॥ ৭৫ ॥
এক সাহেব ডাক্তার আনানো হল ঢাকা থেকে। দেখেশুনে তিনি বললেন, হি হ্যাজ কনস্টিটিউশন অফ এ বুল। নাথিং টু ফিয়ার। হি উইল পুল আউট।
হেমকান্ত সম্পর্কে এই উক্তি যে কতটা খাঁটি তা দশ দিনের মাথায় বোঝা গেল। দু দুটো গভীর ক্ষত এবং প্রচুর রক্তপাতজনিত অবসাদ কাটিয়ে হেমকান্ত উঠে বসলেন। বললেন, হাসপাতালে আর একদিনও নয়। আমার বংশে কেউ কখনো হাসপাতালে যায়নি।
এগারো দিনের দিন তিনি একরকম জোর করে হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে এলেন। তাঁর বাড়ি ফেরায় একটা উৎসবের মতো হৈ-চৈ ছড়িয়ে পড়ল শহরে। বহু লোক দেখা করতে এলেন। বিস্তর প্রজাও এল বিভিন্ন মহল থেকে। বাড়িতেও বেশ মানুষের ভীড়। খবর পেয়ে বড় মেজো দুই ছেলেই সপরিবারে চলে এসেছে। এসেছে মেয়েরাও। গিজগিজ করছে বাড়ি।
ভীড় একটু কমলে দুর্বল শরীরে হেমকান্ত চোখ বুজলেন। আগাগোড়া তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল রঙ্গময়ী। এতক্ষণ কথা বলেনি, বার বার শুধু চোখের জল মুছেছে আঁচলে। লোকের ভীড়ে কথা বলার সুযোগ পায়নি এতক্ষণ, এবার পেল।
হেমকান্ত রঙ্গময়ীর দিকে তাকাননি ভাল করে। তবে তার দেহের গন্ধ এবং নৈকট্যজনিত একটা তাপ টের পাচ্ছিলেন এত হৈ-চৈ-এর মধ্যেও। আশ্চর্য এক সুখানুভূতিতে তাঁর অভ্যন্তর টৈটুম্বুর হয়ে যাচ্ছিল। রঙ্গময়ী যে তাঁর জীবনে কতখানি জুড়ে আছে তা যেন এতদিনে খুব স্পষ্ট ভাবে অনুভব করলেন।
চোখ বুজে রেখেই হেমকান্ত মৃদুস্বরে ডাকলেন, মনু।
বলো।
অত চোখের জল ফেলছো কেন? আমি তো বেঁচেই আছি এখনো।
চোখে জল আসবে না? বেঁচে আছো সেই আনন্দেই চোখে জল আসছে।
বেঁচে থেকে আমার কিন্তু তেমন আনন্দ হচ্ছে না।
কেন, তোমার কি মরার ইচ্ছে নাকি?
অনেকটা তাই। মরার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে আর ভাল লাগে না। মরতে যখন হবেই তখন সেই ভয়ংকর ব্যাপারটা এবারই চুকে গেলে হত। আর দুশ্চিন্তা করতে হত না।
সে তো বুঝলাম। স্বার্থপরেরাই ওরকম ভাবে। তুমি মরলে আমার কী হত বলো তো! কী নিয়ে বাকি জীবনটা কাটত আমার?
একটু হেসে হেমকান্ত চোখ খুলে মুখ তুলে রঙ্গময়ীর দিকে তাকালেন। রঙ্গময়ী এই কয়দিনে খুব রোগা হয়ে গেছে। অনেক কান্নার চিহ্ন পড়েছে চোখের কোলে! চুলে এলোমেলো ভাব। পোশাকে পারিপাট্য নেই। তবু রঙ্গময়ীর ধারাল মুখখানা পিপাসার্তের মতো মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখেন হেমকান্ত। বলেন, এমন অবস্থা হয়েছে নাকি তোমার?
কেন, অন্যরকম অবস্থা আবার কবে ছিল?
হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যেই আমাকে মেরে থাকুক সে আমার একরকম উপকারই করেছে। অনেক দিনের একটা দ্বিধা কেটে গেছে আমার।
কিসের দ্বিধা গো?
বিপদে না পড়লে তো মনটাকে ঠিক বোঝা যায় না যখন লোকটা আমাকে ছোরা মারল তখন আমি হঠাৎ বুঝলাম, আয়ু ফুরিয়ে এল, আর সময় নেই। সেই সময় সকলের আগে কার কথা মনে পড়ল জানো?
রঙ্গময়ী চোখ নত করল।
হেমকান্ত বললেন, তোমার কথা। গাড়োয়ানকে বললাম, গাড়ি ছুটিয়ে শিগগির আমাকে মনুর কাছে পৌঁছে দে। তারপর যা হয় হবে।
জানি। বলে রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু এই বিপদের মধ্যে আর নয়। তোমাকে কলকাতায় বা অন্য কোথাও যেতে হবে।
হেমকান্ত বিস্মিত হয়ে বলেন, কেন মনু?
যারা তোমাকে মারার চেষ্টা করেছিল তারা তো জানে তুমি মরোনি।
সে তো জানেই। তাতে কি? আবার অ্যাটেমপট করবে বলে ভাবছো? করুক। আমি ভয় পাই না।
তুমি পাও না, কিন্তু আমি পাই।
তুমিই বা পাবে কেন? তুমি না স্বদেশী করো!
স্বদেশী করি কে বলল তোমায়?
আমি কি বোকা মনু?
রঙ্গময়ী তীব্র চোখে হেমকান্তর দিকে চেয়ে বলল, তার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? তোমাকে কিছু লোক মারতে চেষ্টা করছে আর আমি স্বদেশী করি বলে হাল ছেড়ে দেবো, এটা কেমন যুক্তি হল।
তোমার স্বদেশীরাই তো মারতে চেয়েছিল আমাকে। ওদের ধারণা আমিই শশীকে ধরিয়ে দিয়েছি। কাজেই তোমার তো ভয় পেলে চলবে না মনু। তোমার আদরের স্বদেশীরা আমাকে মারবে, তোমাকেও তার জন্য বাহবা দিতে হবে।
খুব বিঁধিয়ে কথা বলতে শিখেছো তো! এতদিনে এই বুঝলে!
হেমকান্ত ক্ষীণ হেসে বললেন, কী বুঝব তা জানি না। তবে ছোরা খাওয়ার পর আমার ভয় ডর কেটে গেছে। বেশ ঝরঝরে লাগছে মনটা। জীবন কি আবার শুরু করা যায় মনু?
কি জানি? তুমি তো আর বুড়ো হও নি। জীবন শুরু করতে বাধা কী? শুধু একটা কথা আমার রাখো। এখানে আর নয়।
তবে কোথায়?
কলকাতায় কনকের কাছে গিয়ে থাকো, না হয় তত অন্য কোথাও।
এস্টেটের কী অবস্থা হবে তাহলে?
সে কথাও আমি ভেবে রেখেছি। বিশাখার বিয়ে দিয়ে দাও। শচীন সব দেখাশোনা করবে।
শচীন? সে কি বিশাখাকে বিয়ে করবে আর?
বিয়ের পিঁড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে।
বলো কি? বলে হেমকান্ত একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু এখন তো আর তা হয় না।
কেন হবে না?
শচীন বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে আমার বংশের মর্যাদা নষ্ট করতে বসেছিল।
হীরের আঙটির আবার বাঁকা আর সোজা।
যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে পারব না মনু।
শোনো। শচীন তেমন ছেলে নয় যে অন্যের ঘরের বউকে ফুসলে নিয়ে যাবে। তোমার বউমার ব্যাপারে আমি তো তার দোষ দেখি না। বউমা নিজে এত ঢলাঢলি করেছিল যে বেচারার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। খুব অনুতপ্ত, লজ্জায় মুখ দেখাতে চায় না। তাছাড়া দেখলে তো, এই ঘটনার পর কেমন ছোটাছুটি করল। তিন রাত্রি ঘুমোয়নি।
সবই বুঝলাম মনু, তবু মনটা সায় দেয় না।
যদি বিশাখা রাজি থাকে?
বিশাখা রাজি হবে? কী বলছো! সে তো বরাবর অরাজি।
সব ঘটনা তুমি জানো না। জেনে কাজও নেই। তবে আমি জানি। বিশাখার এখন অমত তো নেই-ই, বরং আগ্রহই আছে।
হেমকান্ত চুপ করে ছাদের দিকে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, আচ্ছা ভেবে দেখি।
বেশী ভেবো না গো। তোমাকে আর বেশীদিন এখানে থাকতে দিতে আমার ভয় করে।
সে তো বুঝলাম মনু। কিন্তু কলকাতাতেই বা আমার কিসের স্বস্তি? সেখানে কনকের সংসার, আমার সেখানে ভাল লাগবে না। বাপ পিতামহর এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে কি ভাল লাগার কথা?
সে বললে তো হবে না। আগে প্রাণটা বাঁচুক।
আমি চলে গেলে তোমার কী হবে মনু?
আমার আবার কী হবে?
পারবে থাকতে আমাকে ছেড়ে?
রঙ্গময়ী স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। দুটো চোখ ফের টসটসে হয়ে ওঠে জলে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, তোমার ভালর জন্য সব পারি।
হেমকান্ত চোখ বুজলেন। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ধীর স্বরে বললেন, আজই সব ব্যাপারে মতামত চেও না। আমাকে ভাবতে দাও।
রঙ্গময়ী তাঁর কপালে একবার হাত রাখল। বলল, ঘুমোও। পরে আসব।
হেমকান্ত বললেন, ঘুম কি আসে? এক কাজ করো, কৃষ্ণকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
দিই। বলে রঙ্গময়ী চলে গেল।
হেমকান্ত চোখ বুজে শরীরের গভীর অবসাদ টের পাচ্ছিলেন। মৃত্যু স্পর্শ করে গেল তাঁকে। কত কাছ দিয়ে গেল। পলকের জন্য অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে দেখিয়ে দিয়ে গেল তার মুখ। তবু রহস্যময় মৃত্যুর সবটুকু দেখা হল না। কিছু বাকি রয়ে গেল। আবার অপেক্ষা। সে অপেক্ষা কি খুব দীর্ঘ হবে?
শরীর! শরীর ছাড়া অস্তিত্ব নেই। এই বাহ্য রূপ, এই ক্ষুধা তৃষ্ণা কামাতুর দেহ নিয়ে তাঁর কত না দুশ্চিন্তা ছিল। ছিল মৃত্যু ভয়। আজও আছে হয় তো। কিন্তু মৃত্যুর ক্ষণিক নৈকট্য তাঁকে অনেক জড়তামুক্ত করেছে। মনে হচ্ছে, সাহসের সঙ্গেই একদিন এই দেহ ছাড়তে পারবেন, যখন সময় হবে।
আসব বাবা?
হেমকান্ত চোখ খুলে হাসলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন, এসো।
তাঁর প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্রটি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। দীর্ঘ গড়ন আর দেবদূতের মতো পবিত্র মুখশ্রী। দেখলেই তাঁর মন ভরে যায়। জায়া শব্দের অর্থ যার ভিতর দিয়ে পুরুষ আবার জন্মগ্রহণ করে। স্ত্রীর ভিতর দিয়ে হেমকান্ত তাঁর পুত্র কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু এই কনিষ্ঠ পুত্রটির দিকে তাকিয়ে তাঁর আজ মনে হল, এই দেবশিশুর মধ্যেই তাঁর জন্মগ্রহণ বুঝি সবচেয়ে সার্থক হয়েছে।
বিছানায় তাঁর পাশে এসে বসল কৃষ্ণকান্ত। মুখখানা শুকনো। চোখদুটো করুণ।
আপনি কেমন আছেন বাবা এখন?
তোমরা ভাল থাকলেই আমি ভাল। এখন আর নিজের একার ভাল থাকাটাকে বেশী মূল্য দিই না। তোমাদের সবাইকে নিয়ে তো আমি।
কথাটা নতুন। ঠিক এরকম কথা হেমকান্তর মুখে কখনো শোনেনি কৃষ্ণকান্ত। সে স্থির করল, কথাটা তার খাতায় টুকে রাখবে। আজকাল সে একটা উদ্ধৃতি লিখে রাখার খাতা করেছে। বাবার কথাটা তার বড় ভাল লাগল।
কৃষ্ণকান্ত বলল, আমি ইস্কুলের সেই ছেলেটাকে ধরেছিলাম।
কোন ছেলেটাকে?
ক্লাস নাইনের চুনীলাল।
সে আবার কি করেছে?
আপনাকে যেদিন স্ট্যাব করা হয় তার কয়েকদিন আগে চুনী আমাকে বলেছিল, স্বদেশীরা নাকি আপনাকে মারতে চায়।
বলেছিল? হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে একটু ভাবলেন। সন্দেহটা ছিলই, এখন সাক্ষ্যেরও সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে যাই হোক, আমাদের ও নিয়ে আর দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ছেলেটা কী বলল?
প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। আমি একটু ভয় দেখাতেই বলল, সে শুনেছে ননীলালবাবুর কাছে।
কোন ননীলাল? মেছোবাজারে যার তামাকের দোকান?
হ্যাঁ।
হেমকান্ত আবার চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, এসব কথা যেন পাঁচ কান না হয় বাবা। স্বদেশীদের মধ্যেও অনেক বাজে লোক আছে। অস্তিত্ব বিপন্ন হলে তারা মরীয়া হয়ে যা খুশি করতে পারে।
কৃষ্ণকান্ত তার বাবার মুখের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে ছিল। মাথা নেড়ে বলল, আমি কাউকে বলিনি। তবে—
তবে কী বাবা?
স্বদেশীদের বোঝা উচিত যে কাজটা অন্যায় হয়েছে।
কিশোর ছেলের মুখে কথাটা শুনে একটু চমকে উঠলেন হেমকান্ত। যেন একজন বড় মানুষ কথা বলছে। তিনি একটু হেসে বললেন, তাদের বোঝাবে কে বলো? কেবল আবেগ নিয়ে যারা চলে তারা সব সময় যুক্তির ধার ধারে না। সত্যকেও অনেক সময় সত্য বলে স্বীকার করতে চায় না। তাদের বোঝাতে গেলেই বরং হিতে বিপরীত হবে। তার দরকার নেই।
কেন দরকার নেই বাবা?
যা করার পুলিশ করবে। এটা তাদেরই কাজ।
পুলিশ কিছু করবে না।
হেমকান্ত অবাক হয়ে বললেন, এ কথা কে বলল তোমাকে?
শুনেছি। দারোগা রামকান্ত রায়ের আপনার ওপর খুব রাগ।
তাই নাকি? কেন বলো তো!
আপনার কাছে নাকি উনি একটা স্টেটমেন্ট চেয়েছিলেন, আপনি তা দেননি।
আমার স্টেটমেন্ট দেওয়ার কথা নয়। লিখিত পড়িত কিছু দেওয়া বিপজ্জনক বলেই আমি দিইনি। শচীনও বারণ করেছিল।
সেই জন্যই রাগ। আপনাকে স্ট্যাব করে যারা পালিয়েছে তাদের ধরার জন্য পুলিশ কিছুই করেনি।
হেমকান্ত উদাস গলায় বললেন, তাদের ধরেই বা কি হবে বলো তো! হয় জেল-এ আটকে রাখবে নয়তো ফাঁসি দেবে। তাতে আরো রাগ বাড়বে ওদের।
কৃষ্ণকান্ত চুপ করে থমথমে মুখে চেয়ে থাকে। দাঁতে দাঁত দৃঢ়বদ্ধ। চোখে রাগ, জল।
হেমকান্ত সস্নেহে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, আমার জন্য ভেবো না। মানুষের জীবনের একটা সীমারেখা আছে। সেটা পেরোনো যায় না। কিন্তু তা বলে সে শেষও হয় না। পুত্র কন্যাদের মধ্যে বেঁচে থাকে।
কৃষ্ণকান্ত তার বাবার দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে বলে, না বাবা, না।
না কেন কৃষ্ণ? আমার তো মনে হয় জীবনের সব কাজ আমার ফুরিয়েছে। আমার আর কিছু করার নেই। এই তো বিদায় হওয়ার সঠিক সময়।
কৃষ্ণকান্তর চোখ বেয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ে।
হেমকান্তও কাঁদলেন। বহু দিন পর বুক-ভাঙা এক শোক অনুভব করছেন আজ। আশ্চর্য, সেই শোক নিজেরই জন্য। ছেলের পিঠে হাত রেখে অবরুদ্ধ গলায় অস্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, আমার তো মনে হয়, তোমার মতো উজ্জ্বল একটি ছেলের বাবা হওয়াই আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল, এখন তুমি যদি বেঁচে থাকো, মানুষের মতো মানুষ হও, তবে আর চিন্তা কী?
আপনি ওকথা বলছেন কেন বাবা? আপনার শরীর খারাপ নয় তো?
না। আমি তো ভালই আছি। ভাবছিলাম, যদি আবার কেউ আমাকে মারে? আমি রাজনীতি জানি না, বুঝি না। তা নিয়ে আমার চিন্তাও নেই। আমি শুধু বুঝি, স্বদেশীর রূপ ধরে যে মারতে আসবে সে আমার নিয়তি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
মনুপিসি তো বলছে, আপনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবে।
বাপের ভিটে ছেড়ে কোথায় যাবো বাবা? কলকাতাই কি আর বাঁচিয়ে রাখবে? সেখানেও মরণ আছে। তাছাড়া সেখানে কনক সংসার পেতে বসেছে। আমি গেলে ওদের অসুবিধে হবে।
কৃষ্ণকান্ত কী বলবে? চুপ করে রইল।
হেমকান্ত চোখ বুজে ধীর স্বরে স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগলেন, এই নদী, গাছপালা, বাগান, এই নরম মাটির গন্ধ, কত স্মৃতি এসব ছেড়ে কোথায় যাবো? মানুষের বাড়ি কিরকম জানো? সে শুধু ইট কাঠ পাথর তো নয়। বংশানুক্রমে একটি পরিবারের বসবাসের ফলে সেখানে একটা প্রাণ জেগে ওঠে। তুমি কি তা টের পাও?
কৃষ্ণকান্ত কান্না গিলে বাবার দিকে বিস্ময়ভরে চেয়ে ছিল। এরকম তারও মনে হয়। তবে শুধু ঐ বাড়ি নয়, তার চারপাশে যা কিছু আছে সব কিছুর মধ্যেই একটা জীবনের আভাস পায় সে। কাকার যে ঘরখানায় সে থাকে তার বাতাসে আজও সে কাকার শ্বাসের শব্দ পায়। তার তো প্রায়ই মনে হয়েছে, তার মা দেহহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, দোতলার রেলিং ধরে ঝুঁকে তাকে রোজ দেখে, যখন সে ঘোড়ায় চড়ে বা সাইকেল চালায়। মৃতেরা যে সবাই বেঁচে আছে এটা শুধু সে বিশ্বাসই করে না, সে জানে।
সে বলল, করি বাবা।
হেমকান্ত স্বপ্নাতুর চোখে ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। তার মধ্যে নানা দুঃসাহসী স্বপ্ন জেগে ওঠে। ছেলেকে নিয়ে সকলেই স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ তা নয়। নিজের এই ছেলেটির মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি আছে বলে তিনি টের পান।
ক্লান্ত হেমকান্ত চোখ বুজলেন।
আপনি ঘুমোন আমি যাই।
রোসো। একটু বসে থাকো আমার কাছে। তোমার বড়দা মেজদা সব কোথায়?
ওঁরা বেরিয়ে গেছেন। বউদি আর দিদিরা সব নিচের বৈঠকখানায় পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন।
ওরা খুব নিশ্চিন্ত, না? ভাল। খুব ভাল।
আপনার শরীর ভাল নয় বলে ডাক্তার এ ঘরে ভীড় করতে বারণ করেছেন।
হ্যাঁ। শরীরটা ভাল নয় ঠিকই। বড় ক্লান্ত। তবে কেউ কেউ কাছে থাকলে ভাল লাগে, এই যে তুমি বসে আছো কাছে, তাতে আমার খুব ভাল লাগছে।
তার প্রতি হেমকান্তর বিশেষ দুর্বলতার কথা কৃষ্ণকান্ত জানে। তাই সে লজ্জায় মুখ টিপে একটু হাসল। হেমকান্ত তার একখানা হাত ধরে থেকে চোখ বুজে রইলেন।
দুটি রক্তস্রোত পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
রামকান্ত রায় এলেন বিকেলে, তাঁর চেহারায় একটা দৃপ্ত স্পর্ধিত ভাব দেখা যাচ্ছিল। ঘোড়া থেকে নেমে গটগট করে ওপরে উঠে এলেন। কারো অনুমতি নেওয়ার তেমন প্রয়োজন বোধ করলেন না।
হেমকান্তকে ছানা খাওয়ানো হয়েছে একটু আগে। উঁচু তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে বড় আর মেজো ছেলের সঙ্গে মৃদু স্বরে কথা বলছিলেন। রামকান্ত রায় ঘরে ঢোকায় কনককান্তি বিরক্ত হল। বলল, কী চাইছেন আবার? এজাহার তো অনেক নেওয়া হয়েছে!
রামকান্ত রায় একটু মাথা উঁচু করে বললেন, আরো নিতে হবে। আপনারা যদি একটু ঘরের বাইরে যান তাহলে ভাল হয়।
কনক উঠে দাঁড়িয়ে একটু উষ্মার সঙ্গে বলে, স্ট্যাবিং-এর পর দশ এগারো দিন কেটে গেছে, এখনো আপনারা কাউকে অ্যারেস্ট করতে পারেন নি। কিন্তু একজন সিরিয়াস উণ্ডেড লোককে খামোকা বকবক করিয়ে মারছেন। এটা কেমন কথা?
রামকান্ত রায় তাঁর আলিসান দেহটি নিয়ে স্তম্ভের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন শুধু। জবাব দিলেন না। স্থির দৃষ্টি হেমকান্তব মুখে নিবদ্ধ।
হেমকান্ত ছেলেদের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা যাও। কথা বলতে হলে বলব চিন্তার কিছু নেই।
ছেলেরা চলে গেল।
হেমকান্ত বললেন, বসুন। কী খবর?
খবর একটা আছে। লোকটা ধরা পড়েছে।
হেমকান্ত চমকে উঠে বললেন, কে?
বলব। আপনিই তাকে আইডেনটিফাই করবেন।
হেমকান্ত চিন্তিত মুখে বললেন, সনাক্ত করব? কিন্তু আমি যে তাকে ভাল করে দেখিনি। অন্ধকার ছিল। আপনি তো জানেন।
সবই জানি। কিন্তু তবু কিছু লক্ষণ ঠিকই মেলাতে পারবেন। ধরুন হাইট, গলার স্বর, হাতের গড়ন এইসব কিছু না কিছু।
যা মনে পড়েছে সবই বলেছি।
এইবার লোকটাকে চোখে দেখুন। হয়তো আরো কিছু মনে পড়বে।
কবে যেতে হবে?
আপনি এখন কেমন আছেন? থানায় যেতে পারবেন?
আজ পারব না।
আজ নয় যেদিন পারবেন সেদিন গেলেই হবে। তবে দেরী করা চলবে না।
হেমকান্ত চুপ করে রইলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটা ধরা পড়ুক তা তিনি চাননি।
আচমকা রামকান্ত রায় বললেন, হেমকান্তবাবু একটা কথা বলব?
বলুন।
আমার প্রথম থেকেই কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি লোকটাকে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু বলতে চাইছেন না।