2 of 3

৭৬. ধ্রুব রঙ্গময়ির দিকে চেয়ে

॥ ৭৬ ॥

ধ্রুব রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে তার আঁকিবুকিওলা মুখে সেই নব যুবতীকে দেখবার চেষ্টা করছিল, যাকে দেখে মজে গিয়েছিল তার দাদু। সারা জীবন যথার্থ সংযম ও ঘটনাশূন্য কাটিয়ে বুড়ো বয়সে তিনি ওঁর প্রেমে মগ্ন হন। ধ্রুব প্রেম ব্যাপারটা আজও জানে না। সে কি খুব একটা ভসভসে আবেগ? এককেন্দ্রিক কাম? না ব্যাখ্যার অতীত আর কিছু? যে বয়সে তার দাদু প্রেমে পড়েছিলেন সেটা এ আমলের পক্ষে খুব বেশী বয়স নয়। প্রেমে পড়া চলে তো বটেই, হচ্ছেও আকছার। কিন্তু সেই আমলের পক্ষে সেটা স্বাভাবিক ছিল না। হেমকান্তের মতো সংযত পুরুষের তো আরো নয়।

রঙ্গময়ীর মুখচোখে বেশ একটু সত্যিকারের খুশি ছড়িয়ে আছে। ধ্রুবর ছেলে হওয়া যেন তাঁরও কিছু হওয়া। বুড়ো বয়সের এক ধরনের স্থায়ী ধরা গলায় রঙ্গময়ী বললেন, দেখছিস কি অমন হাঁ করে? রূপ নাকি?

ধ্রুব একটু হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই তাই ঠাকুমা। আমি তোমার রূপ দেখছিলাম।

ও বাবা, আমি কিন্তু বয়সকালেও সুন্দরী ছিলাম না। তোর ঠাকুমার কাছে দাঁড় করালে তো বাঁদরী বলে মনে হত। আর তোর বউটাও ভারী ভাল দেখতে। তা তোদের এত রূপের বংশ, তুই আমার বুড়ো মুখের রূপ দেখছিস কি রে?

আমি দেখি বা না দেখি, একজন তো দেখেছিল! আমি তার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।

সে আবার কে?

সে দাদু। বলো তো তুমি যদি সুন্দরীই না হবে তবে তোমাকে দেখে দাদু মজেছিল কেন?

রঙ্গময়ী তেমন প্রাণ খুলে হাসলেন না। কেমন একটু ম্লান দেখাল তাঁকে। ধরা গলায় বললেন, এই বুঝলি দাদু?

কী বুঝবো?

মজতে কি চেহারা লাগে রে! তাহলে তুই কেন মজলি না আমার অমন নাতবউ পেয়ে?

আমার কথা বাদ দাও।

কেন তোর কথা বাদ থাকবে কেন? তুই কি সৃষ্টিছাড়া কিছু? সেই দাদুরই নাতি, সেই বাপেরই ছেলে। তোর কথা বাদ থাকবে কেন? তা তোর দাদুর কথাই ধর না, অমন বউ পেয়েছিল তবু কেমন যেন গা করত না। ঢলাঢলি ছিল না। তখন তো আর আমি প্রতিবন্ধক ছিলাম না, অন্য কোনো মেয়েও এসে মন টলায়নি। তবু ওরকম হয়েছিল কেন তার?

সে সব শুনবো বলেই তো এসে বসলাম তোমার কাছে। বলো।

মজবার কোনো আইন নেই, নিয়ম নেই।

ধ্রুব মাথা নাড়ল। তারপর মুখ টিপে একটু হেসে বলল, এ কথাটা আমি মানি না। বুঝলে। সব কিছুরই একটা আইন আছে। থাকতেই হবে।

রঙ্গময়ী একটু হেসে বললেন, শোন পাগলা। মজবার একটা আইন বা নিয়ম আছে ঠিকই। কিন্তু সে সব জেনে কী করবি? তোদের বংশের পুরুষেরা কোনোকালে কাউকে দেখে মজেনি।

এই যে আমার দাদু মজেছিল, তোমার রূপে!

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলেন, সে ধাতই তোদের নয়। সারা জীবন আমি তার তাঁবেদারি করেছি, সেবা দিয়েছি। কিন্তু ভবি কি ভোলে রে পাগল! সে পাথর শেষ অবধি গলেনি।

কী যে বলো!

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বাইরে থেকে অনেক রকম শোনা যায়। লোকে রটাতেও ভালবাসে। কিন্তু যে জানে সেই শুধু জানে। যখন শুনলাম তোর সঙ্গে নাতবউয়ের মিল হয় না তখন মনে মনে হেসেছিলাম। তারই নাতি তো হবে কি করে? ওই যে কৃষ্ণ, পরের জন্য প্রাণটা দিতে পারে, বুকে কত সাহস, কত তেজ, তবু নিজের বউয়ের চোখের জল কোনোদিন ঘোচাতে পারেনি। তিন পুরুষ ধরে তোদের চিনি রে নিমকহারাম। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনি। তার দাদু দায়ে পড়ে আমাকে মেনে নিয়েছিল মাত্র।

ধ্রুব খুব শান্ত ভাবে রঙ্গময়ীর দিকে চেয়ে ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছিল সে। বংশের ধারা? বংশের ধারাই কি সে বহন করে চলেছে? এরকম তো কথা ছিল না। সে তো ধারাটা উল্টো বওয়াতে চেয়েছিল!

ঠাণ্ডা গলাতেই ধ্রুব বলে, তুমি কি বলতে চাও হেমকান্ত চৌধুরী তোমাকে কোনোদিন ভালবাসেনি?

রঙ্গময়ী হেসে বললেন, আজ যে তোর মুখে ও ছাড়া আর কথা নেই! কী হল বল তো ভাই?

বলো না! আমার জানা দরকার।

জানা দরকার কেন?

কারণ আছে।

রঙ্গময়ী হাত উল্টে বলেন, তার ছিল ওই একরকম স্বভাব। বাইরে থেকে দেখলে ঠাণ্ডা, শান্তশিষ্ট, একটু আত্মভোলা। কিন্তু ভিতরটা ছিল শুকনো খটখটে। ভালবাসতে চাইত না যে তা নয়। পারত না। যেমন কৃষ্ণ পারেনি। তুই পারিস না।

তোমার কৃষ্ণ আমার মাকে ভালবাসত না কেন জানো?

জানব না কেন? খুব জানি। তুইও তো সেই দুঃখে বাপকে দেখতে পারিস না। মা গায়ে আগুন দিয়ে মরল, সে তো দুঃখের কথা ঠিকই। কিন্তু কৃষ্ণকে দুষে লাভ কি রে ভাই? দোষ ওর স্বভাবের নয়, বংশের। তুই যে এত ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াস বলে শুনি, কেন জানিস? নাতবউকে ভালবাসতে পারিসনি বলে। যদি পারতিস তবে ঘরে এতদিন স্থিতু হয়ে যেতি।

ধ্রুব কৃত্রিম শংকার গলায় বলে, তাহলে কি হবে ঠাকুমা?

কি আর হবে! কতগুলো কপাল পুড়বে, যেমন আমার পুড়েছে।

কিন্তু শেষ অবধি তো তোমরা মিলেছিলে ঠাকুমা!

রঙ্গময়ী হাত তুলে বলেন, ও কথা থাক। বলিস না। বড় ফুর্তির জোয়ার লেগেছিল বলে ভাবিস নাকি? বউকে ভাল না বাসলে কী হয়, সে ছিল ছেলে-পাগলা। তাও সব ছেলে নয়। ওই কৃষ্ণ। তা কৃষ্ণ ছেলের মতো ছেলে ছিল বটে। যেমন চেহারা, তেমনি সাহস, তেমনি তেজ। আবার বড় সৎ, দয়ালু। ছেলে ছাড়া সে আর কিছু বুঝত না। ঠিক সেই ধাত আবার পেল কৃষ্ণ। বউ বড় কথা নয়, ছেলেই সব। তাও সব ছেলে সমান নয়। তাদের মধ্যে বিশেষ একজন।

সেই ছেলে কে ঠাকুমা?

আহা জানিস না যেন।

কে বলো।

কেন, তুই!

আমি! তোমার কৃষ্ণ আমাকে দু-চোখে দেখতে পারে না তা জানো?

জানি, খুব জানি। তোকে গালাগাল না দিয়ে নাকি জলস্পর্শ করে না।

তাহলে?

তাহলেও কিন্তু আছে রে ভাই। সে তুই বুঝবি না, বুঝতে চাসও না। এযুগের ছেলেরা বাপের ভালবাসার তোয়াক্কা করছে থোড়াই। ওসব সেকেলে মায়া ভালবাসা তারা পছন্দও করে না। স্বার্থপরতার যুগ না এটা!

আমি কি স্বার্থপর?

নোস? ওরকম বাপকে তিলে তিলে দগ্ধে মারছিস, তোর মতো স্বার্থপর আছে?

কৃষ্ণকান্ত শেষ হচ্ছে তার নিজের কর্মফলে ঠাকুমা।

তার কর্মফল তুই বিচার করবি কেন? তুই কি তার জন্ম দিয়েছিস? বিচার করতে হলে করবে আদালত, করবে দেশ, করবে ভগবান। তোর অত মাথাব্যথা কেন?

ঠাকুমা, রেগে যাচ্ছো।

রঙ্গময়ী একটু হাসলেন। বললেন, রাগ হয় রে। কৃষ্ণকে এইটুকু বেলা থেকে দেখেছি। একখানা আস্ত দেবশিশু। এতটুকু পাপ কোথাও ছোঁয়নি। কলিযুগের মানুষ বলে মনে হত না। সেই কৃষ্ণ পলিটিকস করতে গিয়ে কত কাদা মাখল। মন্ত্রী হয়েছিল বলে কত লোকের চোখ টাটিয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণর মতো অত প্রাণ দিয়ে ভালবাসুক তো কেউ দেশকে! সেই ছেলেটা যখন এই বুড়ো বয়সে আমার কাছে এসে হাউহাউ করে কাঁদে তখন তোদের ওপর আমার রাগ হলে কি দোষ? তোরা কে তাকে কতদিন একটু সুখ একটু শান্তি দিয়েছিস?

কাঁদে? ধ্রুব ভীষণ অবাক হয়ে বলে।

কাঁদবে না কেন? পাথর তো নয়? তবে সব চোখের জল জমা করে রেখে দেয়। আর কারো কাছে কাঁদে না। আমার কাছে এসে কাঁদে।

রঙ্গময়ীর চোখে একটু জল এল। মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর একটু সময়ের ফাঁক দিয়ে বললেন, আর কার কাছেই বা যাবে! কৃষ্ণর তো যাওয়ার জায়গা নেই।

এসব কথা শুনে যে ধ্রুবর বাপের ওপর স্নেহ উথলে উঠল মোটেই তা নয়। তবে সে কোনো কথাও বলল না। চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ “আসি” বলে উঠে চলে এল।

সন্ধের অনেক পর সে ধারার ফ্ল্যাটে পৌঁছোলো।

ধারা কিছু করছিল না আজ। রেকর্ড চেনজারে একগাদা রেকর্ড চাপিয়ে বসে নিজের চুল এলোমেলো করছিল শুধু। ঠিক করেছিল আজ রান্নার ঝামেলা করবে না। শুধু ডিম ভেজে খেয়ে শুয়ে থাকবে।

এমন সময় ধ্রুব এল।

ধারা ভারী উদ্বেগের মুখ নিয়ে তাকিয়ে ধ্রুবর মুখে কী খুঁজল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার বউ কেমন আছে?

ভাল।

বাচ্চা?

ভাল।

বাব্বাঃ, বাঁচলাম। কাল থেকে যা ভাবছিলাম।

ধ্রুব আচমকাই ধারার দু কাঁধ শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, কী ভাবছিলে?

রেমি বাঁচবে কি না! ও বাবা, তুমি অমন খুনীর মতো তাকাচ্ছো কেন?

ধ্রুব হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে কী যেন একটা কিন্তু ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। তারপর বলে, কিছু খাওয়াবে? আই অ্যাম হাংরি।।

কী খাবে?

লাইট কিছু নেই?

থাকবে না কেন! সব আছে। কিন্তু তুমি কী খেতে চাও বলবে তো। ডিম ভেজে দিই।

ধ্রুব বিরক্ত স্বরে বলে, হোপলেস। যেখানেই যাবো একটা করে ডিম ভাজার অফার। ওই বোগাস পোলট্রির ডিমগুলো তোমরা খাও কি করে বলো তো! আর কী অফার করতে পারো?

ধারা লজ্জিত ভাবে হেসে বলে, পাঁউরুটি আছে। মাখন দিয়ে দেবো?

দূর!

তাহলে? চীজ খাবে একটু?

ধ্রুব মাথা নাড়ল, না। বরং একটু চা করো।

শুধু চা?

ওতেই হবে। আর বি কুইক।

ধারা চলে গেলে ধ্রুব মুখে একটা ভ্রূকুটি মেখে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কপালে হাত বোলায়। মাথাটা ধরে আছে। খুব ধরে আছে। অনেকদিন সে কলকাতার বাইরে যায় না। বড্ড রদ্ধ লাগছে এখানকার বাতাস। কিন্তু সারা ভারতবর্ষেই সে একটা পুরোনো বদ্ধ বাতাসের গন্ধ পায়। দেশ কি তার জানালা দরজা এঁটে বন্ধ করে রেখেছে! কিছু বইছে না তো! ধ্রুব উঠল। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ধারা, আমার জন্য ভাত রাঁধবে?

ভাত! ওমা, খেলে করে দেবো।

ভাত খাওয়ার পর যদি আমি শুতে চাই।

ধারা মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে, শোবে।

ধ্রুব মাথা নেড়ে আবার ফিরে আসে বৈঠকখানায়। একটা কিছু করার জন্য তার হাত পা নিসপিস করছে। একটা কিছু ভাঙতে হবে। দান উল্টে দিতে হবে। ওলটপালট। ওলটপালট।

ধারার ঘরে একটা ছোট্টো বেতের চেয়ারে পা মুড়ে বসা তার অভ্যাস। আজও সেইভাবে বসে ধ্রুব জানালা দিয়ে চেয়ে আছে। কিছু দেখছে না। বাইরে কিছু আলো, কিছু অন্ধকার। দেখবার মতো দৃশ্য কিছু নেই। চেয়ে থেকে সে অন্য কথা ভাবছিল। ভাবছিল এসবের কোনো মানেই হয় না। এই যে এত সব বাড়ি-ঘর, সোফাসেট, গাড়ি-ঘোড়া, নর-নারী।

ধারা চা নিয়ে ঘরে এসে বলে, তোমার ভাত রাঁধছি কিন্তু।

রাঁধো। কিন্তু প্লীজ জিজ্ঞেস কোরো না সঙ্গে আর কি রাঁধবো।

করব না। সারপ্রাইজ থাক।

শুধু বলে রাখি আমি শুটকি মাছ, ডাঁটা আর শাক চচ্চড়ি খাই না।

নেইও।

বাঁচা গেল।

চায়ে চুমুক দিয়ে একটু চোখ বুজে থাকে ধ্রুব।

উল্টো দিকের চেয়ারে বসে চায়ের কাপের কিনারার ওপর দিয়ে নিবিড় চোখে ধারা দেখছিল ধ্রুবকে। সে বুঝতে পারছে না, ও আজ কী চাইছে। থাকবে! সত্যিই থাকবে? যদি থাকেও তাহলেও প্রেমিকের মতো যে আচরণ করবে না তা ধারা জানে। ওর মুখে একটা অত্যন্ত উচাটন ভাব। শরীরে অস্থিরতা।

তোমার কী হয়েছে বলো তো!

ধ্রুব চায়ে আর একবার চুমুক দিয়ে বলে, মনটা ভাল নেই।

কেন ভাল নেই! আবার সেই হিউম্যান রিলেশন নিয়ে ভাবছো নাকি?

ধ্রুব ঠাট্টা বুঝে হাসল। তারপর বলল, ভাবলে কি দোষ?

যার খাওয়া পরার চিন্তা নেই, হৃদয়ঘটিত প্রবলেম নেই, একমাত্র সে-ই ওইসব ফিলজফিক্যাল ব্যাপার নিয়ে ভাবতে পারে।

ধ্রুব তীক্ষ্ণ চোখে ধারার দিকে চেয়ে বলল, হিউম্যান রিলেশনটাই যে সবচেয়ে বড় প্রবলেম সেটা অন্তত তোমার বোঝা উচিত। মানুষ এখন সবচেয়ে বেশী কথা বলে। অথচ যত দিন যাচ্ছে ততই মনে হচ্ছে এত কথা বলেও আমরা পরস্পরের সঙ্গে কিছুতেই যেন কমিউনিকেট করতে পারছি না। একটা শূন্য বলয় গড়ে উঠছে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, বাপের সঙ্গে ছেলের, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, এমন কি প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার, টের পাও না?

ওসব তোমার মনগড়া ব্যাপার। মোটেই এরকম হচ্ছে না।

ভাল করে অবজার্ভ কোরো, টের পাবে। আসল প্রবলেম হল মানুষের আজ আর কমিউনিকেট করার কিছুই নেই। সে হৃদয়ের চর্চা ছেড়ে দিয়েছে, আদর্শবাদ বলে কিছুই অধিকাংশ মানুষের নেই, অভ্যন্তরে ভালবাসার পুকুর শুকিয়ে গেছে, আবেগ ফুরিয়েছে, আন্তরিকতাও সে অনুভব করে না। কাজেই সে কমিউনিকেট করবেই বা কী?

বাঃ, আজ যে একদম উল্টো কথা বলছো!

বলছি নাকি?

বলছো না? তুমিই তো ওসব হৃদয়চর্চার সব চেয়ে বড় শত্রু ছিলে। লিভিং টুগেদার, প্রেমহীন সহবাস, কনট্রাক্ট ম্যারেজ এসব কত কী বুঝিয়েছে আমাকে।

ধ্রুব একটু লজ্জিত হয়ে বলে, ও ব্যাপারগুলো অবান্তর ঠিকই, কিন্তু ওগুলোই আসলে আঠা। একটু আঠা বা চিট না থাকলে মানুষে মানুষে ঠিক মোয়াটা বাঁধে না, বুঝলে!

বুঝলাম না। তবে দয়া করে এখনই বোঝাতে বসে যেও না।

কেন বলো তো!

এখন থাক। শক্ত কথা বেশী একদিনে বুঝবার চেষ্টা না করলেই ভাল।

মেয়েরা ভারী তত্ত্ব কথা অপছন্দ করে। তাই না ধারা?

তাই। এটুকু বুঝলে যে কত ঝামেলা কমে যায়।

ধ্রুব চা শেষ করে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আসি। এনজয় উওরসেলফ।

ধারা অবাক হয়ে বলে, তার মানে? এই যে খাবে বললে! থাকবে!

বলেছি নাকি? বাট আই হ্যাভ চেনজড মাই মাইণ্ড।

ধ্রুব! প্লীজ!

না, আজ আমি এমন একজনকে চাই যে খুব নিবিষ্টভাবে আমার কথা শুনবে। বাধা দেবে না, বিরক্ত হবে না, তর্ক করবে না।

আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। বোসো, আমি সব শুনব, বাধা দেবো না, তর্কও করব না।

ধ্রুব একটু হেসে বলে, বাধা দেবে না বটে, কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হবে। মেয়েরা এমনিতেই শ্যালো হয়। তুমি আরো অগভীর।

কী বললে?

বললাম যে, অগভীর।

আমি!

কেন তোমার কি ধারণা ছিল তুমি খুব গভীর মানসিকতার মেয়ে?

ধারা থমথমে মুখ করে চেয়ে রইল। কথা বলতে পারল না।

ধ্রুব তার দিকে চেয়ে বলে, তোমার আঠা নেই ধারা। যার নেই সে এসব বুঝবে না।

ধারা মৃদু স্বরে বলল, একটা কথা বলবে? তুমি সব সময়ে আমাকে অপমান করতে চাও কেন? তুমি কি স্যাডিস্ট?

কেন, স্যাডিস্ট কি তোমার অপছন্দ? আমার তো মনে হয় তোমার দু-দুটো স্বামীর একজনও যদি স্যাডিস্ট হত তাহলে তোমাকে ডিভোর্স করতে হত না।

ধারা ঠাণ্ডা গলায় বলে, তাই নাকি? কি করে বুঝলে?

মেয়েরা অত্যাচারীদের পছন্দ করে, জানো না? আমার বউ আমাকে কেন অত ভালবাসে বলো তো! কেননা আমি ওর ওপর সবচেয়ে বেশী অত্যাচার করি! ও কোনো সময়ে আমাকে ভুলে যায় না। প্রাণপণ আমাকে জয় করার চেষ্টা করে। ক্ষতবিক্ষত হয়, কাঁদে, কপাল চাপড়ায়, তবু তপ্ত ইক্ষু চর্বণের মতো জ্বলে গাল, না যায় ত্যজন।

মেয়েদের সাইকোলজি খুব ভাল বুঝেছো তো —বাঃ!.।

তোমার মতও কি তাই নয়?

মেয়েরা অত্যাচারীদের ঘেন্না করে।

ধ্রুব একটু হেসে বলল, তাই নাকি?

তোমার বউ যে তোমাকে ঘেন্না করে তা তুমি টের পাও না। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে একদিন কথা বলেই সেটা টের পেয়েছি।

রেগে যাচ্ছো ধারা?

মোটেই নয়। আমি কখনো রাগি না।

রেগো না। রাগলে তোমার চেহারাটা পাল্টে যায়।

আমার চেহারা নিয়ে তোমাকে অত ভাবতে হবে না।

চেহারা ছাড়া তোমার আর কী আছে ধারা? বলতে বলতে ধ্রুব একটু এগিয়ে যায়। আলতো ভাবে ধারার দু গালে দুটো করতল চেপে ধরে। মুখখানা তুলে খুব নিবিষ্টভাবে চোখের দিকে তাকায়।

ধারার ভিতর ঠাণ্ডা রাগটা সেই স্পর্শে মরে গেল। রক্তে লাগল এসে উত্তাপ। ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে বলল, কেন মাঝে মাঝে ওরকম হয়ে যাও তুমি! কেন ওরকম অদ্ভুত লাগে তোমাকে!

আমি স্যাডিস্ট ধারা। তোমাকে এখন আমার খুন করতে ইচ্ছে করছে।

করো না খুন। করো!

করব?

ধারা হাসল, করো। তবু তোমার মুরোদ দেখে যাই। আর তো কিছু পারোনি। ভীতু কোথাকার।

কিন্তু খুনটা পারি ধারা। আমার শরীরে খুনীর রক্ত আছে।

তাই নাকি?

আমার বাবা খুনী। অবশ্য স্বদেশী খুনী। বাট হি ইজ এ ডাউনরাইট মাডারার অলরাইট। আমাকে তোমার ভয় পাওয়া উচিত।

পাচ্ছি না।

ধ্রুবর হাত দুটো ধারার গলায় নেমে আসে। দশটা আঙুল বাঁকা হয়ে ধীরে ধীরে চেপে বসতে থাকে তার নরম গলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *