2 of 2

৭৬. কলকাতায় ফিরেই শুনলাম

কলকাতায় ফিরেই শুনলাম, পাড়ার কয়েকটি ছেলে কয়েক দিন ধরে বার বার আমার খোঁজ করে যাচ্ছে। শুনে একটু আশ্চর্য লাগল, কারণ পাড়ার কারওর সঙ্গেই আমার এখন আর মেলামেশা নেই। একটু সন্ত্রস্ত বোধ করলুম।

পরদিন সকালেই মন্টু আর অনিমেষ এসে হাজির। খুব খাতির করে বলল, কী রে, তোর খবরটবর কী? আমাদের একেবারেই ভুলে গেলি?

কয়েক দিন আগে পর্যন্ত ওরা আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে কথা বলত না। হঠাৎ ওদের এ রকম বাড়িতে চলে আসতে দেখে আমার মধ্যে একটা মেয়েলি অভিমান জাগে। ইচ্ছে হয়, আমিও কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে থাকি।

।কিন্তু বাড়িতে কেউ এলে এ রকম করা যায় না। শুকনো গলায় বলি, কী রে, তোরা হঠাৎ, কী মনে করে?

অনিমেষ বলল, এমনিই। তুই ছিলি না, আমরা মাসিমার কাছ থেকে চা খেয়ে গেছি।

মন্টু বলল, আদিনাথদা তোকে একবার ডেকেছেন। বিশেষ করে বলেছেন, আজ বা কালই দেখা করতে।

এবার আমার ঘাড় শক্ত হয়ে যায়। আমি সোজাসুজি মন্টুর চোখে চোখ রেখে বলি, আদিনাথদার সঙ্গে আমার তো কোনও দরকার নেই! আমি তো প্রতিক্রিয়াশীল!

কে তোকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেছে? আদিনাথদা কক্ষনও বলেননি।

আবার তর্ক বেধে যেতে পারত। আমি নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম, যাক, ও-সব কথা তোলার আর কোনও মানে হয় না। আমি নিজেই জানি, আমি প্রতিক্রিয়াশীল। আমি প্রেমের কবিতা লিখি।

প্রেমের কবিতা লেখা কি দোষের কিছু নাকি!

এ-যে নতুন কথা শুনছি তোদের কাছে।

অনিমেষ গম্ভীর ভাবে বলল, কাজের কথা হোক। আমাদের পার্টি থেকে ওয়াচ রাখা হচ্ছিল, তুই অন্য কোনও পার্টিতে যোগ দিস কিনা। এখন কংগ্রেস থেকে যা টাকা ছড়াচ্ছে, অনেকেই ওই দিকে ভিড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুই কোনও দিন ওদের দিকে যাসনি, তোর অনেস্টি আছে।

কোনও পার্টি ফার্টিতেই আর নেই আমি। যদি অন্য কোনও বিষয়ে কথা বলার থাকে আমি বলতে পারি।

মন্টু উঠে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে সস্নেহে বলল, মাথা গরম করছিস কেন? এখন দেশে যে সময় আসছে, তুই তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারবি?

আমার মুখে এসে গিয়েছিল যে, আমি আর এ-দেশেই থাকছি না। কিন্তু সেটা এক্ষুনি কারোকে জানানো ঠিক নয়। তাই বললাম, আমি একা একা বেশ আছি।

আদিনাথদা যদি নিজে তোর বাড়িতে আসেন, তুই কথা বলবি না? উনি আসতেই চাইছিলেন।

আমার মতন সামান্য একটা ছেলের কাছে উনি কেন আসবেন?

কিছুক্ষণ বাদে মন্টু আর অনিমেষ চলে গেল। আমি মচকাইনি। কিন্তু সেদিনই এগারোটার সময় যখন রাস্তায় বেরিয়েছি রেণুর কলেজে গিয়ে একবার দেখা করার জন্য, মোড়ের মাথায় আদিনাথদা অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমি এড়িয়ে যাবার সুযোগ পেলাম না। চোখাচোখি হতেই আদিনাথদা আমার দিকে এগিয়ে এলেন।

ঠোঁটে সেই রকম মোটা চুরুট, খুব সিরিয়াস ধরনের মুখ করে আমাকে প্রথমেই বললেন, বাদল, আমরা তোমার সাহায্য চাই।

আদিনাথদার মতন গণ্যমান্য নেতার মুখ থেকে সাহায্য কথাটা শুনে বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয়, আমিও তা হলে সামান্য কেউ না।

আমাকে কোনও উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই তিনি আবার বললেন, আমরা এবার একটা বড় রকমের যুদ্ধে নামছি, এখন তোমাদের মতন পুরনো ওয়াকারদের সাহায্য আমাদের বিশেষ দরকার। বিশেষ করে তোমার মতন যারা পড়াশুনো করেছে, যারা সব বোঝে–

যুদ্ধ কথাটা শুনে একটু খটকা লাগার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের এমন প্রচণ্ড ডামাডোল চলছে, তাতে বুঝতে ভুল হয় না যে, তিনি এর কথাই বলছেন।

মুখ নিচু করে বললাম, আমি আর কী সাহায্য করতে পারি বলুন। আমার নিজেরই অনেক রকম দ্বিধা আছে।

ও-সব কথা এখন ভুলে যাও। আমরা নির্বাচনে নামছি, ন্যাশনালিস্ট বুর্জোয়াদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার এই সুযোগ। পিপল আমাদের দিকে, আমরা জিতবই, শুধু দরকার ঠিক মতন অর্গানাইজ করা। এ ব্যাপারে তোমার মতন ছেলেরা অনেক সাহায্য করতে পারে!

তখন এমন একটা বয়স, যখন কারওর কাছ থেকে একটুখানি গুরুত্ব পেলেই জীবনটা সার্থক মনে হয়। কেউ যদি স্নেহের সঙ্গে বলে, তুমি আগুনে ঝাঁপ দিতে পারবে? একমাত্র তুমিই পারবে–তখন আর এক মুহূর্তের দ্বিধা থাকে না।

আদিনাথদার কথায় আবেগ ছিল। আদিনাথদার মতন নেতারা পরবর্তীকালে একেবারে পিছু হটে গেছেন, কেউ হয়েছেন অধ্যাপক বা কেউ দুর্মুখ সমালোচক, অনেকে হারিয়েই গেছেন। কিন্তু সেই সময় এই রকমই ছিল নেতৃত্বের ধরন।

আমার এই কয়েক মাসের রাগ-অভিমান সব জল হয়ে গেল, আমি আগেকার চেয়েও বেশি উৎসাহে পার্টির কাজে যোগ দিলাম।

নির্বাচনের কাজে এমনিতেই বেশ উন্মাদনা আছে। তা ছাড়া, সেবারই প্রথম সারা দেশব্যাপী উদ্যোগ হচ্ছে, রীতিনীতি জানা নেই, উৎকণ্ঠা অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের মুখের কথা শুনে মনে হয় আমরা জিতবই। দ্রব্যমূল্য অসম্ভব বাড়ছে, গ্রামে গ্রামে হাহাকার, প্রত্যেক মাসে হাজার হাজার লোক চাকরি থেকে ঘাটাই হচ্ছে, টাটা বিড়লা-ডালমিয়া ইস্পাহানিরাই চালাচ্ছে দেশটাকে, নেহরু কোনও কালোবাজারিকেই ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝোলাননি–লোকে ওদের ভোট দেবে কেন? ওরা শুধু আমাদের জনযুদ্ধের সময়কার কথা বলে আক্রমণ করছে, ওরাই সুভাষ বোসকে তাড়িয়ে এখন সুভাস বোসের নাম ভাঙাবার চেষ্টা করছে।

কয়েকটা দিন কেটে গেল ঘঘারের মধ্য দিয়ে। স্নান-খাওয়া ভুলে গিয়েছিলাম। নির্বাচনের দিন আমাকে একটা বুথের মধ্যে পাঠানো হল অধ্যাপক হীরেন মুখার্জির পোলিং এজেন্ট হিসেবে।

বুথে বুথে পুলিশ পাহারা। আমরা কয়েক জন ভেতরে একটা লম্বা বেঞ্চে বসলাম। অ্যাসেম্বলি সিটে অনেক ক্যান্ডিডেট, সকলের পোলিং এজেন্টদের বসবার জায়গা হয় না। আমার ক্যান্ডিডেট লোকসভার–আমার যেন একটু গর্ব বেশি।

আমাদের প্রত্যেকের হাতে ছাপানো ভোটার লিস্ট। লোক দেখে দেখে টিক দিতে হবে। কারোকে সন্দেহ হলে জেরা করতে পারি। ঘোরতর সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার আছে, তাতে যদিও টাকা জমা দিতে হবে। আমার কাছে অবশ্য কোনও টাকা দেওয়া হয়নি, আমাদের গরিব পার্টি, টাকা কোথায় পাবে। আমার টিফিন অ্যালাউয়েস ছ’আনা।

কংগ্রেসের পোলিং এজেন্টটির বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, দেখলেই মনে হয় পকেটে অনেক টাকা আছে। সে আমাদের দিকে তাকাচ্ছেই না।

প্রথম প্রথম খুব কম লোক এল ভোট দিতে। অনেকক্ষণ বাদে একজন-দু’জন আসে। তাও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। মনটা একটু দমে গেল। বুড়ো বুড়িরা আমাদের ভোট দেবে না, এটা ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু অন্যরা কোথায়, যাদের বাড়ি বাড়ি ক্যানভাস করতে যাবার সময় হাসিমুখে বলেছিল, নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!

ক্রমে ক্রমে ভিড় হতে লাগল। সকলেরই মুখ গম্ভীর। কার মনে যে কী আছে, বোঝবার উপায় নেই। আমার দিকে কেউ চোখে চোখ ফেলেও তাকায় না।

কাকে কী জিজ্ঞাসা করব? দু-এক জনের নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করি, ঠিক ঠিক মিলে যায়, আমার আর কিছু বলার থাকে না।

কংগ্রেসের ছেলেটি যুবক বা যুবতীদের দেখলেই নানা রকম জেরা করে। রীতিমতন ধমক দেয়। কারওর বয়সের গরমিল দেখলেই বলে, রেশন কার্ড এনে দেখাতে পারবেন?

কেউ মুখে মুখে কথা বললেই সে চ্যালেঞ্জ করে।

কংগ্রেসের ছেলেটি হঠাৎ একসময় আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা গোলমাল করলেন না?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী গোলমাল?

শুনেছিলাম, আপনারা বোমাবাজি করবেন?

তাতে তো আপনাদেরই সুবিধে হবার কথা। কারণ, আমরাই তো জিতছি।

তাই নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ—

প্রিসাইডিং অফিসার এই সময় আমাদের কাছে এসে বললেন, আপনারা প্লিজ এই ধরনের আলোচনা এখানে করবেন না।

কংগ্রেসের ছেলেটি বলল, ঠিক আছে, চা খাওয়া যাক তা হলে। আমি সকলের জন্য এক রাউন্ড বলছি।

বেয়ারা এসে দশ কাপ চা দিয়ে গেল। আমি আবার দ্বিধায় পড়ে গেলুম। কংগ্রেসের ছেলের পয়সায় কি চা খাওয়া উচিত? এ সম্পর্কে পার্টির পলিসি কী? মুসলিম লিগের ছেলেটাও খাচ্ছে অবশ্য।

চায়ের কাপ না ছুঁয়ে আমি মনোযোগ দিয়ে ভোটার লিস্টটা পড়তে লাগলুম। পাশ থেকে একজন বলল, দাদা আপনার চা যে জুড়িয়ে গেল?

আমি বললাম, আমি চা খাই না।

কংগ্রেসের ছেলেটি উঠে এসে বলল, দাদা, রাগ করলেন? একটু হাসিঠাট্টাও করা যাবে না?

আমি সত্যি চা খাই না।

আজকে অন্তত খান। আমার কথায় খান। না হলে মনে খুব দুঃখ পাব।

বেশিক্ষণ না না বলতে আমার ভালো লাগে না। সেই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা এক ঢোঁকে খেয়ে ফেললাম। ও রকম বিস্বাদ চা জীবনে খাইনি। সেই মুহূর্তে পি সি রায়ের কথাই ঠিক, চা পান না বিষ পান!

মুখ তুলেই দেখি সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেণু। আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আসলে রেণু নয়, রেণু হতেই পারে না, ওর ভোট নেই। আমারই নেই তো রেণুর থাকবে কী করে। মেয়েটির সঙ্গে রেণুর মুখের খুব মিল–আমি নির্লজ্জের মতন মেয়েটির মুখের দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম, তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলাম।

মেয়েটি আমাকে রেণুর কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল। কলকাতায় ফেরার পর রেণুর সঙ্গে এক বারও দেখা হয়নি। কয়েক দিন হইচইয়ের মধ্যে অন্য কিছুই করা যায়নি। একই শহরে আছি অথচ সাত-আট দিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়নি, এও কি সম্ভব? রেণু যদি এর মধ্যে ভুলে যায় আমাকে?

না, এসব কথা চিন্তা করা উচিত নয় আমার। আমার ওপর এখন কত দায়িত্ব। আমি পরবর্তী লোকটিকে অকারণে নানা প্রশ্ন করে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করি।

ক্যান্ডিডেটরা ঘুরে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। এর আগে দুবার মাত্র ওঁকে দেখেছি। উনি আমার কাধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

একটু পরে এলেন হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। বৃদ্ধ খুব দুঃখিত ভাবে বললেন, ওহে, তোমরা আমার পোলিং এজেন্টকে বসতে দাওনি? সে বেচারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের মধ্য থেকে একজন বলল, তাকে তো বলেছিলাম এই ধারটার বসতে। দেখছেন তো জায়গা কম!

আমার আজও মনে আছে, বৃদ্ধ হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ দু’হাত নেড়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, যদি হয় সুজন, তবে তেঁতুল পাতায় ন’জন! ইচ্ছে থাকলেই জায়গা হয়ে যায়।

আমার পোলিং বুথটা ছিল দর্জিপাড়ার এক স্কুলে। টিফিনের সময় বেরিয়ে একটা চায়ের দোকান খুঁজছি–দেখি একটু দূরেই মন্টু, অনিমেষরা দাঁড়িয়ে আছে।

ওরা এসে ব্যস্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল, কী রে, এ-দিকে আমাদের অবস্থা কী রকম?

আমি বললাম, তা তো ঠিক বুঝতে পারছি না। লোকজন চুপচাপ এসে ভোট দিয়ে। যাচ্ছে। কাকে দিচ্ছে কে জানে!

ওরা কারোকে চ্যালেঞ্জ করেছে?

সব মিলিয়ে আট-দশ জন।

শোন, এদিকে আমাদের পজিশন খুব ভালো। তোর আর ভেতরে গিয়ে দরকার নেই। বাগবাজারের দিকে খুব খারাপ অবস্থা–চল বাগবাজারে চল, অন্য কাজ আছে।

আমার মনে হল, সত্যিই আর ভেতরে বসে শুধু ভোটার লিস্টে টিক মারার কোনও মানে হয় না। আমি ওদের সঙ্গে বাগবাজার চলে এলাম।

রাস্তায় প্রচুর মানুষজন। দেখে মনে হয় সকলেই যেন শ্যামবাজার-বাগবাজারের দিকে যাচ্ছে। নির্বাচন নাকি ওই দিকেই দারুণ জমেছে। বাগবাজারের দিকে আমাদের কোনও চিন্তা থাকার কথা নয়, ও-দিকে আমাদের পার্টির ভালো ভালো ওয়ার্কার আছে, বরং যত বেশি ভোট পড়ে ততই ভালো। কিন্তু মন্টু আর অনিমেষের মুখ গম্ভীর।

বাগবাজারে এসে শুনলাম, এখানে দু-তিনটে সেন্টারে প্রচুর ফল্স ভোটিং হচ্ছে। কংগ্রেস থেকে লরি-ভরতি করে নিয়ে আসছে তোক বাইরে থেকে, তারা হুড়হুড় করে ঢুকে ভোট দিয়ে আসছে।

পরিতোষ আমাদের এদিককার ইনচার্জ, তার চুল উসকোখুসকো, পাঞ্জাবিটা অনেকখানি ছেঁড়া, দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছে। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। পরাজয়।

পরিতোষ আমাদের তিন জনকে দেখে বলল, আমার সঙ্গে আয় এ-দিকে, একটা জরুরি পরামর্শ আছে।

পরিতোষের সঙ্গে দ্রুত পা ফেলে আমরা চলে এলাম বৃন্দাবন পাল লেনে। সেখানে আগাছা-ভরতি একটা মাঠের ও-পাশে একটা ভাঙা বাড়ি অনেক দিন খালি পড়ে থাকতে দেখেছি। শুনেছি বাড়িটার কোনও মালিক নেই। পরিতোষ আমাদের নিয়ে এল সেই বাড়িটার মধ্যে, একেবারে ভেতরের দিকে একটা অন্ধকার ঘরে। যে-কোনও সময় মাথায় ইট খসে পড়তে পারে। ঘরটার মধ্যে আমাদের পার্টির অনেকগুলো ছেলে রয়েছে, কয়েকটা লোহার রড, ফ্ল্যাগ, পোস্টার।

