স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই খুব বাসনা ছিল, দুটি কন্যার পর তাদের তৃতীয় সন্তানটি হবে পুত্র। পুত্ৰই বংশের ধারা বহন করে নিয়ে যায়। অভিজাত বংশে পুত্ৰই খেতাব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। কার্জন তার ভাবী পুত্র-সন্তানের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন। ভারী সুন্দর নাম, ইরিয়ান ডোরিয়ান। কিন্তু হায়, নিয়তির বিচিত্র কৌতুক কে বুঝতে পারে। যথাসময়ে মেরি আবার একটি কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। মেরি তখন ইংল্যান্ডে, কার্জন কলকাতায়। খবর পেয়ে কার্জন নিজে তো নিরাশ হয়েছিলেন বটেই, কিন্তু আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন স্ত্রীর জন্য। মেরির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এবার তিনি পুত্রবতী হবেনই, এই ব্যর্থতায় তিনি বোধ হয় ভেঙে পড়বেন। কার্জন মেরিকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লিখলেন, মেয়েরও একটি মিষ্টি নাম রাখলেন নালডেরা। অধিকাংশ ইংরেজ পরিবারেই দশ-বারোটা নাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখা হয়, জর্জ আর মেরি, স্মিথ আর জুলি, হ্যারি আর পামেলা প্রায় প্রতি ঘরে। কার্জনের ঝোঁক অপ্রচলিত, অসাধারণ নামের দিকে।
আতুর অবস্থা কাটিয়ে ওঠার কিছুদিন পরেই অজ্ঞাত এক রোগের বীজাণু সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মেরি। কার্জন যখন লন্ডনে এসে উপস্থিত হলেন, তখন মেরির একেবারে মরণাপন্ন অবস্থা, চিকিৎসকরা কোনও ভরসা দিতে পারছেন না। পত্নীর শয্যাপার্শ্বে উপবিষ্ট কার্জনকে দেখে তাঁর পূর্বপরিচিতরা প্রায় চিনতেই পারে না। কোথায় সেই অহংকারী, বলদৃপ্ত পুরুষ? কার্জনের মুখোনি রক্তশূন্য, চোখ দুটি বিপন্ন বালকের মতন। মেরি অকালে চিরবিদায় নিলে কার্জনও যেন আর বাঁচবেন না। এ শুধু তীব্র ভালবাসা নয়, পরম নির্ভরতা। কার্জনের স্বভাবই এমন। এ পর্যন্ত কারুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়নি। স্কুল কলেজ জীবনের সাথিদের সঙ্গেও খোলামেলা কথাবার্তা বলতে পারেননি, সকলের সঙ্গেই তার ব্যবহার কেতাব-দুরস্ত, কঠিন ভদ্রতায় মোড়া, তিনি তাঁর আত্মম্ভরিতা কখনও চাপা দিতে পারেন না। একমাত্র মেরিই প্রকৃতপক্ষে তার অর্ধাঙ্গিনী, তার নমসঙ্গিনী। মেরির কাছে তার কোনও কথাই গোপন থাকে না, মেরির সামনে তিনি অনায়াসে ছেলেমানুষি করতে পারেন।
মেরি চলে গেলে তিনি বাঁচবেন কী করে? চিকিৎসকদের কথাতেও কার্জনকে হাসপাতালে মেরির কক্ষ থেকে সরানো যায় না। কার্জন এক দৃষ্টিতে চেয়ে বসে থাকেন মেরির মুখের দিকে। মেরির দু চক্ষু বোজা, কথা বলারও শক্তি নেই, কিছুই খেতে পারছেন না। যেন যে-কোনও মুহূর্তেই প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে।
এক সময় মনে হল, মেরি ফিসফিস করে কী যেন বলছেন আপন মনে।
কার্জন ব্যস্ত হয়ে নিজের কান ঝুঁকিয়ে দিলেন মেরির ঠোঁটের কাছে।
খুব অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলেন, মেরি বলছে, ইরিয়ান-ডোরিয়ান, আমাদের ছেলে, সে এল না।
তোমাকে আমি পুত্রসন্তান দিতে পারলাম না।
কার্জন ব্যাকুলভাবে বললেন, ডারলিং, ও নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। নালডেরা তো এসেছে। কী সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে, ওকে নিয়েই আমরা সন্তুষ্ট থাকব। ইরিয়ান-ডোরিয়ান পরে আসবে।
মেরি মাথা নাড়াবার চেষ্টা করে ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললেন, না, আর সে আসবে না। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। শেষ।
কার্জন বললেন, আমরা দুজনেই একদিন শেষ হয়ে যাব। আমরা চলে যাবার পর আমাদের ছেলে রইল কি মেয়ে রইল, তাতে কী আসে যায়!
মেরি বললেন, আমি আগে চলে যাব। তোমাকে ছেড়ে—
কার্জন বললেন, তা হলে আমারও বেশি দেরি হবে না। মেরি, প্রিয়তমে, যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে, সেখানে গিয়ে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?
মেরি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যা জর্জ, আমি অপেক্ষায় থাকব। আমাদের দুজনের সমাধি হবে পাশাপাশি, মার্বেল পাথরের দুটি মূর্তি গড়াতে বলে দিয়ে, সেই মূর্তি দুটি চেয়ে থাকবে মুখোমুখি।
তারপর মেরি চোখ বুজলেন।
এর পরেও নিয়তির বিচিত্র খেলা চলল। নিয়তিই যেন একেবারে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনল মেরিকে। চিকিত্সকদের হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন মেরি। সঙ্কট কেটে গেল।
কার্জন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। লন্ডনের অভিজাত সমাজ তাকে পাবার জন্য উন্মুখ হয়েছিল, কাজন শুরু করলেন মেলামেশা।
কার্জন যদিও দ্বিতীয় বারের জন্য ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে নিয়োগপত্র পেয়ে গেছেন, কিন্তু তার পরিচিতরা অনেকে বলাবলি করতে লাগল, কার্জনের আর ভারতে ফিরে না যাওয়াই উচিত। ওই অস্বাস্থ্যকর দেশে বেশিদিন থাকার দরকার কী? মেরির যা শরীরের অবস্থা, তার পক্ষে এখন কলকাতায় ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। কার্জনের শরীর ভাল থাকে না মাঝে মাঝে। লন্ডনে থাকলে শুধু যে স্বাস্থ্যোজ্জার হবে তাইই নয়, আরও বড় কাজের জন্য তিনি চেষ্টা চালাতে পারবেন। কার্জন কি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না? তাঁর যোগ্যতা কম কীসে? শুধু গভর্নর জেনারেল হয়ে তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন কেন? প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি সমস্ত গভর্নর জেনারেলদের চালনা করতে পারবেন।
মেরিরও সেরকমই ইচ্ছে। তার মতে, তার স্বামীই প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্যতম ব্যক্তি। মেরি জানেন, তিনি আমেরিকান বলে ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজের অনেক মহিলারা তার আদব-কায়দার জ্ঞানের অভাব কিংবা বাড়াবাড়ি দেখে আড়ালে হাসাহাসি করে। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হলে আর কেউ পরিহাস করার সাহস পাবে?
কার্জন অবশ্য ভারতে ফেরার জন্য বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার আছে অবশ্যই, কিন্তু তার জন্য ব্যস্ততার কী আছে? কোনও কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে ফেলে চলে আসা কার্জনের স্বভাববিরুদ্ধ। ভারতে তাঁর আরব্ধ কার্যগুলি সম্পন্ন করতেই হবে। সমস্ত স্তরের কর্মচারীদের মধ্যে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রবর্তনের জন্য তিনি বদ্ধপরিকর। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, অর্থাৎ বঙ্গদেশ টুকরো টুকরো করার যে প্রস্তাব তোলা হয়েছে, তাও কার্যকর করতে হবে। তিনি এমন একটা ব্যবস্থা করে আসতে চান, যাতে ভারতবাসী চিরকালের জন্য মনে করে যে সেখানে ইংরেজ শাসন অতি আদর্শ এবং দৈব আশীর্বাদ! তা ছাড়া সেনাবাহিনীর প্রধান লর্ড কিনারের সঙ্গে তার যে মতবিরোধ শুরু হয়েছে, তার মীমাংসা না করে ভারত ছেড়ে চলে এলে সেটা পরাজয়ের মতন মনে হবে না! কোনও ব্যাপারেই পরাজয় স্বীকার করা জর্জ ন্যাথানিয়েল কার্জনের ধাতুতে নেই।
নিয়তি কার্জনকে নিয়ে যে পাশা খেলছে তার একটি অতি শক্তিশালী পুঁটি হল ভারতের সেনাধ্যক্ষ লর্ড কিনার। দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধজয়ী এই কিচনার আপামর ইংরেজ জনসাধারণের কাছে জাতীয় বীরের সম্মান পায়। কার্জন নিজেই কিচনারকে ভারতের সেনাপতিত্ব করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইংরেজরা যাকে এত বড় বীর মনে করে সে কার্জনের অধীনে কাজ করবে, এতে কার্জনের অহমিকা তৃপ্ত হবে।
কি কিন্তু কিচনার কারুর অধীনে থাকার পাত্র নন। দম্ভ ও আত্মাভিমানে তিনি কার্জনের চেয়ে মোটেই কম যান না। বরং বলা যায়, কূটবুদ্ধি ও মানবচরিত্র বোঝার ক্ষমতা কার্জনের চেয়েও তার বেশি। এই দুজনের চেহারা ও চরিত্র যেন সম্পূর্ণ বিপরীত। কার্জন রূপবান ও সুপুরুষ, আর কিচনার এক প্রবল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রায় সওয়া ছ’ ফুট লম্বা, সেই রকমই স্বাস্থ্যবান, কিচনার যেন প্রায় একটি দৈত্য, মস্ত বড় মুখোনিতে প্রধান দ্রষ্টব্য তার গোঁফ। কার্জন কথা বলেন শান্ত গম্ভীর স্বরে, প্রতিটি শব্দ মেপে আর কিচনারের কণ্ঠে যেন বাঘের গর্জন। কার্জন অভিজাত ভদ্রতার প্রতিমূর্তি আর কিচনারের নিষ্ঠুরতার বহু কাহিনী প্রচলিত। খারটুম জয় করে সেখানকার নেতা মেহদির মুণ্ড কেটে আনার পর কিচনার সেটাকে রেখে দিয়েছিলেন নিজের টেবিলে। করোটিটা পরিষ্কার করে সোনা বা রুপো দিয়ে বাঁধিয়ে তারপর সেটা দিয়ে একটা দোয়াতদান বা পানপাত্র বানাবার ইচ্ছে ছিল তার। খবর পেয়ে স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়া সেই মুণ্ডটিকে কবর দেবার অনুরোধ জানান।
কার্জন বিবাহিত এবং পত্নী-প্রেমে মুগ্ধ, কিচনার বিবাহ করেননি, কিন্তু অনেক রমণী পরিবৃত হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। ইংলন্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর পুত্রবধূর সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব আছে। সিমলা ও কলকাতায় কিচনারের দুটি আস্তানা। এই দুটি প্রাসাদই প্রচুর লুণ্ঠিত সামগ্রী দিয়ে সজ্জিত। কার্জন যেমন মাঝে মাঝে বড় বড় পার্টি দেন, তাঁকে টেক্কা দিয়ে কিচনার আরও বেশি আড়ম্বর ও ব্যয়বহুল পার্টি দিতে শুরু করেছেন। যেদিন বিশেষ অন্তরঙ্গ পাঁচ-ছ’জনকে নেমন্তন্ন করেন, সেদিন বেয়োয় সোনার সেট। কাপ, প্লেট, থালা, গেলাস, কাঁটা-চামচ সব খাঁটি সোনার। সমস্ত অর্থই খরচ হয় সেনাবাহিনীর তহবিল থেকে। হিসাবরক্ষকরা আপত্তি জানালে কিচনার তা তোয়াক্কা করেন না। কিচনারের নিজস্ব জুড়িগাড়িটি টানে দুটি বিশালকায় কুচকুচে কালো ঘোড়া, অমন ঘোড়া এদেশে বুঝি আর একটিও নেই। সহিস রাখেন না। প্রায়ই কিচনার নিজেই সে গাড়ি চালিয়ে হাওয়া খেতে যান, এক হাতে রাশ ধরা, অন্য হাতে চুরুট, চিনার যখন প্রচণ্ড জোরে সেই গাড়ি হাঁকিয়ে যান, কলকাতার নাগরিকরা শঙ্কামিশ্রিত মুগ্ধতায় হাঁ করে চেয়ে থাকে।
এ হেন কিনারের সঙ্গে কার্জনের যে সংঘাত বাধবে তা যেন অবধারিত।
কিচনার আসবার আগে থেকেই কার্জন সেনাবাহিনীকে চটিয়ে রেখেছেন। অধিকাংশ ব্রিটিশ সৈন্যই ভারতীয়দের মানুষ বলেই গণ্য করে না। সব সময় মনের মধ্যে একটা তীব্র ঘৃণা জাগিয়ে রাখাই যেন একটা দেশকে পদানত করার সফলতম উপায়। কুকুর-বিড়ালকে যেমন যখন-তখন লাথি মারা যায়, সেইরকম ভারতীয় কর্মচারীদেরও লাথি-চড়-ঘুষি মারতে বিবেকের কোনও দায় নেই। আদালি, পাঁচক, সহিস শ্রেণীর লোকরা এই রকম মার খেয়ে কখনও কখনও মরেও যায়, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অনেক দিন থেকেই এরকম চলে আসছে, লেফটেনান্ট গভর্নর বা ভাইসরয়ের মতন উচ্চ পদাধিকারীদের কাছে এসব খবর পৌঁছায় না, পৌঁছলেও কান দেন না। কিন্তু প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে কার্জনের নজর, ইংরেজদের কোনও রকম বর্বর ব্যবহার তিনি সহ্য করতে রাজি নন। কার্জনের মতে, ইংরেজরা তো শুধু এ দেশ শাসন বা শোষণ করতে আসেনি, তারা এই মূর্খ, দরিদ্র দেশের মানুষদের সভ্যতা দান করতে এসেছে। এ দেশের শিল্প-পুরাকীর্তিগুলি দেখলে বোঝা যায়, এককালে এরা সম্পন্ন ছিল, সভ্য ছিল, এখন একেবারে অধঃপতিত হয়ে গেছে। নিজেদের দেশ শাসন করার ক্ষমতাও এদের নেই, তাই তো ইংরেজরা দেশ শাসনের দায়িত্ব বহন করতে এসেছে, এদের আবার সভ্য করতে এসেছে। শ্বেতাঙ্গরা স্বেচ্ছায় এই কৃষ্ণাঙ্গদের দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছে। এদের সামনে ইংরেজরা যদি অভদ্র, অশোভন বা বর্বরোচিত ব্যবহার করে, তাতে তো ইংরেজ জাতিরই দুর্নাম হয়। ইংরেজরা যে শিক্ষায়, সভ্যতায়, ভদ্রতায় চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে, তা এদের সব সময় বোঝানো দরকার। তা ছাড়া, ইংরেজ সরকার এ দেশে উপহার দিয়েছে একটা সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা, সেখানে শ্বেতাঙ্গ অপরাধীদেরও শাস্তি পেতে হবে। নইলে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা থাকবে কী করে?
ইংরেজ কর্মচারী, সেনাবাহিনী বা চা বাগানের মালিকরা কারুর ওপর নৃশংস অত্যাচার করেছে শুনলেই কার্জন ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। বুটের আঘাতে কোনও নিরীহ মানুষকে মারার জন্য কোনও ইংরেজকে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করা হয় না। সে রকম ঘটনা ঘটলে ইংরেজ সৈন্যও নিস্তার পাবে না। চা বাগানের মালিকরা নিজেদের এলাকাটাকে নিজস্ব সাম্রাজ্য মনে করে, কুলিরা যেন ক্রীতদাস, তাদের বেত্রাঘাত করা কিংবা কুলি রমণীকে উলঙ্গ করিয়ে ঘোরানোর কথা প্রায়ই শোনা যায়, কার্জন সঙ্গে সঙ্গে ওইসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন। মানি
এই নিয়ে সেনাবাহিনী ও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কার্জনের খুব কাছাকাছি লোকরাই যে তাঁর এত বাড়াবাড়ি পছন্দ করছেন না তা তিনি বুঝতে পারেন না। চূড়ান্ত ব্যাপার ঘটেছিল, নবম ল্যান্সার বাহিনীর একটি ঘটনায়।
এই অশ্বারোহী বাহিনী অতি সুখ্যাত ও সেনাবাহিনীর গর্ব। ব্রিটেনের বনেদি বড় বড় ঘরের ছেলেরা ছাড়া অন্য কেউ এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হবার সুযোগ পায় না। প্রতিটি স্বাস্থ্যবান তরুণের পোশাক স্বর্ণখচিত, বহুমূল্য ও উজ্জ্বল, তাদের বীরত্বেরও প্রসিদ্ধি আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়রদের বিরুদ্ধে তারা সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তারা সরাসরি এসেছে ভারতে, তাদের স্থান হয়েছে শিয়ালকোট সেনাবাসে। প্রথম দিন দীর্ঘপথ পেরিয়ে পৌঁছবার পর শুরু হয়েছিল দারুণ খানাপিনা। সেই সঙ্গে নাচ-গানের হুল্লোড়। কিছুটা নেশা হবার পর কয়েকজন যুবকের মনে হল, ভারতের মেয়েরা কী রকম? একটু চেখে দেখলে হয় না? দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধের সময় প্রচুর নারীর ওপর বলাৎকার করা হয়েছে, ভারতের নারীরা কি তাদের চেয়ে আলাদা?
আটু নামে একজন আদলি ছিল সেখানে, তাকে হুকুম করা হল, এই, কয়েকটা মেয়ে জোগাড় করে আন তো!
আটু রাজি হল না। যতই নিচু পদের হোক, সেও একজন সরকারি কর্মচারী। ওপরওয়ালার লালসা মেটাবার জন্য নারী সংগ্রহ করা তার কাজ নয়। গোঁয়ারের মতন মুখের ওপর বলে দিল সে কথা। তাকে ভীতি প্রদর্শন, বখশিসের লোভ দেখিয়েও কাজ হল না। তখন শুরু হল মার। দু তিনজন তরুণ সেনানী আটুকে ঘিরে ধরে লাথি আর ঘুষি চালাতে লাগল। আটুর একটা চোখ উপড়ে বেরিয়ে এল, ভেঙে গেল পাঁজরের বেশ কয়েকটা হাড়, সে অচৈতন্য হয়ে যাবার পরেও কিছুক্ষণ চলল প্রহার। তারপর রক্তাপ্লুত অবস্থায় সে বারান্দায় পড়ে রইল সারা রাত। পরদিন বেলা বাড়ার পর আটুকে হাসপাতালে পাঠানো হল বটে, কিন্তু আটু বাঁচল না।
এই সব ঘটনা চাপা দেওয়া মোটেই শক্ত না। একজন নেটিভ মারা গেছে, তাতে কী হয়েছে? কারুর কোনও শাস্তি হল না। এমন একটা তুচ্ছ ব্যাপার, ভারতের বড়লাটের কর্ণগোচর হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু লর্ড কার্জন নিজের নামের প্রতিটি চিঠি খুলে পড়েন, নিজে উত্তর দেন। আটুর কয়েকজন আত্মীয় সরাসরি ঘটনাটি জানিয়ে সুবিচারের আবেদন করে। সে চিঠি পড়েই কার্জন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। এ তো খুন! খুনিরা শাস্তি পাবে না? ভারতীয়রা তা হলে ইংরেজ শাসকদের শ্রদ্ধা করবে কেন? শ্বেতাঙ্গ হলেই কোনও কালো মানুষকে যখন তখন হত্যা করেও নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে, এটা কার্জন কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নন!
কার্জন তদন্তের আদেশ দিলেন। তখন তাঁকে জানানো হল যে আটুর মৃত্যুর পর একটা কোর্ট অব এনকোয়ারি হয়েছিল, কারুর কোনও দোষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওটা একটা দুর্ঘটনা। কার্জন বুঝলেন এটা একটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা মাত্র। তিনি তখন সেনা বাহিনীর প্রধানকে বলেছিলেন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। দুই সেনাধ্যক্ষের ওপর আবার নতুন করে তদন্তের ভার দেওয়া হল। তাতেও একটি অশ্বডিম্ব প্রসব হল।
কার্জন আগেও কয়েকবার দেখেছেন, ভারতীয়দের ওপর অন্যায় অত্যাচার করলে কোনও শ্বেতাঙ্গকেই শ্বেতাঙ্গ বিচারকরা শাস্তি দেবার সুপারিশ করে না। বরং নিজের জাতভাইদের আড়াল করার চেষ্টা করে সব সময়। আর ভারতীয় বিচারকদের মানবেই না শ্বেতাঙ্গরা। এবারেও জানানো হল যে নবম ল্যান্সার বাহিনীর কোনও দোষই নেই, ওই আটু লোকটা ছিল একটা মাতাল, লম্পট, মিথ্যেবাদী, ওই রাতে সে ওই সেনা শিবিরে ছিলই না।
কার্জন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ন্যায়-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা তাঁর বীজমন্ত্র। সেনাবাহিনী যদি এরকম যদৃচ্ছ কারবার চালিয়ে যায়, তাদের শাস্তি না হয়, তা হলে কোনও ভাইসরয়ই তাদের শৃঙ্খলা আরোপ করার সাহস পাবে না। নবম ল্যান্সার বাহিনীতে ডিউক, আর্লদের ছেলেরা রয়েছে তো কী হয়েছে, তাদের যে-কোনও বাঁদরামি সহ্য করতে হবে? প্রকৃত দোষীদের নাম কেউ প্রকাশ করল না বলে কার্জন স্বয়ং ওই পুরো রেজিমেন্টকেই শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করলেন। আগামী ছ’ মাসের জন্য সকলের ছুটি বন্ধ, যারা ছুটিতে ছিল, তাদেরও ডেকে এনে ছুটি বাতিল করা হল।
শুধু সৈনিকেরাই নয়, ভারতের সকল শ্রেণীর ইংরেজই কার্জনের এই উগ্রতায় অসন্তুষ্ট হল। সুখ্যাত নবম ল্যান্সার বাহিনীকে এমনভাবে অপদস্থ করা মোটেই উচিত হয়নি। তাও কিনা সামান্য একটা আদালির জন্য! কার্জনের এত নেটিভ-প্রেম কেন? লর্ড ক্যানিংয়ের মতন, লর্ড রিপনের মতন, এই লর্ড কার্জনও ‘নিগার’দের প্রতি ভালবাসায় গদগদ?
এইসব বাতা লন্ডনেও পৌঁছল, সেখানেও অনেকেই মনে করল, কার্জনের ঔদ্ধত্য যেন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেনাধ্যক্ষদের অগ্রাহ্য করে কার্জন নিজের আধিপত্য জাহির করেছেন। সম্রাটও এই বিবরণ শুনলেন এবং জানালেন যে কার্জন অহেতুকভাবে কঠোর শাস্তি দিয়ে ঠিক করেননি। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় রইলেন কার্জন।
এরপর কিচনার সেনাপতি হয়ে আসার পর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলেন যে ভাইসরয়ের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মধ্যে কতখানি ক্ষোভ রয়ে গেছে। তিনি সরাসরি কার্জনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গেলেন না। এমনি বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক রইল, কার্জন দম্পতিকে তিনি নেমন্তন্ন করে খাওয়ান, মেরির সঙ্গে হাস্য-পরিহাস করেন। কিন্তু কিচনার প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছেন, তিনি তাঁর ওপরে অন্য কারুর কর্তৃত্ব মানবেন না। সেনাবাহিনীর সব অফিসারদেরও তিনি দলে পেয়ে যাবেন। কিনারের চেহারা অত বিশাল হলেও তাঁর আক্রমণ পদ্ধতি খুব সুক্ষ্ম।
এতকাল ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সেনাপতিরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। প্রধান সেনাপতি যুদ্ধনীতি ঠিক করবেন, কোন বাহিনীকে কোথায় পাঠানো হবে কিংবা পদোন্নতি, শৃঙ্খলারক্ষা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁর, কিন্তু অর্থ বরাদ্দ, রসদ সংগ্রহ ইত্যাদি ঠিক করেন ভাইসরয়ের একজন সামরিক উপদেষ্টা। এই সামরিক উপদেষ্টাটি পদমর্যাদায় প্রধান সেনাপতির অনেক নীচে, কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি প্রধান সেনাপতির কিছু কিছু চাহিদা বাতিল করে দিতেও পারেন।
কিচনার বললেন, ওই সামরিক উপদেষ্টার পদটি তুলে দেওয়া হোক। কার্জন তাতে রাজি হতে পারেন না, তা হলে প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা একেবারে লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। কিনার প্রকৃতপক্ষে সেটাই চান। কার্জন তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিচনার অনড়। মোক্ষম চাল চাললেন কিছুদিন পর। সামরিক উপদেষ্টা স্যার এডমন্ড এলিশ একটা খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, কিচনার তাতে অসম্মতি জানিয়ে সই দিতে রাজি হলেন না। এমনকী পদত্যাগেরও হুমকি দিলেন।
এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। লর্ড সলসূবেরির পর তাঁরই আত্মীয় লর্ড বেলফুর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বয়েসে কার্জনের চেয়ে কিছুটা বড় হলেও তিনি অনেক দিনের পরিচিত, কার্জনের প্রায় বন্ধুস্থানীয় বলা যায়। সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ইন্ডিয়া হয়েছেন সেন্ট জন ব্রডরিক, ভারত শাসনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এঁরই মতামত নিয়ে চলেন। এই ব্রডরিক কার্জনের সহপাঠী, কার্জনদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েও থেকেছেন কয়েকবার। সুতরাং কার্জন এই ভেবে নিশ্চিন্ত রইলেন যে প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সচিব তাঁকেই সমর্থন করবেন।
কার্জন নিজের রূপ-গুণ-ক্ষমতায় নিজেই এত মুগ্ধ যে তাঁর আত্মরতি অনেকটা নার্সিসাসের মতন। তিনি অন্যের দিকে তাকান না। তিনি খেয়ালই করেননি যে রাজনীতিতে বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী হবার আগেকার বেলফুর আর পরের বেলফুর এক মানুষ নন। ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্জনের নাম যদি কেউ ফিস ফিস করেও উচ্চারণ করে, তবে তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সহ্য করবেন কেন? কার্জনের ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ বেলফুর মোটেই সুজনরে দেখছেন না। বাল্য সখা ব্রডরিকও এখন কার্জনের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। কার্জন মনে করেন ভারত শাসনের সম্পূর্ণ রাশ তাঁর হাতে, তাঁর ভাবভঙ্গি মোগল সম্রাটদের মতন, কিন্তু ভারত সচিবের সম্মতি ছাড়া কোনও নীতিই কি বিধিবদ্ধ হতে পারে? দূর থেকে সমস্ত কলকাঠিই তো নাড়ছেন ব্রডরিক। কার্জনকে বেশি উঁচুতে উঠতে দিতে তিনি রাজি নন।
তা ছাড়া, কিচনারের পদত্যাগের হুমকি লঘুভাবে নেওয়া যায় না। কিচনার একজন জাতীয় বীর। ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। তিনি সত্যিই পদত্যাগ করলে এই সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ রুষ্ট হতে পারে, পরবর্তী নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে, ভোট অনেক কমে যেতে পারে।
মেরি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর কার্জন যখন বাইরে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করলেন, তখন আস্তে আস্তে টের পেলেন, কিচনার ওপর মহলে গোপনে চিঠি চালাচালি করছেন। এটা গর্হিত কাজ। সেনানায়কের চিঠিপত্র ভাইসরয়ের দফতর মারফত আসা উচিত। তবু কার্জন আত্মবিশ্বাসে অটল রইলেন। তাঁর ধারণা, ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা কখনও ভাইসরয়ের চেয়ে সেনাপতির দাবিকে গুরুত্ব দিতে পারে না।
কার্জনের অনুপস্থিতিতে মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড অ্যান্টাহিল অস্থায়ী ভাইসরয় হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। কার্জন চিঠিপত্রে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ভারতের খবরাখবর পান। একদিন কার্জন পিকাডেলি সাকাস দিয়ে গাড়িতে আসতে আসতে ভাবলেন, অনেক দিন লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হাঁটা হয়নি। আসন্ন শীতে ক্রিসমাসের প্রস্তুতি চলছে, শহর খুব সুন্দরভাবে সেজেছে, পায়ে হেঁটে না ঘুরলে এই রূপ ঠিক উপভোগ করা যায় না।
গাড়ি ছেড়ে দিয়ে কার্জন হাঁটতে লাগলেন। বিকেল হতে না হতেই আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হবে কুয়াশা। দোকানগুলিতে বিজলি বাতি জ্বলছে। টিপি টিপি বৃষ্টি শুরু হল। কার্জনের কাছে ছাতা নেই, রেন কোট আনেননি, তবু হাঁটতে ভালই লাগছে তাঁর। বৃষ্টি কিছুটা জোরালো হতে তিনি একটি বাড়ির পোর্টিকোয় এসে দাঁড়ালেন। আরও অনেক পথ চলতি লোক জমেছে সেখানে, কিছুটা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হচ্ছে।
হঠাৎ কার্জন খেয়াল করলেন, তাঁকে এখানে কেউ চেনে না। লন্ডনের রাস্তায় অন্য সব সাধারণ মানুষের মতনই তিনি একজন। কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না তাঁর দিকে, এমনকী দু একজন তাঁকে ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে দিচ্ছে। এই সময় তিনি ভারতবর্ষের যে কোনও অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকলে কী হত? ভৃত্য-খিদমতগার-দেহরক্ষী মিলিয়ে অন্তত তিন চারশো জন ঘিরে থাকত তাঁকে। পুলিশ ও প্রশাসন কর্মীরা তটস্থ হয়ে অপেক্ষা করত। এখানে তাঁর পাশে যেসব লোক দাঁড়িয়ে আছে, তারা জানে না, তিনি লর্ড কার্জন, ভারতবর্ষের মতন বিশাল উপনিবেশের তিনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, রাজা মহারাজ-নবাবরা তাঁর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করে।
কার্জন ঠিক করলেন, তিনি ভারতে ফিরে যাবেন। কলকাতার মৃদু শীত অতি মনোরম। মেরির সঙ্গে, মেয়েদের সঙ্গে ক্রিসমাস কাটিয়ে যাবারও ধৈর্য ধরতে পারলেন না।
কার্জন যদি ইংল্যান্ডেই থেকে যেতেন, দ্বিতীয়বার ভাইসরয় হিসেবে ভারতে ফিরে না আসতেন, তা হলে তাঁর নিজের ভাগ্য এবং ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য অন্য কোন দিকে প্রবাহিত হত কে জানে!
ডিসেম্বর মাসে কার্জন একা ফিরে এলেন কলকাতায়। এসেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাজে। কিচনারের সঙ্গে মতবিরোধ আপাতত ঝুলে রইল, অন্য একটি গুরুতর ব্যাপারে তাঁকে মনোনিবেশ করতে হল।
কার্জন যতদিন ইংল্যান্ডে ছিলেন, তার মধ্যে ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজার আর স্বরাষ্ট্র সচিব রিজলি এই দুজনে মিলে মনের আনন্দে বাংলার মানচিত্র কাটাকুটি করেছেন। বাংলা ভাগের যে পরিকল্পনা কার্জন দেখে গিয়েছিলেন, তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে অনেকখানি। প্রস্তাবিত নতুন রাজ্যটিতে উত্তর বাংলার আরও কয়েকটি জেলা জোড়া হয়েছে, মুসলমান প্রধান সব অঞ্চল ঢুকে গেছে এর মধ্যে, আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে মূল বাংলা। সারা ভারতে আর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে রাজ্য গড়া হয়নি, বাংলা ভাগ করার সময় এই ধর্মের প্রশ্নটি এসে পড়ায় দৈবাৎ যেন অনেক সুফল পাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মুসলমানরা প্রায় সকলেই এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে রাতারাতি ইংরেজ ভক্ত হয়ে গেছে, বাক্যবাগীশ হিন্দু বাঙালিরা হীনবল হয়ে যেতে বাধ্য।
বঙ্গভঙ্গের প্রধান রূপকার কার্জন নন, রিজলি ও ফ্রেজার, এই দুই রাজকর্মচারী। কার্জন ফিরে এসে পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত এই নতুন রাজ্যটির পরিকল্পনা দেখে আপত্তি জানালেন না। ভারত সচিব ব্রডরিকের সম্মতি ছাড়া এটা কার্যকর হবে না, ব্রডরিক এখনও মত স্থির করতে পারেননি, তবু এরই মধ্যে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। কার্জন তাতেই বেশ উৎসাহ বোধ করছেন। সরকারিভাবে ঘোষণার পর আন্দোলন নাকি তীব্র হবার সম্ভাবনা আছে, গোয়েন্দা বিভাগ এই রিপোর্ট দিয়েছে। বাঙালিরা কতটা আন্দোলন করতে পারে কার্জন তা দেখতে চান। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস বাঙালিদের উদ্দীপনা দু দিনেই মিইয়ে যাবে। এ দেশের গরিব মানুষদের সম্পর্কে কার্জনের যতই সমবেদনা থাক, শাসমুকার্যের ব্যাপারে এদেশীয়দের কোনও অধিকার দেওয়া দূরে থাক, কোনও সমালোচনাও তিনি সহঃকরতে রাজি নন।
সন্ধের পর কার্জনের বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। গৃহকত্রী না থাকলে বাড়িতে লোকজনদের আমন্ত্রণ জানানো যায় না। তিনি নিজেও অন্য কোথাও যেতে চান না। মেরি নেই, মেয়েরা নেই, এত বড় বাড়িটাকে একেবারে শূন্য মনে হয়। ফিরে আসার পর মেরির শয়নকক্ষে কার্জন একদিনও ঢোকেননি। একদিন সেই ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, অকস্মাৎ তাঁর চোখে জল এসে গেল। কত যত্ন করে মেরি ঘরগুলি সাজিয়েছে, আর কি সে এখানে কখনও ফিরে আসবে! বছরের পর বছর কার্জনকে একাকী কাটাতে হবে রাত।
একজন কর্মচারী কিছু একটা বলতে আসতেই কার্জন চট করে চোখ মুছে ফেললেন। তাঁর কোনও দুর্বলতার পরিচয় অন্যরা জানতে পারে না। আবার তাঁর মুখমণ্ডল হয়ে গেল কঠোর অহংকারীর মতন। তিনি ভুরু তুলে বললেন, কী ব্যাপার? চ ত।
কর্মচারীটি জানাল যে স্যার হেনরি কটন তাঁর দর্শনপ্রার্থী। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা। আছে। জরুরি প্রয়োজনের কথা বলছেন।
কার্জন ভ্রূ কুঞ্চিত করে রইলেন। হেনরি কটন? সেই নিমকহারামটা! এই হেনরি কটন কিছুকাল। আগেও ছিল আসামের চিফ কমিশনার। ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। এখন অবসর নিয়ে ভারত দরদি হয়ে উঠেছেন, এমনকী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কার্জন যে কংগ্রেসকে ধ্বংস করে দিতে চান, তার প্রধান হয়েছেন হেনরি কটন, অর্থাৎ তাঁর প্রতিপক্ষ। হেনরি কটন বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিপক্ষে। শাসনকার্যের সুবিধের জন্যই বঙ্গদেশ ভাগ করার প্রথম প্রস্তাব উঠেছিল, সেই শাসনকার্যের ব্যাপারে হেনরি কটনের দীর্ঘকালের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, সুতরাং এ প্রস্তাব রদ করার জন্য তিনি সরকার পক্ষকে বুঝিয়ে বলতে চান।
বাঙালিদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন হেনরি কটন। তিনি কি চান একদিন একজন বাঙালিবাবু এসে গভর্ন হয়ে বসবে? সেটাই কার্জন চিরকালের মতন রুদ্ধ করে দিয়ে যাবেন। কার্জন গম্ভীরভাবে বললেন, কটনকে বলে দাও, দেখা হবে না!