মধ্যরাত পার হয়ে গেছে। কখন, দুলাল জুড়িগাড়ির পশ্চাতের তক্তায় বসে মশার দংশনে ছটফট করছে, আর সেই সময় নবীনকুমার একাকী ঘুরছে ওলাইচণ্ডী তলার একটির পর একটি বাড়িতে। তার চক্ষু জবাফুল বর্ণ, পদদ্বয় আর মস্তিষ্কের ভার বহন করতে চাইছে না, তবু তার গৃহে ফেরার কথা মনে নেই। যত নেশা বাড়ে, তত বাড়ে তার জেদ আর দুঃখ, কেন সে তার মাতৃ-মুখী সেই রমণীকে আর দেখতে পাবে না? কেন একই রকম রূপের দুটি রমণীর একজন হয় স্নেহময়ী পুতচরিত্রা নবীনকুমারের জননী আর অন্যজন হয় বারনারী?
একটি কক্ষের দ্বারে করাঘাত করে নবীনকুমার বললো, খোলো! ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে উত্তর এলো, হবে না, হবে না, যাও। আমার লোক আচে! নবীনকুমার বললো, সে থাকগে যাক, একবারটি শুধু তোমার মুখটি দেকবো, যত টাকা লাগুক—
—কে রে, মুখপোড়া, দূর হ!
—একবারটি খোলো, আমি আর কিচুই চাই না, শুধু দেকবো—
—আরে আমার পিরীতের নগর রে! শুধু দেকবো! যা, যা-—
এরূপ কিছু বাক্য বিনিময়ের পর তিতিবিরক্ত হয়েই স্ত্রীলোকটি দ্বার খোলে। দু জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে যেন তড়িতাহতের মতন স্থাণু হয়ে গেল।
স্ত্রীলোকটিই কথা বললো প্রথম। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে সে বললো, তুমি? কেষ্টঠাকুর! আমায় খুঁজতে খুঁজতে এত দূর এসোচো? এসো, এসো, ভেতরে এসো, তোমায় আমার আঁচল পেতে বসতে দেবো–
স্ত্রীলোকটি বিস্মিত স্তম্ভিত নবীনকুমারের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ঘরের মধ্যে।
নবীনকুমারকে বিস্ময় বিমূঢ় অবস্থায় চিত্ৰাপিতবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রমণীটি হা হা শব্দে উচ্চহাসা করে উঠলো, তার শরীরটি দুলতে লাগলো বেতস লতার মতন। পশ্চিমা বাঈজীদের মতন তার অঙ্গে অত্যুজ্বল লাল মখমলের কামিজ, দুই চক্ষে গাঢ় সুমা, চুড়ো করে চুল বাঁধা। চক্ষের মণি দুটি যেন দু টুকরো হীরে। প্রথম নজরে রমণীটিকে মনে হয় যেন এক ভয়ংকরী অগ্নিশিখা!
নবীনকুমারের হাত চেপে ধরে সে বললো, হাঁ করে দেকচো কী গো? ওগো নবদুবাদলশ্যাম, আমায় চিনতে পারো নি? আমি যে তোমার সেই শিকলিকাটা পাখি!
নবীনকুমার আস্ফুট কণ্ঠে বললো, সুবালা!
প্ৰায় হ্যাঁচকাটানে নবীনকুমারকে কক্ষের মধ্যে এনে সুবালা বললো, না গো, সে সুবালা আর নেই কো! আমি এখুন পুতলী বাঈ। তবে জানতুম, তুমি একদিন না একদিন আসবে! প্ৰাণের টান কি কোনোদিন ছেড়া যায়?
কক্ষের এক ধারে মদ্যপানরত দুই ব্যক্তি এদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল। তাদের একজনের সঙ্গে চোখাচে্যুখি হতেই সে বললো, ছেলাম আলেকুম, বস্তে আজ্ঞা হোক, ছায়েব, আমায় চিনতে পারেন নি!
নবীনকুমারের তখনও বিস্ময়-বিমূঢ় অবস্থা কাটেনি। তাছাড়া চক্ষে নেশার ঘোর। লোকটির মুখখানি সামান্য পরিচিত হলেও আর কিছু সে ধরতে পারলো না। বস্তুত সুবালাকে দেখার পর থেকেই তার শরীরে একটু একটু করে ক্রোধের উত্তাপ সঞ্চারিত হচ্ছে। এই সুবালা তার জীবনের একটি ব্যর্থতার প্রতীক।
সে আর কোনো কথা না বলে তৎক্ষণাৎ সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সুবালা ছুটে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করে সেখানে পিঠ ঠেস দিয়ে দু বাহু ছড়িয়ে দাঁড়ালো। তারপর হীরামন পাখির মতন তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, কোতায় যাচ্চো, নাগরী! এতদিন পর তোমায় পেয়েচি। আমারই খোঁজে এতদূর এসে আবার অমনি সাটুকান দিতে চাইচে যে? এ কী খেলা তোমার, নাথ? ঘরে অন্য লোক দেখে বুঝি তোমার গোঁসা হয়েছে?
নবীনকুমার বললো, পথ ছাড়ো!
সুবালা দুদিকে ঘাড় হেলিয়ে বললো, উঁহু! সেটি হচ্চে না। যাবো বললেই কি যাওয়া হয়? এতদিন পরে এসোচো, বঁধু, আধো আঁচরে বসো, পান খাও, দুটো রসের কতা শোনাও-ওরা দুজনে এক্ষুনি চলে যাবে-ওরা আমার রোজাকার নুন-পান্তা, আর তুমি হলে গে। পোলাও কালিয়া…
নবীনকুমার বললো, আমায় যেতে দাও! আর কোনোদিন তোমার মুখ দেকতে হবে আমি ভাবিনি—
সুবালাও কম নেশাগ্ৰস্ত নয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে সে বারবার তার জিহ্বা দিয়ে ডালিম-রঙা ওষ্ঠ লেহন করছে। উত্তম সাজসজ্জায় এবং মাজাঘষায় তার রূপ অনেকটা বৃদ্ধি পেলেও এই কয়েক বৎসরের ব্যবধানে তার মুখে যেন একটা নিষ্ঠুর ভাব এসেছে।
সে বললো, আহা-রে মরে যাই! মরে যাই! আমার মুক দেকতে হবে ভাবো নি! ও মুক দেখিলে অঙ্গ জ্বলে, না দেখিলে মন সদা উচাটন! তোমার তবে সেই অবস্থা! এতদিন পর খুঁজে খুঁজে। তবে আমার দুয়োরে এসে কেন দাঁড়ালে, বংশীধারী? তোমায় দেকে আমারও গা জ্বলে যাচ্চে, তুমি আমার শত্তুর, পরম শত্তুর, তবু তোমারই প্রতীক্ষেতে এতকাল ঘুমহারা নয়নে বসে আচি।
এর পর সুবালা গান ধরলো :
এক কৰ্ণ বলে আমি কৃষ্ণনাম শুনিব,
আর এক কৰ্ণ বলে আমি বধির হয়ে রব।
(ও নাম শুনবো না, শুনবো না, নিলাজ বঁধুর নাম
শুনবো না, শুনবো না)
এক নয়ন বলে আমি কৃষ্ণরূপ দেখিব
আর এক নয়ন বলে আমি মুদ্রিত হয়ে রব
(ও রূপ দেখবো না, দেখবো না, কালীয় কুটিলের রূপ
দেখবো না, দেখবো না!)
এই গানের সময় মাতাল বাবু দুটির একজন অপরের পৃষ্ঠদেশকে ড়ুগিতবলা বানিয়ে তাল দিতে শুরু করে, রীতিমতন আড়ে ঠেকা সহযোগে।
নবীনকুমার বিরক্তি কুঞ্চিত মুখে আর এক পা অগ্রসর হয়ে বললো, আমায় যেতে দাও! তোমাদের ছুঁতে চাই না। আমি, নইলে জোর করে তোমায় সরিয়ে দিতুম!
সুবালা বললো, কী, আমাদের ছুঁতে চাও না? আমাকে তুমি ঘরের বার করে এনোচো, ভদ্রঘরের বউ ছিলুম, বাজারে মাগী করোচো, এখন বলে ছুঁতে চাই না! এখন বিড়েল তপস্বী সাজচো! সুবালার এমন নৃশংস মিথ্যাভাষণে নবীনকুমার একটুক্ষণের জন্য আবার বাক্যহীন হয়ে যায়। এ সর্বনাশিনী বলে কি? এক কদৰ্য পতিতালয় থেকে একে উদ্ধার করে নবীনকুমার একে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেবার সর্বরকম চেষ্টা করেছিল, তা সে তুচ্ছ করে আবার এই নারকীয় জীবনে ফিরে এসেছে। সে এখন অপর লোকদের সামনে এই অপবাদ দিচ্ছে!
সুবালা অন্য লোক দুটির দিকে চেয়ে আদেশের সুরে বললো, তোরা এই মিনসেটাকে পেড়ে ফ্যাল তো! আজি আমি ওর বুকে বসে দুরমুস করবো!
সুরাপায়ী দুজনের মধ্যে যে নবীনকুমারকে সনাক্ত করেছিল, তার মাথায় একটি ফেজ, চিবুকে ছুঁচোলো দাড়ি অনেকটা মেহেদী রঙের, সে জিহ্বা বার করে বললো, তোবা, তোবা! এসব কী বলছে গো পুতুলীবিবি! এই বাবু কতবড় ইমানদার আদমী, সারা বাংলা মুলুকে কে না ইনাকে চিনহে!
লোকটি এসে নবীনকুমারের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকখানি ঝুঁকে সেলাম বাজিয়ে বললো, সিংহী ছায়েব আপনে যখন উর্দু দূরবীন আখবরের মালেক ছিলেন, তখন আমি সেখানে কুছুদিন সব এডিটারি করেছি। আপনার মনে নেই।…
নবীনকুমারের মনের মধ্যে এমনই ঝঞ্ঝা চলছে যে সে এই লোকটি বিষয়ে মনঃসংযোগই করতে পারলো না। সে যে-কোনো প্রকারে এখান থেকে চলে যেতে চায়।
ফেজ পরিহিত লোকটি তার সঙ্গীর হাত ধরে টেনে, নবীনকুমারকে এড়িয়ে সুবালার কাছে এসে জানালো যে, সুবালার পুরোনো প্রেমিক এসেছে, তাদের মান-অভিমানের পালায় অন্যলোকের উপস্থিতি শোভা পায় না। সুতরাং তারা এখন বিদায় নিচ্ছে। তবে বাবু নবীনকুমার সিংহের যাতে কোনোরকম বে-ইজ্জতী না হয়, সেটা তার দেখা উচিত।
লোক দুটি নিষ্ক্রান্ত হওয়া মাত্র দরজায় অর্গল লাগিয়ে সম্পূর্ণ অন্যরকম কণ্ঠস্বরে সুবালা বললো, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়িচি, না? আপনার দাঁড়ের সোনার শিকলি কেটে আমি একদিন ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে নীল আকাশে ডানা মেলেচিলুম…
নবীনকুমার কক্ষের সব দিকে চক্ষু বুলিয়ে বললো, এই নীলাকাশ?
সুবালা আবার হাসলো। এগিয়ে এসে নবীনকুমারের কণ্ঠে দুটি হস্ত স্থাপন করে বললো, যার যা নিয়তি! এই দুনিয়াটাই হলো গো ধোঁকার টাটি। চক্ষু বুজলে এই ঘরটাই আকাশ। তেমন তেমন কপাল হলে চোখ মেললেও কেউ কোনোদিন আকাশ দেকতে পায় না। আসলে এই শরীরটাই তো খাঁচা গো! শোনো নি সেই গান, খাঁচার মধ্যে অচিন পাখি কমনে আসে যায়। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এক ফকির এই গান গাইতে গাইতে যেত। এ বাড়ি নয়গো, আমার বাপের বাড়ি, সে অনেককাল আগেকার কতা! সেই অচিন পাখিটা যেদিন এই খাঁচা ছেড়ে যাবে, সেইদিন নীলাকাশের সন্ধান পাবো!
সুবালার হাত দুটি নামিয়ে দিয়ে নবীনকুমার একটু সরে দাঁড়ালো। সুবালা সম্পর্কে শুধু ক্ৰোধ নয়, ঘৃণাও অনেকখানি জমে ছিল তার মনের মধ্যে। কিন্তু এ কথাও ঠিক, এরকম রহস্য ভরা সুন্দর কথা সে এ পর্যন্ত আর কোনো স্ত্রীলোকের মুখে শোনেনি। প্রথম সাক্ষাতে এই ধরনের কথা শুনেই সে সুবালার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। এরকম রমণীরও কেন এই বারবনিতার জীবনই পছন্দ হলো!
সঙ্গের সুরার বোতলটি বার করে নবীনকুমার গলায় ঢাললো অনেকখানি। এরকম অবস্থায় কণ্ঠে তরল আগুনের আঁচ না পেলে সে মনের জোর ফিরিয়ে আনতে পারে না।
সুবালা বললো, ডাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো! এই তোষক-জাজিম যদি তোমার অপবিত্র বোধ হয়, তা হলে আমার চোখের জল দিয়ে সব ধুয়ে দিচ্চি! হ্যাঁ গা, আমায় খুঁজে পেতে তোমার খুব কষ্ট করতে হয়েচে, তাই না? আমি ইচ্ছে করেই তোমার কাঁচ থেকে এতদিন নুকিয়ে রয়েচি। জানতুম, তুমি নিজে থেকে একদিন না একদিন আসবেই।
—আমি তোমায় খুঁজতে আসিনি!
—আহা-হা, আমি যেন আর জানি না! আর ভাঁড়িয়ো না গো, ভাঁড়িয়ো না! চাদিকে একেবারে টি টি পড়ে গ্যাচে, আর উনি এখনও ছাঁটা মেরে বলচেন, তোমায় খুঁজতে আসিনি! কত লোক আমায় এসে বলে যাচ্চে, ওগো, নবীনকুমার সিংগী যে সব পাড়ায় পাড়ায় তোমায় হন্যে হয়ে খুঁজচোন! ঐ যে ফকিরুদ্দীন, ঐ ফকরা ছোঁড়াই তো তোমায় দেকেচে কতদিন, তুমি এক একজন রাঢ়ের বাড়ি যাচ্চো, আর তার মুখ দেকে ভিারকুট্টি মেরে বলচো, এ না! এ তো সে না! হি-হি-হি-হি! তুমি আমায় সহজে পাবে কী করে, আমার সেই আগেকার নাম নেই, এখন আমি যবনী হাঁইচি, আর আমার সুরৎও পাল্টে গ্যাচে!
—তোমায় আমি খুঁজবো কেন? তুমি আমার ব্যবস্থায় থাকতে চাওনি—
—কেন চলে এসিচিলুম, তুমি বুঝতে পারো নি? তুমি আমায় সব দিয়েচিলে, খাওয়া-পরার সুখ, দাস-দাসী, আরও কত কী, শুধু তুমি নিজেকে দাওনি! কোনো মেয়েমানুষ এতে খুশী হয়? ব্রজের রাখালরাজার মতন মুখখানি তোমার, আর তুমি মেয়েমানুষের মনের এই খবরটা জানো না! তবে আমি জানতুম, তুমি একদিন না একদিন আসবেই—
-আমি তোমার জন্য আসিনি। আমি অন্য একজনকে খুঁজচিলুম—
–কাকে গো, কাকে? সে আবাগীর বেটী কী এমন পুণ্য করেচে। যে আমার চেয়ে তাকে তোমার মনে ধরবে? বলো না গো, কে? ওগো দুঃখী, তুমি কার সন্ধানে সবার দোরে দোরে ঘুরচো? তোমার বুঝি কোনো বন্ধু নেই, কেউ প্রাণের দোসর নেই, তাই তুমি একজন সঙ্গী খুঁজে বেড়াচ্চো? তোমার কত টাকা, তুমি টাকা ছড়ালে গণ্ডায় গণ্ডায় হুরী-পরী কিনতে পারো, তবু কেন সন্ধ্যেবেলাগুলোতে আমাদের মতন পাতাকিনীদের মধ্যেই ঘুরতে হয় তোমায়? আহা গো!
আর কোনো উত্তর না দিয়ে নবীনকুমার গলায় আর কয়েক ঢোঁক ব্র্যাণ্ডি ঢাললো। সত্যি সত্যিই সে কাকে খুঁজছে, সে কথাটা এখানে আর বলার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া অজান্তে একটা কথা বলে সুবালা তার হৃদয়ের এক গোপন দুঃখের তন্ত্রীতে ঘা দিয়েছে। তোমার কোনো বন্ধু নেই! এর চেয়ে সত্য আর কী হতে পারে! সেইজন্যই কি তার এমন অবুঝ ছটফটানি!
ফকিরুদ্দীন ও তার সঙ্গীর ফেলে যাওয়া সুরার বোতলটি তুলে নিয়ে সুবালাও পান করলো খানিকটা। বড্ড গরম, এই বলে সে তাঁর ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো অতি সূক্ষ্ম ওড়নাখানি ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।
তারপর নবীনকুমারের দিকে তীব্র দৃষ্টি ন্যস্ত করে বললো, সে বাবু, তুমি যাই বলো, তুমি আমায় খোঁজো বা নাই-ই খোঁজে, আমি তো জানতুমই, তুমি একদিন না একদিন আসবেই…তুমি এসোচো, আর আমি তোমায় ছাড়চি নি। তুমি কতক্ষণ ডাঁড়িয়ে থাকবে? এবার একটু এসো।
–না।
—সে তুমি ডাঁড়িয়ে থাকো বা বসেই থাকে, আজ আমি তোমায় খাবো! আমি রাক্কুসী! এই দ্যাকো আমার দাঁতের ধার, আমার নোখ দেকোচো! ঈগল পাখির ঠোঁটের মতন…তুমিই আমায় ঘরের বার করে পথে নামিয়োচো, এখন আমার ওপর ঘেন্না! আমায় ছোবে না!
নবীনকুমার দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো, তুমি কী সব বকচো পাগলের মতন! কেন বলচো, আমিই তোমায় পথে নামিয়িচি? তুমিই তো গপ্পো শুনিয়েচিলে তোমার কোন দেওর না দেওরের শালা…
-সে তো তুমিই—
–পাপীয়সী, পথ ছাড়ো আমার! তোমার প্রলাপ শোনবার মতন সময় নেই আমার! শরীর নিয়ে পাপের বেসতি করাতেই তোমার সুখ, তাই নিয়েই থাকো! আমার সঙ্গে তোমার কোনো সংশ্ৰব নেই।
—শরীর নিয়ে পাপের বেসাতি…ঠিক বলোচো! এসব বড্ড ভালোবাসি আমি। শরীর আমার বাঘিনী, পুরুষ মানুষের রক্ত খেতে চায়। তোমার রক্ত না খেয়ে কি আর ছাড়বো? তুমি আমার নাগর, মৌলাআলীতে আমার জন্য সুন্দর বাসা ভাড়া করেচিলে, কত দয়া তোমার! তুমি সব বোঝে, শরীর বোঝে না, তাই না? মেঠাই খাবার লোভ অথচ হাত বাড়াতে নজা। এসো, সব তোমায় শিকিয়ে-পড়িয়ে দিচ্চি!
—তোমাকে আমি অনেকবার বলিচি, তোমাদের শরীরের প্রতি আমার লোভ নেই—
–লোভ নেই তো বাজারে মাগীদের দরজায় দরজায় রোজ রোজ ঘোরো কেন? তারা শরীর ব্যাচে না অমৃত ব্যাচে? ওগো আমার সন্ন্যিাসী ঠাকুর রে, উনি বনে বনে ঘুরে বেড়াচেন আর ব্যাকুল হয়ে ঈশ্বরকে খুঁজচোন। এই বেবুশ্যেপাড়া তোমার সেই গহন বন, আর আমি তোমার ঈশ্বর!
কথা বলতে বলতে সুবালা তার শরীরের সমস্ত বসন ত্যাগ করতে লাগলো। সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে সে নবীনকুমারের একেবারে সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়ে বললো, এবার?
সুরার প্রভাবে ও নগ্ন নারীরূপের ঝাঁঝে নবীনকুমারের শরীর টলমল করে উঠলো। সে সবেগে মস্তক আন্দোলিত করে বলতে লাগলো, না, না!
সুবালাকে স্পর্শ না করে সে দ্বারের দিকে এক লফে চলে যেতে গিয়ে পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। দেয়ালের কোণে মাথা ঠুকে গেল বেশ জোরে।
মাঠের মধ্যে জুড়ি গাড়ির পিছনের তক্তায় বসে মশার কামড় খেতে খেতে সারা রাত কেটে গোল দুলালের। ভোরের মধ্যেও ফিরলো না। নবীনকুমার। বিরক্তিতে, গ্লানিতে এবং দুভাবনায় তার মাথা খারাপ হবার মতন অবস্থা। এখন তার কী কর্তব্য? সে কোথায় তার প্রভুকে খুঁজতে যাবে? নবীনকুমারের যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে এখুনি কি গৃহে ফিরে গিয়ে গঙ্গানারায়ণকে তা জানানো উচিত? আবার, নবীনকুমার যখন তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে আদেশ করে গেছে, তখন এ স্থান ত্যাগ করাও কি তার পক্ষে, সঙ্গত?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বেলা বাড়তে লাগলো। কোচোয়ানও কোনো পরামর্শ দিতে পারলো না। নটার তোপ পড়বার পর দুলাল যখন নিজ দায়িত্বে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, সেই সময় এসে উপস্থিত হলো নবীনকুমার। চক্ষু দুটি রক্তবর্ণ, কপালের এক কোণে একটি সরু কাটা দাগ, মুখখানি গম্ভীর। কোনো রকম কারণ দশাবার চেষ্টা না করে সে গাড়িতে উঠে হুকুম করলো, বাড়ি চল!
এরপর নবীনকুমার কয়েকদিন পুরোপুরি একেবারে গৃহে অবস্থান করলো। শারীরিক কোনো। অসুস্থতা না থাকলেও সে প্রায় শয্যাত্যাগই করলো না। দিন চারেক পরে যেন তার যোগনিদ্ৰা ভঙ্গ হলো।
দুলালকে দিয়ে সে খবর পাঠালো গঙ্গানারায়ণের কাছে, বিশেষ প্রয়োজনে সে একবার দেখা করতে চায়। গঙ্গানারায়ণ বাড়িতেই ছিল। সে নিজেই চলে এলো কনিষ্ঠ ভ্রাতার মহলে।
নবীনকুমার শান্ত ভাবে জানালো যে সে আগামী দু একদিনের মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। কবে ফিরবে। তার ঠিক নেই। তার প্রথম উদ্দেশ্য হরিদ্বারে গিয়ে জননী বিম্ববতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তাঁর কাছে কয়েকটি দিন কাটিয়ে তারপর সে নানান দেশ পরিভ্রমণ করবে।
গঙ্গানারায়ণ অতিরিক্ত উৎসাহিত হয়ে বললো, বেশ তো, বেশ তো, এ তো খুব ভালো কতা! তোর শরীরটাও অনেক শুকিয়ে গ্যাচে, পশ্চিমে হাওয়া পরিবর্তন করলে উপকার হবে। মায়ের সঙ্গে আমিও একবার দেকা করতে যাবো ভাবচিলুম, কিন্তু তুই আর আমি দুজনে এক সঙ্গে গেলে এখেনকার বিষয়-তদারকি কে করবে!
নবীনকুমার বললো, আমি ঘুরে আসি, তারপর তুমি যেও! আমি মাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেকচি, মা বোধহয় আমায় ডাকচেন!
নবীনকুমারের অনুপস্থিতির জন্য যে-সব কাগজ-পত্রে সই সাবুদ করে যাওয়া দরকার সে-সব সারা হলো। তা ছাড়া নবীনকুমার বাইরে যাবে, সেজন্য এলাহী বন্দোবস্তের দরকার। লোক-লস্কর নিতে হবে প্রচুর।
এই প্রথম দুলাল কচুমাচু হয়ে জানালো যে সে যদি সঙ্গে না যায়, তা হলে কি ছোটবাবুর খুব অসুবিধে হবে? দুলালের পত্নী দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হয়েছে, সেই জন্য সে এখন দূরে যেতে চায় না। কিন্তু নবীনকুমার দুলালচন্দ্রের এই প্রার্থনা খারিজ করে দিল। দুলালকে সঙ্গে না পেলে তার চলবে না। তার স্ত্রীর সন্তান প্রসবের আরও মাস চারেক দেরি, দুলাল অন্তত হরিদ্বার পর্যন্ত তো সঙ্গে চলুক, তারপর না হয় তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যাবে।
গঙ্গানারায়ণ শুধু একবার নবীনকুমারকে বললো, ছোট্কু, তুই যাওয়ার আগে একবার জ্যাঠাবাবুর সঙ্গে দেকা করে যাবি না? মা নিশ্চয়ই জ্যাঠাবাবুর কতা জিজ্ঞেস করবেন।
অতি বাধ্য বালকের মতন নবীনকুমার বললো, হ্যাঁ, যাবো! এক সময় সে শপথ করেছিল, আর কোনো দিন সে ও গৃহে প্ৰবেশ করবে না। এখন সে কথা তার মনে পড়লো না। গেলও সে পরদিন সকালে। বিধুশেখর তখন পূজার কক্ষে ঢুকেছেন, অন্তত একটি ঘণ্টা তো সেখানে কাটাবেনই। অতক্ষণ অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই নবীনকুমারের, আবার পরে আসবো বলে সে বিদায় নিল নিচের তলা থেকেই। আর আসা হলো না। দেখাও হলো না।
তিনখানি বজরা ও পিনিসের বহর নিয়ে শুভ লগ্নে যাত্রা করলো নবীনকুমার। কলকাতা ত্যাগ করার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে যেন সত্যই পল্লী প্রকৃতির শোভা দৰ্শন ও মুক্ত বায়ু সেবনের জন্য তৃষ্ণার্তা। একটি ব্যাপারে দুলালও খুব বিস্মিত। এতদিনের জন্য যাত্রা, অথচ ছোটবাবুর বজরায় একটিও সুরার বোতল নেওয়া হয়নি। যেভাবে ছোটবাবু পতিতালয়গুলিতে সন্ধ্যাযাপন করতে শুরু করেছিলেন, তাতে দুলালের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল যে ছোটবাবুর এই বিদেশ যাত্রা শহরের অন্যান্য বড় মানুষের সন্তানদের মতন প্রমোদ ভ্ৰমণ ছাড়া আর কিছুই নয়। নারী-সুরা ও নৃত্য-গীতই চলবে। সেই কারণেই দুলালের এত অনিচ্ছা ছিল এই ভ্রমণের সঙ্গী হওয়ার। অথচ সে সব কিছুই নেই!
নবীনকুমার কলকাতা পরিত্যাগ করার পক্ষাকাল পরে একদিন এক তরুণ সন্ন্যাসী এসে দাঁড়ালো সিংহ সদনের দ্বারে। সে গঙ্গানারায়ণ সিংহ কিংবা তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতার সাক্ষাৎ প্রার্থী। গঙ্গানারায়ণও তখন গৃহে ছিল না। সন্ন্যাসী ঠায় এক বেলা দাঁড়িয়ে রইলো দ্বারের বাইরে। ভৃত্য ও অন্যান্য কর্মচারীদের বিশেষ অনুরোধেও সে ভিতরে এসে বসলো না, কারণ সে কোনো গৃহস্থ বাড়িতে পদার্পণ করে না।
সন্ধ্যাকালে গঙ্গানারায়ণ প্রত্যাবর্তন করার পর সন্ন্যাসী তার হাতে একটি পুঁটুলি দিয়ে দুর্বোধ্য হিন্দীতে জানালো যে রামকমল সিংহের পুত্রের হাতে ঐটি তুলে দেবার জন্যই সে তার গুরুর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে হরিদ্বার থেকে কলকাতায় এসেছে। আজ রাত্রেই সে আবার ফিরে যাবে।
পুঁটুলির মধ্যে রয়েছে একখানি নামাবলী, একখানি রুদ্রাক্ষের মালা এবং একটি অঙ্গুরীয়। এই গুলিই বিম্ববতীর শেষ চিহ্ন। প্রায় দু মাস কাল আগে বিম্ববতী এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তাঁর সাধনোচিত ধামে প্ৰস্থান করেছেন।