অন্ধকারে জল ভেঙে পোঁটলা-পুঁটলি মাথায় কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছে এ বাড়ির উঠোনে। মংলু তাদের পুবের ঘরের দাওয়ায় উঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন বলল, এ বৃষ্টির জল নয় গো। বেনোজল। স্রোতটা দেখ।
মৃতপ্রায় নদীটার বুকে পলিমাটি জমে এত উঁচু হয়েছে যে, ফি বর্ষাতেই জল উপচে আসে। এবারেও বৃষ্টিতে পুরনো মাটির বাঁধটা যে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। উঠোনের জল দাওয়া প্রায় গিলে ফেলেছে। কয়েক ইঞ্চি বাকি।
ঘরের মধ্যে উদ্বিগ্ন শ্রীনাথ বলে, অবস্থা তো ভাল দেখছি না। জিনিসপত্র এইবেলা পাটাতনে তোলো।
এতক্ষণ তাই করছিল তৃষা। কিন্তু এখন হঠাৎ তার মুখ পার্থিব বিষয় সম্পর্কে খুব নিরাসক্ত হয়ে গেছে। জানালার পাটায় বসে বাইরের দিকে চেয়ে আছে চুপচাপ।
শ্রীনাথ জানে, সজলের সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্ক ভাল নয়। তাতে এক সময়ে সে বেশ খুশিই বোধ করত। কিন্তু আজ অস্বস্তি হয় তার। চারদিকে এই জলের বিপদ, আর ঘরের মধ্যে মা-ছেলের মধ্যে থমথমে ভাব।
শ্রীনাথ একবার রাগের চোখে দরজায় দাঁড়ানো ছেলের দিকে চেয়ে বলে, তোর পায়জামাটা বদলাতে কী হয়? বড় ব্যাপড়া বাদর তৈরি হচ্ছিস তো! যা ছেড়ে ফেল গিয়ে।
শাড়ি পরব?
বিপদের দিনে অত বাছাবাছি কী? এটা কি বাবুয়ানির সময়? যা শিগগির।
সজল মা’র কথা শোনেনি, কিন্তু বাবার কথা শুনল। হয়তো ইচ্ছে করেই। পাটাতনের সিঁড়ির নীচে আলো গিয়ে পৌঁছোয়নি ভাল করে। সেইখানে দাঁড়িয়ে সে একটা সাদা খোলের শাড়ি জড়াল কোমরে।
শ্রীনাথ বলল, জামাটাও ভিজেছে, ছেড়ে ফেল। মাথা মোছ। সজল সবই ধীরেসুস্থে করে এবং তার মধ্যেই মায়ের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখো মুখ টিপে মাঝে মাঝে একটু হাসেও বোধ হয়।
তারপর লক্ষ্মীছেলের মতো সে শ্রীনাথের পাশটিতে এসে বসে।
এ সব মুখ না ঘুরিয়েও টেব পায় তৃষা। তার সমস্ত অনুভূতি সজাগ। সে লক্ষ রাখছে। স্বপ্ন আর মঞ্জুও বাপের পিছন দিকে বিছানায় শুয়ে মৃদু স্বরে কথা বলছে। বৃন্দা কেরোসিন ভরছে স্টোভে। বাড়ির কাজের লোকেরা ভিজে সঁাতা, তাদের জন্য চা হবে।
সরিৎ ঘরে ছিল না। বারান্দা থেকে এইমাত্র ঘরে এসে বলল, মেজদি, দোকানে নিশ্চয়ই জল ঢুকেছে।
তৃষা তার কঠিন মুখখানা এবার ফেরায়, কে বলল?
কে বলবে? ভিতটা তো নিচু। গতকালই নতুন মাল এসেছে। সব পড়ে আছে মেঝেয়। তোলার সময় হয়নি।
তৃষা একটা খাস ফেলে মৃদু স্বরে বলল, থাকগে।
অবাক সরিৎ বলে, থাকবে মানে? অন্তত চার-পাঁচ হাজার টাকার জিনিস। জল ঢুকলে একদম বরবাদ। আমি বরং গিয়ে একটা ব্যবস্থা করে আসি। চাবিটা দাও।
তৃষা আঁচলের গেরো থেকে চাবির গোছাটা মেঝে ছুড়ে দিয়ে বলে, লোহার আলমারিতে আছে। নিয়ে যা।
মেজদির মেজাজ দেখে সরিৎ অবাক হলেও কিছু বলল না। আলমারি খুলে দোকানের চাবি নিয়ে তৃষার হাতে আবার চাবির গোছাটা ফেরত দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। বারান্দা থেকে বলল, মংলু আর নিতাইকে নিয়ে যাচ্ছি। অনেক মাল, তুলতে লোক লাগবে।
তৃষা এ কথারও জবাব দিল না!
ঘরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঘনিয়ে উঠছে। ছেলেমেয়েরা অবশ্য অতটা খেয়াল করল না। স্বপ্না, মঞ্জু আর সজল কোথা থেকে একটা লুডো বের করে হ্যারিকেনের আলোয় খেলতে বসে গেল। অস্বস্তিটা শুধু টের পাচ্ছিল শ্রীনাথ। তৃষার কোনও বিস্ফোরণ নেই, চেঁচামেচি নেই, কিন্তু তার ঠান্ডা রাগ নানা পন্থায় শোধ নেয়। শশাধ নিতে তৃষা কখনও ভুল করেনি।
খুব চিন্তিত উদ্বিগ্ন মুখে সে তাই সজলের দিকে একবার তাকায়। বড় অবাধ্য হয়েছে ছেলেটা। একদিন ওর খাদ্যে পানীয়েও না অজানা বিষ এনে মেশায়। এত সাহস কি ওর ভাল?
একটু ভাবল শ্রীনাথ। তারপর নিঃশব্দে উঠে তৃষার কাছে জানালায় এসে দাঁড়াল। তৃষা একবার দেখল তাকে, তারপর উঠবার চেষ্টা করতেই শ্রীনাথ বলে, বোসো, বোসো। বলছিলাম কী, সজল নিতান্ত ছেলেমানুষ।
আমি তো সেটা জানি। তৃষা অবাক হয়ে বলে।
শ্রীনাথ তৃষার মুখের কঠিন আস্তরণটা লক্ষ করে এই আবছা আলোতেও। মনে মনে প্রমাদ গুনে গলাটা পরিষ্কার করে নিতে বার দুই গলা খাঁকারি দেয়। তারপর বলে, ওর ওপর রাগ পুষে রেখো না। এই বয়সটা বাঁধ ভাঙারই বয়স আমি জানি, ও তোমাকে খুব ভালবাসে।
তৃষা জবাব দিল না। শ্রীনাথ জবাবের আশায় একটু সময় ফাঁক দিয়ে বলল, আর মায়ের শাসনকে একটা বয়সের পর ছেলেপুলেরা বড় একটা মানতে চায় না। আমরাই তো দেখো না, দশ-বারো বছর বয়স থেকে মাকে আর ভয়-টয় পেতাম না। মায়ের সঙ্গে ছেলেপুলেদেব সম্পর্কটাই ওরকম যে!
বলে শ্রীনাথ একটু মনভোলানো হাসি হাসল।
তৃষা চুপ করে যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল।
শ্রীনাথ ভরসা দিল তাকে, তুমি ভেবো না। আমি ওকে শাসন করে দেব। আর যে কখনও তোমার অবাধ্য না হয়।
তৃষার মুখের কঠিন আস্তরণটা যেমন ছিল রয়েই গেল। চারদিকের প্রাকৃতিক বিপদের কথা আর খেয়াল রইল না শ্রীনাথের। তৃষার মুখের দিকে চেয়ে বুকটা গুড়গুড করছিল তার।
বাইরে থেকে কে চেঁচিয়ে বলল, বড় ঘরে জল ঢুকছে গো!
ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টি নেমেছে। বাইরে এসে শ্রীনাথ দেখে দাওয়ার কানায় কানায় জল। আর একচুল বাকি। কিন্তু দৃশ্যটা সে খুব নিস্পৃহভাবে দেখে। কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। মুখ ঘুরিয়ে সে ঘরের ভিতরে চেয়ে দেখে, হারিকেনের আলোয় তিন ভাই-বোন লুডো খেলছে। সজলের মুখ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে পিছন ফেরানো। তার চওড়া কাঁধ, চুলে ভর্তি মাথার একটা ছায়া শরীরের দিকে চিন্তিত ভাবে চেয়ে থাকে শ্রীনাথ। চারদিকের অনেক বিপদের মধ্যে এ ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখাই এক সমস্যা। ওকে কি বেঁচে থাকতে দেবে?
এক ঝলক জল এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে গেল শ্রীনাথের।
বড় ঘরও ড়ুবছে তা হলে! ড়ুবুক, ড়ুবে যাক, ভেসে যাক। শ্রীনাথ তার কোমর থেকে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই বের করে বিড়ি ধরিয়ে নেয়। বারান্দায়, ঘরে মেলা পোকামাকড় ঘুরঘুব করছে। টর্চের আলোয় সে চারদিকটা দেখার চেষ্টা করে। বেনো ঘোলা জল তোড়ে ঢুকছে বিশাল উঠোনে। ঝোপঝাড় সব জলের তলায়। পুবের ঘরে বারান্দায় যারা এসে উঠেছে তারাও এখন গোড়ালি-ড়ুব জলে দাঁড়িয়ে বেকুবের মতো চুপ করে আছে।
বৃষ্টি এখন তেড়ে পড়ছে। টিনের চালে জোর শব্দ। গুপুস করে একটা নারকোল জলে পড়ে ভেসে গেল। চৌকাঠ ডিঙিয়ে কয়েক কোষ জল ঢুকল ঘরে।
লুডো থেকে মুখ তুলে স্বপ্ন ভয়ের গলায় ডাকল, মা!
তৃষা তেমনি জানালায় বসে। জবাব দিল না, তবে মুখ ঘুরিয়ে কঠিন চোখে তাকাল।
স্বপ্না দরজার দিকটা দেখিয়ে বলে, জল ঢুকছে।
তৃষা মৃদু স্বরে বলল, দেখেছি।
সজল লুডোর খুঁটি চুরি করল এই ফাঁকে। একটা কাঁচা খুঁটি আঙুল দিয়ে পাকা ঘরে চালিয়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্তের গলায় বলে, ঢুকছে তো ঢুকছে। সাঁতার জানিস না?
বেশি পাকামি করিস না তো ভাই। শুধু সাঁতার জানলেই বুঝি হবে? ঘরদোর ড়ুবে গেলে কোথায় থাকব আমরা?
ড়ুবতে দে না।
মঞ্জু চুরি ধরতে পেরে সজলের কান টেনে একটা থাপ্পড় মেরে বলল, খুব না! চোর কোথাকার! ডাকাত।
সজল হি হি করে হাসে।
তৃষা কূট চোখে দৃশ্যটা লক্ষ করে। ছেলেটা ভয় পায় না। ভয় কাকে বলে জানে না। কিন্তু তৃষা রাগ চেনে। সে জানে, সজলের এই সাহস কোনও ভাল কাজে লাগবে না।
ঘরে হিলহিল করে জল ঢুকে পড়ছে এবার। এ ঘরের ভিত অনেক উঁচু। তবু ঢুকছে। তার অর্থ, কোথাও বোধহয় আর ডাঙা জমি নেই।
পুবের ঘরের বারান্দায় দাঁড়ানো পুরুষ, মেয়ে, বউ বাচ্চারা ঘরের চালে উঠবার আয়োজন করছে। পাঁচ-সাতজন উঠেও গেছে, বাকিদের টেনে তুলছে ঢালু টিনের ওপর। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে ওই পিছল ঢালু টিনের ওপর কতক্ষণ কাটাতে হবে কে জানে। লক্ষণ ভাল নয়।
চারদিকে টর্চ মেরে দেখছিল শ্রীনাথ।
ঘরে এসে সে দেখে, খাটের বিছানা গুটিয়ে তার ওপর কিছু বাক্স-প্যাটরা তুলছে বৃন্দা। জলে ভিজে মালি আর দুটো কাজের লোক ঘরে এসে গেল।
তৃষা জানালা থেকে জলের মেঝেয় পা রেখে দাঁড়াল। বিশেষ কাউকে নয়, কিন্তু সকলকে উদ্দেশ করেই বলল, তোমরা আস্তে আস্তে পাটাতনে উঠে যাও।
সজল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এখনই কী! আগে ঘরে গলা জল হোক, তারপর দেখা যাবে।
স্বপ্ন আর মঞ্জু সভয়ে কাঠের মই বেয়ে ওপরে ওঠে। তাদের আগে আগে বৃন্দা।
শ্রীনাথ ইতস্তত করে বলে, আর-একটু দেখি। তুমি বরং উঠে পড়ো।
তৃষা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে শিষটা বাড়িয়ে চারদিক দেখল একটু। তারপর বল, পাটাতনে বিছানা পাতা আছে, খাওয়ার জল রাখা আছে। খাবার-দাবারও আছে। চিন্তা কোরো না। আমি যাচ্ছি। বলে তৃষা মইয়ে পা রাখে।
শ্রীনাথ জানে, তৃষা দুরদর্শী। অনেক আগে থেকেই সে সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকে। তুষার আধিপত্য মেনে নিলে কারও কোনও ভয় নেই, কষ্ট নেই। শ্রীনাথ ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তৃষার মই বেয়ে উঠে যাওয়া দেখছিল।
পিছনে সজল হঠাৎ বলে ওঠে, আরে! ওটা কী?
মাঝ-সিঁড়িতে হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায় তৃষাও।
শ্রীনাথ ঘুরে তাকায়। আর তাকিয়েই দেখতে পায়। তৃষা যে জানালার পাটায় এতক্ষণ বসে ছিল ঠিক সেইখানে মস্ত এক চিত্রল কেউটে। চতুর, হিংস্র ফণাটা মাঝে মাঝে তুলে আবার মুখ নামিয়ে নিচ্ছে। লেজের খানিকটা এখনও বাইরে।
সম্মোহিতের মতো চেয়ে ছিল শ্রীনাথ। সাপের যে এক ধরনের সম্মোহন আছে তা সে ছেলেবেলায় শুনেছিল। আসলে আচমকা সাপ দেখা দিলে মানুষ বিমূঢ় হয়ে যায়। সেটাই কি সেই সম্মোহন? শ্রীনাথ হাঁ করে চেয়ে ছিল শুধু।
সবার আগে তৎপর হল সজল। হাত বাড়িয়ে সে খাটের ছতরি থেকে একটা আড়কাঠ তুলে নেয়।
আর তখনই সংবিৎ পেয়ে শ্রীনাথ বলে ওঠে, না! না! সজল, খবরদার!
বাপের এ কথাটা শুনল না সজল। ডান্ডাটা তৎপর হাতে তুলেই বিদ্যুৎবেগে বসিয়ে দিল। কিন্তু ছতরির অত লম্বা কাঠ দিয়ে এই ঘরের মতো অপরিসর জায়গায় লাঠির কাজটা হল না। ছাদের একটা কড়িকাঠে সেটা খটাং করে শব্দ করল, তারপর যদিও বা জানলার পাটা পর্যন্ত নামল তো সেটা সাপটার গায়ে লাগলই না। কিন্তু এই আক্রমণে ভয়ংকর সাপটা দুরন্ত ফণার ছোবল তুলল।
করছিস কি গাধা কোথাকার!— বলে হঠাৎ শ্রীনাথ জাপটে ধরে সজলকে, কামড়াবে তোকে। উঠে যা পাটাতনে। যা!
সজল মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে চেয়ে হাসল, ছাড়ো বাবা, একটা সাপকে এত ভয় কী! দেখো না, মেরে ঠান্ডা করে দিচ্ছি।
এক পলকের এই সর্বনাশা অমনোযোগ, ওই সুযোগেই সাপটা হড়হড় করে নেমে এল মেঝেয়। তীব্র ফোসানির শব্দে সচকিত সজল চেয়ে দেখে, মাত্র তিন হাত দুরে সাপটার ফণা, আর তার পাল্লায় সে দাঁড়িয়ে। তাকে জাপটে আছে বাবা।
গোয়ালঘরে, বাগানে অনেক সাপ মেরেছে সজল। সাপে তার ভয় প্রায় নেই-ই। কিন্তু ঠিক এই অবস্থায় সাপের মুখোমুখি সে কখনও পড়েনি। তার ওপর বিপদ, বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে একটা অদ্ভুত গোঁ-গোঁ শব্দ করছে।
কিন্তু সজলের কাছে সাপের কোনও সম্মোহন নেই। তার মাথা পরিষ্কার। সহজেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। হাতের বিশাল ডান্ডাটা ফেলে গায়ের আসুরিক জোরে সে এক ঝটকায় বাবাকে ছিটকে ফেলে দিল।
সাপটা ছোবল দিতে একটু দেরি করেছিল। তারও তো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার আছে। বেনোজল থেকে মানুষের ঘরে উঠে এসে সেও একটু অপ্রতিভ।
সজল তাই এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বাবাকে সরিয়ে প্রায় অন্ধের মতো একটা মাঝারি ট্রাংক দু’হাতে তুলে নিল চোখের পলকে। তুলেই সেটাকে মেঝেয় ফেলে লম্বালম্বি তড়িৎগতিতে ঠেলে নিয়ে গেল সাপটার দিকে। মেলট্রেনের মতো দ্রুতগামী সেই ট্রাংক সাপটাকে নড়ার সময় দিল না। সোজা দেয়ালের সঙ্গে চিড়ে-চ্যাপটা করে দেয়। দেয়ালে সাপটাকে ট্রাংক দিয়ে দুমদুম করে ঠুসতে থাকে সজল। প্রবল সেই প্রহারে সাপটার হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে যায়, চামড়া ছিড়ে যেতে থাকে। সজল সাপটাকে চুসতে চুসতে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে, মর! মর! মর!
কিছুক্ষণ আগেকার ভয়ংকর কেউটে যখন প্রায় ছিবড়ে হয়ে এসেছে তখন তাকে ছাড়ল সজল।
শ্রীনাথ উঠে বসেছে। হাঁ করে দেখছে দৃশ্যটা। সিঁড়ির মাঝখানে স্থির স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে তুষা। নির্নিমেষ চোখ। এতক্ষণ সে একটাও শব্দ করেনি।
সজল ট্রাংকটা আবার খাটে তুলে রাখে, তারপর বাবার দিকে ফিরে একগাল বাহাদুর হাসি হেসে বলে, তুমি যা ভিতু না! তোমার জন্যই আর-একটু হলে সাপটার ছোবল খেতাম। বলে সে বাবাকে টেনে তোলে।
শ্রীনাথ কঁপছিল। হাতে-পায়ে বশ নেই। কিছুক্ষণ স্তম্ভিতের মতো সজলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে হ্যাদানো গলায় বলল, তোর প্রাণের ভয় নেই হারামজাদা! ফের যদি কোনওদিন…
সজল একটু হেসে বলে, আমার চেয়ে মা’র বিপদ অনেক বেশি ছিল। ওই জানালায় মা বসে ছিল একটু আগে।
তা বটে। কিন্তু তৃষাকে সাপে কামড়াতে পারে এটা যেন বিশ্বাস হয় না শ্রীনাথের। এ বাড়ির সাপও হয়তো তৃষার অনুগত। এমনও হতে পারে যে, এই কেউটেটা তৃষার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেই সজলকে ছোবল তুলেছিল।
পাটাতনের ওপর থেকে এ সময়ে মুখ বাড়িয়ে মরা সাপটা দেখে স্বপ্না চেঁচিয়ে উঠল, উঃ বাবাগো! ভাই, তুই মারলি?
তৃষা কোনও কথা না বলে এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বলল, বৃন্দা, সাপটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়।
কোঁচকানো ভ্রু আর কঠিন মুখ নিয়ে তৃষা আস্তে আস্তে পাটাতনে উঠে গেল। সাপটা তাকে কামড়াতে পারত, আর একটুক্ষণ যদি সে বসে থাকত জানালার পাটায়। কিন্তু সেজন্য কোনও দুশ্চিন্তা হচ্ছিল না তৃষার। এ বাড়িতে আসার পর বিস্তর সাপ বিছে পাগলা শেয়ালের সঙ্গে বসবাস করতে হয়েছে। কিন্তু এখন আরও বুদ্ধিমান, আরও হিংস্র, আরও তৎপর মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে হবে তাকে, যাদের ওপর কিছুতেই আধিপত্য বিস্তার করা যাবে না।
বড় ঘরটা বেঁচে গেল শেষ পর্যন্ত। জল ঢুকল বটে, কিন্তু এক-দেড় ইঞ্চির বেশি উঠল না। ভোর হতে না হতেই সেই জল নেমে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে।
সরিৎ সকালবেলা খবর আনল, নদীর ওপারের বাঁধ এপারের লোক গিয়ে কেটে দিয়ে এসেছে। ফলে জলটা আর বাড়তে পারেনি।
সকালে অগোছালো ঘরে সকলে জড়ো হয়ে বসে চা খাচ্ছিল।
পুবের ঘরের চাল থেকে তোক নেমে দাওয়ায় বসে আছে। বৃন্দা তাদের জন্য ধামাভর্তি চিড়ে বের করে দিচ্ছিল। বৃষ্টি এখনও হচ্ছে। রোদ ফোটেনি।
তৃষা একদমই কথা বলছে না রাত থেকে। এটা লক্ষ করেছে শ্রীনাথ! কথা বলানোর জন্য সে বলল, কাল রাতে তোমারও খুব ফাড়া গেছে। উঃ, যা একখানা সাইজ সাপটার!
তৃষা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মৃদু স্বরে বলল, কাঁড়া এখনও যায়নি।
শ্রীনাথ চমকে উঠে বলে, তার মানে?
মানে কী তা তোমার বোঝা উচিত ছিল।-–বলে তৃষা উঠে পড়ে। অনেক কাজ।