জায়গাটাকে দেখলেই বোঝা যায় একটা গুপ্ত আস্তানা। একটু রোমাঞ্চ বোধ হয়। এর আগে যখন শুনতাম পার্টির লিডাররা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে, তখন আমার মনে হত সত্যিই বোধহয় মাটির তলায় সুড়ঙ্গ কেটে কোনও লুকোবার জায়গা আছে। সে-বিষয়ে অনেক দিন আমি নিঃসংশয় হতে পারিনি। এই পোড়োবাড়ির ভাঙা ঘরটা দেখেও মনে হয় সেই রকম কিছু। কিংবা গোপন যুদ্ধের হেড কোয়ার্টার।

যুদ্ধ কিংবা বিপ্লব সম্পর্কে অন্য রকম ছবির কথা চিন্তা করে চিত্ত আন্দোলিত হত। সেই রকম যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন অনেক দূরে সরে গেছে। এখন আমরা ভোট-যুদ্ধে মেতেছি। প্রথম বারে তাতেও উত্তেজনা কম অনুভব করিনি।

দুটি লম্বা মতন রাগী চেহারার ছেলে পরিতোষকে জিজ্ঞেস করল লেটেস্ট পজিসন কী?

পরিতোষ বলল, এইট্টি কিংবা নাইনটি পার্সেন্ট পোলিং হচ্ছে এক একটা সেন্টারে। তার মধ্যে একটিও জেনুইন কিনা সন্দেহ! শংকর বোস ক্যানটার করে দিচ্ছে একেবারে।

শংকর বোসের নামটা আমার কাছে যেন চেনা মনে হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, শংকর বোস কে রে?

মন্টু অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, তুই গ্রেট ডিগবাজি মাস্টার শংকর বোসকে চিনিস না? আগে টেরারর্স পার্টিতে ছিল, তারপর ফরটি টু-তে জেলে গিয়ে আমাদের পার্টিতে যোগ দিল, খুব বড় বড় কথা বলত, এখন ইলেকশানের ঠিক আগে কংগ্রেসে গিয়ে ভিড়েছে। মিজে দাঁড়ায়নি, কিন্তু এ-পাড়ার কংগ্রেস ক্যান্ডিডেটকে তো সে-ই জিতিয়ে দিচ্ছে। টাকাও পেয়েছে অঢেল!

আমার মনে হল, এই শংকর বোসের নাম আমি সূর্যদার মুখে দু’-এক বার শুনেছি, সূর্যদাদের দলেই ছিল একসময়। সূর্যদা যদি এখন এখানে থাকত, কোন পার্টিতে যোগ দিত? বোধহয় ভোটই দিত না। সূর্যদা রাজনীতি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু টাকা ছড়ালেও এত লোক পাবে কোথা থেকে? এদের সকলেরই তো অন্য জায়গায় ভোট আছে।

পরিতোষ বলল, তুই ইলেকশানের কিছু বুঝিস না। অনেকেরই ভোটার লিস্টে নাম থাকে না। তা ছাড়া রেফিউজিদের তো প্রায় কারওরই ভোট নেই–শংকর বোসের খুব হোল্ড আছে রেফিউজি কলোনিগুলোতেওখান থেকে গাড়ি ভরতি করে করে নিয়ে আসছে।

রাগী চেহারার লম্বা ছেলেদুটি বলল, ওরা এ রকম ফল্স ভোটিং চালাবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? তারচেয়ে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে চার্জ করি, ইলেকশান ভন্ডুল হয়ে যাক।

মন্টু বলল, ওখানে অনেক পুলিশ আছে।

থাক পুলিশ। আমরা আধলা ইটে ভুষ্টিনাশ করে দেব।

পরিতোষ বলল, শুধু পুলিশ নয়, ওরা ওখানে অনেক গুন্ডা লাগিয়ে রেখেছে। ইলেকশান ভাঙতে দেবে না–ওদের কাছে ড্যাগার আছে। আমরা প্রিপেয়ার্ড নই। কাশীপুরে ওরা দুজনকে স্ট্যাব করেছে।

অনিমেষ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শালা! আমরা কি তা হলে কিছুই করব না! পরিতোষ বলল, আমরা কাউন্টার অ্যাকশন নেব। আদিনাথদা খবর পাঠিয়েছেন, আমরা যত জনকে পারি জোগাড় করে আমাদেরও ফল্স চালাতে হবে।

পরিতোষ ঘাড় ফিরিয়ে অন্য কয়েকটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, দাগ তুলতে পেরেছিস।

একজন বলল, ইজি! পাঁচ-সাত মিনিট লাগে।

সে কাছে এগিয়ে এসে আঙুলটা দেখাল। তর্জনীর পাশের দিকে কালির ফোঁটা যেখানে থাকার কথা, সে জায়গাটা ফরসা। দেশলাই কাঠির বারুদের দিকটা জলে ডুবিয়ে পাঁচ-সাত মিনিট ঘষলেই উঠে যাচ্ছে দাগটা। শুধু দেশলাই কাঠির বারুদ ঘষলেই যে দাগটা ওঠে, তা এত তাড়াতাড়ি কী করে সকলে জেনে ফেলল, সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার।

মন্টু বলল, বাদল, তোর দাগটা তুলে ফেল!

আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমার এ বছর ভোটিং রাইট হয়নি। যদিও আমার এখন একুশ হয়ে গেছে, কিন্তু ভোটার লিস্ট তৈরি করার সময় কম ছিল।

সে কথা বলতেই ওরা সবাই একসঙ্গে হইহই করে উঠল। আমি এখনও একটাও ভোট দিইনি, এ তো ম্যান পাওয়ার নষ্ট করা। তক্ষুনি ভোটার লিস্ট দেখে একটা নাম বার করল, সাধন রায়, বয়স চব্বিশ, বাবার নাম শশাঙ্ক রায়। পরিতোষ জানাল, এই সাধন রায় পাটনায় গেছে, ওরা খুব ভালো ভাবে জানে, সুতরাং কোনও রিস্ক নেই।

আমাকে ঠেলতে ঠেলতে ওরা পাঠিয়ে দিল। আমি ভয় পাচ্ছিলাম। যদিও একটু আগে আমি নিজে পোলিং এজেন্ট হিসেবে দেখে এসেছি যে ভয়ের কিছু নেইনামটাম ঠিক বলতে পারলে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, তবু আমার বুক কাঁপছিল। এই প্রথম আমি সজ্ঞানে একটা অন্যায় করতে যাচ্ছি। অন্যরা অন্যায় করছে বলেই আমার নিজের অন্যায়টা ছোট হয়ে যায় না।

মন্টু আমাকে এগিয়ে দিল বুথের কাছাকাছি। শেষকালে বলে দিল, আমাদের পোলিং এজেন্ট যদি তোকে চিনতে না পেরে বেশি জেরা করে তা হলে ডান দিকে কানের পাশটা চুলকোতে থাকবি। তা হলেই বুঝতে পারবে।

আমি সাধন রায় ও শশাঙ্ক রায়ের নাম জপ করতে করতে লাইনে দাঁড়ালাম। বার বার মনে হচ্ছে, এই সামান্য নামদুটো শেষ মুহূর্তে ভুলে যাব। মুখখানা হাসি হাসি করে রাখবার চেষ্টা করতে গিয়েও বুঝতে পারলাম, ঠিক মতন হাসি ফুটছে না। আমার বুকের মধ্যে যে এত জোরে ধড়াস ধড়াস শব্দ তা কি অন্যরা শুনতে পাচ্ছে না? রেণু যদি জানতে পারে কখনও? রেণু একটু মিথ্যে কথা বলাও সহ্য করতে পারে না। আর আমি অন্য লোকের নামে পরিচয় দিয়ে। রেণু যদি আমাকে ভালো না বাসে, তা হলে কি আমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব? নাঃ, রেণুকে বোঝাতে হবে, এটা একটা স্ট্র্যাটেজি।

শেষ পর্যন্ত কোনও অসুবিধে হল না। যন্ত্রের মতন আমি নাম ও ঠিকানা বলে গেলাম, পোলিং এজেন্টরা বলল, নেক্সট! এখানে দেখলাম, কংগ্রেসের পোলিং এজেন্টরা দারুণ প্রতাপের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। প্রিসাইডিং অফিসারটি মিনমিনে। তাকে বোঝানো হয়েছে যে, লাইন বিরাট হয়ে গেছে, সুতরাং এখন বেশি জেরা করে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

আঙুলে ফোঁটা দিয়ে, ব্যালট পেপারটা বাক্সে ফেলার পরের মুহূর্তে আমার সমস্ত গ্লানি কেটে গেল। আমার মনে হল, আমি একটা দারুণ ব্যাপার করে ফেলেছি। আমি অসৎ লোকদের ঠকাতে পেরেছি।

লাফাতে লাফাতে ফিরে এলাম সেই ভাঙা বাড়িতে। আমি অত্যন্ত উচ্ছাসের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কেউ তেমন উৎসাহ দেখাল না। পরিতোষ বলল, দাগটা মুছে ফ্যাল। তোকে আবার য়েতে হবে।

সকলেই তিন বার-চার বার করে যাচ্ছে। কংগ্রেসের অর্থবল আছে, লোকবল আছে। আমাদের এ দুটোর একটাও নেই বলে এক এক জনকেই যেতে হচ্ছে বার বার। এই গোপন ঘরটায় একটা কারখানা বসে গেছে। এক এক জন ভোট দিয়ে আসছে, আর তিন জন এক্সপার্ট ব্যস্ত হয়ে পড়ছে তাদের দাগ তুলে ফেলার জন্য। আমাদের যেখানে যত ওয়ার্কার আর ভলান্টিয়ার ছিল সকলকেই ডেকে আনা হয়েছে এখন আর মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় আছে, এর মধ্যে যতগুলো তুলতে পারা যায়। অনিমেষ ভেতরে ঢুকে ভোটার। লিস্ট বার করে এনেছে কায়দা করে, কোন কোন নামের পাশে এখনও টিক পড়েনি দেখবার জন্য।

এবার আমাকে দেওয়া হল সুশান্ত তালুকদার, বাবা জয়দেব তালুকদার, বাড়ির নম্বর সাতাশের দুই, হলদে রঙের বাড়ি। এবার অন্য বুথে, তেমন একটা ভয়ও করছে না। লাইনে দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেট ধরালাম। লাইনে আমার সামনে-পেছনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারা কোনওক্রমেই বাগবাজারের লোক নয় বাগবাজারের লোক দেখলেই চেনা যায়।

খানিকটা এগিয়েই বুঝতে পারলাম, এই বুথের চেহারা অন্য রকম। আমাদের পার্টির কোনও পোলিং এজেন্ট এখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না। যারা বসে আছে তারা যাকে তাকে ধরে হঠাৎ জেরা করছে, ছেলেছোকরা দেখলে আর রক্ষে নেই। ভেতরে পুলিশ রয়েছে, উঠোনের মধ্যে কয়েক জন ভোটারকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের মিথ্যে পরিচয় প্রমাণিত হয়ে গেছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওদের। এবং স্বয়ং শংকর বোস ওই বুথ পরিদর্শন করতে এসেছেন। সেই প্রথম আমি দেখলাম শংকর বোসকে–তখন ঘুণাক্ষরেও অনুমান করা সম্ভব নয়, ভবিষ্যতে এঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।

লোকজনের কথাবার্তা শুনেই আমি চিনতে পারলাম শংকর বোসকে। খুব রোগা আর লম্বা মতন মানুষ, চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। আমার বন্ধুরা যেমন বলেছিল, সে রকম কোনও ফন্দিবাজ মানুষের মতন মুখ নয়, বরং যেন একটু বেশি অভিজ্ঞ আর ক্লান্ত মনে হয়। মোটামুটি চেহারা দেখলে খারাপ ধারণা কিছু হয় না।

আমার শরীরে ভয়টা আবার ফিরে এল। স্পষ্ট টের পাচ্ছি পা কাঁপছে। সুশান্ত তালুকদারের বাবার নাম যেন কী? বাড়ির নম্বর সাতাশের দুইনা সাঁইতিরিশের দুই! ইস, কাগজে লিখে আনিনি কেন? এই সামান্য ব্যাপারটাও মনে থাকে না? এখনও চলে যাব? বড্ড কাছাকাছি এসে গেছি, এখন চলে যেতে গেলে যদি কিছু মনে করে!শংকর বোসের সামনেই ধরা পড়ব, যদি উনি কোনওক্রমে জানতে পারেন আমি সূর্যদার ভাই।

শংকর বোস সেই মুহূর্তেই সেখান থেকে চলে গেলেন বলে আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল কিছুটা। নাম ঠিকানা সব ঠিকঠাক মনে পড়ে গেল।

নাম?

সুশান্ত তালুকদার।

বাবার নাম?

জয়দেব তালুকদার, সাতাশের দুই…

পোলিং এজেন্টটি আমাকে ছেড়ে দিয়ে টিক দেওয়ার জন্য মাথা নিচু করেছিল, হঠাৎ আবার মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা তো মারা গেছেন?

এক মুহূর্তও চিন্তা না করে আমি বললাম, না তো!

লোকটি এবার রাগী গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবা মারা যাননি?

আমিও জোর দিয়ে বললাম, না!

প্রথম বার প্রশ্নের সময় অতর্কিতে আমি নিজের বাবার কথাই ভেবেছিলাম। পরের বার খেয়াল হয়েছে। তবু সামান্য কুসংস্কার, মুখ ফুটে বলতে পারলাম না, আমার বাবা মারা গেছেন। আমার বাবা বড় নিরীহ মানুষ, তাকে মুখের কথাতেও আমি মেরে ফেলতে পারি না।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, জয়দেব তালুকদার আমার মাস্টারমশাই ছিলেন, উনি মারা যাবার পর ওঁর ডেডবডি আমি নিজে কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে গেছি, আর আপনি বলছেন, উনি মারা যাননি!

আমার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমি ধরা পড়ে গেছি। কাছেই পুলিশ। হয়তো এই লোকটা অত্যন্ত চালু, জয়দেব তালুকদারের মারা যাবার ব্যাপারটাও বানিয়ে বলছে, কিন্তু আমার আর জোর দিয়ে কিছু বলার উপায় নেই।

দু’এক মুহূর্ত আমি চুপ করে ছিলাম শুধু। সেই সময়টুকুতে পৃথিবীর আর কিছু নয়, শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠল রেণুর মুখ। রেণুই যেন আমার বিচারক। রেণু কি আমার সব দোষ ক্ষমা করবে? রেণুর চোখের দিকে তাকালেই ও কি বলবে, আমি রাগ করিনি!

আমি খুব দুর্বল গলায় লোকটিকে বললাম, দাঁড়ান, আমি বাড়ি থেকে রেশান কার্ড নিয়ে আসছি!

রেশান কার্ড এনে কী দেখাবেন? আমি জানি না?

আমি আর অপেক্ষা করলাম না, পেছন ফিরেই দৌড়োলাম।

কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ধরুন, ধরুন, ওই ছেলেটাকে ধরুন তো!

কিন্তু তখন আমি অন্ধ, আমি কারোকেই দেখতে পাচ্ছি না, শুধু দৌড়োচ্ছি। অত জোরে জীবনে কখনও ছুটিনি আগে।

একসময় বুঝতে পারলাম, আমি বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, আমি ধরা পড়িনি, বেঁচে গেছি। তবু দৌড় থামালাম না। তীব্র গতিতে ছুটছি। সেই ভাঙা বাড়ির দিকে নয়, বন্ধুদের দিকে নয়। কোন দিকে জানি না। ভয় চলে গিয়ে এখন ফিরে এসেছে লজ্জা। আমি হেরে গেলাম। অন্যরা কী রকম অনায়াসে তিন-চার বার ফল্স দিয়ে এসেছে। আমি পারলাম না। আমি হেরে যাই বার বার। আমি ভয় পাই।

কিন্তু ফিরে গিয়ে আবার চেষ্টা করার ইচ্ছে হল না। আমি বুঝতে পারলাম, এইসব পথ আমার জন্য নয়। আমি অযোগ্য। আমাকে একাই থাকতে হবে।

ছুটতে ছুটতেই আমি দেখলাম, সার সার লরি-ভরতি নকল ভোটার তখনও আসছে। গণতন্ত্রের বিচিত্র রূপ আমার সেই দিনই দেখা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *