জানলা দিয়ে ভোরের আলো দেখা গেলেই ভরত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। রাত্রেও তার মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। একেবারে একলা কোনও বাড়িতে রাত্রি যাপন করলে একটানা ঘুম হয় না, মস্তিষ্ক বোধহয় সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পারে না। যদিও এ বাড়ি সম্পর্কে ভূতের বাড়ি বলে যে রটনা ছিল, তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভরত পায়নি, কোনও অলৌকিক দর্শন হয়নি তার। ভরত অবশ্য প্রথম দিকে অনেক দিন ধরেই আশা করেছিল, কিছু একটা দেখা গেলে মন্দ হয় না। এই জীবন-সীমার পরপারে সত্যিই আর কিছু আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন বা ধন্ধ কিছুতেই মেটে না। এর মধ্যে একবার মাত্র একটি চোর ঢুকে পড়েছিল, ঠিক সময়ে জেগে উঠে ভরত তাকে ধরেও ফেলেছিল প্রায়, সর্বাঙ্গে তেলমাখা চোরটি কোনওক্রমে পিছলে পালিয়ে যায়। সে যাই হোক, এর সঙ্গে অলৌকিকের কোনও সম্পর্ক নেই, চোরেরা অতিমাত্রায় লৌকিক।
ঘুম ভাঙার পর একটা নিমডাল দিয়ে দাঁতন করতে করতে ভরত বাগানে চলে আসে। নিজের হাতে সে যে-সব গাছ পুঁতেছিল, সেগুলি এর মধ্যে অনেকটা বড় হয়েছে। প্রত্যেকটি গাছের সামনে ভরত দাঁড়ায়, পাতায় হাত বুলোয়, গভীর তৃপ্তিতে তার বুক ভরে যায়।
এ পর্যন্ত ভরত হরেক রকম জীবিকা গ্রহণ করেছে, এবারেই নিজেকে সবচেয়ে সার্থক মনে হয়। এইসব গাছপালা তার নিজের সৃষ্টি। এক এক সময় ভারী আশ্চর্য লাগে। একটা গাছ এখানে ছিল, ফাঁকা মাটি ছিল, ভরত একটা বীজ পুঁতেছিল, নিজে প্রতিদিন জল দিয়েছে, কয়েক বছরের মধ্যেই সেখানে শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা করবী ফুলের গাছ, তাতে ফুল ফুটছে, সেই ফুলের মধু খেতে মৌমাছি-ভ্রমর আসছে, বাতাসে ছড়াচ্ছে মৃদু সৌরভ, এ সবই যেন ম্যাজিকের মতন। একটা কলাগাছে কত বড় মোচা বেরিয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কলাগাছের ডগা থেকে গোল হয়ে যে নতুন পাতা বেরোয়, সে রকম নরম সবুজ পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি? গাছগুলো যখন বাতাসে দোলে, তখন মনে হয় যেন ওরা হাসতে হাসতে কী সব বলাবলি করছে। হয়তো সত্যিই ওরা কিছু বলে, মানুষ সে ভাষা বোঝে না।
হেমচন্দ্রও আশা করেনি যে ভরতের মতন একজন যাযাবর সত্যি সত্যি মেদিনীপুরের এই খামারবাড়িতে স্থায়ী হয়ে বসবে এবং অতি যত্নের সঙ্গে বাগান গড়ায় মন দেবে। এখন ভরত ফলপাকুড় ও শাকসবজি বিক্রি করে ভাল পয়সা পায়, হেমচন্দ্রের সব ধার সে শোধ করে দিয়েছে। বাগানের প্রতি তার এমন টান যে ইদানীং সে গ্রামের দিকে স্বদেশি প্রচার করতেও বিশেষ যায় না। মানুষের বদলে গাছপালার সংসর্গেই যেন সে বেশি স্বস্তি বোধ করে। সারা দিন রোদে পুড়ে পুড়ে তার গায়ের রং ময়লা হয়ে গেছে, কিন্তু শরীর বেশ মজবুত।
আজও দু’জন মালিকে সঙ্গে নিয়ে ভরত বাগানের পরিচর্যা করছে, বেলা এগারোটার সময় একটি কিশোর এলে তাকে একটি চিরকুট দিল। হেমচন্দ্র এখনই তাকে একবার তাঁতশালায় যেতে
বলেছে। খুব জরুরি।
হাতপায়ের ধুলোমাটি ধুয়ে ভরত গায়ে একটা জামা গলিয়ে নিল। তারপর বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে।
তাঁতশালাটি মেদিনীপুর শহরের অন্যপ্রান্তে কাঁসাই নদীর ধারে। হজরত পীর লোহানির সমাধিক্ষেত্রর কাছে খাপরার চাল দেওয়া একটা লম্বা ঘর, তার দু’পাশে কয়েকটি ছোট ঘর আর চৌকো একটা উঠোন। বড় ঘরখানায় তিনখানা তাঁত আছে, তাতে দেশি কাপড় উৎপাদনের চেষ্টা চলছে। আসলে এই তাঁতশালা গুপ্ত সমিতির একটি আখড়া, যে-সব বেকার ছেলে নিজেদের বাড়িতে থাকতে চায় না, দেশের কাজ করতে চায়, তাদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। হেমচন্দ্ৰই প্রধানত এটা চালায়।
হেমচন্দ্র বিবাহিত ও কয়েকটি সন্তানের পিতা হলেও নিজের বাড়িতে খুব কম সময়ই থাকে। ভরত এসে দেখল, তাঁতঘরের মেঝেতে বড় বড় কাগজ ছড়িয়ে হেম রং-তুলি নিয়ে কী সব আঁকছে। ভরত পাশে গিয়ে বসতেই হেম বলল, ব্রাদার, অনেকদিন এখানে আসোনি, খবর শোনোনি বোধহয়?
ভরত জিজ্ঞেস করল, কী খবর?
হেম বলল, সত্যেনদা কলকাতা থেকে ফিরেছেন কাল। অনেকগুলি পত্রপত্রিকা নিয়ে এসেছেন। ইংরেজ সরকার সত্যি সত্যি এবার বাংলাকে টুকরো টুকরো করে দিতে উদ্যত হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম কী জানো, বাঙালির যা স্বভাব, মনের দুঃখে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে আর ইংরেজদের পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করবে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তা হয়নি! সত্যেনদা দেখে এসেছেন, কলকাতায় প্রতিদিন প্রতিবাদ সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, ছাত্ররা সাহেব-পুলিশদের চোখ রাঙানি দেখেও ভয় পাচ্ছে না।
হেম সহজে উত্তেজিত হয় না, আবেগ প্রকাশ করে না। আজ তাকে বিচলিত দেখে ভরত বিস্মিত হল। নিরীহভাবে সে জিজ্ঞেস করল, ইংরেজ এ দেশ শাসন করছে, পুলিশ তার হাতে, সৈন্যবাহিনী তার হাতে, সে যদি ইচ্ছেমতন রাজ্যগুলি ভাঙাভাঙি করে, তাতে আমাদের আপত্তি জানাবার কী অধিকার আছে, আপত্তি জানিয়েই বা লাভ কী!
হেম বলল, ভারতে এতগুলি ভাষা, এতগুলি রাজ্য, আর কোনও রাজ্য ভাগ করেনি, শুধু বাংলাকেই ভাগ করতে চায়। কেন? বাঙালিকে সে একটা শিক্ষা দিতে চাইছে। বাঙালির জীবনে এই একটা চরম পরীক্ষার সময়। বাঙালি মাথা নিচু করে এই শাস্তি মেনে নেবে, না রুখে দাঁড়াবে? এইবার প্রমাণিত হবে, এই জাতির মেরুদণ্ড আছে না একেবারেই গেছে!
ভরত বলল, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার! বাঙালি কী নিয়ে প্রবল শক্তিমান ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে? বাঙালির হাতে অস্ত্র আছে?
অন্য একটি ছেলে বলল, ঠিকই বলেছেন, শুধু মিটিং করে কী হবে? পুলিশ তাড়া করলেই পালাবে সবাই। অস্ত্র ছাড়া কোনও জাত উঠে দাঁড়াতে পারে না।
হেম বলল, আমারও এতকাল সেই ধারণাই ছিল। এই রাজশক্তিকে পাল্টা আঘাত হানা দরকার। তার জন্য অস্ত্র জোগাড় করতে হবে, শত শত তরুণকে ট্রেনিং দিতে হবে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন চুপ করে বসে থাকব? আমার মা-বোনকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেলেও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকব? অস্ত্র অনেক রকম হতে পারে। সঞ্জীবনী কাগজে কৃষ্ণকুমার মিত্র সেইরকম একটা অস্ত্রের কথা লিখেছেন, তার নাম বয়কট। সেটা কী জানো!
অন্যরা চুপ করে আছে দেখে হেম আবার বলল, ইংরেজরা বেনের জাত। তাদের বাণিজ্যে আঘাত লাগলেই তারা সবচেয়ে বেশি আহত হবে। এখন থেকে আমরা সাহেবদের তৈরি সব রকম জিনিস বয়কট করব, মানে, ওদের কিছুই কিনব না। বিলিতি জুতো পরব না, বিলিতি কাপড় ব্যবহার করব না, ওদের চিনির বদলে আমাদের গুড় খাব। গ ভরত বাধা দিয়ে বলল, আমাদের জুতো হয় নাকি? কাপড়-চোপড় সবই তো আসে ম্যানচেস্টার-ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে।
হেম বলল, খড়ম পায়ে দেব কিংবা খালি পায়ে থাকব। বোম্বাই মিলের দিশি কাপড় পরব। দিশি কাপড়ের চাহিদা বাড়লে আবার গ্রামে গ্রামে তাঁত চালু হবে, লোকদের সিগারেট-চুরুট ছেড়ে বিড়ি খেতে বলব, বিলিতি মদের দোকানে পিকেটিং করতে হবে, মোট কথা, বিলিতি সব জিনিসের বিক্রি বন্ধ করতে হবে এদেশে। এটাই আমাদের অস্ত্র। আমাদের সমিতির কর্মীদের এই কাজে লেগে পড়তে হবে। তার আগে, কলকাতায় এত সভা আর মিছিল হচ্ছে, মেদিনীপুরে একটা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভা করতে পারব না? সেই সভাতেই ঘোষণা করতে হবে বয়কটের কথা।
দুদিনের মধ্যেই কর্নেলগোলার একটা ফাঁকা মাঠে হয়ে গেল সেই সভা। লোক সমাগম হল আশাতিরিক্ত। হেম কিন্তু মঞ্চে উঠল না, সে সব কিছু সংগঠন করে আড়ালে থাকতেই ভালবাসে।
সভা যখন চলছে, তখন জনতার পেছন দিকে দাঁড়িয়ে হেম ভরতকে বলল, এই আগস্ট মাসের সাত তারিখে কলকাতার টাউন হলে একটা বিরাট সভা হবে শুনেছি। বহু গণ্যমান্য লোক সেখানে উপস্থিত থাকবেন, সেখান থেকে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হবে কার্জন সাহেবের কাছে। আমি সেই সভায় যাব ঠিক করেছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কলকাতায়?
ভরত একটু ইতস্তত করতে লাগল। আবার কলকাতায়? না, তার ইচ্ছে করে না। এখনও কলকাতার নাম উচ্চারিত হলেই তার একটা পুরনো ক্ষতে জ্বালা ধরে। তার চেয়ে তার বাগানে অনেক শান্তি। গাছপালা মানুষকে আঘাত দেয় না। গাছপালার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয় না। পুকুরের জলে প্রতিদিন অবগাহনে শরীর জুড়িয়ে যায়, দুপুরবেলা লিচুগাছের ছায়ায় শুয়ে থাকলে ঘুম হয় বড় আরামের। এই সব ছেড়ে কলকাতার ধুলো-ধোঁওয়া আর মানুষের ঠেলাঠেলির মধ্যে যেতে কার ভাল লাগে?
ভরত বলল, নাঃ, আমি কলকাতায় যাব না।
হেম ভ্রু কুঞ্চিত করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। তারপর আপন মনেই বলল, পত্র-পত্রিকা পড়ে, সত্যেনদার কাছে সব শুনেটুনে মনে হল, এবার বড় কিছু একটা ঘটবে। একটা যেন বিস্ফোরণ হবে। এই সময় কলকাতা ছেড়ে দূরে বসে থাকার কোনও মানে হয়? এতদিন ধরে আমরা এই রকম কিছুরই তো প্রতীক্ষায় ছিলাম!
ভরত বলল, তুমি ঘুরে এসো, তোমার কাছে সব শুনব!
হেম বলল, এই মেদিনীপুরেই তোমার শিকড় গেঁথে গেল? তবু তো বিয়ে-থা করনি!
হেমের কণ্ঠস্বরে যে শ্লেষের আভাস আছে, তা গ্রাহ্য করল না ভরত। সে বলল, অনেক তো ঘুরলাম, অনেক জায়গায় থিতু হবার চেষ্টা করেছি, পারিনি। এখানে কিছু গাছপালা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর বোধহয় তাদের ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না।
হেম বলল, আমরা তলোয়ার আর গীতা ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলাম, দেশের কাজের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করব না!
ভরত এবার বেশ বিস্মিত হয়ে বলল, সেই শপথের এখনও কোনও গুরুত্ব আছে নাকি? যিনি আমাদের দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরই তো প্রায় দু তিন বছর কোনও সাড়াশব্দ নেই। তা ছাড়া সভা-সমিতিতে বক্তৃতা শোনা কি দেশের কাজ নাকি?
হেম রাগতভাবে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবে না!
খামারবাড়িতে ফিরে এল ভরত। সে হেমচন্দ্রর রাগের কারণ ঠিক বুঝতে পারে না। ইংরেজ সরকার ঠিক করেছে বাংলা ভাগ করবে, বাংলা থেকে অনেকগুলি জেলা কেটে নিয়ে জুড়ে দেবে আসামের সঙ্গে। এটা সরকারি নীতি, কার্যকর হবেই। সভা-সমিতি করে তা আটকানোর চেষ্টাটাই হাস্যকর। সাধারণ মানুষ সভায় এসে গরম গরম বক্তৃতা শুনতে ভালবাসে, তারপর বাড়ি ফিরে সব ভুলে যায়। এই যে মেদিনীপুর শহরে সভা হল, কত মানুষ এসেছিল, তার ফলটা কী হল? পুলিশ গ্রাহ্যই করেনি। সভায় যারা এসেছিল, তারা আবার যে-যার কাজে ফিরে গেছে। বয়কট? যার পয়সা আছে, সে বিলিতি জুতো পরবে না, খালি পায়ে হাঁটবে? দিশি নুন না পাওয়া গেলে আলুনি খাবে? জামা না পরে খালি গায়ে থাকবে? অসুখ-বিসুখে বিলিতি ওষুধ না কিনে মরবে? যত সব উদ্ভট চিন্তা। হেম তো আগে সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া অন্য কিছুতে বিশ্বাস করত না!
একটা আমগাছের গোড়ায় উই লেগেছে। বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে, তাতে কিলবিল করছে উইপোকা। একটা খুরপি নিয়ে সেই গর্তগুলো খুঁড়ছে ভরত। বাগানের মালি তাকে সাবধান করে দিয়েছিল, এই সব উইয়ের গর্তে সাপ ঢুকে বসে থাকে অনেক সময়। সাপ আর সন্ন্যাসী, এদের নিজস্ব বাসা থাকে না, পরের বাসায় আশ্রয় নেয়। এই বর্ষাকালে প্রায়ই সাপ দেখা যায়। একটা কেউটে সাপকে ভরত কয়েক দিন আগে ডান্ডা দিয়ে মারতে গিয়েছিল, খানিকটা চোট লাগলেও সাপটা মরেনি, পালিয়েছে। সেটা নিশ্চয়ই আছে আশেপাশে কোথাও।
সাইকেলের শব্দ শুনে ভরত ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। গেট ঠেলে ঢুকছে ক্ষুদিরাম। ওর নিজের সাইকেল নেই, কাকুতি-মিনতি করে অন্য কারুর সাইকেল চেয়ে নিয়ে ছেলেটা প্রায়ই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, এখানেও আসে মাঝে মাঝে! ছেলেটা অসম্ভব ছটফটে ও জেদি ধরনের, তবু ওকে পছন্দ করে ভরত। লেখাপড়ার দিকে মন নেই ক্ষুদিরামের, তবে সে হেমের কাছে দেশ-বিদেশের যুদ্ধ-বিগ্রহ আর বিপ্লবের গল্প শুনতে চায়। ভাল-মন্দ খেতে পায় না বলে ভরত ওকে বাগানের ফলটল দেয়, এক এক দিন দুপুরে নিজের সঙ্গে বসিয়ে পেট ভরে মাছের ঝোল ভাত খাওয়ায়।
আজ ওর ব্যস্তসমস্ত ভাব দেখে ভরত জিজ্ঞেস করলে, কী ব্যাপারে রে খুদি? ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছিস মনে হচ্ছে!
সাইকেলটাকে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে ক্ষুদিরাম ভরতের পাশে এসে উবু হয়ে বসল। কোনও রকম ভূমিকা না করে বলল, দাদা, আমাকে কুড়িটা টাকা দেবে?
ভরত সকৌতুকে বলল, এক টাকা দু টাকা নয়, একেবারে কুড়ি টাকা? এত টাকা দিয়ে কী করবি? জমি কিনবি নাকি?
ক্ষুদিরাম বলল, না, কলকাতায় যাব!
–হঠাৎ কলকাতায় যাবি কেন? সেখানে তোর কে আছে?
–কেউ নেই। আমার আবার কে থাকবে?
–তা হলে তুই যেতে চাইছিস কেন?
–বাঃ, সবাই তো কলকাতায় যাচ্ছে। সত্যেনকাকা, হেমদাদা, অবনীদাদা, আরও অনেকে। আমায় কেউ সঙ্গে নিতে চায় না। তাই আমি ঠিক করেছি, নিজেই যাব!
–কলকাতা কী রকম জায়গা তুই জানিস? কত মানুষ, কত গাড়িঘোড়া, তাতে লোকে চাপা পড়ে মরেও যায়। একবার রাস্তা হারালে আর খুঁজে পাবি না। সেখানে জিনিসপত্রের কী সাঙ্ঘাতিক দাম! একটা ডিমের দাম দু’পয়সা। হোটেলে ভাত খেতে গেলে ছপয়সার কমে পেটই ভরবে না। কলকাতায় তুই থাকবি কোথায়? হোটেলে থাকতে গেলে কুড়ি টাকায় আর কদিন চলবে?
–রাত্তিরে রাস্তায় শুয়ে থাকব। তাতে তো আর পয়সা লাগবে না?
–কলকাতায় রাস্তায় কারুকেই শুতে দেয় না। সেপাই এসে কোতোয়ালিতে ধরে নিয়ে যায়। রাস্তায় পায়খানা-পেচ্ছাপ করলেও পুলিশে ধরে, ফাইন করে কিংবা জেলে ভরে রাখে। হঠাৎ কলকাতায় যাবার শখ চাপল কেন তোর!
–কলকাতায় কী যেন হচ্ছে। অনেকে দেখতে যাচ্ছে, আমি যাব না কেন?
–তোর মুশকিল কী জানিস খুদি, তুই যে এখনও ছোট, সে কথা তোর মনে থাকে না। কলকাতায় যারা হুজুগ দেখতে যাচ্ছে, তাদের বয়েস তোর অন্তত ডবল! তোর এখন ইস্কুলে পড়ার কথা। তোর বাপ-মা বেঁচে থাকলে তকে কিছুতেই যেতে দিত না।
–ভরতদাদা, আমার আর ছোট থাকতে ভাল লাগে না। আমি কাজ চাই, কাজ!
–লেখাপড়া না শিখলে তোকে কাজ দেবে কে?
ক্ষুদিরামের মুখে বিরক্তির ছাপ পড়ল। এই ধরনের উপদেশের কথা শুনতে শুনতে তার কান পচে গেছে। সে বলল, তুমি টাকা দেবে না!
ভরত বলল, এই বয়েসে তোকে আমি কলকাতায় যেতে দিতে পারি না। আর একটু বড় হ, আমি সঙ্গে নিয়ে যাব!
উঠে দাঁড়াতে গিয়েও হঠাৎ সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্ষুদিরাম। ভরতকে ঠেলে সরিয়ে দিল এক পাশে।
হিস হিস শব্দ করে ফণা তুলেছে একটা সাপ। সেই আহত সাপটা ফিরে এসেছে, কিংবা অন্য সাপও হতে পারে। ভরত সাপ দেখে ভয় পাবার পাত্র নয়, বাল্যকাল থেকে অনেক সাপ তার দেখা আছে, কিন্তু এত কাছে, যদি ছোবল দিত? একবার ভরতের বুকটা কেঁপে উঠল।
ক্ষুদিরাম চেঁচিয়ে বলল, তুমি সরে যাও দাদা, আমি ব্যাটাকে সাবাড় করে দিচ্ছি!
সে এক মুঠো মাটি ছুঁড়ে দিল সাপটার মুখে। সাপটা রেগে গিয়ে আরও লম্বা হয়ে উঠে মাথা দোলাতে লাগল।
ভরত অনেকটা পিছিয়ে এসে বলল, তুইও সরে আয় খুদি, আমি একটা লাঠি আনছি।
ক্ষুদিরাম সে কথা শুনল না। সে সাপটার চারপাশে ঘুরতে লাগল, যেন সে এক দক্ষ সাপুড়ে। মাঝে মাঝে মাটি খুঁড়ে আরও রাগিয়ে দিচ্ছে সাপটাকে, সাপটা কিন্তু তেড়ে যাচ্ছে না। ক্ষুদিরাম যেদিকে যাচ্ছে, সেও সেদিকে মাথা ঘোরাচ্ছে।
ভরত আমগাছটার একটা ডাল ভেঙে নিল। কিন্তু সেটা দিয়ে মারবার আগেই সাপটা পশ্চাৎ অপসারণ করে মাথা ঢুকিয়ে দিল একটা গর্তে।
সাপ যতই হিংস্র প্রাণী হোক, আসলে নির্বোধ। শত্রুপক্ষের সামনে থেকে পালাতে গিয়ে সে গর্তের মধ্যে প্রথম ঢোকায় মাথা। খুব দ্রুত সে ঢুকতে পারল না, ক্ষুদিরাম খপ করে চেপে ধরল তার লেজ।
ভরত জানে, এই ছেলেটা দারুণ দুঃসাহসী ও ডাকাবুকো। কিন্তু এই ধরনের দুঃসাহসী ছেলেদেরই আকস্মিক বিপদ হয়। সে বলল, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে!
ক্ষুদিরাম শুনল না, সাপটাকে টেনে বার করে মাথার ওপর ঘোরাতে লাগল বনবন করে। তারপর মাটিতে আছাড় মারল কয়েকবার। হাড়গোড় ভেঙে সাপটা অক্কা পেয়ে গেছে।
ক্ষুদিরাম বলল, এখনও এ ব্যাটা মরেনি, মটকা মেরে পড়ে আছে। এটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। না পোড়ালে বিশ্বাস নেই।
চ্যাঁচামেচি শুনে ছুটে এসেছে বাগানের মালি।
ভরত ক্ষুদিরামের কাঁধে চাপড় মেরে বলল, তুই বীরত্ব দেখাতে গেলি কেন রে? আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিস, সে জন্য কুড়ি টাকা তোর প্রাপ্য, তাই না? আমি কিন্তু তবু তোকে কলকাতায় যাবার জন্য টাকা দেব না। আশ্রয়দাতা কেউ না থাকলে তোর বয়েসী ছেলে কলকাতায় গিয়ে কত কষ্টে পড়বে, তা আমি হাড়েহাড়ে জানি!
ক্ষুদিরাম বলল, মোটেই আমি টাকার জন্য সাপটাকে মারিনি।
ভরত বলল, আমার বাগানের সাপ, দরকার হলে আমি মারব। তোকে এত কেরানি দেখাতে কে বলল?
ক্ষুদিরাম বলল, আমাদের এখানে সব সময় যে আগে দেখে, সে-ই সাপ মারার চেষ্টা করে। কার বাগানের সাপ, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নাকি।
ভরত বলল, তুই আগেও সাপ মেরেছিস এ রকম?
ক্ষুদিরাম বলল, হ্যাঁ। সাপ দেখলেই আমার মারতে ইচ্ছে করে। তুমি উইয়ের গর্তের অত কাছে বসে ছিলে কেন?
ভরত বলল, তুই এসে কথা বলতে শুরু করলি, তাই তো অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। সাপটা ছোবল দিলে মরে যেতে পারতাম। কিন্তু তুই তো আমায় মুশকিলে ফেলে দিলি ক্ষুদিরাম। তুই কুড়িটা টাকা চেয়েছিলি, তারপর আমার প্রাণ বাঁচালি, এখন আমি যদি টাকাটা না দিই তা হলে আমি নিমকহারাম হয়ে যাব, তাই না? অথচ টাকাটা দিয়ে তোর ক্ষতি করতেও ইচ্ছে করছে না। বরং পাঁচটা টাকা দিচ্ছি, তোর বন্ধুদের সঙ্গে পেট ভরে কাঁচাগোল্লা কিনে খা গিয়ে।
ক্ষুদিরাম বলল, এ কী সাপ মারার জন্য বখশিস নাকি? আমার এক পয়সাও চাই না।
ভরত বলল, সেই ভাল। তোর হাতে পাঁচ টাকা দিলেও তুই তা নিয়ে ট্রেনে চেপে বসতে পারিস। বরং আমি নিজে একদিন মিষ্টি কিনে তোকে খাওয়াব। আর কথা দিচ্ছি, বছর দুএক পরে, যদি ঠিকমতন লেখাপড়া করিস, তা হলে তোকে কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে যাব।
ওষ্ঠ উল্টে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ক্ষুদিরাম বলল, আমার বয়ে গেছে! আমি মোটেই বেড়াতে যেতে চাই না!
ক্ষুদিরাম সাইকেলে উঠতে যাচ্ছে, ভরত আবার বলল, দাঁড়া। এই সাইকেলটা কার?
সাইকেলটার সিটের ওপর দিয়ে একটা সিল্কের কাপড় জড়ানো। এই সাইকেল ভরতের চেনা। সে বলল, এটা তো হেমের সাইকেল। সে তত কারুকে ব্যবহার করতে দেয় না। তুই আনলি কী করে?
ক্ষুদিরাম বলল, তুমি কি ভাবছ চুরি করে এনেছি? হেমদাদার কি আর সাইকেল চড়ার ক্ষমতা আছে? পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছে না?
ভরত সবিস্ময়ে বলল, হেমের পা ভেঙেছে? কবে? তুই এতক্ষণ সে কথা আমাকে বলিসনি?
ক্ষুদিরাম বলল, তুমি কি জিজেস করেছ? তোমার বন্ধুর পা ভাঙার খবর তুমি জানবে না তা আমি বুঝব কী করে? কাল সকালে হেদাদা নদীর ধার দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। মাথাতেও লেগেছে। খুব বেশি না, কিন্তু ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে!
বিকেলবেলা হেমের বাড়িতে চলে এল ভরত। বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে হেম। তার মাথায় পট্টি বাঁধা, ডান পায়ের পাতা ফুলে হাঁড়ির মতন হয়ে আছে, সেখানে চুন-হলুদ লাগানো। কথা কাটাকাটি চলছে তার স্ত্রীর সঙ্গে। হেম জেদ ধরে বসে আছে, এই অবস্থাতেও আগামীকাল ভোরের ট্রেনে সে কলকাতায় যাবেই যাবে। সত্যেন ও অন্যান্যরা চলে গেছে আজ, হেম যাবে একা।
পাশে বসে পড়ে ভরত জিজ্ঞেস করল, কেন, কলকাতায় যেতেই হবে কেন?
হেম গম্ভীরভাবে বলল, আগে থেকে যাব ঠিক করেছি, তাই।
ভরত বলল, কিন্তু এরকম ভাঙা পা নিয়ে গিয়েই বা তুমি কী করবে? হাঁটতে পারবে না, কোথাও যেতে পারবে না। এ তো পাগলামি।
হেম বলল, যদি পাগলামি মনে করো তো তাই। গোঁয়ার্তুমিও বলতে পারো। তবু আমি যাবই। তা নিয়ে অন্য কারুর মাথা ঘামাবার তো দরকার নেই।
দরজার আড়ালে দাঁড়ানো স্ত্রীর উদ্দেশে সে বলল, কলকাতায় গিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাব, এখানে কি সে রকম ডাক্তার আছে?
ভরত বলল, সেটা অবশ্য ঠিক। কলকাতায় ডাক্তার দেখালে পা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি একা ট্রেনে যাবে, হাওড়ায় ট্রেন থেকে নেমে ছ্যাকড়া গাড়ির স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছতে অনেকটা হাঁটতে হয়, তুমি একলা পারবে কী করে?
হেম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, এর চেয়ে ঢের বেশি শক্ত কাজ মানুষকে একা একা করতে হয়, তা বুঝি জানো না?
ভরত বলল, জানি। কিন্তু তোমাকে এই অবস্থায় দেখেও যদি একা আমি যেতে দিই, তা হলে আমার নিজেরই মনে হবে যে আমি অমানুষ! সত্যি করে বলো তো হেম, তুমি কি আমায় কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্যই ইচ্ছে করে পা ভাঙলে?
হেম প্রায় গর্জন করে উঠে বলল, খবরদার, তুমি যাবে না! তুমি কলকাতায় যেতে চাওনি, আমার জন্য কেন যাবে? আমি তোমার সাহায্য চাই না। তুমি কিছুতেই যাবে না।
ভরত বলল, যেতে আমাকে হবেই। বুঝলাম, নিয়তি আমাকে আবার টানছে কলকাতার দিকে।
হেম বলল, ওসব নিয়তিটিয়তি বাজে কথা! তোমাকে যেতে হবে না। তুমি বাগান নিয়েই থাকো। আমি তোমাকে সঙ্গে নিতে রাজি নই।
ভরত বলল, তুমি রাজি হও বা না হও, আমি ট্রেনে চাপলে তুমি আটকাতে পারবে? ন্যায্যভাবেই আমি তোমার সঙ্গে এক কামরায় বসতে পারি। হাওড়া স্টেশনে তোমার পাশাপাশি হাঁটারও অধিকার আছে আমার! তুমি কি পুলিশ ডেকে বলতে পারবে, এই লোকটা কেন যাচ্ছে আমার সঙ্গে?
নিজের রসিকতাতে নিজেই হেসে উঠল ভরত।
পড়ে রইল নিজের হাতে লাগানো গাছগুলি, না-ফোঁটা ফুলের কলি, কলাগাহ্বে মোচা, পুকুরের মাছ। একটা ছোট ব্যাগে কয়েকটি জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে ভরত বাগানে এসে দাঁড়াল। একটা ঝুপসি গাছের পাতার আড়ালে বসে একটা পাখি চোখ গেল, চোখ গেল ডেকে যাচ্ছে অবিশ্রান্তভাবে। পাখিটাকে দেখা যায় না। কাঠচাঁপা ফুলগাছটাকে ঘিরে গুনগুন করছে দুটো ভোমরা, তালগাছ বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে একটা চেনা কাঠবিড়ালি, কামিনী গাছটার নীচে ঝরে পড়া ফুলগুলি সাদা চাঁদরের মতন বিছিয়ে আছে।
ভরত অস্ফুট স্বরে বলল, বেশি দিন না, দিন সাতেকের মধ্যেই আমি ফিরে আসছি।
একটুও বাতাস নেই। অন্য দিন গাছের পাতাগুলো দুলতে দুলতে কিছু কথা বলে, আজ তারা ভরতকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল না।
হেমকে নিয়ে ভরত হাওড়া স্টেশনে পৌঁছল বিকেলের দিকে। হাতে যদিও একটা লাঠি নিয়েছে, তবু হেমের নিজে নিজে হাঁটার ক্ষমতা নেই। ভরত হেমের একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে ওর শরীরের ভার অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে, তবু প্রতিটি পদক্ষেপে হেমের মুখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে, মুখে সে কোনও শব্দ করছে না।
ছ্যাকড়া গাড়ির আড়ার দিকে যেতে যেতে ভরত জিজ্ঞেস করল, তুমি একা আসতে চাইছিলে, কী করে গাড়িতে গিয়ে উঠতে?
হেম বলল, হামাগুড়ি দিয়ে যেতাম!
ভরত বলল, এত লোকের ভিড়ের মধ্যে তুমি হামাগুড়ি দিতে?
হেম জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ যেতাম! আমি কারুর সাহায্যের তোয়াক্কা করি না।
ভরত হেমকে ছেড়ে দিয়ে খানিকটা সরে গিয়ে বলল, দেখি তো কেমন হামাগুড়ি দিতে পারো?
হেম সত্যিই বসে পড়ল। চার পাশ দিয়ে ব্যস্ত মানুষ ছুটছে, কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকালেও কেউ থামছে না। এর মধ্যে হেম হামাগুড়ি দিতে উদ্যত হলে ভরত দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলল, জোর করে টেনে তুলল। তারপর ক্ষোভের সঙ্গে বলল, হেম, তুমি আমাকে এখনও বন্ধু বলে মনে করো না! বন্ধু কি বন্ধুর কাছে সাহায্য চায় না?
হেম বলল, কী করব বলল! আমার স্বভাবটাই এরকম। আমি কারুর ওপর কখনও নির্ভরশীল হতে চাই না। অন্যের ব্যাপারেও মাথা গলাই না। এই জন্য অনেকে আমাকে হৃদয়হীন মনে করে।
ভরত বলল, তোমার সম্পূর্ণ হৃদয় তুমি দেশ নামে এক ভাবমূর্তিকে দিয়ে বসে আছ! তাই কোনও মানুষকে আর তুমি ভালবাসতে পারো না। কিন্তু মানুষ নিয়েই তো দেশ!
হেম বলল, দেশ আমার কাছে ভাবমূর্তি নয়। বঙ্কিমবাবুর দেশজননীও আমার চোখে ভাসে না। আমার কাছে দেশ মানে কোটি কোটি পরাধীন মানুষের অপমানিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মুখ।
ভরত একটা ছ্যাকড়া গাড়ি ভাড়া করল, প্রথমেই হেমের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। হেম আগেই বলে দিয়েছে, সে হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে থাকতে রাজি নয়, আগামীকালের প্রতিবাদ সভা সে দেখতে যাবেই। তা হলে কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ভরতের মনে পড়ল ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের কথা। শশিভূষণ মাস্টারের সঙ্গে সে মহেন্দ্রলালের চেম্বারে কয়েকবার গেছে, জায়গাটা তার চেনা।
গাড়ি নিয়ে ভবানীপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। আগে ভরত এই চেম্বারের সামনে প্রচুর রোগীর ভিড় দেখেছিল, এখন মাত্র দুজন অপেক্ষা করছে। তাদের হয়ে যাবার পর ভরত চেম্বারের মধ্যে প্রবেশ করেই চমকে গেল। চামড়ায় মোড়া গদিওয়ালা যে বড় চেয়ারটিতে বিশালকায় মহেন্দ্রলাল বসতেন, সেখানে এখন বসে আছেন একজন সরু চেহারার মাঝবয়েসী ব্যক্তি। পেছনের দেওয়ালে টাঙানো মহেন্দ্রলালের একটি বাঁধানো ছবি।
ভরত জিজ্ঞেস করল, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার নেই?
ডাক্তারটি চোখ থেকে চশমা খুলে বললেন, আপনারা বুঝি বিদেশি? তাই খবর শোনেননি। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার গত বছর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম, আমিও ডাক্তার সরকার।
ভরত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। ডাক্তাররা অমর নন, তাঁদেরও রোগ-ভোগ আছে, মহেন্দ্রলালের বয়েসও যথেষ্ট হয়েছিল, তবু তাঁর চলে যাওয়াটা যেন বিশ্বাস্য মনে হয় না।
এই ডাক্তার যতক্ষণ হেমের মাথার ক্ষত ও পা-টা পরীক্ষা করতে লাগলেন, ভরত বসে বসে ভাবতে লাগল মহেন্দ্রলালের কথা। অমন প্রবল প্রতাপান্বিত ব্যক্তিত্ব, তাও একদিন শুন্যে মিলিয়ে যায়। একেবারে সব শেষ! মহেন্দ্রলাল প্রথম দিন ভরতকে একটা মন্ত্র শিখিয়েছিলেন, ভরত মনে মনে বারবার সেটা বলতে লাগল, পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে! পঞ্চভূতের ফাঁদে, ব্ৰহ্ম পড়ে কাঁদে! তা হলে পঞ্চভূত দিয়ে গড়া মানুষের এই শরীরটাই আসল, এই শরীর না থাকলে ব্ৰহ্মট্রহ্ম কিছুই থাকে না।
ডাক্তারটি মলম মাখিয়ে ভাল করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন পায়ে, মাথায় আর কিছু দরকার হল না। হেমকে দশদিন টানা শুয়ে থাকতে হবে। বাড়ি থেকে বেরুনোও নিষেধ।
এর পর শিয়ালদা অঞ্চলের পূর্বপরিচিত একটি মেসবাড়িতে হেমকে নিয়ে উঠল ভরত। সৌভাগ্যবশত একতলায় ঘর পাওয়া গেল, তাতে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। একতলার বড় হলঘরটিতে মেসের বাসিন্দারা প্রতিদিন সন্ধেবেলা জমায়েত হয়ে গাল-গল্প করে। হেম বিছানায় শুয়ে আছে, ভরত শিয়রের চেয়ারে বসে বাইরের সব কথাবার্তাই শুনতে পাচ্ছে। না শুনে উপায় নেই, বাইরের আড্ডাধারীদের কণ্ঠস্বর এমনই উচ্চগ্রামে যে দরজা বন্ধ করলেও সব শোনা যায়।
আগেরবার এই মেসে থাকার সময় ভরত অন্য কারুর সঙ্গে মেলামেশা করেনি, কিন্তু খাবারঘরে কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় অনেকের কথা তার কানে এসেছে। সে সবই অতি সাধারণ কথা, অনেক সময় নিম্নরুচির কথা। এরা অধিকাংশই অফিস-চাকুরে, অফিসের কথা, খাওয়াদাওয়ার কথা, বাজার-দর ও স্ত্রীলোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে লালসাময় রসিকতা ছাড়া যেন আর কিছু জানেই না। আজ এদের আলোচনার বিষয় শুনে ভরতের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে! সবাই উত্তেজিত বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গে। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে কারুর কারুর বাড়ি পূর্ববঙ্গে, কারুর কারুর হুগলি, মেদিনীপুরে, সকলেই বাংলা ভাগের ঘোর বিরোধী। আগামীকাল টাউন হলের সভাতেও যোগ দিতে অনেকে বদ্ধপরিকর। আজ বৃষ্টি হচ্ছে দেখে, কালও যদি বৃষ্টি হয় তা হলে মিছিল পণ্ড হয়ে যেতে পারে, এই নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। দু’চারটি খিস্তিখেউড় যা শোনা গেল, তা কোনও নারী সম্পর্কে নয়, লর্ড কার্জন সম্পর্কে।
হেম বলে বটে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মুখে পরাধীনতার অপমান ও বঞ্চনার জ্বালা রয়েছে, কিন্তু ভরত তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। ওটা শুধু হেমের মনের কথা। আসলে এ দেশের শতকরা নব্বই জন মানুষ স্বাধীন না পরাধীন তা নিয়ে মাথাই ঘামায় না, দিব্যি হাসছে, খেলছে, খাচ্ছেদাচ্ছে বংশ বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করে, ইংরেজ শাসন ভারতের পক্ষে আশীবাদ। মহারানি ভিকটোরিয়ার মৃত্যুসংবাদ শুনে কত লোক কেঁদে ভাসিয়েছে। যারা বঞ্চিত, যারা দরিদ্র, তারা কাছাকাছি কিছু লোককে তাদের দুভাগ্যের কারণ মনে করে, দেশের সামগ্রিক অবস্থা বোঝে না। আজ হঠাৎ এত লোক ইংরেজ সরকারের একটা সিদ্ধান্তের বিরোধী হয়ে উঠল কী করে? বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা? বেশির ভাগ শিক্ষিত বাঙালিই তো বাংলা-ইংরিজি মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি ভাষা বলে! বাংলা বই-ই বা ক’জন পড়ে? আর অশিক্ষিত লোকদের ভাষা-সচেতনতাই নেই। তবে?
পরদিন সকালেই মেসের এক ভৃত্য খবর দিল, এ পল্লীর সমস্ত দোকানপাট আজ বন্ধ। কেউ হরতালের ডাক দেয়নি, তারা নিজেরাই বন্ধ করেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে পথে পথে লোকে লোকারণ্য, সব দিকে কী হয় কী হয় ভাব! মাঝে মাঝে মিলিত কণ্ঠে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে বলে মাতরম!
বঙ্কিমবাবুর বন্দে মাতরম গানটি আগে শুনেছে ভরত, কিন্তু তার প্রথম শব্দ নিয়ে এমন শ্লোগান সে আগে শোনেনি। কোনও শ্লোগানই শোনেনি আগে। এটা শুনতে ভাল লাগছে, বেশ জোরালো এবং আবেগময়। কে বন্দে মাতরম শ্লোগান বানাবার নির্দেশ দিল?
আগেই শোনা গিয়েছিল, প্রথম জমায়েতটি হবে কলেজ স্কোয়ারে। সেখান থেকে মিছিল যাবে টাউন হলের দিকে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরেই হেম বলল, ব্রাদার, একটা গাড়ি ডাকো, আমি কলেজ স্কোয়ারে যাব, প্রথম থেকে সব দেখব।
ও ভরত বলল, ডাক্তার তোমাকে ঘর থেকে বেরুতেই বারণ করেছেন যে—
হেম সে কথায় পাত্তাই দিল না। এক হাতে ঝাঁপটা দিয়ে বলল, তুমি যদি না ডাকো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমি নিজেই যাব।
বেলা দুটো বাজে, এর মধ্যেই ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে কলেজ স্কোয়ারের দিকে এগোনোই যায় না। সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে। চতুর্দিকে গিসগিস করছে মানুষ, অনেকের হাতে কালো পতাকা। গাড়িটাকে অ্যালবার্ট হলের সামনে থামিয়ে রাখা হল।
ভরত বলল, হেম, এত যে মানুষ আসছে, এত লোক সভায় যোগ দেবে, এদের সংগঠন করল কে? জাতীয় কংগ্রেস তো সভার ডাক দেয়নি। লোকে এমনি এমনি আসছে?
হেম বলল, বেশ হয়েছে। এর জন্য দায়ি ইংরেজ সরকার। না বুঝে এই সরকারও অতি সাধারণ মানুষদেরও রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাঙালির আঁতে ঘা দিয়েছে, তাই যারা কোনওদিন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাত না, তারাও এখন নেমে পড়েছে রাস্তায়।
ভরত বলল, ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি দেখছি। ছাত্ররাই ভিড় সামলাচ্ছে।
হেম বলল, ছাত্ররাই তো আসল শক্তি। ছাত্ররা খেপে উঠলে এই আন্দোলন দীর্ঘদিন চলবে। সাধারণ মানুষের সংসারের চিন্তা থাকে, তাতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বেশিদিন টেনে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু ছাত্ররা অদম্য, তারা ইচ্ছে করলে সারা দেশের জীবনযাত্রা অচল করে দিতে পারে।
ভরত বলল, আমি এক সঙ্গে এত মানুষ আগে কখনও দেখিনি। কোনও সংগঠন নেই, তবু অসংখ্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসছে, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে।
হেম বলল, আন্দোলনটা টেনে নিয়ে যেতে হলে এর পর আমাদেরই সংগঠনের কাজে লাগতে হবে। বঙ্গভঙ্গ দেখছি সত্যিই শাপে বর হল। ইস, এই সময়েই আমার পা ভাঙল!
_একটু পরে মিছিল চলতে শুরু করল। মুহুর্মুহু গর্জন শোনা যেতে লাগল, বন্দে মাতরম! বঙ্গ ভঙ্গ চাই না চাই না! বঙ্গ ভঙ্গ হবে না হবে না! কালো পতাকা ছাড়াও কারুর কারুর হাতে রয়েছে নীল রঙের ফেস্টুন, তাতে লেখা, বাংলা অখণ্ড।
রাস্তার এক এক জায়গায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোখা পুলিশ, মধ্যে মধ্যে গোরা সার্জেন। ছাত্ররা তাদের দেখে প্রবল উৎসাহে নাচতে শুরু করছে, কেউ কেউ টিটকিরি দিচ্ছে। সব ভয় ভেঙে গেল কী করে?
গাড়িটা চলেছে মিছিলের পেছনে পেছনে, ভরত অনেকখানি শরীর বাইরে ঝুঁকিয়ে দেখে দেখে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে। একটু পরে হেম বলল, আমার দুর্ভাগ্য, আমি এই ঐতিহাসিক পদযাত্রায় অংশ নিতে পারলাম না। কিন্তু তুমি গাড়িতে বসে থাকবে কেন? নামো। হাঁটো ওদের সঙ্গে।
ভরত নেমে পড়ে মিছিলে যোগ দিল। কত রকমের মানুষ এক সঙ্গে হাঁটছে। কারুকে কারুকে দেখলেই বোঝা যায় সম্রান্ত পরিবারের লোক, তাদের পাশাপাশি কেরানি, দোকানদার বা ফেরিওয়ালা শ্রেণী, ছাত্রদের সঙ্গে মিশে আছে শিক্ষক-অধ্যাপক। মিছিলের মাঝামাঝি একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি সবাইকে উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বন্দে মাতরম ধ্বনি দিচ্ছে, তার দিকে সকলেরই চোখ পড়ে। অত্যন্ত সুদর্শন, শাল-প্রাংশু মহাভুজ ব্যক্তিটিকে বাঙালি বলে মনেই হয় না। তবে কি অবাঙালিরাও বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। কথায় কথায় জানা গেল, ওই ব্যক্তিটি বাঙালিই বটে, ওঁর নাম রমাকান্ত রায়, সদ্য জাপান থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে ফিরেছেন। মিছিলে মুসলমানদের সংখ্যা কম, কিন্তু একজন দাড়িওয়ালা মৌলভি মহা উৎসাহে সকলের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন, অনেকেই এঁকে চেনে, ইনি মৌলভি লিয়াকৎ হোসেন।
টাউন হলের কাছে পৌঁছে দেখা গেল অন্য দিক থেকেও আরও মিছিল এসে সে স্থানটি এর মধ্যেই এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। মানুষ, মানুষ, অসংখ্য মানুষ! এই শহরের ইতিহাসে আগে কখনও এক সঙ্গে এত মানুষ পথে নামেনি, একই উদ্দেশ্য নিয়ে এক জায়গায় মিলিত হয়নি। এত কলকোলাহলের মধ্যে মিটিং হবে কী করে? অথচ একটা মিটিং হওয়ার খুবই প্রয়োজন আছে। শুধু প্রতিবাদ নয়, আন্দোলন চালিয়ে যাবার পথনির্দেশ চায় সাধারণ মানুষ। এবং সেই নির্দেশ কোনও মান্যগণ্য নেতার মুখ থেকে শোনাই কার্যকর হবে। বড়দরের নেতার অভাব নেই, অনেক রাজা-মহারাজাও এখানে সমবেত হয়েছেন, কিন্তু এমন কে আছেন যাঁর কণ্ঠস্বর এত সহস্র মানুষ শুনতে পাবে? তা অসম্ভব?
নেতারা দ্রুত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। মিটিং হবেই, তবে একটি নয়, তিনটি, এবং তা চলবে একযোগে। টাউন হলের দোতলায় হলঘরে একটি, একতলায় একটি এবং সামনের মাঠে একটি। তিনটি সভাতে যাতে একই রকম ঘোষণা হয়, তাও ঠিক করে নিলেন তিন সভাপতি। কাশিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রথম সভার সভাপতি, অন্য দুটির ভূপেন্দ্রনাথ বসু ও অম্বিকাঁচরণ মজুমদার। অনেক উঁদে উঁকিল ব্যারিস্টার রয়েছেন তাঁদের পাশে।
সবিস্তারে পটভূমিকা আলোচনা করার পর মূল প্রস্তাব দাঁড়াল দুটি। বাংলাকে ভাগ করার জন্য সরকারের অযৌক্তিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। যতদিন না প্রত্যাহৃত হয়, ততদিন চলবে প্রতিরোধ আন্দোলন। আর প্রতিরোধের প্রধান অস্ত্র বয়কট। কেউ বিদেশি দ্রব্য কিনবে না, কেউ বিদেশি পণ্য ব্যবহার করবে না।
বক্তৃতার মাঝে মাঝেই জনতা তুমুল হর্ষধ্বনি করতে লাগল। বয়কট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সকলে হাততালি দিয়ে উঠল, সেই শব্দ যেন পৌঁছে গেল শহরের অন্য প্রান্ত পর্যন্ত
হেম বলল, ব্রাদার, শুধু সমর্থন করলে হবে না, এখনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে! তোমার পায়ের বিলিতি জুতো খুলে ফেল!
ভরত বলল, জুতো খুলে… খালি পায়ে যাব?
হেম জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ। জুতো খুলে শূন্যে ছুঁড়ে দাও!
ভরত দুই লাফে ঘোড়া গাড়ির ওপরে উঠে দাঁড়াল। পা থেকে জুতো খুলে চিৎকার করে বলল, বন্ধুগণ, বিদেশি বর্জন এখন থেকেই শুরু হোক। এই আমি আমার বিলিতি জুতো ত্যাগ করলাম!
অমনি হাজার হাজার লোক নিজেদের জুতো ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করল। অনেকে খুলে ফেলল গায়ের জামা। সামনের একটা গোলা থেকে খড়-পাটকাঠি টেনে এনে তৈরি হল লর্ড কার্জনের মস্ত এক কুশপুত্তলিকা। তাতে আগুন ধরিয়ে দেবার পর এতগুলি কণ্ঠের বন্দে মাতরম ধ্বনি যেন বিদীর্ণ করে দিল গগন।
জনকণ্ঠের সেই গর্জন বড় লাটভবন থেকে শোনা যায়। লর্ড কার্জন গোয়েন্দা মারফত দশ মিনিট অন্তর মিছিল ও সমাবেশের খবর নিচ্ছেন। তাঁর মুখমণ্ডলে উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই, বরং হাসছেন। তিনি তো জানেনই, এ বঙ্গে বালখিল্যদের দাপাদাপি। দুচারদিন চেঁচালেই ওদের গলা ভাঙবে, তারপর চুপ করে যাবে। এই দুর্বল, অক্ষম জাতির সাধ্য আছে সরকারের নীতি বদলাবার?
টাউন হলের সভার গর্জন যখন প্রবলতর হল, তখন কার্জন পাশ ফিরে ফ্রেজারকে সকৌতুকে বললেন, Conceive the howls! They will almost slay me in Bengal.