অনেক দিন বাদে সূর্যকে আজ আবার খুব অস্থির মনে হচ্ছে। তোলপাড় চলছে বুকের মধ্যে। মাঝে মাঝে শক্ত হয়ে যাচ্ছে চোয়াল, চোখে দৃষ্টি ধারালো। তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে রূপলাল কত কিছু বলে যাচ্ছে, কিছুই শুনছে না সূর্য।
সূর্যর এই অস্থিরতা কীসের জন্য? তা সে নিজেই জানে না। একসময় সে মাঠে মাঠে ঘুরেছে, না খেয়ে থেকেছে, জেল খেটেছে, হঠাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেমে না গেলে তার ফাঁসিও হতে পারত। কিন্তু সেই সব দিনগুলির জন্য তো তার মনে কোনও গর্ববোধ নেই। সে তো বিনিময়ে কিছু চায়নি কখনও। শুধু তার যে সব পরিচিত ব্যক্তি মারা গেছে, অজ্ঞাত থেকে গেছে, তাদের কথা মনে পড়লেই তার নিশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। ওরাই ছিল সূর্যর বন্ধু, আর কেউ নেই এখন। সূর্যর মনে হচ্ছে বার বার, সে নিজেও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
শহিদ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় দু’জন মন্ত্রী ভোট ভিক্ষা করছিল নির্লজ্জ ভাবে, এটা সে কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। বার বার তার মনে হচ্ছে, একবার অন্তত মঞ্চে লাফিয়ে উঠে ওই শ্রীবাস্তব আর সাকসেনার ঘাড় ধরে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া উচিত ছিল। পরক্ষণেই আবার ভাবছে, না, না, আমার ওসব করা উচিত নয়। ওরা যা খুশি করুক, দেশটা জাহান্নামে নিয়ে যাক। আমি একা কী করতে পারি?
সূর্য যখন প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন সে ছিল প্রায় কিশোর। অনেকখানিই ছিল জেদ আর গোঁয়ারতুমি। এরপর অনেকগুলো বছর গেছে, বাস্তব সম্পর্কে তার জ্ঞান হয়েছে, বইটইও পড়েছে অনেক। এখন সে জানে, এই পৃথিবীতে মানুষের অধিবাসের মধ্যে কত জটিলতা। মানুষের মঙ্গলের জন্য যে সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়, সেটাই আবার এক সময় মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। দু’-এক শতাব্দী পর পর মানুষকেই সেই জন্য আবার সেই ব্যবস্থা ভাঙতে হয়। যারা এই ভাঙার কাজে অগ্রণী হয়ে পড়ে, তাদের সহজে ফেরার পথ থাকে না। কেউ সেই পথে খানিকটা এগিয়ে আবার ছিটকে পড়লে, তার মতন নিঃস্ব আর কেউ নেই। সে কোথাও আশ্রয় পায় না।
ভারতের এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য এই কথাই টের পাচ্ছে, তার নিজস্ব কোনও জায়গা নেই। কোথাও সে মিলেমিশে থাকতে পারবে না। সে পরিত্যক্ত। অথবা, এখন তার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় সে অন্যদের আঘাত করে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারে ওদের, সে ভাঙার কাজে নামতে পারে। অথবা মিশে যেতে পারে প্রতিবাদহীন গড্ডালিকার স্রোতে। এ বিষয়ে মনস্থির করাও সহজ কথা নয়।
রূপলাল বলল, এই তো দানৌলি বাজারে এসে গেছি। আপনি কোন বাড়িতে যাবেন?
সূর্য দেখল, দোকানপাট অধিকাংশই বন্ধ, পথে লোকজন কম, মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে।
সূর্য রূপলালের কথার কোনও উত্তর দিল না। একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। তার কিছুই মনে নেই। কোথায় সে বাড়ি খুঁজবে?
অন্ধ যে রকম রাস্তা চিনে চিনে যায়, সূর্য সেই রকম ঘুরতে লাগল। তারপর হঠাৎ একটা সাদা রঙের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে!
বাড়িটা দোতলা, পুরনো আমলের, সামনের দিকে এখন একটা কাপড়ের দোকান। দোকান বন্ধ, ওপর তলাটাও অন্ধকার।
রূপলাল জিজ্ঞেস করল, এই বাড়িতে আপনার চেনাজানা কেউ থাকে?
সূর্যর এতক্ষণ কিছুই মনে পড়ছিল না, কিন্তু এখন তার কোনও সন্দেহ নেই, এই বাড়িতেই তার শৈশবের কয়েকটা বছর কেটেছে। সে চোখ বুজে বলে দিতে পারে, বাড়িটা দু’মহলা, সামনের দিকটা পার হলেই একটা সিমেন্ট বাঁধানো বড় চাতাল, তার এক পাশে একটা ইঁদারা। ইদারার উলটো দিক থেকে দোতলায় যাবার সিঁড়ি উঠে গেছে। ওপরে টানা বারান্দা। বারান্দার পাশে একটা ছোট ছাদ।
সূর্য অন্যমনস্ক ভাবে তার বাঁ হাতের কনুইতে হাত দিল। একটা গভীর কাটা দাগ, অনেক দিনের পুরনো। সূর্য একবার ওই ছোট ছাদটায় আছাড় খেয়ে পড়ে হাত কেটেছিল।
হঠাৎ কী করে এসব মনে পড়ে যায়? কোথায় থাকে এসব স্মৃতি? তার একথাও মনে পড়ল, একদিন সে বাবার হাত ধরে মিঞা তানসেনের সমাধি দেখতে গিয়েছিল। বাবা ওখানে প্রায়ই যেতেন, সংগীতের ওপর তার খুব টান ছিল।
সূর্য রূপলালকে জিজ্ঞেস করল, তানসেনের সমাধিটা কোথায়?
রূপলাল এই যুবকটির ধরনধারণ বুঝতে পারছে না। সে বিস্মিতভাবে বলল, সেখানে যাবেন? এখন কি টাঙ্গা মিলবে?
সূর্য বলল, না, সেখানে যাব না। এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।
এ-বাড়িতে যাবেন না?
সূর্য ভাবল, তার জন্মস্থানটি দেখে তার কি খুব রোমাঞ্চ হবার কথা ছিল? বাবা কেন এখানে আসতে বলেছিলেন? অসুখের ঘোরে প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই না। এখানে এসে তার তো নতুন কিছু বোধ হচ্ছে না। সামান্য কৌতূহল ছাড়া।
তারপর মনে পড়ল, তার জন্ম তো এ বাড়িতে নয়। তার মা তো অন্য বাড়িতে থাকতেন। মা মারা যাবার পর সূর্যকে এ বাড়িতে আনা হয়। কিন্তু আগের বাড়িটা চিনে বার করা তার পক্ষে অসম্ভব, তখন সে খুবই ছোট ছিল।
সে বলল, না, এবাড়িটা এমনি দেখতে এলাম। আচ্ছা, রূপলালজি, অনেক দিন আগে একজন মারা গেছেন, তিনি কোন বাড়িতে থাকতেন, সেটা কি খুঁজে বার করা যায় এখন?
রূপলাল বলল, কে?
সূর্য বলল, তার নাম ছিল নাসিম আরা বানু। ডাক নাম বুলবুল। তিনি খুব নাচগান জানতেন।
রূপলালের চোখ চকচক করে উঠল। বলল বাইজি?
নিজের মা সম্পর্কে এ রকম পরিচয় অপরের মুখে শুনতে কারওর ভালো লাগে না। কিন্তু সূর্য বিচলিত হল না। বলল, হ্যাঁ।
কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখলে হয়।
সেটা এ-পাড়ায় নয়। বোধহয় জনকগঞ্জের দিকে।
আমি বাইজিপাড়া চিনি। যাবেন সেখানে?
চলুন।
এ-ব্যাপারে রূপলালের খুব উৎসাহ দেখা গেল। সে সূর্যকে নিয়ে চলে এল অন্য একটা রাস্তায়। নিচু গলায় বলল, যে মারা গেছে তার খোঁজ নিয়ে কী হবে? আমার চেনাজানা দু-এক জন বাইজি আছে, গানটান শুনবেন? গোয়ালিয়ার ঘরানার গান বড় মিষ্টি।
একটা বাড়ির সামনে একজন মোটা মতন তোক দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে রাস্তার দিকে নজর রাখছিল। রূপলাল তাকে কী যেন জিজ্ঞেস করল। সে আবার রূপলালকে নিয়ে গেল অন্য কয়েক জনের কাছে। অনেক রকম কথা বলাবলি হল। রূপলাল ফিরে এসে সূর্যকে বলল, না, এরা ওনামে কারোকে চেনে না।
সূর্য একটু হাসল। সে শুনেছিল, তার মায়ের রূপ এবং নৃত্য-প্রতিভার খুব খ্যাতি ছিল। একবার দেখে কেউ তাকে ভুলতে পারত না। মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর এখানকার কেউ তাকে মনে রাখেনি। সূর্যর ইচ্ছে হচ্ছে, তার মায়ের সমাধির জায়গাটা একবার দেখে আসতে। মায়ের মুখখানাও তার মনে নেই।
সে রূপলালকে অনুরোধ করল, আরও কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করুন। পুরনো লোকেরা বোধহয় চিনতে পারবে।
এদিক-ওদিক ঘুরে কয়েক জায়গায় খোঁজখবর নেওয়া হল। কেউ কিছু জানে না, মৃত নর্তকীর সম্পর্কে কেউ উৎসাহই দেখাতে চায় না।
একজন শুধু বলল, আপনারা বুলবুলের কথা বলছেন তো? আমি জানি–আসুন, আমি বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছি।
লোকটি খুব রোগা এবং লম্বা। মুখখানা ভয়-পাওয়া মানুষের মতন। হাটবার সময় বার বার পেছন ফিরে তাকায়। লোকটির বয়স বছর পঞ্চাশেক, এ হয়তো জানতেও পারে।
লোকটি ওদের নিয়ে একটা মস্ত বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভেতরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সূর্য তার স্মৃতিকে মুচড়ে মনে করবার চেষ্টা করল, এই বাড়িতেই সে জন্মেছিল কিনা। কিছুই মনে পড়ছে না।
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওরা উঠে এল দোতলায়। কয়েকটা ঘরের ভেজানো দরজা থেকে সরু আলো দেখা যাচ্ছে এখন, ভেতরে হারমোনিয়াম ও ঘুঙুরের শব্দ।
একটা ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল লোকটা। ঝলমলে সালোয়ার কামিজ পরা একটি যুবতী মেয়ে দরজা খুলে বলল, কী?
রোগা লোকটা বলল, মেহমান এসেছে।
রূপলাল হেসে বলল, জিন্দা বুলবুলের কাছে নিয়ে এসেছে। আপনার নাম বুলবুল বুঝি?
মেয়েটি হেসে বলল, জি।
রূপলাল কৌতুকের সঙ্গে সূর্যকে দেখিয়ে বলল, আমার এই দোস্ত আপনাকে দেখতে এসেছেন। ইনি বলছেন, ইনি আপনাকে চেনেন।
মেয়েটি সূর্যর হাত ধরে বলল, আমিও তো অনেক দিন ধরে এঁকে চিনি। আইয়ে, অন্দর আইয়ে।
সূর্য একবার তাকাল মেয়েটির হাতের দিকে। মেয়েটি বিনা দ্বিধায় তার হাত ধরেছে। সূর্য হাত ছাড়িয়ে নিতে পারে। নিল না। মুখ তুলে মেয়েটির চোখের দিকে দৃষ্টি রাখল। ঝকঝকে দুটি চোখ। গভীর ভুরু। মসৃণ কপাল। কানের লতির পাশে ঢেউ-খেলানো দুই গুচ্ছ চুল। শিশুর মতন চিবুক। চিবুকটা সত্যিই বড় সুন্দর। হাত ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে।
মেয়েটি রহস্যময় ভাবে হেসে বলল, পরদেশি আমায় চিনতে পারছেন না? আমার নাম বুলবুল।
সূর্যও হেসে বলল, হ্যাঁ, চিনতে পারছি।
ঘরটি বেশ বড়। মেঝেতে ফরাস পাতা, তার ওপর কয়েকটা লাল ভেলভেটের তাকিয়া ছড়ানো। দেওয়ালে রাধাকৃষ্ণের দু-তিনটে ছবি। একটা মোটাসোটা কাবুলি বেড়াল ঘরের কোণে চুপ করে বসে ছিল, ওদের দেখে পিঠ ফুলিয়ে দাঁড়াল। ঘরটাতে সুন্দর ধূপের গন্ধ।
বুলবুল নামের মেয়েটি সূর্যর হাত ধরে টেনে এনে ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রহস্যভরা গলায় বলল, এতদিন আসোনি কেন? আমি কত দিন তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি!
রূপলাল বলল, দেখুন, কী রকম ঠিক জায়গায় নিয়ে এলাম। মিছিমিছি এদিক-ওদিক ঘুরছিলেন!
ওদের পথপ্রদর্শক লম্বা মতন লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। রূপলাল তাকে বকশিশ দিল পাঁচ টাকা। সে তবু সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
বুলবুল সূর্যর বাহুতে চাপ দিয়ে বলল, তসরিফ রাখিয়ে। কুছ পিয়েঙ্গে?
সূর্য জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম বুলবুল? তোমার ভালো নাম কী?
বুলবুল হাসিতে সারা শরীর দোলাতে লাগল। নকল হাসি নয়। সে যখন তখন হাসতে ভালোবাসে। হাসতে হাসতেই বলল, বুলবুলের চেয়ে আবার ভালো নাম হয় নাকি? এনাম তোমার পছন্দ হল না? আর কী নাম চাও? আমার পাশের ঘরে থাকে পরিবানু, তাকে ডাকব?
রূপলাল বলল, আরে না না, আমার দোস্ত তোমার কাছেই আসতে চেয়েছে। সারা সন্ধে থেকে শুধু বুলবুল বুলবুল করছে।
সে সূর্যকে জোর করে বসাল। তারপর কোলের ওপর একটা তাকিয়া টেনে এনে বলল, গান শুনব, নাচ দেখব। দু-আড়াই ঘণ্টা বাদে ফেরার জন্য টাঙ্গা পাওয়া যাবে তো?
বুলবুল এবার মুখে রাগের ভাব আনল। এটা কপট রাগ। বলল, আসতে-না-আসতেই যাবার কথা? তোমাদের আমি আজ সারা রাত আটকে রাখব।
রূপলাল পকেট থেকে দশ টাকার কয়েকটা নোট বার করে বলল, কিছু আনাও টানাও।
বুলবুল জিজ্ঞেস করল, বিয়ার? না হুইস্কি? আমি বেরান্ডি ভালোবাসি।
রূপলাল বলল, ম্যায় তো দারু পিতে নেহি। এই বাঙালিবাবুকো পুছো। আমার জন্য। কয়েক খিলি পান আনিয়ে দাও।
বুলবুল তখন সূর্যকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী খাবে, মেহমান?
সূর্য মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।
বুলবুল হাঁটু গেড়ে সূর্যর সামনে বসে পড়ে বলল, একদম কিছু না? একটা কিছু খাও!
সূর্যর শান্ত মুখখানা দেখলে মনে হয়, সে যেন এক নবীন সন্ন্যাসী। এক নর্তকী তার মান ভাঙাচ্ছে।
আসলে, বাইরে শান্ত ভাব দেখালেও সূর্য ভেতরে ভেতরে বিচলিত। সে তন্ন তন্ন করে দেখছে মেয়েটিকে। মেয়েটির রূপের আকর্ষণ আছে, সূর্যর রূপ-পিপাসু মনটা জেগে উঠেছে। মেয়েটির চড়া লাল রঙের পোশাক, অভ্রের গুঁড়ো-মাখা মুখ, রক্তবর্ণ আঙুলের নখ, সব মিলিয়ে একটা ঝকমকে ব্যাপার। চোখের পাতায় ঘন করে আঁকা সুর্মা, ধারালো নাক, টুকটুকে ঠোঁট, গলায় একটা রঙিন পুঁতির মালা, কাঁচুলি বাঁধা বুক বড় বেশি উদ্ধত, সরু কোমর ও ভারী নিতম্ব, পায়ে রুপোর মল। একে হাত বাড়িয়ে কাছে। টেনে নিতেই ইচ্ছে করে।
বুলবুল লম্বা লোকটাকে কী সব আনতে দিয়ে আবার এসে সূর্যর কাছে বসল। এবার অভিমান দেখিয়ে বলল, তুমি কোনও কথা বলছ না কেন?
রূপলাল বলল, তুমি একটা নাচ দেখাও। তখন মেজাজ শরিফ হবে।
বুলবুল বলল, তবলচিকে খবর পাঠিয়েছি। সে আসুক।
রূপলাল বলল, না, না, তবলচির কোনও জরুরত নেই। তুমি এমনিই নাচ দেখাও। কিংবা একটা গানা শুরু করো!
তবলচি ছাড়া আমি নাচতেও পারি না, গাইতেও পারি না।
ঘরে অন্য লোক আমার ভালো লাগে না। গুন গুন করে একটা গান করো। কিংবা তবলা দাও, আমি ঠেকা দিতে জানি। কাজ চলে যাবে।
দাঁড়াও, ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আগে পানটান আসুক। কী গো মেহমান, তোমার কী পছন্দ বললে না?
সূর্য এবার ধীরে ধীরে বলল, তুমি নাচ দেখিয়ে কিংবা গান শুনিয়ে টাকা নাও, তাই না? লোকে টাকা খরচ করে তোমার রূপ দেখতে আসে। তোমার রূপের দাম কত?
বুলবুল আবার হাসিতে গড়িয়ে পড়ল। বলল, কী অদ্ভুত কথা শোনো! রূপের আবার দাম! আমার রূপের কিম্মত দশ জুতি। যাবার সময় আমাকে দশ ঘা জুতো মেরে যেয়ো, তা হলেই হবে।
সূর্য এ রকম হেঁয়ালির কথার মানে বুঝতে পারল না। বলল, না, তুমি তো সত্যিই সুন্দর। টাকা না নিলে তোমার চলবে কেন?
রূপলাল বলল, আরে দোস্ত, ও রকম ভাবে টাকার কথা বলতে নেই। যাবার সময় ওকে খুশি করে গেলেই হবে।
সূর্য একটু বিরক্তির মুখভঙ্গি করল। সে তো দরদাম করতে চাইছে না, সে জানতে চাইছে।
বুলবুল বলল, আমি আবার সুন্দর নাকি? কেউ বলে না। এই দেখো না, আমার গালে বসন্তের দাগ!
ঘন প্রসাধনের জন্য আগে দেখা যায়নি। এবার সূর্য লক্ষ করল, সত্যিই বুলবুলের গালে কয়েকটা বসন্তের দাগ আছে। কিন্তু এর জন্য তার রূপের তো কোনও হানি হয়নি। এর মুখে একটা সারল্য আছে। নিত্য নতুন অচেনা লোকদের মনোরঞ্জন করে, কত রকম মিথ্যে কথা বলতে হয়। তবু মুখে এই সারল্য থাকে কী করে? এখনও কেউ এসে নতুন করে একে ভালোবাসতে পারে। সেই ভালোবাসার স্বাদ কী রকম?
বড় রেকাবির ওপর দশবারো খিলি পান। তার থেকে এক খিলি পান নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে রূপলাল বলল, একটা গান শোনাও। একটা বেশ মিঠি ঠুংরি ধরো তো!
বুলবুল তাকাল সূর্যর মুখের দিকে। সূর্য দু’হাত মেঝেতে হেলান দিয়ে বসে আছে, চোখ বুলবুলের দিকে স্থির নিবদ্ধ। যেন সে কোনও মানুষকে দেখছে না, দেখছে একটা সুন্দর মূর্তি।
রূপলালের অনুরোধ সত্ত্বেও বুলবুল সূর্যকে জিজ্ঞাসা করল, কী গান গাইব?
সূর্য মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল।
বুলবুল বেশ নিচু গলায় গান ধরল:
বৈঠি শোঁচে ব্রিজবাম
নাহি আয়ে
ঘনশ্যাম
ঘেরি আই বদরিয়া…
গানের কথা সামান্যই, লাইনগুলো ঘুরে ঘুরে আসে, কণ্ঠস্বর মুচড়ে মুচড়ে প্রণয় ও বেদনার সুর উচ্ছ্বসিত হয়। রূপলাল অনবরত মাথা দোলায় এবং সমের মুখে এসে হাঁটুতে চাপড় দেয়। সূর্য সংগীতের রস তেমন বোঝে না, সে গানের বদলে গায়িকার দিকে সমস্ত মনোযোগ দিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
গানের শেষে রূপলাল আহা-হা-হা শব্দ তুলে প্রগম্ভ হয়ে ওঠে। বুলবুল সূর্যর থুতনিতে হাত দিয়ে বলল, কী, তোমার কেমন লাগল?
সূর্য সংক্ষিপ্ত ভাবে জানাল, ভালো।
বুলবুল হেসে বলল, আমি গান গাইতে জানিই না। লোকে আমার নাচ দেখতে আসে।
সূর্য বুঝতে পারল, এইটিই বুলবুলের বৈশিষ্ট্য। তার রূপের প্রশংসা করলে সে বলবে
যে সে সুন্দরী নয়। তার গানের প্রশংসা করলে সে বলবে, গান জানে না।
সূর্য বলল, তা হলে এবার নাচ দেখাও!
তাও কি তোমার পছন্দ হবে? তুমি যা গম্ভীর!
বুলবুল দুটি গেলাসে ব্র্যান্ডি ঢেলে একটা এগিয়ে দিল সূর্যর দিকে। সূর্য বলল, আমার জন্য দরকার নেই।
বুলবুল মিনতি করে বলল, একটুখানি! আমার জন্য!
রূপলাল বলল, খান না। একটু খেয়ে দেখুন।
সূর্য রূপলালের দিকে তাকাল। রূপলাল মদের ব্যবসা করে, কাল সে পারমিট আদায় করতে যাবে মন্ত্রীর কাছে। কিন্তু সে নিজে মদ খায় না, অন্যদের পেড়াপিড়ি করে।
সূর্য ওদের সঙ্গে তর্ক করল না। গেলাসটা পাশে সরিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ আগে তার মাথার মধ্যে যে ঝড় বইছিল, এখন তা থেমে গেছে। এখন তার ভালো লাগছে।
বুলবুল অনেকখানি নিট ব্র্যান্ডি এক চুমুকে খেয়ে উঠে দাঁড়াল। দু’পা জোড় করে নূপুরের ঝংকার তুলল একবার। তারপর রাগত ভাবে বলল, তবলিয়া ছাড়া নাচ হয়? তোমরা কেমন লোক গো!
রূপলাল ঘরের কোণ থেকে বায়া-তবলা জোড়া নিয়ে এসে বলল, আমি তাল দিচ্ছি, তুমি ধরো না।
তবলায় চাঁটি দিয়ে রূপলাল দেখল, ঠিক মতন বাঁধা নেই। সুরে লাগছে না। খানিকটা হাতুড়ি ঠোকাঠুকি করে সে যখন আর কয়েক বার আওয়াজ তুলল, তখন বোঝা গেল সে একেবারে অনভিজ্ঞ নয়, মোটামুটি কয়েকটা বোল তুলতে পারে।
বুলবুল একটু সরে গিয়ে হাতদুটো নিজের বুকের কাছে জোড় করে দাঁড়াল। পা দুটো পর্যায়ক্রমে ঠুকল কয়েক বার। তারপর খুব ধীর লয়ে নাচ শুরু করল।
সূর্যর মনে হল, ঘরটা যেন কী রকম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নাচের সময়ে ঘর-ভরতি লোক থাকবে, মাইফেলে যে রকম থাকে, এদিক-ওদিক থেকে সবাই তারিফ করবে, তা হলেই যেন নাচ ঠিক জমে।
পরক্ষণেই তার মনে হল, এ-ঘরে রূপলাল এখন না থাকলেই ভালো হত। শুধু সে একা যদি বুলবুলের নাচ দেখত, তা হলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতে পারত। তবলা ছাড়া নাচ হয় না এ আবার কী অদ্ভুত নিয়ম।
সে তাকিয়ে রইল বুলবুলের মুখের দিকে। মুখটা এখন অন্য রকম। এই ব্যাপারটা সূর্য আগেও লক্ষ করেছে। কোনও শিল্পী যখন তার নিজস্ব শিল্পের মধ্যে ডুবে যায়, তখন তাকে অন্য মানুষের মতন দেখায়। সেই মুখখানা চেনা কারওর মতন নয়।
বুলবুলের হাত ও পা ধারালো অস্ত্রের মতন চতুর্দিকে সঞ্চালিত হচ্ছে। তার শরীরে এখন অনেক তরঙ্গ। বস্তুত, রেখা ও রং এবং সুর ও তালের ঝাঁপটাঝাঁপটির মধ্যে মেয়েটি যেন কোথায় আড়ালে পড়ে গেছে। বুলবুলকে আর দেখা যাচ্ছে না। তার উড়ন্ত গোল ঘাঘরাটিকে মাঝে মাঝে দেখাচ্ছে একটা বিরাট ফুলের মতন।
নাচতে নাচতে বুলবুল যখন দু’-এক বার রূপলালের মুখের কাছে হাত কিংবা শরীর আনছে, রূপলাল মাথা হেলিয়ে সরে যাচ্ছে। সূর্য লক্ষ করল, রূপলাল প্রত্যেক বারই খুব সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছে বুলবুলের স্পর্শ। যেন সে একটা অচ্ছুত। ছেলেটি অদ্ভুত সত্যিই, সে মদ খায় না কিন্তু মদ কেনার জন্য টাকা দেয়। সে বাইজির নাচ দেখে ফুর্তি পায়, কিন্তু তাকে স্পর্শ করে না।
নাচ শেষ হবার পর রূপলাল বলল, ধুর, তোমার নাচের চেয়ে তোমার গানই বেশি ভালো। দ্রুত লয়ে ঠিক ছিল না!
বুলবুল অভিমান করে বলল, আমায় কেউ ভালো বলে না। আমার কেউ পছন্দ করে না।
সূর্যর দিকে ফিরে বলল, তোমারও ভালো লাগেনি তো?
সূর্য বলল, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে!
বুলবুল কান্না কান্না গলায় বলল, মোটেই না। আমি ঠিক জানি! তোমরা পরিবানুর কাছে যাবে? আমি দেখিয়ে দিচ্ছি ঘর!
সূর্য বলল, না, কোথাও যাব না। তুমি খুব সুন্দর।
বুলবুল গেলাসে অনেকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে লম্বা চুমুক দিল। তারপর সেই এঁটো গেলাসটা সূর্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও! আমি বলছি খাও!
সূর্য হাত দিয়ে বাধা দিয়ে বলল, কেন জোর করছ, আমি ও-সব খাই না।
বুলবুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমি জানি, তুমি আমায় ঘেন্না করছ।
সূর্য আহত ভাবে বলল, না, তা নয়।
বুলবুল গেলাসটা তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করে বলল, যাও, তোমরা পরিবানুর কাছে চলে যাও! আমি কি তোমাদের ধরে রেখেছি?
এতক্ষণ বাদে সূর্য স্বচ্ছ ভাবে হাসল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, দাও–
সূর্য গেলাসটা নিয়ে একটা চুমুক দিল। বিষম লেগে গেল গলায়। তাই দেখে আবার হাসিতে লুটিয়ে পড়ল বুলবুল। সূর্যর উরুতে চাপড় মেরে বলল, ঠিক হয়েছে! জব্দ করেছি তো! আর খাবে?
রূপলাল হাই তুলে বলল, অনেক রাত হয়ে গেল। এবার ফিরতে হবে। চলুন ভাদুড়ীজি–
সূর্য এই সুযোগটা খুঁজছিল। মুখ তুলে বলল, আপনি যান, আমি এখানে থাকব।
রূপলাল অবাক হয়ে বলল, এখানে থাকবেন? আর কতক্ষণ?
তা জানি না। হয়তো অনেক দিন।
কী বলছেন আপনি? আপনার জিনিসপত্তর।
সে পরে ব্যবস্থা হবে।
সূর্য বুলবুলের দিকে ফিরে বলল, আমাকে তোমার কাছে থাকতে দেবে?
বুলবুল বলল, সে আপনার মর্জি!
রূপলাল আরও কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করল সূর্যকে ফিরিয়ে নেবার। ব্যর্থ হল। অগত্যা সে উঠে পড়ল একাই চলে যাবার জন্য। বাইজির ঘরে রাত কাটাবার কথা সে ভাবতেই পারে না।
রূপলালকে বিদায় দিয়ে এসে বুলবুল দরজা বন্ধ করল। তারপর বলল, আমি আজ গান গাইব না, নাচব না, কিছু করব না। আমি শুধু শরাব খাব! মেহমান, তুমি এখানে থাকতে চাইলে কেন?
সূর্য বলল, আমি অনেক খুঁজে খুঁজে তোমার কাছে এলাম। তোমাকে না পেলে আমার সবকিছু নষ্ট হয়ে যেত।
সত্যি?
হ্যাঁ। কাছে এসো।
বুলবুল দৌড়ে এসে সূর্যর গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার একটু নেশা হয়েছে। অতি ব্যস্ততায় সে যেন সূর্যর ঠোঁট খুঁজে পাচ্ছে না। তার চোখ, কপাল, গাল চুমোয় ভিজিয়ে দিল।
সূর্য তাকে ধরে সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল, শোনো, আগে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি।
বুলবুল পাগলাটে গলায় বলল, আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। আগে বলো, তুমি সত্যিই আমাকে খুঁজতে এসেছিলে?
হ্যাঁ, সত্যি।
কে বলেছে আমার কথা?
কেউ বলেনি।
আমি জানতাম, তুমি ঠিক একদিন আসবে। তুমি আমার ঘনশ্যাম। যদিও তোমার গায়ের রং খুব গোরা–
বুলবুল তার দুটো হাত চেপে ধরল সূর্যর গালে। একেবার মুখের সামনে মুখ! সূর্য চোখ বুজল। কয়েক লহমার জন্য তার মনে পড়ল সেই নারীর কথা, যে তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। যাকে সে কোনও দিন আর দেখবে না। যে তাকে বলেছিল, তুমি যেখানেই থাকো, আমি সব সময় তোমার সঙ্গে আছি।
সূর্য চোখ খুলে আপন মনে বলল, না, সে নেই। বুলবুল আছে।
একটানে সে বুলবুলকে নিয়ে এল নিজের বুকের ওপর।
ওড়নাটা আগেই খসে গিয়েছিল বুলবুলের গা থেকে। সূর্য ওর কঁচুলিটা ছিঁড়ে ফেলার জন্য টানাটানি করতে লাগল। সহজে ছেড়ে না। বুলবুল নিজেই সেটা খুলে ফেলে বলল, কী চাও?
সূর্য বুলবুলের নগ্ন স্তনে মুখ রেখে বলল, তোমাকে। আর কিছু না।
বুলবুল বলল, এই তো আমি। আমাকে নাও।
সূর্য বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করবে না? আমাকে তাড়িয়ে দেবে না?
বুলবুল বলল, আমার কী ভাগ্য, তুমি এসেছ। আমায় কেউ পছন্দ করে না। আমার মুখে বসন্তের দাগ–
তারা অন্ধ, তারা তোমাকে দেখতে পায় না। আমি তোমাকে একটু ভালো করে দেখি?
সে বুলবুলকে সোজা করে বসিয়ে তার পিঠ ও কোমরে নিজের হাত রাখল। বুলবুলের চোখে ঈষৎ রক্তিম ছটা, সে হাতে আবার ব্র্যান্ডির গেলাস তুলে নিয়েছে। সূর্যর মধ্যে জেগে উঠছে অসম্ভব রতি সম্ভোগের ইচ্ছে। এখন আর অন্য কিছু মনে পড়ে না।
পুনরায় বুলবুল সূর্যর কণ্ঠলগ্না হয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাল। দীর্ঘস্থায়ী হল চুম্বন। যেন, পরস্পর জীবনীশক্তি বিনিময় করছে। বুলবুল উঠে এসে বসল সূর্যর কোলের ওপর। সূর্য তার ঘাঘরার দড়ি খোলার জন্য হাত দিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তোমার বয়স কত?
বুলবুল বলল, বয়স? একশো-দুশো হবে।
সূর্য মনে মনে বলল, বুলবুলের বয়স তিরিশের কাছাকাছি নিশ্চয়ই। ঠিক এই রকমই বয়সে, আর একজন নর্তকী, তার নামও ছিল বুলবুল, তাকে দেখে তার বাবা আকৃষ্ট হয়েছিল। সূর্য যেন সেই একই জায়গায় ফিরে এসেছে।
বুলবুলের শরীরটা পাখির মতনই সূর্যর আলিঙ্গনের মধ্যে ছটফট করে। সূর্যর শার্টের বোতামগুলো খুলে ফেলে তার বুকে মুখ ঘষতে লাগল বুলবুল। বুলবুলের মসৃণ খোলা পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে সূর্য জিজ্ঞেস করল বুলবুল, অনেক দিন আগে আর একজন বুলবুল থাকত এখানে, সে-ও খুব ভাল নাচত, তুমি তার নাম শুনেছ?
না।
তোমার মা-ও কি নর্তকী ছিল?
বুলবুল মুখ তুলে বলল, তুমি এত প্রশ্ন করছ কেন?
সূর্য তাকে আদর করে বলল, এমনিই। বলো না।
হ্যাঁ। আমার মা কোথায় চলে গেছে!
সূর্য আপন মনে হাসল। সে আর বুলবুল তো একই। একজন নর্তকীর ছেলে হিসেবে সে যদি এখানেই থেকে যেত, তা হলে এতদিনে সে গুন্ডা, দালাল কিংবা তবলচি হত। কিংবা ব্যবসা করত রূপলালের মতন। তার বদলে কত দূর চলে গিয়েছিল সে! সেই দূরের জগৎটা বড় জ্বালা যন্ত্রণার। সে আর কোথাও যাবে না।