2 of 3

৭২. একটি লোকও নার্সিংহোম ছেড়ে যায়নি

॥ ৭২ ॥

একটি লোকও নার্সিং হোম ছেড়ে যায়নি। ধীরে ধীরে পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে আসছিল। লাউঞ্জে এক ক্লান্ত নীরবতা। অদৃশ্য এক ঘড়িতে টিক টিক করে সময় বয়ে যাচ্ছে।

একজন ডাক্তার সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে নেমে এলেন। প্রায় ত্রিশ জোড়া চোখ একসঙ্গে তাঁর ওপর গিয়ে পড়ল।

ডাক্তারের মুখে হাসি নেই, কিন্তু খুব গম্ভীরও নন। ভীড়টার দিকে তাকিয়ে একটু থমকালেন। তারপর নেমে এসে কৃষ্ণকান্তের দিকে চেয়ে বললেন, স্যার, আপনি এখন বাড়ি যেতে পারেন। ব্লিডিংটা বন্ধ হয়েছে।

কৃষ্ণকান্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, আরো স্পষ্ট করে বলুন অবস্থাটা কী।

অবস্থা একটু ভাল। তবে আউট অফ ডেনজার বলা যাবে না।

তাহলে বাড়ি যেতে বলছেন কেন? আমার কথা ভেবে? আমার জন্য ভাবতে হবে না।

ডাক্তাবটির বয়স অল্প নয়। মধ্যবয়স্ক এবং বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট নামডাক আছে। তবু কৃষ্ণকান্তের সামনে তাঁকে নিতান্তই ছেলেমানুষের মতো লাগছিল। তটস্থ হয়ে বললেন, না স্যার, সে কথা বলিনি। বলছিলাম শী ইজ রেসপনডিং টু আওয়ার ট্রিটমেন্ট, কিছু ব্লাড দেওয়া গেছে। হার্ট তেমন খারাপ নয়। ইফ এভরিথিং গোজ ওয়েল তাহলে সকাল আটটা নাগাদ আমরা অপারেশনটা করে ফেলতে পারব।

আপনার কথায় একটি ইফ থেকে যাচ্ছে। ওই ইফটা ইরেজ করুন তারপর বাড়ি যাবো। আমার বউমার যদি ভালমন্দ কিছু হয় ডাক্তার, তাহলে আমার নিজের ভালমন্দে কিছু যায় আসে না। অবস্থা কিছু ইমপ্রুভ করেছে বলছেন?

অনেকটা।

সারভাইভ্যালের চানস্ কী?

ফিফটি ফিফটি।

এটা কি ইমপ্রুভমেন্ট?

তা বলা যায় স্যার, কারণ ঘণ্টা দুয়েক আগেও শী ওয়াজ জাস্ট সিংকিং। আপনি এখন নিশ্চিন্তে বাড়ি যেতে পারেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোনো বিপদ ঘটবে না। বরং আমরা ইমপ্রুভমেন্টের কিছু পজিটিভ সাইন পাচ্ছি। নতুন করে কনভালশনও দেখা দেয়নি।

কৃষ্ণকান্ত ডাক্তারকে উপেক্ষা করে প্রশ্নাতুর চোখে লাল্টুর দিকে তাকালেন।

লাল্টু বলল, তাই করুন কাকা।

কী করব?

বাড়ি যান। একটু বিশ্রাম করুন। একটু বেলায় ফের এলেই হবে।

তোরা কে কে থাকবি এখানে?

আমি আছি। জগাও থাক। আর সবাই চলে যাক এখন।

আর কুট্টি! সেই দামড়া কোথায়?

গাড়িতে বসে আছে।

তার কি লজ্জা হয়েছে?

লাল্টুর মৃদু একটু হাসল। জবাব দিল না।

কৃষ্ণকান্ত ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললেন, আমি আমার নাতিটাকে একবার দেখব।

নিশ্চয়ই। আমি আয়াকে বলে দিচ্ছি।

যদি দেখেন যে ঘুমোচ্ছে তাহলে থাক। বাচ্চাদের এ সময়টায় খুব ঘুম দরকার।

ঠিক আছে। দেখছি।

একটু বাদেই একজন পরিচ্ছন্ন আয়া মোটাসোটা ফর্সা একটি ঘুমন্ত বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে এল। কৃষ্ণকান্ত নির্নিমেষ চোখে দেখলেন। তারপর জগার দিকে তাকিয়ে চোখের একটা ইংগিত করলেন। জগা দশ টাকার একটা নোট আয়ার হাতে দিল।

কৃষ্ণকান্ত বাইরে এসে চারধারে ভোরের আবছা আলোয় নির্জন রাস্তাঘাটের দিকে অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে দেখলেন। বুকের পাষাণভার সবটুকু নেমে যায়নি। তবু একটু আশা ভরসা হচ্ছে, মনের ভিতর একটু জোর পাচ্ছেন। ছেলেবেলায় একসময়ে তিনি কিছুদিন ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। তখন ধ্যান করতে খুব ভাল লাগত। একটা মানসিক স্থিরতা আসত ধ্যানে। বুকের জোর বেড়ে যেত। নানা ঘটনার ওলট-পালট স্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে দূরে। তবু জীবনে একটা স্থির প্রত্যয়ের ভূমি বরাবরই ছিল তার। আজও কি আছে? কে জানে! কিন্তু ওই প্রত্যয়টুকু না থাকলে জীবনের সুখদুঃখগুলিকে অহরহ সহ্য করা যায় না। তিনি জীবনে সহ্য করেছেন বড় কম নয়। স্বদেশী আমলে মার খেয়েছেন, জেল খেটেছেন, স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যু ঘটেছে একরকম চোখের সামনে, বড় ছেলে বংশের নাম ডুবিয়ে এক ঘর-খেদানো মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা হয়েছে, মেজো ছেলে উচ্ছন্নে গেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, এই শেষ ধাক্কাটা, রেমিকে নিয়ে এই যমে-মানুষে টানাটানি তিনি বুঝি সইতে পারবেন না।

এদিক ওদিক তাকিয়ে কৃষ্ণকান্ত তাঁর মেজো ছেলেটিকেই খুঁজছিলেন। কুলাঙ্গারটা অবশ্য তাঁর সামনে এসে দাঁড়ানোর মতো সাহস পায় না। তবু খুঁজছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, সবচেয়ে অবাধ্য, সবচেয়ে বখা, সবচেয়ে নিন্দিত ও ধিকৃত এই ছেলেটির প্রতি তাঁর এক অপরিমেয় দুর্বলতা রয়েছে, যা ব্যাখ্যার অতীত, যা যুক্তিহীন। এই দুর্বলতা ঠিক পুত্রস্নেহ নয়। অন্য কিছু। কৃষ্ণকান্ত জীবনে কাউকে ভয় পেয়েছেন বলে মনে পড়ে না। এখনো পান না। কিন্তু এই মধ্যম পুত্রটির চোখের দিকে তাকালে তিনি এক বিপুল ভাঙচুরের কাল্পনিক ছবি দেখতে পান। তাঁর মনে হয় এই ধর্মহীন, অবিমৃষ্যকারী কালাপাহাড় দুনিয়াতে সৎ বস্তু বলে কিছু রাখবে না, সমাজ বলে কিছু রাখবে না, সব নীতিবোধ ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে। একে তিনি বুঝতে পারেন না। তাঁরই শরীর থেকে জাত, তাঁরই আত্মার স্ফুলিঙ্গ থেকে প্রাপ্ত এর প্রাণ, তাঁরই বীজ, তাঁরই জীন, তবু এ যেন এক অপরিচিত দেশের অচীন-ভাষাভাষী, অজানা আদবকায়দার মানুষ। কিছুই মেলে না। তা বলে ধ্রুব কখনো কৃষ্ণকান্তের মুখে মুখে কথা বলে না, তর্ক বা ঝগড়ার প্রশ্নও ওঠে না, এমন কি চোখে চোখ রাখে না পর্যন্ত। তবু ওর ভিতরে একটা কঠিন উপেক্ষা ও ঘৃণাকে খুব স্পষ্ট টের পান তিনি। এটা শুধু জেনারেশন গ্যাপ নয়, এক ধরনের নীরব বিদ্রোহ। নিজের বাপকে সবচেয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ধরে নিয়েছে ও। জেনারেশন গ্যাপ সহনীয়, কারণ তা স্বাভাবিক এবং প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে থাকে। কিন্তু এটা অন্য কিছু। শুধু কৃষ্ণকান্তই ধ্রুবর ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাত্র নয়, কৃষ্ণকান্ত যা কিছু পছন্দ করেন, যা কিছুকে মূল্য দেন বা যাকে স্নেহ করেন সবকিছুর প্রতিই ধ্রুবর জাতক্রোধ। এরকম পরিপূর্ণ বিদ্বেষ খুব স্বাভাবিক নয়। বাঘের ঘরে এই ঘোঘের বাস তাই কৃষ্ণকান্তর পক্ষে অস্বস্তিকর।

কৃষ্ণকান্ত নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি কোথা থেকে এসে দরজা খুলে দিল।

কৃষ্ণকান্ত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, দামড়াটাকে দেখেছিস?

এই তো ছিলেন।

কোথায় ছিল?

গাড়িতেই বসেছিলেন। একটু আগে নেমে গেলেন।

ধারেকাছে আছে?

ড্রাইভার কয়েক পা হেঁটে চারদিকটা দেখে এসে মাথা নাড়ল, না। ডেকে আনব?

কৃষ্ণকান্ত একটু ভেবে বললেন, থাকগে। বাড়ি চল। একটু বাদেই আবার আসতে হবে।

বাড়ি বেশি দূরে নয়। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলেন কৃষ্ণকান্ত। চাকর, দারোয়ান সব তটস্থ, জাগ্রত। তিনি কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দোতলায় উঠে নিজের চেম্বারে ঢুকলেন। একটা করুণ দৃশ্য চোখে পড়ল। লতু টেলিফোনের কাছে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। শোয়নি। বড় কর্তব্যপরায়ণ মেয়ে। কৃষ্ণকান্ত ওকে বলে গিয়েছিলেন যেন টেলিফোনের কাছে থাকে।

মেয়ের মাথায় হাত রেখে কৃষ্ণকান্ত ডাকলেন, ওঠো মা।

লতু এক ডাকে সোজা হয়ে বসে একটু হাসল, এসে গেছেন বাবা? বউদি!

একটু ভাল।

বেঁচে যাবে তো!

মনে তো হয়।

ছেলেমেয়ে কারো দিকেই কোনোকালে নজর দিতে পারেননি কৃষ্ণকান্ত। এরা বড় হয়েছে মায়ের ছায়ায় এবং মায়ের মৃত্যুর পর দাসদাসীদের তত্ত্বাবধানে। তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা কম। এদের শিশুকালেও তিনি খুব একটা কোলেপিঠে নেননি, ছানাঘাঁটা করেননি। নেই দূরত্বটা আজ আর অতিক্রম করা সম্ভব নয়।

লতুর দিকে তাকিয়ে আজ কৃষ্ণকান্তর একটু কষ্ট হল। মেয়েটা সারা রাত বসে ছিল টেলিফোনের কাছে। কত না জানি কষ্ট পেয়েছে। তিনি খুব নরম স্নেহসিক্ত গলায় বললেন, যাও গিয়ে স্নান সেরে নাও। রাত জাগলে সকালে স্নান করতে হয়। তাতে ক্লান্তিটা চলে যায়।

লতু একটা হাই চেপে বলে, আপনিও সারা রাত জেগে ছিলেন। চোখ তো লাল হয়ে আছে। টায়ার্ড দেখাচ্ছে।

কৃষ্ণকান্ত একটু হেসে বলেন, আমার কথা আলাদা। সারাটা জীবন তো অনিয়মেই কেটেছে মা। আমাকে কি কখনো আরামে থাকতে দেখেছো? কিছু হবে না আমার। ভয় পেও না।

লতু এমনিতে বাবার মুখের ওপর কোনো কথা বলে না। কিন্তু আজ নরম স্বরে বলল, এখন তো বয়েস হচ্ছে! তাই না! আপনার রাত জাগার দরকার ছিল না। আর সবাই তো ছিল।

মেয়ের একটু লঘু শাসনে কৃষ্ণকান্ত কয়েক বছর আগে হলেও চটে যেতেন। আজ চটলেন না। বয়স হচ্ছে, কথাটা তো মিথ্যে নয়। এতকাল নিজের বয়সটাকে একেবারেই পাত্তা দেননি তিনি। বয়স একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিস, একটা সংস্কার মাত্র। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা মানুষের জীবনকে বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে যে ভাগটা করা হয় সেটাও উদ্ভট। মানুষকে কিছু কাজ করার জন্যই জন্মগ্রহণ করতে হয় এবং শরীর পাত করেও সেইসব কাজ সম্পূর্ণ করার প্রয়াসই জীবন। এছাড়া জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

মেয়েকে বললেন, বউমার ওরকম অবস্থা, ঘুম বা বিশ্রাম সম্ভব ছিল না।

অপারেশন কি হয়ে গেছে?

না। আজ সকাল আটটায় হবে।

আপনি কি যাবেন আবার?

না গিয়ে উপায় কী?

তাহলে আপনি স্নান করে আহ্নিক সেরে নিন। আমি ঠাকুরকে তাড়াতাড়ি ভাত রাঁধতে বলে দিই।

কৃষ্ণকান্ত কিছু বললেন না। লতু চলে গেলে নার্সিং হোমে ফোন করে জানলেন, রেমির অবস্থা আর একটু ভাল। অপারেশনের তোড়জোড় চলছে। আর তাঁর সদ্যোজাত নাতি ভাল আছে। লাল্টুকে ফোনে ডাকিয়ে নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, দামড়াটাকে দেখেছিস নাকি? ধারেকাছে আছে?

না তো!

একটু দেখ। কাল রাত থেকে বোধ হয় কিছু খায়টায়নি।

দেখছি। কিছু বলতে হবে?

বাড়ি চলে আসতে বলিস। এসে স্নান-খাওয়া সেরে যেন যায়।

বলব। আপনি ভাববেন না।

একটু দেখিস ওকে লাল্টু। বলে কৃষ্ণকান্ত টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

একটা রেস্তারাঁয় বসে এক কাপ চা খাওয়ার চেষ্টা করছিল ধ্রুব। পারছিল না। মুখটা বিস্বাদে ভরে আছে। মুখোমুখি বসে তার দিকে স্থির ও ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে ছিল জয়ন্ত। খানিকক্ষণ ভগ্নীপতির দুরবস্থা লক্ষ করে বলল, লেবুর জল খাবেন?

লেবুর জল খেলে কী হয়?

জানি না। শুনেছি হ্যাংওভারের পক্ষে ভাল।

দূর। লেবুর জল খেলে বমি হয়ে যাবে।

হোক না। তাতে রিলিফ পাবেন।

না হে, রিলিফ অত সোজা নয়। অ্যাসপিরিন আছে তোমার কাছে?

না। আমি তো রাখি না। দরকার হলে এনে দিতে পারি। কিন্তু খালিপেটে কি ওসব খাওয়া ভাল?

আমার পক্ষে সব সমান। এখন উপদেশ দিও না, আই নীড কুইক রিলিফ।

ঠিক আছে, এনে দিচ্ছি! বাইরের ওষুধের দোকানগুলো বোধ হয় এখনো খোলেনি।

নার্সিং হোমে একটি মেডিসিন স্টোর আছে।

জয়ন্ত উঠে গেল। একটু বাদে দুটো ট্যাবলেট এনে টেবিলের ওপর রেখে বলল, ইওর পয়জন।

ধ্রুব ট্যাবলেট দুটো গিলে বলল, তুমি সেই মাঝরাত থেকে আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছো, আর টিকটিক করে যাচ্ছো। কেন বলো তো!

আপনাকে আর একটু স্টাডি করছি।

খুব স্মার্ট ভাবছো নাকি নিজেকে? আমাকে স্টাডি করছো মানে?

নার্সিং হোমের সামনে আপনার এই রাত কাটানোটা আমার একটু অদ্ভুত লাগছে। ভেরী আনলাইক ইউ।

এতে অস্বাভাবিক কী আছে?

আমার দিদির জন্য আপনি কোনোদিনই কিছু ফিল করেননি। বরং নানাভাবে তাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। হঠাৎ এমন রেসপনসিবল্ হাজব্যাণ্ডের মতো বিহেভ করছেন যে, খুব অবাক লাগল।

ধ্রুব একটু হাসল, তারপর টপ করে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে “ওঃ” বলে একটা কাতরতার শব্দ করে চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ বোজা অবস্থাতেই বলে, তুমি বোধ হয় আমার সম্পর্কে একটু সফ্‌ট্ হয়ে পড়েছো জয়। ইউ আর টেকিং কেয়ার অফ মি।

জয় বলে, সে তো ঠিকই। আপনার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো সফট্‌নেস নেই। কাল রাতেই তো বলেছিলাম, দিদির জন্যই আপনাকে চোখে চোখে রাখছি। দিদি বিধবা হোক এটা তো আর চাইতে পারি না।

ধ্রুব খানিকক্ষণ মৃদু মৃদু হাসল। তারপর বলল, আপাতত তোমার দিদি বিধবা হচ্ছে না। তাকে জ্বালাতে আমি আরো কিছুদিন বাঁচবো।

জয় মাথা নেড়ে বলল, আর আপনিও বোধ হয় এ যাত্রা বিপত্নীক হতে পারছেন না। অনেক কষ্ট করেছিলেন যদিও। বেটার লাক নেক্‌স্ট টাইম।

ধ্রুব এবার হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। খানিকক্ষণ হেসে আবার একটা কাতর শব্দ করে থেমে যায়। বলে, পেটের মধ্যে একটা কী যেন হচ্ছে জানো? একটা পেন। খুব বিচ্ছিরি টাইপের।

ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেন?

ভয় পাই। দেখালেই হয়তো বলবে ক্যানসার।

আপনি তাহলে ক্যানসারকে ভয় পান?

কে না পায়?

পেলে তো ভালই। অন্তত বোঝা যায় আপনি কিছুটা হিউম্যান।

ধ্রুব এটাকে অপমান হিসেবে নিল না। বরং আবার তার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। খুশিয়াল একরকম গলায় সে বলে, এত স্মার্ট কিন্তু কখনো ছিলে না জয়।

এখন হয়েছি তাহলে?

বোধ হয়। আজ বেশ ভাল ফর্ম দেখছি তোমার।

সেটা আপনার মনে হচ্ছে আপনি আজ ভাল ফর্মে নেই বলে।

ধ্রুব একথায় হাসল না। কিছুক্ষণ মুখ বিকৃত করে চোখ বুজে রইল। তারপর বলল, তোমার লেবুজল প্রেসক্রিপশনটা একটু ট্রাই করলে হত। এই রেস্টুরেন্টে কি পাওয়া যাবে?

যাবে না মানে? আপনি কি সোজা ভি আই পি? এক্ষুনি কাঁপতে কাঁপতে দেবে।

তাহলে বলে দাও। আর এক কাপ লিকারও দিতে বোলো, দুধ চিনি ছাড়া শুধু পাতলা একটু লিকার।

একটু হুইস্কি মিশিয়ে দেবে নাকি? জয় ঠাট্টার গলায় বলে।

দরকার নেই।

জয় উঠে গেল। ধ্রুব নিজের ভিতরে অ্যাসপিরিনের ক্রিয়া শুরু হওয়ার জন্য চোখ বুজে খুব ব্যগ্র মনে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে নিজেকেই নিজে বলে, ইট ইজ নট ওয়ার্কিং।

লেবুজল এবং লিকার একই সঙ্গে টেবিলে রেখে গেল বেয়ারা।

জয় বলল, লেবুজলটা আগে খেয়ে নিন।

সভয়ে গ্লাসটার দিকে চেয়ে থেকে ধ্রুব বলে, খেলে কিছু হবে না তো!

বললাম তো, জানি না। শুনেছি।

আরে, শুনেছি তো আমিও। কখনো টাচ করিনি।

করে দেখুন।

ধ্রুব গ্লাসটা তুলল। অল্প অল্প করে কয়েকটা চুমুক দিয়ে বলল, খুব খারাপ লাগছে না।

তাহলে খেয়ে নিন।

ধ্রুব খেয়ে নিল। একটা মস্ত ঢেঁকুর তোলার পর একটু স্বস্তি বোধ করতে লাগল। লিকারের কাপ মুখে তুলে বলল, রেমির অপারেশন কটায়?

আটটা। এখনো দেড় ঘণ্টা দেরী আছে।

ততক্ষণ আমি কোথাও একটু শুয়ে থাকতে চাই।

বাড়ি চলে যান না। টেক এ ন্যাপ।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, না। কারো গাড়িটাড়ি নেই? ব্যাকসিটে একটু পড়ে থাকা যেত।

না। গাড়ি সব চলে গেছে। তবে আবার আসবে।

তবে থাক।

কাল রাতে আপনি কিছুক্ষণ ফুটপাথেও শুয়ে ছিলেন।

মনে আছে।

জয়ন্ত কিছুক্ষণ অপলক চোখে ধ্রুবকে লক্ষ করে বলল, আমার ধারণা আপনার শরীর সুস্থ নেই। একজন ডাক্তার দেখানো উচিত।

ধ্রুব একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলে, সেটা আমি জানি। আমি আগেকার মতো সুস্থ আর নেই। নিজের ওপর আমার শোধ তোলা হয়ে গেছে। এখন অপেক্ষা।

জয়ন্ত অবাক হয়ে বলে, কথাটার মানে কী?

তুমি বুঝবে না।

নিজের ওপর শোধ তুলছেন কেন? কৃতকর্মের জন্য নাকি?

ধ্রুব মাথা নেড়ে হাসিমুখে বলে, না। একটা ভুলের জন্য।

কিরকম ভুল?

টু বি বর্ন ইন এ রং প্লেস অ্যাণ্ড ইন এ রং টাইম অ্যাণ্ড ইন এ রং ফ্যামিলি।

জয়ন্ত চুপ করে থাকে।

ধ্রুব বলে, কিছু বুঝলে?

আপনার এ ধারণাটাও তো ভুল হতে পারে!

না। কিন্তু সে কথা থাক। চলো একটু মর্নিং ওয়াক করে আসি।

জয়ন্ত একটা হাত তুলে বলে, আমার আর ওয়াকের দরকার নেই। এমনিতেই যথেষ্ট টায়ার্ড।

তাহলে আমি একটু ঘুরে আসি।

আসুন।

ধ্রুব উঠল, ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে শীতের সকালে কবোষ্ণ রোদে হাঁটতে লাগল।

একটা বাঁক ঘুরল সে। মাথাটা দুলছে। মাথাটা হঠাৎ শূন্য লাগছে। ধ্রুব ফেরার চেষ্টা করল। কিন্তু হাঁটুতে জোর পেল না। বুকের মধ্যে একটা অস্থিরতা।

শরীরের একটু অহংকার ছিল ধ্রুবর। কিন্তু সেই চমৎকার দীর্ঘ, একহারা চাবুকের মতো শরীরটাই এখন একটা বোঝার মতো মনে হচ্ছিল।

ধ্রুব হাত বাড়িয়ে বাতাসের হাতল ধরার একটা অক্ষম চেষ্টা করল। তারপর দুমড়ে মুচড়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল কঠিন শানের ফুটপাথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *