2 of 2

৭৩. যুবকটি সূর্যর চেয়ে

যুবকটি সূর্যর চেয়ে বয়সে কয়েক বছর বড়ই হবে, ছিপছিপে লম্বা চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় যে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। হোটেলে-ডাকবাংলোয় এসে সবাই একটা নিজস্ব আলাদা ঘর পেতে পছন্দ করে, এই ছেলেটি নিজে থেকেই তার ঘরের ভাগ অন্য একজনকে দিতে চাইছে। সুতরাং সে যে খুব মিশুকে প্রকৃতির তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে জানে না, সে সূর্যর মতন। কতখানি অমিশুককে ঘরে ডেনে আনল।

যুবকটি নিজেই সূর্যর সূটকেসটা নিয়ে এল ঘরে। অন্য দিকের খালি খাটটা দেখিয়ে বলল, চাদরটাদর সব পরিষ্কারই আছে। ওয়ার্ডরোবটাও আপনি ব্যবহার করতে পারেন। আমার জিনিসপত্র বিশেষ কিছুই নেই। খেয়ে এসেছেন তো?

সূর্য বলল, এখন না খেলেও চলবে। স্নানটা করা দরকার।

না, না, খাবার দরকার হলে চৌকিদারকে এখনও বলে দিন। খাবার আনিয়ে দেবে। আপনার কি বিজনেস আছে, না সরকারি কাজ?

কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতেই। যুবকটির ইংরেজি নির্ভুল নয়, তবু সে অনর্গল কথা বলে যেতে পারে, ক্রিয়াপদ বা অব্যয়ের নির্ভুল ব্যবহার নিয়ে মাথা ঘামায় না।

সূর্য বলল, না আমি বেড়াতে এসেছি।

যুবকটি একটু অবাক হয়ে সূর্যর মুখের দিকে তাকাল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, যাস্ট ফর সাইট সিয়িং? অ্যালোন?

হ্যাঁ।

যুবকটি একটু হাসল। তারপর বলল, এত গরমে কেউ এখানে বেড়াতে আসে? বেড়াতে এসেছেন তো আগে থেকে থাকবার জায়গা ঠিক করে আসেননি? এখানে থাকবার জায়গা পাওয়ার খুবই অসুবিধে।

এই ব্যাপারটাতে সূর্যর মনে একটা অভিমান জন্মেছিল। এই শহরে সে জন্মেছে, একসময় এখানে তার বাবার যথেষ্ট বিষয়সম্পত্তি ছিল, আর এখন এখানে সে একটু থাকবার জায়গাও পাচ্ছিল না।

সূর্য বলল, এই সময় কেউ বেড়াতে আসে না, তবু হোটেল ডাকবাংলোয় এত ভিড় কেন?

আপনাকে বললাম না, মধ্যপ্রদেশের দু’জন মন্ত্রী এসেছেন, সেইসঙ্গে অনেক গভর্নমেন্ট অফিসার–আমি তো একমাস আগে রিজার্ভেশন করিয়ে রেখেছিলাম।

ডাকবাংলোর চৌকিদার এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। যুবকটি তাকে দেখে তাড়া দিয়ে বলল, গোসলখানামে পানি লাগাও পহলে। তারপর সাহেবের জন্য খানা–

যুবকটি সূর্যর দিকে ফিরে বললে, আমাদের এখনও পরিচয় হয়নি–আমার নাম রূপলাল গুপ্তা। আমার একটা ছোটখাটো বিজনেস আছে।

সূর্য নিজের নাম জানাল।

রূপলাল বলল, ভাদুড়ী? আপনি কি শিশির ভাদুড়ীর রিলেটিভ?

না।

ওঃ, সাচ এ গ্রেট অ্যাক্টর। এতবড় অ্যাক্টর ইন্ডিয়াতে কেউ নেই।

আপনি বাংলা থিয়েটার দ্যাখেন নাকি?

যুবকটি তখন বাঙলা বলতে শুরু করল। বলল, বহুত, অনেক! আমি তো পড়া লিখা করেছি কলকাতায়। চিত্তারাঞ্জান এভিনিউতে আমাদের বাড়ি আছে। আপনি কলিকাতায় কি কাম করেন?

সূর্য বুঝতে পারল, যুবকটি তাকে আরও অনেক প্রশ্ন করবে। সে স্নান করার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

রূপলাল তারই মধ্যে শুনিয়ে দিল যে কলকাতায় তাদের অনেক দিনের ব্যবসা আছে। সে কলকাতাকে খুবই ভালোবাসে। কলকাতার মতন ‘লাইফ’ আর কোথাও নেই। তবে সে আর তার দাদা মধ্যপ্রদেশে নতুন একটা কারখানা শুরু করছে। সেই জন্য এখানেই এখন থাকতে হচ্ছে। গোয়ালিয়ারেও এসেছে ব্যবসার কাজে। যে-মিনিস্টার দু’জন এসেছেন, তাদের একজনকে ধরে পারমিট আদায় করতে হবে। জানেন তো, ক্যাপিটালে বসে মিনিস্টারদের মন গলানো খুব শক্ত। তবে বাইরে কোথাও গেলে তারা দিলদরিয়া হয়ে যান, ঝটাকসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেন। তারপর লেগে থাকতে পারলেই হল। তবে আজ মিনিস্টাররা মিটিং ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, আজ কোনও কাজ হবে না, অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আগামীকাল। আজ সে সূর্যবাবুর সঙ্গে সাইট সিয়িংয়ে বেরোতে পারে। দুজনে একসঙ্গে বেরোবার সুবিধে এই, টাঙ্গাভাড়া ভাগাভাগি করে দেওয়া যায়।

সূর্য চুপচাপ শুনে গেল। এই বাক্যবাগীশ ছেলেটির সঙ্গে যদি এক ঘরে কাটাতে হয়, তা হলে কালকেই সে গোয়ালিয়ার ছেড়ে চলে যাবে। টাঙ্গাভাড়া বাঁচাবার জন্য অন্য কারওর সঙ্গে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছেও তার নেই।

স্নান করে এসে সূর্য চুল আঁচড়াচ্ছে, রূপলাল তার মধ্যেই ভ্রমণের সূচি বানিয়ে ফেলেছে। সে আগে গোয়ালিয়ার দু’-তিন বার এসেছে অবশ্য, বিশেষ কিছুই দেখেনি।

সে জিজ্ঞেস করল, আপনি আগে ফোর্ট দেখতে যাবেন নিশ্চয়। ওইটাই তো আসল দেখবার। গুহারী মহলের কাছে তার চেনাজানা একজনের একটা দোকান আছে। তার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে। এ ছাড়া সূর্য যদি জলবিলাস আর মতিমহলে যেতে চায়–

সূর্য বলল, আমি আজ আর বেরোব না ভাবছি। শরীরটা ভালো নেই। আজ শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নেব।

রূপলাল একটু নিরাশ হয়ে গেল। তবিয়ত ভালো, নেই! কী হয়েছে বলুক না সূর্য? তার কাছে অনেক রকম ওষুধ আছে।

ওষুধের দরকার নেই। এমনিই শুয়ে থাকব।

রূপলাল বলল, তা হলে আমিই বা কোথায় ঘোরাঘুরি করতে যাব? আমিও শুয়েই থাকি!

চৌকিদারকে দিয়ে কিছু খাবার আনিয়ে সূর্য খেয়ে নিল। তারপর নিজের খাটে শুয়ে পড়ে চোখের সামনে মেলে ধরল একটা বই। রূপলাল টুকিটাকি আরও দু-একটা প্রশ্ন চালাল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল হঠাৎ। বোঝা যায়, সে বেশ সুখী লোক, তার ইচ্ছাঘুম। সূর্যর কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তার ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হল না।

দুপুরে ঘুমোনো অভ্যেস নেই সূর্যর। রেলের স্টল থেকে কেনা গ্ৰেহাম গ্রিনের উপন্যাসটায় সে বেশ রস পেয়ে গেল। পড়তে লাগল গভীর মনোযোগ দিয়ে। ঝিমঝিম গ্রীষ্মের দুপুর। মাঝে মাঝে শোনা যায় কাকের শুকনো গলার ডাক।

বেশ কিছুক্ষণ পর বাইরের একটা শোরগোলে সূর্যর চমক ভাঙল। এটা ঠিক বিপদের। গোলমাল নয়, অন্য রকম। বই মুড়ে রেখে সূর্য ডাকবাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রূপলালও ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে।

একটা বিরাট মিছিল বেরিয়েছে। তেরঙা ঝান্ডা ও ফেস্টুন নিয়ে স্লোগান দিচ্ছে একদল লোক, তাদের ফিটফাট পোশাক ও মাথায় গান্ধী টুপি, মিছিলের বাদবাকি লোকেদের চেহারা ও পোশাক মলিন, খালি পা, তারা বন্দেমাতরম শব্দটার অর্থও জানে না, তবু যন্ত্রের মতন গলা মেলায়।

মিছিলের মাঝখানে দুটি মোটরগাড়িতে শুভ্র খদ্দরের পোশাক পরা দু’জন স্থূলকায় ব্যক্তি, এঁদেরও মাথায় গান্ধী টুপি, গলায় প্রচুর মালা, হাত জোড় করে দু’পাশের জনতার। দিকে নমস্কার জানিয়ে বিগলিত হাস্য বিতরণ করছেন।

রূপলাল বলল, জুলুস বেরিয়ে গেছে, আজ বিকালে খুব বড় মিটিং আছে।

তারপর সে খুব উত্তেজিত ভাবে মোটরগাড়ির আরোহী বিশিষ্ট ব্যক্তি দু’জনের মধ্যে এক জনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখছেন, উনিই হচ্ছেন শ্রীবাস্তবজি। আবগারি মন্ত্রী কাল উনার সঙ্গেই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। পারমিট যদি মিলে যায়–

সূর্য মুখ ফিরিয়ে রূপলালকে জিজ্ঞেস করল, আপনার কীসের ব্যবসা?

রূপলাল বলল, মদ। ভোপালে একটি বিয়ার তৈরির কারখানা যদি খুলতে পারি—

সূর্য আবার জিজ্ঞেস করল, আজ কীসের মিটিং?

আজ তো আগস্ট দিবস আছে। সেই মিটিং—

আগস্ট দিবস মানে?

আজ কত তারিখ আপনার খেয়াল নেই। আজ ৯ই আগস্ট–ফরটি টু-তে যে-আগস্ট মুভমেন্ট শুরু হয়েছিল না–

সূর্য সামান্য একটু চমকে উঠেছিল। তারপরই তার মুখের চেহারা খানিকটা বদলে গেল। কোনও কারণ নেই, তবু বেশ রাগ হল তার। আগস্ট আন্দোলন উপলক্ষে এই রকম একটা মিছিল তার মনে হল অতি কদর্য। যেন ওই আন্দোলনটা সূর্যর একেবারেই। নিজস্ব, অন্য কারওর এ ব্যাপারে কোনও অধিকার নেই।

সে রাগত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আগস্ট দিবসে আবগারি মন্ত্রী কী বলবেন?

বাঃ, আপনি শ্রীবাস্তবজির কথা জানেন না? সাতারাতে উনি সেই সময় যা লড়েছিলেন–

হয়তো সাতারাতে শ্রীবাস্তবজি সত্যিই খুব বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন বেয়াল্লিশ সালে। আজ স্থূল চেহারায় গান্ধী টুপি পরে আবগারি মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করে তিনি সেই সব দিনের স্মৃতি নিয়ে আজ একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা না দিয়ে ছাড়বেন না মনে হয়।

সূর্য হঠাৎ বলল, মিটিংটা কোথায় হবে? আমি শুনতে যাব।

রূপলাল একগাল হেসে বলল, বাঙালিরা বক্তৃতা শুনতে বড্ড ভালোবাসে। চলুন, আমিও যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।

ঘরে ফিরে এসে সূর্য দ্রুত পোশাক পালটাতে লাগল। চুলে চিরুনি বসিয়ে বুঝল, বেশ শক্ত হয়ে গেছে চুল, সহজে আঁচড়ানো যায় না। তা ছাড়া চুল আঁচড়াবার জন্য ডান। হাতখানা উঁচু করতে গেলেই কাঁধের কাছে খচ করে লাগে। জলপাইগুড়িতে তাকে যে মেরেছিল তার ব্যথার রেশ এখনও রয়েছে। দেশের স্বাধীনতা এবং দীপ্তিদি এই দুটি কারণে সে দু’বার মার খেয়েছে, এই দুটিই তার জীবন থেকে অনেক দূরে এখন। দীপ্তিদি তার লেখা চিঠি সূর্যর কাছ থেকে ফেরত চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার যুদ্ধ সূর্যর কাছ থেকে আগেই সবকিছু ফেরত নিয়ে নিয়েছে।

সূর্য কঠিন মুখ করে রূপলালকে বলল, চলুন।

.

সূর্য একা থাকতে অভ্যস্ত, সে একাই শহরে বেরোতে চেয়েছিল, কিন্তু রূপলাল তার সঙ্গ ছাড়বে না। ছেলেটির মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু নেই, অথচ খুব একটা বিরক্তিকরও বলা যায় না। কথার মাঝখানে হঠাৎ অদ্ভুত ভাবে হাসে, তখন তার মুখে একটা সরল সৌন্দর্য আসে। সূর্যর মতন একজন গোমড়ামুখো ছেলের প্রতি কেন যে সে আকৃষ্ট হল, বোঝাই যায় না। রূপলাল টাকা তৈরি করার জগতের একটা অংশ এবং সে সেই আনন্দেই মশগুল।

স্টেশন ছাড়িয়ে বিরাট চওড়া রাস্তা। এই ঐতিহাসিক পুরনো শহরটিতে ঐশ্বর্য এবং দারিদ্র খুব সহজ ভাবেই পাশাপাশি অবস্থান করে আছে।

মিছিলটি একটু আগে চলে গেছে এই রাস্তা দিয়ে। সূর্য আর রূপলাল হাঁটতে হাঁটতে চলে এল ময়দানে। মিটিংয়ে যথেষ্ট জনসমাগম হয়েছে। সেটা আগস্ট দিবস বলে নয়, মন্ত্রী দু’জনের আগমনের কারণে। মন্ত্রীরা এরই মধ্যে বেশ দ্রষ্টব্য বিষয়। মাত্র চার বছর আগে, দেশ যখন পরাধীন ছিল, তখন এইসব মন্ত্রীরা ছিল ছোটখাটো জননেতা, তখন এইসব রাস্তা দিয়েই তারা কত বার পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড কথা বলেছেন চেনাজানা লোকদের সঙ্গে। এখন মন্ত্রী হবার পর তারা আর পায়ে হেঁটে রাস্তা দিয়ে যান না কখনও। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের কায়দাতেই তাঁরা নিজেদের আলাদা করে দূরে সরিয়ে রেখেছেন জনতা থেকে। বাইরে বেরোবার সময় পুলিশ পাহারা থাকে।

এখানকার মানুষ কলকাতার মতন সভা-সমিতিতে খুব একটা অভিজ্ঞ নয়। সভায় রীতিমতন বিশৃঙ্খলা। মঞ্চের ওপর শুরু হয়েছে উদ্বোধন সংগীত, ও-দিকে বিভিন্ন জায়গায় গোলমাল চলছে, অনবরত হুইল বাজাচ্ছে টুপি-পরা স্বেচ্ছাসেবকরা।

সূর্য ভিড়ের একেবারে পেছন দিকে এসে দাঁড়াল। সে যথেষ্ট লম্বা, তার দেখতে কোনও অসুবিধে হয় না, কিন্তু রূপলাল ঠিক দেখতে পাচ্ছে না, তাকে আঙুলের ভর। দিয়ে উঁচু হতে হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর সূর্য এই প্রথম কোনও মিটিং শুনতে এল। আগস্ট আন্দোলনের কথাতেই সে একটু উত্তেজিত বোধ করছে–অনেক রকমের স্মৃতি আসে, শরীরের মধ্যে একটা শিরশিরে ভাব হয়।

জেলা কংগ্রেসের সভাপতি প্রথমে সংক্ষেপেঁ দু-চার কথায় তার বক্তব্য সারলেন। মাননীয় দু’জন মন্ত্রীর প্রসঙ্গেই তিনি বেশি বললেন। তিনি বুদ্ধিমান, তিনি বুঝেছেন, আজ তাঁর কথা এখানে কেউ বেশিক্ষণ শুনবে না–মন্ত্রীদ্বয়ই প্রধান আকর্ষণ। ব্রিটিশ রাজত্বের রেশ এখনও যায়নি, যাদের হুকুমে রাস্তায় পুলিশ নামে, দোকানপাট খোলা থাকে কিংবা বন্ধ হয়, কলমের খোঁচায় চাকরি হয় কিংবা চাকরি যায়–তারা এখন আর সাহেব নয়, আমাদেরই মতন মানুষ–তবু দেখলে সমীহ জাগে।

প্রথমে বলতে উঠলেন আবগারি মন্ত্রী শ্রীবাস্তবজি। বিশাল চেহারা, শুভ্র খদ্দরের পোশাক পরা, মাথায় গান্ধী টুপি। মুখখানা গম্ভীর। প্রথমেই তিনি বললেন, আজ আমার। মনে পড়ছে–সেই সব সহকর্মীর কথা, যাঁদের আত্মত্যাগের মূলে এসেছে এই স্বাধীনতা। সেই সব শহীদদের স্মরণে আমরা দু মিনিট নীরবতা পালন করব।

এই বলেই শ্রীবাস্তবজি চোখ বুজলেন। অনেকে দেখাদেখি চোখ বুজে চুপ করল। অনেকে তাঁর কথা শুনতে পায়নি বলে তখনও গোলমাল করছে আর ভলান্টিয়াররা বলছে, চুপ, চুপ!

সূর্য চুপ করে রইল, কিন্তু যোগানন্দ ছাড়া আর কারওর কথা তার মনে পড়ল না। যোগানন্দকে কি শহীদ বলা যায়? পথের কুকুরের মতন সে রাস্তায় মরে পড়ে ছিল, তার কোনও বন্ধু বা আত্মীয় তার কাছে যায়নি। পুলিসের মুদাফরাশ এসে চ্যাংদোলা। করে নিয়ে গিয়েছিল দেহটা। বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ যোগানন্দ, দেশের জন্য প্রাণ। দিতেই চেয়েছিল, তবু মৃত্যু এসেছিল অত্যন্ত অতর্কিতে। সূর্য তাকে ফেলে পালিয়ে ছিল। কোনও ইতিহাসের পাতায় তার নামটাও থাকবে না। কেন সে প্রাণটা দিতে গেল?

যোগানন্দর স্ত্রী শ্যামলীর কথাও মনে পড়ল একবার। সূর্যর সঙ্গে আর কোনও দিন তার দেখা হয়নি। কী ভাবে সে যোগানন্দর মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিল কে জানে! শ্যামলী ছিল একটু গম্ভীর ধরনের, যেন একটু অহংকারী, কিন্তু হঠাৎ যখন হাসত, অন্য রকম হয়ে যেত তার মুখ। শ্যামলী কি সহ্য করতে পেরেছে? সূর্য নিজেকে অপরাধী বোধ করে।

নীরবতা ভাঙার পর মন্ত্রী মহোদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজ এই পুণ্য। দিনে আমি এখানে যে আপনাদের সামনে উপস্থিত হতে পেরেছি, সে জন্য নিজেকে ধন্য মনে করছি। এই এলাকার যে বিপ্লবী ঐতিহ্য আছে…।

সূর্য অবাক হয়ে ভাবল, বেয়াল্লিশের সময় গোয়ালিয়ারে কি কিছু হয়েছিল? সে তো শোনেনি। সে সাতনার কথা শুনেছিল বটে। একটু পরেই বুঝতে পারল, শ্রীবাস্তবজি বলছেন ১৮৫৭ সালের সিপাহি যুদ্ধের কথা। তিনি অত দূর থেকে শুরু করেছেন।

শ্রীবাস্তবজিকে ঠিক মেঠো বক্তা বলা চলে না। গরম গরম বুলি ছাড়ার দিকে তার ঝোঁক নেই। ধীর স্থির ভাবে তিনি ইতিহাস আলোচনা করতে শুরু করলেন, অবশ্য একদেশদর্শী ইতিহাস।

মানুষটিকে বেশ সৎ বলেই মনে হয়। এই লোকটিকে যেন আবগারি বিভাগের মন্ত্রী পদে ঠিক মানায় না। বোধহয় আর কোনও দপ্তর খালি ছিল না।

ময়দানের মিটিংয়ে এ রকম মাস্টারমশাই সুলভ বক্তৃতা কেউ বেশিক্ষণ শুনতে চায় না–একটু পরেই এদিক-ওদিক থেকে গুঞ্জন শুরু হল। রূপলাল কিন্তু খুব মুগ্ধ ভাবে শুনছে, এই আবগারি মন্ত্রীর কাছে কাল তার পারমিট আনতে যাওয়ার কথা আছে।

শ্রীবাস্তবজি বেয়াল্লিশের আন্দোলনের বিষয় মাত্র দু-তিন লাইনে সেরে দিলেন। শুধু জানালেন যে, ওই সময় তিনি নেহরুজির সঙ্গে এক জেলে ছিলেন। জেলের ভেতরে থেকে তাঁরা তখন বুঝতেই পারেননি যে, বাইরে এক শ্রেণির লোক হিংস্র হয়ে উঠে গান্ধীজির প্রোগ্রাম বানচাল করে দিতে চলেছে। যাই হোক, গান্ধীজি যে স্বাধীনতা আমাদের হাতে দিয়ে গেছেন, তাকে রক্ষা করতে হবে…

কে যেন কী একটা প্রশ্ন করল চেঁচিয়ে, ঠিক বোঝা গেল না। অমনি খানিকটা গোলমাল শুরু হল। তারপর দেখা গেল, খাকি পোশাক পরা প্রৌঢ় মতন একজন লোক মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবকরা জাপটে ধরে ফেললে তাকে। খাকি পোশাক-পরা লোকটির একটা হাত কনুইয়ের কাছ থেকে কাটা, সে হাউহাউ করে কঁদছে আর কী যেন বলতে চাইছে।

শ্রীবাস্তবজি উর্দু মেশানো হিন্দিতে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সূর্য মোটামুটি বুঝতে পারছিল। খাকি পোশাক-পরা লোকটার কথা সে কিছুতেই বুঝতেই পারল না। লোকটা কি পাগল?

সেরূপলালকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী?

রূপলাল বলল, ও লোকটা বলছে, ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সেপাই ছিল। এখন খেতে পায় না। কিছু একটা কাজ চাইছে।

সূর্য হেসে বলল, শ্রীবাস্তবজি তো আজাদ হিন্দ ফৌজের নাম উল্লেখ করেননি। সেই জন্য, ওঁর কোনও দায়িত্ব নেই।

রূপলাল বলল, নেতাজি যখন ফিরে আসবেন, তখন দেখে নেবেন এক হাত!

ফিরে আসবার কথা আছে নাকি?

আলবাত। তিনি ফিরে এসে যদি তার সব পুরনো সেপাইদের নিয়ে আবার দল তৈরি করেন, সেই জন্যই তো আজাদ হিন্দ ফৌজের কারোকে আর্মিতে নেওয়া হয়নি।

সূর্য এই অভিনব তত্ত্বটি শুনে চুপ করে গেল। ও-দিকে শ্রীবাস্তবজি এবার গলা চড়ালেন। তাকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, স্বাধীনতা শুধু মুখের কথা নয়, এর জন্য অনেক আত্মদান করতে হবে। প্রথমেই আমাদের রক্ষা করতে হবে গণতন্ত্র। সামনেই যে সাধারণ নির্বাচন আসছে–

পরের বক্তা কৃষিমন্ত্রী সাকসেনাজির কথা থেকে আরও স্পষ্ট বোঝা গেল, এটা আসলে একটি নির্বাচনী সভা। কয়েক মাস পরেই ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন, তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বেয়াল্লিশের আন্দোলনের স্মৃতি উদ্যাপন নিয়ে কারওর মাথাব্যথা নেই।

সাকসেনাজি আগের বক্তার মতন নিছক ইতিহাসের কচকচি নিয়ে সময় কাটাবার মতন ভুল করলেন না। তিনি সরাসরি নেমে পড়লেন আত্মপ্রচারে। সি শার্পের পঞ্চম সূরের নীচে তার গলা নামে না কখনও। তিনি বললেন, তিনি চোদ্দো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে কংগ্রেসের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। জেল খেটেছেন, পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন, তবু মহান কংগ্রেসের আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। তিনি সব মিলিয়ে। পাঁচ বার জেল খেটেছেন, তার মধ্যে লাহোর জেলে যে ভয়াবহ অত্যাচার করা হয়েছিল, তার বর্ণনা শুনলে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তিনি নাটকীয় ভাবে বোতাম খুলে জামাটা ফাঁক করে গলার কাছে হাত দিয়ে বললেন, এইখানে, ঠিক এইখানে লোহার ডান্ডা দিয়ে আমাকে মেরেছিল, আমি তবুও বলেছি, বন্দে মাতরম্‌! বন্দে মাতরম্‌! যত বার মেরেছে তত বার আমি বলেছি–

সূর্যর মনে হল, আগ্রা হোটেলের সেই মেয়ে তিনটি যেমন তাদের শরীরের রূপ-যৌবন দেখিয়ে খরিদ্দার আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল, এই ব্যক্তিটিও ঠিক সেই রকমই যেন নিজের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের বিবরণ দিয়ে ভোট আদায় করতে চাইছে। কেন তিনি ভোটে জিততে চাইছেন? অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে বলে এখন একটু আরাম চান? নাকি, দেশের সেবা করা একটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে?

সূর্য হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার মনে হল, হরকুমার, ব্রজগোপাল, যোগানন্দ–এঁদের স্মৃতিকে অপমান করা হচ্ছে। সেই লোকগুলো কি মূর্খ ও নির্বোধ ছিল, তাই শুধু শুধু প্রাণ দিয়েছে? সে নিজেই বা কেন নষ্ট করল তার প্রথম যৌবনের শ্রেষ্ঠ কয়েকটা বছর? স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে একসময় তারা উন্মাদ হয়েছিল, এর নাম স্বাধীনতা? মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে দু’জন হোমরাচোমরা, অদূরে পুলিশের গাড়ি পাহারায়–আর কতকগুলো ভিখিরি হাঁ করে শুনে যাচ্ছে নানা রকম উদ্ভট কথা। কোটি কোটি লোক দিশেহারা হয়ে বসে আছে, দেশের কোন কাজে তারা লাগবে, তাও জানে না–তাদের সামনে আজ দেওয়া হচ্ছে মস্ত বড় একটা কাজ, ভোট দাও!

সূর্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না–কিন্তু আগস্ট আন্দোলনের স্মৃতির নাম করে এই সভা ডাকা হয়েছে বলেই তার মধ্যে জেগে উঠেছে পুরনো দিনের উত্তেজনা।

সাকসেনাজি যখন গলার আওয়াজ আরও উঁচুতে তুলেছেন, সূর্য তখন আরও জোরে চিৎকার করে বলল, শাট আপ।

কিন্তু এতে বড় কিছু আলোড়ন দেখা গেল না। কয়েক জন ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল এ-দিকে। রূপলাল সূর্যর হাত চেপে ধরে বলল, এ কী করছেন?

সূর্য তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ভিড় ঠেলে এগোতে চাইছিল। তার মুখ এখন রক্তাভ, কপালে ঘাম জমেছে, সে আত্মবিস্মৃত। সামনে যত বাধাই থাক, সে গোঁয়ারের মতন। মঞ্চের ওপর উঠে গিয়ে বক্তার কলার চেপে ধরতে চাইছিল। সে অপমানিত এবং ক্রুদ্ধ। কিন্তু সূর্যকে বেশি দূর এগোতে হল না, এই সময়েই ময়দানের অন্য অংশ থেকে গোলমাল শোনা গেল। একদল লোক, তাদের মধ্যে অধিকাংশই যুবক–উঠে দাঁড়িয়ে। হইহই শুরু করেছে। তারা বলছে, তারা মন্ত্রীর বক্তৃতা শুনতে চায় না, চাকরি চায়। ওরা অনেকেই সদ্য চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবকরা আর কিছু জানে না, তাদের ওপর শুধু নির্দেশ আছে, কোনও গণ্ডগোল বাধলেই থামাতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকরা ছুটে গিয়ে ওদের ঘাড় ধরে জোর করে বসিয়ে দিতে গেল। ফলে শুরু হয়ে গেল ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি। এইসব ঘটনার গতি কখন কোন দিকে যাবে, তা আগে থেকে বলা শিবের বাপেরও অসাধ্য। অনেক সভায় এই রকম সামান্য গোলমাল একটুতেই থেমে যায়, অনেক সময় আবার রক্তারক্তি পর্যন্ত পৌঁছোয়। সাকসেনাজি অদম্য ভাবে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, কমিউনিস্টরা দেশটাকে টুকরো টুকরো করতে চাইছে। তারা পাকিস্তানের সাপোর্টার। তাদের ষড়যন্ত্র আমরা ব্যর্থ করে দেবই। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান করার কথা যখন উঠেছিল, তখন আমরা তার বিরোধিতা করেছি। আমরা জনতার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করব। আমরা–

পুলিশের লাঠি চার্জে সেই সভা শেষ হয়। আহত হয় এগারো জন, তার মধ্যে এক জন সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ এবং একটি এগারো বছরের ছেলে।

সূর্য আর বেশি মাথা গরম করেনি, হঠাৎ নিজেকে সামলে নিয়েছে। বরং নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল তার। এই সাত পাগলের মেলায় তার আসবার দরকার কী ছিল? এই নিরন্ন, বুভুক্ষু, মূর্খের দেশটা উচ্ছন্নে যাক না, তার কী আসে যায় তাতে? হরদা’র কাছে সে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তা শেষ হয়ে গেছে, আর কারওর কাছে তো তার মাথার দিব্যি দেওয়া নেই।

ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে সূর্য ময়দানের অন্য প্রান্তে এসে পড়েছিল, রূপলালকে হারিয়ে ফেলেছে, তাতে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে। যাক, এখন একটু একা ঘোরাফেরা করা যাবে। মিটিংয়ে লাঠি চালনার ফলে রাস্তায় বেশ উত্তেজনার আবহাওয়া রয়েছে, অনেক দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে এর মধ্যেই, লাঠিসোটা হাতে কিছু মানুষও দেখা যায়। সূর্য অবশ্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে এ রকম অনেক দেখেছে, সে জানে কী ভাবে এড়িয়ে থাকতে হয়।

কিন্তু রূপলালকে এড়ানো গেল না। সে হঠাৎ আবার ফস করে কোথা থেকে হাজির হল। মুখ-ভরতি হাসি নিয়ে বলল, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? ডাকবাংলো তো উলটো দিকে।

সূর্য বলল, আমি একটু দানৌলি বাজারের দিকে যাব।

সেখানে চেনা জানা কেউ আছে বুঝি?

সেখানে একটা বাড়ি খুঁজতে হবে।

চলুন আমিও যাই।

অগত্যা তাকে নিতেই হল সঙ্গে। খানিকক্ষণ চুপচাপ যাবার পর সে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ আপনার দেমাগ খারাপ হয়ে গেল কেন?

সূর্য কাঁধ ঝাঁকাল, কোনও উত্তর দিল না।

আপনি পলিটিক্স করেন নাকি?

এ কথার উত্তর না দিয়ে সূর্য ফস করে জিজ্ঞেস করল আপনি তো কাল মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন?

রূপলাল থমকে দাঁড়িয়ে সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। তারপর বলল, মাথা খারাপ? আপনাকে নিয়ে গিয়ে আমি মরব? আমি যাচ্ছি পারমিটের জন্য দরবার করতে–সেখানে আপনি গরম গরম বাত বলতে শুরু করবেন–

সূর্য আবার নিজের ওপর খুব বিরক্ত হয়ে উঠল। একটু আগেই সে ঠিক করেছিল, ওদের কারওর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক থাকবে না, তবু সে এ কথাটা বলতে গেল কেন? রাজনীতির ভূত কি কিছুতেই ঘাড় থেকে নামবে না? না, আর ওই চিন্তা একদম স্থান দেবে না মাথায়।

সূর্য উষ্ণ গলায় বলল, তা হলে আপনি আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছেন কেন?

রূপলাল বলল, আরে দাদা, আপনি রাগ করছেন কেন? আপনার লাইন আলাদা, আমার লাইন আলাদা। তা বলে কি সন্ধেটা একসঙ্গে কাটাতে পারি না? আপনি তো আমাকে মিটিং শোনালেন, এবার চলুন, আপনাকে আমি ভালো ভালো জায়গায় নিয়ে যাব। দেখবেন, পছন্দ হয় কিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *