, তুমি তাহলে বাঙালিদের সঙ্গে আরও একটু মেশো। ভাল হবে।

লেডিজ গ্রুপটায় আপাই নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেয় বিমলাকে। তারপর কি বিমলার খুব কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল? যতদূর আপা জানে, না। তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। রক্তের গভীর সংস্কার আর অভ্যাস কি সহজে পাল্টায়?

আপা যশবীরের দিকে চেয়ে বলল, আপনি খুব বীরপুরুষ, না? আমি পুলিশের কাছে যাচ্ছি।

গো টু হেল।

আপা শেষ অবধি পুলিশের কাছে যায়নি। কারণ, বিমলাকে খুন করা হয়েছে এমন কোনও কথা হুট করে পুলিশকে গিয়ে বলাটা ঠিক হবে না। হয়তো বিমলাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কে জানে? সে স্কুলে দেরিতে পৌঁছলো, টিচারের বকুনি খেল এবং তারপর টিফিনের সময় বন্ধুদের জড়ো করে ঘটনাটা সবিস্তারে শোনাল।

পারগত বলল, হোয়াইল দেয়ার ইজ আপা, দেয়ার অলওয়েজ ইজ ট্রাবল। আপা অ্যাট্রাক্টস্ ট্রাবল।

বুবকা একটু গরম হয়ে বলল, উই হ্যাভ টু পাই অন দি ম্যান। আপা, তুমি ওর ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি জোগাড় করতে পারবে?

পারব।

পরমা বলে উঠল, আরে লক তো পিক করাই যায়। আমরা সবাই মিলে আজ সন্ধেবেলাতেই যাই চলো। লোকটাকে চেপে ধরি।

আপা মাথা নেড়ে বলে, না, সেটা বুদ্ধির কাজ হবে না। আমি আজ নজর রাখব। যশবীরের বাড়িতে টেলিফোন আছে। টেলিফোনেও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, লোকটা পালিয়ে যাবে। মাথার ঠিক নেই এখন।

রাজেশ বলে, খুন করলেও বডি যে ঘরে আছে তার তো মানে নেই। যদি গাড়ি থাকে তো বডি নিয়ে গিয়ে ধাপা বা গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসতে পারে।

আপা বলল, ওদের গাড়ি আছে। কন্টেসা।

রাজেশ বলে, তাহলে? উই হ্যাভ টু অ্যালার্ট দি অথরিটি।

বুবকা একটু হেসে বলল, পুলিশের দরকার কী? আপার তো গুণ্ডার দল আছে। বলল আপা, এসব ঝামেলা মেটানোর জন্যই না তুমি গুণ্ডার দল খুলতে চেয়েছিলে?

আপা মৃদু হেসে বলল, তাহলে তুমিও তো মানো যে কেন একটা গুণ্ডার দল খোলা দরকার?

কিন্তু তোমার গুণ্ডারা তো অহিংসা গুণ্ডা। অহিংসা দিয়ে কি যশবীরের মতো লোককে ঢিট করা যাবে?

অঞ্জলি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বেজার মুখে বলল, আপাটার সব কিছুতেই বেশি বেশি। তুই পুলিশে জানিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাক না। অত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন?

আপা আস্তে করে বলল, মাথা থাকলে একটু ঘামাতেও হয়। বিমলা আমার বন্ধু ছিল।

অঞ্জলি একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, বন্ধু ছিল তো ছিল। তুই আবার ওকে উইমেনস লিভ দেখাতে গেলি কেন? সেইজন্যই তো এসব হল। সাধে কি বলি আপাটার বড্ড বাড় বেড়েছে!

পারগত বাধা দিয়ে বলে, আরে বাবা, এসব না হলে লাইফটার কোনও ইন্টারেস্ট থাকত আমাদের? আপা, নাউ ইউ সে হোয়াট উই শুড ডু। আমি বলি কি আমরা কয়েকজন এখন তোমার সঙ্গে যাই। বাড়িটা ওয়াচ করি। ইফ যশবীর ইজ দেয়ার তাহলে তাকেও একটু দেখে রাখি।

না, সন্দেহ করবে।

করুক না, কী আছে?

সন্দেহ করলে ও সাবধান হয়ে যাবে।

পারগত হেসে বলল, দূর বোকা! সন্দেহ করলে ও একটু ঘাবড়েও যাবে। ঘাবড়ে গেলে ব্লান্ডার করবে।

আপার মনটা খুব খারাপ। বিমলা কি সত্যিই খুন হল? হয়ে থাকলে খুব খারাপ ব্যাপার। সে পারগতের দিকে চেয়ে বলল, আজ আমি একাই ওকে ওয়াচ করি। কাল তোমরা যেও।

বুবকা সামান্য রেগে গিয়ে বলে, আপা, সব ব্যাপারেই তুমি একা এগিয়ে যেতে চাও কেন? ড্রাগ পেডলারদের সঙ্গে যখন লেগেছিল তখনও তুমি একা গিয়েছিলে। ফলে মার খেতে হয়েছিল, মনে আছে?

বাংলায় একটা কথা আছে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।

পারগত বলে, আরে বাবা, ওসব কথা ছাড়া। আমি বলি, যশবীর ইজ নাউ এ উন্ডেড টাইগার। তোমার যা স্বভাব হয়তো একাই ওকে ফেস করতে যাবে। তাহলেই বিপদ।

আপা একটু ভাবল। তারপর বলল, আমি তাতে ভয় পাই না। কিন্তু লোকটাকে ধরা দরকার। আমি আজ তেমন কিছু করব না। শুধু লক্ষ রাখব। দরকার হলে কাল তোমরা যেও। বিপদের ভয় নেই। আমি আজ বাবা আর মাকেও বলব।

তাই হল। স্কুলের পর আপার বন্ধুরা একটু উদ্বেগ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

আপা বাস থেকে নেমে নিজেদের বাড়িতে ঢোকার আগে যশবীরের ঘরখানা আবার ভাল করে দেখল। ঘর অন্ধকার, তালা বন্ধ। কেউ নেই। আপা কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে জল আসছিল তার। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে ডানদিকে তাকাল আপা। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে আসছে। ওপরে বাড়িওলা থাকেন একা। বুড়ো মানুষ। নিচের তলার ভাড়াটে হল যশবীর।

চোখের জলের ভিতর দিয়েও আপা বাড়িওলাকে দেখতে পেল। চেনা মানুষ।

এই যে আপা, কেমন আছ?

আপা হাসল, ভাল।

বিমলার কাছে এসেছ নাকি? ওরা কি বাড়ি আছে?

আপা একটু আকুল হয়ে বলল, কাকাবাবু, আপনাকে একটা জরুরি কথা জানানো দরকার। বিমলার কিছু একটা হয়েছে।

বুড়ো মানুষটি ভয় পেয়ে গেলেন। উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে?

ঠিক বুঝতে পারছি না। আজ যশবীরের ভাবসাব দেখে কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছে।

কী সন্দেহ বলো তো?

ওদের মধ্যে কি কাল বা আজ ঝগড়া হয়েছে কাকাবাবু?

ঝগড়া! সে তো কিছুদিন যাবৎ রোজই হয়। হ্যাঁ, কাল রাতেও তো কথা কাটাকাটি হচ্ছিল।

আর কিছু শুনতে পাননি!

বাড়িওলার মুখ শুকিয়ে গেল। বললেন, কিছু মনে তো পড়ছে না। কী ব্যাপার একটু খুলে বলবে?

আমিও যে জানি না। শুধু ভয় হচ্ছে। আপনার কাছে কি এই ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি আছে কাকাবাবু? ফ্ল্যাটটা একবার দেখা দরকার।

বাড়িওলা একটু চিন্তিত মুখে বললেন, কাজটা কি ঠিক হবে আপা? ট্রেসপাসিং।

কাকাবাবু, আমার যে জানা দরকার। বিমলার যদি কিছু হয়ে থাকে তবে ঢুকে দেখলে দোষ নেই। আমি আজ সকালে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যশবীর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।

বলো কি? আচ্ছা তুমি দাঁড়াও। চাবি আনছি।

আপা নিচে দাঁড়িয়ে রইল। বাড়িওলা চাবি আনতে অনেক সময় নিচ্ছিলেন। আপা ধৈর্য হারাচ্ছে।

চটিজুতোর শব্দটা শোনা গেল যেন এক যুগ পর।

এই নাও চাবি। কিন্তু সাবধান!

আপা দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকল। সন্ধের অন্ধকার হয়ে এসেছে। সে বাতি জ্বালল। প্রথম ঘরটা লিভিং কাম ডাইনিং। দারুণ সাজানো। টিভি, ভি সি আর, ফ্রিজ সব এই ঘরে। আপা পরের ঘরটায় উঁকি দিল। স্পেয়ার বেডরুম। ওপাশে আর একটা বেডরুম। তার দরজাটা বন্ধ। আপা দরজায় একটা টোকা দিল। তারপর হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে বাতি জ্বালতেই বিমলাকে দেখতে পেল। দেয়ালের গা ঘেঁষে কার্পেটে পড়ে আছে বিমলা। হাত পা পিছমোড়া করে বাঁধা। মুখে একটা চওড়া লিউকোপ্লাস্ট আটকানো।

একটা শ্বাস ফেলল আপা। নিশ্চিন্তের খাস। হাত পা যখন বাঁধা তখন হয়তো খুন হয়নি এখনও।

কিন্তু দেখা গেল, খুনের খুব কাছাকাছিই ঘটে আছে। অভুক্ত, দুর্বল, ক্লান্ত, মার-খাওয়া বিমলা অজ্ঞান হয়ে গেছে। হয়তো অনেকক্ষণ। হাত পা সাদা হয়ে গেছে রক্ত চলাচলের অভাবে। শ্বাস চলছে ধীরে।

আপা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে একটু ছুরি এনে বাঁধন কাটল। লিউকোপ্লাস্টটা বড্ড সেঁটে বসে গিয়েছিল। খুলতে কষ্ট হল আপার।

কাকাবাবু! একটু আসুন।

বাড়িওলা এলেন। নার্ভাস, ভীত।

এসব কী আপা?

দেখুন কী অবস্থা করে রেখে গেছে। মরেই যেত।

লোকটা তো খুব অমানুষ দেখছি!

আপনি, একজন ডাক্তার ডাকবেন কাকাবাবু? বিমলার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি না।

পুলিশেও কি খবর দেওয়া দরকার আপা?

না কাকাবাবু, পুলিশ ডেকে লাভ নেই। মেয়েদের কেউ বুঝবে না। ডাক্তারই ডাকুন।

চোখে-মুখে জল দেওয়ার পরই অবশ্য বিমলা চোখ খুলল। অনেকক্ষণ সেই চোখ রইল শূন্য, ভাষাহীন। এত দুর্বল যে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না বিমলা।

ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে গ্যাস জ্বেলে গরম করে এনে তাকে একটু খাওয়াল আপা।

অনেকক্ষণ বাদে বিমলা বলতে পারল, আপা, আমি তো মরবই। কেন কষ্ট করছ?

না, মরবে না। মরলে লড়বে কে? উঠতে পারবে?

পারব।

তাহলে আমাদের বাড়ি চলো। এ বাড়ি তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়।

কেন কষ্ট করবে আপা? ছেড়ে দাও।

না। চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *