2 of 2

৭৫. অস্থায়ী মন্দির বানিয়েছেন অরবিন্দ

বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই একটি অস্থায়ী মন্দির বানিয়েছেন অরবিন্দ। দেখতে সাধারণ কুটিরের মতন। তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বগলা মূর্তি। সোনায় মোড়া এই মূর্তিটি অরবিন্দ নিজ ব্যয়ে প্রস্তুত করিয়েছেন। সিংহাসনে উপবিষ্টা এই দেবী পীতবর্ণা, পীত আভরণ ও পীতবর্ণ মালা পরে আছেন গলায়। গম্ভীর আকৃতি, যেন সব সময় মদোন্মত্তা, স্তনযুগল দৃঢ় ও স্কুল, দেবীর ডান হাতে মুগুর, অন্য হাতে এক প্রতিস্পর্ধীর জিভ টেনে ধরে আছেন। মুগুরের আঘাতে তিনি শত্রুকে দমন করার জন্য উদ্যত।

একজন ব্রাহ্মণ পূজারী নিযুক্ত হয়েছে, তা ছাড়া অরবিন্দ নিজে প্রতিদিন অতি ভোরে উঠে স্নান সেরে নিয়ে সেই দেবীমূর্তির সামনে ধ্যানে বসেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তখন যেন তাঁর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। দুপুরবেলা কলেজে পড়াতে যান বটে, কিন্তু সন্ধের পরই আবার সেই কুটিরে বসে পূজারীটির নির্দেশে তন্ত্রমতে সাধনা শুরু করেন।

ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান, প্রায় আবাল্য ইংলন্ডে লালিত পালিত অরবিন্দ এখন ঘোরতর হিন্দু। শরীর-মন থেকে বিলিতি গন্ধ পুরোপুরি মুছে ফেলতে চান। মাঝে মাঝেই শরীরে ছাই মাখা জটাজুটধারী যোগীরা আসেন তাঁর কাছে, তিনি নিভৃতে শাস্ত্র আলোচনা করেন তাঁদের সঙ্গে।

বরোদায় অরবিন্দর পরিচিত দু-চারজন ব্যক্তি আগে মাঝে মাঝেই গল্পগুজব করতে আসতেন এ বাড়িতে। কাব্যশাস্ত্র নিয়ে তর্কবিতর্ক হত, পেয়ালার পর পেয়ালা চা ও প্রচুর সিগারেটের ধোঁয়া উড়ত, এখন তাঁরা এসে অরবিন্দকে প্রায় সব সময় পূজার ঘরে দেখে নিরাশ হয়ে ফিরে যান।

হিন্দুর ছেলে আবার স্বধর্মে ফিরে এসেছে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবু কয়েকজন বলাবলি করেন যে হিন্দু ধর্মে এত দেব-দেবী থাকতে অরবিন্দ হঠাৎ ভয়ংকরী বগলা মূর্তি পূজায় মেতে উঠলেন কেন? দশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত এই বগলামুখী দেবীর আরাধনা সাধারণত গৃহস্থবাড়িতে হয় না। তান্ত্রিকেরা এই মূর্তির সামনে সাধনা করেন শত্রু বধের জন্য। অরবিন্দ ঘোষের তেমন শত্রু কে? এই নিরীহ, শান্ত, লাজুক, মৃদুভাষী অধ্যাপকটির কোনও শত্রু থাকতে পারে বলে বিশ্বাসই হয় না।

ব্যক্তিগতভাবে অরবিন্দর কোনও শত্রু নেই। মাতৃস্নেহবঞ্চিত অরবিন্দ এই দেশকেই মা বলে মেনেছেন। দেশের শত্রুই তাঁর চিরশত্রু। যতদিন না এই শত্রুকে বিতাড়িত করা যায়, ততদিন তাঁর মনে এক ফোঁটা শান্তি নেই। অরবিন্দর এই যে ধর্মাচরণ, তা নিছক নিজের আত্মিক উন্নতির জন্য নয়, দেশজননীকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করাই তাঁর পরম উদ্দেশ্য। কয়েকবছর আগে বারীন ও যতীনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে গেছে। অরবিন্দ তবু হাল ছেড়ে দেননি। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বুঝেছেন, এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ বা ধর্মভীরু, সাধারণভাবে ডাক দিলে অনেকে সমবেত হবে না, দু-চারজন এলেও দলাদলি, ঝগড়া শুরু করবে। কিন্তু ধর্মের নামে অনেককে একত্র করা যায়, ধর্মের নামে অনেক মানুষ যে-কোনও শপথ নিতেও প্রস্তুত।

অরবিন্দ অনেকদিন থেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত। আনন্দমঠ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র দশপ্রহরণধারিণী দুগাঁর মূর্তি বর্ণনা করেছেন, সেই মূর্তির পদতলে বসে সংগঠিত হয়েছিল সন্তান সৈন্যদল। অরবিন্দ দুগার বদলে বগলামুখী দেবীকে বেছে নিয়েছেন, তার কারণ এই দেবী আরও হিংস্র, আরও ক্ষিপ্র! আনন্দমঠ প্রায় একটি কল্পিত কাহিনী, অরবিন্দ চান কোনও গোপন স্থলে সত্যি সত্যি একটি ভবানী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হোক, সেখানে সাধনা-আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে শত শত যুবককে দেওয়া হবে অস্ত্রশিক্ষা। দেবীমূর্তির সামনে দেশের জন্য জীবন দান করতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে, তারপর ছড়িয়ে পড়বে বিপ্লবের আগুন। এই পরিকল্পনা নিয়ে অরবিন্দ ‘ভবানী মন্দির নামে একটি পুস্তিকা লিখতেও শুরু করেছেন।

বারীন এখন এখানেই থাকে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়, আবার ফিরে আসে। কাজকর্ম কিছু করে না, তবে বারীনের লঘু স্বভাবের কিছুটা বদল হয়েছে। সে অনেক বইপত্র পড়ে, কিছু লেখালিখিও করে।

বাড়িতে কোনও নারী না থাকলে সংসারের শ্রী থাকে না। বিবাহ করলেন বটে, তবু অরবিন্দর বিবাহিত জীবন ঠিক পরিপূর্ণতা পেল না, মৃণালিনী থাকতে চান না বরোদায়। বাপের বাড়িতেও মৃণালিনীর স্বস্তি নেই। কেউ কেউ তাঁর স্বামীর নামে আভাসে-ইঙ্গিতে খোঁটা দেয়। সবাই বলে, মৃণালিনীর স্বামী প্রকাণ্ড বিদ্বান ও অসাধারণ পুরুষ, কিন্তু তিনি সারাজীবন বরোদার মতন একটি ছোট জায়গায় অধ্যাপকগিরি করে যাবেন? এতে অসাধারণত্ব কোথায়? কলকাতায় এলে অন্য চাকুরিতে কত উন্নতি হতে পারত, অরবিন্দর উন্নতির কোনও চেষ্টাই নেই। অধ্যাপকগিরিতে কতই বা উপার্জন হবে!

মৃণালিনী অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লেখেন। সে চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে মাথা নাড়েন অরবিন্দ। উন্নতি? না, কোনও দিন হবে না। তাঁর মাথায় যে একটা পোকা ঢুকে আছে, চাকরির উন্নতির চেষ্টা করার জন্য তিনি জন্মাননি।

স্ত্রীকে বোঝাবার জন্য অরবিন্দ এক দিন একটা লম্বা চিঠি লিখলেন : প্রিয়তমে মৃণালিনী, তুমি যে রকম উন্নতি চাও, তা আমার হবে কী করে? আমার মাথায় যে তিনটে পাগলামি আছে!

প্রথম পাগলামি হচ্ছে, নিতান্ত সাধারণ মানুষের মতন খেয়ে পরে থেকে আমার উপার্জনের বাকি টাকা আমি দেশের অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাই। এ দেশে আমার তিরিশ কোটি ভাইবোন আছে, তাদের মধ্যে অনেকে অনাহারে মরছে। অধিকাংশই দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়ে কোনও রকমে টিকে থাকে। তাদের হিত করব না!

দ্বিতীয় পাগলামিটা সম্প্রতি আমার ঘাড়ে চেপেছে। যে-কোনও উপায়ে ভগবানের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করতে হবে। …ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করবার, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার কোনও না কোনও পথ অবশ্যই থাকবে। সে পথ যতই দুর্গম হোক, আমি সে পথে যাবার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে বসেছি।

আর তৃতীয় পাগলামিটা কী জানো? অনেক লোকই স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলো মাঠ, খেত, বন, পর্বত, নদী বলে জানে। আমি স্বদেশকে মা বলে জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মায়ের বুকের ওপর বসে যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত হয়, তা হলে ছেলে কী করে? নিশ্চিন্তভাবে খাওয়া দাওয়া করতে বসে, স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ প্রমোদ করতে বসে, না মাকে উদ্ধার করার জন্য দৌড়ে যায়? আমি জানি, এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করার বল আমার আছে, শারীরিক বল নয়, তলোয়ার-বন্দুক নিয়ে আমি যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। জ্ঞানের বল। ক্ষাত্র তেজ একমাত্র তেজ নয়, ব্ৰহ্মতেজও আছে। সেই তেজ জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

শেষ দিকটা একটু ধোঁয়াটে করে রাখলেন অরবিন্দ। শুধু জ্ঞান নয়, তিনি যে তলোয়ার বন্দুক নিয়েও যুদ্ধ শুরু করার পক্ষপাতী, সে কথা আর জানালেন না। মৃণালিনীর পিতা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী, কোনওক্রমে এই চিঠি তাঁর হাতে পড়লে বিপর্যয় হতে পারে।

বারীনের তেমন পূজো-আচ্চায় মতি নেই। দাদার ধর্মাচরণ সে খানিকটা কৌতূহলের চোখে দেখে। দাদার সঙ্গে ইদানীং কথাবার্তারও সুযোগ ঘটে না। একদিন সে অরবিন্দকে বলল, সেজদা, তুমি ‘পাইয়োনিয়ার’ পত্রিকাটি পড়েছ? সত্যি সত্যি বাংলা দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তাই নিয়ে কলকাতায় ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়েছে। আমি

অরবিন্দ কাগজ পড়েননি, কিন্তু কলেজ লাইব্রেরিতে এই আলোচনা শুনে এসেছেন। অন্য অধ্যাপকরা বলাবলি করছে যে বাঙালিরা সরাসরি ইংরেজ বিরোধিতায় নেমে পড়েছে, সমস্ত বিদেশি দ্রব্য বর্জন শুরু হয়ে গেছে। ইংরেজদের দোকানপাটে কেউ যায় না, বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কেউ বিদেশি পোশাক পরে রাস্তায় বেরুলেও অন্য লোকেরা তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। এমনকী ছাত্ররাও বলে দিয়েছে, তারা সরকারি স্কুল কলেজে আর পড়তে যাবে না। এমন. কাণ্ড ভূ-ভারতে কখনও হয়নি। বাঙালিরা এত সাহস পেল কী করে?

অরবিন্দ জিজ্ঞেস করলেন, এই আন্দোলন কারা চালাচ্ছে? পেছনে কোন দল আছে?

বারীন বলল, সব কাগজেই এই আন্দোলনের খবর ছাপছে। কোনও দলের তো উল্লেখ দেখি। কংগ্রেস থেকে কোনও প্রস্তাব নেওয়া হয়নি। কোনও কোনও নেতা অবশ্য প্রকাশ্যে সমর্থন জানাচ্ছেন, কেউ কেউ আড়ালে আছেন। সুরেন বাঁড়জ্যেকে তো জানোই, যতটা নরম, ততটা গরম হতে পারেন না। স্বদেশি আন্দোলন চালিয়ে যাবার পক্ষপাতী, কিন্তু ছেলেরা সরকারি স্কুল কলেজ বর্জন করুক তা তিনি চান না।

অরবিন্দ বললেন, অবশ্যই বর্জন করা উচিত। ও সব জায়গায় তো গোলামির শিক্ষা দেওয়া হয়। ওরকম শিক্ষা না পেলেও ক্ষতি নেই!

বারীন বলল, একটা কাগজে একটা অদ্ভুত ঘটনা লিখেছে। বাগবাজারের একটা বাড়িতে একটা ছ’ বছরের ছেলের খুব অসুখ। তার বাবা ডাক্তার ডেকে এনে দেখাবার পর তাকে যেই ওষুধ খাওয়াতে গেছেন, অমনি ছেলেটা চিৎকার করে উঠল, না, বিদেশি ওষুধ খাব না, কিছুতেই খাব না, কবিরাজি ওষুধ খাব। …ওইটুকু ছেলেও যদি এরকম কথা বলে, তা হলে ব্যাপারটা কতখানি ছড়িয়েছে ভেবে দ্যাখো!

অরবিন্দ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ইদানীং তিনি সিগারেট কম খান, ব্র্যান্ডি পানও কমিয়ে দিয়েছেন। চক্ষু মুদে যেন ধ্যানমগ্ন অবস্থা। তারপর চোখ খুলে বললেন, কলকাতায় এ রকম কাণ্ড ঘটছে, তুই এখানে বসে থেকে কী করবি? তুই কলকাতায় চলে যা।

বারীন বলল, আমিও সেই কথা ভাবছিলাম। মনটা উতলা হয়ে আছে। বয়কট আন্দোলন স্বচক্ষে দেখতে চাই।

অরবিন্দ বললেন, শুধু দেখলে চলবে না। পুরনো সঙ্গী-সাথিদের আবার জোগাড় কর। আন্দোলন যেন ঝিমিয়ে না পড়ে, সব সময় তাতিয়ে রাখতে হবে!

বারীন জিজ্ঞেস করল, সেজদা, তুমি যাবে না? তোমার যেতে ইচ্ছে করছে না?

অরবিন্দ বললেন, ইচ্ছে তো করছে অবশ্যই। মনের মধ্যে একটা নির্দেশ পেয়েছি, বরোদা ছেড়ে আরও বৃহত্তর কেন্দ্রে আমাকে যেতে হবে। এখানকার সব কিছু গুটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করি, কলকাতার আন্দোলন আরও জোরদার হলে আমি অবশ্যই গিয়ে উপস্থিত হব। তুই কাল-পরশুই রওনা হ।

বারীন বলল, কলকাতায় গিয়ে থাকব কোথায়?

অরবিন্দ বললেন, প্রথমে গিয়ে আমার শ্বশুরবাড়িতেই উঠতে পারিস। তারপর অন্য আস্তানা খুঁজে নিবি।

বারীন বলল, সেজদা, আমি আর একটা কথা ভাবছিলাম। নিজেদের একটা কাগজ বার করলে কেমন হয়? এখন প্রকাশ্যেই অনেক কথা ঘোষণা করা দরকার।

অরবিন্দ বললেন, সেও খুব ভাল কথা। দেখ যদি পারিস। একা তো কাগজ চালানো যায়, দলবল জোগাড় করতে হবে। দুটো কাগজ বার করা দরকার, একটা ইংরেজি, একটা বাংলা।

বারীন কলকাতায় পৌঁছল বেলা এগারোটায়। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে তাকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। জাহাজ চলাচলের জন্য হাওড়া ব্রিজ খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন ওপারে যাওয়া যাবে না। যাত্রীরা গঙ্গার ধারে ভিড় করে আছে, ফেরিওয়ালারা চিনেবাদাম, ফুটকড়াই, গোলাবি রেউড়ি বিক্রি করছে ঘুরে ঘুরে। এক জায়গায় গোটা চারেক যুবক, মনে হয় কলেজের ছাত্র, গান জুড়েছে সমস্বরে। তাদের খালি পা, পরনে ধুতি, উধ্বাঙ্গে জামা নেই, শুধু একটা চাদর জড়ানো।

বারীন কৌতূহলী হয়ে সেখানে গিয়ে উঁকি দিল। ভদ্র বংশের ছেলেদের এমন ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে আগে সে কখনও দেখেনি। গানটিও নতুন, অশ্রুতপূর্ব।

আমার সোনার বাংলা, আমি
তোমায় ভালবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
তার আমার প্রাণে, ও মা আমার প্রাণে
বাজায় বাঁশি…

গানটির সরল আবেগ সোজাসুজি বুকে এসে ধাক্কা দেয়। এ গানের সুরেও যেন বাংলার বাতাস হিল্লোলিত হচ্ছে। বারীন পাশের এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ মশাই, এ গানটি কার রচনা?

লোকটি বলল, জানেন না! কবিবর রবীন্দ্রবাবু বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এই গানটি লিখে দিয়েছেন।

বারীন বিস্মিত হল। রবীন্দ্রবাবুর কিছু কিছু গান সে আগে শুনেছে, সেগুলি ভক্তিগীতি কিংবা প্রেমগীতি। প্রধানত ব্রাহ্মরাই তাঁর গান গায়, এখন তাঁর গান রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে?

একটু পরে বারীন নিজেই অস্ফুট স্বরে গাইতে লাগল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি…

ব্রিজ যুক্ত হওয়ায় বারীন চলে এল এপারে। সঙ্গে মালপত্র বিশেষ নেই, সে হেঁটেই যাবে। কিছুদূর যাবার পর বড়বাজারে সে দেখল আর এক দৃশ্য! একটা মস্ত বড় দোকানের সামনে ভিড় জমে আছে। একদল তরুণ হাতে হাত ধরে শৃঙ্খল রচনা করে ঘিরে আছে সেই দোকান, কোনও খরিদ্দারকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেবে না। দোকানের কর্মচারীরা পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, লাঠি হাতে দু’জন সেপাইও রয়েছে ভিড়ের পেছনে।

এখানেও মাথায় গেরুয়া পাগড়ি বাঁধা একজন লোক নেচেনেচে গান জুড়েছে :

মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নে রে ভাই
দীন দুখিনী মা যে তোদর
তার বেশি আর সাধ্য নাই।
ঐ মোটা সতোর সঙ্গে মায়ের
অপার স্নেহ দেখতে পাই
আমরা এমনি পাষাণ
তা ফেলে ঐ
পরের দোরে ভিক্ষে চাই…

গানের মাঝখানেই ছুটতে ছুটতে চলে এল আরও কয়েকজন সেপাই, সঙ্গে একজন গোরা পুলিশ। হঠো হঠো হঠো বলে ভিড় সরিয়ে ভেঙে দিল সেই মানব-শৃঙ্খল। জনতা কোনও প্রতিবাদ করল না। সরে গেল একটু দূরে।

গায়কটি সেখান থেকেই আবার গান ধরল :

ঐ দুঃখী মায়ের ঘরে তোদের
সবার প্রচুর অন্ন নাই
গত তব, তাই বেচে কাঁচ-সাবান-মোজা
কিনে কল্লি ঘর বোঝাই।

আয় রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা করবো
ভাই পরের জিনিস কিনবো না যদি
মায়ের ঘরের জিনিস পাই…

অনেক বক্তৃতার চেয়েও একটি গানের আবেদন বেশি তীব্র। লোকেরা ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছে, কেউ কেউ সুর মেলাচ্ছে নিজেদের গলায়। একটা গান শেষ হলেই অনুরোধ আসছে আর একটা, আর একটা।

দোকানের সামনেটা পরিষ্কার হয়ে যাবার পর একজন মাত্র খরিদ্দার এগিয়ে গেল সেদিকে। লোকটির পরনে ঠেঙো ধুতি, গায়ে চায়না কোট। সে দোকানের সিঁড়িতে পা দেওয়া মাত্র এদিকের জনতা চেঁচিয়ে উঠল, দুয়ো, দুয়ো, দুয়ো!

লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কম্পিত গলায় বলল, বাবাসকল, আমাকে মাপ করে দাও! আমার কন্যাদায়। আজ বাদে কাল মেয়ের বিয়ে। জামাইয়ের একখানাও ধুতি কেনা হয়নি।

কয়েকজন বলে উঠল, জামাইকে বিলিতি ধুতি দিতে হবে? কন্যা বুঝি মেমসাহেব? a লোকটি বলল, বিবাহের বস্ত্র কি আজেবাজে দেওয়া যায়? ইয়ে, মানে, দিশি ধুতি বা পাই কই? কোনও দোকানে মেলে না।

একজন জানাল, পটলডাঙার স্বদেশি ভাণ্ডারে চলে যান, সেখানে অনেক গুজরাটি ধুতি মজুদ আছে।

লোকটি তবু অনুনয় করে বলল, এবারের মতন একখানা ভাল ধুতি কিনতে দাও বাবাসকল। মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছি!

একজন বলল, ম্যাঞ্চেস্টারের ধুতিটি ভাল ধুতি কে বলেছে?

আর একজন বলল, বরকে বিলিতি ধুতি পরালে পুরুত মন্ত্র পড়াতে রাজি হবে না। আপনার বাড়িতে ধোপা-নাপিত যাবে না!

আর একজন বলল, শালিরা বরের কাছা খুলে দেবে!

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

লোকটি করুণভাবে একবার দোকানের দিকে তাকিয়ে নেমে এল গুটিগুটি। অমনি মুহুর্মুহু করতালি। একদল লোক ছুটে গিয়ে লোকটিকে কাঁধে তুলে নাচতে লাগল।

রাস্তায় কয়েক পা যেতে যেতে এই রকমই দৃশ্য। সারা শহরে যেন একটা উৎসব লেগে গেছে। কলকাতার এই রূপ বারীন আগে কখনও দেখেনি। কোথাও কোথাও কৌতুকরস বেশি গাঢ়। বিলিতি পাম্প শু পরে সেজেগুঁজে যাচ্ছেন এক ভদ্রলোক, একদল ছেলে তাকে ঘিরে ধরে নেচে নেচে হাততালি দিতে লাগল। অন্য পথচারীরা থমকে গিয়ে হাসছে। শেষ পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হয়ে ভদ্রলোক পা থেকে জুতো জোড়া খুলে ফেললেন। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ছেলেরা বলতে লাগল, জামাটা, জামাটাও তো বিলেতি? আর ওই রিস্ট ওয়াচ?

এই বয়কটের সময়ই ঠিক মতন অনুভব করা গেল ইংরেজদের শোষণের স্বরূপ। পায়ের জুতো থেকে মাথার চিরুনি পর্যন্ত বিলেত থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে কিছু কিছু যাও বা তৈরি হয়, তা প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য। এ দেশে কলকারখানা শিল্প স্থাপনে ইংরেজ আগ্রহী নয়, তাতে তাদের মুনাফায় টান পড়বে। গায়ে মাখা সাবান, দেশলাই সব বিলিতি। ট্রেনে চাপো, ট্রামে ওঠো, ইংরেজকে পয়সা দাও!

একটা দোকানের পিকেটিং থেকে বেরিয়ে এসে একদল যুবক বলল, চল, জোড়াসাঁকো ঘুরে আসি। রবিবাবু যদি নতুন গান বাঁধেন, সেটা শিখতে হবে!

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সামনে প্রতিদিনই দলে দলে লোক আসে। তারা রবীন্দ্রনাথের গান চায়। তাঁর গান গেয়ে ও শুনিয়ে জোরদার হয় আন্দোলন। পাড়ায় পাড়ায় গানের স্কুল খোলা হয়েছে, সেখানে শেখানো হচ্ছে এই সব গান।

বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব যখন ওঠে, তখন রবীন্দ্রনাথ বিশেষ সাড়া দেননি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, প্রতিবাদসভা ও মিছিল শুরু হয়ে গেল, তার কোনওটিতেই যোগ দেননি রবীন্দ্রনাথ। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কলমও ধরেননি। তাঁর এই অমনোযোগ অনেককে বিস্মিত করেছিল।

এই সময় অন্য ব্যাপারেও ব্যস্ত থাকতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। বছরের গোড়ার দিকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ। সাতাশি বছর বয়েস হলেও দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু শুধু তিনটি ব্রাহ্মসমাজেই নয়, সারা বাংলাতেই মহাগুরু নিপাতের মতন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর শেষ উইলে এক্সিকিউটর হিসেবে অন্য জীবিত পুত্রদের বাদ দিয়ে শুধু রবীন্দ্রনাথকেই নিযুক্ত করেছেন, সঙ্গে আর দুজন নাতি দ্বিপেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ। কনিষ্ঠ পুত্র ছাড়া অন্য পুত্রদের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি পিতা। এ জন্য সম্পত্তির হিসেবনিকেশ, জোড়াসাঁকোর অত বড় বাড়ির ব্যবস্থাপনা, এ সব নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। ত্রিপুরার রাজপরিবারে একটা সঙ্কট ঘনিয়ে এসেছিল, তা থেকেও বিযুক্ত থাকতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। মহারাজ রাধাকিশোর তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র, মহারাজও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শের ওপর নির্ভর করেন। এর মধ্যে শরীরও বিশেষ ভাল নয়, অর্শের ব্যথা শুরু হয়েছে, তাই নিয়েও শান্তিনিকেতনে যাতায়াত তো আছেই। মাঝে মাঝে গিরিডিতে গিয়ে থাকলে স্বাস্থ্য ভাল বোধ করেন, গিরিডির জল-বাতাস সুস্থতা এনে দেয়।

বঙ্গভঙ্গ সত্যি সত্যি কার্যকর হতে যাচ্ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। বাংলা সত্যি খণ্ড বিখণ্ড হবে, এ কি সত্যি সম্ভব! বাঙালি তা মেনে নেবে! বাঙালির মধ্যে যে একটা জাতীয়তাবোধ জেগে উঠছে সেটা ভেঙে দেওয়াই ইংরেজদের উদ্দেশ্য। শাসনকার্যের সুবিধের জন্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতন এত বড় রাজ্যকে ভাগ করতে হলে বিহার ও ওড়িশাকে পৃথক করে দেবার যুক্তি বোঝা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী জেলাগুলিকে কেন জুড়ে দেওয়া হবে আসামের সঙ্গে? স্যার হেনরি কটন ইংরেজ সরকারেরই দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, তিনিও বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ অন্যায়।

এ যেন বাঙালির ঐক্যের মূলে কুঠারাঘাত। বাংলা ভাষার প্রসারের বিরুদ্ধতা। রবীন্দ্রনাথের মনে প্রবল প্রতিবাদ গুমরে উঠল। সেই প্রতিবাদ প্রথম ধ্বনিত হল গানে। এর আগে তিনি রচনা করছিলেন ‘তবু পারি না সঁপিতে প্রাণ’ কিংবা ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’র মতন গান। শান্তিনিকেতনে এক নির্জন রাত্রে তাঁর বুক থেকে উৎসারিত হল অন্য রকম গানের কলি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। শিলাইদহের গগন হরকরা নামের ডাকপিওনটি প্রায়ই তাঁকে গান শোনাত, তার একটি গান ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’, এর সুরটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয়েছিল। সেই সুর লাগিয়ে দিলেন সোনার বাংলা গানটিতে। দু-একজনকে শোনাবার পরই গানটি মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল। তাঁর আর কোনও গান এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়নি, মিছিলে মিছিলে শোনা যায় এই গান।

এর পর গিরিডিতে গিয়ে রচনা করতে লাগলেন একটার পর একটা দেশাত্মবোধক গান : ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা’, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ক, আমি তোমায় ছাড়বো না মা’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, ‘তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে, তা বলে ভাবনা করা চলবে না, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে’, ‘আমি ভয় করবো না ভয় করবো না, দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না’, ‘ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিস নে ভাই’, ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ‘আপনি অবশ হলি, তবে বল দিবি তুই কারে?’, ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু এবার ওগো কর্ণধার, তোমারে করি নমস্কার’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান! এ রকম আরও অনেক গান।

প্রতিবাদ আন্দোলন বা বিপ্লবের সময় যে-যার নিজস্ব অস্ত্র হাতে তুলে নেবে। কবির অস্ত্র তাঁর কবিতা। কলমের বদলে তাঁর অপটু হাতে বন্দুক মানায় না। তবু কবিকেও কখনও কখনও রণক্ষেত্রে যেতে হয়, যেতে হয় সভা-সমিতিতে, মিছিলে। এখন আর সভা-সমিতির ডাক উপেক্ষা করতে পারছেন না রবীন্দ্রনাথ, গিরিডি থেকে মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে মিটিং-এ যোগ দেন, প্রবন্ধ পাঠ করেন, গান শোনাতে হয়। তিনি বয়কটেরও সমর্থক। তিনি মনে করেন, ইংরেজের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বর্জন করে এই জাতি আত্মশক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠুক। এমনকী সংবাদপত্রে কালো বর্ডার দিয়ে বঙ্গভঙ্গের খবর ছাপা কিংবা সভায় দর্শকদের করতালিও তিনি পছন্দ করেন না, এগুলোও বিদেশের অনুকরণ।

সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন অনুযায়ী বলবৎ হবে। দেশের মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও মূল্যই দিল না ইংরেজ প্রভুরা। দেশের মানুষও বুঝিয়ে দেবে তাদের ক্রোধ। ওই দিন রাজধানী কলকাতায় হরতাল ডাকা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আর গিরিডিতে থাকতে পারলেন না, ওই দিন তাঁকে কলকাতায় উপস্থিত থাকতেই হবে।

রাত্রিবেলা ট্রেন ছুটে চলেছে, রবীন্দ্রনাথের ঘুম আসছে না। আর মাত্র সাত দিন পরে দ্বিধাবিভক্ত হবে বাঙালি জাতি? কিছুতেই যেন এটা সহ্য করা যায় না। খাতা খুলে রচনা করতে লাগলেন আর একটি নতুন গান :

ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে
মোদের ততই বাঁধন টুটবে
ওরে হতহ আখি রক্ত হবে মোদের আখ ফুটবে
ততই মোদের আঁখি ফুটবে…

১৬ অক্টোবর কলকাতায় হরতাল ডাকা হয়েছে। বিভিন্ন সভায় নেতারা ঘোষণা করেছেন, সেদিন কোনও বাড়িতে উনুনও জ্বলবে না, বাঙালিরা অরন্ধন পালন করবে। শাসনের ছুরি দিয়ে মানচিত্র বদলালেও বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন। উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ পরস্পরের হাতে হলুদ রঙের তিন সুতোর রাখি বেঁধে দেবে, তার মন্ত্র হবে : ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই, ভেদ নাই!

ঘোষণা তো করা হয়েছে, কিন্তু সব মানুষ মানবে তো? সর্বস্তরে এমন হরতালের কথা আগে কেউ কখনও শোনেনি। একটা দিন ভাত না খেয়ে থাকতে রাজি হবে সবাই? রাখিবন্ধন উপলক্ষে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়!

ওই দিনটি পালনের জন্য ঠাকুরবাড়িতে দারুণ সাড়া পড়ে গেছে, মেতে উঠেছে পরিবারের সবাই। রাশি রাশি রাখি জড়ো করা হয়েছে, কলকাতার বাইরে যে-সব পরিচিত মানুষরা থাকে, তাদের জন্য খামে ভরে ডাকে পাঠানো হচ্ছে একটি করে রাখি। এমনকী বাড়ির মেয়েরাও রাখি বানাচ্ছে, খামে ঠিকানা লিখতে লেগে গেছে। মস্ত বড় পশ্চিমের বারান্দা জুড়ে চলেছে এই যজ্ঞ। সেই সঙ্গে চলেছে গান।

সেদিনের জন্য নতুন গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনি একলা গাইলে তো চলবে না, মিছিলের সকলকে গাইতে হবে। তাই রবীন্দ্রনাথ বাড়ির বাইরে সমবেত যুবকদের সে গানটি শিখিয়ে যাচ্ছেন এক-একবার এসে, তারা আবার অন্যদের শেখাবে। গানটির ছাপা কপি বিলি হচ্ছে হাজার, হাজার।

ঠাকুর পরিবারের শুধু একজন মানুষের এই কর্মযজ্ঞে কোনও উৎসাহ নেই। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আর ভুলেও কখনও পা দেন না। তিনি থাকেন বালিগঞ্জে জ্ঞানদানন্দিনীর আশ্রয়ে। নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুধু বই পড়ে যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়, আলো জ্বালবার উৎসাহ পান না, বিছানা ছেড়ে উঠে এসে চুপ করে বসে থাকেন জানালার ধারে। বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও বয়কটের কথা তাঁর কানে এসেছে ঠিকই। কত দিন আগে তিনি ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে স্টিমার সার্ভিস চালিয়েছিলেন, সেদিন যদি দেশের মানুষ ইংরেজদের স্টিমার পুরোপুরি বয়কট করত, তা হলে তাঁকে সর্বস্বান্ত হতে হত না। টিকিটের দাম কমিয়ে দিলেন, যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ত্রুটি করেননি, তবু সেই দেশি কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করল না দেশের মানুষ। আজ বিলিতি কাপড় বর্জন করার জন্য স্থাপিত হচ্ছে দেশি কাপড়ের কল, ইংরেজদের বাণিজ্যে ধাক্কা দেওয়াই যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র তা অনেকে বুঝেছে, কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আর একটুও উদ্যম অবশিষ্ট নেই। কিছুই ভাল লাগে না। শুধু সময় কাটাবার জন্য মাঝে মাঝে গান-বাজনা নিয়ে ভুলে থাকেন, কিছু কিছু লেখা অনুবাদ করেন, এই পর্যন্ত।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, তিনি এলেন না। সেদিন ভোর হতে না হতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সমস্ত পুরুষদের ডেকে তুললেন। সুরেন সারারাত প্রায় ঘুমোয়নি, তার উৎসাহ সব চেয়ে বেশি। একটু একটু শীত পড়েছে, ভোরের দিকে ঘুমটা ভাল জমে, সুরেন ঘরে ঘরে গিয়ে সবার গা থেকে চাদর সরিয়ে নিয়ে নিতে লাগল।

প্রথমে সবাই মিলে যাবে গঙ্গার ঘাটে। সেখানে স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে নিয়ে তারপর শুরু হবে রাখি বন্ধন উৎসব।

তৈরি হতে হতে খানিকটা বেলা হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ একটা ধুতি পরে গায়ে একটা মুগার চাদর জড়িয়ে নিলেন। খালি পা। সবাইকে নিয়ে বেরুতে যাবেন, হঠাৎ অবনীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কী অবন, তুই জুতো পরেছিস যে! খোল, খোল!

অবনীন্দ্র শৌখিন ধরনের মানুষ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও জুতো খুলে ফেলে বলল, গাড়ি জুততে বলেছি। তুমি কি আমার গাড়িতে যাবে?

রবীন্দ্রনাথ বললেন, গাড়ি! গাড়ি কী হবে? আজ সকলে মিলে একসঙ্গে হেঁটে যাব!

এবার অবনীন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে ভুরু তুলে বলল, খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব? তুমি বলো কী রবিকা? কত কাঁটাকুটো, পেরেক, কাঁচ।

অবনীন্দ্রর বিস্ময়ের কারণ আছে। ঠাকুরবাড়ির পুরুষদের মোজা ছাড়া বাড়ির বার হওয়াই অমর্যাদাকর, জুতো ছাড়া রাস্তা দিয়ে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু তাই নয়, রাস্তায় সাধারণ পাঁচপেঁচি লোকের পাশাপাশি তারা হাঁটবে!

বাড়ির সামনে এর মধ্যেই কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ নিজের বাড়ির লোকজনদের নিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। চতুর্দিক থেকে আরও মিছিল আসছে, সারা শহর উত্তাল। একটাও দোকান খোলেনি। কেরাঞ্চি গাড়ি, ঠেলা গাড়ি নেই রাস্তায়। মুটেমজুররাও কাজ বন্ধ করেছে। বাজার বন্ধ। কোনও বাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছে না উনুনের ধোঁয়া। ট্রাম কোম্পানি এবারকা ট্রাম চালাচ্ছে বটে, তাতে একজনও যাত্রী নেই।

জোর জবরদস্তি নেই, এ হরতাল স্বতঃস্ফূর্ত। বাড়ি ছেড়ে সব মানুষ বেরিয়ে আসছে পথে।

রবীন্দ্রনাথ দু হাত তুলে গান ধরেছেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গাইছে সহস্র কণ্ঠ :

বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
পুণ্য হউক, হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট
বাংলার বন, বাংলার মাঠ—
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক
পূর্ণ হউক, হে ভগবান!
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা–
সত্য হউক, সত্য হউক
সত্য হউক, হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন
বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন–
এক হউক, এক হউক
এক হউক হে ভগবান।

কবি আজ চারণ হয়েছেন। তাঁর উজ্জ্বল নয়ন, প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে অনেকে বেশি বেশি প্রেরণা পাচ্ছে। কিছু লোক ঠেলাঠেলি করে সামনে আসছে তাঁকে দেখবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ গান থামাতে পারছেন না, একবার শেষ হলেই জনতার দাবি উঠছে, আবার, আবার!

গঙ্গার কুলে গিসগিস করছে মানুষ। সারা শহর যেন আজ এখানে ভেঙে পড়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই নেমে জলে কয়েকটা ডুব দিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারপর ভিজে ধুতি বদলে নিলেন। একটি যুবক ছুটে এসে বলল, প্রথমে আপনাকে আমি রাখি ব!

শুরু হয়ে গেল উৎসব। এ ওকে রাখি বেঁধে দিচ্ছে আর মাঝে মাঝে গগনভেদী শ্লোগান উঠছে, ভাই ভাই এক ঠাই, ভেদ নাই ভেদ নাই!

অবনীন্দ্র তার রবিকার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এ কী অদ্ভুত পরিবর্তন! রবীন্দ্রনাথ চেনাশুননা মহলে হাসিঠাট্টা করেন, কিন্তু বাড়ির বাইরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন না। কথা বলেন মেপে মেপে, এত বেশি ভদ্রতা দেখান যে তা কৃত্রিমতার পর্যায়ে চলে যায়। কখনও অন্যের সামনে তাঁর আবেগের প্রকাশ ঘটে না। আজ তাঁর এ কী হল! সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই জড়িয়ে ধরছেন। রাখি পরাবার সময় সে মেথর-মুদ্দোফরাস না অভিজাত, তা বিন্দুমাত্র বিবেচনা করছেন না। মহা উৎসাহে রাখি পরিয়ে চলেছেন। এমনকী পুলিশদেরও বাদ দিচ্ছেন না। পুলিশদের ডেকে ডেকে বলছেন, এসো ভাই, এসো, তুমিও তো বাঙালি! বাঙালি না হও, আমারই দেশের মানুষ!

এক জায়গায় প্রথম বাধা পড়ল। একজন সেপাইকে রবীন্দ্রনাথ যে-ই রাখি পরাতে গেলেন, সে কাচুমাচু মুখে বলল, হুজুর মাপ করবেন, আমি মুসলমান!

রবীন্দ্রনাথ থমকে গেলেন। মুহূর্তের জন্য তাঁর মুখোনা ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তিনি মৃদু স্বরে বললেন, আচ্ছা থাক!

পূর্ববঙ্গ থেকে অনেক পরস্পরবিরোধী খবর আসছে। সেখানেও বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন যেমন চলছে, তেমনি এক শ্রেণীর মুসলমান বঙ্গভঙ্গের প্রবল সমর্থক। কোথাও কোথাও হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের মারামারিও হয়েছে।

সেপাইটির প্রত্যাখ্যানের পরই একটি দাড়িওয়ালা লোক ছুটে এসে রবীন্দ্রনাথকে বলল, আমিও মুসলমান, আমার আপত্তি নেই, আপনি আমাকে রাখি পরিয়ে দিন।

অমনি জয়ধ্বনি উঠল : ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই, ভেদ নাই!

গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার পথে রাস্তার দু’পাশের লোকদের রাখি পরাতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ। ঘোড়ার গাড়ির সহিস, ভিস্তিওয়ালা, ফিরিঙ্গি, পাদ্রি সবাই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, অনেকে রবীন্দ্রনাথকেও রাখি পরাচ্ছে।

জোড়াসাঁকোয় নিজেদের বাড়ির মোড়ের কাছে এসে রবীন্দ্রনাথকে অবনীন্দ্র বলল, রবিকা, কী অবস্থা হয়েছে তোমার, শরীরে ওজন বেড়ে গেছে?

সত্যিই তাই, রবীন্দ্রনাথের দু’হাতে প্রায় পঞ্চাশ ষাটটা করে রাখি বাঁধা। কক্তি ছাড়িয়ে উঠে গেছে কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত।

হাসতে হাসতে তিনি রাখি খুলতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখে যেন দুষ্টবুদ্ধি ঝলসে উঠল। বললেন, অবন, একটা কাজ করলে হয় না? কাছেই তো নাখোদা মসজিদ, চল না, সেখানকার মোল্লা সাহেবদের রাখি পরিয়ে আসি।

অবনীন্দ্র চোখ কপালে তুলে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি রবিকা! ওখানে গেলে দাঙ্গা বেঁধে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, কেন, অনেক তো মাথায় ফেজ টুপি পরা মুসলমান রাখি বাঁধতে আপত্তি করল না। একবার গিয়েই দেখা যাক না।

অবনীন্দ্র বললেন, খবরদার ও কর্ম কোরো না। চলো বাড়ি চলে! রবীন্দ্রনাথ তবু যেতে চান। জোর জারির তত কিছু নেই, মোল্লারা রাজি না হলে ফিরে আসবেন।

অবনীন্দ্রর তবু সাহসে কুলেল না। সে সরে পড়ল। সুরেন ও আরও কয়েকজন রয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। দুপুর সাড়ে তিনটের সময় সার্কুলার রোডে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে ফেডারেশন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হবে। অল্প কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ হেঁটে চললেন নাখোদা মসজিদের দিকে।

বিশাল মসজিদটি অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। কাছাকাছি এসে সুরেন বলল, আমার মনে হয়, আগেই ওখানকার লোকদের রাখি পরাতে শুরু না করে ইমামের অনুমতি নেওয়া দরকার।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক বলেছিস!

দ্বাররক্ষীকে দিয়ে ইমামের কাছে খবর পাঠানো হল।

ভেতরের একটি ছোট কক্ষে চার পাঁচজন মোল্লা সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন বৃদ্ধ ইমাম। তাঁর সাদা ধপধপে চুল, সেই রকমই সাদা দাড়ি, গৌরবর্ণ, বয়েসের তুলনায় চক্ষু দুটি বেশ উজ্জ্বল, অঙ্গে মখমলের পোশাক। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী শুনে তিনি অনুমতি দিয়ে বললেন, ভেতরে নিয়ে এসো।

একটু পরে সে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর দিকে যে-কেউ এক পলক তাকালেই বুঝতে পারে, ইনি সাধারণ মানুষ নন।

রবীন্দ্রনাথ আদাব জানিয়ে বললেন, ইংরেজ সরকার বাংলা ভাগ করেছে বলে অনেকে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। দেশ ভাগ হোক বা না হোক, বাঙালির একতা কিছুতেই নষ্ট হবে না। হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের ভাই। ঈদের দিনে মুসলমান হিন্দুর সঙ্গে কোলাকুলি করে। বিজয়া দশমীর দিনে হিন্দু মুসলমানকে আলিঙ্গনে জড়ায়। আজকের দিনটিতে সেই ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হিসেবে আমরা পরস্পরের হাতে রাখি বেঁধে দিতে চাই।

ইমাম সাহেব তাঁর সঙ্গীদের মুখের দিকে তাকালেন। কেউ কোনও কথা বলল না। কয়েক মুহূর্তের জন্য অস্বস্তিকর নীরবতা। তারপর বৃদ্ধ ইমাম প্রশান্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, আইয়ে। তিনি একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *